#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৩
তূর্ণ’কে বিদায় জানিয়ে বরাদ্দকৃত কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। প্রবেশ করেই হতবিহ্বল! ধক করে উঠলো অন্তর আত্মা। কতটা সময় ওভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। আচানক সম্বিৎ ফিরে পেতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিছানার ধারে ছুটে গেল মেয়েটি। এলোমেলো ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে শুয়ে তৃষা। তাকে অবলোকন করে অজানা ভীতিতে আড়ষ্ট হলো দুয়া। দু পা ধীরে সুস্থে বিছানায় উঠিয়ে নিলো। বসলো তৃষা’র শিয়রে। নিদ্রায় আচ্ছন্ন মানবীর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে আদর মাখা স্বরে ডাকতে লাগলো,
” তৃষা। অ্যাই তৃষা। ”
দু ডাকেই নেত্রপল্লব মেলে তাকালো তৃষা। নিদ্রা অগভীর ছিল কিনা। দুয়া আঁতকে উঠলো ননদিনীর অবস্থা দেখে। এলোমেলো ভঙ্গিমায় শুয়ে তৃষা। লালাভ আভা ছড়িয়ে চক্ষু জোড়ার সফেদ অংশে। চোখমুখ শুকিয়ে ম্লান। কেশের হাল করুণ। এক রাতেই ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী লাগছে। এমন দেখাচ্ছে কেন ওকে? কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে দুয়া তৎক্ষণাৎ শুধালো,
” বোন। কি হয়েছে তোর? এভাবে ঘুমিয়ে ছিলি কেন? শরীর খারাপ করছে? ”
কি জানি কি হলো। তৃষা কিচ্ছুটি বললো না। বরং ভাবির কোলে মুখ গুঁজে দিলো। লুকানোর চেষ্টা করলো ভেতরকার সবটুকু গ্লানি, যাতনা। চুপটি করে শুয়ে রইলো সেভাবে। ওর হাল অবলোকন করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো দুয়া। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনের মধ্যে ভালোমন্দ বহু চিন্তা উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে। বড় ভয় করছে। সুস্থ সবল হাসিখুশি মেয়েটির এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো? তার অনুপস্থিতিতে খারাপ কিছু…! না না। ছিঃ! এসব কু চিন্তা কি করে সে প্রশ্রয় দিচ্ছে? আল্লাহ্ সহায় আছেন। নিশ্চয়ই সব ঠিক আছে। তবে কি হয়েছে ওর? কিছু বলছেও না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভীত মনটি আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। শেষমেষ নিরুপায় হয়ে নীরবতা ই বেছে নিলো দুয়া। নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়লো কক্ষটি। দুয়া কোমল হাতে বিরহে কাতর মেয়েটির মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। নানাবিধ চিন্তায় দুয়া’র অবস্থা বেগতিক। কিছু সময় বাদে সে অনুভব করতে পারলো ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের স্পর্শ। তৃষা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করলো দুয়া। সমস্ত কু চিন্তা দূরীকরণ করতে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিলো। ঘুমন্ত মানবীর মাথার নিচে এক হাত এবং ঘাড়ে আরেক হাত গলিয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে আস্তে ধীরে বালিশে শুয়ে দিলো। অতঃপর ওর অগোছালো কেশ, এলোমেলো পোশাক ঠিক করে মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিলো। দেহে জড়িয়ে দিলো পাতলা কাঁথা। দেয়ালঘড়িতে চোখ পড়তে আঁতকে উঠলো দুয়া। ওহ্ হো! নামাজের ওয়াক্ত শেষের পথে। তড়িঘড়ি করে মেঝেতে পদযুগল নামিয়ে বিছানা ত্যাগ করলো মেয়েটি। ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে।
•
উন্মুক্ত বাতায়নের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। কানে ঠেকানো ক্ষুদ্র যোগাযোগের মাধ্যম। আদিত্য’র মিঠি কিরণ মেখে যাচ্ছে সুঠাম গাত্রে। হালকা হাওয়ায় মসৃণ লালচে চুলগুলো মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ছুটছে। ফোনালাপে মগ্ন মানুষটি। ওপাশে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণে ব্যস্ত। দিচ্ছে কোনো নির্দেশনা। অধরে লেপ্টে দুর্বোধ্য হাসির রেখা। ফোনালাপ শেষে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো তূর্ণ। মোবাইল হাতে পিছু ঘুরে কিঞ্চিৎ চমকালো। বিছানায় বসে মিহাদ। দু পা ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।
” হোয়াট হ্যাপেন? এমন খা!টাশের মতো হাসছিস কেন? ”
খা.টাশ! এত পঁচা সম্বোধন শুনে মিহাদ অসন্তুষ্ট হলো না। বরং আরো দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখে শুধালো,
” কি ভাইয়া? গতরাত কোথায় ছিলে? প্রেমনগরে? ”
তূর্ণ হাঁটি হাঁটি পায়ে সমতল আরশির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। এলোমেলো কেশ দু হাতে সেট করতে করতে বললো,
” বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে প্রেমনগর যেতে হবে কেন? বউ সাথে থাকলে অলি থেকে গলি যেকোনো জায়গাতেই প্রেমের পবন বয়ে যায়। কোনো বিশেষ জায়গার দরকার হয় না। বুঝলি? ”
মিহাদ দুঃখী বদনে বললো, ” কি করে বুঝবো? আজ অবধি একান্ত একজন পেয়েছি কি? সিঙ্গেল হয়ে মিঙ্গেলের ফিলিংস মাখা কথা বোঝা কতটা কঠিন, তুমি জানো? ”
তূর্ণ ওর দিকে আফশোসের চাহনিতে তাকিয়ে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ রকমের শব্দ করলো।
” আফশোস! তুই আমার ভাই। আস্ত এক গ*বেট। বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের অভাব পড়েছে নাকি? দুয়া’র ফ্রেন্ড আছে। আমার ফ্রেন্ড আছে। আরো কত গেস্ট আছে। একটাও পটাতে পারলি না? তুই তো সিঙ্গেল নামক জাতির ক*লঙ্ক। ”
মিহাদ অবাক চাহনিতে তাকালো! এত বড় অপবাদ! সহে না গাত্রে। করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কি বলছো এসব ভাইয়া? শেষমেষ তোমার বন্ধু! ওই মনিকা আপু তো ম্যারিড। বাকি আছে শুধু দিবা আপু। আমি নাদান ছেলে হয়ে শেষে কিনা সিনিয়র পটাবো? ”
তূর্ণ হেসে বললো, ” চাইলে ট্রাই করতে পারিস। সিনিয়র আপুর সাথে ডেট করার মজাই আলাদা। ইউ নো না? ”
চোখ টিপে কক্ষ হতে প্রস্থান করলো তূর্ণ। আর নাদান ছেলেটি? তার তো অনবরত হিচকি উঠছে। কোনোমতে উঠে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা জগের ওপর
হা;মলে পড়লো।
.
মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ডাইনিং এরিয়ায় একত্রিত হলো তরুণ প্রজন্ম। খাওয়ার ফাঁকে চলছে কথোপকথন, খুনসুটি। মিহাদ ওর বিপরীত দিকে বসে থাকা ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
” এই মু;টকি? আর কত খাবি? বিয়েশাদী হয়ে গেছে। এখনো অন্যের অন্ন ধ্বং*স করবি? একটু তো রয়ে সয়ে খা। ”
সিনথিয়া এমন কটূক্তি গায়ে মাখলো না। প্লেটে হাত চালনা করতে করতে বললো,
” ভাই আমার। অন্যের প্লেটে কালি নজর না দিয়ে নিজের প্লেটে নজর দে। গরুর মাংস কয় পিস নিয়েছিস সে খেয়াল আছে? অন্যকে আবার পেটুক বলে! হুহ্! ”
মিহাদ বোকা বনে গেল। সশব্দে হেসে উঠলো বাকিরা। কবির সকলের অলক্ষ্যে বউয়ের দিকে ঠোঁট চোখা করে চু মু ইশারা করলো। ফাটাফাটি বলেছে তার বউটা। সিনথিয়া স্বামীর পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তাতে বক্র হাসলো কবির। দুয়া পানির গ্লাসে এক চুমুক বসিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিলো,
” ভাইয়া। একটু রয়ে সয়ে। আমরাও আছি কিন্তু। ”
কবির ঠিক বুঝতে পারলো কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। যদিওবা বাকিরা বুঝতে পারলো না একমাত্র তূর্ণ ব্যতিত। সে একমনে খেয়ে চলেছে। উপস্থিত অন্য সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চলেছে। বুঝতে পারছে না দুয়া কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো। কবির দুষ্টু হেসে দুয়া’র প্রত্যুত্তরে বললো,
” সমস্যা নেই বোন। বড়রাই তো ছোটদের গুরু। মাঝেমধ্যে এমন টুকটাক ছোটোখাটো টিপস্ দেয়া দরকার। নাহলে তারা শিখবে কি করে? তাই না? ”
হতবিহ্বল দুয়া! তপ্ত হলো তার কপোলদ্বয়। সিনথিয়া তো লাজে মরি মরি। তূর্ণ তো খুব সুন্দর মতো বোন জামাইয়ের সাথে সম্মত হলো।
” একদম ঠিক বলেছো কবির। টোটালি অ্যাগ্ৰি উইথ ইয়্যু। ”
কবির সমর্থক পেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বিজয়ের সে হাসি। সিনথিয়া তো লাজে জড়োসড়ো। ছোট-বড় ভাইবোনদের সামনে এসব কি করছে এরা? এতকিছুর ভিড়ে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক তৃষা। তার চোখজোড়া স্বল্প সিক্ত। ম্লান মায়াবী মুখখানি। তৃষ্ণা জেগেছে চক্ষে। সকলের ভিড়ে অনুপস্থিত আকাঙ্ক্ষিত মানব। নিশাদ। সে এখানে নেই। কোন দরকারি কাজ আছে নাকি। তাই আগেই খেয়ে নিয়েছে। সকলের সাথে যোগদান করেনি। তবে এ কথাটি যে সত্য নয়, মিথ্যা। তা তৃষা ঠিক অনুধাবন করতে পারলো। তার জন্যই তো নিশাদ এমন করছে। এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। দেখেও নাদেখা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তার কোমল হৃদয় যে ভ!ঙ্গুর অবস্থায় ছটফট করে চলেছে! সে খবর কি জানে ভাবলেশহীন মানবটি? সকলের অলক্ষ্যে তর্জনী ছুঁয়ে নেত্রকোণে জমায়িত অশ্রু মুছে নিলো তৃষা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেল। সে মুহূর্তে কর্ণ কুহরে পৌঁছালো তূর্ণ’র কণ্ঠ,
” তৃষা। তোর প্লেট তো খালি। কিছু নে। ”
.
রিসোর্টের একাংশে সরু পথ। পথের দু ধারে সারি সারি দৈ-ত্যকায় বৃক্ষ সমারোহ। কর্ণ কুহরে ভেসে আসছে পাখপাখালির মৃদু গুঞ্জন। নিরিবিলি নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত এমন পরিবেশে একাকী উপস্থিত মানব। লম্বাকার গাছের সনে হেলান দিয়ে বসে সে। বাঁ পা জমিন ছুঁয়ে তো ডান পা ভাঁজ করে উঁচু ভাবে দাঁড় করা। হাতে তার ক্ষুদ্র এক যন্ত্র। নাম সে যন্ত্রের স্মার্টফোন। তাতে দৃশ্যমান হৃদয়ে লুকানো রমণীর অবয়ব। হাসিখুশি মুখখানি সে যতবার দেখে ততবারই শীতলতম অনুভূতি জেঁকে ধরে অন্তঃস্থলে। রমণীটিকে আরেকটু খানি ভালোবাসার, নিজের সনে আগলে নেয়ার, পবিত্রতম বাঁধনে বেঁধে রাখার ইচ্ছেরা উড়াল দেয় হৃদ দিগন্তে। ছোটখাটো এই মেয়েটিকে সে যে খুব করে ভালোবাসে। দু’টো বছর ধরে লালন করে আসছে হৃদ মাঝারে। কম সময় নয়। দিনপঞ্জির হিসেব মতে লম্বা সময়। সর্বদা সে আড়ালে আবডালে থেকে হৃদয়ে লুকানো রমণীকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। প্রয়াস চালিয়েছে সমস্ত দুঃখকষ্ট- ভয় থেকে দূরে রাখার। আল্লাহ্’র রহমতে সফল হয়েছে বটে। এই দু’টো বছরে একটু একটু করে তার অনুভূতি গাঢ় হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে হৃদয়ের অলিগলি সর্বত্র। বক্ষস্থলে একান্ত রমণী রূপে তাকে মিশিয়ে নেবার ইচ্ছে বারংবার জাগ্রত হয়েছে। তবে সে তাড়াহুড়ো করেনি কখনো। বরং তার লুকানো অনুভূতি লুকায়িত রেখেছে। অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের। তবে তার অপেক্ষার প্রহর যে যাতনায় সমাপ্ত হবে জানা ছিল না। শেষে এই ছিল তার তাকদীরে? তার হৃদয়ে লুকানো প্রেম এভাবেই অসমাপ্ত, অপূর্ণ রইবে! কভু মিলবে না সে রমণী! তার ছোঁয়ায় আবেশিত হবে না পৌরুষ চিত্ত! হয়ে যাবে দু’জনার দু’টি পথ আলাদা! কেন? কি অন্যায় করেছে সে? প্রেমিক হতে গিয়ে শা*সক হয়ে গিয়েছিল? বেশি ত্রাশ সৃষ্টি করে ফেলেছে! হৃদয়ে লুকানো রমণীর নিকট সে এখন এতটাই অপছন্দনীয়? ঘৃণ্য? ঘৃণা শব্দটি মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়লো। গাছের সঙ্গে লেপ্টে গেল মানুষটির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি হলো বক্ষ মাঝারে। বদ্ধ হলো অক্ষি জোড়া। সে অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো ক ফোঁটা তপ্ত কণা। পুরুষ মানুষের হৃদয় নাকি পাথরের মতো কঠিন। তাদের কাঁদতে মানা। চিরচেনা সে রীতি ভঙ্গ করে আজ ক্রন্দনে লিপ্ত হলো নিশাদ। তার প্রেমী চিত্ত ভেঙেচুরে আজ অগণিত টুকরো। কভু লাগবে না আর জোড়া!
.
নিশুতি রাত। পুরুষালি হাতের মাঝে বন্দী পেলব হাতটি। সতর্কতা অবলম্বন করে দুজনে বেরিয়ে এলো রিসোর্টের ভবন হতে। মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে মৃদু স্বরে শুধালো,
” এভাবে রাতদুপুরে আমরা চোরের মতো কোথায় যাচ্ছি? বলো না। ”
” আরে ভাই একটু ধৈর্য ধর। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। জানিস না? ”
” আমি ভাই হই? ” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দুয়া।
তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো, ” কথার কথা বললাম। এটাও বুঝিস না? ”
” তুমি কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। সত্যিটা বলবে না? ”
” হ্যাভ প্যাশেন্স। ”
অধৈর্য হয়ে মুখ ফুলালো দুয়া। নীরবে হাঁটতে লাগলো সঙ্গীর সনে।
.
