#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_76
সময় যেনো স্রোতের ন্যায় বয়ে চলে।সাবিহার ক্ষেত্রেও তাই।মিরাজ নামক মানুষটির সাথে তার বিয়ে ঠিক হলেও মানুষটিকে তার একবার দেখা হয়েছে।লোকটির দিকে সাবিহা ফিরেও তাকায়নি।বাবা তাকে ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ভালোবেসে। সাবিহাও বাবার বাধ্যগত সন্তান ছিল।বাবাকে প্রচন্ড সম্মান করে মেয়েটা।কোনোদিন বাবার মুখের উপর কোনো কথা বলতে পারেনি।বাবাও তার সকল ইচ্ছা না চাইতেই পূরণ করেছে।কিন্তু তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন সিদ্বান্ত বাবা এতো দ্রুত নিচ্ছেন কেনো? তার মতামতের দিকেও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না।আজ দুদিন যাবত মেয়েটা নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে।রুমের বাইরে একদমই বের হয়নি।সাবিহার মা মেয়ের এই অস্থিরতা বুঝতে পারলেও স্বামীর মুখের উপর কিছুই বলতে পারছেন না।মানুষটা ছেলে মেয়েদের অসম্ভব ভালোবাসলেও নিজের স্ট্যাটাস নিয়ে বেশ সচেতন।উচ্চবিত্ত বন্ধুবান্ধবের সাথে তার উঠাবসা।সেখানে মেয়েকে নিতান্তই বেকার এতিম ছেলের হাতে নিশ্চই তুলে দিবেন না।বেশ বিচক্ষণ মানুষ তিনি।মেয়েকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে কিছুতেই ধাবিত করবেন না।
সাবিহার রুমের দরজায় নক করলেন সাবিহার বাবা।সাবিহা দরজা খুলে দিল।বাবাকে দেখে মাথা নিচু করে নিলো।মেয়ের ফোলা চোখ দেখে বুঝতে পারলেন মেয়ে প্রচুর কেঁদেছে।সাবিহার বাবার ভীষণ কষ্ট লাগলেও সেটা মুখে প্রকাশ করলেন না।কখনো কখনো সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য বাবা-মাকে শক্ত হতে হয়।তিনি রুমে ঢুকে বললেন
-“সারাক্ষণ রুমে বসে থাকলে চলবে? আর কয়টা দিন আমাদের সাথে আছো।বাবা মাকে একটু সময় দিতে পারো।বিয়ের কনেকে এতো মন মরা মানায় না।আমার মেয়েকে হাসি খুশি মানায়।”
সাবিহার চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।বুকের ভেতরে চলা উত্তাল ঢেউ সে কি করে সামলাবে?সাবিহার বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-“যার জন্য এমন মনমরা হয়ে আছো সে কি আদৌ তোমার খবর রেখেছে? তোমার বিয়ের খবর শুনে কি সে কোন রকম বিচলিত হয়েছে?”
সাবিহা কিছুই বলতে পারলো না।সাবিহার বাবা আবার বললেন
-” হয়তো বুজে গেছে সে তোমার যোগ্য না।নিজেকে তোমার সামনে দার করানোর কোনো যোগ্যতা তার নেই।তোমাদের এই বয়সে ভুল মানুষকে পছন্দ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।তাই নিজেকে সামলে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও।সমাজে আমার একটা সম্মান আছে।সেটা ক্ষুন্ন করোনা।বাবা মা সর্বদাই সন্তানের ভালো চায়।”
সাবিহা মাথা নিচু করে সবটাই শুনলো।আজ একটাবার রামিম যদি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতো তবে বাবার সাথে তর্ক করে হলেও রামিম কে চাইতো।কিন্তু সেই পথ রামিম বন্ধ করে রেখেছে।নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।
____________________
আজ সাবিহার গায়ে হলুদ।বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজন ভিড় করেছে। সাবিহার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে।নিজেকে শেষ করে দিতে পারলে এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়া যেত।বিকেলেই আরজু,জারা আর রিমি সাবিহাকে নিয়ে পার্লারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়েছে।সাবিহার বিয়েতে আরজু আর বাকি বন্ধুরা মোটেও খুশি হতে পারছে না।অথচ তাদের কতো প্ল্যান ছিল বন্ধুমহলের সকলের বিয়েতে অনেক আনন্দ করবে।আরজু হুট করে বিয়ে করে নিলো।আর অন্যদিকে সাবিহার বিয়েটা কেউ মানতে পড়ছে না।তবে পরিস্থিতি এমন যে সাবিহাকে একা ছাড়তেও পড়ছেনা।কিন্তু পার্লার থেকে বেরিয়েই সাবিহা অদ্ভুদ কাণ্ড করে বসলো।নিজের সকল অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।তাই সে সোজা বেরিয়ে পড়লো রামিমের বাড়ির উদ্দেশে।
আরজু,জারা রিমি রীতিমতো অবাক।তবে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো।সাবিহা সব কিছুর উর্ধ্বে নিজের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছে। এখন রামিমের পালা।
ফুয়াদ আর শুভ কেউ সাবিহার হলুদে যায়নি।দুজনেই ভীষণ চিন্তিত সামনের ভবিষ্যৎ নিয়ে।রামিম ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট টাইপের ছেলে।নিজেকে কারো সামনেই প্রকাশ করতে চায়না।অন্য দিকে সাবিহা বাবাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা ও সম্মান করে।বাবার কথার বিপরীতে তেমন কিছুই বলতে পারবে না।
রামিম অন্ধকার রুমে চুপটি করে বসে আছে।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।প্রিয়তমাকে অন্য কারো হতে দেখার চাইতে যন্ত্রণার বোধয় আর কিছুই নেই।কিন্তু সে বড্ডো অসহায়।ঠিক তখনই ডোরবেল বাজতেই চোখ মুছে দরজা খুলতেই চমকে গেলো।সাবিহা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।বাসন্তী লেহেঙ্গাতে চমৎকার লাগছে।বউ সাজে সব মেয়েকেই এতো মোহনীয় লাগে নাকি সাবিহাকে একমাত্র এমন লাগছে রামিম ঠিক ঠাহর করতে পারলো না।রামিম মুগ্ধ চোখে সাবিহার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু পেছনেই আরজু,জারা আর রিমিকে দেখে নিজেকে সামলে নিলো। হতবম্ব হয়ে প্রশ্ন করলো
-” তোরা? ”
সাবিহা এগিয়ে এসে রামিমকে জড়িয়ে ধরলো।রামিম যেনো হতবাক। রামিমের হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই চলছে।সাবিহা রামিমকে জড়িয়ে কাদতে লাগলো।রামিম দ্রুত সাবিহাকে দূরে সরিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো
-” সাবিহা তোর মাথা ঠিক আছে? তুই এই সময়ে এখানে কি করছিস?”
সাবিহা ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো
-” আমি চলে এসেছি রামিম।ওই বিয়ে আমি কিছুতেই করছি না।তোকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভাবতেই পারি না।”
রামিম রেগে বললো
-“তোর মাথা ঠিক নেই।এই ভাবে পালিয়ে আসার মানে কি?বাসায় ফিরে যা।তোকে আমি কখনোই কোনো কমিটমেন্ট করিনি।আর না বলেছি তোকে ভালোবাসি।তবে কি কারণে তুই বাবার সম্মানকে পায়ে ঠেলে এসেছিস।”
-” আমি তোকে ভালবাসি রামিম।আর তুই ও বাসিস।যদি নাই বাসতি তবে কান্না কেনো করছিলি?ভালোবাসার কথা সব সময় মুখে বলতে হয়না।তুই কেনো আমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছিস? যেখানে আমি তোকে ভালোবেসে তোর জীবনের সকল কষ্ট আপন করে নিতে চাইছি।”
রামিম কি বলবে বুজে উঠতে পারছে না।এই মেয়েটা তার দৃঢ় মনোবল ভেঙে ছাড়বে।তাই রেগে সাবিহার বহু চেপে বললো
-“হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? কাল তোর বিয়ে।একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে রেখে তুই আমার মতো একটা ছেলের কাছে এসে দয়া দেখাচ্ছি?আমাকে মোটেও দুর্বল ভেবে দয়া দেখবি না।আমি তোর যোগ্য নই।বাসায় ফিরে যা সাবিহা।আমি তোকে ভালবাসিনা।”
সাবিহা অস্থির হয়ে বললো
-” কেনো মিথ্যা বলছিস? কেনো আমাকে এই মরণ যন্ত্রণা দিচ্ছিস? তোর জন্য আমি সব ছেড়ে এসেছি আর তুই আমার দিকে একটা কদম বাড়াতে ভয় পাচ্ছিস?”
-” আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না।তুই বাসায় ফিরে যা।আমি একা থাকতে চাই।আর আরজু তোরাও ওর পাগলামিতে সায় দিচ্ছিস?ওকে নিয়ে যা।”
সাবিহা প্রচন্ড রেগে রামিমের গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।রাগে মেয়েটার শরীর থরথর করে কাপছে।রেগে বললো
-“নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে তোর মত একটা কাপুরুষকে ভালোবেসে ছিলাম।যার জন্য নিজের বাবার সম্মানকে বলি দিয়ে ছুটে এসেছি সে এই প্রতিদান দিচ্ছে?যে মনের পীড়া অনুভব করতে পারেনা তার সামনে হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি প্রকাশ করা বৃথা।সেই ভালোবাসার কি প্রয়োজন যা হৃদয়কে ভেঙেচুরে পঙ্গু করে দেয়।তোর সামনে আমি কোনোদিন ভালোবাসার আকুতি নিয়ে ফিরবো না।কোনো দিন না।”
সাবিহা রেগে রামিমের সামনে থেকে সরে আসল। জারা প্রচন্ড রেগে গেলো রামিমের উপর।এসব ফাজলামির মানে কি? সেও প্রচন্ড রেগে রামিমের গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।টিশার্ট খামচে বললো
-” তোকে আমার বন্ধু ভাবতে লজ্জা লাগছে।আমাদের গ্রুপের সবচাইতে মেচিউর মানুষটা আজ এমন ইম’ম্যাচিউর কাজ করবে আমি ভাবতে পারিনি।”
আরজু টেনে জারাকে সরিয়ে আনলো।জারা তখনও রাগে ফুসফুস করছে।আরজু রামিমের চোখে মুখে বিষাদ দেখতে পাচ্ছে।কিন্তু ছেলেটা কেনো সাবিহাকে অগ্রাহ্য করছে?আরজু শান্ত সুরে বললো
-” তুই মুখে একথা বলছিস আর তোর চোখ আরেক কথা বলছে। কেন এই লুকোচুরি করছিস আমি ঠিক জানিনা। তবে এসব কিছুর জন্য তোদের দুজনের জীবনেই বিপর্যয় নেমে আসবে।দুজনের কেউই সুখী হতে পারবি না।আজকের এই সময়টা আর কখনোই আসবে না রামিম।কেনো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিস?মেয়েটা নিজে তোর বর্তমান পরিস্তিতি জেনেও তোর জীবনে জড়াতে চাইছে।সত্যিকারের ভালোবাসা জীবনে বার বার আসে না।সেটাকে এই ভাবে হাতছাড়া করিস না।”
রামিম আরজুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” সত্যিকারের ভালোবাসা তো তুই ও পেয়েছিস।তাহলে তুই কেনো সেটা হাতছাড়া করছিস?”
আরজু থমকে গেলো।দৃষ্টি কেমন ঘোলা হয়ে আসছে।আরজু শুকনো ঢোক গিলে নিজের কান্না রোধ করলো।আরজু আর এক মুহুর্ত দাড়ালো না।সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।
আরজু বেরিয়ে আসতেই ধপাস করে মেঝেতে বসে দুহাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে উন্মাদের মত গলা ফাটানো চিৎকার করতে লাগল রামিম। এই হাহাকার বোঝার ক্ষমতা বোধহয় পৃথিবীর একটি প্রাণীরও নেই।কি করে সাবিহাকে আটকাবে?
সেই সন্ধায় সাবিহা একদম মূর্তির নেয় বসে ছিল।সবাই একে একে তাকে হলুদ দিচ্ছে।কিন্তু মেয়েটার কোনো হুস ছিলো না।সাবিহার মা মেয়েকে এমন অসাড় হয়ে থাকতে দেখে বার বার আঁচলে চোখ মুছলেন।সেই রাতে আরজু ওরা সাবিহাকে একা ছাড়লো না।কখন কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে কে জানে?সেই রাতে আর কারো ঘুম হলো না।সকাল হতেই আবার বিয়ে বাড়ির ব্যাস্ততা শুরু।
সাবিহা বধূ বসে বসে আছে।মুখে নেই কোনো উজ্জ্বলতা।সাবিহার মলিন মুখটা দেখে আরজুর চোখ ভিজে উটছে।ভালোবাসার মানুষটির থেকে সামান্য দূরত্ব ঠিক কতটা যন্ত্রণা দায়ক আরজু তা খুব ভালো করেই জানে।জারার আজ বার বার কান্না আসছে।সাবিহার এই মলিন মুখটা একদম সহ্য হচ্ছে না।রিমি সাবিহার হাত ধরে বসে আছে। কাল রামিমের বাসা থেকে ফিরে মেয়েটা মুখ ফুটে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।রুমে কেমন পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে।অথচ আজ তাদের কতো উল্লাস করার কথা ছিল।কিন্তু কেউ সাবিহাকে সান্তনা দেবার ভাষা খুজে পাচ্ছে না। হঠাৎ বাইরে শোরগোল শুনে ওরা চমকে গেলো।রিমিকে সাবিহার পাশে রেখে আরজু আর জারা বাইরে গেলো দেখতে।আরজু কিছুটা সামনে এগিয়ে দেখলো গেটের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি।বেশ কিছু সিকিউরিটি একটা গাড়ি ঘেরাও করে দাড়িয়ে আছে।আরজু ঘাড় কাত করে সেদিকেই তাকিয়ে রইল।জারা নিজেও উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। হঠাৎ গাড়ি থেকে একজনকে বের হতে দেখে আরজুর মুখ হা হয়ে গেলো।জারা নিজেও হতবাক।সে আরজুর কানে বির বির করে বললো
-” আমাদের মেয়র জিজু সাবিহার বিয়েতে কি করে? মেয়র সাহেব বউয়ের বিরহে পাগল হয়ে গেলো নাকি?বউ যেখানে বান্দা সেখানে।”
আরজু যেনো জারা কথা শুনতেই পেলো না।সে অবাক দৃষ্টিতে নাহিদকে দেখে যাচ্ছে।নাহিদ এক পলক আরজুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনের দিকে দ্রুত চলে গেলো।আরজু ভেবে পেলনা নাহিদের আগমনের কারণ।
সাবিহার বাবা হঠাৎ নিজ মেয়ের বিয়েতে শহরের মেয়রকে দেখে ভরকে গেলেন।তিনি ভাবতেই পারেনি এতো বড়মাপের ব্যাক্তি তার মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছে।তবে এই মুহূর্তে তিনি ভীষণ চিন্তিত।নাহিদের আসার কারণ তিনি ঠাহর করতে পারছেন না।তাই দ্রুত নাহিদের দিকে এগিয়ে আসলেন।অনুষ্ঠানের সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদকে দেখেই সাবিহার বাবা মৃদু হেসে বললেন
-” স্যার আপনি আমার বাসায়?আমি তো ভাবতেই পারছি না।কিছু হয়েছে স্যার?”
নাহিদ আড়চোখে আশেপাশের সকলের উৎসুক দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললো
-” সৈকত সাহেব আপনি অস্থির হবেন না।আমি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে পারি?”
