#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — শেষপর্ব (১)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
‘কুঞ্জকানন’-এ রোজ সকাল আসে পাখির ডানায় ভর করে। সুখ-দুঃখের সবটুকু অনুভূতিকে আলিঙ্গন করিয়ে কখনও ঝুমঝুম বৃষ্টি কিংবা কখনও সোনাঝড়া রোদ্দুর মেখেও সকাল আসে। প্রতিদিন সকাল হয়, প্রতিটা প্রাণের চঞ্চল হৃদয়ের প্রশান্তি হয়ে। দলে দলে ফুলেরা সুগন্ধি বাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে থাকা সবটুকু সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়, ঘরের সকল কোণায় কোণায়। রোজ সকালের মতো আজও কাঁচা ফুলের সুগন্ধি নাসারন্ধ্রে প্রবেশের পরই চোখ মেলে তাকায় মাহদিয়া। শিয়রের কাছে একগুচ্ছ ফুল দেখে ঠোঁটে ফুটে উঠে প্রাপ্তির হাসি। সেই হাসির মৃদুমন্দ হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মানস্পটে। রাঙিয়ে দেয় মন ভালোবাসার রঙে। ছড়িয়ে দেয় ঘ্রাণ মনমাতানো সৌরভে। হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো তুলে নেয় হাতে। নিঃশব্দে ফুলের পাপড়িতে চুমু খায় একবার। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে খুঁজে। কিন্তু তার চিহ্নও রুমের আশেপাশে নেই। এতক্ষণে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে নিশ্চিত। প্রতিদিন এমন হয়। ফজরের নামাজ একসাথে পড়ার পর লম্বা ঘুম দেয় মাহদিয়া। সেই ফাঁকে ঘুমন্ত মাহদিয়ার শিয়রে একগুচ্ছ কাঁচাফুল রেখে মা ও ভাইকে সময় দেয় শাদাব। এরপর রুটিনমাফিক নিয়ম রক্ষার্থে চলে যায় হসপিটালে।
বেলা দশটা। দুর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়ল মাহদিয়া। আয়নার সামনে দাঁড়াল কয়েক মিনিটের জন্য। মাথায় চুল গঁজাচ্ছে। এক ইঞ্চির চেয়েও সামান্য বেশি চুল এখন। ধীরে ধীরে চুল বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেলাই কাটাতে গিয়ে মাহদিয়ার যত ভয়, যত ব্যথা। এই দু’মাসে সব ভয়েরা সীমাহীন ভালোবাসার কাছে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। এখন আর ভয় হয় না তার। নিজের সৌন্দর্য নিয়েও মনে কোনোপ্রকার খুঁতখুঁত ভাব জন্ম নেয় না। যতবারই মনে হয়, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য সবসময়ই পরাজয় বরণ করে; ততবারই সুখের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের তালে মন হয়ে উঠে তৃপ্ত। শাদাব নিয়মিত কাটাছেঁড়া জায়গায় ঔষধ লাগিয়ে দেয়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তাকে প্রিয়তমার দিকে। চুপটি করে বুকের ভেতর আগলে নেয়। নিজের এই অসুন্দর চেহারা ও ন্যাড়া মাথার জন্য কখনও কখনও কান্নায় ভেঙে পড়ত মাহদিয়া। সবসময় নিজের ত্রুটির দিকে আঙুল দিয়ে বলত,
-‘আমাকে খুব বিচ্ছিরি লাগে তাই না, শাদাব? চেহারার সবটুকু সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এই বিচ্ছিরি একটা মানুষের দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে তোমার অস্বস্তি হয় না?’
শাদাব স্বচ্ছ হাসির সাথে টুপ করে মাহদিয়ার বলা সেইসব বিচ্ছিরি জায়গায় নিঃসংকোচে অধর ছুঁইয়ে দিত। ভরসার বাণী শুনিয়ে বলত,
-‘একদিন বলেছিলাম, ‘আমার কাছে সৌন্দর্যের সবচেয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত তুমি।’ আজ তুমি যেমন আছো, তেমনটাই আমার কাছে সুন্দর, পবিত্র আছো। বার্ধক্যের কোনো এক সময়ে পৌঁছেও আমি বলব, ‘তুমি সুন্দর।’ তখন তুমি বুড়ি হয়ে যাবে। সমস্ত চুল পেকে যাবে। চোখে ছানি পড়বে। শরীরের সবটুক শক্তি হারিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে ঠুকঠুক করে হাঁটবে। আমি তোমাকে দ্যাখব। অপলকে। আনমনে। একসময় হাতে হাত রেখে উঠোনজুড়ে নাতি-নাতনীদের সাথে গল্পের আসর জমাব। ওদের সবাইকে সাক্ষী রেখে তখনও আমি বলব, ‘তুমি সুন্দর ঠিক আগের মতো।’ কারণ, সময় শতবছর পেরিয়ে গেলেও, বর্ষপঞ্জিকা ঋতু পাল্টালেও আমার চোখে তুমি সবসময়ই আমার ‘ভ্রমর’ হয়ে থাকবে। এমনই, এইভাবে, বিশ্বাসে, আদরে।’
ভালোবাসা তো এমনই সুন্দর। বার্ধক্যের পরও যেন প্রিয়জনেরা একে-অন্যের চোখে সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়েই থাকে। সময় পেরিয়ে যাক। বছর ঘুরে যাক। ভালোবাসারা এইভাবে বাড়তে থাকুক। কভু না ফুরাক। এমনসব ভাবনাকে মনে লালন করে ঘুমঘুম ভাবটাকে দূরে সরিয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসলো মাহদিয়া। শিহাব, শাদাব কেউ-ই বাসায় নেই। একজন হসপিটালে, অন্যজন ফাইনাল এ্যাক্সাম দিতে স্কুলে গিয়েছে। সায়রা করীম ইদ্দত পালনের (৪মাস ১০দিন) ওই সময়টুকু বাড়িতেই ইবাদত-বন্দেগি করে কাটান। অপেক্ষায় আছেন, ইদ্দত শেষ হলে এবং মাহদিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলে, রিসেপশনের ঝামেলাটা শেষ করে ফেলবেন। এরমধ্যে শায়লা সুলতানা যে একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, সেটা তো ভুল করেও ভাবেননি তিনি। মেয়ের জন্য হলেও একবার খোঁজ নিতে পারতেন। মাহদিয়া নিজেও মাঝেমধ্যে মায়ের এই হেয়ালিপনা আচরণের কথা ভেবে হতাশ হয়ে পড়ে। তবে পরিবারের সবাইকে পাশে পেয়ে মনে সাহসটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে।
রেহনুমা নাশতা সাজাচ্ছে। সবার খাওয়া শেষ হলেও সে অপেক্ষা করছিল মাহদিয়ার ঘুম ভাঙার। এখন তাকে পাশে দেখে নিজেও খেতে বসল। হঠাৎই বেজে উঠল ফোন। হাতে তুলে দেখল, বাইরের দেশের নম্বর। এবং এটা ইতালি থেকে আসা কল। নতুন ফোন কিনেছে কয়েকদিন আগেই। সিমও কিনতে হয়েছে। এই নম্বরটা শুধু তিনজন মানুষের কাছেই আছে। শাদাব, তার বাবা ও হায়দার সাহেবের কাছে। এতদিন পর, মা তাকে ফোন করছেন? নাশতার প্লেট দূরে সরিয়ে চেয়ার ছেড়ে সোফায় এসে বসল মাহদিয়া। কল রিসিভ করে শান্তস্বরে সালাম দিল। ওপাশ থেকে মায়ের থমথমে মুখের জবাব শোনে বলল,
-‘এতদিন পর মেয়েকে মনে পড়ল?’
শায়লা সুলতানা নির্বিকার গলায় বললেন,
-‘তুই আমার মেয়ে! এটা ভাবতেও খারাপ লাগছে। আমি না-হয় খোঁজ নিইনি, তুই তো নিতে পারতি। ওইভাবে জোরজবরদস্তি করে এয়ারপোর্টে নিয়ে, কসম-টসম দিয়ে তোর বাবা আমাকে ইতালি পাঠিয়ে দিল। অভিমানে যোগাযোগ করিনি। কিন্তু আমি আসার পর তোমরা বাবা-মেয়ে যে অনেক সুখে আছো, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।’
মাহদিয়া কিছু বলতে পারল না। সে নিজেও তো অভিমানে যোগাযোগ করেনি। শুধু অপেক্ষায় থাকত, মা নিজে থেকে ফোন করবেন! ওই ঘটনার পর মায়ের প্রতি সুক্ষ্ম অভিমান ও রাগ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। চাইলেও কল করার মতো মনের জোর পায়নি মাহদিয়া। কেবলই মনে হয়েছে, মা সুযোগ খুঁজবেন। এবং বলবেন, ‘তুই চলে আয় মা। মায়ের কাছে চলে আয়।’ এতকিছুর পর মায়ের সহজসরল কথার কোনো ফাঁদে সে পড়তে চায়নি। যেখানে সে নিশ্চিত হয়ে আছে, মা বিচ্ছেদই টেনে আনতে চান, সেখানে কী করে মা’কে বুঝাবে, শাদাবের সাথেই সে থাকতে চায়! মা যদি নিজে থেকে সন্তানের সুখ না বুঝেন, তাহলে ওই মা’কে আর কীভাবে বুঝানো যায়, জানা নেই মাহদিয়ার। সে শুধু অপেক্ষায় ছিল, মা একটু অনুতপ্ত হোন। তাহলেই সে সবটুকু ভুলকে ক্ষমা করে দিবে এক নিমিষেই! শাদাব যেভাবে ক্ষমা না করে, শেষ দেখা দেখতে গিয়ে অনুতাপে জর্জরিত হয়েছে, সেই একই পরিস্থিতিতে সে পড়তে চায় না। শত হলেও মা তো। ভুল করে অনুতপ্ত হলে, ক্ষমা করে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। তবে নিজেদের সম্পর্কের খুঁটিটাকে চিরকাল শক্ত হাতে বেঁধে রাখতে হবে। নয়তো যেকোনো তৃতীয় পক্ষ এই সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন টেনে আনবে।
মেয়ের নীরবতা দেখে শায়লা সুলতানা বললেন,
-‘একটা কথা বলতে ফোন করেছি।’
-‘বোলো।’
-‘তোর বাবা ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। আড়াই মাস আগের একটা তারিখ দেয়া আছে তাতে। কয়েকদিন আগেই এটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। তুই কি চাস, সাইন করে দিই?’