আঁধারিয়া রজনী চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে সে কপোত- কপোতী। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। আঁধারের মাঝে তূর্ণ হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো চমক। সেথায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হলো দুয়া! অজান্তেই ডান হাতে ঢেকে গেল ওষ্ঠাধর। অবাক নয়নে স্বামীর পানে তাকালো মেয়েটি। তূর্ণ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দুয়া পুলকিত, স্তম্ভিত! নীরবে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো প্রেমিক রূপী স্বামীটি। ইশারায় হাতে হাত রাখার আহ্বান জানালো। সম্মোহিতের ন্যায় পুরুষালি হাতের মাঝে নিজের হাতটি স্থাপন করলো দুয়া। তূর্ণ’র বাঁ হাতে বন্দী দুয়া’র কোমল হাতখানি। ডান হাতে মোবাইল তুলে ধরা। ফ্লাশ লাইটের আলোয় পথ ধরে তারা এগিয়ে গেল। সাবধানতা অবলম্বন করে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়ে নিচে নেমে গেল। প্রথমে তূর্ণ উঠলো কায়াক এ ( kayak ). সে কায়াকে উঠে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে স্বামীর হাত ধরে কায়াকে উঠলো উত্তেজনায় কম্পিত দুয়া। তূর্ণ’র ইশারা মতো সে সাবধানে বসলো।
মাঝারি আকৃতির নীলাভ শুভ্র মিশেলের কায়াক’টি। মধ্যখানে একটি লণ্ঠন রাখা। লণ্ঠন হতে হলদে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে কায়াকের অন্দরে। মাথার ওপরে কৃষ্ণবর্ণ নভস্থল। গাত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে হিমেল পবন। চারিদিকে আঁধারের মাঝে এক টুকরো হলদে আভা। সঙ্গী হিসেবে রয়েছে একান্ত জন। সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! ভালোলাগার আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। আচমকা ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। লেকের বুকে আঁধার রাতে চলতে শুরু করেছে কায়াক’টি। কায়াকের নিয়ন্ত্রণ তূর্ণ’র হাতে। চিকন বৈঠা মতো লাঠিটি জলজ বুক চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে। দুয়ার অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। যে খুশিতে সয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমিত হলো প্রেমিক পুরুষটি। মনোমুগ্ধকর এ পরিবেশে হঠাৎ মোহনীয় সুর ভেসে উঠলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
চমকিত নেত্রে স্বামীর পানে তাকালো দুয়া! তার চোখেমুখে অবাকতার পাশাপাশি উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হলো। তাতেই সন্তুষ্ট হলো হৃদয়। তার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বুঝি এক ফালি হাসিতেই সফলতা অর্জন করলো। স্বামীর চোখের ইশারায় দুয়াও এবার সুরেলা সঙ্গ দিলো। আঁধারের মাঝে মেয়েলী কণ্ঠে ভেসে উঠলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
তূর্ণ’র অধর কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। হৃদয় ছুঁয়ে গেল শব্দমালা গুলো। তার হৃদয়ে লালিত রমণীর কণ্ঠ বড্ড সুমধুর! হৃদয়, কর্ণ, মস্তিষ্ক সর্বত্র মা*দকতা ছড়িয়ে দেয়। মাইরা’র চোখের গভীরতায় ভেসে বেড়ানোর মাঝে সে-ও এবার নিজস্ব মনোভাব সুরে সুরে ব্যক্ত করতে লাগলো,
‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘
দুয়া বিমোহিত নয়নে চেয়ে স্বামীর পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে একান্ত জনকে। মিটিয়ে চলেছে চক্ষু তৃষ্ণা। হৃদয়ের তৃষ্ণা। এক হাতে বৈঠা আগলে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো তূর্ণ। ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। কপোলে ছেয়ে গেল আর’ক্ত আভা। লাজুক রমণী অর্ধাঙ্গের হাতে হাত রাখলো। সুরে সুরে ব্যক্ত করে গেল,
‘ তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
অমোঘ আকর্ষণে বশীকরণ হয়ে অর্ধাঙ্গের পানে এগিয়ে গেল দুয়া। বসলো সুঠাম বক্ষপটে পৃষ্ঠ এলিয়ে। তাকে আঁকড়ে ধরলো স্বামী রূপী প্রেমিক পুরুষটি। আবেশে বুজে এলো মেয়েটির আঁখি পল্লব। একান্ত জনকে অনুভব করতে করতে ভীন দুনিয়ায় হারিয়ে গেল। পেলব হাতটি রাখলো উদরে স্থাপিত অর্ধাঙ্গের হাতের ওপর। থেমে থেমে কণ্ঠ নিঃসৃত হতে লাগলো,
‘ ইতিউতি কার্নিশে
আলো-ছায়া যায় মিশে
চলো না কুড়োবো আবার
এলোমেলো চেনা রুট-এ
বসন্ত যায় যায় যায় জুটে
ভালোবেসে জীবন কাবার ‘
লেকের বুকে থেমে গেল কায়াক। বৈঠা সতর্ক ভঙ্গিতে আগলে রেখে অর্ধাঙ্গীকে নিজের সনে মিশিয়ে নিলো তূর্ণ। ললাট কার্নিশে অধর ছুঁয়ে দিলো। জাগতিক হুঁশ ফিরে এলো মেয়েটির। তপ্ত হলো কপোল। তূর্ণ সম্মোহনী স্বরে গাইতে লাগলো,
‘ গুঁড়ো গুঁড়ো করিডোরে
চুপিসারে পাতা উড়ে
আজ বাতাসও মা!তাল
বেপরোয়া হাফ ছুটি
মাখাচ্ছে খুনসুটি, খুনসুটি
ভালোবেসে উথালপাথাল ‘
মাইরা’কে দু হাতে সযতনে আগলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। চোখে চোখে আলাপণ সেরে কপালে ঠেকে গেল কপাল। বদ্ধ হলো দু’জনার আঁখি। পুরুষালি স্বরে ভেসে এলো,
‘ এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে
এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে ‘
দুয়া মন্থর গতিতে কপাল হতে কপাল সরিয়ে নিলো। আঁখি মেলে তাকালো দু’জনে। স্বামীর নয়নে নয়ন মিলিয়ে দুয়া গেয়ে উঠলো,
‘ চোখে চোখে কথোপকথন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
প্রিয়তমার কোমল ওষ্ঠে আলতো পরশ বুলিয়ে তূর্ণ গাইতে লাগলো,
‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘
লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মায়াবী বদনে। দুজনের একত্রিত সুরের কলতানে মুখরিত হলো চারিপাশ,
‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘
সমাপ্ত হলো প্রেমময় গানের শব্দমালা। আবেশে সিক্ত কপোত কপোতী গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। মাঝ লেকের বুকে থমকে কায়াক। তাতে প্রেমাসক্ত এক জোড়া কপোত-কপোতী। মগ্ন নিজেদের মধ্যে। বাতাসেও যেন আজ প্রণয়ের অনুভূতি।
চলবে.
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৪
” আদ্রিয়ান স্যার। আপনারা এত রাতে এখানে! ”
লেকের ধারে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। তার বক্ষস্থলে পৃষ্ঠ ঠেকে মাইরা’র। একে অপরের সান্নিধ্যে মনোরম মুহূর্ত উপভোগ করছে তারা। একান্ত জনের হস্তদ্বয়ে বন্দী দুয়া’র কোমল গাত্র। বদ্ধ দু’জনার আঁখি পল্লব। ঝিরিঝিরি হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। জাগতিক হুঁশ হারিয়ে তারা এখন প্রণয় বসুধায়। মগ্ন একে অপরেতে। ঠিক সে মুহূর্তে শোনা গেল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বর। ঘোর কেটে গেল তূর্ণ, দুয়া’র। আঁখি মেলে তাকালো। তড়িঘড়ি করে দুয়া সরে যেতে উদ্যত হলো। তবে পুরোপুরি সফল হলো না। ওর ডান হাতটি মুঠোয় নিয়ে পিছু ঘুরে তাকালো তূর্ণ। চমকালো তিয়াশকে দেখে! শুধু তিয়াশ একা উপস্থিত নয়। পাশে অবাক নেত্রে তাকিয়ে মিহাদ! মিহাদ শীঘ্রই অবাকতার রেশ কাটিয়ে দুষ্টু হেসে দিলো। তূর্ণ মৃদু গম্ভীর স্বরে শুধালো,
” তোমরা এখানে? ”
” হাঁ ভাইয়া আমরা। তবে তোমরা এখানে কি করছো? ভাবির সাথে হ!টিনটি টাইম স্পেন্ড করছিলে বুঝি? আমরা এসে খুব ডিস্টার্ব করে ফেললাম? ”
মামাতো ভাইয়ের কথা শুনে লাজে আর’ক্ত হলো দুয়া। শেষমেশ ভাইয়া এমন করে লজ্জা দিচ্ছে! সে দৃষ্টি অবনত করে মিনমিনে গলায় ডেকে উঠলো,
” ভাইয়া! ”
মিহাদ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। জিভ কা মড়ে হাসি মুখে বলে ফেললো,
” ওপস্ সরি সরি। ভাবিজি লজ্জা পাচ্ছেন। ”
তূর্ণ চোখ পাকিয়ে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই এত রাতে এখানে কি করছিস? বি ড়ি টানতে এসেছিস?”
