ঝরা বকুলের গল্প পর্ব-১৭

0
216

#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_১৭ (ক)
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
প্রেম এবং ভালোবাসা- দুটি দু মেরুর জিনিস। প্রেম এবং ভালোবাসা কখনোই এক নয়। প্রেম কাব্যতেও হয়, কারো হাসিতেও হয়, কারো চোখ দেখেও প্রেমে পড়া যায়। কিন্তু ভালোবাসা হয় একান্ত মানুষটাকে ঘিরে! মানুষটার সবকিছুতে ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। মানুষটার কথায়-কাজে মনের মাঝে এক অন্যরকমের প্রশান্তি এনে দেয়। মানুষটার বাজে অভ্যাস গুলোও তখন ভালো লাগতে শুরু করে। অপছন্দের জিনিস গুলো পছন্দের হতে শুরু করে। প্রেমকে ভুলে থাকা যায়, ভুলেও যাওয়া যায়। কিন্তু ভালোবাসা- ভোলা না এত সহজ, আর না এত ঠুনকো এই অনুভূতির তীব্রতা!

কাব্যিক মন হয়ে তুষারের হয়েছে যত জ্বালা। সবকিছুতেই আপনা আপনি কাব্য রচনা হয়। এই যে বকুল, কোনো উত্তর না দিয়েই পালিয়ে গেল, এতেও বেহায়া মন কাব্য লিখতে শুরু করল। তুষার মোটা কাঁথা গায়ে দিয়ে আধ শোয়া হয়ে কাঠের জানালার বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার পানে তাকাল। বুকের ভিতর তীব্র হাহাকার, শূন্যতা। সে আপন মনেই স্বগতোক্তি করে উঠল,

“ওরে প্রকৃতি, যে শুষ্কতার হাহাকারে তুমি রুগ্ন, তারচেয়েও বেশি রুক্ষতা ধরেছে আমার হৃদয়ের দরজায়। গোপন কুঠুরিটা তালা মে*রে দিয়েছি। আজকের পর বসন্তের হাওয়ার মন বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ নিষেধ নিষেধ! ওহে প্রকৃতি, আমার নিস্তব্ধতার আর্ত চিৎকার কি তুমি শুনতে পাচ্ছো?”

____________

ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে দরজাটা খুলে গেল। শাহজাদি দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরে। ভয়ে ভয়ে পেছন এবং আশেপাশে সাবধানের সহিত দেখল। না, কেউ টের পায়নি কিছু। শাহজাদি পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর ঢুকল। পুনরায় ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে দরজাটা বন্ধ হলো। এরপর সব নিস্তব্ধ। শাহজাদী দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কয়েক মিনিট। এই ঘরটা মোরশেদের বাড়ি একেবারেই কোণায় অবস্থিত। সব সময় খালি পড়ে থাকে। এই ঘরে দুটো জানালা। একটি জানালা খুললে আম, কাঁঠাল এবং তেতুলের ঝাড় চোখে পড়ে। আরেকটি জানালা খুলে চোখে পড়ে পাশাপাশি তিনটি কবর। কবর তিনটির একটি মোরশেদের বাবার, বাকি দুইটি দাদা-দাদীর। বলা যায় ছোটখাটো পারিবারিক কবরস্থান। শাহজাদি এই কয়েকদিন বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে এই রুমটি বেছে নিয়েছে তার পিচাশ কর্মের জন্য।

কিন্তু এই মুহূর্তে সে ভয় পাচ্ছে। যে কাজ করতে চলেছে তা এর আগেও তিন বার করেছে। তবে তখন একা ছিল না। তার সঙ্গে অন্যরা ছিল। আজ সে একা। যা করতে হবে, একেবারেই একা হাতে করতে হবে। আরেক বার অন্ধকার ঘরটায় চোখ ঘুরালো। শাহজাদি ঘাবড়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো। তারপর এগিয়ে চললো জানালার দিকে। যেটি দিয়ে আম-কাঁঠালের গাছ চোখে পড়ে, সেই জানালাটি খুলে ওখানেই বসে পড়ল ও। বুক দুরুদুরু করছে। কিন্তু সাহস হারালে চলবে না। রাতের মধ্যভাগ চলছে। প্রহর শেষ হওয়ার আগেই ওর কার্য সম্পাদন করা খুব জরুরি। একটা কাপড়ের থলেতে প্রয়োজনীয় সব নিয়েই এসেছে। এই কয়দিন যাবত এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সবকিছু জোগাড় করেছে সে। দু’দিন আগে কবর খুঁড়ে মানুষের মাথার কঙ্কাল বের করে আনতে গিয়ে প্রায় জানটাই বের হয়ে যাচ্ছিল ওর। কত কষ্ট করে এই জিনিস জোগাড় করেছে, তা শুধুমাত্র ও-ই জানে। থলে থেকে আলগোছে জিনিসটা বের করে নিলো। দু’হাতের আঁজলায় কঙ্কালটা ধরে মাথার উপর নমস্কারের ভঙ্গি করে উঁচু করে। তারপর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে শয়তানের প্রশংসা এবং শুকরিয়া আদায় করতে করতে কঙ্কালটি মাটির উপর রাখল। যেখানে রাখল তার চারপাশে গোল দাগ টেনে মধ্যে তারা আঁকলো। পাঁচটি তারায় পাঁচ ধরনের জিনিস রাখল। সব গুলোয় প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশবিশেষ। প্রায় রাতে মোরশেদকে কাঠবাদামের দুধ খাইয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত রাখত ও। কেননা কাঠবাদামে থাকে ম্যাগনেশিয়াম এবং ট্রিপটোফ্যান- যা মানুষের স্নায়ুপেশী শিথিল করে ঘুম গভীর এবং দীর্ঘ করে। মোরশেদ ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত ও। ফিরতো ফজরের আগে আগে। রুনু বেগম দেখে ফেলেছিলেন একদিন। কোনো ভাবে কথা ঘুরিয়ে বেঁচে ছিল সে-বারে। মধ্য রাতে এর কবর ওর কবর ঘুরে ঘুরে এই জিনিসগুলো উদ্ধার করতে হয়েছে ওর। থলে থেকে কালচে শুকিয়ে যাওয়া মানুষের কলিজাটা বের করতে গিয়ে ওর একবার হাত কাঁপল। তীব্র শীতের রাতেও ও হু হু করে ঘেমে উঠল। কলিজাটা তারার শেষ ভাগে রেখে আরও একবার সব ঠিকঠাক ভাবে গোছানো হলো কি-না, তা দেখে নিলো ও।

