মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৫২+৫৩

0
1018

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_52

রাতের নিকষ কালো আঁধারকে ছাপিয়ে ছুটে চলছে একজোড়া দম্পতি। আরজু পরম আবেশে ঝাপটে ধরে আছে তার নেতা সাহেবকে।বুকে কেমন ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে।এই শব্দ নেতা সাহেব শুনলে লজ্জায় আরজু তাকাতে পারবে না।নেতা সাহেবের পুরুষালি সুগন্ধি আরজুর বেহায়া মনকে বার বার বেসামাল করে তুলছে।শুভর বাইকে আরজু বহুবার উঠেছে।কই এমন অনুভূতি তো কখনোই হয়নি?আরজুর কাছে এই মানুষটা আস্ত একটা মাদকতা।আরজু চিরদিন এই মাদকতার নেশায় ডুবে থাকতে চায়।এই নেশার ঘোর যেনো কখনোই না কাটে।

কিছুক্ষণ আগে যখন নেতা সাহেব রেডি হয়ে আরজুর সামনে এসেছিলো আরজুর তখন টালমাটাল অবস্থা।সর্বদা সাদা পাঞ্জাবি পরা নেতাকে হঠাৎ ব্ল্যাক টিশার্টের উপর ব্ল্যাক জ্যাকেট আর ডেনিম প্যান্টে দেখে আরজু শিউরে উঠেছিলো।কোনো পুরুষ কি এতো আকর্ষণীয় হতে পারে?একজন নেতাকে অন্তত এতো আকর্ষণীয় হতে দেখেনি।এই নেতা সাহেব তাকে রীতিমতো সিডিউস করছে।আরজুকে বেহায়া হতে উৎসাহিত করছে।আরজু যদি এই মুহূর্তে নেতা সাহেবের উপর ঝাপিয়ে পড়ে চুমুর বর্ষণ শুরু করে তবে তার কোনো দোষ নেই।সব দোষ এই নেতার।

নাহিদ আরজুকে আড়চোখে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।ডেনিম প্যান্ট আর হোয়াইট টিপস।উপরে ডেনিম জ্যাকেটে আরজুকে ড্যাম স্মার্ট লাগছে।এই মেয়েটা শুধু রূপবতী তা না,নিজেকে কি করে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হয় ভালো করেই জানে।তার বউ যে বেশ ফ্যাশন সচেতন সেটা নাহিদের আগে থেকেই জানা।মাঝে মাঝে নাহিদের ইচ্ছে হয় আরজুকে এই চার দেয়ালের মাঝে লুকিয়ে রাখতে।তার প্রিয়তমাকে আর কেউ না দেখুক। শুধু সে দেখবে এই সৌন্দর্য্য।কিন্তু সে এই উড়ন্ত পাখিটাকে নিজের খাচায় বন্দী করে রাখতে চায়না।নাহলে তার প্রিয় পাখিটা মূর্ছা যাবে।প্রানবন্ত,প্রাণোচ্ছল এই পাখি দিন শেষে তার বুকের খাঁচায় এসে ধরা দিলেই চলবে।আর কিছু চায়না সে।

দুজনেই তৈরি হয়ে নিচে গ্যারেজে আসতেই আরজু আরো চমকে গেলো।সেখানে চারটা বাইক দাড়িয়ে আছে।আরজু হা হয়ে তাকিয়ে থেকে বিস্ময় নিয়ে বললো

-” এই গ্যারেজে এতো বাইক ছিলো? আমি তো খেয়ালই করিনি।এই বাইক গুলো কার?”

নাহিদ মুচকি হেসে পাশের সেলফ থেকে একটা হেলমেট নিয়ে আরজুর সামনে দাড়ালো।আরজুকে সেটা পরিয়ে দিতে দিতে বললো

-” বাড়িটা যেহেতু তোমার হাসবেন্ডের সো বাইক গুলো অবশ্যই তার।”

আরজু কপাল কুঁচকে সন্দিহান প্রশ্ন করলো
-” আপনি বাইক চালাতে পারেন?”

নাহিদ ডান ভ্রু উচু করে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো
-” কেনো তোমার কি মনে হয়?”

আরজু আমতা আমতা করে বললো
-” আসলে আপনাকে সব সময় গাড়িতে করে চলতে দেখেছি তাই।”

নাহিদ বাইকে উঠে নিজেও হেলমেট পড়তে পড়তে বললো
-” তোমার হাসবেন্ড এক সময় দুর্দান্ত বাইক রাইডার ছিলো।কলেজ লাইফে কতো রেস করেছি হিসেব নেই।বর্তমানে ব্যস্ততার কারণে তেমন চালানো হয়না।তাছাড়া সিকিউরিটি ইস্যু তো আছেই।চাইলেও হুটহাট বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারিনা।উঠে বসো আরজু।”

আরজু বসতেই নাহিদ মিরোর ঠিক করতে করতে বললো
-” ভালো করে ধরে বসো আরজু।আমি তোমার হাসবেন্ড, পরপুরুষ নই।সো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”

আরজু মুচকি হাসলো।মানুষটা তার লজ্জা পাওয়াটাও খেয়াল করেছে।আরজু আলতো করে নাহিদের কাধে হাত রাখলো।নাহিদ মুচকি হেসে মনে মনে বললো

-” ফাইনালি তোমাকে আমার বাইকে তুলতে পারলাম বউ।শুভর বাইকে যখনই তোমাকে দেখতাম মনে হতো,আদো কোনোদিন তোমাকে এই ভাবে আমার বাইকে চড়ানোর সুযোগ হবে কিনা?কিন্তু আল্লাহ সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।”

নিস্তব্দ রাতে দমকা হাওয়াকে ভেদ করে ছুটে চলছে নাহিদ।এই ভাবে আরজুকে নিয়ে ঘুড়ার স্বপ্নটা ফাইনালি পূরণ হচ্ছে।নীরবে অনেকটা পথ চলতে থাকলো বাইকটা।দারুন রোমাঞ্চকর পরিবেশ।দুজনেই এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছে।নাহিদ আরজুকে উদ্দেশে করে বললো

-” আরজু আর ইউ ওকে।কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

আরজু মজার ছলে বললো
-” আপনি যেই স্পিডে চালাচ্ছেন তাতে আর যাই হোক দুর্দান্ত বাইক রাইডার অন্তত মনে হচ্ছে না।রিকশার চাইতেও ধীরে চলছি আমরা।”

নাহিদ কপাল কুঁচকে মিররে তাকালো আরজুর দিকে।যার সেফটির জন্য সে ধীরে বাইক চালাচ্ছে সেই মজা নিচ্ছে।আরজু মেকি হাসলো।নাহিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো আর হেসে বললো

-” ওকে!! শক্ত করে ধরে বসো।তোমাকে তোমার বরের বাইক রাইডের স্কিল দেখাই। টিসু পেপার মতো উড়ে গেলে আমার দোষ নেই।”