তৎক্ষণাৎ নেতিবাচক মাথা নাড়লো মিহাদ। চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
” আসতাগফিরুল্লাহ্! না না। ছিঃ! আমি ওসব খাই নাকি? ”
” খাস কিনা বললি নাকি জিজ্ঞেস করলি? ”
মিহাদ ঢিমি স্বরে বললো, ” আমি ওসব ছাইপাশ খাই না। ”
” গুড। তাহলে এত রাতে এখানে কি করছিস? আমি না হয় বউয়ের সাথে হ!টিনটি টাইম স্পেন্ড করছিলাম। কিন্তু তুই? তুই এখানে কি করছিস? আমাদের ফলো করতে করতে এসেছিস? ”
স্যারের মুখে এমন বেশরম উক্তি শুনে তিয়াশ লজ্জায় পড়ে গেল। কোন আক্কেলে যে এখানে আসতে গিয়েছিল? এখন অহেতুক বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। ইশ্! মিহাদ ভাইয়ের কথার পৃষ্ঠে থেমে থেমে বললো,
” আসলে ভাইয়া। আমার ঘুম আসছিল না। তার ওপর তুমি রুমে ছিলে না। তাই হাঁটতে হাঁটতে এদিকটায় চলে এলাম। পথে অবশ্য ওর সাথে আই মিন তিয়াশের সাথে দেখা হলো। ও-ও নিদ্রাহীন হয়ে ইতিউতি করছিল। তাই হাঁটতে হাঁটতে… ”
” বড় ভাইয়ের কোয়ালিটি টাইমে বাগড়া দিতে চলে এলি? তাই তো? ”
মিহাদ কিছু বলার পূর্বেই দুয়া স্বামীকে আটকালো। কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
” তুমি থামবে? কিসব বলছো? ছোট ভাই, স্টুডেন্ট ওরা। একটু তো বুঝেশুনে কথা বলো। সবসময় সব জায়গায় ঠোঁটকা-টা কথা বলতে নেই। ”
তূর্ণ বক্র হেসে সম্মোহনী স্বরে বললো,
” তবে কি শুধু বউয়ের কাছেই ঠোঁটকা-টা নির্লজ্জ অবতার নেবো? ”
লাজে আড়ষ্ট রমণী স্বামীর বাহুতে আলতো চাপড়
মে রে দ্রুত কদম ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো। অর্ধাঙ্গীর গমন পথে তাকিয়ে তৃপ্তিময় হাসলো তূর্ণ। তিয়াশ স্বচক্ষে অবলোকন করলো বন্ধুর সংসার জীবন। আসলেই দুয়া খুব ভালো আছে, সুখে আছে। আদ্রিয়ান স্যার বিহীন অন্য কেউ ওর মতো পা,গলীকে এত সুন্দর রূপে আগলে রাখতে পারতো না। এরা দু’জনে প্রকৃত রূপে একে অপরের পরিপূরক!
•
পরেরদিন। সূর্য মামার আলোক রশ্মিতে উজ্জ্বল ধরিত্রী। বিছানায় বসে তাহমিদা। দু হাঁটু ভাঁজ করে ডান পার্শ্বে এলিয়ে রাখা। কোলে শুয়ে তার কনিষ্ঠ কন্যা দুয়া। উনি মাতৃস্নেহ বুলিয়ে চলেছেন মেয়ের কেশের ভাঁজে ভাঁজে। আজ আদুরে কন্যার মেহেদী অনুষ্ঠান। আর মাত্র ক’দিন। স্বামীর সনে দ্বিতীয়বারের মতো পবিত্র এক বাঁধনে বাঁধা পড়তে চলেছে মেয়েটা। ওনার ছোট সে-ই আদুরে মেয়েটা দেখতে দেখতে সময়ের পরিক্রমায় কত বড় হয়ে গেল। এখন পড়াশোনা, ঘরসংসার দু-ই সামলাতে শিখে গেছে। এই মেয়েকে নিয়েই তো ওনার চিন্তার অন্ত ছিল না। ছোট থেকেই গুলুমুলু মেয়েটা সবার আদরের। অল্পতেই মন জয় করতে জানে। মিশুক স্বভাবের। বড় মেয়ে যেখানে স্বল্পভাষী সেখানে ছোট মেয়ে ছিল ননস্টপ রেডিও। সকলের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার অসীম কারিশমা রয়েছে ওর মধ্যে। তবে বড় আলসে ছিল। মাঝেমধ্যে ভীত হয়েও পড়তো। নিজের কাজ নিজে করতে চাইতো না। উনি এবং তানজিনা ই ওর কাজগুলো করে দিতেন। দিনে দিনে মেয়েটা যেন আরো আলসে, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। এজন্য ওনার চিন্তার শেষ ছিল না। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে পারে। বিয়ের পর এই আলসে মেয়েটা করবে কি? নিজের কাজ করা তো পরের কথা, শ্বশুরবাড়ির লোকগুলোকে আগলে রাখতে পারবে তো? তবে স্রষ্টার অসীম কৃপায় ওনার চিন্তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মেয়ে হলো বড় বোনের পুত্রবধূ। সেথায় আদরে ভালোবাসায় ওনার অবুঝ, দুষ্টু মেয়েটা বুঝদার হতে শুরু করলো। আজ সে বেশ সংসারী হয়ে উঠেছে। ক’দিন পর বিবাহিত জীবনের এক বর্ষ পূর্ণ হবে। সুখেশান্তিতে রয়েছে ওনার সে-ই অবুঝ পা*গলী মেয়েটা। বিয়ের পর সব মেয়েরা বুঝি এভাবেই বুঝদার হয়ে যায়। ঘরসংসার আগলে রাখতে শিখে যায়। এজন্য কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। স্বয়ংক্রিয় ভাবে স্রষ্টার রহমতে হয়ে যায়। মুচকি হেসে মেয়ের কেশের ভাঁজে চুম্বন এঁকে দিলেন উনি। আঁখি পল্লব বুজে থাকা মেয়েটি মাতৃস্নেহ উপলব্ধি করে তৃপ্তিময় হাসলো।
.
আঁধারিয়া রজনী। রিসোর্টের একাংশে ফাঁকা স্থানে আয়োজন করা হয়েছে চমৎকার আউটডোর মেহেন্দি সজ্জা। এ বহিরাঙ্গন মেহেদী অনুষ্ঠানের সাজ অত্যন্ত সুন্দর থিম, শৈলি এবং রঙের মিশ্রনে অপূর্ব লাগছে! চারিপাশ হতে হলদে কার্টেন গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে, সামিয়ানা হিসেব মাথার উপরিভাগে থাকা হলদে কাপড়ে। আশপাশে অসংখ্য ফেইরি লাইটস আলো ঝলমলে পরিবেশ তৈরি করেছে। হলদে রঙা অপূর্ব ক্যাবানার অন্দরে বেশ চমৎকার আয়োজন করা হয়েছে। বসার জন্য বেশ কতগুলো হলদে মোড়কে আবৃত আসন। সেগুলোর ওপর কমলা রঙে রঙিন কুশন সমূহ। পাশে কিছু বেতের তৈরি সিঙ্গেল আসনও রয়েছে। সব মিলিয়ে সে এক মনোরম আয়োজন!
বরাদ্দকৃত স্থানে বসে দুয়া। পড়নে তার হলদে রঙা বন্ধনী আনারকলি। আনারকলি’র গোলাকার গলা এবং গলার ডিজাইনে পোটলি বোতাম। সাদা এবং হলুদ চিনন শিফন দোপাট্টা’তে দেহের উর্ধাংশ শালীনতার সহিত আগলে রাখা। চুলের মধ্যখানে লম্বা সিঁথি টানা। দীঘল কালো কেশ পৃ্ষ্ঠে লেপ্টে। মুখখানিতে হালকা কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। দু কানে ঝুমকা। এতটুকুই সাজ। দেখতে অপরূপা লাগছে! মেহেদী অনুষ্ঠানে আজ পুরুষরা নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র রমণীবৃন্দ সেথায় উপস্থিত। দুয়া’র হাতে ব্রাইডাল মেহেদী রাঙিয়ে দিচ্ছে মেহেদী আর্টিস্ট। পাশে বসে আলাপণে ব্যস্ত পুষ্পি, সিনথিয়া, বিন্দু, দিবা। দুয়া হাসিমুখে বসে তো রয়েছে। তবে তার অবাধ্য দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে একজনকে। কোথায় সে? কিয়ৎক্ষণ পূর্বে এখানেই তো উপস্থিত ছিল।
.
