মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৭০+৭১+৭২

0
1061

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_70

বাইরে বৃষ্টির রেস কাটানো সোনালী রোদ।ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে চারপাশে।এই মনোরম পরিবেশে বারান্দায় বসে চা পান করছেন সাবিহার বাবা।তিনি বেশ সৌখিন মানুষ।গাছের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে।বারান্দায় ছোটখাটো বাগান বানিয়ে ফেলেছেন।তার মাঝেই ছোট্ট একটা টেবিল সেট করে নিয়েছেন।ছুটির দিন গুলোতে তিনি এই জায়গায় অনেকটা সময় ব্যায় করেন।আজ তুমুল বৃষ্টির ফলে সামনের বড়ো রাস্তায় পানিতে টইটুম্বুর।হঠাৎ সেখানে একটা রিক্সা থামলো।সাবিহাকে ভেজা অবস্থায় নামতে দেখে খানিকটা চমকালেন।সাবিহা বাসায় এসে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে।মেয়েটার মুখটা কেমন বিষণ্ণ দেখালো।মেয়েটার মতিগতি আজকাল সুবিধার মনে হচ্ছে না।তিনি স্ত্রীকে ডেকে বললেন

-” সাবিহা এই বৃষ্টিতে কোথা থেকে আসলো?”

-” ওই তো রামিম ছেলেটা আছে না?ওর সাথেই দেখা করতে গেছিলো।এইতো এসেই রুমে ঢুকলো।ছেলেটার জন্য ভীষণ খারাপ লাগে জানো।এই বয়সেই বাবা মা হারিয়ে কেমন একা হয়ে পড়েছে।শুনেছি আপন বলতে তেমন কেউই নেই।একা বেচেঁ থাকা কতো কষ্টের ছেলেটাই ভালো বুঝতে পড়ছে।তাইতো ওরা বন্ধুরা মাঝে মাঝে একটু সঙ্গ দিয়ে আসে।”
ভদ্রলোক স্ত্রীর উপর ভীষণ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ধমকের সুরে বললেন

-” তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।যুবতী মেয়েটাকে একটা ব্যাচেলর ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছ?লোক জানলে নানান কথা রটাবে।সাবিহাকে ওই ছেলের কাছথেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলবে।”

ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে বললেন
-” তুমি ভুল ভাবছো।ছেলেটা ভীষণ ভালো।ভদ্র,মার্জিত ছেলে।তাছাড়া সাবিহা ওর সব ফ্রেডের সাথেই বেশ ক্লোজ।”

সাবিহার বাবা চিন্তিত হয়ে বললেন
-” আমি যা বুঝতে পারছি সেটা তোমার মাথায় ঢুকবে না।মেয়েকে নিয়ে আমার অনেক সপ্ন।আবেগে ভেসে সে সব ধুলিৎসাত করে দিক সেটা চাইনা।রবিউলের ছেলেটার সাথে এবার পাকা কথা সারতেই হবে।মেয়েটাকে এমন বেপরোয়া হয়ে চলতে দেওয়া যাবে না।”

সাবিহার মা অবাক হয়ে বললো
-” এতো জলদি বিয়ে নিয়ে কেনো ভাবছো? মেয়েটা স্টাডি শেষ করুক তার পর নাহয় এসব হবে।”

-” ততো দিন অনেক দেরি হয়ে যাবে।মেয়েটাকে কিছুতেই ভরসা করতে পারছি না।সে ভীষণ আবেগী।বয়স হয়েছে।দুনিয়া তো কম দেখিনি।রামিম ছেলেটাকে তোমার মেয়ে বন্ধুর চাইতে বেশি কিছু ভাবছে।আর এমনটা কিছুতেই সম্ভব না।”

সাবিহা দরজা বন্ধ করে ভেজা সারিতেই ফ্লোরে বসে রইলো। পেট গুলিয়ে কান্না আসছে।অভিমানের যেনো শত অভিযোগ তুলছে।আজকের এই মাদকতাময় মুহূর্তকে এমন বাজে ভাঁজে শেষ করতে হলো রামিমের?বেশি কিছু কি চেয়েছিলো? একটু ভালোবেসে প্রিয় মানুষটার সানিদ্ধে কামনা করেছে।কিন্তু রামিম এই প্রিসিয়াস মুহূর্তকে তুচ্ছ করে তাকে বের করে দিল।এই ছেলেটা কেনো নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করছে না? সাবিহার তো কোনো চাওয়া নেই।প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বাঁধতে চেয়েছে।তবে কেনো এতো ভয় রামিমের?
__________________

বন্ধু মহলের সকলেই সেই চিরো চেনা ক্যান্টিনে বসে আছে। অন্যান্য দিনের মতো আজ আর গল্প জমে ওঠেনি। করো মধ্যে নেই কোনো উল্লাস উদ্দীপনা। এমনটা খুব কম সময়ে হয়ে থাকে।সামনে পড়ে থাকা কফির মগের কফি গুলো ঠান্ডা হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।সাবিহা আড়চোখে তাকাচ্ছে রামিমের দিকে।রামিম আশেপাশের মনোরম পরিবেশ দেখতে ব্যাস্ত।একটাবার ফিরেও তাকাচ্ছে না সাবিহার দিকে।সাবিহার অভিমানী মনে একদলা কান্না জমা হলো।কিন্তু সবার সামনে বেরিয়ে আসতে চাইছে না।অন্যদিকে রামিমের ভীষণ অসস্তি হচ্ছে।সেদিনের ঘটনার পর সাবিহার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দ্বিধা বোধ করছে।অজানা অনুভূতিটা এসে ভেতরে তোলপাড় সৃষ্টি করছে।নিজেকে ভেতর অপরাধ বোধ কাজ করছে।

শুভ তাকিয়ে আছে আরজুর মলিন মুখটায়।কয়দিনই কেমন চোখ গর্তে চলে গেছে। চোখে মুখের সেই চঞ্চলতা আর নেই।শুভর মন চাইলো আরজুকে বুকে ঝাপটে ধরে বলতে ‘তুই আবার আগের মতো হাসি খুশি থাক।তোকে এই ভাবে দেখলে আমি সহ্য করতে পারিনা।

কিন্তু তাদের সম্পর্কের কোথাও কেনো একটু ভাটা পড়েছে।চাইলেই অন্যের স্ত্রীকে জড়িয়ে নেয়া যায়না।চাইলেই আরজুর উপর আগের মতো অধিকার ফলাতে দ্বিধা কাজ করে।রিমি শুভর অস্থিরতা বুঝতে পারছে।কিন্তু করার কিছুই নেই।এই ছেলেটা আরজুকে এতো ভালো কেনো বসে? এই যুগে এতটা নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়?

অন্য সব দিনের মতো আজ জারাকে তেমন উৎফুল্ল দেখলো না।আজকাল তার মনটা বিষণ্ণতায় ঘিরে থাকে।অদ্ভুদ ভাবে সে একটা বাচ্চা ছেলেকে মিস করছে।ভীষণ মিস করছে।জাহিদের তার পিছু পিছু আসা,তাকে বিরক্ত করা সবটাই মিস করছে।এমন তো হওয়ার কথা ছিল না? এই বিষয়টা নিয়ে জারা নিজের উপরই ভীষণ বিরক্ত।জারার অচেতন মন এখনো ঐ স্টুপিড ছেলেটাকে খুঁজছে।ছেলেটা কি তার উপর অভিমান করেছে?

ফুয়াদ আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।আজ সকালটা স্নিগ্ধ কোমলমতি কিশোরীকে দেখতে না পেরে ভীষণ অস্থির হয়ে আছে।কোনো কিছুতেই মন বসছে না।ফুয়াদ বুঝতে পারছে লামিয়াকে ছাড়া আসলে তার এক দিনও ভালো কাটবে না।মেয়েটা তার মায়ার জালে তাকে এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টসাধ্য।

সকলেই যেনো নিজেদের জীবনের নানান জটিলতায় ঘিরে আছে।সকলেই মন বিক্ষিপ্ত।সকলকে স্বাভাবিক করতে প্রথম উদ্যোগ জারা নিলো।বললো

-” আরজু তুই চেহারাটা এমন ভোঁতা দা এর মতো করে রেখেছিস কেনো? তোর কি জামাই মরেছে? আজও দেখলাম দিব্যি এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছে।ফিট অ্যান্ড ফাইন।বরং তুই আসার পর থেকে সে তো আরো হ্যান্ডসাম লুকে ঘুরছে।শয়ে শয়ে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।আর তুই গাধী ওই মেয়েদের সুন্দর রাস্তা করে দিচ্ছিস।স্টুপিড একটা!!আর সাবিহা তোর কি সমস্যা এমন ভাব মারাচ্ছিস কেনো?যেই ব্যাটার জন্য এমন করছিস সে যেহেতু বুঁজছেই না, তার বুকে দুইটা লাত্থি মেরে চলে যা।কাহিনী খতম। এতো কিসের বিরহ?”