সৈকত সাহেব কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।তিনি নাহিদকে নিয়ে পাশের একটি রুমে চলে গেলেন।অন্য দিকে আরজু আর জারা হতবাক হয়ে সবটা দেখছে।ঘটনা ঠিক কি ঘটছে তারা বুঝতে পারছে না।জারা আরজুকে টেনে দরজার পাশে দাঁড়ালো।ভেতরে কি হচ্ছে না জানা অব্দি জারার পেটের গুর গুর কিছুতেই কমবে না।
নাহিদ একটা সিঙ্গেল সোফায় বেশ আয়েস করেই বসে আছে।তার সামনেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে সাবিহার বাবা।একজন পাওয়ার ফুল নেতা এই ভাবে তার বাসায় আসার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।নাহিদ পাঞ্জাবীর হাতা গুটাতে গুটাতে বললো
-” দেখুন সৌকত সাহেব, আমি জানি আমাকে হঠাৎ দেখে আপনি চিন্তায় পরে গেছেন।চিন্তার কিছু নেই।রেলেক্স হন।আজ আপনার মেয়ের বিয়ে।একজন বাবার জন্য এই দিনটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমি জানি।ছেলে মেয়ের সুখের জন্য বাবা মা কতো কিছু করে।তবে আপনি কি সিওর যে আপনার মেয়ে এই বিয়েতে খুশি?”
সাবিহার বাবা ঘাবড়ে গেলেন।চোখ ছোট করে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।নাহিদ মৃদু হেসে বললেন
-” যেই সন্তান কে এতো ভালোবেসে বড়ো করেছেন,তাকে এতো স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেই সন্তানের পরবর্তী জীবন নিয়ে আপনার চিন্তা স্বাভাবিক।বাবা মা সন্তানের সর্বোচ্চ সুখের কথা চিন্তা করে।কিন্তু অনেক সময় বাবামা সন্তানের ভালো চাইতে যেয়ে অনেক খারাপ করে ফেলে।আপনি খুব ভালো করেই জানেন আপনার মেয়ে অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসে।তাহলে কেনো তাকে অন্যত্র বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছেন?”
সাবিহার বাবা বুঝতে পারলেন নাহিদ রামিমের কথা বলছেন।তিনি অবাক হলেন নাহিদ কি করে সাবিহা আর রামিমকে চেনে?তিনি আমতা আমতা করে বললেন
-” দেখুন স্যার আমি তিলে তিলে সমাজে আমার একটা অবস্থান তৈরি করেছি।সমাজের উচ্চ ব্যক্তিবর্গের সাথে আমার চলাফেরা। আমার মেয়েকে যদি একটা বেকার, পরিবারহীন, নিন্মবিত্ত ছেলের কাছে বিয়ে দেই তবে সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।আমার মেয়ে ভীষণ ইমোশনাল।সে আবেগী হয়ে ভুল সিদ্বান্ত নিতে চাইলে বাবা হিসেবে তাকে সুদ্রে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
নাহিদ মৃদু হাসলো।বললো
-” মেয়ে যদি সুখেই না থাকে তবে কি হবে অর্থসম্পদ দিয়ে?মেয়ের চোখের অশ্রুর চাইতে নিশ্চই সমাজ আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ন না।দেখুন রামিম খুব ভালো একটা ছেলে।আজকালকার যুগে এতটা ক্লিন ক্যারেক্টারের ছেলে পাওয়া দুষ্কর।ছেলেটাকে আমি বেশ কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি।রামিম কেমন ছেলে সেটা আপনি নিজেও জানেন। বর্তমানে ছেলেটার আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও সে যথেষ্ট ব্রাইড একটা রেস্টুরেন্ট।ছেলেটা আমেরিকার টপ একটা ভার্সিটিতে স্কলার্শিপ পেয়েছে।এটা খুব সাধারণ বিষয় না।আপনি আমি কিন্তু সেটা পারিনি যা এই ছেলেটা মেধা দিয়ে করে দেখিয়েছে।রামিম কিন্তু এই খবরটা আপনাকেই সবার আগে জানিয়েছিল।মনে অনেক সাহস যুগিয়ে আপনার কাছে সাবিহার হাত চেয়েছিলো।কিন্তু আপনি তখনও ডিনাই করেছেন।উল্টো ছেলেটাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে সাবিহার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।আপনি ছেলেটার অর্থ সম্পদ বিচার করেছে।অথচ ছেলেটার মেধা,বুদ্ধিমত্তা,সুশীল ব্যাবহার আর প্রগাঢ় ব্যাক্তিত্ব দেখেননি।”
দরজা পাশে দাড়ানো আরজু আর জারা এসব শুনে অবাক হয়ে গেলো।এতো কিছু ঘটে গেছে আর তারা কিছুই জানে না।কিন্তু নাহিদ এতো কিছু কি করে জানে।জারা আরজুর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-” তোর নেতা সাহেব কি আমাদের সবার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে। ও মাই গড! তার মানে তোর জামাই নিশ্চই আমার পেছনেও স্পাই লাগিয়েছে।”
আরজু বিরক্ত হয়ে জারার দিকে রেগে তাকালো।তারপর আবার দরজায় কান পাতলো।
নাহিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবিহার বাবার গলা শুকিয়ে গেলো।এতো ভেতরের খবর নাহিদ কি করে জানে ভেবে পেলেন না।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবিহার বাবার হাতে হাত রেখে কোমল সুরে বললো
-” আমি বুঝতে পারছি আপনার কনসার্ন।মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আপনি চিন্তত।একজন বাবা হিসেবে এটা স্বাভাবিক।কিন্তু মেয়েকে বড়ো ঘরে বিয়ে দিয়েও যদি সুখী না দেখেন তখন?অর্থ কখনোই সুখ আনতে পারে না।সাবিহা আর রামিম আমার ছোট ভাইবোনের মতো।আমি চাইনা ছেলে মেয়ে দুটো সারা জীবন মানুষিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকুক। রামিমের মা একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন।শিক্ষিত নারী ছিলেন আর সন্তানকেও শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন।স্বামী ছাড়া একজন নারী হয়ে এই সমাজে মাথা উচু করে চলেছেন।ছেলেকে নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন।যেই নারী এই সমাজে নিজেকে সম্মানের সাথে টিকিয়ে রাখতে জানে সেই নারীর সন্তান ঠিক কতটা বাস্তববাদী আর কর্মঠ সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।বাবা মাকে হারিয়ে ছেলেটা এতিম।তবুও কখনো বিপথে যায়নি।আর না আছে কোনো বাজে অভ্যাস।শত কষ্টেও কখনোই করো কাছে কোনো দয়া চায়নি।নিজে পরিশ্রম করে যাচ্ছে।সব কিছু হারিয়ে যদি শেষে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলে তবে ছেলেটার জন্য বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।আপনি একজন বাবা।একটিবার সেই স্নেহময় বাবার দৃষ্টিতে ছেলেটার কথা বিবেচনা করে দেখুন।”
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো
-” রামিম ব্রাইট স্টুডেন্ট। ফিউচারে অনেক ভালো কিছু করবে আমার বিশ্বাস।আমেরিকায় ভালো গবেষণার সুযোগ আছে।সেখানে খুব সহজেই সেটেল হওয়া সম্ভব।আমি দেখতে পাচ্ছি ছেলেটার ব্রাইট ফিউচার।আপনি ছেলেটাকে তিনটা বছর সময় দিন।আমি নিজে রামিমের দায়িত্ব নিচ্ছি।আপনি আমার ভরসায় মেয়েটাকে রামিমের হাতে তুলে দিন।আপনার মেয়ে রামিমের সাথে ভালো থাকবে।নিজের পছন্দের মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।আর সেই সৌভাগ্য নিজের বাবার হাতে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের।আপনার মেয়ে আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে,সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে।তাইতো আপনার বাধ্যগত সন্তান হয়ে নিজের অনুভূতি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।সন্তান যদি বাবামায়ের সম্মান রক্ষার্থে সেক্রিফিজ করতে পারে তবে বাবা হয়ে আপনি কেনো পারবেন না মেয়ের অনুভূতির মূল্য দিতে?ছেলেটা একটি সুযোগ ডিজার্ভ করে।আপনি কি রামিম কে একটা সুযোগ দেবেন?”