বলেই নাহিদ বাইকের স্পীড বাড়াতে লাগলো।আরজু চমকে গেলো আর নাহিদকে ঝাপটে ধরলো।নাহিদ বাইকের স্পীড একশো কিলোমিটার বেগে চালাতে শুরু করলো।আরজুর মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে।এই নেতার ইগোতে আঘাত করায় ইচ্ছে করে এমনটা করছে।আরজুর মনে হচ্ছে হয়তো এক্ষনি এই বাতাসে উড়ে যাবে সে।সাথে তার প্রাণটাও উড়ে যাবে।আরজু মনে মনে বললো আর কোনোদিন এই নেতাকে রাগাতে যাবে না।বেশ কিছুক্ষন হাই স্পীডে বাইক চালিয়ে নাহিদ ধীরে ধীরে স্পীড কমিয়ে দিলো।মনে মনে হাসালো আরজুর ভিত মুখ দেখে। হঠাৎ আরজু পেছন থেকেই নিজের ধারালো নখ নাহিদের ঘাড়ে ডাবিয়ে দিলো।আর রেগে বললো

-” আপনি ইচ্ছে করে এমন করলেন তাই না?আর একটু হলেই আমার প্রাণ পাখিটা উড়ে যেতো।”

নাহিদ দুষ্ট হেসে বললো
-” রাস্তা ঘাটে বাইক চালানোর সময় এই ভাবে খামছি দিয়ে মানুষকে সিডিউস করতে হয়না আরজু। এক্সিডেন্ট হবার ভয় থাকে।বাসায় যাওয়ার পর চাইলে খামছি,কামড় সব দিতে পারো।আমি মাইন্ড করবো না।”

নাহিদের কথায় আরজু ভীষণ লজ্জা পেলো।এই লোককে যতোটা শান্ত আর সভ্য মনে হয়।আসলে মোটেও তেমন না।ভীষণ অসভ্য।
বেশখানিকটা দূরে নীরব নিস্তব্দ একটা জায়গায় বাইক থামালো নাহিদ।আরজু চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা টিনের বন্ধ দোকান ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পেলো না। প্রশ্ন করলো

-” এখানে থামালেন যে?”

নাহিদ বাইক থেকে নেমে গম্ভীর সুরে বললো
-” নিবরাস নাহিদকে ব্লাকমেইল করে তুমি পাড় পাবে ভেবেছো?এই জায়গায় তোমাকে মেরে গুম করে দিলে কাক পক্ষীও টের পাবে না।তাই নিয়ে এসেছি।”

আরজু ভিতো চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।আবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেমন নীরবতা ছেয়ে আছে চারপাশে।আরজুর ভীতো মুখখানা দেখে নাহিদ বেশ মজা পেলো।বুক ফাটা হাসি পেলো।কিন্তু হাসলো না।বরং মুচকি হেসে নিজেকে সামলালো।কিন্তু সেই হাসি বেশি ক্ষন স্থায়ী হলো না।কারণ আরজু হঠাৎ করেই নাহিদের জ্যাকেটের কলার ধরে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।আর টুপ করে নাহিদের অধরে চুমু খেয়ে বসলো।নাহিদ যেনো বরফের নেয় জমে গেলো।আকস্মিক এই হামলার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না।নাহিদ ফ্যালফ্যাল করে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।

আরজু নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করতে ব্যস্ত তখন।যেনো সে কিছুই করেনি।আরজু সিল্কি চুলগুলো গুছাতে লাগল আর বললো
-” আমাকে মারার প্ল্যান করে দেখি নিজেই খুন হয়ে গেছেন নেতা সাহেব।”

এবার আরজু নাহিদের আরো কাছাকাছি দাড়ালো।আরজুর গরম নিঃশ্বাস নাহিদের গলায় আঁচড়ে পড়ছে।নাহিদ খেয়াল করলো তার গলা শুকিয়ে গেছে।এই এক নারী তাকে ভীষণ অপ্রস্তুত আর বেসামাল করতে উস্তাদ।নাহিদকে এই অসহায় অবস্থায় তার অ্যাসিস্টেন্ট আসিফ দেখলে নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতো।কারণ অন্য সকলের চোখে নাহিদ বেশ কঠিন ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ।কিন্তু এই রমণীর সামনে নিতান্তই বেচারা প্রেমিক।

আরজু নাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
-” আপনি কি ভেবেছেন আমি আপনার কথায় ভয় পেয়ে যাবো?আমি কিন্তু অতটাও ভীতু নই যতটা দেখে মনে হয়। তাছাড়া যার চোখে আমি আমার জন্য অস্থিরতা দেখতে পাই,তাকে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।আপনি নিজেও জানেনা আপনার চোখে আমি আমার জন্য কতটা মায়া দেখতে পাই।এই পৃথিবীতে আমি নিজেকে সবচাইতে নিরাপদ ভাবি খালামণি,খালুজান আর শুভর কাছে।তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো,সেদিন সাজেকে আমার বিপদে আপনি যেই ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেটা কেউ করতে পারেনি।সেদিনের পর থেকে আমি নিজেকে সবচাইতে বেশি নিরাপদ মনে করি আপনার কাছে।”

নাহিদ এক দৃষ্টিতে আরজুকে দেখে যাচ্ছে।আরজু নাহিদের হতবম্ব মুখ দেখে মৃদু হাসলো।নাহিদের এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে বললো
-” এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলেন যে?পানি খাবেন?”

নাহিদ হতবম্ব হয়ে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।আরজু ঠোঁট টিপে হেসে আশেপাশে তাকিয়ে বললো
-” এখানে পানির বেবস্থা করা যাবে বলে মনে হয়না।”

নাহিদ এবার খানিকটা স্বাভাবিক হলো।এই মেয়েটাকে যতোটা বোকা ভেবেছে ততটা বোকা মোটেও না।হুটহাট নাহিদকে চমকে অপ্রস্তুত করতে বেশ মজা পায় এই মেয়ে।নাহিদ গলা ঝেড়ে সামনের দিকে একটু তাকালো।তারপর আরজুর হাতে নিজের হাত মিলিয়ে সামনে আগাতে লাগলো।আরজু মুচকি হেসে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।জারা কে একটা ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন।নেতা সাহেবকে কাবু করার এই অভিনব কৌশল অবলম্বনের সাজেশন দেওয়ার জন্য।জারার এই কৌশল একটু পাগলাটে হলেও কার্যকর।

নাহিদ সামনের বন্ধ একটা দোকানে কয়েকটা টোকা দিলো।ভেতর থেকে একজন লোক দোকানের সাটার খুলে দিয়ে নাহিদকে দেখে হাসি মুখে সালাম দিলো।নাহিদ সালামের জবাব দিয়ে আরজুকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।আরজু অবাক হয়ে সবটাই দেখছিলো।তাদের আসার খবর যেনো এই লোকটা আগে থেকেই জানে।ভেতরে প্রবেশ করে আরজু আরো অবাক হলো।কারণ দোকানটি একটা ফুচকার দোকান।আরজু অবাক হয়ে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো

-” তোমাকে নিয়ে দিনের আলোয় রাস্তায় দাড়িয়ে ফুচকা খাওয়া সম্ভব না হলেও রাতের আধারে সেটা করাই যেতে পারে।কি বলো?”