সবাই খানিকটা নড়ে চড়ে বসলো।রামিম প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করে উঠে দাড়িয়ে বললো

-“তোদের ফালতু পেঁচালে আমি নাই।আমার টিউশনি আছে যেতে হবে।আর আরজু তুই ভুল করছিস।যা বুজলাম সেটা একটা এক্সিডেন্ট ছাড়া আর কিছুই না।নাহিদ ভাই যথেষ্ট ভদ্র আর ভালো লোক।সে নিশ্চই ইচ্ছেকৃত ভাবে তোর বাবা মাকে মারতে যায়নি? লজিক্যালি চিন্তা কর।আর বাকি রইলো সবটা তোর কাছে লুকানোর বিষয়,সেটা নাহয় তুই নাহিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে ক্লিয়ার করে নে।চাইলেই সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়না।আমরা জানি বাবা মায়ের বিষয়ে তুই অনেক বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়িস।তোর ইমোশন আমি বুজি।তোর মতো আমিও এতিম।কিন্তু তবুও তোকে ভালোবেসে আগলে রাখার অনেকেই আছে।কিন্তু আমার কেউ নেই।”

জারা মুখ ভেংচি মেরে বললো

-“রাবিশ!!তুই কতো দিস আগলে রাখতে।কেউ তোর কাছে গেলেই তো ফোস্কা পড়ে যায়।হুলু বেড়াল একটা।”

ফুয়াদ জারার দিকে চোখ গরম করে তাকালো।
রামিম আর একটা বাক্য উচ্চারণ করলো না।সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লো।সাবিহা রামিম এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।কেমন পাষণ্ড এই যুবক!! একটাবার সাবিহার দিকে ফিরেও তাকালো না।
_________________________

আরজু অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।আজ শুভ জোর না করলে হয়তো ভার্সিটিতেও আসতো না।জীবন বড়ো রংহীন সাদা কাগজ মনে হচ্ছে।যেখানে সুখের রঙের কোনো চিহ্ন নেই। আরজুর এখনো মনে পড়ে সেই সোনালী দিনের কথা যখন তার পাশে বাবা-মা দুজনেই ছিল। আরজুর মা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী।বাবা নাকি ভার্সিটিতে মাকে দুর থেকেই দেখতেন। অতো রূপবতী নারীর সমুক্ষে যেতে ভীষণ ভয় পেতেন।কিন্তু আরজুর মা ছিলেন ভীষণ চঞ্চল।অনেকটা আরজুর মতো।তিনি নিজেই একদিন তার বাবাকে ডেকে বলেছিলেন “দুর থেকে শুধু দেখেই যাবে?নাকি মুখেও কিছু বলবে?আমি আবার ভীতু লোক নিয়ে সংসার করতে পারবো না।বাবা নাকি সেদিন খুশিতে কেঁদে ওঠে ছিলেন।তার পর দেখতে দেখতে অনেকটা সময়।একটু একটু করে গড়েছিল একটা ছোট্ট সংসার।কিন্তু সবটাই মুহূর্তেই শেষ।খুবই বাজে ভাবে তাদের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল।আরজু কি করে ভুলবে মায়ের সেই থেতলে যাওয়া হাত,ক্ষতবিক্ষত মাথার ডান পাশ,ভাঙ্গা পা।আর বাবার ফেটে যাওয়া মাথা,ভাঙ্গা মেরুদন্ড,কেটে যাওয়া দুইটা আঙ্গুল।সেদিন আরজু দেখেছিল চারদিকেই শুধু রক্তের বন্যা।তাইতো আজও সামান্য রক্ত দেখলে মেয়েটার পেনিক অ্যাটাক হয়। বাবা মাকে সেই অন্ধকার কবরে শুয়ে আসার পর সেই বিরান,নির্জন ঘরে আরজুর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।যেখানে এক সময় ছিলো কোলাহল পুরনো।সব অতীত আবার আরজুর মস্তিষ্ককে গ্রাস করে রেখেছে।আরজু যেনো আবারও হারিয়ে যাচ্ছে পূর্বের ডিপ্রেশনের।

ক্যান্টিনে তখনই তাদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল সাঈদ।তাদের সিনিয়র আর একজন ছাত্রনেতা।ভার্সিটিতে বেশ দাপট তার।আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটা আরজুকে বেশ সমীহ করে।জারার মতে লোকটা আরজুর প্রমে হাবুডুবু খাচ্ছে।আরজুর দিকে কেউ বাজে নজরে তাকালেই এই সাঈদ তার মাথা ফাটাতে দেরি করেনা। সাঈদ মিষ্টি হেসে বললো

-“হ্যালো গার্লস! কি অবস্থা তোমাদের?”

শুভ তখন ওয়াসরুমে ছিলো।রামিম তো আগেই চলে গেছে।তাই বর্তমানে টেবিলে সাবিহা,জারা,রিমি,আরজু আর ফুয়াদ উপস্থিত।ফুয়াদ বাঁকা হেসে বললো

-“অনলি গার্লস!! ভাই আমাদেরকে কি চোখে পড়ে না?”

সাঈদ মেকি হেসে বললো

-” আমার নজর শুধু গার্লস দের দিকেই আটকায়।
গে বা সমকামী হলে অবশ্য তোমার দিকেও পড়তো।তুমিও নিশ্চই সেই ক্যাটাগরিতে পরো না?”

রিমি আর জারা ফিক করে হেসে উঠলো।ফুয়াদ বেচারা চুপসে গেছে। সাঈদ বেশ বুদ্ধিমান ও চতুর ছেলে।তার সামনে ফুয়াদ টিকতে পারবে না ভালো করেই জানে।a সাঈদ আরজুর উদ্দেশে বললো

-” আরজু তোমাকে একটু দরকার ছিল।আসতে পারবে?”

আরজু মলিন হেসে বললো
-” কোনো প্রয়োজন ভাইয়া?”

-” হু। একটু যদি আসতে।”

আরজু সাঈদ কে বেশ সম্মান করে।তাই এই বিষণ্ণ সময়ও মানুষটাকে মানা করতে পারলো না। সাঈদ তাকে নিয়ে গেটের বাইরে চলে আসলো।খানিকটা সামনে এগিয়ে একটা গাড়ি দেখিয়ে বললো

-” ভাই অপেক্ষা করছে। যাও।”

আরজুর কপাল কুঁচকে ভালো করে তাকিয়ে চমকে গেলো।এটা নাহিদের গাড়ি।ঠিক সেই সময় ড্রাইভিং সাইটের পাশের গ্লাস খুলে গেলো।দেখা গেলো একটা সুদর্শন পুরুষ সানগ্লাস পড়ে বসে আছে।আরজুর মনে হলো কয়েক যুগ পর লোকটার সাথে তার দেখা হলো।নাহিদ সানগ্লাস খুলে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরজুর উদ্দেশে বললো

-” গাড়িতে উঠে বসো।”

নাহিদের গম্ভীর স্বরে করা আদেশে আরজুর বুকে দুকপুক শুরু হয়ে গেলো।অন্তত এটা অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে এই পুরুষটিকে আরজু ভীষণ ভালোবাসে।এই মানুষটার মুখ তার হৃদয়কে শীতল করে তুলে।এতো কিছুর পরও আরজুর এই মুহূর্তে নেতা সাহেবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।আরজু মনে মনে নিজের বেহায়া মনকে ধমকালো।আরজুকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিদ গাড়ি থেকে নেমে আসলো।আরজুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো

-” কিছু বলেছি আরজু।”

এতক্ষনে আরজুর ধ্যান ফিরলো।সে নাহিদকে অতি নিকটে দেখে কয়েক কদম দূরে সরে দাড়ালো।আর এই কাজটাই যেনো নাহিদের পছন্দ হলো না।এই প্রথম সে আরজুর সাথে রুঢ় হলো।আরজুর বহু চেপে ধরে বললো

-” এখন দূরে সরে যাচ্ছ কেনো? একবার যেহেতু আমার জীবনে এসেই পড়েছ তোমার কোনো মুক্তি নেই।”

বলেই পাশের সাঈদ এর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
-” ধন্যবাদ সাঈদ আমার বউটাকে এতো বছর দেখে রাখার জন্য।তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে আমি একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছি।”

সাঈদ কপাল চুলকে মুচকি হেসে বললো
-” এসব বলে লজ্জা দেবেননা ভাই।আরজু উপস! সরি ভাবীর সেবায় নিয়োজিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”