এরপর শুরু হলো যজ্ঞ। দু’হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে আসন পেতে বসে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করতে লাগল। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, তিরিশ মিনিট। হঠাৎ হাওয়ার গতি বাড়ে। শাহজাদি কেঁপে ওঠে তবে মন্ত্রপাঠ থামাল না। দু’হাত আরও শক্ত করে জোর দিয়ে ধরল। ঠোঁটের বিড়বিড়ানি বেড়ে চলে। বাহিরে ততক্ষণে হাওয়ার তেজ দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। শান্ত প্রকৃতি হঠাৎ করে ঝড়ের রূপ ধারণ করে। শাহজাদি বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ওর মন্ত্রপাঠ বাড়িয়ে যায়। কে*টে যায় চল্লিশ মিনিট। একটা বড় বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে আঁছড়ে পড়তেই শাহজাদি চোখ মেলে তাকাল। ডান পাশ থেকে বের করে রাখা চা*কুটা এবার তুলে নিলো। চোখের পলকে বাম হাতের মাঝখান দিয়ে কে*টে ফেলল ও। গলগল করে বেরিয়ে আসে র*ক্ত, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে মানুষের মাথার খুলিটার উপর। কি ভয়ংকর সেই দৃশ্য! প্রকৃতি শান্ত হলো। শাহজাদির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। তৎক্ষনাৎ থলে থেকে কাপড় দিয়ে বানানো বিভৎস পুতুলটি বের করে নিলো ও। নিজের হাতের রক্ত দিয়ে মাখামাখি করে দিলো পুতুলটি। তারপর একটি বড় মোটা সূচ পুতুলের বুক বরাবর এফোড়-ওফোড় করে ঢুকিয়ে দিতেই বাইরের ঝড় পুরোপুরি শান্ত হয়ে আসে। দেখে মনেই হবে না, মিনিট কয়েক পূর্বেও সব ভেঙেচুরে নেওয়া বাতাস বইছিল! শাহজাদি ঘেমে জবজবে হয়। তবুও তার বুকে প্রশান্তি, ঠোঁটে পৈশাচিক তৃপ্তিময় হাসি। কাজ হয়ে গেছে। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে গুছিয়ে নিয়ে পুনরায় থলেতে ভরল ও। শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে বাম হাতটা শক্ত করে বেঁধে নিলো। ভেতরে দিয়ে দিলো কিছু দূর্বাঘাস। যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু এই যন্ত্রণা আগাম হতে যাওয়া কাজটির কাছে কিছুই নয়! শাহজাদি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা চলে এলো কবর তিনটির পাশে। খুঁজে বের করল,মোরশেদের বাবার কবর। তারপর সেই কবরের পাশেই মাটি খুঁড়ে পুতুলটিকে দাফন করে দিলো ও। সম্পূর্ণ কাজ শেষ!
শাহজাদি কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। ভোরের আলো ফুঁটি ফুঁটি করছে। এখন গোসল সাড়তে হবে। ক্লান্ত লাগছে তবে স্বস্তি লাগছে। শাহজাদি দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎসিত হাসিটা ওর ঠোঁটে ধরে বলল,

“খা** মা**, কাইল থেইকা এই সংসার আমার একলার। তোর যাওনের সময় হইয়া গেছে।”

পরদিন সকালে মোরশেদের ঘুম ভাঙলো শাহজাদির আর্ত চিৎকারে। শাহজাদি ‘আল্লাহ গো’ বলে চিৎকার করে কাঁদছে। কেননা রুনু বেগম গতকাল রাতে ঘুমের ভেতরই মা*রা গিয়েছেন।

মোরশেদের মনে হলো তিনি ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন। এই বুঝি ঘুম ভেঙে জেগে উঠবেন আর দেখবেন, সব কিছুই ঠিক আছে। তাঁর মা বেঁচে রয়েছেন। উনুনের সামনে পিড়ি পেতে বসে জ্বাল ঠেলছেন চুলোর ভেতর। মোরশেদ কে দেখেই ডাক দিয়ে বলবেন,

“বাবা, উঠছোস? হাত-মুখ ধুইয়া আয়। আমি ভাত বাইড়া দেই।”

কিন্তু…
না! কঠিন হলেও সত্য, তাঁর মা তাঁকে ছেড়ে চিরজীবনের জন্য চলে গিয়েছেন। আর কোনোদিন তাঁর জন্য তিন বেলার খাবার বেড়ে অপেক্ষা করবেন না। তিনি আর অস্থির হয়ে উঠবেন না সন্তান বাড়ি ফেরার আগেই রান্না হলো কীনা সেই দুশ্চিন্তা করে। কোনোদিনই সন্তানের মঙ্গল কামনায় রবের নিকট দু’হাত তুলে অঝোরে কাঁদবেন না। আর না কোনোদিন মোরশেদ অসুস্থ হলে বারবার ‘কিছু লাগবে কীনা, কিছু চাই কীনা, এখন কেমন লাগছে’ করে করে অশান্ত হয়ে উঠবেন!

‘মা’ – এক অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটার ভেতর পৃথিবীর সব মায়া মমতা জড়ানো। দশটা মাস পেটে রাখার পর দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করে জন্ম দিয়েও আজীবন ছায়ার মতো মিশে থাকেন সন্তানের সঙ্গে। আগলে রাখেন বটবৃক্ষের মতো। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সন্তানের ভালোটা চেয়ে যান, চাইতেই থাকেন, চাইতে চাইতে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দেন। তবুও তার দুঃখবোধ থাকে না, আফসোস লাগে না। কি এক অদ্ভুত সম্পর্ক, রহস্যময় টান মা এবং সন্তানের মধ্যে। স্বয়ং আল্লাহ এই মহব্বত তৈরি করে ছড়িয়ে দেন! তাই বুঝি মানুষ বলে, নাড়ির টান, সবচেয়ে বড় টান!

মোরশেদ দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন। তাঁর আব্বা মা*রা গেছেন আরও প্রায় বাইশ বছর পূর্বে। তখন তিনি কম বয়সী তরুণ। খুব একটা চোট লাগেনি হৃদয়ে। আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকে মা-ই একমাত্র ছেলেটাকে ভালোবেসে, বুকে আগলে দিন পার করেছেন। মোরশেদ যত বড়ই হোক না কেন, তাকে মমতা করেছেন যেন সে ছোট্ট একটি শিশু! সেই মা আজ চোখের সামনে নিথর হয়ে শুয়ে… এ দৃশ্য কি মানা যায়?
আর কোনোদিন তবে ‘মা’ বলে ডাক দেওয়া হবে না! আর কোনোদিন অন্যের রাগ মায়ের উপর মিটিয়ে ফেলার সুযোগ পাওয়া যাবে না। আর কোনোদিন মা’কে জ্বালিয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করা হবে না। আর না কোনোদিন মায়ের থেকে শুনতে পারা যাবে, ‘পেটে একটা অজাত ধরছি!’