বাবা এবং চাচুর সঙ্গে প্রি ওয়েডিং ফাংশন নিয়ে আলাপণে লিপ্ত তূর্ণ। তারা দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে রিসোর্টের লনে। আঁধার পরিবেশে কৃত্রিম আলোর আচ্ছাদন। কথোপকথনে লিপ্ত তৃ পুরুষ। ঠিক সে মুহূর্তে সেথায় উপস্থিত হলো নিশাদ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের কথোপকথনে বাঁধা প্রদান করতে বাধ্য হলো। মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো বন্ধুকে,
” তূর্ণ! ”
ওর ডাকে সাড়া দিয়ে তাকালো তূর্ণ, ” হুম বল। ”
” একটু এদিকে আয়। ”
তূর্ণ বন্ধুর কথায় অতটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
” একটু দাঁড়া। কথা শেষ করে আসছি। ”
নিশাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তাড়া দেখিয়ে বললো,
” আরে ভাই। জলদি আয় না। লাইনে রয়েছে একজন। ”
নিশাদের হাতে মোবাইল। কেউ কলে রয়েছে। নিজাম সাহেব এ লক্ষ্য করে ছেলেকে বললেন,
” তুই কথা বল। আমরা আসছি। ”
দুই ভাই সেথা হতে প্রস্থান করলেন। তূর্ণ বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে শুধালো,
” কি হয়েছে বল। এত হাপুশ হুপুশ করছিলি কেন? ”
নিশাদ মোবাইল এগিয়ে দিলো। চিন্তিত স্বরে বললো,
” কথা বল। বুঝতে পারবি। ”
তূর্ণ ঠিক বুঝতে পারলো না। হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলো। ঠেকালো কর্ণ কুহরে।
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ স্পিকিং। ”
.
তৃষা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে রিসোর্টের করিডোর ধরে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত নয়ন জোড়া খুঁজে চলেছে একজনকে। তাকে না দেখা অবধি শান্ত হচ্ছে না অন্তঃস্থল। ঝড়ো হাওয়ায় ল.ণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সব। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে উঠছে মেয়েটি। বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা শীতলতা জেঁকে ধরছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শরীরে বিদ্ধ হচ্ছে অবিরাম। র-ক্তাক্ত করে তুলছে ভেতরকার সবটুকু। অত্যন্ত ব্যথিত বদনে হেঁটে যাচ্ছিল মেয়েটি। হঠাৎ তার পদযুগল থমকে গেল। নয়নে ধরা দিলো অতি আকাঙ্ক্ষিত জন। তৃষা অমোঘ আকর্ষণে ব*শীকরণ হলো বোধহয়। দ্রুত পায়ে সেদিকে অগ্রসর হতে লাগলো।
দুশ্চিন্তায় মস্তিষ্কে ভ;য়াবহ গর্জন হচ্ছে। শুকনো বদনে দাঁড়িয়ে নিশাদ। দৃষ্টি নিবদ্ধ জমিনে। মাথার পেছনের চুলগুলো ডান হাতে আঁকড়ে ধরে অস্থির হয়ে রয়েছে। ঠিক তখনই শুনতে পেল হৃদয়ে লুকানো রমণীর কণ্ঠ,
” এসময়ে এখানে কি করছেন? ”
অসীম খুশিতে ভরে উঠল হৃদয়। তার প্রেয়সী! সে। সে স্বেচ্ছায় কথা বললো! তার খোঁজ করছে? পূর্বের ন্যায় সবটা থাকলে এ মুহূর্তে নিশাদের চেয়ে খুশি বোধহয় আর কেউ হতো না। তবে এখন সময়, পরিস্থিতি, প্রত্যাশা সবটাই ভিন্ন। তাই তো জোরপূর্বক নিজেকে দমিয়ে নিলো নিশাদ। মুঠো মুক্ত করলো চুল। হাতটি নামিয়ে নিলো। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত বিহীন সেথা হতে চলে যেতে উদ্যত হলো। তবে বাঁধাপ্রাপ্ত হলো আচমকা।
” চলে যাচ্ছেন? জবাবটা দিলেন না তো। ”
তৃষা ঘাবড়ে রয়েছে। নিজে থেকে কথা তো বলতে এসেছে। তবে কি থেকে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভুলভাল বলে চলেছে। গণ্ডস্থল শুকিয়ে মরুভূমির ন্যায় শুষ্ক। খাঁ খাঁ করছে। শব্দমালা যেন পলায়ন করেছে ভূতুড়ে রজনীর বুকে। তৃষার এই অপ্রত্যাশিত আচরণ আর সইতে পারলো না মানুষটি। তৎক্ষণাৎ তেঁতে উঠলো। পিছু ঘুরে ওর চোখে চোখ রেখে কাঠিন্যতা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,
” জবাব দিতে হবে? কেন? হু আর ইয়্যু? আমার জিএফ, বউ নাকি বাগদত্তা? কোনটা? কোনোটাই নয়। তুই শুধুমাত্র আমার বন্ধুর বোন। সো স্টে ইন ইয়্যুর লিমিটস। ওকে? ”
হতবিহ্বল রমণীর অক্ষি ফেটে অশ্রু বিন্দু উপচে পড়তে চাইছে। চরমভাবে ধরাশায়ী অন্তঃস্থল। সর্বদা এ মানুষটির মিষ্টিমধুর শাসন পেয়ে এসেছে সে। কখনো এমন কঠিন স্বর শুনতে পায়নি। সেখানে আজ সামান্য, ক্ষুদ্র কারণে মানুষটি এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে? অভিমান নাকি অপমান জানা নেই। টলমলে চোখে তাকিয়ে তৃষা। ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করে বসলো,
” আ আপনি এমন করে বলছেন কেন? ”
” তাহলে কিভাবে বলবো? অস*ভ্য লোকেরা এর চেয়ে ভালো ভাষায় কথা বলে বুঝি? ”
” আ-আমি আসলে.. ”
ডান হাতের তেলো দেখিয়ে থামতে ইশারা করলো নিশাদ।
” স্টপ। মনমেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। আগুনে আর ঘি ঢেলে দিস না। জাস্ট লিভ মি অ্যালোন। ”
সেথা হতে প্রস্থান করার ইশারা করলো নিশাদ। প্রেয়সীর অশ্রুসিক্ত বদন দেখেও সে যেন আজ ভাবলেশহীন। কঠিন। কিছুই এসে যায় না। চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। এমন বিরূপতা সইতে পারলো না তৃষা। একরাশ যাতনা নিয়ে সেথা হতে ছুটে পালালো। পেছনে রয়ে গেল চিন্তিত এক মানব।
.
আনন্দে মুখরিত মেহেদী অনুষ্ঠান। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। হবু কনের দু হাত রাঙা হলো মেহেদীর পরশে। মেহেদী রাঙা কোমল দু’টো হাত সাবধানে আগলে রেখে কক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলো দুয়া। পৌঁছালো কক্ষে। নয়নতারায় আবদ্ধ হলো ননদের অবয়ব। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মেয়েটি। মুখ গুঁজে বালিশের আবরণে। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে কায়া। সে দৃশ্য অবলোকন করে দুয়া সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন ভাবে করে বসলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক প্রশ্ন,
” নিশাদ ভাইয়ার সঙ্গে তোর কি চলছে? ”
ক্রন্দনে লিপ্ত রমণী হতবিহ্বল হলো। ভুলে গেল ক্রন্দন। অশ্রুসজল নয়নে পিছু ঘুরে তাকালো। দুয়া ওর দিকে না তাকিয়ে বিছানার এক ধারে গিয়ে বসলো। ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা ব্যবহার করে কোনোমতে দেহ হতে ওড়না সরিয়ে নিলো। সিলিং ফ্যানের নিম্নে আরামে দেহ এলিয়ে দিলো হেডবোর্ডে। তৃষা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। বোধগম্য হচ্ছে না কিছুই। কি বলবে, কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তা অজানা। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে চক্ষু বন্ধ করে দুয়া পুনরায় শুধালো,
” চুপ করে আছিস কেন? বল। কবে থেকে মনের লেনাদেনা চলছে? ”
তৃষা সোজা হয়ে বসলো। কাট-কাট কণ্ঠে বললো,
” কিসের লেনাদেনার কথা বলছিস? কো কোনো লেনাদেনা নেই। ”
চক্ষু মেলে তাকালো দুয়া। ভ্রু উঁচু করে নিশ্চিত হতে শুধালো,
” আচ্ছা? ”
তৃষা অবনত মস্তকে জবাব দিলো, ” হুম। ”
” তাহলে তোমার চোখে অশ্রু কেন ললনা? কাঁদছিলেই বা কেন? ভাবির শোকে? ” দুয়ার কণ্ঠে উপহাসের ছাপ।
তৃষা দু হাতে তড়িঘড়ি করে অশ্রু বিন্দু মুছে নিলো। মৃদু শব্দে হাসলো দুয়া। চক্ষু বন্ধ করে কাব্যিক ভাবে বলতে লাগলো,
” ওহে ললনা! প্রণয় নামক বি!ষধর সাপ তোমায় দং*শন করে ফেলেছে। এবার যে তোমার প্রণয়াসক্ত বি’নাশ আসন্ন।”
মেয়েটির অক্ষি কোল গড়িয়ে অবিরাম অশ্রু ঝড়তে লাগলো। সে ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিজেকে বুঝ দেয়ার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
” না না। এ-এ হতে পারে না। ”
” ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। স্বীকার করতে শিখ তৃষ। অন্যথায় দেরি না হয়ে যায়। ”
দুয়া অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৃষা। পুনরায় বালিশে মুখ লুকিয়ে শুলো। যেন নিজেকে আড়াল করলো। গোপন করলো তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতির বহর। দুয়া তার প্রিয় বন্ধুসম ননদের পাশে দুঃখী চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভেবে নিলো কিছু ভাবনা।
.
