হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব-১৯+২০

0
327

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৯]

আকবর সাহেব তরীর বানানো চা খেয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। তরী হাতে ট্রে ধরে অধরে অধর চেপে বাবার দিকে উৎসুক নজরে চেয়ে আছে। চাপা অস্থিরতা তাকে চেপে ধরেছে। আকবর সাহেব বললেন,

–“আগের থেকে চা-টা উন্নত হয়েছে। সত্যি-ই ভালো হয়েছে মা। এশারের পরপর আরেক কাপ বানিয়ে খাওয়াবে কিন্তু!”

তরীর অধর প্রসারিত হলো আকবর সাহেবের মুখে প্রশংসা শুনতে পেরে। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“অবশ্যই বাবা!”

তরী খালি চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। রান্নাঘরের একটি চেয়ারে বসে কামরুন নাহারও তরীর বানানো চা পান করছে। সে আগেই প্রশংসা করে ফেলেছে। তরী মুচকি হেসে বললো,

–“এশারের পরপর আরেক কাপ খেও আম্মা!”

–“না, না। একবারই যথেষ্ট। নয়তো দেখা যাবে রাতে ঘুমানো মুশকিল হয়ে পরবে। তুমি যাও, গিয়ে পড়তে বসো। রান্নাঘর আমি সামলাচ্ছি।”

তরী মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সাবিয়া পড়ার টেবিলেই অমনোযোগী হয়ে বসে আছে। তরী সাবিয়ার দিকে চেয়ে টেবিল থেকে তার নির্ধারিত বই নিলো। অতঃপর বললো,
–“কিসের এত চিন্তা করছিস পড়তে বসে?”

সাবিয়া চমকে উঠে বোনের কথা শুনে। আমতা আমতা করে বললো,
–“কিছু না তো!”
–“কিন্তু তোর অভিব্যক্তি আমাকে অন্যকিছু বলছে। সত্যি করে বল সাবিয়া। আমার থেকে কী লুকাচ্ছিস?”

সাবিয়া ঘাবড়ে গেলো। প্রথমে বলতে চাইলো না। কিন্তু তরীর চোখ রাঙানো দেখে বলতে বাধ্য হয়। বললো,
–“আব্বার সাথে আজ একজন লোক দেখা করেছে। আমার সামনেই। খুব সম্ভবত উনি রফিক চাচা। আব্বার কোনো এক বন্ধু। উনি আব্বাকে জিজ্ঞেস করে বলে বড়ো মেয়েকে বিয়ে কবে দিবেন? বয়স পেরিয়ে যেতে দিচ্ছেন কেন? এটা তো অনুচিত! আব্বা তখন তাকে হেসে জানিয়েছিলো মাবুদ যখন হুকুম করবেন তখনই বিয়ে দিবে। তবে তার আগে সুপাত্র তো পেতে হবে!”

সাবিয়া থামে। তরী ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে সাবিয়ার পানে। এই ব্যাপারটা তো পড়ার টেবিলে বসে চিন্তা করার কথা নয়। তরী লহু কন্ঠে বললো,
–“কত মানুষ তো কত কথাই আব্বাকে বলে। তুই এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছিস কেন?”

–“এই লোক মোটেও সুবিধার নয় আপু। না জানি কবে কী বলে আমাদের আব্বার কান ভারী করে ফেলে। আমার খুব ভয় হয় আপু। আমি চাই না তোমার বিয়ে হোক।”

তরী ফিক করে হেসে দেয়। কিছুদিন পর এসএসসি পরীক্ষা অথচ এই মেয়ে তরীর বিয়ে নিয়ে পরে আছে। তাও তরী সাবিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

–“আব্বা আগেই বলেছে আমার পড়াশোনা শেষে বিয়ের চিন্তা করবে। তুই এত উতলা হোস না। তোকে ছেড়ে আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। পাগলী বোন আমার!”

————-
সিদাত চোখ-মুখ কুচকে তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে। সিদাতের মায়ের চোখ যেন হাসছে। এটাই সিদাত সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে মা তাকে ব্যঙ্গ করছে, উপহাস করছে। সিদাত অভিমানী গলায় বললো,

–“এটা একদম ঠিক হচ্ছে না মা। তুমি আর অনয় মিলে আমার দুর্দিনে শুধু হেসেই যাচ্ছো। আমি কী জেনে বুঝে পরেছি নাকি? মনটা হঠাৎ খাঁচা খুলে পালালো। সেই মন পালিয়ে অন্য কোথাও না গিয়ে তরীর কাছেই কেন গেলো?”