মাহদিয়ার মাথায় বাজ পড়ল। বাবার এই কাজটা সে জানত না। এতদিন শোনেওনি। বাবা তাকে কোনোপ্রকার ইঙ্গিত না দিয়েই এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন? স্তব্ধ মাহদিয়া কোনো কথা খুঁজে পেল না। বাকহীন হয়ে বসে রইল। শায়লা সুলতানা বললেন,
-‘ঠিক আছে। তোমাদের ভালোর জন্য যদি এই রাস্তা দ্যাখে থাকে তোর বাবা, তাহলে তা-ই হোক। বাংলাদেশের নাম চিরদিনের জন্য মন থেকে মুছে দিচ্ছি। এমনিতেও ওই দেশের প্রতি কোনো টান আমার নেই। এক তুই ছিল। সেই টানটাও এখন ফুরিয়ে এসেছে। নোটিশ পাওয়ার পর তোর বাবাকে ফোন করেছিলাম। শুনলাম, শাদাবের হাতেই তোকে তুলে দেয়া হয়েছে। যাক্। এই অস্ত্রহীন যু//দ্ধে শাদাবই জিতে গেল শ্যাষম্যাশ। মেয়েকেও হারালাম, স্বামী-সংসারও হারালাম।’
শায়লা সুলতানার কণ্ঠস্বরে অনুশোচনা আছে কি নেই মোটেও বুঝতে পারল না মাহদিয়া। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
-‘এখনও সময় আছে মা। চাইলেই এই ডিভোর্স তুমি আটকাতে পারো। প্লিজ আমার কথাগুলো শোনো। দেশে না ফিরো, ফোন করে একবার মায়ের সাথে কথা বলে নাও। মা নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করে দিবে।’
খানিক সময়ের জন্য থমকে গেলেন শায়লা সুলতানা। ঠোঁট নাড়িয়ে ‘মা’ শব্দটা আওড়ে গেলেন। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে নিশ্চিত হলেন, মাহদিয়া এই মা দ্বারা কাকে ইঙ্গিত করল। অভিমানে ভরা গলায় বললেন,
-‘আপন মায়ের সব প্রয়োজন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল দিয়া? এত সহজে সায়রা আপাকে মায়ের আসন দিয়ে দিলি?’
মাহদিয়া অসহায়বোধ করল। মায়ের আসন এত সহজেই কাউকে দেয়া যায় বুঝি? মা তো মা’ই হয়! মায়ের চেয়ে আপন কে আছে আর! সে মায়ের মনের সমস্ত ভুল ধারণা দূর করতে বলল,
-‘মায়েদের জোর করে আসন দিতে হয় না, মা। ওই আসন কিছু কিছু মায়েরা নিজগুণে অর্জন করে নেন। আমার শাশুড়ি মা-ও তেমনই এক মা। যিনি সে-ই ছোট্টটি থেকে, নিজের অভ্যন্তরীণ গুণাবলী ও মায়া-মমতার দিক দিয়ে আমার মা হয়ে গিয়েছেন। আমি চাইলেও এই মায়ের মমতাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারি না। চাইলেও এই মা’কে অস্বীকার করতে পারি না। তেমনই, তুমিও আমার মনেই আছো মা। শুধু একটা ভুলের জন্য আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে। তুমি চাইলেই সেই দূরত্ব দূর করে দিতে পারো। আমি তোমার ওপর কোনো অভিযোগ রাখিনি মা। প্লিজ, ফিরে এসো।’
শায়লা সুলতানা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে গেলেন। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বললেন,
-‘চাইলেই কি আর ফেরা সম্ভব, দিয়া?’
-‘কেন সম্ভব নয়? মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় মা। তুমি যদি অনুতপ্ত হও। যদি একবার ক্ষমা চাও। সবাই তোমার ভুল ক্ষমা করে দিবে। একদম আগের মতো হয়ে যাবে সবকিছু। ফিরে আসবে না, মা?’
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন শায়লা সুলতানা। মাহদিয়া আরও কয়েকবার ডায়াল করেও ব্যর্থ হলো। শায়লা সুলতানা ফোন রিসিভ তো করলেন-ই না। উলটে ফোন সুইচড অফ রেখে দিলেন। বাসার ল্যান্ড-লাইনেও কল করল মাহদিয়া। অনবরত বাজতে থাকল সেটা। রিসিভ হলো না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সায়রা করীমের কাছে গেল মনের কোণে একটু শান্তি অনুভবের জন্য।
***
ছোটোন এ্যাক্সাম শেষ করে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। এবার তার বায়না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাশ্মীর যাবে। যদিও ক’দিন ধরে শাদাবের কানে এই নিয়ে দিনে অসংখ্যবার পোকা ঢোকায় আর বের করে। শাদাব পাত্তা না দেয়ার ভান করে, এটা-সেটা বলে ঘুরিয়ে নেয়। সে আসলে মাহদিয়ার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এখন তাকে নিয়ে দেশের বাইরে কোথায় যেতে মন থেকে সায় পাচ্ছে না। আবার ভাইয়ের আবদারও ফেলে দিবে, সে-ই উপায়ও নেই। কথা যেহেতু দিয়েছে, রাখতেই হবে। কিন্তু কী উপায়ে? ব্যস্ত শাদাব দিশা খুঁজে পায় না। এই কারণেই ভাইকে বুঝিয়ে রাখে। তবে শিহাব নিজের ট্যুর নিয়ে সবসময়ই একটুবেশি-ই আগ্রহী হয়ে থাকে। এবারের ট্যুর যেন মিস নাহয়, সে কারণে তার ছোটাছুটি এখন মাহদিয়ার পিছনেই। অনেকক্ষণ ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে আর বলে বেড়াচ্ছে,
-‘ও ভাবী, একবার ভাইয়াকে বলো না। মাত্র সাতদিনের ট্যুর দিব। কাশ্মীর কত সুন্দর জানো? আমার তো তরই সইছে না। ভাইয়া কেন আমার কথা শুনছে না?’
একাধারে এমনসব কথা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল মাহদিয়া। সে-ও চায়, শিহাব ট্যুরে যাক। একটু আনন্দ-ফুর্তি করে আসুক। মন ফ্রেশ রাখুক। বাবার স্মৃতি কাটিয়ে উঠুক। অথচ শাদাব ব্যস্ত। অসুস্থতা, মৃত্যু, কর্মব্যস্ততা সবমিলিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই শাদাব। মাহদিয়া এটা বুঝতে পারলেও শিহাবকে বুঝানোর মতো পর্যাপ্ত ধৈর্য্যশক্তির বড্ড অভাব তার। অবসর সময়টা টিভি দেখে কাটাচ্ছিল মাহদিয়া। মাঝেমধ্যে বাদাম চিবোচ্ছিল। কিন্তু শিহাব তাকে যে পরিমাণে বিরক্ত করছে, তাতে তার মনোযোগ আর কোথাও নেই। সে টিভির রিমোটটা ফেলে রেখে বলল,
-‘আসো যাই। তুমি আর আমি ট্যুর দিয়ে আসি। তোমার ভাইকে নেয়ার দরকার নেই। সে থাকুক তার কাজ নিয়ে।’
শিহাব গাল ফুলানো ভাব নিয়ে বলল,
-‘কিন্তু তুমি তো অসুস্থ। নিজেকেই ঠিকঠাক সামলাতে পারো না, আমাকে আবার কী সামলাবে? তুমি শুধু ভাইয়াকে ম্যানেজ করে দাও না। আমার বাড়িতে ভালো লাগে না।’
-‘আচ্ছা চলো, আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমি যতদিন সম্পূর্ণ সুস্থ না হচ্ছি, ততদিন তুমি-আমি মিলে এই শহরের আশেপাশেই ছোটোখাটো ট্যুর দিই। সুস্থ হওয়ার পর লম্বা ট্যুরে যাব।’
শিহাব আগের মতোই বলল,
-‘কোথায় যাব এখন?’
-‘এখুনি যাবে? আগামীকাল যাই?’
-‘না। আমি এক্ষুণি যাব। চলো যাই।’
-‘কোথায় যাবে? সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরে আসব কিন্তু। নয়তো বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।’
তিড়িংতিড়িং লাফঝাঁপ দিয়ে শিহাব মাত্রই প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কাছেপিঠে কোথাও একটু ঘুরেফিরে মন ফ্রেশ করে আসবে। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধলেন সায়রা করীম। ছেলেকে শাসন করতে বললেন,
-‘অসুস্থ একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাহস তোর হচ্ছে কী করে, ছোটোন? যদি মেয়েটার কোনো ক্ষতি হয়! মাথাটাথা ঘুরে গেলে, পারবি সামলাতে? দৌড় দিয়ে পালাবি তখন।’
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল শিহাব। সে চায় না, তার একমাত্র ভাবী তাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ুক। মন খারাপ করে নিজের জায়গায়ই বসে রইল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
-‘আমি কি ভীতুর ডিম না-কি? পালাব কেন? সুপারম্যানকে এত দুর্বল ভাবছ কেন তোমরা?’
সায়রা করীম শক্তকণ্ঠে বললেন,
-‘হয়েছে। সব জায়গায় এই সুপারম্যানগিরি দ্যাখানোর দরকার নেই। মাঝেমধ্যে অন্যের কথা ভেবে নিজের দিক ত্যাগ করতে হয়। দিয়া অসুস্থ জেনেও তাকে ধরেবেঁধে বাইরে নিয়ে যাবি? এরপর অসুস্থ হয়ে ফিরলে টোটোন তোকে ছেড়ে কথা বলবে? বকেটকে দিবে তালু ঠাণ্ডা করে।’
-‘তাইবলে কোথাও ঘুরতেও যাব না?’