আরজু বিস্মিত হয়ে সবটাই শুনছে।তার মানে সাঈদ ভাই যে কিনা ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই তার প্রতি এক্সট্রা কেয়ার করেছে,তার সব সমস্যায় এগিয়ে এসেছে এর মূলে ছিলো নেতা সাহেব?মূলত তার পেছনে একটা গার্ড হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছিল?সাঈদ ভাইকে দিয়ে ছেলেদের হুমকি,মারধর করার কাজ করিয়ে নিজে বেশ সাধু সেজে ছিলো। এই অসভ্য নেতা আর কি কি লুকিয়েছে তার কাছে?আরজু বাহুতে বেশ চাপ অনুভব করতেই আহ!! শব্দ করে উঠলো।খানিকটা রেগে বললো

-” রাস্তা ঘাটে এমন অসভ্যতামি কেনো করছেন? ছাড়ুন বলছি।আমি আপনি সাথে কোথাও যাবো না।”

-“আরজু সিনক্রিয়েট করো না।আমি রাস্তা ঘাটের কোনো লোফার নই যে এমন রিয়েক্ট করছো।তোমার হাসবেন্ড হই।এই মুহূর্তে সবার সামনে তোমাকে চুমু খেলেও কেউ কিছু বলার সাহস পাবে না।এমন কিছু না চাইলে বিনা বাক্য ব্যয়ে করে গাড়িতে উঠ।”

নাহিদের শক্ত ও কঠিন বাক্যে অভিমানী আরজুর অভিমান আকাশ ছুঁয়ে গেলো।নেতা সাহেব কখনোই তার সাথে এমন কঠিন স্বরে কথা বলেনি।অথচ আজ কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আরজুকে স্থির থাকতে দেখে নাহিদ আরজুকে এক প্রকার জোর করে গাড়িতে তুললো।আরজু অভিমানে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে।বার বার নাক টানছে।নাহিদ সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।নাহিদের ইচ্ছে করছে আরজুকে নিয়ে দুর অজানায় হারিয়ে যেতে।যাতে এই জগতের কোনো ঝঞ্জাল তাদের ছুটে না পারে।নাহিদ আড়চোখে আরজুকে দেখলো।তার মিষ্টি বউটার সারা মুখে কেমন বিষাদ ছেয়ে আছে।আচ্ছা রাগলে কি আরজুকে বেশি মায়াবী লাগে? লালচে নাকের ডগায় যেনো মায়া উপচে পড়ে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_71

আকাশে জমা হয়েছে ঘন কালো মেঘ।রোদের তীব্রতাকে ছাপিয়ে আকাশ সেজেছে নিজের রঙে।যেনো নিজের যন্ত্রণা ধরণীর বুকে ঢেলে দিচ্ছে।নিস্তব্দ রাস্তায় এগিয়ে চলছে নাহিদের গাড়ি।আকাশের চাইতেও বেশি নিস্তব্দতা ছেয়ে আছে গাড়ির ভেতরে।আরজু একদম নীরব হয়ে বসে আছে।নাহিদের দিকে তাকাচ্ছে না।কারণ এতে তার অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পাবে।কিন্তু নাহিদের গাড়ি শহরের বাইরের দিকে ছুটতে দেখে আরজুর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।সে অস্থির চিত্তে বললো

-“আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?গাড়ি থামান। আমি যাবনা আপনার সাথে।”

নাহিদ আরজুর কথায় কোনো পাত্তা দিলো না।আরজু রেগে আবার বললো

-” কি বলছি শুনতে পারছেন না? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

নাহিদের নিরলস উত্তর
-” জাহান্নামে।”

-” আমি আপনার সাথে জাহান্নাম,জান্নাত কোথাও যাবো না।”

নাহিদ আবারও শান্ত কিন্তু কঠিন সুরে বললো

-” তুমি যেতে বাধ্য।”

-” কি পেয়েছেন আপনি? নেতা বলে সব জায়গায় ক্ষমতা দেখবেন?আমার সাথে একদম গুন্ডামি করবেন না।এতো দিন ভদ্র,শান্ত সেজে এখন গুন্ডামি করছেন?”

-” নেতা বলে না বরং হাসবেন্ড বলে ক্ষমতা দেখাচ্ছি।আর আমি তো ভদ্র কখনোই ছিলাম না।সেটা তোমার চাইতে ভালো কে জানে?”

বলেই আরজুর দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।আরজু হা করে তাকিয়ে রইল নাহিদের দিকে।এই লোকটা এতো অসভ্য?কি তীক্ষ্ণ চাহুনি?আরজু যেনো পারে না নিজেকে একটা খোলসে ঢুকিয়ে ফেলে।প্রচন্ড লজ্জা আর রাগে সে নাহিদের দিকে তেরে আসলো।নাহিদের পাঞ্জাবীর কলার টেনে বললো

-“আপনি একটা অসহ্য লোক।বেহায়া,নির্লজ্জ।”

নাহিদ দুষ্ট হেসে নিচের ঠোঁট কামড়ে বললো
-” এসবের প্রমাণ তো প্রতি রাতেই দিয়েছি।নতুন করে বলার কি আছে?”

আরজু বিস্মিত হয়ে ছিঁটকে দূরে সরে আসলো। এ কোন নেতা সাহেবকে দেখছে? এর তো মুখে কোনো লাগাম নেই।আগেও আরজুকে নানা ভাবে লজ্জা দিতো কিন্তু এখন!আরজু আর ভাবতে পারছে না।আচ্ছা!নেতা সাহেব তাকে কোথায় নিয়ে হচ্ছে? আরজু ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো।উদ্দেশ্য শুভকে কল করা।শুভকে কল করে বলতে হবে এই নেতা পাগল হয়ে গেছে।নিজের স্ত্রীকেই কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে।শুভর নম্বরে ডায়াল করে হ্যালো বলতেই নাহিদ ছিনিয়ে ফোন নিয়ে কানে ধরে বললো

-” শালা সাহেব আমি আমার বউকে নিয়ে গেলাম।কবে ফিরছি জানিনা।আরজুর খালামণিকে কাইন্ডলি ইনফর্ম করে দিয়ো।আরজু ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে তাকে জানাতে।হানিমুনের কথা মেয়েরা নিজের মুখে বলতে ভীষণ লজ্জা পায়।আশা করি তুমি নিশ্চই বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারবে।আল্লাহ হাফেজ।”

বিস্মিত আরজুর দুহাত আপনাআপনি নিজের মুখে চলে গেলো।এই লোক নির্ঘাত মাথায় ব্যাথা পেয়েছে।তার নেতা সাহেব এমন আচরণ করতেই পারেনা।সেই ভদ্র,শান্ত নেতার এ কেমন রূপ?আরজুকে ভরকে দিতে পারে নাহিদের ভীষণ ভালো লাগলো।বউকে রাগাতে এতো আনন্দ হয় আগে জানা ছিল না।এই রমণী তো আগে তার সাথে এতো রাগ দেখাত না।কেমন লাজুক লতা কিংবা ভালোবাসায় তৃষ্ণার্ত হতে দেখেছে।আরজু এবার ক্ষেপা বাঘিনীর মতো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো

-” শুভ কে কি বললেন এসব?আমি আর এক মুহূর্তই আপনার সাথে থাকবো না।গাড়ি থামান বলছি।”

বলেই আরজু দরজা খুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।আরজুর ছটপট করাতে নাহিদের ড্রাইভ করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।তাই আরজুর দিকে ঝুঁকে বললো

-” আসফি ঠিক বলেছে।মেয়েরা বেশি বুঝে।তোমার মতো বাঘিনী কে যে এতো সহজে জব্দ করতে পারবো না আগেই বুজেছি।তাইতো তোমার জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।তবে আমি এমনটা করতে চাইনি।কিন্তু এটা ছাড়া আর উপায় নেই।”

বলেই আরজুর মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে।আরজু কয়েক সেকেন্ড দাপাদাপি করে নিস্তেজ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।নাহিদের কাজটা করে মোটেও ভালো লাগছে না।কিন্তু আরজুকে শান্ত করার আর কোনো উপায় ছিলো না।
______________

নাহিদের কল পেয়ে শুভ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলো।নাহিদের কথার মানে না বুজলেও এটা বুঝতে পারলো আরজুর মান অভিমান ভাঙ্গার প্রয়াস চলছে।শুভর একদিকে ভালো লাগলো।কারণ আরজু বেশ কিছুদিন যাবত কেমন অস্বাভাবিক হয়ে ছিলো।করো সাথেও তেমন কথা বলছিলো না।এই মেয়েটা একদম মেন্টাল স্ট্রেস নিতেই পারেনা।নাহিদ যদি সবটা ঠিক করতে পারে তবে শুভ প্রশান্তি অনুভব করবে।তবে নাহিদের একটা কথা শুভর মস্তিষ্ককে কেমন পীড়া দিচ্ছে।হানিমুন শব্দটা কেনো যেনো শুভর বুকের ভেতরের পুরনো ক্ষতটা একটু ঘা সৃষ্টি করলো।শুভ জানে আরজু সম্পূর্ণ রূপে অন্য কারো তবুও তার অবুঝ মনকে কি দিয়ে বুঝাবে?