মা- মা’রে..মায়ের চেয়ে বড় আপন কেহই যে হয় না! সবকিছুর ঋণ শোধ হয়, মায়ের ঋণ যে শোধ করা যাবে না গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে পড়ালেও! উপস্থিত জনস্রোত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেন, জীবনের অর্ধেকেরও বেশি পার করা পুরুষটি ছোট্ট শিশুর মতো হাউমাউ করে মায়ের লা*শ জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এহেন দৃশ্য পানি এনে দিলো সকলের চোখেই…

কবর জীবনটা কেমন হয়? মাটির ঘরে শুয়ে থাকে কেমন করে রুহ? একলা অন্ধকারে সেও বুঝি কাঁদে! হয়তো ডাকেও পরিবারের পরিচিত মানুষদের। হয়তো আর্তনাদও করে। তাই তো মানুষের কানে সেই আর্তনাদ পৌঁছানোর কোনো পথ মাওলা তৈরি করে দেননি। যদি দিতেন, তবে বুঝি পৃথিবীর বুকে পেন্সিলের এক ফোঁটা সমপরিমাণ পাপ কাজ করার সাহস কারো চিত্তে থাকত না।

সদ্য তাজা মাটির খোঁড়া কবরটির সামনে দাঁড়িয়ে মোরশেদ অনেক কিছুর হিসেব মেলাতে শুরু করে। তার অবচেতন মন কেমন যেন হু হু করছে। মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু খারাপ হয়েছে। ভীষণ খারাপ কিছু। যা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। একটু অদূরেই খাটিয়ার উপর রাখা মায়ের লা*শটা কি যেন বলতে চাইছে, বোঝাতে চাইছে। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ চিৎকারের ভাষা বোঝার সাধ্য মোরশেদের নেই। সে মাথা ঝেড়ে চিন্তা সরানোর চেষ্টা করে। বারবার চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছতে মুছতে গলার কাছে এক ধরনের জ্বালাপোড়া অনুভব করেন তিনি। বুকের ছাতিটা ফেটে যাচ্ছে। একটুখানি পানি ভীষণ প্রয়োজন। মোরশেদ চারপাশে চোখ বোলালেন। শাহজাদি নেই। মেয়েটা গর্ভবতী। সকালে সেই অবস্থায় চিৎকার করে কেঁদেছে। সম্পর্ক যেমনই ছিল কিন্তু শ্বাশুড়ি ছিল ওর। কষ্ট পেয়েছে! মোরশেদের উচিত নিজের পাশাপাশি বউকেও সামলানো, সাহস এবং শক্তি দেওয়া। মানুষ মরণশীল। আজ নয়তো কাল তাকে তার রবের পথে চিরতরের পাড়ি জমাতে হবেই। দুই দিনের এই দুনিয়ার প্রতি এত মায়া না রাখাই উচিত তাই।

মোরশেদ রুনু বেগমকে কবরে শোয়ানোর আগে পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরের ভিতরে পা বাড়ালেন। পানি খেয়ে শাহজাদি কে খুঁজতে খুঁজতে নিজেদের ঘরে এলেন। দেখলেন, শাহজাদি চুপ করে বসে রয়েছে। ওর চোখমুখ অদ্ভুত। গভীর চিন্তায় যেন নিমজ্জিত। মোরশেদের হৃদয়টা পুনরায় মোচড় দিয়ে উঠে। তিনি এগিয়ে গিয়ে শাহজাদির পাশে বসতেই শাহজাদির ধ্যান ভাঙে। চোখের সামনে আচানক মোরশেদ কে দেখতে পেয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থতমত খায়। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে অভিনয়ের অংশটা শুরু করে।

মোরশেদকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপনে ভাইঙ্গা পড়বেন না। হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে। মায়ের এই কয়দিন রিযিক আছিলো। আপনে আল্লাহর দোহাই লাগে ভাইঙ্গা পড়বেন না।”

মোরশেদ ব্যথিত স্বরে বললেন,

“কষ্ট হইতাছে। সুস্থ মানুষ, হঠাৎ কইরা…ভাবতে পারি নাই।”

“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করেন, আম্মারে বেশি কষ্ট দিয়া নেয় নাই। ঘুমের মধ্যে নিয়া গেছে গা। আম্মা জানি বেহেশত পায়, আপনে নামাজ পইড়া খালি হেই দোয়াই করবেন। কবর দিছেন?”

মোরশেদ শাহজাদিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,

“না। গলাডা শুকাইয়া গেছিল। পানি খাইতে আইয়া এদিক আইলাম। তুমি আর কান্দাকাটি কইরো না। ইট্টু শুইয়া থাকো। এই শরীরে এইসব…”

“আপনে আমার লিগা চিন্তা কইরেন না খামাকা। আমি ঠিক আছি। আপনে যান। কবর দিয়া আহেন।”

“আইচ্ছা।”

মোরশেদ চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় শাহজাদির দিকে তাকালেন। একটা জিনিস হুট করেই তার চোখে লেগেছে। শাহজাদি খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল। মোরশেদ এগিয়ে এসে খপ করে শাহজাদির বাম হাতটা নিজের হাতে তুলে নেন। শাহজাদি ভয় পেয়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে মোরশেদ কঠিন চোখ করে তাকায়।

“হাতে কি হইছে?”

শাহজাদি আমতা আমতা করে বলল,

“কি অইবো! কিছু না।”

“তাইলে কাপড় বাইন্ধা রাখছোস ক্যান? দেহি…”

“কইলাম তো কিছু অয় নাই। ইট্টূখানি কাইটা গেছিল। আপনে এদিক না দেইখা ওদিক যান। রুহের কষ্ট হইতাছে। তাড়াতাড়ি দাফন দেওয়া ভালো।”

“আমারে হিগাইস না। হাত খুলতে দে।”

এক প্রকার জোর করেই শাহজাদির হাতের বাঁধন খুলে ফেললেন। শাহজাদি ব্যথা পেল ভীষণ। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। মোরশেদ হাত দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। এত বড় কা*টার আঘাত! তাও আবার এবড়োথেবড়ো ভাবে নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই কা*টা টা ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে। ধারালো কিছু দিয়ে এক টানে কা*টা হয়েছে। কিন্তু এমন কাজ শাহজাদি কেন করতে যাবে! মোরশেদ একটি প্রশ্নও করলেন না। ভয়ার্ত শাহজাদির চোখমুখ দেখে শুধু বললেন,

“কাপড় পেচাইয়া ল।”

তারপর বের হয়ে গেলেন। শাহজাদির বুকের অস্থিরতা বেড়ে আকাশ ছুঁলো। মানুষটা কিচ্ছু বলল না কেন! তবে কি সে সব বুঝে গিয়েছে?