আরজুর খুশিতে কেঁদে দিতে ইচ্ছে করলো।নেতা সাহেব তার ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো এতটা প্রায়োরিটি দিয়েছে এটাই তার জন্য অনেক কিছু।নাহিদ সামনের লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” মামা আমার বউ যেই কয় প্লেট ফুচকা খেতে চায় দিন।ভালো করে বানাবেন কিন্তু।”

“আমার বউ” এই শব্দটা আরজুকে কতটা অনুভূতির সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আরজু নিজেও জানে না।আরজুর চোখ মুহূর্তেই ভিজে উঠলো।নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে চোখ কুচকে ফেললো।আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“ঝাল খাওয়ার আগেই চোখে পানি চলে আসলো? আদো ঝাল খেতে পারবে তো?”

আরজু ফিক করে হেসে উঠলো।নাহিদ আরজুর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।যেই ধরার মাঝে ছিলো বিশ্বস্ততা,ভালোবাসা।

নাহিদকে এতো ঝাল ফুচকা এতো তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে আরজু বেশ অবাক হলো।আর বললো

-” আমি প্রথম কোনো ছেলেকে এতো তৃপ্তি নিয়ে ফুচকা খেতে দেখলাম।”

নাহিদ আরেকটা ফুচকা মুখে পুরে নিলো।আর খেতে খেতে বললো
-” ফুচকা শুধু মেয়েদের পছন্দের খাবার হবে এমন কোনো রূলস আছে নাকি?স্কুল লাইফ থেকেই বন্ধুরা মিলে কতো ফুচকা কম্পিটিশন করেছি।আমাদের স্কুলের সামনের মামা দুর্দান্ত ফুচকা বানাতো।ছেলে মেয়ে সবাই তখন ভিড় জমাতো।উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতে আমি পছন্দ করতাম।টঙের দোকানের চা থেকে শুরু করে ফুচকা সবটাই আমি ট্রাই করেছি।জনগণের সেবা করার উদ্দেশ্যে রাজনীতির মাঠে নামার আগে জনসাধারণের সাথে না মিসলে তাদের সমস্যা বুজবো কি করে?তাদের জন্য কিছু করতে হলে তাদের একজন হয়ে চলতে হবে।”

আরজু যতো মানুষটাকে দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে।এই মানুষটাকে একটু একটু করে এক্সপ্লোর করতে আরজুর বেশ লাগছে।এই মানুষটার সাথে না মিশলে আরজু কখনোই একজন প্রভাবশালী নেতার মাঝেও এতটা সিম্প্লিসিটি থাকতে পারে জানতেই পারতো না।এই মানুষটার জীবনের একটা অংশ হতে পেরে নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
____________
অফিসের কাজে ভীষন ব্যস্ত সময় পার করছে নিশান।এই ব্যাস্ততার মাঝে যখন তার ফোন বাজতে থাকলো নিশান এতে বেশ বিরক্ত হলো।কিন্তু আননোন নাম্বার থেকে বারবার কল আসায় সেটা রিসিভ করল। অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর।

-” কখন থেকে কল করছি ধরছেন না কেনো?”

নিশান অবাক হলো।মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলছে যেনো তার বিয়ে করা বউ।নিশান বিরক্ত হয়ে বললো
-” কে বলছেন?”

-” আরে বার বার আমাকে ভুলে যান নাকি?নিজের বউকে চেনে না এমন নির্বোধ লোক আমি প্রথম দেখছি।”

নিশান বিরক্ত হয়ে বললো
-” আপনি আবার কল করেছেন?”

অবণী মৃদু হেসে বললো
-” আমি করবো না তো কে করবে?”

-” আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করছেন।”

-” আপনার মতো আনরোমান্টিক বর পেয়ে আমার পুরো লাইফ ডিস্টার্ব হয়ে আছে।”

-” আপনি এমন কল করে সবাইকেই নিজের বর বলে দাবি করেন?”

-” মোটেও না।আপনার স্মরণশক্তি খারাপ জানতাম।কিন্তু এতটা খারাপ জানতাম না।আনরোমান্টিক লোক একটা।”

নিশান বেশ রেগে গেলো।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
-” বার বার আনরোমান্টিক লোক বলছেন কেন?”

অবণী ঠোঁট টিপে হেসে বললো
-“আনরোমান্টিক বলবো না তো কি বলবো? আজ পর্যন্ত নিজে থেকে তো একটাও কিস করতে পারলেন না। প্রথম কিসটা আমাকেই করতে হলো।”

নিশান যেনো আকাশ থেকে পড়লো।মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো।বিস্ময় নিয়ে বললো
-” আপনি আমাকে কিস করেছেন?লিসেন!! আমাকে প্রথম কিস শুধু একজনই করেছে।তাও একটা বাচ্চা মেয়ে।”

কথাটা বলেই নিশান থমকে গেলো।অচেনা কাউকে কি বলে ফেললো।নিশান দ্রুত কল কেটে দিলো।বুকের ভেতর আবার অস্থিরতা শুরু হলো।যেই মুহূর্তটা সে বার বার ভুলতে চায় সেটা কেনো বার বার তার মনে পড়ে যায়।মুহূর্তেই অবনির বাচ্ছাসুলোভ মুখখানা নিশানের চোখের সামনে চলে আসলো।নিশান টেবিল থেকে দ্রুত পানির গ্লাস নিয়ে সেটা সাবার করলো।নিশানের অস্থিরতা দেখে তার কলিগ বলে উঠলো

-” নিশান সাহেব ঠিক আছেন? আপনাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে।”

নিশান মৃদু হেসে বললো
-” আই অ্যাম ফাইন।”

তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।নিশান মনের মধ্যে জেগে উঠা অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা।তাকে নিয়ে এমন ভাবনা তাকে মানায় না।
_____________
খাওয়ার পর্ব শেষ করে আরজু আর নাহিদ আবার ছুটে চললো অজানা পথে।নাহিদ আরজুকে বললো
-” কি ম্যাডাম ভালো লাগছে?”