-‘যাবি তো। টোটোন ফিরুক। ও বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিক। ছুটি নিতে পারলে, এই শহরেই ট্যুর দিবে না-হয়। দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই এখন।’
-‘সেই…। ঘরেই থাকো। ধ্যাত্তেরি।’
মাহদিয়া নিজেও অসহায়। শাশুড়ির কথা ডিঙিয়ে বাড়ির বাইরে পা ফেলার সাহস তার হলো না। আসলেই যদি মাথা ঘুরে পড়ে, তখন কী করবে! শাদাব পাশে থাকলে সাহস থাকে। শত ভয়কেও তখন জয় করা যায়। সে নিজেও মন খারাপের ক্ষণটা এড়িয়ে যেতে শিহাবের ফুটবলটা হাতে নিয়ে রেহনুমাকে ডেকে আনল। শিহাবকে বলল,
-‘আমরা বাড়ির ভেতরেই ইনজয় করতে পারি। খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোড় আর চা-কফি, জমে যাবে না?’
এই কথায় খানিকটা খুশি হলো শিহাব। তবুও মন খারাপ করে বলল,
-‘যদি পড়ে গিয়ে ব্যথা পাও?’
-‘বাড়ির ভেতরে আছি। তাছাড়া সুপারম্যান তো আশেপাশে থাকবেই। ভয়ের কী আছে? কিছু হলে সে ম্যাজিক করে ব্যথা সারিয়ে দিবে।’
মুখভরা হাসি নিয়ে বাড়ির বাইরে খেলাতেই মনোযোগ দিল শিহাব। মাহদিয়া ও রেহনুমাও সঙ্গ দিল। সায়রা করীম ঘরের জানালা দিয়ে ওদের ছোটাছুটি দেখলেন। হাসি-আনন্দ ও দৌড়ঝাঁপ দেখলেন। বাড়ির আনাচে-কানাচে যদি প্রাণের এইরূপ ছোটাছুটি দিনরাত চলতে থাকে, তবে এই বাড়িটা একদিন প্রাণে প্রাণে মুখরিত হয়ে উঠবে।
***
শাদাব বাড়ি ফিরে দেখল, ওদের খুঁনসুটি চলছে। তিনজনে মিলে ড্রয়িংরুমেই খেলছে। এতে করে ফুটবল তো এদিক-ওদিক ছুটছেই, জোরেশোরে লাতি পরাতে ওটা উড়ে এসে একদম শাদাবের কপালে পড়ল। আজ একটু তাড়াতাড়ি-ই ফিরে আসা। বল পড়াতে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শাদাব। কোমরে হাত রেখে তিনজন নামীদামী খেলোয়াড়ের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সবার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝল, কাজটা মাহদিয়াই করেছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে দু’দিকে মাথা নেড়ে যাচ্ছে সে। সামনে এসে কিছু বলতেও পারছে না, আবার নিজের দোষ লুকিয়েও রাখতে পারছে না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আঙুল ফাঁক করে দেখল, শাদাব নিজেই এখন বলটা ফ্লোরে রেখে উপরনিচ করছে আর বলছে,
-‘বল যে মেরেছে, তারজন্য একটা শা//স্তি তুলে রাখা হলো।
মাহদিয়া হাত সরিয়ে বলল,
-‘কী শা//স্তি?’
-‘তোমাকে বলব কেন? তুমি মেরেছ?’
মাহদিয়া ঢোক গিলল। স্বীকার করতে গিয়েও উশখুশ মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাদাব তার পাশে দাঁড়িয়ে, মুখ নামিয়ে বলল,
-‘আরেকটু হলে তো মাথা ফা//টি//য়ে দিচ্ছিলে। তখন নিজেই কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যেতে। ব্যথাটা যেহেতু অল্পই, তাই শা//স্তি//টাও ছোটো। রুমে যাচ্ছি। ফ্রেশ হব। দশ মিনিটের মধ্যে চা-কফি যা পারো, নিয়ে এসো। এরপর যেখানে ব্যথা দিয়েছ, গুনে গুনে দশটা চুমু বসাবে সেখানে। নয়তো শা//স্তি//টা আরও দ্বিগুণ হবে।’
কথা শেষ করে আস্তে করে বলটা ভাইয়ের হাতে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-‘এ্যাক্সাম ভালো হয়েছে?’
ফাঁক পেয়ে দৌড় দিল মাহদিয়া। শিহাব হাসিমুখে বলল,
-‘খুবই ভালো হয়েছে।’
-‘এরপর পরবর্তী প্ল্যান কী? কোন সাবজেক্ট নিয়ে এগোতে চাও?’
-‘সেটা এখনও ভাবিনী। পরে সিদ্ধান্ত নিই?’
-‘কয়েক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো। আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে, আগামীর পথটা সহজ হবে। যা তোমার ভালো লাগে, সেটা নিয়েই এগোবে। কোনো চাপ নেই।’
-‘আচ্ছা। জানো, আমি আর ভাবী চাইছিলাম আজ কোথাও ঘুরতে যাব। কিন্তু মা যেতে নিষেধ করেছে। বলছে, দেশের বাইরেও ট্যুরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি কি সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকব? ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটাব? অলস হয়ে যাব না? স্যার সবসময় বলেন, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা’। এইবার শয়তানেরা বিন্দাস একটা সুযোগ পাবে। ইচ্ছেমতো ঘাড়ে উঠে নাচবে। দূর ভাল্লাগে না।’
শয়তান ঘাড়ে আসুক বা না, তার ঘাড়ে যে এখন ট্যুরে যাওয়ার ভূত চেপেছে সেটা নিমিষেই বুঝে ফেলল শাদাব। ভাবুক নয়নে বলল,
-‘তাই তো! শয়তান তো ছাড়া পেয়ে যাবে। এবার কী হবে? ঘাড় কি আর আস্তো থাকবে? ওটা শয়তানের নাচানাচিতে খসে পড়বে না তো?’
শিহাব দাঁত কটমট ভাব নিয়ে বলল,
-‘তোমরা কেউ-ই চাইছ না, আমি ট্যুরে যাই। তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ। এবার মিস হলে…।’
-‘আরেহ্, তুমি টেনশন নিচ্ছ কেন? ভাইয়া আছি না? সব সমস্যার চটজলদি সমাধান দিতে, এক আমি-ই যথেষ্ট। তবে কথা হচ্ছে, মা তো সারাক্ষণ একা থাকবেন, জানোই। ভ্রমরও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। এইমুহূর্তে, এই দু’জনকে ফেলে যদি আমরা একা একা ট্যুর দিই, ভালো দ্যাখাবে?
শিহাব চিন্তায় পড়ে গেল। ফ্যামিলি ট্যুর হলে আনন্দ দ্বিগুণ হবে তার। কিন্তু তারজন্য তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এক্ষুণি কিংবা এত তাড়াতাড়ি কোথাও ট্যুর দেয়া হবে না। তবে সে এ-ও চাইল না, বাড়ির দু’জন মানুষকে রেখে মনের সুখে তারা দুই ভাই, ঘুরে-বেড়াবে আর দু’জন মানুষ একা একা বাড়িতে থেকে বোর হবে। তারচেয়ে সে যদি কিছুদিন মানিয়ে নিতে পারে, তাহলে তো হলোই। বুদ্ধি কাটিয়ে শিহাব নিজেই বলল,
-‘তুমি কি চাইছ, আমরা সবাই একসাথে ট্যুর দিই?’
-‘অফকোর্স। কিন্তু সেটা এখনই নয়। আরও দুই থেকে তিনমাস পর। তবে তুমি চাইলে আমরা কাশ্মীর যেতেই পারি। বাড়িতে দু’জনকে একা রেখে যাব। তারা আবার অসুস্থ। সবার চিন্তা বাদ দিয়ে যদি ঘুরেফিরে নিজের জন্য শান্তি ও সুখ খুঁজতে চাও, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আগামী দু’দিনের মধ্যে সবকিছু কনফার্ম করে ফেলব।’
শিহাব আবারও কিছুক্ষণ ভাবল। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিল। সবাইকে ফেলে সে নিজে একা ঘুরবে, ফিরবে, হৈ-হুল্লোড় করবে, এটা ঠিক মনোঃপুত হলো না। আহ্লাদী দু’খানা হাত দিয়ে শাদাবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তাহলে থাক্। আমরা একসাথে, অনেকদিনের জন্য দূরে কোথাও ঘুরতে যাব। কিন্তু আমার একটা কথা। দেশের বাইরে ট্যুরে যাওয়ার আগে প্রতি শুক্রবার, তুমি আর আমি বাইরে কোথাও ঘুরতে যাব। তুমি চাইলে সঙ্গে ভাবীকে নিতে পারো আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে কাবাবে হাড্ডি হয়ে গেলে বকাঝকা করতে পারবে না।’
আদূরে কথাবার্তার জাল থেকে বেরিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো শাদাব। ঘড়িতে তখন রাত মাত্র নয়টা। আজ কোনো ও.টি ছিল না। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে পেরেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেহেতু সার্জারীর কোনো রোগী আসেনি, পরবর্তীতেও আসবে না। আর আসলেও সে ছাড়া আরও অন্যান্য স্কিন স্পেশালিষ্টরা আছেন। প্রয়োজন পড়লে, হসপিটাল থেকে মধ্যরাতেও কল আসে। তখন সবকিছু ফেলে রেখে ছুটে যেতে হয় পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্যের টানে। ঝরঝরে শরীর নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে দু’চারবার ব্যাকব্রাশ করল শাদাব। তখন কফি হাতে নিয়ে রুমে আসলো মাহদিয়া। খাবার টাইমে কোন পাগলে কফি খায়? ইচ্ছে হলো একগাদা বকা দিক। কিন্তু তার দ্বারা এসব হয় না। কেন যেন, শাদাবের এই আদুরে হুকুম তার বড্ড ভালো লাগে। মনে হয়, নিজের একটাই তো মানুষ। তারজন্য কিছু করতে পারা তো সৌভাগ্য। পাশে দাঁড়িয়ে কফির কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘সকালে মায়ের কল এসেছিল, শাদাব।’
পিছু ঘুরে কফির কাপটা নিজের হাতে টেনে নিল শাদাব। তাতে চুমুক বসিয়ে বলল,
-‘হঠাৎ! কিছু বলেছেন?’