ভাগ্য সদয় হলো নাকি মায়ের রুহই একের পর এক ঘটনা গুলো মোরশেদের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়ালো কে জানে। শাহজাদির কা*টা হাতটা মনের মধ্যে অদ্ভুত সব চিন্তাধারার আবির্ভাব করছে। মোরশেদ ঘোরগ্রস্তের মতো খোঁড়া কবরে নামে। মায়ের লাশটা শুইয়ে দিয়ে উপরে উঠতে গেলে রোদের আলোতে কী যেন চমকে উঠল। মোরশেদ সরু চোখ করে তাকাল। কবরের ডান পাশে, মাটির ভেতর কিছু একটা চকচক করছে। সূর্যের তেজী রশ্মির কারণে সেটিই আলো প্রতিফলন করছে। মোরশেদ হাত ঢুকিয়ে দিলো। মাটির ভেতর থেকে জিনিসটা টেনে বের করে আনতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। সেই সঙ্গে আশেপাশে যারা উপস্থিত, সবাই-ই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। এ যে ভালো লক্ষণ নয়! অশুভ প্রতীক! বুকে শূল বিঁধানো পুতুল! পুতুলের গায়ের যে কাপড়টা, সেটি রুনু বেগমের শাড়ির এক টুকরো অংশ। এই শাড়িটা খুব ভালো ভাবে চেনে মোরশেদ। সে নিজ হাতে হাট থেকে মায়ের জন্য কিনে নিয়ে এসেছিল গত রোজায়। মা সবসময় পড়তেন। সেই শাড়ির একটুকরো অংশ এই বীভৎস পুতুলের গায়ে কি করছে? আর কেনই বা এর বুকে শূল বিঁধে আছে? শাহজাদির হাত কা*টা কেন? একটার পর একটা প্রশ্ন মোরশেদের বুকের উপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। মোরশেদ থ মে*রে বেশ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই রইলেন। সদ্য শোয়ানো লা*শের দিকে তাকালে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মা কি তবে এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর গুলো বুকে আসার জন্যে বুঝি এত উচাটন হচ্ছিল সকাল থেকে!

(চলবে)

#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_১৭ (খ)
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
খসখস আওয়াজ হচ্ছে পাতায়। তুষারের আঙুল চলছে। কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বেলা কত হলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটার।

ও চাঁদ রাণী,
শেষমেশ তুমি ওই আকাশের চাঁদ হয়েই থাকবে? আমার আকাশে তোমার আলো পড়বে না? আমি যে মেঘ হয়ে উড়ছি তোমায় একটুখানি ছোঁয়ার জন্য। তোমার এক টুকরো স্পর্শও আমাকে জান্নাতের সুখ দেবে। মনে হবে, এ জীবনে আর চাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। তুমি ছুঁয়ে দিলেই আমি অমর হবো। কিন্তু.. তুমি রাতের আকাশের তেজী চাঁদ! তোমার আশপাশ দিয়ে উড়ে চলে যাওয়া যায়, ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়েও থাকা যায়, শুধু ছোঁয়া যায় না। তুমি না চাইলে কারো সাধ্যি নেই তোমাকে ছোঁয়! ও চাঁদ রাণী, আমার হয়েও হলে না। তোমায় এক সমুদ্র ভালোবাসা দিতাম। সেই সমুদ্রে তোমার আলো জ্বলজ্বল করে জানান দিতো, ভালোবাসা সুন্দর, ভালোবাসা পবিত্র, ভালোবাসায় ম*রলেও পাপ নেই। যদি আমি হারিয়ে যাই, কোনোদিন কি খোঁজ নেবে? কোনোদিন কি মনে পড়বে, এক টুকরো মেঘ ছিল তোমার আঙিনায়?

দরজাটা খোলার শব্দ হলো। তুষারের মনোযোগ ছিন্ন হয়। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল আহ্লাদি সজল চোখে এসে দাঁড়িয়েছে। তুষারের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে সযত্নে ডায়েরিটা বন্ধ করতে করতে বলল,

“কিছু চাই?”

আহ্লাদি সে কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। সে এগিয়ে এসে চুপ করে তুষারের পাশে বসে। তুষার তার পরিপূর্ণ মনোযোগ নিয়ে আহ্লাদির দিকে তাকাল। মেয়েটাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তার আগে জানা প্রয়োজন, ও এখানে কেন এসেছে!

তুষার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

“কিছু বলতে এসেছো?”

আহ্লাদি ঘাড় কাত করে।

“হুম।”

“বলো।”

একটুখানি সময় চুপ করে থেকে ও বলতে শুরু করে,

“আপনে সত্যিই আমারে পছন্দ করেন না?”

“পছন্দ বলতে কি বোঝো তুমি?”

“আমি আপনেরে যেমুন পছন্দ করি, সেমুন করেন না?”

“তুমি আমাকে কেমন পছন্দ করো, তা আমি জানি না! তবে হ্যাঁ, আমি তোমাকে মানুষ হিসেবে পছন্দ করি। এর বাহিরে আর কিচ্ছু নয়। তোমার সাথে আমার আলাদা কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়া অসম্ভব আহ্লাদি।”

আহ্লাদির চোখজোড়া জলে চিকচিক করছে। সে মাথানিচু করল। তুষার ফের গভীর একটি শ্বাস ছাড়ে। বলল,

“শোনো, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দাও। পৃথিবীর সব কাজ করতে তোমার ভালো লাগে?”

আহ্লাদি দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

“না।”

“তুমি কি করতে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করো?”

আহ্লাদি চটচট করে জবাব দিলো,

“বেশি কাম করতেই আমার ভালো লাগে না। আমি তো খাই, দাই, ঘুমাই আর ঘুরি। মায়ে আমারে বকে। এইডা ওইডা করতে কয়। আমি পাত্তা দেই না। ভাইয়ের বউয়েরা আছে। হেরাই সব করে। আমার কুনু কাম নাই।”

“আচ্ছা! তারপরও ধরো, তোমার অনেক বিরক্তিকর একটা কাজের কথা বলো।”

এবার ও খানিকটা ভাবার সময় নিয়ে উত্তর করল,

“কাপড় ধুইতে। এই কাম করতে গেলে আমার এমুন মেজাজটা খারাপ হয়। মন চায় সব কাপড় ছিঁড়া ফালাইয়া চইলা আসি।”

“কাপড় ধুতে তোমার কতক্ষণ সময় লাগে? সর্বোচ্চ?”

“এক ঘন্টা!”