রিমি আর জারা পাশেই ছিল।রিমি শুভর মলিন মুখটা দেখে বললো
-” কি বললো আরজু?”

শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” আরজু না,নাহিদ ভাই কল করেছে।আরজুকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।খালামণিকে ইনফর্ম করতে বললো।”

জারা মুচকি হেসে বললো
-” এই এরা আবার হানিমুনে যাচ্ছে না তো? হাও রোমান্টিক!!আরজুর মান ভাঙ্গাতে রসকষহীন মেয়র ও রোমান্টিক পোলা হয়ে গেলো। ভাবা যায়?”

রিমি আড়চোখে শুভর দিকে তাকালো।শুভর থমথমে মুখটা দেখে বিষয়টা স্বাভাবিক করতে মৃদু হেসে বললো

-” তাহলে তো ভালই হয়।অনেকদিন ধরেই আরজুর মুখে হাসি দেখি না। এবার যদি একটু স্বাভাবিক হয়।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হাজারো মন মালিন্যতার পরও তাদের মদ্যকার ভালোবাসা তাদের কাছে টেনে আনে।আমার বিশ্বাস এবার পরিস্থিতি অনেকটাই শিথিল হবে।”

শুভ কিছুই বললো না।আনমনে পাশের টেবিলে তাকিয়ে রইলো।সেখানে জুনিয়র একজোড়া ছেলে মেয়ে নানান খুনসুটিতে ব্যাস্ত।শুভর চোখের সামনে তার আর আরজুর বন্ধুত্বের মিষ্টি মুহূর্তগুলি ভেসে উঠছে।সত্যি অতীত কতো সুন্দর ছিলো।
______________

ফুয়াদ বাসায় পৌছেছে প্রায় বিকেলের দিকে।তাকে দেখেই তাদের গৃহকর্মী ফাতেমা খালা খাবার বেড়ে দিলো।ফুয়াদ খাবার মুখে দিয়েই চোখ মুখ কুচকে ফেললো।ফাতেমা খালাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-” খালা আপনি কি জানেন আপনার হাতের রান্না খুবই বাজে?”

খালা মুখটা মলিন করে বললো
-” জি জানি।আমার জামাইও এই কথা কয়।”

-“আপনার হাতের রান্না খেলে নির্ঘাত আমি পটল তুলবো।”

খালা বিস্মিত হয়ে বললো
-” হায় আল্লাহ আপনি কেন ফডল তুইল্যা আনবেন?আপনার ফডল খাইতে মন চাইলে আমি বাজার তেনে আইনা দিমু।”

খালার কথায় ফুয়াদ বুক ফাটিয়ে হেসে উঠলো।আর বললো
-” খালা এই পটল তোলা সেই পটল তোলা না। যাই হোক লামিয়া আসেনি কেনো কিছু জানেন?আমি কল করলাম ধরলো না।”

ফুয়াদের কথায় খালা খানিকটা কাচুমাচু করতে লাগলো।ফুয়াদের সন্দেহ হওয়ায় জোর দিয়ে বললো
-” কিছু কি হয়েছে খালা?”

ফাতেমা কাচুমাচু করে দুই হাতের তালু ঘষতে লাগলো আর বললো

-” আসলে লামিয়া আর আইব না।খালাম্মা হেরে বিদায় কইরা দিছে।”

ফুয়াদ অবাক গেলো কথাটা শুনে।কপাল কুঁচকে বললো
-“মানে?কি বলছেন?কেনো মানা করেছে?”

-“আসলে খালাম্মা হেতেরে পছন্দ করে না।অনেক কথা শুনাইয়া বাইর কইরা দিছে।লামিয়া নাকি আপনেরে হাত করবার চায়।বড়লোক পোলা দেইখা ওর নিয়ত খারাপ হইয়া গেছে।আপনার সামনে ইচ্ছা কইরা নাকি রঙ্গ তামাশা করে আপনের মাথা খারাপ করতেছে। মাইয়াডা কানতে কানতে বাইর হইলো। খালাম্মায় কামডা ঠিক করে নাই।মাইয়াডা কতো ভালা ছিলো।কি সুন্দর কইরা কথা কইত।”

ফুয়াদ অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে গেলো।তার মা এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে তার ধারণা ছিলো না।রাগে টেবিলের উপর থাকা পানির মগটা আছার মেরে ভেঙ্গে ফেলল।চেঁচিয়ে বললো

-“এত কিছু হয়ে গেলো আর আপনি আমাকে এখন বলছেন?”

ফাতেমা খালা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন।ফুয়াদ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের নম্বরে কল করলো।কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।হয়তো কোনো মিটিং এ ছিলেন।তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা লামিয়া।আগে হাজারটা গফ থাকলেও তাদের প্রতি ফুয়াদের কোনো অনুভূতি ছিলো না।দুই পক্ষ থেকেই টাইম পাস ছিলো।কিন্তু লামিয়ার প্রতি তার বেশ গাঢ় অনুভূতি।এই মেয়েটার মুখের এক চিলতে হাসি ফুয়াদের এলোমেলো জীবনকে মুহূর্তেই কেমন পরিপূর্ণ করে তুলে।আর সেই মেয়েটাকেই তার মায়ের কাছ থেকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হলো?ফুয়াদ প্রচন্দ ক্রোধ নিয়ে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসলো।উদ্দেশ্য মায়ের অফিস।
___________________

সাদা বাল্ব এর তীক্ষ্ণ আলোতে চোখ খুললো আরজু। চোখে মুখে এখনো ঘুম ঘুম ভাব।পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলো একটা অচেনা রুমের নরম বিছানায় সে।আরজু এক মুহূর্তের জন্য চমকে গেলেও পরমুহূর্তেই মনে পড়লো নাহিদের কাণ্ডের কথা।অস্থির চিত্তে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো নাহিদ কোথাও নেই।দ্রুত বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে খেয়াল করলো তার পরনে আগের ফতুয়াটা নেই।বরং অন্য একটা টিশার্ট।আরজু টিশার্ট থাকে নির্গত হওয়া পুরুষালি গন্ধে বুজে গেলো এটা নাহিদের।আরজুর প্রচন্ড রাগ হলো।এসবের মানে কি? ঠিক তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো নাহিদ।উন্মুক্ত দেহে শুধু পরনে কালো টাউজার।ভেজা স্নিগ্ধ নাহিদকে দেখে আরজু যেনো সব ভুলে গেলো।এইতো সেই বক্ষস্থল যেখানে মাথা রেখে কতো রাত কেটেছে আরজুর।এই সেই দেহ যার উষ্ণতায় মত্ত ছিলো বহু রজনী।আরজুকে এই ভাবে সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে নাহিদ গলা খাকানী দিয়ে বললো

-“এমন ভাবে তাকাচ্ছ যেনো খেয়ে ফেলবে।”

আরজুর অনুভূতির রাজ্য থেকে ফিরে আসলো।নাহিদের বাঁকা কথায় আরজুর মন মেজাজ খারাপ হলো।রেগে তেড়ে আসলো নাহিদের দিকে।বললো

-” আমার ড্রেস চেঞ্জ করেছে কে?আর কেনো?”

নাহিদ গায়ে টিশার্ট জড়াতে জড়াতে বললো
-” কে আবার করবে আমি ছাড়া?বাইরে বৃষ্টি ছিলো।গাড়ি থেকে তোমাকে কোলে নিয়ে নামতে নামতে ভিজে গেছিলে তাই।”

-” কি?? আপনি এমনটা করতে পারলেন?এতো নির্লজ্জ আপনি?একটা মেয়েকে অজ্ঞান করে তার সাথে যা তা করবেন?আপনি একটা দুশ্চরিত্র।”

নাহিদের এবার মেজাজ চটে গেলো।আরজুর দিকে তেড়ে এসে বললো

-“লিসেন আরজু।আমি কোনো পরপুরুষ নই।তোমার স্বামী।তোমার শরীরের প্রতিটা লোমকূপে আমার বিচরণ আছে।আরে তোমার শরীরের প্রতিটি তিল আমার মুখস্ত।তাই এটা নিয়ে আমার চরিত্রে দাগ দেওয়াটা নিতান্তই বোকামি।”

আরজু বুজলো রাগে বোকার মতো কথা বলছে।যেই মানুষটা তার স্বামী,যার সাথে তার একটা সেক্স্যুয়াল রিলেশন ছিল তার সামনে এমন করাটা বোকামি।
আরজু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো

-” আমরা কোথায় এখন?”