আরজু হেসে বললো
-” ভীষণ।জানেন আমি আর শুভও অনেক সময় এমন রাতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।মজার বিষয় আমরা কখনোই তেমন কোনো প্রবলেমে পড়িনি।খালামণি আমাকে রাতে বের হতে দিতে চাইতো না।তার ভীষণ ভয় আমাকে নিয়ে।কিন্তু আমাকে আটকায় কে?শুভ ঠিক বাইক নিয়ে বাসার সামনে চলে আসতো।আর আমিও কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।”

নাহিদ মুচকি হাসলো।মনে মনে ভাবলো
-” তোমার মতো মায়াবতী রমণী রাতের শহরে এতো সহজে ঘুরে বেড়াতে পারেনা আরজু।হায়নার দলেরা সব জায়গায় উৎ পেতে থাকে।এই নাহিদ তোমাকে সেই রাস্তা করে দিয়েছি বলেই তুমি পেরেছো বউ।”

আরজু যখনই শুভর সাথে রাতে বাইরে বেরিয়েছে ঠিক ততবার নাহিদের লোকজন তাদের পেছনে ছিলো।নাহিদ জানতো তার প্রিয়সির মাথায় যখন তখন এইসব ভূত এসে জড়ো করে।তাই আরজুর বাসার সামনে সর্বদাই নাহিদের লোকেরা পাহারা দিতো।তারা বাইরে বের হলে আরজু আর শুভকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতো।অনেক সময় নাহিদ নিজেও তাদের পেছন পেছন এসেছে।নিজের প্রিয়তমাকে আগলে রাখতে।দূরে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর আইসক্রীম খাওয়া দেখেছে।দুর থেকে আরজুর হাসি মাখা মুখ দেখে সারা দিনের ক্লান্তি দুর করেছে।তখনও চিন্তা করেনি এই মায়াবতীকে নিজের বউ করে পাবে।সে তো আরজুকে দুর থেকেই ভালোবাসতে চেয়েছে।আর মনে মনে ভেবেছে

” যদি ভাগ্যক্রমে কোনোদিন তোমাকে পেয়ে যাই,
তাহলে তুমিই হবে আমার সবচেয়ে বড় উপহার।”

বাইক চালাতে চালাতে নাহিদ দেখলো পেছনে আরো তিনটা বাইক এগিয়ে আসছে।নাহিদ বিচক্ষণ চোখে দেখলো কোনো বিপদের আশঙ্কা আছে কিনা?প্রতিটা বাইকেই দুজন করে ছেলে বসে আছে।বাইকগুলো তাদের পাশাপাশি আসতেই ছেলে গুলো শিস বাজাতে লাগলো।কয়েকজন বাজে ইঙ্গিত করতে লাগলো।কয়েকজন আরজুকে উদ্দেশ্য করে ভীষণ বাজে কথা বলতে লাগলো।নাহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।একটা ছেলে টিস করে বলে উঠলো

-“কি মামা!! কঠিন মা*ল নিয়ে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়াচ্ছো।আমাদেরও একটু ভাগ দেও।”

আরজু নাহিদের জ্যাকেটের কলার খামচে ধরলো।আরজুর চোখ জোড়া ভিজে উঠলো।মানুষ এমন পশুর মত ব্যাবহার কি করে করতে পারে।পেছনে দুর থেকে পুলিশের গাড়ির হালকা সাইরেন শুনতে পেয়ে সেই ছেলেগুলো শিস বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে চলে গেলো।নাহিদ সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।চোখ জোড়া মুহূর্তেই রক্তিম আভা ধারণ করলো।বিপদ আশঙ্কা করে নাহিদ একটা সংকেত বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে তার গার্ডকে।নাহিদ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কোনো সিকিউরিটি নিয়ে বের হয়নি ঠিক।কিন্তু নিজের লোকেশন অন রেখেছে। যাতে তার গার্ডরা সর্বক্ষণ নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে।নাহিদ ভেবেছে হয়তো এরা বিরোধী দলের কেউ।কিন্তু বুঝতে পারলো তেমন কিছু না।বরং এরা রাস্তার লাফাঙ্গা ছেলেপেলে।নাহিদকে বাইকের এক্সেলেরেশন বাড়াতে দেখে আরজু ভয় পেয়ে গেল।শান্ত সরে বললো

-” প্লিজ কোন ঝামেলা করবেন না। যেতে দিন ওদের।”

নাহিদ সামনের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললো
-” ইম্পসিবল।”

নাহিদ স্পীড বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছেলে গুলোকে ওভারটেক করে সামনে রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে পড়লো।নাহিদকে দাড়াতে দেখে ছেলে গুলো নিজেদের বাইক থামিয়ে দিলো।নাহিদকে উদ্দেশ্য করে একটা ছেলে বললো

-” কি মামা!!!! মেয়েটাকে দিয়ে যেতে এসেছো নাকি?”

আড়চোখে আরজুর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো
-” ফিগার টা কিন্তু হেব্বি।চেহারাও নিশ্চই জোস হবে।কি সুন্দরী হেলমেট টা একটু খুলো দেখি।তোমার চাঁদ মুখটা দেখি একটু।”

নাহিদ দ্রুতই বাইক থেকে নেমে দাড়ালো।আরজুকে ধীরে বললো
-” হেলমেট খুলবে না আরজু।”

আরজু ভীষণ ভয় পেয়ে বাইক থেকে নেমে নাহিদের হাত চেপে ধরলো।চোখের ইশারায় কিছু করতে মানা করলো।সামনে থেকে একটা ছেলে হেসে বলে উঠলো
-” আরে আমাদের হিরো মনে হয় ফাইট করতে চাইছে।কিন্তু হিরোইন মানা করছে।”

বলেই সবাই হেসে উঠলো।নাহিদ আরজুর হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।শান্ত স্বরে বাঁকা হেসে বললো
-“বাচ্চাদের সাথে তর্ক করতে আমি মোটেও ইচ্ছুক নই।কিন্তু বাচ্চারা যখন মেনার্স ভুলে যায় তাদের শিক্ষা দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

বাচ্চা বলায় ছেলেগুলো চটে গেলো।রেগে বললো
-” আমাদের শিক্ষা দেওয়ার তুই কে?চিনিস আমরা কে?”

নাহিদ আরেকটু সামনে এগিয়ে একটা ছেলের গালে কষিয়ে একটা থাপ্পর মেরে বললো
-” তোদের বাপ।”

ছেলেটি নাহিদের হাতে কঠিন থাপ্পর খেয়ে সোজা রাস্তায় পড়ে গেলো।মুহূর্তেই মাথা ভো ভো করতে লাগলো।সামনের সবকিছুই কেমন ঝাপসা লাগছে।

থাপ্পড়ের শব্দ নীরব নিস্তব্দ রাস্তায় বার বার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।আরজু ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো।
নাহিদের কাজে অন্য ছেলে গুলো প্রচন্ড রেগে গেলো।আরেকটা ছেলে তেরে আসতে লাগলো আর বললো
-” তোর এতো সাহস।জানিস আমার বাবা কে? তোকে মেরে মুহূর্তেই গুম করে ফেলবে।”

কথাটা বলে সামনে আসতেই নাহিদ আবার আরেকটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।ছেলেটা গালে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো। গাল কেমন জ্বলে যাচ্ছে। নাক দিয়ে গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা লাল তরল নেমে গেলো।অন্য ছেলে গুলো খানিকটা ভরকে গেলো।আরজু হা করে সবটা দেখছে।এই মুহূর্তে তার সামনে দাড়ানো নেতা সাহেবকে মোটেও হিরো না ভিলেন লাগছে।কি ভয়ঙ্কর দৃষ্টি!!