“আচ্ছা। ভেবে দেখো, একটা কাজ তোমার পছন্দ না। তাও সেটা করতে এক ঘন্টা লাগে মাত্র। তবুও তুমি সেই কাজটা করতে ইচ্ছুক নও মোটেও। এই এক ঘন্টা সময় ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী নও। সেখানে আমার তোমাকে অন্য ভাবে একেবারেই পছন্দ নয়। তারপরও তোমার ইচ্ছার গুরুত্ব দিতে গিয়ে সারাটা জীবন কীভাবে ত্যাগ করে দিবো? বলো?”

আহ্লাদি হা-মুখ করে চেয়ে রইলো। এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। এভাবে ও ভেবেও দেখেনি। তুষার আহ্লাদির মুখের অবস্থা দেখে অল্প একটু হাসে। পুনরায় বলে উঠল,

“শোনো আহ্লাদি, জীবনের ব্যাপারে কখনো জোর করতে নেই। যেটা ভালো লাগছে না, সেটা করো না, যেটা ভালো লাগছে, সেটা জানিয়ে দাও। যদি পাও তবে ভাগ্যবতী, না পেলে ভাগ্যে নেই ভেবে এগিয়ে যাও। একটা মাত্র জীবনে এত হিসেব কষে কি হবে বলো? মাঝে মাঝে নিজের প্রতি ন্যায় করা উচিত।”

আহ্লাদি ভোঁতা মুখ করে বলল,

“আপনের এত শক্ত শক্ত কতা আমি বুজি না। সব আমার মাতার উপর দিয়া যায়।”

“আমি তোমাকে বিশেষ নজরে দেখি না। তুমি আমার কাছে সাধারণ একটি মেয়ে, একজন মানুষ। তোমার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়। এইটুকু তো বোঝো, বুঝতে পারছো, নাকি?”

আহ্লাদি মুখ গোমড়া করে বলে,

“হুঁ..”

“এইটুকু বুঝলেই হবে। আর কিছু বুঝতে হবে না। বোঝার প্রয়োজন ও নেই।”

“আরেকটা জিনিস বোঝার দরকার আছে। সেইটা বুঝতেই আপনের ধারে আইছি।”

“তাই? কি জিনিস?”

“বলব?”

“হ্যাঁ বলো! আমি শুনছি।”

আহ্লাদির হঠাৎ পরিবর্তন হয়। তার চেহারায় সে বিষাদ খেলা করছিল তা সরে গিয়ে অদ্ভুত একটি আবহ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

আহ্লাদি ধীর স্বরে আসল কথাটা পাড়লো এইবার,

“বকুল অত রাইতে আপনের ঘরে কি করতে আইছিল?”

তুষার বজ্রাহত হলো। ওর কপাল আপনা আপনি কুঁচকে আসে। আহ্লাদি যেন খুব মজা পায়। ওর ঠোঁটে এই এতক্ষণ পর এক চিলতে হাসি ফুঁটে ওঠে।

“আমি গতকাল সব টের পাইছি। আপনে বকুলরে টাইনা নিজের রুমে ঢুকাইছেন। তারপর কি কইছেন? ওয় ওমন দৌড় দিয়া বাইর হইলো ক্যান? ঘরে গিয়া আমারে পানি দেওনের সময় ওর পুরা শরীল থরথর কইরা কাঁপতেছিল। ক্যান? কি করছেন আপনে ওর লগে? আপনের লগে ওর কিয়ের সম্পর্ক? তাইলে কি ভাইবা নিমু আপনেগো ভেতর কিছু একটা চলতাছে?”

তুষার তড়িৎ বলে উঠল,

“কেউ কারো ঘরে আসা মানেই নেতিবাচক কিছু? এত ছোট মন নিয়ে থাকো কীভাবে আহ্লাদি?”

আহ্লাদির নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হয়। অপমানিত বোধ করল সে। ভেবেছিল, এই কথার দ্বারা তুষারকে কাবু করা সম্ভব। কিন্তু এখন দেখছে তুষারই বরং তাকে কাবু করে ফেলছে।

আহ্লাদি শক্ত কণ্ঠে বলল,

“একটা পোলা আর একটা মাইয়া রাইতের আন্ধারে কি করে এক লগে? তাও দুইডাই আবিয়াইত্তা। আমি কি কিছু বুজি না?”

“বোঝো, কিন্তু বেশি বোঝো। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয় আহ্লাদি। হ্যাঁ, ওকে আমি টেনে নিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ভাষা যা বুঝাতে চাইছে সেরকম কোনো কিছুর জন্যে নয়। এই বিষয়টা এখানেই সমাপ্ত থাকবে। যদি এটা নিয়ে তুমি বকুলের সাথে কোনো প্রকার বাজে ব্যবহার করো তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত জল গড়াবে আহ্লাদি।”

আহ্লাদির দাপট কমলো না বরং তুষারের প্রতিটা কথা ওর গায়ে শূলের মতো বিঁধতে শুরু করল।

“আপনের লগে ওর কিছু না থাকলে ওর লিগা আপনের এত দরদ লাগে ক্যান? আপনে কি মনে করছেন, আমারে একটা বুজাইয়া দিলেই হইবো?”

“শোনো মেয়ে…”

ভয়ংকর রেগে গেল ও। এতক্ষণ যাবত চুপচাপ সহ্য করলেও এই মুহূর্তে আর পারল না। তুষারের একটি বাজে স্বভাব হলো, ও সহজে রেগে যায় না কিন্তু একবার রেগে গেলে সহজে ঠান্ডা হয় না। অনেকক্ষণ যাবত ভূতের মতো রাগটা মাথায় চেপে থাকে। একটু পর পর সাপের মতো নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। আশেপাশের সবকিছুর প্রতি মেজাজ খারাপ লাগে। ভয়ানক নিষ্ঠুরতা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

আহ্লাদির পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল তুষার। একটা আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করল,

“ঠিক এই কারণেই আমি তোমাকে পছন্দ করতে পারিনি। তোমার আর বকুলের ভেতর পার্থক্যটা ঠিক এই জায়গায়। বকুল যখন জেনেছিল তুমি আমাকে পছন্দ করো, ও বিষয়টা নেতিবাচক ভাবে নেয়নি। তোমাকে আমাকে এক সাথে এক ঘরে দেখেছে যতই সেটা দিনের বেলা হোক না কেন, তারপরও ও তোমাকে আমাকে ছোট নজরে দেখেনি। আর তুমি তখন থেকে উলটাপালটা কথা বলা শুরু করেছো! নিজের মন মানসিকতা পরিবর্তন করো। স্বভাব পাল্টাও। আশেপাশে চোখ মেলে দেখো। তোমার ব্যাপারে সত্যিই কি সবাই মন থেকে ভালোটা বলে? বলে না আহ্লাদি! মেয়েরা হয় মায়ের জাত তাই মেয়েরা লক্ষী। অলক্ষী হয়ো না। কোনো একদিন নিজের এহেন নিচু ভাবনার কারণে নিজেই আফসোস করবে।”