-” হানিমুনে।”

আরজু বেশ বিরক্ত হলো।অন্য সময় হলে হয়তো খুশিতে নাহিদের ঠোঁটে জম্পেশ একটা চুমু খেয়ে নিতো।কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন।আরজু আবার বললো

-” হেয়ালি বন্ধ করুন।”

নাহিদ এবার খানিকটা সিরিয়াস হয়ে আরজুর পাশে দাড়ালো।আরজুর চোয়ালে আলতো স্পর্শ করে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-” তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।যার জন্য একটা পিসফুল প্লেসের প্রয়োজন ছিল।”

আরজুর সারা শরীর শিউরে উঠলো।কতো দিন পর মানুষটার সেই আলতো স্পর্শ পেলো।নাকে এসে ঠেকেছে পুরনো সেই মাতাল করা সুবাস।সত্যি আরজু বেহায়া।এই পুরুষটির জন্য চরম বেহায়া।

নাহিদ আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো

-” আমরা বর্তমানে সিলেট আছি।”

আরজু চমকে গেলো।সিলেট? এতো দূর? এতো সময় ঘুমিয়েছে সে?আরজু রেগে উত্তেজিত হয়ে বললো

-” সিলেট? এতো দূরে কেনো এনেছেন আমাকে?”

নাহিদ মলিন হেসে আরজুর কপালে উষ্ণ স্পর্শ একে নেশালো সুরে বললো

-” কতদিন ধরে আমার বউটাকে ভালো করে দেখি না। একটু ছুঁই না।তাকে মন ভরে দেখতে যাতে কোনো বাঁধা না আসে তাই।”

আরজুর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো।বুকের ভেতর অসম্ভব ঝড় তুফান চলছে।নাহিদের সংস্পর্শে আসলেই যেনো আরজু দুর্বল হয়ে পড়ে।কিন্তু যখনই সব মনে পড়ে বুকে তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়।আরজু নাহিদকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিলো।আর চিৎকার করে বললো

-“ডোন্ট টাচ মি। যেই হাতে আমার মাম্মা পাপার রক্ত লেগে আছে সেই হাতের স্পর্শ আমি চাইনা।”

নাহিদ আরজুর কাছাকাছি আসতে নিলেই আরজু রেগে নাহিদের দিকে বলিস ছুড়ে মারে থাকে।আর কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে

-“মিথ্যাবাদী প্রতারক আপনি। আমার সাথে এতদিন নাটক করে গেছেন, মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করেছেন।”

নাহিদ দ্রুত আরজুকে বুকে জড়িয়ে নিলো।আরজু ছুটতে চাইলে নাহিদ জোর করেই ধরে রাখলো।প্রচন্ড রাগে অভিমানে আরজু চিৎকার করে কাদতে লাগলো।নাহিদের নিজেরও চোখ ভিজে উঠেছে।সে আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো

-” শান্ত হও আরজু।তোমার কান্না আমার কাছে বিষের কাটার মতো।আমি তোমাকে সবটা বলতে চাই।কেনো কিভাবে সব হয়েছে সবটা।”

-” আমি আর কোনো বানোয়াট কথা শুনতে চাইনা।ছাড়ুন আমাকে।ছাড়ুন বলছি।আমি খালামনির কাছে যাবো।”

নাহিদ আরজুকে শান্ত করতে পারছে না।অন্যদিকে আরজু নাহিদকে একের পর এক বকে যাচ্ছে।নাহিদ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো

-” শাট আপ আরজু।আমি তোমার সাথে কোন প্রতারণা করিনি।যদি প্রতারণা করতাম তবে তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা আছে জেনে তোমাকে মুহূর্তেই বিয়ে করে নিতে পারতাম।সুযোগ কি ছিল না? এটা কি অস্বীকার করবে আমার একটা ইশারায় তুমি আমার হয়ে যেতে না?আমি নিজের অপরাধ বোধের কারণে সবসময তোমাকে এড়িয়ে চলেছি।তোমার অনুভূতিকে কখনোই প্রশ্রয় দিয়ে তোমাকে দুর্বল করিনি।যেদিন তুমি আমার কাছে নিজের ভালোবাসার ঝুলি খুলে বসলে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি।আমি ও তো মানুষ।যাকে এতো বছর যাবত ভালোবেসে এসেছি তাকে বার বার কি করে ফিরিয়ে দেই?”

আরজু শান্ত হলো।অতিরিক্ত কান্নার ফলে চোখ ফুলে উঠেছে।বুক অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছে।নাহিদ আরজুর সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো।আরজুর কোলে মাথা রেখে শান্ত হয়ে বললো

-” জানো আরজু মা মারা যাওয়ার পর থেকেই না আমি অনেকটা বদলে গেছিলাম।অতি দুষ্ট ছেলেটা কেমন শান্ত হয়ে পড়েছিল।দাদাজান আর চাচুকে ছাড়া আমি কারো সামনেই খুব একটা সহজ হতে পারিনা। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে এক আসফি ছাড়া তেমন কেউ ছিলো না।আমার জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিলো পলিটিক্সে জইন করা।অন্য কিছুতে কখনোই ধ্যান যায়নি।কোনো নারীর প্রতি আমি কখনোই আকর্ষণ বোধ করিনি।”

নাহিদ একবার নিঃশ্বাস নিলো মুচকি হেসে বলল
-“কিন্তু এক বসন্তের দিনে এক কিশোরী বাসন্তী কন্যাকে দেখে জীবনে প্রথম আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম।সেই কিশোরীর মায়াবী আখির অতলে হারিয়ে গেছিলাম।প্রথম জেলে যাবার কারণে যেই দিনটাকে আমি অশুভ ভেবেছিলাম,ঠিক সেই দিনটাই আমার জীবনে শুভ হয়ে দাঁড়িয়েছে।থানার বাইরেই আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান মানুষটার অবস্থান ছিল।যে তার খালামণি সাথে কতো না ভঙ্গিমায় কথা বলছিলো।আমি অবাক হয়ে সেই কিশোরীকে দেখছিলাম।আমার জীবনে সেদিন বসন্তের রং লেগেছিল।পলিটিক্সের বাইরে আমার মন অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছিল।”

আরজু স্তব্ধ হয়ে সবটাই শুনছিল।নাহিদ যেই দিনটার কথা বলছে আরজুর সেটা অনেকটা ঝাপসা মনে হচ্ছে।খালামণি কে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার বায়না করতেই হয়তো গেছিলো।তবে আরজু অবাক হলো যে তখন তো তার মাম্মা পাপা জীবিত ছিলো।তার মানে নেতা সাহেব তাকে সেই এক্সিডেন্টের আগে থেকেই চেনে?নাহিদ আরজুর কোমর জড়িয়ে আরেকটু কাছে টেনে কোলে ভালো করে শুয়ে বলতে লাগলো

-” এর পরের সময়টা আমার জন্য ছিলো অনেকটা অন্যরকম।তোমার সাথে অদ্ভুদ ভাবেই আমার আরো দুই একবার দেখা হয়।আমি যতই চাইছিলাম এই মায়া থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু অজানা আকর্ষণ আমাকে তোমার দিকে টেনে নিয়ে গেছে।একটা সময় তোমার সব ডিটেলস কালেক্ট করি।সেই কিশোরী আরজুকে আমি প্রায় প্রতিদিন স্টক করতে থাকি।একটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে ঘুরার কারণে আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করত।আমি কখনোই তোমার সামনে এসে নিজের ভালোবাসা প্রকাশের চেষ্টা করিনি।কারণ তোমার বয়সটা অল্প ছিলো।রাস্তা ঘাটে দাড়িয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে তোমার কিশোরী মনে ভয় সঞ্চার করতে চাইনি।তাছাড়া প্রেম,ভালোবাসার অনুভূতির বেরা জালে ফেললে তুমি স্টাডিতে মনোযোগ হারাতে।আর আমি চেয়েছিলাম কয়েকটা বছর পর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই তোমার মুখোমুখি হবো।
আচ্ছা!!তোমার কি মনে হয়,তোমার মতো রূপবতী মেয়ের এই শহরে এতো স্বাচ্ছন্দ মতো চলা সম্ভব?কেউ কখনো তোমাকে না ইফটিজিং করতে পেরেছে আর না প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে।যেই দুই এক জন চেষ্টা করেছে তাদের পরদিন এমনি এমনি হসপিটালে ভর্তি হতে হয়নি।আমি তোমার মুখমুখী না হলেও তোমাকে একান্ত আমার করে রেখেছি।কারো নজর তোমার অব্দি পৌঁছাতে দেইনি।তুমি হয়তো জানানো না তখন থেকে এখন অব্দি আমার নজর সর্বদা তোমার উপর থাকে।সময়টা আমার বেশ চলছিল।একদিকে আমার লুকানো অনুভূতি আর অন্যদিকে আমার পলিটিক্সে বিচরণ সবটাই পারফেক্ট।একদম পারফেক্ট।কিন্তু……”