জয়া পলক ফেললো। অর্থাৎ এটাই হওয়ার ছিলো। তার চোখ-মুখ অন্য দিনের তুলনায় চিকচিক করছে বেশি। এদিকে সিদাতের অস্থির লাগছে। মায়ের মজা নেওয়া একদম সহ্য হচ্ছে না তার। সিদাত উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা জেদ করে বললো,
–“আমি আমার মন ঠিকই ফিরিয়ে আনবো মা। দেখে নিও! এখন আমি অফিস যাচ্ছি।”

বলেই সিদাত হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। জয়া তখনো ছাদের দিকে শূন্য নজরে আছে। তার চোখ-মুখ জুড়ে তৃপ্তি। ছোটো ছেলেটাকে যেন উপরওয়ালা দারুণ কাউকে মিলিয়ে দিলেন। সিদাতের জন্যে চিন্তা কিছুটা কমে এলো তার। ভালো লাগছে, শান্তি লাগছে তার।

দিয়া আজ ক্লাসে যেতে ইচ্ছুক। এজন্যে একমনে টেবিলে বিচরণ করা তার বই সমূহের দিকে চেয়ে আছে সে। সাইফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। আড়চোখে স্ত্রীকেও খেয়াল করছে। এখন জরুরি এক মিটিং আছে তার। সে তাড়াহুড়ো না করে বরঞ্চ ধীরে সুস্থে রেডি হচ্ছে। সাইফ পারফিউম দিতে দিতে বললো,

–“কী ব্যাপার দিয়া? এভাবে বসে আছো যে?”

দিয়া ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–“আমি আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করতে চাইছি!”

–“তো যাবে। সমস্যা নেই তো। আজকে গেলে রেডি হয়ে নাও!”

দিয়া খুব খুশি হলো সাইফের কথা শুনে। দিয়া একটি চওড়া হাসি দিয়ে বললো,
–“আচ্ছা।”

সাইফ দিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“এখন থেকে বাইরে গেলে তুমি বোরকা পরার অভ্যাস করবে দিয়া। আলমারিতে কয়েকটা আনিয়ে রেখেছি। যেটা ইচ্ছে পরতে পারো। আমার কথা মানতে কী কোনো অসুবিধা হবে?”

সাইফ ঘুরে তাকালো দিয়ার উত্তরের অপেক্ষায়। দিয়া কিছু না বলে আলমারি খুলে একটি বোরকা হাতে নিলো। সাইফ দিয়ার নীরব সম্মতি বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। বিছানায় গা এলিয়ে বসে সাইফ বললো,
–“রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।”

—————
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আকাশ জুড়ে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ ভাসমান। অন্যান্য দিনের চাইতে আজ গরমের উত্তাপ কিছুটা কম। মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিয়ে তার সোনালী নরম রোদ ছড়াচ্ছে আজ। যেন বৃষ্টি নামবে ভাব। এই এত সুন্দর একটি দিনে তরীর মামা রাজিব এসে হাজির হন। হাতে তার বিয়ের কার্ড। অধর জুড়ে চওড়া হাসি।

আকবর সাহেব পত্রিকা ছেড়ে রাজিবের সাথে কথা-বার্তা বলছেন। কামরুন নাহার ব্যস্ত হাতে রান্না করছে ভাইয়ের জন্যে। অনেক জোরাজুরির পর ভাইকে অন্তত দুপুরে খাওয়ার জন্যে রাজি করিয়েছে। তরী টুকটাক সাহায্য করছে মাকে। মামার সাথে একটু আগেই তরী দেখা করে, কথা বলে এসেছে।

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসলো। মামা খেতে খেতে জানালো মৌসুমীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে ঢাকাতেই থাকে। ভালো চাকরি-বাকরি আছে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এবং ওয়ারীতে নাকি একটি করে বাড়ী আছে। পরিবারও ভালো, ভদ্র। এক কাছের জনের মাধ্যমেই এই পাত্রের সন্ধান পায় সে। আকবর সাহেব সব শুনে খুশি হলেন। এ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা চললো।