তুষারের মুখ চললো বিরামহীন। এক নাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলা শেষে যখন ও কথার লাগাম টেনে ধরে তখন আহ্লাদির দু-চোখে নোনা স্রোতের বন্যা। মানুষটা ওকে চরম অপমান করল বটে। আহ্লাদির জেদ বেড়ে এবার আকাশ ছুঁলো। বারবার দাঁতে দাঁত চেপে একটি নাম মনে মনে উচ্চারণ করে, ‘বকুল’
ওকে করা অপমানের শাস্তি মেয়েটাকে পেতে হবে। নাহলে যে কিছুতেই শান্ত হবে না অশান্ত মনখানা। আহ্লাদি কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে সাথে সাথে বেরিয়ে গেল তুষারের ঘর থেকে। তুষার এক হাতে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবল, এবার যদি একটু আক্কেলবোধ হয় ওর!

কেউ নিজ থেকে না চাইলে তাকে গিলিয়ে আক্কেলবোধ অথবা ভালো চিন্তা ভাবনার গুণ খাওয়ানো যায় না। এগুলো মা্নুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, স্বভাব এবং বৈশিষ্ট। আহ্লাদির বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই নিজের স্বভাব পরিবর্তন করার। তার কাছে সে সঠিক এবং তার ভাবনাই ঠিক। একটা মেয়ে অত রাতে আরেকটি ছেলের ঘরে কেন যাবে? আবার সেটি বলায় ছেলেটির এহেন আচরণ তো করার কোনোই প্রশ্ন ছিল না যদি না তাদের ভেতর বিশেষ কোনো সম্পর্ক লুকিয়ে থাকে। তবে কি আহ্লাদি যে চিন্তাভাবনা করত তুষারকে নিয়ে সেই একই চিন্তা বকুলেরও! এবং তুষার তার প্রতি সাড়া না দিলেও বকুলকে সাড়া দিয়েছে? একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী হয়েছে তুষারের মতো ছেলের দিকে হাত বাড়ানো! এত বড় দুঃসাহস ওর? আহ্লাদির ভেতরটা রাগে,ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বকুলের চেয়ে হাজার গুণ দেখতে ভালো হওয়া আহ্লাদি সোজা গিয়ে ঢুকলো আরজুর ঘরে। দুর্ভাগ্যবশত মকবুল ঘরেই ছিলেন। গেঞ্জি গায়ে চাপাচ্ছিলেন। কোথাও বেরোবেন মনে হয়। আহ্লাদি ও ঘরে ঢুকেই কেঁদে ফেলল।

আরজু ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।

“ও আহ্লাদি, ও মা, তুই কান্দোস ক্যান? কি হইছে?”

এগিয়ে এলেন মকবুলও। আরজুকে প্রশ্ন করলেন,

“ওয়ে কান্দে ক্যান?”

“কইতে পারি না।”

পরমুহূর্তেই আহ্লাদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন।

“ওমা, কি হইছে? ক আমারে। আমি না তোর মায়ের মতো। কেউ কিছু কইছে? কি হইছে মা? ও আহ্লাদি, এমনে চুপ কইরা থাকলে কি বুজুম? বকুলের লগে লাগছে? ও কিছু কইছে?”

আহ্লাদি চোখের জল, নাকের জল একত্র করে দু দিকে মাথা নাড়লো। নাক টেনে ভেজা কণ্ঠে বলল,

“না, ও কিছু কয় নাই। ওরে কিছু কমু দেইখাই তো এত্তডি কতা হুনলাম। ওয় আর কি কইবো?”

“আমি তোর কতার আগামাতা বুজতাছি না মা। আমারে একটু খুইল্যা ক দেহি। এই তোর খালুও আছে সামনে। তুই ক আমারে…”

“তোমার মাইয়ার লগে ওই ভাইজান ভাব জমাইছে। আমি হেইডা জিগাইছি দেইখা আমারে দুনিয়ার কতা হুনাইলো!”

আরজু এবং মকবুল একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।

“গতকাল রাইতের বেলা তোমার ছেড়িরে কইছি আমার লিগা পানি আননের কতা। ওয় আনতে গিয়া হাওয়া হইয়া গেছে। আমি দেখবার লিগা বাইর হইয়া দেহি, ওয় ভাইজানের ঘরের সামনে। দুইজনে কি ফুসুরফাসুর করল। আবার ওর গায়েও হাত দিছে। আমি এইসব দেইখা সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই। বকুলরে কি জিগামু? তুষার ভাইজানরে জিগাইতে গেছিলাম, হেয় আমারে কি রাগডা দেহাইলো। আমারে কইলো, আমি যেন বকুলরে এইসব লইয়া কিচ্ছু না জিগাই আর না কাউরে কই। যদি কই তাইলে বলে অনেক খারাপ হইবো। হেয় এই বাড়ির মেহমান, তাই বইলা যা মুন চায় তাই করবো। আর তোমার মাইয়াও বা কেমন! লজ্জা শরম সব খাইয়া ফালাইছে? কয়দিন হইলো এক সংসার থেইকা তালাক খাইয়া আইলো। আইতে না আইতে পোলা মানুষ পাইয়া আউলায় গেছে? এডি জিগাইছি দেইখা আমার দোষ? আমার মন ভালা না। আমারে এতডি কতা হুনানোর হেয় কেডা?”

আহ্লাদি পুনরায় শব্দ করে কাঁদতে লাগল। আরজু দাঁতে দাঁত ঘষলেন। পা বাড়ালেই মকবুল ডেকে উঠে বললেন,

“ওর গায়ে একটাও হাত দিবা না। যা করার আমি করতাছি। মেহমানরে আমি ঘরে আনছি, তাই আমারেই বুজতে দাও।”

“তোমার সাথে আমার মাইয়ার কিয়ের সম্পর্ক?”

তুষার চুপ করে বসে রয়েছে। তাকে ঘিরে আছে মকবুল, আরজু, আহ্লাদি, আহ্লাদির বাবা হারেস এবং ঘরের এক কোণে বকুল। আকাশ এবং সবুজও এতক্ষণ ছিল, তুষার ওদের চলে যেতে বলেছে। মকবুল আর তুষার মুখোমুখি চৌকিতে বসে রয়েছে। মকবুল উত্তরটা করে একবার হারেসের দিকে তাকালে হারেস সুযোগ পেয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলো,

“তোমারে এইহানে অনেক বিশ্বাস কইরা আমরা জায়গা দিছি। তুমি দেহি এহন ঘরের মাইয়াগো ইজ্জত নিয়া টান লাগাইছো।”

তুষার দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“আমি এখানে থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভাড়া দিয়েছি। আপনারা কেউ বিনা খরচে আমাকে রাখেননি।”

“তাই বইলা যা মুন চায় তাই কইরা বেড়াবা হ?”