সাবিহার বাবার চোখ ভিজে উঠলো।আসলেই মেয়েকে উচ্চবিত্ত পরিবারের বিয়ে দিলেও সুখের নিশ্চয়তা দেওয়া অসম্ভব।তিনি মেয়ের ভবিষ্যৎ সিকিউর করতে চেয়েছেন।কিন্তু মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করেনি।যদি মেয়ে সুখেই না থাকে তবে সামাজিক মর্যাদা আদো কাজে আসবে?রামিম ছেলেটা নিঃসন্দেহে ভালো।সুশীল চরিত্রে।তিনি বর্তমান চিন্তা করে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু অদূর ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে ছেলেটা একদমই ফেলনা নয়।তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে নাহিদের দিকে তাকালো।
নাহিদ সাবিহার বাবার পিঠে আলতো ছুঁয়ে ভরসা দিয়ে বললো
-“পাত্রপক্ষ কি বলবে এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।এই দিকটা আমি সামলে নিবো। রামিমের ফ্লাইট কাল।আপনি নিশ্চই জানেন আপনার কি করণীয়।”
সাবিহার বাবা নাহিদের হাত ধরে কেঁদে উঠলেন।আসলেই কেউ তাকে এমন করে বুঝায় নি।তিনি তো মেয়েকে উচ্চ বংশে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন।কিন্তু তার শান্ত স্বভাবের মেয়েটি যে ঘুমড়ে ঘুমড়ে মরছিল সেটা দেখেও না দেখার ভান করে গেছেন।ক্ষতি কি একটাবার রামিম কে সুযোগ দিলে?
জারা নিচের ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো
-” ইসস!! আংকেল যদি একবার জানতে পাড়ে তার শান্ত শিষ্ট মেয়েটা তার সম্মানে একগ্লাস জল ঢেলে পালিয়ে গেছিলো।তাহলে এই অনুশোচনের বদলে এই মুহূর্তেই মেয়েকে পটিয়ে বিয়ে দিতে দিতো।”
আরজু জারার মাথায় চাপড় মেরে বললো
-” মুখ বন্ধ রাখ।তোর জন্য সব নাহলে জলে যাবে।একদম চুপ।”
জারা মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বললো
-“তোর নেতা সাহেব তো সেই জিনিস? এক মিটিংয়ে আংকেলের মাথা থেকে বিয়ের ভূত বের করে নিয়েছে।আর তুই এই জিনিয়াস মালকে পাত্তা দিচ্ছিস না? এমন জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের বিষয় আরজু।যেই মানুষ অন্য সবার সমস্যা চুটকি তে সমাধান করতে পারে সে নিজের জীবনের সবচাইতে বড় সমস্যাটাই সমাধান করতে পারছে না।আফসোস!!”
বলেই আরজুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আরজু রেগে বললো
-” আমি সমস্যা?”
-” তুই সমস্যার আরত। বেচারাকে কেমন পেইনে রেখেছিস।আহা!!!আমাদের হ্যান্ডসাম মেয়রের কপালটাই খারাপ।”
আরজু ফ্যাল ফ্যাল করে জারার দিকে তাকিয়ে রইল।মনের গভীরে কোথাও না কোথাও গর্ববোধ হচ্ছে মানুষটিকে নিয়ে।মানুষটার কথায় জাদু আছে।সামনের ব্যাক্তিকে কেমন বসে এনে ফেলে।মানুষটা তার চারপাশের প্রতিটি মানুষের খেয়াল রাখে।ভেবেই আরজু মুচকি হাসলো।
_________________
রামিমের মায়ের মৃত্যুর পর একদিন নাহিদ এসেছিলো রামিমের বাসায়।রামিম অবাক হয়ে গেছিলো নাহিদকে নিজের ছোট্ট কুটিরে দেখে।সেদিন বেশ কিছু সময় সে রামিমের সাথে কাটিয়েছে।ছেলেটাকে ভরসা দিয়েছে।রামিম ভবিষ্যতে কি করতে চায় জানতে চাইলে রামিম মায়ের ইচ্ছার কথা জানায়।তিনি চাইতেন তার ছেলে বাইরের ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করবে।নাহিদ রামিমকে বলেছিল
-” তুমি এপ্লাই করে ফেলো রামিম।তুমি ভালো স্টুডেন্ট।একটা অপরচুনিটি পেয়ে গেলে তোমাকে আর ফিরে তাকাতে হবে না।তোমার পাশে আমি আছি।আরজুর হাসবেন্ড হিসেবে না বরং বড়ো ভাই হিসেবে তোমার পাশে আছি।একবার সিলেক্ট হয়ে গেলে যাওয়ার চিন্তা করতে হবে না।বড়ো ভাই সবটাই বেবস্থা করে দিবো।”
নাহিদের আশ্বাসে বেশ কিছুদিন আগে রামিম আমেরিকার কয়েকটি সুনামধন্য ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করে ছিল।মায়ের ভীষণ ইচ্ছা ছিল বাইরের কোনো ভালো ভার্সিটি থেকে ছেলে মাস্টার্স করবে।মায়ের চলে যাওয়ার পর মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য এপ্লাই করেছিলো।কিছুদিন আগেই রামিম জানতে পারে সে আমেরিকার একটা ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০% স্কলার্শিপ পেয়েছে। প্রথমে রামিম বিশ্বাস করতেই পারছিলো না।উপরওয়ালা তার প্রতি এতটা সহায় হয়েছে। এই খবরটা পেয়ে সে মনে একটু জোর পেয়েছিল।এই খবরটা সে সবার আগে সাবিহার বাবাকে জানতে চেয়েছে।কারণ নিজের যোগ্যতা প্রমাণের দারুন একটা সুযোগ তার হাতে ছিলো।শুধু সময়ের প্রয়োজন।সে তখনই বেরিয়ে পড়েছিল সাবিহার বাবার অফিসের উদ্দেশে।অদ্ভুদ ভাবেই রাস্তায় তার দেখা হয় নাহিদের সাথে।নাহিদ তাকে দেখেই বললো
-” গাড়িতে উঠে এসো রামিম।তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেই।”
রামিম প্রথমে ইতোস্থবোদ করলেও পরে উঠে পরে।নাহিদ তাকে গুড লাক উইশ করে তাকে পৌঁছে চলে যায়।
রামিমকে দেখে সাবিহার বাবা প্রথমে অবাক হয়।রামিম বেশ কিছুক্ষন আমতা একটা করে সাবিহার বাবাকে সবটা বুজিয়ে বলে।সাবিহার বাবার কাছে ছেলেটা একটু সময় চায়।নিজেকে প্রমাণ করেই সে সাবিহার বাবার সামনে দাড়াতে চায়।সৈকত সাহেব বেশ তীক্ষ্ণ মানুষ।হুমকি ধামকি তে কাজ হাসিলের চাইতে বিগড়ে যায় বেশি সেটা তিনি জানেন।তাই রামিমকে ইমোশনালি আঘাত করলেন।তাই শান্ত সুরে বললেন
-” দেখো বাবা আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা।কিন্তু তুমিই বলো আদো তুমি আমার মেয়ের যোগ্য?আমার মেয়ে অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করে।তোমাকে আমিও পছন্দ করি।কিন্তু মেয়ের জামাই হিসেবে একজন এতিম ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া কতটা যুক্তি সঙ্গত?আমার মেয়েকে আমি বেশ বিলাসিতায় বড়ো করেছি।তোমার অভাবের সংসারে গেলে তার এই ভালোবাসা ঠিক কতদিন টিকবে বলো? তুমি স্কলারশিপ পেয়েছ শুনে খুশি হয়েছি।কিন্তু তুমি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করবে সেই আশায় মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার কি ঠিক হবে?এটা তো বানের জলে মেয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার সমান।আমার একটা স্ট্যাটাস আছে।সেখানে তুমি কখনোই ফিট হবে না।আমি জানি আমার মেয়ে ইমোশনাল।সে আমাকে সম্মান করে।কিন্তু আবেগী মেয়েটা হয়তো দিন শেষে তোমার কাছে ছুটে যেতে পারে।এমন কিছু হলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।তোমার কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি আমার তিলে তিলে গড়া আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হতে দিও না।তাহলে আমার জন্য মৃত্যু ছড়া উপায় থাকবে না।একজন বাবা হয়ে তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি।তুমি ওর কাছথেকে দূরত্ব বজায় রাখলেন সে ঠিক এক সময় তোমাকে ভুলে যাবে।নিজেকে ঠিক সামলে নিতে পারবে।তুমি আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও বাবা।”
বলেই সাবিহার বাবা রামিমের সামনে হাত জোড় করে রইলেন। রামিমের মতো আত্মমর্যদাসম্পন্ন ছেলের জন্য এটা চরম অপমানের।বাবার বয়সী একজন লোক তার সামনে হাত জোড় করবে এই শিক্ষা তার মা কখনোই দেয়নি।রামিম সাবিহার বাবার হাত নামিয়ে ভেজা চোখে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো
-” আপনি চিন্তা করবেন না আংকেল।আমি সাবিহার কাছ থেকে দূরে থাকবো।আপনি হাত জোর করে আমাকে আর লজ্জা দিবেন না।আপনি আমার বাবার মতো।”
সেদিন ভাঙ্গা হৃদয় নিয়েই ফিরতে হয়েছিল রামিম কে।তার পর থেকেই সে সাবিহাকে সম্পূর্ন এড়িয়ে চলছে।রামিম চাইছিলো যতো দ্রুত সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যেতে।কারণ চারপাশের সব কিছুই তার জন্য বিষাদময় ছিলো।বন্ধুবান্ধবরা তাকে ভুল বুঝছে।সাবিহার সেই মলিন মুখ তার ভেতরটা ঝাঁজরা করে দিচ্ছে।মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেওয়া রামিমের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। মায়ের জমানো কিছু টাকা আর নাহিদের সাহায্যে সে সব ফর্মালিটি পূরণ করতে থাকে।এই বিষয়ে সে বন্ধু মহলের কাউকেই জানায়নি।চেয়েছিলো চুপিসারে সবার কাছথেকে আড়াল হয়ে যাবে।আর কোনোদিন এই মাটিতে ফিরে আসবে না।কিন্তু সেদিন ফুয়াদ আর শুভ তার ব্যাগে রাখা পাসপোর্ট আর কাগজপত্র দেখে ফেলে।রামিম তিনদিনে মধ্যে চলে যাচ্ছে দেখে দুজনেই বেশ অবাক হয়েছিল।রামিম সেদিন আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেনি।দুই বন্ধুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল।শুভ আর ফুয়াদকে সবটাই সে জানায়। রামিমকে কি বলা প্রয়জন তারা যেনো খুজেই পাচ্ছিল না।রামিম তার যাওয়ার পূর্বে কাউকেই এই খবর জানাতে মানা করে দেয়।তাই তো শুভ আর ফুয়াদ কাউকেই জানায়নি।
সন্ধার দিকে সাবিহার বাবাকে নিজের বাসায় দেখে রামিম ভীষণ ঘাবড়ে যায়। সাবিহার বাবার অস্থির মুখটা রামিমের মনে তীব্র ভয় সঞ্চার করলো।এই সময় তো মানুষটার মেয়ে বিদায় করার কথা।সাবিহা আদো ঠিক আছে কিনা সেই চিন্তাই তার মাথায় ভর করলো।আবেগী মেয়েটা কোনো ভুল কিছু করে বসেনি তো ভেবেই রামিমের সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।
#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_77
এতো বিষাদময় দিনটি এতটা সুখময় হয়ে উঠবে কেউ ভাবতেই পারেনি।সাবিহার বাবাকে দেখে রামিম ঠিক যতোটা আতঙ্কিত হয়েছিল কিছু মুহূর্ত পর ঠিক ততটাই স্তব্দ হয়েছে সাবিহার বিয়ে ভাঙার খবরে।এমন কিছু তার জীবনে ঘটবে সে ভাবতেই পারেনি।মা মারা যাবার পর রামিমের মনে হয়েছে জীবন শুধু তার কাছথেকে সব কেরেই নিচ্ছে।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ঠিক যতোটা কেরে নেয় তার চাইতে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়।
সাবিহার বাবা রামিমের সামনের সোফায় বসে আছেন। লোকটির মুখে গাম্ভীর্যতা বিদ্যমান।মানুষটি কি তার উপর রেগে আছে?রামিমের ভীষণ অস্থির লাগছে।সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।তার পেছনে আরজু,জারা,শুভ,ফুয়াদ দাড়িয়ে আছে। আর নাহিদ বসে আছে পাশের সোফায়।আরজু একটু পর পর আড়চোখে নাহিদকে দেখছে।নাহিদ সোফার হাতলে কনুই ভর দিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে বসে ফোন টিপছে।আরজু ভাবছে মানুষটা কি নিজের যত্ন নেয়না?এতো নিষ্প্রাণ কেনো লাগছে?তার দিকে একটিবার ঠিক ভাবে তাকালো না পর্যন্ত।মানুষটি কি অভিমান করেছে?কঠিন অভিমান?
সাবিহার বাবা নিস্তব্দতা ভেঙে গম্ভীর দৃষ্টিতে রামিমের দিকে তাকিয়ে বললেন
-“আমি আমার মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি।আমি চাই সে সুখে থাকুক।সেই সুখ যদি তোমার মাঝে থাকে তবে সেটাই মেনে নিচ্ছি।নিজের মেয়ের সুখের কাছে সব কিছুই ক্ষুদ্র।তুমি আবার ভেবে বসনা আমি তোমার হাতে মেয়েকে এক্ষনি তুলে দিচ্ছি।মোটেও না। জাস্ট তিন বছর সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করতে না পারলে মেয়েকে আমি সোজা অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবো।আমেরিকায় যেয়ে কোনো বাজে কাজে জড়িয়ে যেয়েও না।তোমার মধ্যে বর্তমানে যেই সততা আর নিষ্ঠা দেখতে পাচ্ছি বাইরে থেকে ফিরেও যেনো সেটা দেখতে পাই।কোনো হের ফের হলে মেয়ে দিবো না।”
রামিম অতি আবেগে ফুঁপিয়ে উঠলো।মা কি তবে তার জন্য মন থেকে দোয়া করে গেছেন যেন তার ছেলে ভালোবাসার মানুষটিকে পায়।নাহলে এমন মিরাকেল কি করে হচ্ছে?ফুয়াদ রামিমের কাধে হাত রেখে ভরসা দিলো।রামিম সোজা সাবিহার বাবার সামনে এসে ফ্লোরে বসে পড়লো।সাবিহার বাবার হাতটা আলতো স্পর্শ করে ভাঙ্গা গলায় বললো
-” আজ আপনি আমার উপর যেই ভরসা দেখিয়েছেন সেটার মূল্য আমি রাখবো।আমার মতো এতিম কে আপনি এতো বড়ো একটা অপরচুনিটি দিয়েছেন সেটাই অনেক।আমার জন্য দোয়া করবেন আংকেল।আমি যেনো আপনাদের সকলের এক্সপেক্টেশন ফুলফিল করতে পারি।নিজেকে সাবিহার যোগ্য প্রমাণ করতে পারি।”
সাবিহার বাবা রামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-” তোমার উপর আমার ভরসা আছে।ইনশাআল্লাহ তুমি পারবে।আমার পূর্বের ব্যাবহারে জন্য আমি লজ্জিত।আসলে মেয়ের বাবা হলে অনেক কিছু চিন্তায় চলে আসে।যেদিন বাবা হবে সেদিন বুজবে।”
সাবিহার বাবার কথায় সবাই হেসে উঠলো।তিনি মুচকি হাসলেও পরে গম্ভীর স্বরে বললেন
-” কাল রাতে নাকি তোমার ফ্লাইট।সেখানে পৌঁছে নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ করবে। কাল দুপুরে আমার বাসায় লাঞ্চ করতে যাবে।আমি নিজে তোমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিব।”
রামিম মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।সাবিহার বাবা সকলকেই কাল দুপুরে তাদের বাসায় দাওয়াত করলো।নাহিদ বললো
-“সরি,আমার পক্ষে আসা সম্ভব হবে না।আমার মিটিং আছে।অন্য কোনো সময় অবশ্যই আসব।আজ আসি।”
রামিম নাহিদের হাত ধরে বললো
-” ধন্যবাদ ভাইয়া।আজ আপনি না থাকে কিছুই সম্ভব ছিল না।আমিতো সাবিহাকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।আপনার এই উপকার আমি চিরদিন মনে রাখবো।আজ বলতে হচ্ছে, আমাদের ইমোশনাল ফুল আরজু জীবনে সঠিক মানুষটিকেই বেছে নিয়েছে।শুধু উপলব্ধি করা বাকি।”
নাহিদ আড়চোখে আরজুর দিকে তাকালো।আরজু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।নাহিদ মলিন হেসে বলল
-“কাউকে শেষ অব্দি চাওয়া এবং পাওয়াটাই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসা।”
নাহিদ আবার আরজুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
-“প্রিয়জনকে ছেড়ে থাকা খুব কষ্টের,কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্টের হলো সে আসবেনা জেনেও তার জন্য অপেক্ষা করা।তোমার আর সাবিহার জন্য শুভকামনা রইলো।জীবনে দারুন একটা জার্নি হোক তোমাদের।কারণ সবার ভাগ্যে একসাথে পথ চলা লেখা থাকে না।”
বলেই নাহিদ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো।আরজু নাহিদের চলে যাওয়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। শিরশিরে কাঁপন ধরলো সর্বাঙ্গে। নেতা সাহেবের অভিমান আরজুর হৃদযয়ে ভীষণ ঝড় তুলে দিলো।আরজু বরাবর পাগলাটে।জীবনের সকল ক্ষেত্রে সে নিজের আবেগকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।আজও ঠিক তাই করলো। সে হঠাৎ করেই বললো
-“আচ্ছা আমার জীবনে আচমকা নেওয়া সিদ্বান্ত গুলো শেষ পর্যন্ত সঠিক হয় তাই না?ঠান্ডা মাথায় আমি কখনোই ভালো সিদ্বান্ত নিয়ে পারি না।রাইট?”