বলেই নাহিদ থামলো।

আরজু সবটাই হতবম্ব হয়ে শুনছিল।এই মানুষটা তাকে এতো আগে থেকেই ভালোবেসে এসেছে।আরজু ভেবেছে সবটা ঘটেছে সেই এক্সিডেন্ট এর পর।সত্যি তো, আরজুকে কখনোই কেউ রাস্তাঘাটে ডিস্টার্ব করেনি।যদিও শুভ তার পাশে থাকতো তবুও তখন সেই কিশোর শুভর পক্ষে তাকে সিনিয়রদের তোপের মুখ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ছিলনা।তবে নাহিদের মুখে “কিন্তু” শুনে আরজুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।কারণ নিশ্চই সেই “কিন্তু” পর সেই দুর্বিষহ রাতের বর্ণনা রয়েছে।আরজু হাঁটুর উপরে ভেজা অনুভব করলো।বুঝতে পারলো কঠোর ব্যাক্তিত্বের নেতা সাহেব কাদঁছে।আরজু অবাক হলো।এই আরজু এই মানুষটিকে দুর্বল হতে দেখলো।আরজু মন চাইলো নাহিদের চুলে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে।কিন্তু আরজু তেমনটা করলো না।কারণ এই বর্ণনার শেষটা আরজুর জানা। এর শেষটা ভীষণ হৃদয়বিদারক।একবার মন চাইলো নাহিদকে ঠেলে কোল থেকে নামিয়ে দিতে।কিন্তু আরজুর বেহায়া মন সেটা পারলো না।ভালোবাসা এতো যন্ত্রণাদায়ক কেনো?তাছাড়া আরজু জানতে চায় সেই নিষ্ঠুর রাতের বর্ণনা।এই মানুষটা ঠিক কতটা নির্মম ভাবে তার মাম্মা পাপার আজরাইল হয়ে এসেছিলো সবটাই শুনতে চায়।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_72

কয়েক বছর আগের কথা।নাহিদ তখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট।লেখাপড়া আর পলিটিক্স তার সমান তালে অগ্রসর হচ্ছে।তবে আজকাল নাহিদের কাজে মনোযোগ কম।হুটহাট মিটিং থেকে বেরিয়ে পড়ে।বিশেষ করে আরজুর স্কুল ছুটির সময়টায়।আরজুর স্কুল ছুটির সময়টায় নাহিদ আশেপাশেই উপস্থিত থাকতো।আরজুকে কিছুক্ষণ মন ভরে দেখতো।কিন্তু কখনোই তার মুখোমুখি হয়নি।কিন্তু ছুটে আসতো এক ঝলক সেই মায়াবীকে দেখতে।আরজু নামটা নাহিদের বুকে এমন ভাবে গেঁথে গেছিলো যে নাহিদ প্রতিদিন আরজুর এক ঝলক পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো। এটা নিয়ে অবশ্য আসফি অনেক মজা করতো।বার বার বলতো আরজুকে প্রপোজ করতে।কিন্তু নাহিদ বলতো

-“শালা!! আরজু একদমই বাচ্চা।প্রপোজ করলে দেখা যাবে কান্নাকাটি করে নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলেছে।আমাকে দেখলেই ভয়ে পালাবে।আর একটু ম্যাচিউর হোক।যে কিশোরী নিজের অনুভূতিই বুঝতে শেখেনি সে অন্যের অনুভূতি কি করে বুজবে?”

আসফি হেসে বলতো
-” এমন একটা বাচ্চাই তোর মনে ধরলো? বলা বাহুল্য পিচ্ছি ভাবিটা অনেক কিউট আছে।”

মা মারা যাবার পর এই প্রথম নাহিদকে এতটা উচ্ছ্বসিত দেখাতো।বাড়ির সকলের নজরেই বিষয়টা পড়েছে।একসময় বাড়ির সকলের কান অব্দি চলে আসে আরজুর নাম।এক কিশোরীর কারণেই নাহিদ আজ অতি স্বাচ্ছন্দ্যে সবার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।একজন রমণীকে মন দিয়ে বসে আছে জেনে নূরজাহান বেগম বেশ খুশি হয়েছিলেন।নাহিদের কাছ থেকে আরজুর ছবি দেখতে চেয়েছেন।কিন্তু নাহিদ জানিয়েছে

-” আরে সুইট দাদীজান আমি নিজেই ভালো ভাবে দেখতে পারিনি।পিচ্ছিটাকে আগে একটু বড়ো হয়ে দাও।তারপর একেবারে নতবৌ করে তোমার সামনে বসিয়ে রাখবো।মন ভরে দেখো।”

নাহিদকে আরজুর প্রতি ঝুঁকতে দেখে নিজামুল হক ভীষণ খুশি থাকলেও নাঈম মাহমুদ একটু চিন্তিত।কারণ একে ছেলে পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে তার উপর এই বয়সেই একটা মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত ছিলেন।তাছাড়া ছেলের সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়ন তো চলছেই।নাহিদ আরজুর ভাবনায় বিভোর থেকে কাজে ও পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলো।দুর থেকে কাউকে দেখে যে ভালোবাসা যায় সেটা নাহিদ প্রথম বুঝতে পারলো।নাহিদ বুঝতে পারতো, না আরজুর দেহে, না আরজুর সৌন্দর্যে বরং মায়াবী আরজুর মায়ায় আটকে গেছিলো সে।কারণ রূপের মায়ায় পড়লে তখন তার আসে পাশে রূপবতীদের কোনো কমতি ছিল না।আরজুর কিশোরী বয়সে তখনও সেই ওপর সৌন্দর্য তখন ফুটে উঠেনি।নাহিদকে এমন বেখেয়ালি হতে দেখে নাহিদের দাদাজান হেসে বললেন

-” আমার নাতি কি সেই কিশোরীর প্রতি বেশিই আসক্ত হয়ে পড়েছে নাকি?যদি বলো তবে সম্পর্কটাকে পাকাপোক্ত করে রাখতে পারি।”

-” নট নাও দাদাজান।পলিটিক্স এ নিজের একটা ভালো অবস্থান করে নেই তারপর না হয় এ বিষয়ে ভাববো।বাপ দাদার পরিচয়ে না বরং নিজের পরিচয়ে, নিজ যোগ্যতায় আরজুর বাবা মায়ের সামনে দাঁড়বো।”

নাতির দৃঢ় মনোভাব দেখে নিজামুল হক বেশ আপ্লুত হয়েছিলেন।

তার বেশ কিছুদিন পরের কথা।নিজামুল হক একদিন হুট করেই নাহিদের পছন্দের ব্র্যান্ড নিউ কার গিফট করলো।এই মডেলের জন্য নাহিদ অনেকদিন যাবত অপেক্ষা করছিল।সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার দরুন তাদের এই ইচ্ছে গুলো মুহূর্তেই পূরণ হয়ে যেত।নাহিদের দাদাজান সবসময় নাতি নাতনীদের সখের বিষয় গুলো বেশ খেয়ার রাখতেন।শুধু মাত্র নাহিদ না- জাহিদ,জেরিন,নীতি সবার ইচ্ছের বলার আগেই পূরণ করতেন।পরীক্ষা আর পার্টির নানান কাজে ব্যাস্ততার জন্য নাহিদ পছন্দের গাড়িটির একটা রাইড ও নেওয়ার সময় পাইনি।নাতিকে এতো স্ট্রেস দেখে নিজামুল হক নিজেই একদিন রাতে হুট করে নাতির কাছে আবদার করলেন লং ড্রাইভে যেতে।নাহিদ তখন তার ফ্রেন্ড গ্রুপে চ্যাট করছিলো।দাদার আবদারের কথা শুনে আসফি হেসে লিখেছিলো

-” আমাদের এমপি সাহেব জোস!!এমন একটা মর্ডান দাদা যদি আমাদের থাকতো তাহলে তো হতোই।কি বলিস সাদমান?”