সাবিয়া তো ভেতরে ভেতরে খুব খুশি। মৌসুমীর বিয়ে হবে। এর মানে হচ্ছে শহুরে পরিবেশ ছেড়ে সুদূর জামালপুরের গ্রামাঞ্চলে যাবে। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। তার ওপর তো বিয়ে বাড়ির মজাই আলাদা। নিজে আনন্দ করতে না পারলেও অন্যদের আনন্দ দেখে তো অন্তত শান্তি পাবে, তাই না? যা হয়েছে ভালোই হলো। রাজিব সকলকে অত্যন্ত অনুরোধ করে বললো যাতে সোমবারের মধ্যেই তারা চলে আসে জামালপুর। এতে রাজিব সহ তাদের সবার খুব ভালো লাগবে। একসাথে বিয়ের আয়োজন করবে সবাই। আকবর সাহেব হাসি-মুখে বলেছে সে চেষ্টা করবে।

——-
–“স্যার। আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। বললো আপনার পরিচিত। আমি বললাম আপনি ব্যস্ত কিন্তু সেও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই সেখান থেকে সরবে না। ঠিকই ঘন্টাখানেক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে কল দিলাম!”

সাইদ সাহেব নীরবে সব শুনে বললো,
–“নাম তো জিজ্ঞেস করেছ নিশ্চয়ই?”
দারোয়াম জিভে কামড় দিয়ে বললো,

–“স্যরি স্যার। এত কিছু বললাম অথচ নামটাই বলিনি। লোকটির নাম রাজিব। বললো জামালপুর থেকে এসেছে। হাতে বিয়ের কার্ডও আছে বোধহয়!”

অদ্ভুত ভাবে সাঈদ সাহেব যেন তাকে চিনতে পারলো। বললো,
–“তাকে ভেতরে আসতে দাও। এবং বাগানে বসতে বলো।”

দারোয়ান থতমত খেয়ে বললো, “জি, আচ্ছা স্যার।”
দারোয়ান বুঝতেই পারছে না সুদূর জামালপুরের লোকের সাথে সাঈদ সাহেবের কী সম্পর্ক? তাকে তো কোনোক্রমেই সাঈদ সাহেবের নিকটাত্মীয় লাগছে না। তাহলে? দারোয়ান ব্যাপারটাকে বেশি না ঘেটে গেটের দিকে পা বাড়ালো।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২০]

চলন্ত ট্রেনে সিদাত তার সামনের সিটে তরীকে দেখে হতভম্ভ হয়ে গিয়েছে। তরীও একই ভাবে অবাক। যদিও সিদাত সর্বপ্রথম খেয়াল করেনি। তবে তরী প্রথমে এসেই দেখেছে। সিদাত যদি জানতো এমন অনাকাঙ্খিত ভাবে তরীর সাথে দেখা হয়ে যাবে তবে সে কখনোই জামালপুরের ট্রেন ধরতো না। বাসে করেই যেত। কিন্তু ট্রেন জার্নিতে একটু আয়েশ করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে সিদাত নিজেও ট্রেন ভ্রমণ পছন্দ করে। এজন্যই ট্রেনে আসা। নানান লোকের সাথে ট্রেনে করে কোথাও যেতে দারুণ মজা।

সিদাত বাবার এক ঘনিষ্ঠ জনের মেয়ের বিয়েতে যাচ্ছে। ভদ্রলোক এতই অনুরোধ করলো সাঈদ সাহেবকে যে না করতে পারেনি। তবে সাঈদ সাহেবও এই মুহূর্তে ভীষণ ব্যস্ত। এজন্য সিদাত সিদ্ধান্ত নেয় সে একা যাবে জামালপুর। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ দুটো। এক, অনেকদিন ধরে কোথাও ট্যুর দেওয়া হয় না এবং দুই, তরীকে ভুলার প্রচেষ্টায়।

নয়তো আজকাল সে অমনোযোগী, অস্থির হয়ে আছে। বারবার ইচ্ছে করে তরীর কাছে ছুটে আসতে। এজন্য নিজেকে এর মাঝ থেকে ছুটিয়ে আনতে চাচ্ছিলো। কিন্তু উপরওয়ালার পরিকল্পনা যেন সিদাতের উপকূলে ছিলো। ঘুরে ফিরে সেই তরীর সামনেই তাকে পরতে হলো। পৃথিবী গোল তা জানা ছিলো। তাই বলে এতটাই গোল যে একজনের সামনে না চাইতেও বারবার এসে পরছে।