নাহিদ এবার হেলমেটটা খুলে ফেললো।মুহূর্তেই সামনের ছেলে গুলো চমকে উঠলো।তাদের সামনে এই শহরের মেয়র দাড়িয়ে আছে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না।মুহূর্তেই তারা বুঝতে পারলো ভীষণ ভুল করে ফেলেছে।ভুল জায়গায় ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করেছে।যেই বাবার পাওয়ার নিয়ে বড়াই করছে সেই বাবা এই মেয়রের আগে পিছে ঘুরে বেড়ায়।

ছেলেগুলির ভয়ে শরীর কাঁপতে লাগলো। নিবরাস নাহিদ কতটা কঠোর হতে পাড়ে সেটা ছেলেটা বাবার মাধ্যেমে জেনেছে।নাহিদ সামান্য কপাল চুলকে বললো
-” আসতে বল তোর বাপকে।আমিও দেখে শিখি কেমন করে মেরে গুম করে ফেলতে হয়।”

ছেলেগুলো মুহূর্তেই নাহিদের পায়ে পড়ে গেলো।অনুরোধ করে বললো
-” ভাই মাফ করে দেন।আমরা বুঝতে পারিনি।আর কোনোদিন এমন করবো না।”

আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো
-” ভাবী মাফ করে দেন।আমরা বুঝতে পারিনি আপনি আমাদের ভাবী।”

নাহিদ প্রচন্ড রেগে বললো
-” শুধু ওকে না,কোনো মেয়েকেই টিস্ করার কোনো অধিকার তোদের নেই।তোদের মতো লাফাঙ্গা দের জন্য মেয়েরা নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে না।”

ছেলে গুলো বার বার নাহিদের কাছে মাফ চাইতে থাকলো।নাহিদ শান্ত সুরে বললো
-” যার কাছে অপরাধ করেছিস তার কাছে ক্ষমা চা।”

ছেলেগুলো আরজুর সামনে যেয়ে বললো
-” ভাবী মাফ করে দেন।নাহলে ভাই আমাদের ছাড়বে না।”

নাহিদ মাথা দুদিকে নেড়ে বললো
-” উহু!! হচ্ছে না।ভাবী মা বল।”

আরজু হা করে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ছেলে গুলো আরজুর উদ্দেশ্যে বললো
-” ভাবী মা।আপনি আমাদের আম্মা।আমাদের মাফ করে দেন।জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে তাকাবো না।বাজে কথা বলবো না।”

আরজু খানিকটা অসস্তিতে পড়ে গেলো। এতো বড়ো ছেলেরা তাকে কেমন করে আম্মা আম্মা ডাকছে।নাহিদের দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আরজু বললো
-” যেতে দিন।আমি মাফ করে দিয়েছি ওদের।”

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আরজু সামনে না থাকলে ছেলে গুলোকে নাহিদ তার অন্য রূপ দেখাতো।একজনকেও ছারতো না।কিন্তু আরজুর সামনে এমনটা করা ঠিক হবে না।আরজুর মতো কোমল হৃদয়ের মানুষ সেটা নিতে পারবে না।নাহিদ ছেলে গুলোকে ওয়ার্নিং দিয়ে চলে যেতে বললো।ছেলে গুলো চলে যেতেই নাহিদ আরজুর সামনে দাড়ালো।আরজুর হেলমেট খুলে দিলো।মুহূর্তেই একফালি চুল আরজুর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো।নাহিদ পকেট থেকে টিস্যু বের করে আরজুর ঘামে ভেজা কপাল মুছে দিলো।আরজু এক দৃষ্টিতে নাহিদকে দেখে যাচ্ছে।বুকের মাঝে প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।আরজু জানেনা নেতা সাহেব তাকে ভালোবাসে কিনা।কিন্তু মানুষটা তার ভীষণ কেয়ার করে।নাহিদ যত্ন করে আরজুর চুল কানের পিঠে গুজে দিলো।আর ফিসফিসিয়ে বললো

-” একজন নেতার বউকে এতো কোমল হৃদয়ের হতে নেই।তাকে হতে হবে সূর্যের মতো তীক্ষ্ণ আর পাথরের মতো কঠিন।কারণ এমন পরিস্থিতি যে কোনো সময় সৃষ্টি হতে পারে।নিজেকে আরো কঠিন করতে শেখো।”

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_53

কাঠ ফাটা তীব্র রোদের মধ্যে ফুয়াদ ঘামে ভিজে দাড়িয়ে আছে লামিয়াদের বাসার সামনে।গতকাল থেকে লামিয়া কাজে যায়নি।ফুয়াদ কয়েকবার কল করলেও লামিয়া রিসিভ করেনি।ফুয়াদের ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো।মেয়েটা এই শহরে বোনকে নিয়ে একা থাকে।কোনো বিপদ অপদ হয়েছে কিনা কে জানে?অদ্ভুদ ভাবেই এই মেয়েটাকে একদিন না দেখলে ফুয়াদের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। এতো অল্প বয়সেই এই মেয়েটার মধ্যে যেই দায়িত্ববোধ আছে সেটা আজকালকের মেয়েদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না।তার বন্ধুমহলে একমাত্র সাবিহার মধ্যে খানিকটা দায়িত্ববোধ আছে।রিমি তো সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকে।আর বাকি দুজন তো পুরোই পাগলাটে।এক পাগল হুট করে বিয়ে করে বসে আছে।আর অন্য পাগল ব্লগ,শুটিং আর মডেলিং নিয়ে ব্যাস্ত।লামিয়ার মতো এতো ছোট্ট বয়সে এতটা মেচিউর মেয়ে সে একটাও দেখেনি।এই একটা বিষয় ফুয়াদকে বেশ প্রভাবিত করে।তার সকল এক্স গার্লফ্রেন্ড গুলি ছিলো নেকার রানী। ম্যাচুরিটি সাথে দূর দূর পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নাই।

ফুয়াদ লামিয়াদের বাসার ডোর বেল বাজলো।কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল লামিয়ার ছোট বোন লামিসা।ফুয়াদকে দেখে সে চিনতে পাড়লো না।মেয়েটার কপালের সূক্ষ ভাঁজ দেখেই ফুয়াদ বুঝতে পেরেছে সেটা।তাই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো

-“হ্যালো সুইট গার্ল।কেমন আছো?”

লামিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।এতো কিউট একটা ছেলে তাদের বাসায় কেনো আসলো? তাই প্রশ্ন করলো
-” কে আপনি? কাকে চান?”