-‘বাবা না-কি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন।’
যারপরনাই চমকাল শাদাব। আজাদ সাহেবের এত দূরবর্তী ভাবনা তো তারা কেউ-ই টের পায়নি। কেউ ভুল করলে তাকে শা//স্তি দেয়া উচিত। তাইবলে সম্পর্কের বিচ্ছেদ! এমন জঘন্য শা//স্তির কী দরকার! তবে শায়লা সুলতানার ভাগ্য ভালো যে, আজাদ সাহেব ও কায়ছার সাহেবের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। কায়ছার সাহেব কোনোকিছু না ভেবেই স্ত্রীকে অহেতুক নির্দয় ও কঠোর শা//স্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। যা এক নির্দোষ নরম মনের মানুষকে তিলেতিলে কঠিন পাথরে পরিণত করেছে। এখনও ওই পাথর হৃদয়ে স্বামীর প্রতি কোমলতা টের পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে ক্ষমা করে দিয়েছেন এটা নিশ্চিত। এইজন্য রোজ প্রার্থনাও করেন। তবে পূণরায় ওই মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসানো বেশ কঠিনই। এসব দিক থেকে আজাদ সাহেব ও শায়লা সুলতানার অবস্থান আলাদা হলেও, এখন যা পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে শায়লা সুলতানার একূল-ওকূল, দু’কূল ভেসে যাওয়ার জোগাড়। অন্তত নিজের সংসার বাঁচাতে, এবার তাঁর একটুখানি হলেও অনুতপ্ত হওয়া উচিত। সেটুকু জানার আগ্রহ থেকেই বলল,
-‘উনি কী সিদ্ধান্ত নিলেন?’
-‘জানি না। আমি জিজ্ঞেস করাতে, উত্তর না দিয়েই লাইন কেটে দিলেন। এরপর কতবার কল দিলাম, রিসিভ করলেন না। ল্যান্ড-লাইনেও দিলাম, সেটাও একাধারে বেজে গেল। মা এখনও কেন নিজের ভুল স্বীকার করতে নারাজ, শাদাব? আমি ভেবে পাই না, একটা মানুষ এতটা নীচু হয় কী করে? আমি তো তাঁর ভুল ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু তিনি যদি নিজে অনুতপ্ত না হোন…।’
ইশ্, বড্ড অসহায় অবস্থা মাহদিয়ার। মা’কে সে বুঝতেও পারছে না। বুঝাতেও পারছে না। আর কীভাবে মায়ের হুঁশ ফিরবে? কবে তিনি স্ব-জ্ঞানে উপলব্ধি করবেন, তিনি ভুল করেছেন? এখনও করছেন। শাদাব তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাতে থাকা কফির কাপ রেখে দিল ড্রেসিংটেবিলের এককোণে। দু’হাতে তাকে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-‘আমাদের যতটুকু করা দরকার আমরা করব। কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করতে না চায়, তাহলে তাকে আর জোর করার দরকার নেই। সম্পর্ককে ঘিরে একফোঁটা সম্মান ও ভালোবাসা যদি ওনার মনে এখনও অবশিষ্ট থাকে, তবে তিনি নিশ্চয়ই এই ডিভোর্স আটকানোর চেষ্টা করবেন। আর যদি তা না করেন, তবে ধরে নিতে হবে তিনি এটাই চান। এই মুক্তির মাঝেই তাঁর সব সুখ লুকিয়ে রয়েছে।’
***
চলবে…
#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব (২)
কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!
‘পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন,
নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।’
এক লোভের বশবর্তী হয়ে শায়লা সুলতানা পুরো ‘সুখনীড়’-এর সুখকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার খেলায় মেতে উঠেছিলেন। তার দীর্ঘদিনের সব শ্রম-সাধনা সফল হয়েছিল বলেই, সামান্য এক শিহাবের সূত্র ধরে ‘সুখনীড়’ পুরোপুরি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছেন, অন্যায়কারী যতই অন্যায় করুক, একদিন সে মুখ থুবড়ে পড়বেই। পরের অনিষ্ট করতে গিয়ে আজ যে তিনি মাথার উপর বিশ্বস্ত এক হাত ও কোলের সন্তানকে হারালেন, সেটাই এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াল সামনে। তবুও তার চোখের সামনে অহংকার ও হিংসার যে ভারী পর্দা আছে, সেটা তখনও সরল না। তিনি ইচ্ছে করেই সরাননি। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছেন, এখন তিনি যতই ক্ষমা চান, সেটাকে কেউ মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে বিচার করবে না। উলটে করুণা হিসেবে চালিয়ে দিবে। এবং চিরদিন তিনি সায়রা করীমের সামনে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হবেন। কিছু মানুষ আর যা-ই করুক, অন্যের সামনে কখনও মাথা নত করতে বাধ্য থাকে না। নিজেকে সর্বসেরা ভাবাই তাদের একমাত্র কাজ।
একজীবনে বিলাসবহুল জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে তাঁকে। অনেক কাঠগড় পুড়িয়ে আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়াতে হয়েছে। সামান্য এক ক্ষমার কাছে নিজের এতদিনের জমা হওয়া আত্ম-অহমিকাকে দূরে সরিয়ে দিবেন, এত সহজেই? কারও পায়ের কাছে মাথা ঠুকে বলবেন,
-‘আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা। আমার করা ভুলের জন্য দিয়াকে আপনি কষ্ট দিবেন না। ও’কে নিজের মেয়ের মতোই আগলে নিন।’
অসম্ভব! এমন কথা ও শব্দ তিনি কোনোদিনও উচ্চারণ করবেন না। ‘সুখনীড়’-এর সুখ কপালে নেই তো কী হয়েছে, ওই নীড়ের কেউ তো এখন আর সুখে নেই, এটাই তার শান্তির। কেউ কেন এত সুখে থাকবে? কেন এত হাসিখুশি থাকবে? সুখী শুধু তিনি একাই হবেন। এই কারণে মেয়ের সঙ্গেও তিনি আর যোগাযোগ রাখেননি। যেখানে তিনি দু’হাত ভরা টাকা উড়াতে পারছেন, বিলাসবহুল জীবন ও সময়কে নিজের মতো করে উপভোগ করতে পারছেন, সেখানে কী দরকার; সায়রা করীমের হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিজের অহমিকাটুকু বিসর্জন দেয়ার? উঁচু আসনে মানুষ কি একদিনে অধিষ্ঠিত হয়? বছর বছর ধরে লড়াই করে, ধৈর্য ধরে, শ্রম দিয়ে ওই স্থানে আরোহন করতে হয়। ক্ষমা চাইলে তিনি আর উঁচুতে থাকলেন কই? সেইতো কারও পায়ের নিচে মাথা ঠুকতে হবে। নিজের জন্য এখন তিনি নিজেই যথেষ্ট, এমনটাই ভাবনা তাঁর। একাকী জীবন কাটানো খুব একটা কঠিন না। যতই একা থাকুন, যতই স্বামী-সন্তান দূরে থাকুক, তবুও তিনি কারও কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোটো করবেন না। ঠিক এইটুকু ভেবে আজাদ সাহেবের কাজকে সহজ করে দিয়েছেন। নিজেই ডিভোর্স লেটারটায় সিগনেচার করে সেটা আবার দেশে রিটার্নও পাঠিয়ে দিয়েছেন।
শায়লা সুলতানা ইতালির মাটিতে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন নিয়মিত। তিনি এখন ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা পাখি। এতদিন অন্যের বশে থেকে নিজেকে খুঁজে পাননি। সারাজীবন সংসার, হেঁশেল, বাচ্চা এইসব করে কী আর থাকা যায়? পায়ের ওপর পা তুলে খাওয়ার দিনটা একবার আসুক জীবনে! তবে মাহদিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনওই কম ছিল না। মিথ্যেও ছিল না। নাড়িছেঁড়া ধন। তার প্রতি ভালোবাসা, আদর-যত্ন মিথ্যে হওয়ার কথা না। নিজের মেয়েকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন, এটা সত্য। এখনও বাসেন। তবুও এই সত্যকে ঠেলে দিয়ে সন্তানের কাছে অহংকারটাকেই জিতিয়ে দিলেন। সেই অহংকার ও স্বাধীন জীবনের দাপট দেখিয়ে তিনি এখন দিনরাত আয়-ইনকাম করেন। রাতভর শহরের আনাচে-কানাচে দাপাদাপি করেন। মনে কোনোপ্রকার গ্লানিবোধও আসে না, এতটাই সুখকর জীবন উপভোগ করছেন তিনি।
একরাতে তিনি প্রচণ্ড আমোদে মেজাজে বাসায় ফিরলেন। শরীর চাঙ্গা করতে এক কাপ কড়া কফি নিয়ে বসলেন। টেলিভিশন অন করে আয়েশী ভঙ্গিমায় পায়ের ওপর পা উঠিয়ে বসে বসে নিউজ দেখতে লাগলেন। যেন কোনো বাড়তি চাপ নেই জীবনে। সেই সময়েই ল্যান্ড লাইনে কল আসলো। তিনি ভাবলেন, কাজ থেকে ফিরেছেন। হয়তো কাছের বন্ধুবান্ধবদের কেউ ফোন করছে। তাই বেখেয়ালি হয়ে রিসিভার কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
-‘আজ আমার জন্মদিন, মা। আমি তোমাকে প্রচণ্ড মিস করছি। তুমি কি একবারের জন্যও আমাকে কোরোনি? এই দিনটাও কি ভুলে গেলে, তুমি?’