তরী শক্ত হয়ে বসে আড়চোখে সিদাতকে পরখ করছে। সিদাতের পাশেই আকবর সাহেব বসেছে। আর তরী, সাবিয়া এবং তার মা একসাথে বসেছে। আকবর সাহেব চেয়েছিলো কেবিন টিকেট নিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেরী করে আসায় কেবিন টিকেট শেষ হয়ে যায়। যার দরুণ এভাবেই তাদের যেতে হচ্ছে।

সাবিয়া সিদাতকে দেখে ভয় পেয়ে বসে আছে। তার ছোটো মস্তিষ্কের ধারণা সিদাত তাদের পিছু নিচ্ছে। গল্পতে নায়করা নায়িকাদের পিছে পিছে কত জায়গায় যায়। সাবিয়া তরীকেই নায়িকা ধরে বসে রইলো, অর্থাৎ সিদাত তরীর পিছু নিচ্ছে। সে কখনোই এই ধরণের গল্প শুনেনি। কিন্তু তার মাদ্রাসায় একজন সহপাঠী ছিলো। প্রচুর প্রেম কাহিনী বলতো। সাবিয়া লজ্জায়, অস্বস্থিতে অন্যপাশে গিয়ে বসে থাকতো। কিন্তু তাও সেই মেয়েটার কথা-বার্তা তার কানে আসতো। সেই থেকেই সাবিয়া এসব ব্যাপারে ধারণা করতে পারে।

অবশ্য সাবিয়ার মতো তরীর এত মাথা ব্যথা নেই সিদাতকে নিয়ে। তবে এটা পুরোপুরি সত্যও নয়। সিদাত আগে যেসব কান্ড করেছে তাতে এসব ভাবনা মাথায় আসা স্বাভাবিক। এজন্য সে আড়চোখে বারংবার সিদাতকে পরখ করে নিলো। তবে তার অভিব্যক্তি দেখে তরীর ধারণা ভুল প্রমাণ হচ্ছে যেন। সিদাত নজর লুকানোর চেষ্টা করছে। বাইরের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। তরী বাইরে চাইলো। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখার নেই। তাহলে এভাবে শক্ত চোখে কী এমন দেখছে সিদাত? সিদাত এবং তরী উভয়েই জানালার ধারে বসেছে। তবে তরী নিশ্চিত হলো সিদাত নজর লুকাচ্ছে। কিন্তু কেন? সিদাতকে যতদূর চিনেছে সে মোটেও নজর লুকানোর মানুষ নয়। উলটো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেওয়ার মানুষ সে। বেশি কথা বলার পুরানো অভ্যাস তো আছেই। কিন্তু সিদাতের চরিত্র আজ বোধহয় খুব কম সময়েই বদলে গিয়েছে।

সিদাতের ভাবতেই অবাক লাগছে আকবর সাহেব তার পাশে বসে আছে। তাকে দেখে অনয়ের কথাগুলো কানে মাইকের মতো এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। এজন্যে না চাইতেও সিদাত তার কানের ব্লুটুথ খুলে হাতে রেখেছে। মোবাইলটাও হাতে। কেন যেন গান শুনতে ইচ্ছে করছে না তার। সিদাত ব্লুটুথ কান থেকে সরাতেই পাশ থেকে গুণগুণ শুনতে পারছে। আকবর সাহেব বিড়বিড় করে জিকির করছে। সিদাতের দিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধও করছে না। সে একবার চোখ বুজছে, তো আবার সতর্ক দৃষ্টিতে তার পরিবারের দিকে নজর বুলাচ্ছে।

সিদাতের গুণগুণ জিকির ভালোই লাগলো। তবে তার নিজের অজান্তেই কেমন ভয় অনুভব করলো। সে কী করে এই ভদ্রলোককে পটাবে? পটানোর মতো কোনো গুণ কী তার মধ্যে আছে? পরমুহূর্তেই সিদাতের বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়লো। সে বোধহয় বেশি বেশি ভাবছে। নিজ মনে নিজেকে বকে আবারও বাইরে তাকালো সে। তরীকে দেখতে ইচ্ছে করলো তার। নিজের অজান্তেই আড়চোখে তরীর দিকে চাইলো। কয়েক সেকেন্ডেই আবার নজর সরিয়ে বাইরে স্থির করলো।

সাবিয়া তরীকে খোঁচালো। তরী চমকে সাবিয়ার দিকে চাইতেই সাবিয়া খুব চাপা স্বরে বললো,
–“সিদাত ভাইয়া কী আমাদের পিছু নিচ্ছে আপু?”