ফুয়াদ দুষ্ট হেসে বললো
-” আমি জ্বিনের বাদশা।তোমার বোনকে চাই।তাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”

কিশোরী মেয়েটা ফুয়াদের কথা শুনে কিছুক্ষণ হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।মুহূর্তেই মুখ বিকৃত করে চিৎকার দিয়ে উঠলো
-” ওহ আল্লাহ বাঁচাও!!!আমি আপুকে কিছুতেই জ্বিনের সাথে যেতে দিবো না।”

তার পরই মেয়েটা জোরে জোরে দোয়া উচ্চারণ করতে লাগলো
-“আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিওঁ ওয়া আতুবু ইলাইহি; লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।”

মেয়েটার অবস্থা দেখে ফুয়াদ ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো।বাচ্চা মেয়েটা বেশ ভয় পেয়েছে।

লামিয়া বার বার আড়চোখে ফুয়াদের দিকে তাকাচ্ছে।এমন অদ্ভুত মানুষ সে জীবনে দেখেনি।বাড়ির একজন সামান্য রাধুনী দুইদিন কাজে যায়নি বলে কেউ এই ভাবে অস্থির হয়ে খবর নিতে চলে আসে লামিয়ার জানা ছিলো না।এই মানুষটা তার এতো পরওয়া কেনো করে?কই তার আপন চাচা তো করে না।

ভাবনার মাঝেই হঠাৎ উষ্ণ স্পর্শে লামিয়ার সারা শরীর কেঁপে ওঠে।মনে হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।ফুয়াদ আলতো স্পর্শে লামিয়ার কপালে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো

-” সামনে পরীক্ষা আর তুমি জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো?ফাঁকিবাজ মেয়ে একটা।”

লামিয়া আবেশে চোখ বুজে নিলো।আজ বহুদিন পর কেউ এই ভাবে তার খোঁজ নিলো।নাহলে এই দুনিয়াতে কেউ নেই তার অসুস্থতায় খোঁজ নেওয়ার।তবে আরো একজন আছে যে তার খোঁজ নেয়।কিন্তু লামিয়া সেই মানুষটিকে ঘৃনা করে।সে চায়না মানুষটার অস্তিত্ব তার জীবনে পরুক।লামিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুলে বললো

-“তেমন কিছু না।পরীক্ষার আগেই ঠিক হয়ে যাবে।আপনি হঠাৎ এখানে?”

ফুয়াদ তাকালো লামিয়ার দিকে।মেয়েটাকে কি করে বলবে যে সে ভীষণ অস্থিরতায় ভুগছে তাই এসেছে।কিন্তু মুখে বললো
-” আরে তুমি নেই তাই আমি মুখে স্বাদ পাচ্ছি না।আমার বাজে অভ্যাস করে ফেলেছো।তোমার রান্না ছাড়া অন্য কারো রান্না করা খাবার আমার মুখে উঠে না।”

লামিয়া এক দৃষ্টিতে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।আর বললো
-” কাল থেকে আসবো।”

ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো
-” কোনো প্রয়োজন নেই।তুমি আগে সুস্থ হও।আর পরীক্ষার সময় আসার প্রয়োজন নেই।মনোযোগ দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিবে।বুজলে?”

লামিয়া মাথা নিচু করে হে জানালো।আসলে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।মাকে ভীষণ মনে পড়ছে।মা ছোটবেলায় এই ভাবেই তার কেয়ার করতো।ফুয়াদ চলে যেতেই লামিসা বোনকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” এই ভাইয়াদের বাসায় তুমি রান্না করো?কি কিউট দেখতে।কিন্তু লোকটা ভীষণ পাজী।আমাকে কেমন করে ভয় দেখালো।বলে কিনা জ্বিনের বাদশা।”

লামিয়া মুচকি হেসে মনে মনে বললো
-” আসলেই উনি ভীষণ অদ্ভুত।মানুষকে সম্মান দিতে জানে।প্রতিটা নারী মন এমন অদ্ভুদ কাউকেই খুঁজে বেড়ায়।”
_____________

ভ্যাপসা গরমে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ গাছালির ঝাক। কোথাও এক চিলতে হাওয়া নেই।আরজু দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছে তার মনে এই হাওয়ার মত স্বস্তি নেই।সেই কখন থেকে ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাড়িয়ে আছে আরজু।চোখ দুটো এক পলক শুভকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে।ছেলেটার অভিমান আরজুকে সস্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না।কবে শুভ হেসে তাকে “গালফুলি” বলে বিরক্ত করবে?আরজুর চুল টেনে ধমক দিয়ে বলবে “এই ফাজিল মাইয়া একা একা বিয়ে করে নিয়েছিস? এবার মাস ব্যাপী ট্রিট দিবি।তোর নেতার পকেট খালি না করা অব্দি শান্তি পাবো না।”

আরজু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।সেই আগের শুভকে ভীষণ মিস করছে। আট দশজনের মতো তো তাদের বন্ধুত্ব ছিলো না।তাদের বন্ধুত্ব এতো সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে তো শেষ হবার নয়। শুভ আগে কখনোই এতো দিন আরজুর উপর অভিমান করে থাকেনি।তবে এখন কেনো এতো অভিমান নিয়ে বসে আছে? নিজের রাগ আরজুর উপর ঝেড়ে ফেলুক না।দরকার পড়লে আরজুর চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলুক।তবুও এই নীরবতার পরিত্রাণ হোক।

আরজুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো রিমি।কয়দিন যাবত আরজুর সাথে ঠিক মতো কথা হয়না তার।তার কারণ শুভ।রিমি অনেকটা দোটানায় ভুগছে।রিমির অবচেতন মন শুভর এই অবস্থার জন্য আরজুকে দায়ী করে।কিন্তু অন্যদিকে সেদিন যদি আরজুর আর শুভর এনগেজমেন্ট হয়ে যেতো হয়তো রিমি আরো বেশি কষ্ট পেতো।আসলে কোনো পরিস্থিতিই রিমির জন্য সুখকর নয়।কিন্তু রিমি জানে আসলে আরজুর দোষ নেই।এতো দিনে শুভর কাছে থেকে সে যেমন বুঝতে পারেনি শুভর মনের সুপ্ত ভালোবাসার কথা।হয়তো আরজুও তেমন ভাবে বুঝতে পারেনি।রিমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।সে স্পষ্ট এই বন্ধুমহলে ফাটল দেখতে পাচ্ছে।তাদের সকলের সম্পর্ক বদলাতে শুরু করেছে।শুধু একটাই ভয় সবাই যেনো ছিটকে না পড়ে।দিন শেষে যেনো সবাই এক সুতায় গেথে থাকে সেটাই প্রত্যাশা।

রিমি আরজুর দিকে এগিয়ে এসে বললো
-” ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।যাবি না?”

আরজু মলিন চোখে রিমির দিকে তাকালো।রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” ক্লাসে চল।পড়ে শুভ চলে আসবে।”

সারা ক্লাসে আরজু শুভর পথ চেয়ে বসে ছিল।কিন্তু শুভ আসেনি।ক্লাস শেষে ক্লান্ত মন নিয়ে আরজু রিমি আর জারার সাথে ক্যান্টিনে পৌঁছালো।কিন্তু সেখানে পৌঁছে আরজুর মেজাজ খারাপ হলো।শুভ আর ফুয়াদ বসে মনের সুখে সিগারেট টানছে।আরজু মনে মনে ফুয়াদকে গালি হলো দিলো।রিমি আর জারা অবাক হয়ে দুজনকে দেখছে।জারা চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠলো

-” এই ছাগলের দল ক্লাস বাদ দিয়ে ধোওয়া উড়াচ্ছে? এই ফুয়াদ শুভকে খারাপ বানাচ্ছে।কয়দিন ধরে আর নতুন গফ পটাতে না পারার বিরহে এই ফুয়াদ ছাগল দেবদাস দেবদাস ভাব মারতেছে।ধরে লাত্থি মারা দরকার।”

আরজু ভীষণ রেগে দ্রুত টেবিলের সামনে এসে শুভর হাত থেকে সিগারেট টেনে পাশে ছুড়ে মারলো।আকস্মিক কাণ্ডে শুভ অবাক হয়ে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু যেনো রণমূর্তি ধারণ করেছে।আরজুর রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে ফুয়াদ ভয়ে নিজের হাতের সিগারেট লুকিয়ে নিচে ফেলে দিল।
আরজু রেগে বললো

-“এতো অধঃপতন হয়েছে তোর? যেখানে সেখানে নেশা করে বেরাচ্ছিস?”