মেয়ের কান্নারত স্বরের একটা শব্দ শোনেই শরীর হীম হয়ে গেল তাঁর। আনমনে, বসে বসে আজ তিনি মেয়ের ফোঁপানি শোনে গেলেন। ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে, ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে উলটে দেখলেন, আজ থেকে ঠিক ছাব্বিশ বছর আগে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের আগমনে কোল ভরে উঠেছিল তাঁর। তিনি থমকানো ভাব নিয়ে চোখমুখ মুছলেন। ওপাশে অনবরত মা হারা সন্তান কাঁদছে। সেই কান্না তাঁর নারীমনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, অথচ তিনি অনড়, পাথর, বাকহীন। বলার মতো আজ যে আর কিছুই বাকী নেই। যা ভুল হওয়ার তা তো অনেক আগেই হয়েছে। এই ভুল এখন শোধরাবেন কী করে? সেদিন তো সুযোগ ছিল, কোর্টের দেয়া নির্ধারিত সময় ছিল, তবুও তিনি সময়টাকে কাজে লাগাননি। উলটে, নিজের অহমিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে তছনছ করে দিয়েছেন নিজেরই সাজানো-গোছানো সংসারকে। এখন কী বলবেন মেয়েকে? কীভাবে মুখ রাখবেন? এইমুহূর্তে তিনি খুব বেশি দিশেহারাবোধ করলেন। শূণ্য বুকটা খা খা করে উঠল, সন্তানকে একটুখানি বুকে নেয়ার জন্য। হাতদুটো নিশপিশ করে উঠল, নাড়িছেঁড়া ধনকে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আজ তিনি নিরুপায়। পথহারা। একদম একা। তাঁর এই একাকীত্বের জন্য কেবল তিনি-ই দায়ী।
মায়ের স্তব্ধতা, নীরবতা আরও বুকফাটা আর্তনাদের কারণ হয়ে দাঁড়াল মাহদিয়ার। অভিমানী স্বরে জানতে চাইল,
-‘শুনতে পাচ্ছ মা, আমার কথা?’
-‘শুনছি, বল।’
ভাঙাগলায় অনুমতি দিয়ে ফের চুপ হয়ে গেলেন শায়লা সুলতানা। মাহদিয়া মনভাঙা কণ্ঠে বলল,
-‘মা…। এই প্রথম এমন হলো, তাই না? তুমি আমার জন্মদিনটা ভুলে গেলে।’
-‘আমি আসলে…।’
-‘প্রতিবার আমার ঘুম ভাঙত, তোমার মুখ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা শোনে। এইযে, রাত পোহালেই ভোর হবে, তোমার গলার আওয়াজ শোনার জন্য, আমার সব অপেক্ষারা এবার ব্যর্থ হবে। তুমি কাছে নেই, চোখের সামনে নেই, তোমার মুখ থেকে আগামীর শুভেচ্ছাবার্তাও শোনা হবে না, চোখ মেলে তোমাকে দ্যাখা হবে না। এসব আমি মানতেই পারছি না। দিনগুলো খুব শূণ্যতায় কাটছে আমার। আমি তোমাকে বুঝাতে পারছি না মা, ঠিক কী হচ্ছে আমার বুকের ভেতর। মন আঁকুপাঁকু করছে তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য। একবার জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখার জন্য। একটুখানি শান্তির জন্য, তোমাকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছি আমি। অথচ, তুমি আসবে না। আমি জানি মা, তুমি আসবে না। আমার জীবনে তোমাকে সবসময়ই প্রয়োজন ছিল, থাকবেও। অথচ তোমার জীবন থেকে আমার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে।’
-‘মায়ের জীবন থেকে সন্তানের প্রয়োজন কখনও ফুরোয় না দিয়া।’
-‘তাই? প্রয়োজন যদি না-ই ফুরোয়, তাহলে কোন অপরাধের শা//স্তি পাচ্ছি আমি?’
-‘তুই কেন শা//স্তি পাবি? শা//স্তি তো তোমরা বাবা-মেয়ে মিলে আমাকে দিলে!’
-‘ভুল করলে তুমি। অন্যায় করলে তুমি। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিলাম আমরা। তবুও তুমি বলছ, আমরা তোমাকে শা//স্তি দিয়েছি? যদি এরকমটা হোতো, তাহলে দিনরাত তোমার শূণ্যতায় আমি ছটফট করতাম না, মা। একদমই করতাম না। সেদিক থেকে তুমি তো একদম গা’ছাড়া ভাব নিয়ে থাকতে পারছ, যা আমরা চাইলেও পারছি না।’
-‘তবে কী করতাম? তোর হাত-পা ধরে ক্ষমা চাইতাম?’
-‘ছিঃ মা। আমি এসব কথা কখনও বলি না। উলটে আমারই তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। মায়েদের শত অন্যায় দ্যাখেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়ে। ক্ষমা করতেও পারে না, মায়ের থেকে দূরেও থাকতে পারে না। চোখে আঙুল দিয়ে দ্যাখিয়েও দিতে পারে না যে, এটা চরম অন্যায়। কত অবলীলায় তুমি ভুল করে গেলে! একটা সাজানো-গোছানো সংসার নষ্ট করে দিলে। তবুও আমরা তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি, ক্ষমা চাওয়ার। নিজের অহংকারকে ধরে রাখতে গিয়ে তুমি, আমাকেই হারিয়ে ফেলেছ মা। টেরও পাওনি, তুমি শুধু মেয়ের দৃষ্টির বাইরেই যাওনি, মনের বাইরেও চলে যাচ্ছ। অথচ আমি সেটা চাইছি না দ্যাখেই, নিয়ম করে ল্যান্ড-লাইনে করে যাই। তুমি কল রিসিভ কোরো না, মা। কলব্যাকও কোরো না। একবার জানতেও চাও না, আমি কেমন আছি!’
-‘তুই যে ভালো আছিস, এটা না বোঝার মতো বোকা আমি নই।’
-‘অথচ আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছিলাম! শুধু শাদাবকে চেয়েছিলাম বলে, পবিত্র সম্পর্কটাকে মূল্য দিতে চেয়েছিলাম বলে, একটা সুন্দর ঘর সাজানোর স্বপ্ন দ্যাখেছিলাম বলে, আমাকে এত বড়ো শা//স্তি দিলে! কী করে মা? কী করলে পারলে আমার সাথে এই দূরত্ব টানতে?’
শায়লা সুলতানা একেবারে নীরব হয়ে গেলেন। মাহদিয়া দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত স্বরে বলল,
-‘তুমি কি খেয়াল করেছ, অন্যের সংসার ভাঙতে গিয়ে আজ তোমার সংসার শূণ্য? তুমি কি খেয়াল করেছ মা, এক মা’কে সন্তানহারা করতে গিয়ে তুমি আজ নিজের মেয়ের থেকে দূরে? একবারও মনে হয় না, তুমি এতদিন ধরে ভুলেগড়া ভাবনা নিয়ে, জীবন অতিবাহিত করে এসেছ? যদি কোনোদিন মনে হয় ভুল থেকে ফিরে সৎ, শুদ্ধ জীবনকে আঁকড়ে ধরা উচিত, তবে পূণরায় বাংলাদেশে ফিরে এসো! এখানে তুমি তোমার ভাঙা সংসার জোড়া লাগাতে না পারলেও আমাকে ঠিকই চোখের সামনে পাবে। ছুঁতেও পারবে। আমি দূরে যাব না, কখনও না। আর যদি মনে হয় একা বাঁচা উচিত, তাহলে বাঁচো। সব ছেড়ে তুমি ভিনদেশকেই আপন করে নাও। আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।’
-‘চাইলেই তো আর ফিরা সম্ভব নয়, দিয়া। আমি কখনও সায়রা আপার কাছে ক্ষমা চাইতে পারব না। তোর বাবার সামনেও আর দাঁড়াতে পারব না। তারচেয়ে আমার এখানেই থাকা শ্রেয়।’
-‘কেন মা? ক্ষমা চাইতে ক্ষতি কী? কেউ তো তোমাকে গলাধা//ক্কা দিবে না।’
-‘এত কথা আমি জানি না, দিয়া। আমি শুধু জানি, ক্ষমা চাওয়া সম্ভব নয়।’
-‘আর কত ইগোকে বাঁচিয়ে রাখবে তুমি? নিজের বিবেকের কাছে শুদ্ধ থাকতে ইচ্ছে হয় না? মনে হয় না, উপরে একজন আছেন, যিনি সর্বশ্রোতা? যার দৃষ্টির বাইরে যাওয়া কঠিন ও অসম্ভব!’
-‘জ্ঞান দিতে ফোন করলি?’
-‘না…। তোমাকে এইটুকু বলতে যে, তুমি এক স্বার্থপর মা হয়ে গিয়েছ। যার কাছে নিজের সুখের আগে আর কিচ্ছু নেই। না সন্তান, না সংসার, আর না অন্যের সুখ।’
মনের সবটুকু কথাকে উগড়ে দিয়ে হাতের ফোনটা পাশে রেখে দিল মাহদিয়া। অশ্রুসিক্ত চোখে শাদাবের দিকে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
-‘এই মহিলাকে আর কোনোভাবেই বুঝানো সম্ভব না। বাদ দিই। এরপর আর ফোন করব না। আজও দিতাম না, শুধু…।’
আঁজলাভরে মাহদিয়ার কান্নারত মুখখানি ছুঁয়ে দিল শাদাব। সবসময়ের মতো বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিয়ে বলল,
-‘আমি জানি, এই দিনটা তোমার কাছে অন্যসব দিনের চেয়ে একটুবেশি-ই কষ্টের। তবে তুমি যদি এইভাবে কষ্ট পাও, দিনরাত এতবেশি কাঁদতে থাকো, তবে আমাদের এতদিনের ধৈর্য্য, চেষ্টা, ভালোবাসা বৃথা যাবে। যত কান্না আছে, সব এক্ষুণি কেঁদে শেষ করবে। আগামীকাল থেকে একফোঁটা পানিও বাড়তি খরচ করবে না। যদি কোরো, মনে হবে আমার কাছে তুমি সুখী নও। আমরা তোমাকে সুখ দিতে ব্যর্থ। আমি জানি, মা একটা সন্তানের জন্য কী! বাবা হারিয়ে সে-ই একই কষ্ট আমিও উপলব্ধি করেছি। কিন্তু তোমাকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, জগতের কোনোকিছুই কারও জন্য থেমে থাকে না। কোনো শূণ্যতাই জীবন থামিয়ে রাখতে পারে না। জীবন এগিয়ে যায় নিজ নিয়মে। কাউকে না পাওয়ার তীব্রব্যথা বুকে নিয়ে, জীবন থামিয়ে দেয়া যায় না। জীবন একটাই। এখানে নিঃশ্বাস যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে থামতে দেয়া যাবে না।’
-‘মা কেন এত কঠিন শাদাব? আমি তো এইটুকুই বুঝতে পারছি না। কেন তিনি স্বীকার করছেন না, তিনি দোষী? কেন নিজের ভুলকে, ভুল বলে গ্রহণ করতে পারছেন না?’