তরী হকচকানো ভঙ্গিতে বললো,
–“আমার পিছু কেন নিবে? মাথা গেছে? এত ভাবিস না!”

তরীর কথা শুনে সাবিয়া তার ভাবনা ছেড়ে দিতে পারলো না। ভাবনা যেন ধৈ ধৈ করে বাড়লো। তবে এ প্রসঙ্গে তরীকে কিছু বললো না। না জানি সে আবার বকা খেতে পারে।

রাত দুইটায় জামালপুরের এক স্টেশনে ট্রেন এসে থামলো। একে একে ওরা নামলো। স্টেশনে ছিলো তরীর খালাতো ভাই মিরাজ। মিরাজকে ওরা দেখেই এগিয়ে গেলো। মিরাজ আকবর সাহেবকে দেখতেই সালাম দিলো। আকবর সাহেব মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে কুশল বিনিময় করে। মিরাজ হেসে বলে,
–“আঙ্কেল, আরেকটু অপেক্ষা করুন। আরেকজন মেহমান আছে। তাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবো।”

বলেই মিরাজ সিদাতকে কল দিলো। মেহমানের কথা শুনেই তরীর চট করে মাথায় এলো সিদাতের কথা। আপাতত তার মামার মেহমান হিসেবে সিদাট ছাড়া কাউকেই মাথায় আসছে না। তরীর ভেতরটা নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠলো।

তরীর ধারণা আসলেই সত্য প্রমাণিত হলো৷ সিদাত-ই আরেকজন মেহমান। এরপর আর কী করার, সিদাতের সঙ্গেই ওরা স্টেশন থেকে বের হলো। মিরাজ একটি অটো নিয়ে এসেছিলো। ভেতরে তরীরা এবং সামনে চালকের সঙ্গে সিদাত এবং মিরাজ বসলো। সিদাতের কাঁধের ব্যাগটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই আকবর সাহেবের কাছে দিয়েছে। কারণ ব্যাগ নিয়ে সামনে বসা একটু কষ্টসাধ্য। মিরাজের মুখে শুনেছে সামনে নাকি একটু ভাঙা রাস্তাও রয়েছে। এজন্য আকবর সাহেব নিজেই বলেছে সিদাত চাইলে তার ব্যাগ আকবর সাহেবের কাছে দিতে পারে।

চলার পথে আকবর সাহেব নিজেই সিদাতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। জেনেছে সিদাত রেডিও অফিসে আরজে হিসেবে আছে। এর মাঝে মিরাজের থেকে শুনেছে সংসদ সদস্য সাঈদ সাহেবের ছোটো ছেলে সিদাত। আকবর সাহেব সে-কথা শুনে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়েছিলেন। সিদাত তখন নীরব ছিলো। বেশি একটা কথা বলছে না সিদাত। মনে হচ্ছে মুখ খুললেই এমন কিছু বলে বসবে যা আকবর সাহেব অপছন্দ করবেন। এজন্যে খুব মেপে মেপে কথা খরচ করছে সে।

তরী পুরো পথেই নীরব শ্রোতা ছিলো। অটোতে উঠেই সাবিয়া তরীর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে। এজন্যে এসব কিছুই সাবিয়া শুনেনি। কামরুন নাহারও ঘুমে কিছুটা ঢুলছে। নিস্তব্ধ, হিম শীতল পরিবেশ। দমকা ঠান্ডা হাওয়া সকলের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই ঠান্ডা পরিবেশে ঘুম আসাটা স্বাভাবিক। তরীর মামা বাড়ি কিছুটা গ্রামাঞ্চলেই পরেছে। তবে তাদের গ্রামের পরিবেশ উন্নত। শুধু মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক সমস্যা দেয় এই যা!