সকলেই চমকে তাকালো আরজুর দিকে।আরজু মিষ্টি করে হেসে রামিমের দিকে তাকিয়ে বললো
-” রামিম তোর সাথে কাল দেখা হচ্ছে।সাবিহা তোর উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে।ওকে কি করে শান্ত করে যাবি সেটা সারা রাত ভেবে রাখিস।আমি কিন্তু সাবিহার পক্ষে।তোকে কাল দুইটা উষ্ঠা দিলেও হজম করে নিস।কারণ আমরা কেউ তোর সাপোর্টে নেই।আচ্ছা বায়।”
বলেই আরজু দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো।ফুয়াদ হতবম্ব হয়ে বললো
-” কি হলো বুজলাম না।”
শুভ মৃদু হেসে বললো
-” এতো দিনে পাগলের সুবুদ্ধি হয়েছে।”
শুভর কথায় বাকি সবাই হেসে উঠলো।ফুয়াদ বির বির করে বললো
-” শুভ কবে যে তোর সুবুদ্ধি হবে? রিমি আর তোর একটা গতি হলেই হলো।উফফ!! আমার নিজেই তো কোনো গতি হলো না।ইসস!!পিচ্ছি লামিসাটা কে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু ওর বিস সিস্টার যা তেজ দেখায়।গেলে ভাব দেখাবে এমন যেনো তার সাথে প্রেম করতে গেছি।”
________________
রামিমের বাসা থেকে বেরিয়ে নাহিদ নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।শরীর ভীষণ ক্লান্ত।আজ একটা জরুরী কাজ ফেলে এসেছে রামিমের জন্য।ছেলেটাকে তার ভীষণ ভালো লাগে।আরজুকে ভালোবাসার পর থেকে সে তার আশেপাশের প্রতিটি মানুষের খোঁজ খবর রেখেছে।মানুষ গুলো আরজুর জন্য কতটা ভালো হবে সেটা খতিয়ে দেখেছে।বিশেষ করে আরজুর বন্ধুমহলের সকলের বিষয়ে।আর যাই হোক মেয়েটা বেশ কিছু চমৎকার মানুষদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছে।এই বন্ধু মহলের সকলের বিষয়ে নাহিদ সব কিছুই জানে।যেমন ফুয়াদের সাথে লামিয়ার কি চলছে।প্রথমে বিষয়টা নাহিদের কাছে চিন্তার বিষয় ছিল।কারণ লামিয়াকে সে ভীষণ স্নেহ করে।ফুয়াদ ভালো ছেলে হলেও রিলেশনের ক্ষেত্রে বেশ উদাসীন।একাধিক গার্লফ্রেন্ড ছিল তার।কিন্তু ফুয়াদকে সে লামিয়ার প্রতি বেশ সিরিয়াস দেখেছে।আর জারার বিষয়টা জেনে সে ভীষণ আশ্চর্য হয়েছে।জাহিদ আর জারা সে ভাবতেই পারেনি।তবে মন্দ হবে না।জাহিদকে সে কখনোই ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেনি কিন্তু ছেলেটার খারাপ সে কখনোই চায়নি।জারা বেশ বাস্তববাদী মেয়ে। আর এম্বিসিয়াস বটে।জাহিদের মতো উড়নচণ্ডী ছেলেকে কন্ট্রোল করতে এমন কাউকেই প্রয়োজন।এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পেছন থেকে মিষ্টি কণ্ঠে কেউ ডেকে উঠলো
-” শুনুন”
নাহিদ থমকে দাড়ালো।ঠিক কতদিন পর সেই সুরেলা সুরের মিষ্টি ডাক শুনতে পাচ্ছে।নাহিদ খেয়াল করলো তার হৃদস্পন্দের গতি বহু গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।এই এক নারী পারে নাহিদকে বেসামাল করে তুলতে।নিজেকে ধাতস্থ করে পেছনে ফিরে তাকালো।আরজু ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ির কুচি ধরে এগিয়ে আসছে।সাবিহার বাসায় এক পলক আরজুর দিকে তাকানোর পর নাহিদ আর আরজুর দিকে ভালো করে তাকায়নি।কারণ সেই এক পলকের দৃষ্টিতেই নাহিদ বহু বার ঘায়েল হয়েছে।কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে বসেছিলো সে কেনো সেখানে গেছে।আরজু হাপাতে হাপাতে নাহিদের সামনে দাড়িয়ে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো
-” আপনার ফোনটা দিন।”
নাহিদ বোকার মতো আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।আরজু কপাল কুঁচকে আবার বললো
-” কি হলো ফোনটা দিন।”
আরজুর এতো স্বাভাবিক আচরণে নাহিদ ভরকে গেল।আরজু ঠিক কি চাইছে বুঝতে পাড়লো না।সে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে দিল।আরজু ফোন নিয়ে কারো নাম্বারে ডায়েল করলো।
সাবা খানম বেশ মনোযোগ দিয়ে বিছানায় বসে একটা কেসের ফাইল দেখছিলেন।হঠাৎ নাহিদের নাম্বার থেকে কল আসায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আরজু বলতে লাগলো
-” হ্যালো খালামণি!!আমি আর বাসায় ফিরছি না।”
সাবা খানম চমকে বললেন
-” মানে?”
-“আরে তোমাদের জামাই আমাকে ধরে বেধে নিয়ে যাচ্ছে।বলে কিনা তার খুব হানিমুন হানিমুন পাচ্ছে।কি করি বলো তো? একদম লজ্জা নেই লোকটার।হানিমুনের চিন্তায় না জানি কয়দিন ধরে ঘুমায় না। চোখের নিচে কেমন কালো হয়ে আছে।সে নেতা হয়ে জনগণের এতো সেবা করে।তাই ভাবলাম একজন সাধারণ জনগন হিসেবে আমারও তার সেবা করা প্রয়োজন।তাইনা বলো?”