-‘উনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, উনি ভুল করেছেন। কিন্তু ভুলকে ভুল স্বীকার করে অন্যের কাছে মাথা নোয়াতে হবে, এটাই উনি মানতে পারছেন না। এমন অনেক মানুষ আছে, যারা ভাবে, ক্ষমা চাওয়া মানেই অন্যের কাছে নিজেকে নত করে ফেলা। প্রকৃতপক্ষে কোনো বিবেকবান নারী-পুরুষের পক্ষে অন্যায়কে ন্যায় ও ন্যায়কে অন্যায় বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। আবার বিবেকহীন মানুষ এসব কাজ অবলীলায় করতে পারে। তুমি শত বাঁধা দেয়ার চেষ্টা কোরো না কেন, সেই বাঁধাকে তারা শতবার ডিঙিয়ে যেতেও রাজি হবে তবু বিবেককে শুদ্ধ করতে চাইবে না।’
-‘তুমি পালটে যেও না, শাদাব। এমনই থাকো। সবসময়।’
ভয়মিশ্রিত মনকে একটুখানি শক্তি ও প্রশান্তি দিতে গভীরভাবে শাদাবের বুকের ভেতর গুটিয়ে গেল মাহদিয়া। এই নাজুক পুতুলকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি শেষ অবধি যেন রক্ষা করতে পারে, এইটুকু ভাবনাই এখন শাদাবের মনে। প্রার্থনাও খুব করে তার। তা-ই নিজের সবটা দিয়ে মাহদিয়ার ভয় দূর করতে বলল,
-‘মৃত্যু আসে আসুক, তবুও আমাদের সম্পর্কে থাকা বিশ্বাসের দেয়ালে অবিশ্বাসের আঁচড় না পড়ুক।’
***
রিসেপশনের আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি সায়রা করীম ও আজাদ সাহেব। মেয়েকে তুলে দেয়ার সামাজিক রীতিনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন। শাদাব নিজেও তার মামা ও খালাকে এই অনুষ্ঠানে থাকতে বলেছে। সব আত্মীয়-স্বজনের মিছিলে অনুপস্থিত শুধু শায়লা সুলতানা। মাহদিয়ার শূণ্য হৃদয় মায়ের জন্য ক্ষণে ক্ষণে পুড়ছিল। তবে নায়রা ও জাইমা দু’জনে মিলে তাকে ওই সময়টায় পর্যাপ্ত মনোবল দিয়েছে। এত জম্পেশ আয়োজনে ইভানাও উপস্থিত হতে পারেনি। তার ভেতরে আরেক প্রাণের আগমন হওয়ার পর থেকে যথেষ্ট সচেতন হয়ে চলাফেরা করে সে। দীর্ঘ বছরের প্রার্থনার ফলকে সামান্য কোনো দুর্ঘটনার কাছে হারিয়ে যেতে দিতে রাজি নয় সে। এই নিয়ে মাহদিয়ার একটু মন খারাপ লাগছিল। বোন সমতুল্য ভাবী তার আপনের চেয়েও আপন হয়ে উঠেছে এই কয়েক মাসে। তাই ইভানা এই অনুষ্ঠানে নেই, এটাও তার মন খারাপের আরও একটা কারণ হয়ে দাঁড়াল।
মন যতই খারাপ হোক তাকে সাহস-মনোবল, ভরসা দিতে পাশে একজন বিশ্বস্ত মানুষ ছিল। যার হাতের মুঠোয় আছে ভরসা, চোখের ভাষায় আছে শান্তি, হৃদয়ে আছে সীমাহীন ভালোবাসা ও নিজেকে নিরাপদ রাখার মতো একখণ্ড প্রশস্ত জায়গা। যার জন্য শত দুঃখ ও মন খারাপের মাঝেও ওই একটা মানুষের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকাতেই মুহূর্তটা সুখে পরিণত হলো তার। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে ফুটে উঠল সুখ ও পূর্ণতার হাসি। মাহদিয়া জানত, আজ এখানে মানুষের উপচেপড়া ভীড় হবে। তাই নিজেকে স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিতে সবসময়ের মতো ফেইস মাস্ক জড়িয়েছে মুখে। এতে তার হাসির দৃশ্য চোখে না লাগলেও মন ছুঁয়ে যাচ্ছে শাদাবের। চোখের ভাষা ও তাকানোর ধরণটাই বলে দিচ্ছে, মেয়েটা হাসছে। নিষ্পাপ, স্বচ্ছ ও মুক্তোঝরা হাসি। সে মুগ্ধচোখে চেয়ে চেয়ে চোখের ও মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিয়ে গানের সুরে বলল,
চোখ যে মনের কথা বলে,
চোখে চোখ রাখা শুধু নয়।
চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে,
চোখের মতো চোখ থাকা চাই।
মাহদিয়ার চোখের চাহনি এতে আরও গভীর হলো। ঠোঁটের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। মুখফুটে ‘ভালোবাসি’ বলেনি, কিন্তু গানের লিরিক দিয়ে, চোখের ভাষা দিয়ে কত অনায়াসে বলে দিল, ‘ভালোবাসি’। জবাবে তারও কি ‘ভালোবাসি’ বলা উচিত? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে হাতের ভাঁজে হাত রাখল মাহদিয়া। আঙুলের ফাঁকে আঙুল আটকাল। মোহমায়া জড়ানো গলায় বলল,
-‘আমার জীবনের প্রথম ও শেষ পুরুষ তুমি। প্রথম ও শেষ অনুভূতি তুমি। সময় ফুরাবে, জীবন ফুরাবে, তবু তোমার প্রতি আমার সমস্ত অনুভূতি আমৃত্যু বেঁচে থাকবে ঠিক এইভাবেই, একই অনুভবে। কারণ আমার একটাই ‘তুমি’ আছো, যাকে আমি দু’চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি।’
সমস্ত দৌড়ঝাঁপ ও হৈ-হট্টগোল শেষে বাড়িতে ফিরতেই ছোট্ট একটা সারপ্রাইজের মুখোমুখি হলো মাহদিয়া। শিহাব ও নায়রা একটা চমৎকার কেক নিয়ে তারজন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা আগেই ফিরে এসেছিল বলে, এই সারপ্রাইজ প্ল্যানের আয়োজন। একেই তো বিশেষ একটা দিন, তারওপর মাহদিয়ার জন্মদিন। দুটোদিনের আনন্দকে একসাথে ভাগ করে নিতে পুরো রুমটা ফুলের পাশাপাশি বেলুন দিয়েও সাজিয়ে নিয়েছে দু’জনে। যদিও এটা জন্মদিন পালন উৎসব নয়, শুধু মাহদিয়ার মনের দুঃখ-কষ্ট ও মা’কে ঘিরে যত না পাওয়ার আহাজারি ছিল, সেই সবটুকু না পাওয়া ও মন খারাপকে দূর করে তাকে অল্পবিস্তর সুখ দেয়ার জন্যই এই আয়োজন। এখানে তার মুখে হাসি দেখাটাই মুখ্য। এই কারণে, মাহদিয়া ঘরে প্রবেশ করতেই তাকে ছোট্ট টেবিলটার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল শিহাব। হাতে ছু//রি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘শুভ জন্মদিন, ভাবী।’
হাসিমুখে কেক কে//টে শিহাবের মুখে একটুকরো কেক তুলে দিল মাহদিয়া। বলল,
-‘ধন্যবাদ তোমায়। কিন্তু, এসবের কোনো দরকার ছিল না। কেন খামাখা কষ্ট করতে গেলে?’
-‘সকালে দ্যাখলাম, মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলে। মা তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পরও তোমার কান্না থামছিল না। তাই নায়রাপুর সাথে প্ল্যান করে, তোমাকে একটুখানি খুশি দ্যাখার চেষ্টা করেছি মাত্র।’
আত্মার সম্পর্কগুলো এমনই হয়। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা দিতে পারে, কেবল ওই সম্পর্কের মানুষগুলোই। তার মায়ের যা ভুল, তাতে এই পরিবারের সবাই তাকে দিনরাত কটুবাক্য শোনাতে পারত। অথচ কেউ তা করেনি। উলটো, ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখছে সারাক্ষণ। নায়রা, শিহাব, নাবহান ও ইভানা, এই প্রত্যেকটা মানুষের সাথে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আত্মার এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যা সে শত চাইলেও অস্বীকার করতে পারে না। গভীর মমতামাখা চোখে সবাইকে একনজর দেখল মাহদিয়া। মনে ভীষণ শান্তি পেল। দুঃখ, হতাশা, না পাওয়া দূর হলো। সারাজীবন এই মানুষগুলোর চোখের সামনে হেসেখেলে বাঁচতে পারলেই সব ভালোবাসা স্বার্থক হয়ে উঠবে। সে শিহাবের এরূপ কথা ও মনোভাব থেকেই বুঝল, কিছু সম্পর্ক এমনই সুন্দর। এইভাবেই তাকে বাঁচিয়ে রাখা সুন্দর। নিজের সবটুকু দুঃখ ভুলে শিহাবের পরিপাটি স্টাইলিশ চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-‘তোমাদের সাথে থাকার সুযোগ পেয়েছি, এতেই আমি খুশি। সারাজীবন নিজেকে এইভাবেই সুখী দ্যাখে বাঁচতে চাই। তোমরা যদি পাশে থাকো, এটা অসম্ভব কিছুই না। বুঝেছ সুপারম্যান?’
হেসে মাথা নাড়ল শিহাব। সবাই মিলে আনন্দ-ফুর্তির পর ঝটপট কয়েকটা ফ্যামিলি পিকচার তুলে ফেলল নায়রা। রাত গভীর হওয়াতে আড্ডা, হৈচৈ বেশিক্ষণ জমল না। সবাই ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিল। যাওয়ার আগে মাহদিয়ার কপালে একটা চুমু খেল ইভানা। বলল,
-‘সুখী হও।’
মাহদিয়া ব্যথা না দিয়ে আলগোছে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘দোয়া কোরো। তোমাদের সবার দোয়া-ই আমাদের সুখী জীবন দিতে পারে।’
-‘দোয়াত অবশ্যই আছে। তোমরা নিজেরা একে-অন্যকে নিয়ে সৎ থেকো, সম্পর্ক মজবুত হবে। কোনোপ্রকার সন্দেহ, অবিশ্বাস ও স্বার্থপরতাকে সম্পর্কের মাঝখানে প্রবেশ করতে দিও না। ভালোবাসা এমনিতেই আকাশ ছুঁয়ে যাবে।’
-‘আমি ভীষণ ভয় পাই ভাবী। জানি না, এই সম্পর্কের মধ্যে থাকা সমস্ত দায়-দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারব কি-না। তবুও, নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করব, ইনশা’আল্লাহ!’
মাহদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ইভানা বলল,
-‘একটা সম্পর্ককে বিশ্বাসের সাথে বাঁচিয়ে রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট কী জানো? তার সমস্ত একাকীত্বকে দূর করে দিয়ে ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়ানো। যখন একটা মানুষকে তুমি ভালোবাসবে, তার সাথে গোটা জীবন কাটানোর প্রতিশ্রুতি নিবে, তখন কোনো অবস্থাতেই তাকে একা হতে দিবে না। বিশেষ করে সেই মুহূর্তে, যেই মুহূর্তে তোমাকে তার খুব বেশি প্রয়োজন হবে। প্রয়োজনের সময়টায় বিশ্বস্ত মানুষের পাশে থাকার জোরেই কিন্তু সম্পর্ক হয়ে উঠে মজবুত ও শক্তিশালী।’
ইভানা চলে যাওয়ার পর নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে শুরু থেকে এই অবধি সমস্ত ঘটনাকে ঘিরে নানারকম ভাবনায় ডুবেছিল মাহদিয়া। কতটা ধৈর্য্য, মনোবল ও মানসিক শক্তিকে আগলে নিয়ে এই সম্পর্কটাকে বাঁচাতে হয়েছে তাকে। দুটো মানুষ এক হতে গিয়েও বার বার বিচ্ছেদের দ্বারে ছিঁটকে পড়ছিল। সম্পর্ক এই অবধি গড়াত না, যদি না এখানে একে-অন্যকে ঘিরে পর্যাপ্ত সাপোর্ট ও ভালোবাসার প্রকাশ না ঘটত। ভাবনার অতলে হারিয়ে যেতে যেতে হিজাবের পিন খোলায় মনোযোগ দিল মাহদিয়া। হিজাবের আবরণ থেকে ছাড়া পেয়ে স্বস্তিভরে নিঃশ্বাস নিল। শাদাব পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে বলল,
-‘কী ভাবছ সেই তখন থেকে?’
-‘অনেককিছু।’
-‘ঘরে যে একটা প্রাণী আছে সেদিকে খেয়াল একদমই নেই দ্যাখছি।’
আয়নার দিকে তাকিয়ে লাজুক লাজুক হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলল মাহদিয়া। বলল,
-‘পৃথিবীতে একটাই নারী আছে, যে তোমার জন্য বৈধ। এবং যার চোখ ও মনের ঘরে সবসময়ই তোমার আনাগোনা চলে। তাই খেয়াল নেই, এই অভিযোগ একদমই তোলা নিষেধ।’
-‘জন্মদিনের শুভেচ্ছাটা কীভাবে নিবে? উপহার হিসেবে কী দিলে খুশি হবে? হীরে-জহরত কিংবা দামী কোনো উপহারে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই না।’
-‘যতটুকু আছে ততটুকু ইনাফ। এসব প্রয়োজনীয় জিনিস তুমি না চাইলেও দিবে। আজ আমি এমন কিছু চাইব, যা তোমার সাধ্যের বাইরে থাকবে এবং যা না পেলে আমার নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে।’
গভীর ভাবনাজনিত কথা। শাদাব ভীষণ চমকাল। সরাসরি চোখের ভাষা বুঝে, মন পড়তে মাহদিয়াকে নিজের দিকে ঘুরাল। তিন ইঞ্চি পরিমাণ চুলের ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে এসে দাঁড়াল। আবেগমিশ্রিত স্বরে বলল,
-‘এমন কী চাওয়ার আছে তোমার, যা আমার সাধ্যের বাইরে?’
মাহদিয়া গভীরচিত্তে চেয়ে থেকে উত্তর দিল,
-‘সময়।’
শাদাব হাসল। ঠোঁট জোড়ে এক অদ্ভুত সুখকর হাসি ঢেউ খেলে গেল তার। জড়ানো গলায় বলল,
-‘শুধু সময়? কেন? আর কিছু কেন চাইবে না তুমি?’
-‘আমার বিশ্বস্ত হাত দরকার ছিল যে হাতে ভরসা মিশে থাকবে, পেয়েছি। একটা সুন্দর নীড় দরকার ছিল, যে নীড়ে সুখ-দুঃখের সাথে একদল মানুষ একসাথে মিলেমিশে থাকবে, পেয়েছি। একটা সৎ মানুষ দরকার ছিল, যার মনে প্রিয়জনদের জন্য অত্যাধিক ভালোবাসা ও দায়িত্ব-কর্তব্য লুকানো, তা-ও পেয়েছি। এখন শুধু এইটুকুই চাই, একটুখানি সময়। যখন আমার খুব কষ্ট হবে, তখন তুমি আমার কষ্টের ভাগীদার হয়ো। যখন আমার খুব বেশি কান্না পাবে, তখন তুমি আমার চোখের পানি মুছে দিও। যখন আমি নির্ঘুম রাত কাটাব, তখন তোমার বুকে একটু জায়গা দিও। যখন আমি কোনো ভুল করব, তখন ভুল থেকে ফিরিয়ে আনতে আমার শুদ্ধ পুরুষ হয়ো। যখন আমি খুব বেশি একা অনুভব করব, তখন ভরসার হাত রেখে পাশে এসে দাঁড়িও। যখন আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহর গুনে তোমার পথচেয়ে থাকব, তখন ফিরে এসে আমার সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিয়ে, একটুবেশি ভালোবেসো। জীবনভর এইটুকুই চাইব তোমার কাছে। দিবে…?’
শাদাব এমন এক পেশায় আছে, যেখানে সময় খুঁজে বের করা খুব কঠিনই। তবুও অর্ধাঙ্গিনীর জন্য এইটুকু ছাড় দিতে রাজি আছে সে। একটা নারীমনের সবচেয়ে বড়ো চাওয়া বোধহয় এটাই। কোনো মেয়ে এই চাওয়া ও পাওয়া থেকে নিজেদের বঞ্চিত হতে দিতে রাজি নয়। প্রতুত্তরে মেঘ ঘোরঘোর কণ্ঠে শাদাব জবাব দিল,
-‘ব্যস্ত জীবনের পরে, আমার জীবনের সবটুকু সময় আমি তোমার নামে লিখে দিলাম, ভ্রমর। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই লিখিত চুক্তির মাঝে আবদ্ধ থাকার চেষ্টা করব ইনশা’আল্লাহ্। এটা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার আছে, তোমার?’
না’বোধক ইশারা করল মাহদিয়া। শাদাব মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তমার দিকে। অনেকক্ষণ দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতিদের ছড়িয়ে দিল একে-অন্যের মাঝে। তোলপাড় করা সবটুকু অনুভূতির মেঘ এসে জমা হলো চোখেমুখে ও মনে। একসময় তা সুখের বারিধারা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল প্রত্যেকের হৃৎস্পন্দনে। স্বর্গের একটুকরো সুখ এসে তখন লুটিয়ে পড়ল, ‘কুঞ্জকানন’-এর কোণায় কোণায়। সেই সুখটাকে কুড়িয়ে নিতে, আবেগ-অনুভূতিকে আজ বাঁধাহীন স্রোতের টানে ভেসে যেতে দিল দু’জনে। উথাল-পাতাল এই স্রোত দু’জনকে একত্রে ভাসাল, ডুবাল। বিশ্বস্ত হাতে ভরসা খুঁজে নিয়েছিল দেখেই, এই দিকবিহীন ছুটে চলা স্রোতও একসময় হার মেনে নিল তাদের ভালোবাসার কাছে।
***
-‘ছোট্টোওন, এ্যাই ছোট্টোওন।’
গুটি গুটি পা ফেলে আধোমুখের বুলি আওড়ে লালচে বাদামী একঝাঁক ঝাঁকড়া চুলওয়ালা পাঁচ বছরের বাচ্চা ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটছিল ফ্লোরে। গলা উঁচিয়ে ডাকছিল, শিহাবকে। মূলত সে, ছোটোন ডাকটাকেই একাধারে ওই শব্দ দিয়ে অনুকরণ করে চলেছে। মাহদিয়া যতবার ছোটোনকে ডাকছিল, বাচ্চা মেয়েটা মা’কে নকল করে সেই ডাকটা বার বার রিপিট করছিল। টুকটুক শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সে শিহাবের দরজায় গিয়ে দুমদুম আওয়াজ তুলতে লাগল। দেরী হলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। এই কারণে তাড়াহুড়ো করে লাগেজে কাপড়চোপড় প্যাক করছিল শিহাব। অমন মায়াজড়ানো ডাক শোনে সে হাতের কাজ ফেলে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে হাত বাড়াতেই তার কোলে ঝাঁপ দিল মাশা। পুরো নাম মানতাশা নূর। আদর করে সবাই ‘মাশা’ বলেই ডাকে। সে কোলে চড়েই দু’হাতে শিহাবের গলা প্যাঁচিয়ে ধরে বুকের সাথে লেপটে গিয়ে বলল,
-‘কোথায় যাচ্ছ চাচ্চু?’
-‘ট্যুরে যাচ্ছি, বুড়ি। তুমি যাবে?’