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তারা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো। রাজিব সাহেব আগে থেকেই ওদের অপেক্ষা করছে। তার স্ত্রীও ঘুম ঘুম চোখে অপেক্ষা করছিলো।

সকলে ভেতরে আসতেই বাড়ির কাজের মেয়েটা তড়িঘড়ি করে শরবত নিয়ে আসলো। সাবিয়া বা তরীর কারোই এই রাতে শরবত খেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু মুখের উপর না করা যাবে না। এজন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সোফার রুমে গিয়ে বসলো। ওদের সোফার রুমে গিয়ে বসতে দেখে সিদাতের মনে হলো তারও খাওয়া উচিত। তবে সে সোফার রুমে প্রবেশ না করে কাজের মেয়েটার থেকে এক গ্লাস শরবত নিয়ে আশেপাশেরই এক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে খেয়ে নিলো পুরোটা। খাওয়া শেষে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে রাজিব সাহেবকে খুঁজলো। রাজিব সাহেব আসতেই মুচকি হাসলো। বললো,
–“জানতাম, সাঈদ ভাই আমাকে নিরাশ করবে না। পথে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

সিদাত ক্লান্তি মাখা হাসি দিলো। সে তো ভাবতেই পারেনি রাজিব সাহেব তরীর আপন মামা হবে। তবে সিদাত তার বিস্ময় ভাব চেপে বললো,
–“না। কোনো সমস্যা হয়নি। আমি কোন রুমে থাকবো তা একটু দেখিয়ে দিবেন আঙ্কেল? বড্ড ক্লান্ত আমি!”

রাজিব সাহেব যেখানে থাকছে এই বাড়িটা মোটামুটি বেশ বড়োসড়ো দো’তলা বাড়ি। যেহেতু তারা যৌথ পরিবার সেহেতু এই বাড়িটায় তারা আরামেই থাকছে। নিজস্ব কোনো রুম নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা করা লাগে না।

রাজিব সিদাতের কথা শুনে নিজ দায়িত্বে সিদাতকে নিয়ে তার রুম দেখিয়ে দিলো। সিদাত মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানাতেই রাজিব সাহেব চলে যায়। কিছুক্ষণ সিদাত সিলিং-এর নিচে বিছানায় বসে রইলো। মনে হচ্ছে ঘামে জর্জরিত তার শার্ট। মিনিট পাঁচেক বসে থেকে শার্ট বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই রুমে লাগোয়া কোনো বাথরুম নেই। কোন দিকে বাথরুম সিদাত তাও জানে না। এজন্য রুমেই চারিপাশে নজর বুলাতে বুলাতে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো।

ঘুমে ঢুলুঢুলু সাবিয়াকে নিয়ে তরী ভুলবশত সিদাতের রুমে ঢুকে পরে। সেই মুহূর্তে তরীরও ঘুমে কোনো খেয়াল ছিলো না। সিদাতের ঘরের লাইট জ্বালানো দেখে তরী ভেবেছিলো এটা মৌসুমীর রুম। এজন্যে সে কোনো দিক না তাকিয়েই ঢুকে পরেছিলো। কিন্তু ভেতরে সিদাতকে অর্ধেক শার্ট খোলা অবস্থায় দেখে তরীর চোখে কোটর থেকে উপচে বেরিয়ে আসার উপক্রম। চাপা স্বরে “আল্লাহ্” বলে দ্রুত পিছে ফিরে গেলো সাবিয়াকে নিয়ে। সাবিয়া ঘুমের ঘোরে থাকায় সিদাতকে এই অবস্থায় দেখতে পায়নি। ঘটনার দ্রুততার ফলে সিদাত নিজেও অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তরী তৎক্ষনাৎ রুম ত্যাগ করে।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মিরাজের মুখোমুখি হলো। মিরাজ তরীর অস্থির চোখ জোড়া দেখে ভ্রু কুচকালো। বললো,
–“কিছু হয়েছে?”
–“মৌসুমী আপুর রুম কী বদলেছে?”
–“না তো। তোদের রুম তো এদিকে। তোরা ওদিকে কী মৌসুমীর ঘরে গিয়েছিলি?”

তরী পিছে ফিরে তাকালো। যে রুমে ভুলবশত ঢুকে পরেছিলো ওই রুম আপাতত বন্ধ। সেই রুমের সাথে আরও দুইটা দরজা। অন্ধকারে ঠাওর হলো না কোনটা মৌসুমীর রুম। তরী চাপা স্বরে বললো, “হুঁ!”
–“কালকেই দেখা করিশ। এটা তোদের ঘর। আজকের জন্যে মামা আলাদা ঘর দিয়েছে তোদের জন্য। আর আমি থাকবো আরজে’র সাথে!”
বলেই মিরাজ চাপা হাসি দিলো। সে খুব উল্লাসে আছে সিদাতকে দেখে।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]