সাদমান একটা সেড ইমজি দিয়ে লিখলো
-” আমাদের এমন ভাগ্য কই।জীবন তো নাহিদের।বিয়ের জন্য মেয়ে রেডি,পলিটিক্সে পজিশন রেডি,না চাইতেই সব চোখের সামনে রেডি।ফিলিং জেলাস ইয়ার।”

সাদমানের কথায় আসফি হেসে উঠলো।

প্ল্যান মোতাবেক রাতের গভীরে দাদা,নাতি বেরিয়ে পড়লেন লং ড্রাইভে।সখের গাড়ি, পাশের বন্ধুর মতো দাদাজান,আর নিস্তব্দ রাস্তা।সবটাই একদম মনোমুগ্ধকর।নিজামুল হক নিজেও বেশ খুশি।কাজের ব্যস্ততায় তিনি পরিবারে তেমন সময় দিতে পারে না।এই নিয়ে তার ঘরণী অভিযোগের শেষ নেই।তিনি জানেন ভবিষ্যতে নাহিদ ও ঠিক তার মতই এত ব্যস্ত লাইফ লিড করবেন।কারণ একজন নেতা হলে নিজের অনেক সখ বিসর্জন দিতে হয়।তাই বর্তমানে ছেলেটা জীবনটাকে একটু উপভোগ করুক।দুজনের পছন্দের গান চলছে গাড়িতে।অন্য সবার সামনে নাহিদ শান্ত থাকলেও দাদাজানের সামনে সে দুরন্ত।দুজন ড্রাইভ করতে করতে পার্টির বিষয়ে অনেক আলাপ আলোচনা করলো।আরজুর আঠারো হলেই নাতবৌ করে ঘরে তুলবেন সেই প্ল্যান ও নিজামুল হক করে ফেললেন।আরজুর বিষয় আসলেই নাহিদের চোখে মুখে দারুন গ্লো চলে আসে।ছেলেটা যেনো একটু লাজুক হয়ে উঠে।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই নাহিদ পিছনের একটা হলদে ট্রাক খেয়াল করলো।নাহিদ চিন্তিত হয়ে পড়লো।তার বিচক্ষণ ব্রেন বিপদের আভাস দিতে লাগলো।কারণ এই ট্রাকটা অনেকক্ষণ যাবত তাদের ফলো করছিলো।প্রথমে নাহিদ দেখেও তেমন পাত্তা দেয়নি।কিন্তু এই নির্জন রাস্তায় এই ভাবে কোনো গাড়ি অকারণে নিশ্চই ফলো করবে না।নাহিদকে বিচলিত হতে দেখে লুকিং গ্লাসে ট্রাকটা দেখে বিষয়টা নিজামুল হক বুঝতে পেরে গেলেন।চিন্তিত হয়ে বললেন

-“ওহ্ শিট।সিকিউরিটি ছাড়া এই ভাবে বের হাওয়া একদম ঠিক হয়নি।কিন্তু এতো রাতে আমরা বের হয়েছি কেউ জানলো কি করে?গাড়িটাও একদম নতুন।এই গড়িয়ে আমরা আছি সেটা বুঝার কথা না।কেউ নিশ্চই আমাদের বাইরে বের হওয়ার খবরটা লিক করেছে।নাহিদ স্পীড বারাও।আমাদের দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে।আমি চাইনা আমার জন্য বিরোধী দলের কেউ তোমার ক্ষতি করুক।”

নাহিদের বয়সটাও তখন কম।এই পরিস্থিতিতে সে অনেকটাই প্যানিক হয়ে পড়ল।নাহিদ যতো দ্রুত সম্ভব গাড়ির চালাতে থাকলো।পেছনে লোক গুলোর একমাত্র টার্গেট যে তার দাদাজান সেটা বুঝতে নাহিদের সময় লাগলো না।পর পর দুবার তার দাদাজান এমপি পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।তাই বিরোধী দলের নেতাদের প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে নিজামুল হকের প্রতি।তারা যেনো এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।তাকে সরাতে পারলেই রাস্তা অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়বে।
_______________

আরজুর বাবা সাদাত হাসান ও আরজুর মা সাবরিনা খানম পেশায় ইঞ্জিনিয়র।স্বামী স্ত্রী আর এক কন্যা নিয়ে তাদের সুখের জীবন।ঠিক যেমনটা প্রণয় কালে কল্পনা করেছিলেন ঠিক তেমন।দুজনই শিক্ষিত পরিবারে বড়ো হয়েছে।আর্থিক দিক দিয়েও তারা বেশ সচ্ছ।সাদাত আর সাবরিনা দুজনই স্বাধীনচেতা মনোভাবের।তাই তাদের একমাত্র কন্যাকেও তারা পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছেন।ছোট হলেও মেয়ের মতামতকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কাজের ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যেই তাদের শহরের বাইরে যেতে হয়।এই সময়টায় একমাত্র ছোটবোন সাবার বাসায় মেয়েকে রেখে তারা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।সাবা আর জুবায়ের দুজন একই এলাকায় থাকে বলে বেশ সুবিধা হয়েছে। সাবার সাথে আরজু বেশ ভাব।

অনেকদিন আগে মেয়েটা বাসায় ফিরে হঠাৎ আবদার করে বসলো তার ছোট ভাই,বোন চাই।যার সাথে সে খেলা করতে পারবে।কাজের ব্যস্ততা আর এক কন্যাকে নিয়ে তারা এতটাই বিভোর ছিলো যে দ্বিতীয় সন্তানের চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি।আরজুর আবদারের পর দুজনেই আরজুর ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় নামলেন।কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না।কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন তারা আবার বাবা মা হতে যাচ্ছেন।একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছিল অন্য দিকে লজ্জাও লাগছিল।কারণ ততদিনে আরজু অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে।আরজু যখন জানতে পারবে তার ছোট ভাই বোন আসতে যাচ্ছে তাহলে কেমন রিয়েক্ট করবে?খুশি হবে নাকি বিস্মিত হবে?

তারা অফিসের গাড়ি করেই ফিরছিলেন।সচরাচর তাদের শহরের বাইরের ট্রিপ গুলোতে অফিস গাড়ি প্রোভাইড করে থাকে।ড্রাইভিং সিটে আছে অফিসের বিশ্বস্ত আর দক্ষ ড্রাইভার লাবিব। সাদাতের সাথে লাবিবের বেশ সখ্যতা রয়েছে।নিস্তব্দ নগরীতে বেশ দক্ষতার সাথেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলো লাবিব। সাদাত বেশ রসিক মানুষ।তিনি মৃদু হেসে লাবিবকে বললো

-” লাবিব কি অবস্থা তোমার? শুনলাম আবার বাবা হয়েছ।আমার আগেই দুই সন্তানের বাবা হয়ে গেলে।”

লাবিব খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলো।লাজুক স্বরে বললো
-” আসলে স্যার,বড়ো মেয়েটার পর আমার বাচ্চা দের প্রতি অন্যরকম মায়া সৃষ্টি হয়েছে।তাই ভাবলাম আরেকটা মেয়ের হলে মন্দ হয়না।”

সাদাত দুষ্টু হেসে প্রিয়তম স্ত্রীর দিকে তাকালেন।সাবরিনা ভীষণ লজ্জা পেয়ে জানালার বাইরে তাকালেন।সব ঠিক থাকলে তারাও দ্রুত দ্বিতীয় সন্তানের পিতা-মাতা হবেন। সাদাত আবার বললেন

-” মাশাআল্লাহ তোমার ঘরে দুইটা জান্নাত। তা মেয়েদের নাম কি রেখেছো?”

-” বড়ো মেয়ের নাম লামিয়া আর ছোট মেয়ের নাম লামিসা।”

-” মাশাআল্লাহ দারুন হয়েছে।”

তারপর সাবরিনার কানের কাছে এসে চুপি চুপি বললেন
-” আমাদেরও কিন্তু নাম ঠিক করে ফেলা প্রয়োজন।আরজুর নামের সাথে ম্যাচ করে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে নাম চুজ করবো।আর যদি বাই এ্যানি চান্স টুইন্স হয় তাহলে তো কথাই নেই।”
সাবরিনা সাদাতের বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বললো
-” মধ্যে বয়সে বাবা হয়ে বেশ আনন্দে আছো দেখছি?”