তমস্র রাত্রি। বারিদের আড়ালে লুকায়িত সুদানিধি। লুকোচুরি খেলে চলেছে পেঁজো তুলোর ন্যায় বারিদের সনে। চারিপাশ আঁধারে ঘনিভূত। দূর আকাশে অবস্থিত সুদানিধি’রও বুঝি আজ মন খারাপ। তাই তো আঁধার নেমেছে প্রকৃতির বুকে। ছাদের একাংশে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। থমথমে তার সুকান্ত মুখশ্রী। কপালে সরু এক ফালি ভাঁজ। মানসপটে চলছে অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তা। অনাকাঙ্ক্ষিত এ কোন ঝড়ো হাওয়া বয়ে আসছে? ল*ণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইছে সাজানো গোছানো সুখের সংসার। একসাথে প্রায় এক বর্ষ কাটালো দু’জনে। অবশেষে বিবাহ বার্ষিকীর দিন নতুন করে আরও একবার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছিল তারা। আর তো মাত্র ক’টা দিন। তন্মধ্যে এ ঝড়ের আভাস! এটা কি খুব দরকার ছিল? সবটা কি নির্বিঘ্নে সুষ্ঠু রূপে হতে পারতো না? হয়তো পারতো। তবে মহান রবের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন কিছু। তাই তো এ অনাহুত বিপদের উঁকিঝুঁকি! আচ্ছা এ বিপদ কাটাতে তার কি করা উচিত? বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী তো করবেই। এছাড়াও! এই বিপদে তার আপনজন, পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তো? তাদের কিছু হয়ে গেলে…! না না। এ কি ভাবছে সে! ওপর ওয়ালা রয়েছেন। উঁনি নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন। সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষক যে উঁনি। মনের মধ্যে একঝাঁক চিন্তাভাবনা ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। খৈ হারিয়ে ফেলছে চেতনার বৈঠা। ওলোটপালোট কত কি ভেবে চলেছে। নির্ঘুম ছাদে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। কখনো মৃদু পবনে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কখনোবা হেঁটে বেড়াচ্ছে ছাদের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত। একটুও স্বস্তি মিলছে না। একাকী রাত। সঙ্গীহীন একেলা বিরহে, দুশ্চিন্তায় পাড় হলো।
চলবে.
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৫
ভানু’র দ্যুতি ছড়িয়ে ধরনীর বুকে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বিরহে কাতর ললনা। তার অশ্রুসজল নয়ন জোড়া নিবদ্ধ অর্থহীন ঠিকানায়। অনুশোচনা-অনুতাপে ক্লিষ্ট অন্তঃস্থল। স্মরণে এসে পড়ছে তূর্ণয়া’র বাগদানের মধ্যাহ্ন লগ্ন। সে-ই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত। দুঃখময় চেহারা, সে চেহারায় একরাশ আকুলতা, নয়ন জোড়ায় অসীম ভালোবাসা। মেয়েটির কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো নেত্রজল।
___
আজ তূর্ণ, দুয়া’র বাগদান। স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত সকলে। তৃষা পুষ্পির সঙ্গে কথা বলতে বলতে লন ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা পথ অগ্রসর হয়ে বিভক্ত হলো তাদের পথ। বায়ের পথে এগিয়ে গেল পুষ্পি। তৃষা ডান দিকের পথে পা বাড়ালো। হঠাৎই হাতে অনুভূত হলো হ্যাঁ’চকা এক টান। ডান পার্শ্বের দেয়ালে পৃষ্ঠ ঠেকে গেল কিংকর্তব্যবিমূঢ় মেয়েটির। তার অবাক নেত্রে দৃশ্যমান হলো নিশাদের মুখখানা। মানুষটির অধরে লেপ্টে দুষ্টু হাসির রেখা। নিশাদ ওর বাহুপাশ সংলগ্ন দেয়ালে দু হাতের ভর ছেড়ে দিলো। কিঞ্চিৎ ঝুঁকে গেল মায়াবী মুখপানে। ফিসফিসিয়ে আদুরে কণ্ঠে শুধালো,
” কি জানেমান? আমায় ছেড়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? ”
তৃষা ততক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করতে সক্ষম হয়েছে। গমগমে স্বরে বলে উঠলো,
” এ কেমন ধরনের আচরণ? এভাবে কেউ টান দেয়? ”
” নিশাদ দেয়। ” একরোখা জবাব।
কঠোর স্বরে মেয়েটা বলে উঠলো,
” আমার পথ ছাড়ুন বলছি। ”
ঈষৎ নড়েচড়ে ওঠে, ” যেতে দিন। ”
” নো। ” দৃঢ় উত্তর এলো।
” তাহলে কি করবেন? চিপায় এনে র*ঙ্গলীলা করবেন?”
তৃষার অভিব্যক্তি কেমন অস্বাভাবিক। চোখমুখ ম্লান। ওর থেকে হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত নোং রা বাক্য আশা করেনি নিশাদ। মানুষটার দু হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলগা হয়ে গেল। এ কি শুনতে পেল সে? আস্তে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো নিশাদ। হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
” এ-এসব কি বলছিস তৃষা? র*ঙ্গলীলা? এ কেমন শব্দ? ”
” ভুল কিছু বলেছি কি? বন্ধুর ছোট বোনকে নিয়ে মানুষ চিপাচাপায় কেন যায়? লুডু খেলতে? ”
নিশাদ তৎক্ষণাৎ বাঁধা প্রদান করলো,
” স্টপ ইট। কিসব ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করছিস তুই? নিজে আদৌও শুনছিস তো? ”
তৃষা দৃষ্টি নত করে নিলো। জবাব দিলো,
” নিশ্চয়ই শুনছি। আমি তো আর কানে কালা নই। ”
” হাঁ আমি জানি তুই কানে কালা নস। তবুও। তখন থেকে কিসব বলে যাচ্ছিস? শুনতে বাজে লাগছে। ”
চোখ তুলে তাকালো মেয়েটা। বিদ্রুপের স্বরে শুধালো,
” আচ্ছা? শুনতে বাজে লাগে। করতে বাজে লাগে না? লজ্জা করে না বন্ধুর ছোট বোনকে নিয়ে এমন করতে?”