ফুয়াদ আরজুর কথায় বাম হাত ঢুকিয়ে বললো
-” সরি টু ইন্টারাপ। কিন্তু সিগারেট আর নেশা করা দুইটা আলাদা জিনিস আরজু।এই সাধারণ জিনিসটা জানিসনা?”

আরজু প্রচন্ড রেগে ফুয়াদের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো।আর ফুয়াদ বেচারা ওহ মা!! বলে চিৎকার করে উঠলো।আরজু টেবিলে শুভর ফোন দেখতে পেয়ে সেটা একটা আছাড় মারতে নিলে ফুয়াদ দ্রুত ধরে ফেললো।আর বললো
-” করিস কি? ফোন ভাঙ্ছিস কেনো?এই ফোন কি করল?”

আরজু শুভর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো
-” যেই ফোনে হাজার বার কল দিলেও পাওয়া যায় না সেই ফোন রেখে কি লাভ?”

শুভ ভাবলেশহীন ভাবে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।আরজুর এবার ভীষণ কাদতে ইচ্ছে করছে।শুভর এই নিস্তব্দতা তাকে শেষ করে দিচ্ছে।শুভ রেগে আরজুর চুল টেনে ধরুক না।তাতেও আরজুর যন্ত্রণা কম হতো।মুহূর্তেই এক রাশ অভিমানী অশ্রু আরজুর চোখে হানা দিলো।আরজু কাপা গলায় বলে উঠলো

-” আমি কি তোকে এতটাই বিরক্ত করছি যে আমার নম্বর ব্লক করে রেখেছিস?নাকি তোর লাইফে আমার কোনো এক্সিসটেন্স নেই?এতটাই অসহ্য লাগছে আমাকে?তুই আমার সেই শুভ না,যে আমার হাজারটা ভুলকে মুহূর্তেই মাফ করে দিতো।উল্টো আমার করা দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিতো।আমার চোখের অশ্রু যে মোটেও সহ্য করতে পারতো না।আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্ব কি এতটাই ঠুনকো ছিলো যে তোর অভিমানের কাছে হেরে যাচ্ছে শুভ?আমি সেই মানুষটার প্রতি অবসেসেস্ট সেটা তুই ঠিক বুঝতে পেরেছিলি।কারণ আমার চোখের ভাষা তুই সবার আগে ধরতে পারিস। সেদিনের পর থেকেই ভীষণ ভয় পেতাম।সবাই আমার অনুভূতির মূল্যায়ন করবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না?কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিলো আমার মনের অবস্থা আর কেউ না বুজলেও তুই বুজবি।আমি আর কারো সাপোর্ট না পেলেও তোর সাপোর্ট পাবো।কিন্তু দেখ আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তুই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিস।আমাকে প্রতিনিয়ত ইগনোর করছিস।একবার ভেবে দেখলি না তোর এই অভিমান আমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে?আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার মাথার উপর থেকে বিশ্বস্ততার হাত সরিয়ে নিয়েছে।যেই হাত আমি পেয়েছিলাম তখন, যখন নিজের সব হারিয়ে এতিম হয়ে পড়েছিলাম।নিজেকে যখন চার দেয়ালের মাঝে আটকে ফেলেছিলাম তখন সেই হাত আমাকে টেনে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছিলো।আমার উপর থেকে সেই বিশ্বস্ততার হাত সরিয়ে ফেলিস না।নিজের রাগ,অভিমানকে বন্ধুত্বের উর্ধ্বে নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বকে নষ্ট করে দিস না।”

আরজুর গলা শুকিয়ে আসলো।আর এক মুহুর্ত সেখানে দাড়ালো না।চোখের অশ্রুটুকু মুছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।জারা আরজুর পেছন পেছন গেলো।শুভ তখনও স্থির হয়ে বসে আছে।যেনো আরজুর কোনো কথাই তার কানে পৌঁছায়নি।সবাই শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।এই কঠিন হৃদয়ের শুভকে বড্ডো অচেনা লাগছে সবার।
কিন্তু শুভর ভেতরে তখন চলছে ঝড়।আরজুর অশ্রু আজও শুভর হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে তুলে।কিন্তু সে আর অস্থির হয়ে উঠেবে না।নিজেকে শক্ত পাথরে পরিণত করেছে।শুভ ইচ্ছে করেই আরজুর কাছ থেকে দূরে থাকছে।নাহলে নিজের অনুভূতি খুব বাজে ভাবে প্রকাশ পাওয়ার সম্ভবনা আছে।যা সে চায়না।

শুভ ফোনটা হাতে নিয়ে ব্লক লিস্ট চেক করলো।সেখানে আরজুর নাম্বার দেখে খানিকটা অবাক হলো।কিন্তু সে তো আরজুকে ব্লক করেনি।তাহলে কে করলো?শুভ কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসলো।
____________________
নাহিদ আজ দ্রুত বাসায় আসলো।কারণ সাইফুল তাকে কল করে জানিয়েছে ভার্সিটি থেকে আরজু কান্না করতে করতে বেরিয়েছে।এমন কি সারা রাস্তা কান্না করেছে।বহু কষ্টে একটা মিটিং ক্যানসেল করে বাসায় এসেছে।বাসায় আসতেই সুমির মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো

-” সুমি তোরও মন খারাপ?মুখটা এমন শুকিয়ে আছে কেনো?”