সাবা খানম এতক্ষন বিস্ময় নিয়ে সবটাই শুনছিলেন।এই পাগলের মাথায় আবার কি পাগলামি ভর করেছে কে জানে?তিনি কপাল কুঁচকে বললেন
-” আরজু আর ইউ ড্রাংক?এমন হলে মাইর একটাও নিচে পড়বে না।”
-“নো। আই অ্যাম এবসুলেটলি ফাইন।”
সাবা খানম এক মুহুর্ত চিন্তা করে মৃদু হেসে বললেন
-” যাক তোর পাগলাটে মাথায় এতো দিনে বুদ্ধি হয়েছে।তোর সিদ্ধান্তে আমি ভীষণ খুশি।হানিমুন শেষে বাসায় চলে আসিস দুজন।”
আরজু মৃদু হেসে বললো
-” ওকে খালামণি।”
আরজু কল কেটে নাহিদের দিকে তাকাতেই দেখলো মানুষটা কেমন কপাল কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরজু নাহিদের হাতে ফোন দিয়ে বললো
-” দ্রুত বাসায় চলুন তো।এই ভারী শাড়িতে ভীষণ অসস্তি লাগছে।”
বলেই গাড়িতে উঠতে গেলে নাহিদ আরজুর বহু টেনে নিজের দিকে ফেরালো।নাহিদের চোখে মুখে তখনও বিস্ময় খেলা করছে।সে আরজুর মায়াবী চোখে চোখ রেখে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বললো
-” আর ইউ সিওর আরজু?”
আরজু নাহিদের দিকে বিমোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
-“হান্ডেট পার্সেন্ট সিওর। ঠিক ততটা সিওর,যতোটা সিওর হলে নিজের হৃদয়টা অন্যের কাছে সমর্পণ করা যায়।”
নাহিদের মনে হলো ঈদের চাঁদ দেখা গেলে যেমন আনন্দ হয় তার ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে তার। হৃদয়ে হাজারো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে।নাহিদ হঠাৎ আরজুর উন্মুক্ত উদরে হাত রেখে আরজুকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফিচেল স্বরে বললো
-” ভালো করে ভেবে বলো আরজু।কারণ আজকের পর আর আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার সুযোগ পাবে না।সমস্ত পথ আমি বন্ধ করে দিবো।তুমি চাইলেও এই নাহিদের জীবন থেকে বের হতে পারবে না।যেদিন আমার শেষ নিঃশ্বাস পড়বে একমাত্র সেদিন তোমার মুক্তি।”
আরজু নাহিদের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আলতো ছুয়ে বললো
-“আমি কোনোদিন আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাইনা নেতা সাহেব।এতদিনে আমি বুজে গেছি আপনাকে ছেড়ে বেচেঁ থাকা সম্ভব কিন্তু ভালো থাকা অসম্ভব।আপনার কাছথেকে দূরে থাকলেও আমার চিন্তা ,চেতনায় আপনি সর্বক্ষণ জ্বালিয়েছেন।এক দ্বন্দ সস্তি দেননি।আমাকে কেনো এতো ভালোবেসেছেন,কেনো এতো স্বাধীনতা দিয়েছেন যে আপনার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার কোনো সাধ্য আমার নেই?এই আপনিটা শুধু মাত্র আরজুর।”
নাহিদ আরজুর চিবুকে উষ্ণ স্পর্শ করে বললো
-“আর কখনো এই ভাবে হারিয়ে যেয়ো না।”
-” হারাতে দিলে তো সবাই হারায়।আপনি নাহয় হারানোর আগেই বুকে টেনে নিবেন আমায়।”
নাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” হানিমুনে কোথায় যাবেন ম্যাডাম?”
আরজু হেসে বললো
-” এমন কোথাও যেখানে শুধু আপনি আর আমি থাকবো।”
নাহিদ ব্রু নাচিয়ে বললো
-” তাহলে তো চাঁদে যেতে হবে। চাঁদে হানিমুন মন্দ হবে না।”
আরজু ফিক করে হেসে নাহিদের বুকে মুখ লুকালো।জীবনে এমন একজন মানুষ ভীষণ প্রয়োজন যে আপনাকে সর্বোচ্চ কমফোর্ট ফিল করাবে।আপনাকে সবচাইতে স্পেশাল ফিল করাবে।যে আপনাকে গুরুত্ব দেবে,ভালোবাসবে।আর সর্বাধিক যে আপনাকে সম্মান করবে।আরজুর নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয়।এই মানুষটা তাকে যেই ভাবে সম্মান প্রদর্শন করে সেটা আজকাল কয়জন স্বামী করে?যেই মানুষটা এতবছর অপরাধবোধ নিয়ে মানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে,নিজেকে বারংবার দোষী সাব্যস্ত করেছে,নিজের প্রিয়সী কে পাওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেছে সেই মানুষটিকে আর কি শাস্তি দিবে আরজু? মানুষের বিবেকের আদালতে পাওয়া শাস্তির চাইতে অধিক শাস্তি আর কি হতে পারে? এবার নাহয় এই শাস্তির অবসান ঘটুক।আরজু নিজেও পারছে না মানুষটিকে ছাড়া সুস্থ ভাবে বাঁচতে।
সুমি দরজা খুলে আরজুকে দেখে চমকে গেলো।মেয়েটা আবেগে কেঁদে উঠলো।আরজু সুমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-” এই ভাবে কাদলে তোমাকে ভীষণ বাজে লাগে সুমি।”
সুমি ভাঙ্গা গলায় বললো
-” ভাবী আপনি আসছেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।জানেন আপনি চলে যাওয়ার পর থেকেই ভাইজান কতো অনিয়ম করে চলেছে।ভাইজানের মুখের হাসিটা ও গায়েব হয়ে গেছিলো।দিন রাত কাজ নিয়ে পড়ে ছিলো।ঠিক মত খায়নি,ঘুমায়নি।আপনি আর যাবেন না ভাবী।তাহলে ভাইজান ডিপ্রেশনে চলে যাবে।”
আরজু শান্ত সুরে বললো
-” তোমার ভাইজানকে লাইনে আনার জন্যই তো ফিরে এলাম।”
সুমি হেসে উঠলো।আর বললো
-” তবে একটা দারুন জিনিস হয়েছে ভাবী।ভাইজান আর খালুজানের মধ্যে মনোমালিন্য অনেকটা কমে গেছে।সেদিন সকালে দুজন পাশাপাশি বসে নাস্তা করলো।ভাইজান এই প্রথম খালু জানের সাথে এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছে।”
আরজু সব শুনে বেশ অবাক হলো।নাহিদ গাড়ি পার্ক করে এসে বললো
-” তোমাদের গল্প শুরু হয়ে গেছে?”
আরজু নাহিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
-” হুমম!! অনেক নতুন গল্প শুনলাম।কেউ একজন কতটা বিরহে দিন পাড় করেছে সেই গল্পই শুনছিলাম।”
নাহিদ রাগী চোখে সুমির দিকে তাকালো।সুমি বেচারি ভয়ে কাবু।আরজু ধমক দিয়ে বললো
-” খবরদার সুমিকে চোখ রাঙানি দিবেন না।”
নাহিদ সুমির দিকে তাকিয়ে বললো
-” সুমি পাঁচ মিনিটের জন্য চোখ বন্ধ কর।”
সুমি কিছু চিন্তা না করেই নাহিদের কথা মতো চোখ বন্ধ করে রাখলো।আরজু কপাল কুঁচকে সবটাই দেখছে।হঠাৎ নাহিদ আরজুকে পাজা কোলে তুলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।সুমি চোখ খুলে নাহিদকে যেতে দেখে মুচকি হাসলো।নাহিদের কাজে আরজু মুহূর্তেই শিউরে উঠলো।শক্ত করে নাহিদের গলা জড়িয়ে বুজে মুখ লুকালো।আরজুর এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে।নাহিদ মৃদু হেসে বললো
-” তোমার হুটহাট নেয়া সিদ্বান্ত গুলো একদম দারুন হয়।তোমাকে কখনোই কোনো কিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দেওয়া যাবে না।”
আরজু কপট রাগ দেখিয়ে বললো
-” আপনি বলতে চাইছেন আমি ঠান্ডা মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?”