“আমি এমন কিছুই করিনি যার কারণে ঘরের মেয়েদের সম্মানহানী হবে। বরং আপনারা একটা ছোট্ট বিষয়কে জটিল করে তুলছেন এবং চিৎকার করে আশেপাশের সবাইকে জানাচ্ছেন। আপনারাই বরং বকুলের সম্মান নষ্ট করছেন।”

“কি বললা তুমি!”

হারেস এমন ভাবে এগিয়ে এলেন যেন এক্ষুনি তুষারের গায়ে হাত তুলবেন। তুষার নিজেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ওর মাথার রগ দপদপ করে কাঁপছে। হুট করে ওর চোখ পড়ল বকুলের দিকে। বকুলের চেহারার অস্বাভাবিক কাঁপন ওকে নিস্তেজ করে দিলো। চোখ ইশারায় মেয়েটাকে স্বাভাবিক হতে বলে হারেসের দিকে ফিরে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল,

“আপনি উত্তেজিত হয়ে জল ঘোলা করবেন না। বকুল গত রাতে যাচ্ছিল, আমি জেগে ছিলাম। ওকে দেখার পর থামিয়ে দাঁড়া করাই এবং কিছু কথা বলি। আমি মনে করি না এতে এমন কোনো পাপ করে ফেলেছি।”

“আপনে ওরে ছুইছেন…”

তুষারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলো আহ্লাদি। তুষার অগ্নি চোখে তাকাল। পারছে না চোখের আগুন দিয়েই এই বেয়াদব মেয়েটাকে ভস্ম করে দিতে। এই মেয়েটাই সব কিছুর জন্য দায়ী।

“তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে যে আমি ওকে ছুঁয়েছি?”

আহ্লাদি জবাব দিতে পারল না। আমতা আমতা করে আরজুর মুখের দিকে তাকাল। তুষার পুনরায় শক্ত কণ্ঠে জবাব চাইলো,

“বলো কি প্রমাণ আছে যে আমি ওকে ছুঁয়েছি?”

সঙ্গে সঙ্গে বকুলকে উদ্দেশ্য করে তুষার প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“আমি কি তোমাকে ছুঁয়েছিলাম?”

বকুল হতভম্বের ন্যায় সেকেন্ড তিনেক চেয়ে থেকে আস্তে করে মাথা নাড়লো। তুষার রীতিমতো ধমকের সুরে বলল,

“কথা বলো। বলো, ছুঁয়েছিলাম?”

বকুল ভয়ে কেঁদে ফেলল। দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল,

“না। আপনে আমারে ধরেন নাই। খালি কতা কইছিলেন।”

“কথা বলাটা যে মহা পাপ, আর এই বাড়িতে যে এত কাহিনি, এত নাটক হতে পারে তা আগে জানলে কখনোই এখানে আসতাম না। আমার একটা সম্মান আছে। রীতিমতো সম্মান নিয়ে টানাটানি!”

তুষার মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক চ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে। বকুলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ইশারায় ওকে শান্ত হতে বলে মকবুলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“কাকা,আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকব না। আজকেই এখান থেকে চলে যেতে চাই। আপনাদের এত নাটক সহ্য করার শক্তি পাচ্ছি না।”

মকবুল কি বলবেন ভেবে পেলেন না। নিজের কাছেই খানিকটা লজ্জিত বোধ করছেন। বউয়ের কথায় হারেস কে এভাবে ডেকে এনে ছেলেটাকে অসম্মানিত করা মোটেও উচিত হয়নি। ছেলেটা ভালো ঘরের, ভালো বংশের। সম্পর্ক থাকলে তারই উপকার হতো।

তুষার কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সেই বিকেলেই হারেস যাওয়ার সময় আহ্লাদিকে সাথে করে নিয়ে গেল। এবং রাতের মধ্যে তুষারও নিজের সব কিছু গুছিয়ে নিলো। সেও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ভোরে স্টিমার ছাড়বে শহরের উদ্দেশ্যে। সেই স্টিমারেই তুষার সব স্মৃতি ফেলে চলে যাবে চিরতরের জন্য। হয়তো আর কোনোদিন মনপুরায় আসা হবে না। হয়তো কোনোদিন বকুলের সামনে দাঁড়ানো হবে না। বুকের ভেতর কোথাও একটা জ্বলছে, পুড়ছে মরিচের মতো। কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। আর যে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে এখানে থাকা যায় না!

শেষতক মকবুলও বার কয়েক বললেন, যা হয়েছে সব ভুলে থেকে যাওয়ার কথা। যে কাজে এসেছিল ও, সেই কাজ শেষ করে যাওয়ার কথা। তুষার রাজি হয়নি। অগ্রিম যে থাকার টাকাটা ও দিয়েছিল, সেটাও নিতে আগ্রহী ছিল না। বরং হাসিমুখেই নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,

“আটকাবেন না কাকা। আমার যাওয়া প্রয়োজন।”

এরপর একটা মানুষকে আর বলার কিছুই থাকে না। সে রাতে খেতে বসেও কারো খাওয়া হলো না। আরজুরও কোথাও না কোথাও খারাপ লাগল একটু। শত হোক, নিজের সংসার। এই প্রথম একটা বাইরের মানুষ এলো, তাও আপ্যায়নের বদলে কিসব নিয়ে বিদায় হচ্ছে!