সুমি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” ভাইজান আজ ভাবীর মন খারাপ।তাই আমারও মন খারাপ। দুপুরে বাসায় ফিরে রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি।আমি খেতে ডাকলাম কিন্তু খেলো না। রাতেও খায়নি।ভাবী আসার পর থেকে বাড়িটা কত সজীব ছিলো।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বাড়িটা কেমন শুকনো পাতার মতো নেতিয়ে পড়েছে।”

নাহিদ চিন্তিত হয়ে বললো
-” খাবার আমার রুমে পাঠিয়ে দে।আমি দেখছি কি হয়েছে।”

নাহিদ রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো রুম অন্ধকার।আলো জ্বালাতেই দেখলো এলোমেলো অবস্থায় বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে আরজু।নাহিদ আরজুর পাশে যেয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।আরজুর সুন্দর মুখটা লালচে হয়ে আছে।চোখ দুটো ফুলে উঠছে। চোখের কার্নিশে এখনো বিন্দু বিন্দু অশ্রু মুক্তার নেয় ঝলমল করছে।আরজুর মলিন মুখটা নাহিদের হৃদপিণ্ডে ব্যাথার সৃষ্টি করছে। নিবরাস নাহিদের মতো তুখোড় রাজনীতিবিদ এক মায়াবী রমণীর প্রেমে কতটা মাতোয়ারা হয়ে পড়েছে।পার্টির লোকে জানলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবে না।

নাহিদ আরজুর হাতের কাছে ফোনটা পড়ে থাকতে দেখলো।সেটা নিয়ে ছোট টেবিলে রাখতে গেলে ফোনের স্ক্রিনে একটা ছবি ভেসে উঠলো।মূলত আরজুর আঙুলের স্পর্শে ফোনটা আনলক হয়ে গেছে।নাহিদ দেখলো সেখানে দুজন মানুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখ।আরজু আর শুভ একই রকম ব্ল্যাক টিশার্ট পরে আছে।টিশার্টের গায়ে বড়ো করে লেখা ” friends forever”.

নাহিদ অনেকটা বুঝতে পাড়লো আরজুর মন খারাপের কারণ।নাহিদ আরজুর কপালে আলতো স্পর্শে চুমু খেয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো।ফ্রেস হয়ে এসে আরজুর চুলে হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগলো।আরজু পিট পিট চোখে তাকালো।প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় ঠিক মতো চোখ খুলতে পারছে না।নাহিদ আদুরে স্বরে বললো

-” আরজু উঠ প্লিজ।দুপুর থেকে না খেয়ে আছো।জলদি উঠে ফ্রেস হয়ে নাও।”

আরজু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো
-” আমি খাবোনা নেতা সাহেব।প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।একটু ঘুমাতে দিন।”

-” উহু!! লক্ষী মেয়ের মতো উঠে পরো।কিছু খেয়ে মেডিসিন নিলে মাথা ব্যাথা ঠিক হয়ে যাবে।উঠো জলদি।”

নাহিদের তাগিদে আরজুকে উঠতে হলো।কোনো মতে ফ্রেস হয়ে আবার বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে পড়লো।পাশে কারো অস্তিত্ব পেয়ে চোখ খুলে তাকালো।দেখলো নাহিদ খাবার প্লেট নিয়ে বসেছে।আরজুকে অবাক করে দিয়ে নাহিদ নিজ হাতে এক লোকমা খাবার আরজুর সামনে ধরে বললো

-” হা করো।”

আরজু যেনো নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না।নেতা সাহেব নিজ হাতে তাকে খাবার খাইয়ে দিতে চাইছে?আরজু কে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে নাহিদ বললো

-” কি হলো হা করো?”

আরজু হা করতেই নাহিদ আরজুর মুখে খাবার পুড়ে দিলো।আরজু খাবার মুখে নিয়েই বুঝতে পাড়লো নেতা সাহেব আজ প্রথম কাউকে খাইয়ে দিচ্ছে।আনাড়ি হাতে বাচ্চাদের যে ভাবে খাওয়ায় ঠিক তেমন।আরজু যেনো মুহূর্তেই সারাদিনের কষ্ট ভুলে গেলো।সারা শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।কিছু মুহূর্তের মধ্যে আরজুর চোখ ভিজে উঠলো।বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেলো।

আরজু তখন স্কুলে পড়তো।বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন আদরের কোনো কমতি ছিলনা তার।বেশ আহ্লাদী মেয়ে যাকে বলে।ক্লাস সিক্স,সেভেনে পড়ার সময়ও তাকে মায়ের বা বাবার হাতে খাবার না খেলে পেট ভরতো না।একদিন ক্লাসের দেরি হওয়ায় আরজু দ্রুত রেডি হচ্ছে আর তার বাবা খাবার প্লেট হাতে নিয়ে মেয়ের পেছনে ঘুরে ঘুরে খাওয়াচ্ছে।আরজুর মা বিরক্ত হয়ে বললো

-” আরজু এবার একটু বড়ো হো।এতো বড়ো মেয়েকে হাতে তুলে খাইয়ে দিতে হয়?”

আরজু মুখে খাবার নিয়ে হেসে বললো
-“মাম্মা তুমি বা পাপা খাইয়ে দিলে বেশি খেতে পারি।আর আমিতো একটাই মেয়ে তোমাদের।আমার আদরের ভাগ নেওয়ার কেউ নেই।তাই সব আদর লুফে নিচ্ছি।”

আরজুর মা বললো
-” আমরা কি সারা জীবন থাকবো নাকি? নিজের কাজ নিজে করতে শিখ।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-” সারা জীবন থাকবে না তো কোথায় যাবে?আমাকে না নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না বলে দিলাম।”

আরজুর মা হেসে বললেন
-” আরে পাগল বাবা মা কি চিরদিন বেঁচে থাকে? তাছাড়া বিয়ের পর তো শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে তাই না।তখন এই ভাবে কে খাইয়ে দিবে?”

আরজু মুখ ভেঞ্চে বললো
-” আমি কোথাও যাচ্ছি না। আর না তোমরা যাচ্ছ।”

মেয়েকে অভিমান করতে দেখে আরজুর বাবা হেসে স্ত্রীর উদ্দেশ্য বললেন
-” তুমি এতো চিন্তা করো না।আমার মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্র আসবে।যে নিজ হতে আমার প্রিন্সেস কে খাইয়ে দিবে।তাই না মা?”

আরজু খিল খিল করে হেসে বললো
-“এক্সাক্টলি।তুমি খালি খালি চিন্তা করো মাম্মা।”

অতীতের কথা মনে করে আরজুর চোখ জোড়া ভিজে উঠলো।নাহিদ আরজুর ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো
-” খাওয়ার সময় কাদতে নেই আরজু।কাদার জন্য বেস্ট প্লেস হচ্ছে বিশ্বস্ত মানুষের বক্ষস্থল।যেখানে মুখ গুঁজে শান্তি পাওয়া যায়।”

আরজু ড্যাব ড্যাব করে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইল।নাহিদ আবার আরজুর মুখে খাবার পুড়ে দিলো। খাওয়া শেষ করে নাহিদ আরজুকে মেডিসিন খাইয়ে দিলো।আরজুর পাশে বসে বললো
-” মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”

আরজু কোনো কথা বললো না।সোজা নাহিদের কোলে শুয়ে পড়লো।নাহিদ পরম যত্নে আরজুর কেশে রুক্ষ হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।আরজু আবেশে চোখ বুজে রইলো।বেশ আরাম লাগছে।মানুষটার হাতে যাদু আছে।নিমিষেই আরজুর সব যন্ত্রণা গায়েব করে দিচ্ছে।

আরজু চোখ বুজে বিড়বিড় করে বললো
-” পাপা তোমার প্রিন্সেস তার রাজকুমারের সন্ধান পেয়ে গেছে।আফসোস তোমরা দেখতে পারলে না।”