নাহিদ আরজুকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো
-” পারো, তবে সেটা কখনোই আমার ফেভারে হয় না।”
আরজু চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে আছে।সে নাহিদের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো
-” আমি কয়দিন জন্য গেছি আর অমনি আপনি সারা ঘর এলোমেলো করে রেখেছেন?”
নাহিদ আরজুর দিকে ঝুঁকে তার দুইপাশে হাত রেখে আরজুকে বন্দী করে নিলো।আরজুর মুখের কাছে ঝুঁকে বললো
-” তুমি হীনা যেখানে আমার জীবনটাই এলোমেলো, সেখানে এই ঘর তেমন কি?আমার হৃদয়ে বলো কিংবা এই ঘর সবটাই তুমি ছাড়া শূন্য।”
আরজু পলকহীন দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে রইলো।কি মাদকতা ছড়িয়ে আছে নেতা সাহেবের দৃষ্টিতে সেটাই পরখ করছে।এটাই সেই মানুষ যাকে দেখে আরজুর বুক কাপে,গলা শুকিয়ে যায়।মানুষটার মাদকতাময় কণ্ঠে বলা প্রতিটা কথা আরজুর হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়ে তুলে।এই মানুষটিকে ছাড়া আরজুর প্রতিটি সকাল বৃথা।প্রতিটি রাত প্রাণহীন।
নাহিদের উষ্ণ নিঃশ্বাস আরজুর বুকে অনুভূতির ঝড় তুলতে লাগলো।বেসামাল আরজুর মন বরাবর তার নেতা সাহেবের সামনে আসলে বেহায়া হয়ে উঠে।আর এক মুহূর্তের দূরত্ব যেনো আরজু মানতে পারছে না। আরজু চট করেই নাহিদের পেছনের চুলে খামচে ধরে নাহিদের সিগারেটে পোড়া ওষ্ঠ জোড়ায় নিজের ওষ্ঠ মিশিয়ে দিলো।ঠিক কতদিন পর এই বিমোহিত করা স্পর্শ পেলো দুজন কারো জানা নেই।আজ যেনো সকল অভিমানেরা ভালোবাসার স্পর্শের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।সেই স্পর্শ,মাদকতা তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগলো।যেনো দুটি তৃষ্ণার্ত হৃদয় বহুদিন পর আজ বৃষ্টির সন্ধান পেয়েছে।
__________________
পরদিন রামিম সাবিহাদের বাসায় গেলেও সে সাবিহার দেখা পায়নি।সাবিহার মনে কঠিন অভিমান জমা হয়েছে।সে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। বন্ধু মহলের সকলেই সাবিহাকে রিকোয়েস্ট করলো একবার রামিমের সাথে কথা বলতে।কিন্তু সাবিহা নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। এই ছেলেকে সে কঠিন শাস্তি দিবে।তাকে উপেক্ষা করার শাস্তি।তার ভালোবাসাকে অপমান করার শাস্তি।রামিম সাবিহার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বললো
-” জানি ভীষণ অভিমান করেছিস।তোর এই অভিমান ভাঙতে খুব জলদি ফিরে আসবো।ততদিন এই অভিমানী মন নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করিস।ফিরে এসে আমার প্রিয়সী সকল অভিমান ভাঙবো।যেই স্বীকারোক্তির অপেক্ষা বহুদিন করেছিস সেটাও করবো।ভালো থাকিস পাগলী।”
অন্যদিকে সাবিহা বন্ধ দরজার ওপাশে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলছে।মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।ভীষণ ইচ্ছে করছে দরজা খুলে রামিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।কিন্তু সে এটা করবে না।এই মানুষটিকে যোগ্য শাস্তি দিয়ে তবেই সে ক্ষান্ত হবে।রামিম যখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গাড়িতে উঠছিলো সাবিহা পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে মানুষটিকে মন ভরে দেখে নিল।অনেক দিন এই মানুষটিকে দেখা হবে না।সামনে সময়টা শুধু মাত্র অপেক্ষার।তবে এই অপেক্ষা বিষাদের নয়।এই অপেক্ষা নতুন ভোরের।
সাবিহা ছাড়া বাকি সকলেই এয়ারপোর্টে রামিমকে বিদায় দিতে এসেছে।সকলের চোখেই অশ্রু।ফুয়াদ রামিমকে জড়িয়ে ধরে বললো
-“ফাইনালি আন্টির স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি জানি তুই জীবনে ভালো কিছু করবি। বিকজ ইউ ডিজার্ভ ইট। জলদি ফিরে আসিস।তোর জন্য অনেকেই অপেক্ষা করবে।”
শুভ রামিমকে জড়িয়ে ধরে বললো
-” ভালো থাকিস দোস্ত।ভীষণ মিস করবো তোকে।”
আরজু,রিমি আর জারাও রামিম কে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাদলো।রামিম বিরক্ত হয়ে বললো
-” এই ছেচ কাদুনির দলকে আমার সামনে থেকে সরা।যাবার সময় হাসি মুখে বিদায় দিবে তা না ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে।এই মেয়ের জাতই জটিল।একজন তো মুখটা অব্দি দেখালো না।”
জারা মুখ ভেংচে বললো
-” তোর জন্য কে কাদে? আমরা তো কাদছি সাবিহার বিয়ের জন্য শপিং করেছিলাম সেটা জলে গেলো ভেবে।টেনশনে একটা সেলফি ও নিতে পারিনি।কতো সখ ছিলো দারুন কিছু পিক তুলে ডিপি চেঞ্জ করবো।সব মাটি।”
রামিম জারার মাথায় চাপড় মেরে বললো
-“আমার আসা অব্দি অপেক্ষা করিস।ওই বাচ্চাটাকে বিয়ে করে আরজুকে চাচী আম্মা বানিয়ে ফেলিস না।”
জারা রেগে রামিমের পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে বললো
-” আমি মোটেও কোনো বাচ্চা বিয়ে করছি না।যা ভাগ।”
সবাই মৃদু হেসে উঠলো।রামিম রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-“ভালো করে লেখা পরা করিস। মাস্টার্সে তোর দারুন একটা রেজাল্ট দেখতে চাই।”
রিমি চশমা খুলে চোখের জল মুছে নিলো।সে আর কাদবে না। রামিমের এই যাত্রা মোটেও দুঃখের না বরং আনন্দের।
আরজুর হাতে আলতো ছুঁয়ে রামিম বললো
-” তোকে আমরা সবাই আবেগী বললেও একমাত্র তুই জীবনে সঠিক সময়ে সকল সঠিক সিদ্বান্ত নিয়েছিস।যেই মানুষটাকে পেয়েছিস তাকে আগলে রাখিস।কারণ মানুষটা অন্য সবার চাইতে আলাদা।”
আরজুর চোখে অশ্রু জমা হলো। এতো দিনের বন্ধুত্ব তাদের।হঠাৎ একজনের দূরে যাওয়াতে সকলের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।রামিম সবাইকে বললো
-” আমার পাগলীটার খেয়াল রাখিস।আর বলিস পর্দার আড়ালে সেতো ঠিক আমাকে মন ভোরে দেখে নিয়েছে।কিন্তু আমি যেদিন ফিরবো সেদিন তাকে আমার সামনে ধরে বেধে বসিয়ে রাখবো।আর মন ভরে দেখবো।”
সবাই হেসে উঠলো।রামিম এক হাতে কাধের ব্যাগ চেপে ধরে অন্য হাতে লাগেজে টেনে ভেতরে চলে গেল।একবুক স্বপ্ন, আশা,ভরসা নিয়ে সামনের পথে পা বাড়ালো।তার সবাইকে ছেড়ে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।এই দেশ,দেশের মাটি,মায়ের সাথে কাটানো বাড়ির স্মৃতি,প্রিয়তমা সব কিছু রেখেই তাকে যেতে হবে। সংগ্রাম আর ত্যাগ ছাড়া জীবন হয়না।তাই সে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করবে।