” না করে না। বন্ধুর ছোট বোন হোস তুই। নিজের বোন তো আর নয়। তাহলে লজ্জা করবে কেন? আর তাছাড়াও। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বন্ধুর ছোট বোনদের প্রতি ছেলেদের আলাদাই একটা অধিকার বোধ থাকে।”
” ওহ্ আচ্ছা। সেই অধিকার বোধের অসৎ ব্যবহার করছেন? ”
দৃষ্টি নত করে,
” আমার তো ভাবতেও অবাক লাগছে আপনি ভাইয়ার বন্ধু। ভাইয়া বন্ধু নির্বাচন করতে শেষমেষ এমন ভুল করে বসলো! কি করে? ”
তৃষার মায়াবী মুখশ্রীতে আজ জিজ্ঞাসু ভাব। নিশাদ অবাক নেত্রে তাকিয়ে। এসব কি বলছে তৃষা? মেয়েটা আজ এমন অদ্ভুদ আচরণ করছে কেন? কি হয়েছে ওর? নিশাদ কোনোমতে নিজেকে সামলে তৃষার মাথায় বাঁ হাত স্থাপন করলো। কেশে আদুরে হাত বুলিয়ে নরম কণ্ঠে শুধালো,
” তৃষা। কি হয়েছে তোর? বল আমায়। নিশাদ ভাইয়া শুনছি। কোনো অসুবিধা হলে বল। ইনশাআল্লাহ্ সলভ্ করে দেবো। বল না কি অসুবিধা হচ্ছে। এমন করে বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? নাকি কোনো আবদার পূরণ হয়নি? বল আমায়। নিশাদ ভাইয়া শুনছি। ”
কেশে বুলাতে থাকা হাতটি ঝটকা মে.রে সরিয়ে দিলো তৃষা। দাঁড়ালো মুখ ঘুরিয়ে। অধর কা’মড়ে নিজস্ব অনুভূতি লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নেত্রকোণে জমায়িত হতে লাগলো অশ্রু কণা। থেমে থেমে বললো,
” অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করছেন? সবচেয়ে বড় অসুবিধা তো আ-আপনি নিজে। ”
হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ধক করে উঠলো নিশাদের। অসহনীয় যাতনা জাপ্টে ধরলো চরমভাবে। শুকিয়ে কাঠ হলো গণ্ডস্থল। কণ্ঠনালী বুঝি অবরুদ্ধ। ভেতরটা ছিঁড়ে খানখান। ক্ষীণ কম্পিত স্বরে পুনরায় নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো,
” আ আমি অসুবিধা? ”
তৃষা ভিন্ন দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। দৃঢ় স্বরে বললো,
” তা নয়তো কি? দিন নেই রাত নেই অ;ভদ্রের মতো পিছু পড়ে আছেন। আ-পনার জন্য একমাত্র বড় ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ উদযাপনও করতে পারছি না। সবসময় ঝা-ঝামেলা ফেস করতে হচ্ছে। ”
টলে উঠলো সুঠামদেহী মানবের পদযুগল। কর্ণদ্বয় বুঝি আজ বে`ইমানি করে চলেছে। যা নয় তাই শ্রবণ হচ্ছে কর্ণ কুহরে। তৃষা কখনোই এমনটি বলতে পারে না। সে ভুল শুনছে। হাঁ ভুল শুনছে সে। তবে কেন শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাচ্ছে,
” আপনাকে আমি এত করে এড়িয়ে চলছি। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছি ইয়্যু আর নাথিং টু মি। তবুও আপনি পিছে পড়ে আছেন। অস`ভ্য, অ;ভদ্রের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছেন। বড় ভাইয়ের বন্ধু বুঝি এমন হয়? লুজ ক্যারেক্টার? ”
” তৃষা! ” অস্ফুট স্বরে বেদনাদায়ক কণ্ঠ নিঃসৃত হলো নামটি।
” হাঁ তৃষা। আ-আপনার বন্ধুর ছোট বোন। আপনারও ছোট বোনের মতো। তাই দয়া করে এসব বন্ধ করুন। লোক জানাজানি হলে আমার সম্মানহানি হবে। আপনার তো আর কিছু হবে না। আফটার অল পুরুষ মানুষ আপনি। পুরুষ মানুষের আবার কিসের স-ম্মানহানি? সব দোষ তো নারী জাতির। ”
ভেজা কণ্ঠে বলে চলেছে তৃষা। ওদিকে ঘুরিয়ে রাখা মুখখানি। বড় কষ্টে এমন নি ষ্ঠুর শব্দমালা ব্যক্ত করছে সে। পারছে না আর নিজেকে সামলাতে। নিশাদও পারছে না আর শুনতে। আজ এমন করুণ মুহূর্তে নিজস্ব অনুভূতি লুকাতে ব্যর্থ হলো। রয়েসয়ে বেদনা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,
” তৃষা আ-আমি তোকে ভা.. ”
অসম্পূর্ণ রয়ে গেল বাক্যটি। তৃষা বাঁধা প্রদান করে বললো,
” ওহ্ প্লিজ। এসব সো কল্ড অ্যাট্রাকশনকে যেনতেন নাম দেবেন না। ”
” অ্যাট্রাকশন! নাহ্। না। বিশ্বাস কর আমি। আমি তোকে সত্যিই.. ”
ডান হাত প্রদর্শন করে বাঁধা দিলো তৃষা। তার কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কণা। যা রয়ে গেল নিশাদের দৃষ্টির আড়ালে। মেয়েটি কাট-কাট কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কিচ্ছু নেই আমাদের মধ্যে। বুঝেছেন? এসব অ্যাট্রাকশন ফ্যাট্রাকশন ভুলে যান। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন। প্লিজ। আপনার কাছে হাতজোড় করে মিনতি করছি। ”
হায়! নি ষ্ঠুর নিয়তি! তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি আজ স্বেচ্ছায় তার কাছ থেকে মুক্তি চাইছে। হাতজোড় করে মিনতি করছে। তার প্রগাঢ় ভালোবাসাকে অ্যাট্রাকশনের নাম দিয়ে ধামাচাপা দিতে চাইছে। বেদনায় কাতর মানুষটির আঁখি যুগল আর’ক্ত হলো। ভারী হলো কণ্ঠস্বর। টলমলে পদযুগল মন্থর গতিতে পিছু হটতে লাগলো। বেসামাল তৃষা একটিবারের জন্যও পিছু ঘুরে তাকালো না। নিজেকে সামাল দিতে দৌড়ে প্রস্থান করলো সেথা হতে। পেছনে রয়ে গেল একজনার আধুরি কাহানি।
___
তার নি ষ্ঠুর বাক্যমালা সত্যিই মেনে নিয়েছে মানুষটি। সেদিন সে প্রহরের পরমুহুর্ত হতে আর স্বেচ্ছায় সামনে আসেনি। কখনো ভুলে দেখা হয়ে গেলেও দৃষ্টি সরিয়ে প্রস্থান করেছে। যেন সে অদৃশ্য, অস্পৃশ্য। সে তো এমনটাই চেয়েছিল। তাই তো ভেতরকার নাম না জানা অনুভূতি দা ফন করে নি’ষ্ঠুর রূপ ধারণ করলো। শোনালো কিছু অবাঞ্চিত বাক্য। আজ সে মুক্ত বিহঙ্গ। নেই কোনো পিছুটান। তাড়া করে বেড়াচ্ছে না কোনো নিশাদ নামধারী শা;সক। তবে? কেন যাতনায় পিষ্ট হৃদয়! কেন সহে না এ ব্যবধান? কেন? জানা নেই এ বোকা- অবুঝ ললনার। সে তো শুধু জানে ক্রন্দনের লীলা। বরাবরের ন্যায় কপোলের কোমল আবরণে মুক্তোর মতো দানা জ্বলজ্বল করে চলেছে। অসহনীয় যন্ত্রণা তোলপাড় করে দিচ্ছে অন্তঃপুর।
” তৃষা? অ্যাই তৃষা? ”
আকস্মিক মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে গেল তৃষা। তড়িঘড়ি করে অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো। কক্ষে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করলেন তাসলিমা।
” কি রে! কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? ”
তৃষা ধীরে ধীরে পিছু ঘুরে তাকালো। দৃষ্টি নত করে মিহি স্বরে বললো,
” সরি আম্মু। ”
তাসলিমা চমকালেন! ওনার চঞ্চল মেয়ে আজ কথা না পেঁচিয়ে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করছে! এ যে অভাবনীয়! উনি হাতে থাকা কিছু পোশাক বিছানায় রেখে মেয়ের পানে এগিয়ে গেলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর মাখা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে মা? তুই ঠিক আছিস তো? ”
তৃষা মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে জড়ানো স্বরে মিথ্যে বললো,
” আ’ম ফাইন আম্মু। ”
তাসলিমা উদ্বেগ প্রকাশ করলেন,
” সত্যি বলছিস তো? ক’দিন ধরে তোকে কেমন দেখাচ্ছে। ব্যস্ততার জন্য কিছু যে জিজ্ঞেস করবো সে সুযোগ অবধি পাচ্ছি না। তুই সত্যি ঠিক আছিস তো মা? বিয়েবাড়িতে কিছু হয়েছে? ”
তৃষা মেকি হেসে মায়ের ডান কপোলে চুমু এঁকে দিলো।
” আমি ঠিক আছি আম্মু। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। আ’ম ফাইন, ওকে? ”
মাতৃহৃদয় তো! দুশ্চিন্তা সরাতে পারলেন না। তবুও মিথ্যে হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
” আচ্ছা ঠিক আছে। দেখ তো তোর আব্বু কোথায়। সে-ই কখন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মানুষটা রীতিমতো উধাও। ”
” ওকে মাদার। আমি এই যাচ্ছি আর পিতাজিকে খুঁজে নিয়ে আসছি। ”
একটুও বিলম্ব করলো না তৃষা। মায়ের সন্দেহভাজন দৃষ্টি এড়াতে দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো।
.