বকুলের আজ কান্না থামছে না। বুকের ভেতর উথাল ঝড়। রাত ফুরালেই মানুষটা চলে যাবে। আর বুঝি কোনোদিন তার ছায়া দেখারও সৌভাগ্য হবে না! এইকবার এপাশ, একবার ওপাশ করে শেষমেশ উঠে বসল ও। আজ কোনো বারণ শুনছে না এ মন। এত উচাটন তো আগে কখনো লাগেনি। মানুষটা খালি হাতে যাচ্ছে না, যাচ্ছে ওর গোটা সত্তা চুরি করে। ওর হৃদয়, ওর রুহ, ওর জীবনটাই মানুষটার নামে উৎসর্গ! বকুল চোখ মুছে চুপি চুপি পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। একবার দেখে নিলো ও ঘরটা। বাবা-মা সবাই ঘুমিয়ে। চারিদিকে সব চুপচাপ। তুষারের ঘরের দিকে যেতে যেতে কি মনে পড়ায় থামলো ও। নিজের ঘরে এলো। চৌকির তল থেকে একটা ঝাপি টেনে নিয়ে আসে। সেখানে একটা ছোট্ট কৌটায় খানিকটা গাঢ় ঘন কাজল। বকুল খুব যত্নে কাজল টানে চোখে। ঘরে কোনো আয়না নেই। নিজেকে নিজে দেখতে পায় না। দেখতে হবেও না। ওই মানুষটা দেখুক! সে জানুক, সবসময় এলোমেলো থাকা আধা পাগল মেয়েটা আজ তাকে দেখাতে চোখে কাজল টেনেছে! তারপর দ্রুততার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তুষারের দরজা আজ বন্ধ। বকুল আতংকিত বোধ করে। লোকটা কি ঘুমিয়ে গেছে? যদি বকুলকে তার ঘরের সামনে দেখে রাগ করে বসেন? যদি বলেন, কেন এসেছো? চলেই তো যাচ্ছি! তবুও কেন মায়া বাড়াচ্ছো? বকুল কি জবাব দেবে? মাথার ভেতর প্রশ্ন পোকা কিলবিল করে খায়। তবুও সব জড়তা পাশে রেখে বকুল আস্তে করে কাঠের দরজায় টোকা মা*রে। একবার, দুইবার, তৃতীয় বার হাত তুলবার আগেই দরজা খুলে যায়। বকুলের নিঃশ্বাস আঁটকে আসে। চোখ জলে ভরে ওঠে। ও খোদা! মানুষটা এত সুন্দর কেন? এত কেন মায়া ওই মুখে? কাল থেকে যে আর দেখা হবে না! একবার ঐ চোখজোড়া ছুঁয়ে দিলে কি খুব পাপ হবে?

তুষার বলল,

“তুমি?”

বকুল দ্রুত নিজেকে সামলালো। আস্তে করে বলল,

“একটু বাইরে আইবেন?”

“কোথায়?”

“ভয় পাইয়েন না, নিয়া মাইরা ফালাবো না। আমার সাথে এক জায়গায় যাইবেন। আইবেন?”

তুষার মৃদু শ্বাস ফেলে গায়ে গরম কাপড় চাপায়।

“চলো।”

ওরা পাশাপাশি হাঁটে। বকুলদের বাড়ির পেছন দিয়ে যে পথটা সোজা আম বাগানের গিয়ে থামে, সেই পথে এত আঁধারেও অবলীলায় এগিয়ে চলে বকুল তরতর করে। তুষারের হাঁটতে সমস্যা হয়। তবে আজ বুকে ভয় নেই, আতংক নেই। ও অনুভব করে। এক হাত দূরত্বে থাকা মেয়েটা ওর হৃদয়ের এত কাছে কেমন করে এলো? হায় ভালোবাসা- তুমি এক আজব জিনিস! মানুষকে উন্মাদ বানাতে কোনো কমতি নেই তোমার।

আজ আকাশে চাঁদ নেই। তুষার বিড়বিড় করে বলে,

“চাঁদ টা তো আমার পাশে নেমে এসেছে।”

বকুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বলল,

“কি কইলেন?”

তুষার মৃদু হেসে জবাব দিলো,

“কিছু না। এখানে এলে যে!”

“এমনি।”

“কেউ দেখলে…”

বকুল কটাক্ষ করে হাসল।

“নতুন কইরা আর কিইবা হইবো? হইতে দেন। কাইল তো যাইবেনই।”

“হুম।”

এরপর সব চুপ। মৃদুমন্দ বাতাস। গায়ে কা*টা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা দুজনেই উষ্ণ। ভালোবাসার আগুন ওদের জাপটে ধরে আছে। পৃথিবীর কোনো অনুভূতি অনুভূতি শূন্য দুটো হৃদয়ে দাপট চালাতে পারছে না।

বকুল বলল,

“আপনে আর আইবেন না?”

তুষার বলল,

“জানি না।”

“আর কোনোদিন আপনের লগে দেখা হইবো না?”

“ভাগ্যে থাকলে!”

“এইখানেই তো মা*ইর খাই আমি। আমার এমুন পোড়া ভাগ্য। আমি সবসময় যা চাই, তাই হারাই।”

“তুমি আমায় চেয়েছিলে কখনো?”

“যদি বলি চাইছি…তাইলে থাকবেন?”

“না বকুল। এবার আমায় সত্যিই যেতে হবে।”

বকুল মৃদু শ্বাস ফেলে। সেই নিঃশ্বাসে মিশে আছে কান্না, লুকোনো আকুতি। ও আর কিছু বলতে পারল না। অন্ধকারে চোখ বুজে মানুষটাকে অনুভব করে। যখন চোখ খুলল, বিদ্যুৎ গতিতে চমকে উঠে। তুষার অত্যধিক সাহসিকতার একটি কাজ করে বসল। এগিয়ে এসে তড়িৎ বকুলকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। এই প্রথম…হয়তোবা এই শেষ! ভাগ্য ওদের দু’জনার কপালে কি লিখে রেখেছে কে জানে!

“কাঁদবে না। চোখের কাজল মুছে যাবে।”

“আপনে দেখছেন?”

“আমার চাঁদ রাণীর গায়ে দাগ, আর মেঘবালক এত কাছে এসেও দেখবে না?”

“আপনের এই শক্ত কতাডা আজকে আমি বুজলাম।”

“কারণ আজ তোমার হৃদয়ে প্রেম চাঁদ রাণী।”

“আমারে ভুইলা যাইবেন?”

“যে হৃদয়ের এত কাছে তাকে কি করে ভুলি?”

“আর কি আইবেন না?”

“আমার সাথে যোগাযোগের একটা নাম্বার এবং আমার বাড়ির ঠিকানাটা তোমায় লিখে দিয়ে যাচ্ছি চাঁদ রাণী। যেদিন ডাকবে, আমি চলে আসবো। মেঘ উড়ে যত দূরেই যাক, ঘুরেফিরে আসবে তো তার চাঁদ রাণীর ধারেই…”

তুষারের ঠোঁট মেয়েটার কপাল ছোঁয়। দুটি মানবের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রয় গুমোট ঘোলা প্রকৃতি। ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমিও, আপনিও! চাঁদ রাণী এবং মেঘবালকের ভালোবাসায় আমার হৃদয়ে দুটি বাক্য সাজে,

‘ব্যর্থ পোড়া বুক নিয়ে ওরা একলা রাত্রির তারা গোণে,
আহারে প্রেম, আহা ভালোবাসা, কি সুনিপুণ হাতে বুকে সূচ বোনে!’

(চলবে)