-” হবো না মানে?আমার আরজুর মতো আরেকটা কিউটি বাচ্চা আমার কাছে এসে পাপা পাপা বলবে।ভাবতেই সুখ সুখ লাগছে।”

এমন দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছে তারা।কিছুদূর যেতেই ট্রান নিয়ে ডান দিকে মোড় নিতেই লাবিব দেখলো একটা গাড়ি রং সাইড দিয়ে ধেয়ে আছে।গাড়ির স্পীড এতো বেশি দেখে লাবিব ঘাবড়ে গেল।আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে গেলো।কিন্তু কোনো কিছু বুজে উঠার আগেই সামনের গাড়িটি দ্রুত গতিতে তাদের গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়।ফলে দুই গাড়ির মধ্যে বিকট সংঘর্ষ হয়।মুহূর্তের মধ্যেই সকলেই গাড়ির ভেতর সকলেই সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়।কয়েক সেকেন্ড পরই চারদিকে নিস্তব্দতা ছেয়ে যায়।
___________

নাহিদ যখন দেখলো সেই ট্রাকটি তাদের দিকে ধেয়ে আসছে সে আর কোনো দিক বেদিক দেখার সুযোগ পায়নি।যেদিকে পেরেছে গাড়ি সে দিকেই ছুটিয়েছে।যে করেই হোক দাদাজান কে বাঁচাতে হবে।এসব ভাবনার মাঝেই কখন যে রং সাইডে চলে গেছে নিজেই বুঝতে পারেনি।সামনে অন্য কোনো গাড়ি ছিলনা তাই নাহিদ ফুল স্পীডে গাড়ি ড্রাইভ করছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই অপর পাশ থেকে এই রোডে একটা গাড়ি চলে আসায় নাহিদ স্পীড সামলাতে পারেনি।ফলে মুহূর্তেই বিকট শব্দে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়।চারপাশের বাতাসেও যেনো সেই নিস্তব্দতা প্রকাশ পাচ্ছে।নাহিদ হতবম্ব হয়ে পড়ে।বেশ কিছুক্ষন পর নাহিদের হুস ফেরে।মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে সে।কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে।কানে যেনো ঝি ঝি পোকা ভন ভন করছে।মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।দুহাতে মাথা চেপে ধরে আশেপাশে তাকানোর চেষ্টা করে।কিন্তু সব কিছুই কেমন ঝাপসা।নাহিদ অনেক কষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দাদাজান কে দেখার চেষ্টা করে।গাড়ির জানালার কাচ ভেঙে বেশ আহত হয়েছেন নিজামুল হক। কয়েকটা কাচ তার গায়ে বিধেছে।আধো আধো চোখে তাকিয়ে আছে নাহিদের দিকে।কিন্তু একদমই নড়াচড়া করতে পারছেন না।নাহিদ সামনের গাড়িটির দিকে নজর দিলো।ড্রাইভার মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে।সেখান থেকে অঝর ধারায় রক্ত ঝরছে।পেছনের সিটে থাকা দুজন ব্যাক্তির মধ্যে রমণীর জানালার কাচ সারা গায়ে বিধে ক্ষত বিক্ষত অবস্থা।তিনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।পুরুষটির একটি হাত প্রায় ভেঙে গেছে তবুও তিনি নিজ স্ত্রীকে নিয়ে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছেন।নাহিদের চোখ ভিজে উঠলো।তাদের জন্য অন্য মানুষ গুলো সাফার করছে।নাহিদ তাদের সাহায্য করতে নাহিদ গাড়ির দরজা খুলে সামনের গাড়িটির কাছে যেতে উদ্যত হতেই দেখলো সেই ট্রাকটি তার গাড়ির দিকে আবার ধেয়ে আসছে।নাহিদ বুঝতে পাড়লো আজ তার আর দাদাজানের প্রাণ নিয়েই শত্রুপক্ষ দম নিবে।এই পরিস্থিতিতে কি করবে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।সারা শরীর ঘামে ভিজে উটেছে।নাহিদের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।দুহাতে চোখের জল মুছে দ্রুতই দাদাজান এর দিকে তাকালো।তিনি বেশ আহত।সজ্ঞানে আছেন বলে মনে হয়না।এই মুহূর্তে গাড়ি থেকে তাকে বের করার সময় অব্দি পাবে না।তার আগেই ট্রাকটি তাদের পিষে চলে যাবে।নাহিদ আর কিছুই না ভেবে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করলো।কিন্তু ব্র্যান্ডেড গাড়িটির সামনের দিক অনেকটাই থেতলে গেছে। অপর দিকে সেই দ্রুতগামী ট্রাকটি অনেকটাই কাছে চলে এসেছে।নাহিদের হাত পা কাঁপতে লাগলো।মনে মনে বার বার মহান আল্লাহ কে স্মরণ করতে লাগলো।এমন বাজে পরিস্থিতিতে সে কখনোই পড়েনি।ট্রাকটি যখন তাদের খুব কাছে চলে আসলো ঠিক সেই মুহূর্তেই নাহিদের গাড়িটি স্টার্ট হয়ে এতো স্পীডে আগালো যে সেটা নাহিদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।কয়েক মিটার সামনে রাস্তার পাশের দেয়ালে বেশ বাজে ভাবে সংঘর্ষ হয়।নাহিদ গাড়ির সামনে কাচ ভেঙে রাস্তায় ছিটকে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে।সারা শরীর তার রক্তে ভিজে উঠেছে। পিট পিট চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো নাহিদ।দাদাজান গাড়ির ভেতরেই আছেন।তার কি অবস্থা নাহিদের জানা নেই।তার গাড়িটি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ধুমরে মুচড়ে গেছে।নাহিদের চোখের পাশ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।সে ঝাপসা চোখে দেখলো সেই ট্রাকটি এতটাই স্পীডে আসছিল যে নাহিদের গাড়ি সরে যাওয়ার পর সেটা নিয়ন্ত্রণ না হয়ে সোজা সাদাতদের গাড়িটিকে পিষে ফেলেছে।কারণ তাদের গাড়িটি নাহিদের গাড়ির পেছনেই ছিলো।নাহিদ গাড়ি মুভ করায় ট্রাকটির সামনে সাদাত দের গাড়ি চলে আসে।সেই বিভৎস দৃশ্য দেখে নাহিদের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।সামনের সবটাই কেমন ধোঁয়াশা হয়ে এলো।তার সারা শরীর কেমন অবস মনে হচ্ছে।নাহিদ যেনো তীব্র যন্ত্রণায় গভীর নিদ্রায় হারিয়ে গেলো।নাহিদের নিথর শরীরটা পড়ে রইলো নির্জন রাস্তায়।

নিস্তব্দ, নির্জন রাস্তায় পড়ে রইলো কয়েকটি আহত প্রাণ।এই গভীর রাতে কেউ ছিলনা তাদের একটু সাহায্য করার জন্য।ঠিক এই ভাবেই কতটা সময় কেটেছে নাহিদের জানা নেই।নাহিদ চোখ খুলে নিজেকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলো।কয়েক মুহূর্ত লাগলো তার সব মনে করতে।সারা শরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে।উঠে বসার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।সে পাশের দেয়ালের সাহায্যে খুব কষ্ট উঠে দাড়ালো।দেখলো সে ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে সর্ব প্রথম দাদাজানের কাছে গেলো।দাদাজানের মাথা ফেটে রক্ত পড়ে তা প্রায় শুকিয়ে গেছে।নাহিদ ভাঙ্গা গলায় দাদাজানকে ডাকলো।সারা শরীর ঝাকিয়ে ডাকার পরও কোনো সারা পাওয়া গেলো না।নাহিদ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।এই মানুষটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। দাদাজানের কিছু হলে সে নিজেকে কখনোই মাফ করতে পারবে না।নাহিদ কাদতে কাদতে ভয়ে ভয়ে কাপা হতে দাদাজানের হাতের নার্ভ চেক করলো।দেখলো খুব ধীরে গতিতে চলছে।নাহিদ যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ছেলেটা।দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করলো।ফোনের স্ক্রিন ভেঙে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।নাহিদ অনুমান করে দ্রুত তার চাচা কে কল করে সংক্ষেপে সবটা জানালো।কল কেটে নাহিদ পেছনে তাকালো।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সাদাত দের গাড়ির কাছে এসে যেনো দম বন্ধ হয়ে আসলো।গাড়ির ড্রাইভারের গলায় কাচ বিধে আছে।মাথাটা কেমন থেতলে গেছে।নাহিদের আর বুঝতে বাকি নেই যে মানুষটি আর নেই।কাপা কাপা হাতে পেছনের দরজা খুলে দেখলো ভদ্র মহিলাটির হাত থেতলে গেছে।বেকায়দায় তিনি উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।নাহিদ দ্রুত নার্ভ চেক করে দেখলো সবটাই নিস্তব্দ।নাহিদ কাপা কাপা হাতে নাকের কাছে আঙুল রেখে বোঝার চেষ্টা করো শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা। কিন্তু না।নাহিদ খিচে চোখ বুজে নিলো।এই মানুষটিও আর বেঁচে নেই।নিজেকে এতটা অসহায় লাগছিল যে বলে বুজাতে পারবে না।একপ্রকার আসা ছেড়ে ভদ্রলোকের নার্ভ চেক করে নাহিদ চমকে গেলো।তার নার্ভ ধিরো গতিতে চলছে।ততক্ষণে বেশ কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে।পেছনে চাচার গাড়ি দেখে নাহিদের সারা শরীর যেনো শক্তি হারিয়ে ফেললো।ভরসা যোগ্য মানুষকে পেয়ে নাহিদের শরীর অসাড় হয়ে আসলো।শক্তপোক্ত ছেলেটিও ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল।নকীব মাহমুদ দৌড়ে নাহিদের কাছে আসতেই ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো আর কয়েক মুহূর্তেই জ্ঞান হারালো।