-‘মাম্মা-পাপা যাবে না? আমি একা গেলে ভয় পাব তো।’
-‘ভয় কীসের, চাচ্চু আছি না? ঠিক সামলে নেব।’
শিহাব একেবারে পরিপাটি হয়ে আছে। এবার শুধু শাদাব ফিরবে, তারপর সে বিদায় নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। জীবন থেকে চলে গেছে আরও অনেকগুলো বছর। অবুঝ শিহাব বড়ো হয়েছে। শুধু বড়ো হয়নি, সে এখন পঁচিশ বছরের টগবগে যুবকে পরিণত হয়েছে। বুঝতে শিখেছে অনেককিছু। মানতে শিখেছে বাস্তবতা। গ্রহণ করতে শিখেছে সমাজের নিয়মকানুন। এতগুলো বছরে পালটেছে ‘কুঞ্জকানন’-এর অনেককিছু। শুধু পাল্টায়নি একে-অন্যকে ঘিরে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভালোবাসাটুকু। এরমধ্যে বাদ যায়নি, কায়ছার সাহেবের কবরস্থান জেয়ারত করা। প্রতি শুক্রবার দুই ভাই মিলে, ‘সুখনীড়’-এ ঘুরতে যায়, হায়দার সাহেব ও নূরুন্ নাহারের জন্য। বাবার কবর জেয়ারতের জন্য। হায়দার সাহেব শেষ বয়সে এসে শাদাব ও মাহদিয়ার চাপাচাপিতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা এখন তিনি। মানতাশা তার ফুপ্পি বলতে অ//জ্ঞান। ইভানার ছেলেটাও বড়ো হয়ে গেছে। দশ বছরে পা দিয়েছে সে। শায়লা সুলতানার সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয় মাহদিয়ার, তবে তিনি আর দেশে ফিরতে চান না। এখনও ইতালিতেই আছেন। ভালো আছেন, শান্তিতে আছেন। আজাদ সাহেবও নিজের পৈত্রিক বাড়িতে সুখে-অসুখে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। মেয়ে নিয়মিত খোঁজ নেয়, দেখতে আসে, এইতো ঢের। নায়রারও বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী-সংসার, সন্তান নিয়ে সে-ও সুখে আছে ক্যালিফোর্নিয়াতে। শিহাব ওই দেশে যাবে মূলত টুরিস্ট ভিসায়। এই ভিসার জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাকে। এর আগেও বেশ কয়েকটা দেশ ঘুরে এসেছে সে। তার ইচ্ছা, এইভাবেই ঘুরে ঘুরে পুরো পৃথিবীকে জানবে, দেখবে। শাদাব আগে সঙ্গী হতো, মাহদিয়াও থাকত। তবে শিহাব উপযুক্ত হওয়ার পর থেকে একা একাই ট্যুরে যাচ্ছে। জাপান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ছাড়াও ছোটো, বড়ো অসংখ্য দেশে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হওয়াতে তার এই স্বপ্ন পূরণে শাদাব ভরসা হয়ে পাশে থাকছে সবসময়ই। চাকরি-বাকরি এখন অবশ্য কিছুই করছে না। তবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাস্টার্স শেষ করে ভাইয়ের মনের জোর হতে পরিবারের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবে।
নাচুনেবুড়িকে কোলে নিয়ে খাবার টেবিলে এসে ঘড়িতে একবার নজর দিল শিহাব। মাহদিয়া দ্রুতহাতে খাবার সার্ভ করছে। সায়রা করীম বসে বসে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে, ছেলের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য দোয়া করছেন। হাত পরিষ্কার করে খেতে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ভাইয়া এখনও ফিরছে না কেন, ভাবী? ফ্লাইটের তো বেশি দেরী নেই।’
মাহদিয়া বলল,
-‘অপেক্ষা করে লাভ নেই। এক্ষুণি আসবে না। খেয়ে রওনা দাও। তোমার ভাইয়া এ্যায়ারপোর্টে জয়েন করবে।’
শিহাব অল্প একটুই খেল। শুধু ক্ষিধেটুকু সরানোর জন্য। এরপর মায়ের থেকে বিদায় নিতে গেল। তিনি একগাদা দোয়াদরুদ জপে ছেলেকে ফুঁ দিয়ে বললেন,
-‘পৌঁছে ফোন করবি। যেখানে-যেখানে ঘুরতে বের হবি, সাবধানে পা ফেলবি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবি। নিয়ম করে সকাল-বিকাল ফোন করবি। একা একা এত দূরে যাচ্ছিস, ভয় হচ্ছে আমার…। আল্লাহ্ সহায় হোন। সফরের দোয়া পড়ে নিবি মনে করে।’
প্রতিবার এমন হয়। বিদায়বেলা একগাদা আদেশ-নিষেধের বাণী শুনিয়ে দেন। শিহাব বিদায় নেয়। মাহদিয়া তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। বিদায়বেলাও শিহাবের কোলের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইল মানতাশা। মায়ের কোলে আসার নামই নিচ্ছে না। একরকম জোর করে মেয়েকে কোলে আনল মাহদিয়া। শেষবেলা ভাতিজীকে অজস্র আদর দিয়ে শান্ত করল শিহাব। সবুজ গাড়ি স্টার্ট দিলে ‘কুঞ্জকানন’ ছেড়ে হাইওয়ের দিকে এগিয়ে গেল তারা। বিড়বিড়িয়ে সফরের দোয়া পড়ে নিল।
শিহাব এ্যায়ারপোর্টে পৌঁছেই দেখল, শাদাব অপেক্ষা করছে। সে হাত বাড়িয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘আমি তো ভেবেছি তুমি বাড়ি যাবে। একসাথে আসব।’
-‘ও.টি’তে ছিলাম, এই কারণে দেরী হয়ে গেল। সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছ?’
-‘হ্যাঁ, একদম।’
-‘পাসপোর্ট, টিকেট চেক কোরো আবার।’
শিহাব তাই করল। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি নেই, দেখে ভেতরে প্রবেশের জন্য এগিয়ে গেল। যাত্রী ছাড়া বাইরের লোকজনদের ভেতরে প্রবেশ করা নিষেধ। শুধু শাদাবের গলায় একটা কার্ড ঝুলে থাকাতে তার সেখানে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হলো না। ইমিগ্রেশনের জন্য অপেক্ষায় রইল শিহাব। শাদাব বলল,
-‘এই ট্যুরটাই শেষ। এরপর পড়াশোনাতে মনোযোগ দিবে।’
-‘যথাআজ্ঞা।’
-‘হাইকিং-এ যেতে চাইলে নায়রার হাজবেন্ডকে সাথে নিও। একা একা রিস্ক নিবে না।’
-‘ওকে…।’
-‘কোনো অসুবিধা দ্যাখলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।’
-‘আচ্ছা, মনে থাকবে।’
শাদাব আরও একগাদা আদেশ-নিষেধ শুনাল। শিহাব শোনে গেল। একাধারে হ্যাঁ-না জবাবে আলাপ চালিয়ে গেল। একসময় ইমিগ্রেশনের ডাক পড়ল। শেষ একবার ভাইকে জড়িয়ে ধরল শিহাব। বলল,
-‘ভালো থেকো। আল্লাহ্ হাফেজ।’
হাসিমুখে ভাইয়ের কপালে চুমু খেল শাদাব। এই অভ্যাসটা সে ছাড়তে পারেনি আজও। সেই ছোটোবেলা থেকে আদরে-যত্নে লালন-পালন করা ভাইটা এখন একা পথ চলতে শিখেছে। প্রতিবার যখন শিহাব দেশে ও দেশের বাইরে কোথাও ট্যুরে যায়, নির্দিষ্ট ওই দিনগুলোর জন্য পুরোটাই ফাঁকা হয়ে যায় শাদাবের বুক। ভাইকে দূরে পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকে, কখন সে পূণরায় ফিরে আসবে। কখন তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করবে। কখন তার মুখে খাবার তুলে দিবে। অপেক্ষার সময়টুকুর কথা ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেল শাদাবের। তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘আল্লাহ্ হাফেজ। খুব সাবধানে পা ফেলো। সতর্ক থেকো। শীঘ্রই ফিরে এসো। আমরা অপেক্ষায় থাকব। আল্লাহ্ সহায় হোন, তোমার।’
এই এত এত আদর-যত্ন, ভালোবাসাতে অভ্যস্ত শিহাবেরও বাড়ির লোকজনকে ছেড়ে দূরে থাকতে কষ্ট হয়। কিন্তু শখ, ইচ্ছে, স্বপ্ন এসবের জন্য ছুটে যেতে হয় দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। জানতে হয় মানুষকে, চিনতে হয় পৃথিবীকে। সে-ও কান্না চেপে রেখে বলল,
-‘আই লাভ য়্যু, ভাইয়া।’
শিহাবের পিঠে আলতো চাপড় মারল শাদাব। বলল,
-‘আই লাভ য়্যু টু, এন্ড আই অলওয়েজ মিস য়্যু। ম্যে আল্লাহ্ মেইক দিস জার্নি সেইফ ফোর য়্যু, ইনশা’আল্লাহ।’
বিদায় নিয়ে চলে গেল শিহাব। শাদাব গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মাহদিয়া অনবরত ভিডিও কল করে যাচ্ছে। সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে মেয়ের গলা ফাটানো কান্নার আওয়াজ শোনে চমকে গেল। মাহদিয়া তাড়া দিয়ে বলল,
-‘তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ, সামলাতে পারছি না। ছোটোন যাওয়ার পর থেকে গাল ভাসিয়ে কাঁদছে।’
শিহাবের ন্যাওটা এই মানতাশা। এই কারণে শিহাব বাড়িতে না থাকলেই তার কান্নাকাটি, আবদার, দুষ্টুমি সব বেড়ে যায়। আবার বাবাকে পাশে পেয়ে গেলে, একদম শান্ত বাচ্চা হয়ে যায়। সে-ও মেয়েকে কোলে নেয়ার জন্য অধৈর্য হয়ে গেল। মেয়ের কান্না থামাতে বলল,
-‘মাশা, পাপা কয়েক মিনিটে চলে আসবে। এত কাঁদতে হয় না, মা। চোখমুখ ফুলে যাচ্ছে তো। তোমার জন্য কী কী নিয়ে আসব, বোলো তো। পাপা একটা লিস্ট করে নিই।’
কান্নারত মুখখানি নিয়ে মানতাশা শুধু বলল,
-‘তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসো। মাম্মা পঁচা। খালি বকে, মারে, গাল টেনে দেয়। দাদুমনি বকে দিলেও শোনে না।’
মেয়ের নালিশ শোনে হেসে ফেলল শাদাব। বলল,
-‘চিন্তা কোরো না, একটু অপেক্ষা কোরো। পাপা এসে, মাম্মাকে খুব করে শা//স্তি দিব আজ। ওকে…?’
***
সমাপ্ত…