নিজস্ব ভাবনায় মশগুল মেয়েটি লন ধরে এগিয়ে চলেছে। বিপরীত দিক হতে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তূর্ণ। হঠাৎ তার কণ্ঠ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়লো দুয়া’র। মেয়েটি স্বামীকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে তাকালো। তূর্ণ নৈকট্যে পৌঁছাতেই সে কিছু বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু হতাশ হলো চরমভাবে। পাশ কাটিয়ে চলে গেল তূর্ণ। একটিবারের জন্য তাকালো না। মলিন হলো মায়াবী বদন। মানুষটি তাকে এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেল! কেন? গতরাতের জন্য? সে তো ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনটি করেনি। হাঁ মেহেদী অনুষ্ঠান শেষে রাত্রি বেলা ছাদে যাওয়ার কথা ছিল। ছিল সাক্ষাত করার পরিকল্পনা। কিন্তু তৃষার ভাবনায় মশগুল সে যেতে পারেনি। ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে নিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছিল। সেজন্য মানুষটি গোস্যা করেছে! সামান্য কারণে বাবুর এত গোস্যা! অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম দুয়া’র। একদিকে প্রিয় বন্ধুর না বলা আধুরি কাহানি। এর ওপর স্বামীর অভিমান। কোথায় যাবে সে? কোনটা রেখে কোনটা আগে সমাধান করবে? বুঝে উঠতে পারছে না সে। এমন সময় সেথায় হাজির হলো পুষ্পি, বিন্দু। পুষ্পি উদগ্রীব হয়ে ডান হাতের তেলোয় হবু কনের মেহেদী রাঙা হাতটি রাখলো। দেখলো ওর গাঢ় আভায় আচ্ছাদিত হাত। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো বেশ।
” হায়! মেহেদির রঙ কি গাঢ় হয়েছে! আদ্রিয়ান স্যার তো ফাটিয়ে দেবেন জাস্ট। বান্দুপি আমগো সোহাগী সাগরে দিবা-রাত্রি রীতিমতো হাবুডুবু খাইবো। ”
পুষ্পির দুষ্টু কথার রেশ ধরে বিন্দু হাসিমুখে বললো,
” আর আসছে বছরে আমরা খালামনি হয়ে যাবো। ভাগ্নে, ভাগ্নী হাজির হো। ”
সশব্দে হেসে উঠলো ওরা দুজন। তবে এসবের ভিড়ে একদম অনুপস্থিত দুয়া। থেকেও যেন নেই। মন যে আঁটকে ভিন্ন কোথাও। কোনো অতল ভাবনায়।
.
একদিকে তূর্ণয়া’র বিবাহ আয়োজন। খুশিতে আত্মহারা প্রতিটি সদস্য। অন্যদিকে অজানা এক স্থানে চলছে কুটিল ষ*ড়যন্ত্র। কারো থেকে আপনজন কেড়ে নেয়া, বুঝিয়ে দেয়া কষ্টের সপ্ত কাহন।
আহা সে কি য’ন্ত্রণাদায়ক, বি*ভৎস পরিকল্পনা!
.
সারাটা দিন যেনতেন ভাবে অতিবাহিত হলো দুয়া’র। বরাবরই খেয়াল করেছে তূর্ণ কেমন অন্যমনস্ক। বিগত দিনগুলোর ন্যায় উৎফুল্ল, সতেজ নয়। কেমন একটা লাগছে। কোনো চিন্তায় মগ্ন কি? সুযোগের অভাবে জানা হলো না। তবে মনে মনে দ্বৈত ভাবনা পোষণ করে চলেছে দুয়া। আজ রাত কিছু হতে চলেছে। কিন্তু কি?
.
আঁধারিয়া রজনী। হিমাংশু’র দ্যুতি ছড়িয়ে ধরনীর বুকে। হিমেল পবনে নৃত্যরত বৃক্ষপত্র। ভাবনায় মশগুল তূর্ণ ইটে বাঁধানো পথ ধরে হেঁটে চলেছে। আশপাশে অবস্থিত গাছপালা পেছনে ফেলে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। সেথায় পৌঁছাতেই চমকালো বেশ! এক লহমায় পালিয়ে গেল ভাবনার দল। ত্রিকোণ আকৃতির ক্ষুদ্র ছাদ। চারটে চিকন পায়ার ওপর দন্ডায়মান ছাদটি। ফেইরি লাইটস জ্বলজ্বল করে কৃত্রিম আলোকছটা ছড়িয়ে চলেছে চারিধারে। ছাদের নিম্নভাগে ছোট্ট এক টেবিল। টেবিলের দু প্রান্তে দু’টো চেয়ার। মোহময়ী রমণী বসে একটি চেয়ারে। পড়নে তার লাল রঙা থ্রি-পিস। পাতলা ওড়না জড়িয়ে মাথায়। ওড়নার অন্তরাল হতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে একগুচ্ছ কেশ। ফেইরি লাইটের কৃত্রিম আলোয় অবর্ণনীয়-মোহনীয় লাগছে! সম্মোহিত হলো পৌরুষ চিত্ত। ধীরজ গতিতে এগিয়ে গেল তূর্ণ। বসলো অর্ধাঙ্গীর বিপরীতে। নয়নে নয়ন মিলিত হলো। দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কপোলে লেপ্টে থাকা লজ্জালু আভা। কিছুটা সময় ধরে মুহুর্তটুকু উপভোগ করলো তূর্ণ। অতঃপর গলা খাঁকারি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালালো। সফল হলো বটে। লাজুক রমণী অবনত করে নিলো দৃষ্টি। তূর্ণ মৃদু হাসলো। আশপাশে তাকিয়ে বললো,
” নাইস অ্যারেজমেন্ট! ”
দুয়া তৃপ্ত হলো। ওর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মানুষটি। ফিচেল হেসে বলল,
” বউকে একবেলা এড়িয়ে চললে এত ভালো চমক পাওয়া যায় জানা ছিল না তো। এখন মনে হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমন ছোটোখাটো চমকের জন্য হলেও এড়িয়ে যেতে হবে। ”
কথাটা পছন্দ হলো না দুয়া’র। সে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
” আরেকবার শুধু আমাকে অ্যাভয়েড করে দেখো না। তখন জানবে এড়িয়ে যাওয়ার ফলাফল কি। ”
” তাই নাকি? কি করবে বউ আমার? ” দুষ্টু হেসে প্রশ্ন করলো মানুষটি। বিপরীত দিক হতে জবাব এলো,
” সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবো। ”
সশব্দে হেসে উঠলো তূর্ণ। দুয়া এতে অসন্তুষ্ট হলো। তূর্ণ হাসতে হাসতে বললো,
” লাইক সিরিয়াসলি! পাঁচ মিনিটের দূরত্বে বাপের বাড়ি। এখন বরের সাথে ক্যাঁ’চাল করে বাপের বাড়ি চলে যাবি? ”
” দরকার হলে যাবো। ”
” তাহলে আমিও শ্বশুরবাড়ি হানা দিয়ে বউ তুলে নিয়ে কেটে পড়বো। ”
” ইশ্! ভাষার কি দশা! ” চোখমুখ কুঁচকে ফেললো দুয়া।
তূর্ণ দু হাতে টি-শার্টের কলার ঠিক করে গর্বিত কণ্ঠে বললো,
” বাঙালি আমরা। মাঝেমধ্যে এমন ভাষাশৈলী প্রয়োগ করা উচিত। বুঝলি? ”
” ঘেঁচু বুঝলাম। ”
হেসে উঠলো তূর্ণ,
” এই তো বউ আমার বুঝে গেছে। তা ম্যাডাম। এবার বলুন হঠাৎ তলব কেন? বরের জন্য মন কেমন করছিল? ”
” জ্বি না। ”
” তাহলে? ” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তূর্ণ।
দুয়া ওর পানে তাকালো। মৃদু স্বরে আমতা আমতা করে বললো,
” আ আসলে কিছু বলার ছিল। ”
” সরি বলতে চাস? ”
” সরি! কেন? মানে সরি বলবো কেন? ”
” গতরাতে ছাদে এলি না। বরের কথা অমান্য করলি। সেজন্য। ”
” না মশাই। এমন কিছুই নয়। ”
” তাহলে কি? ”
দুয়া কিছু বলতে উদ্যত হতেই তূর্ণ থামিয়ে দিলো। ডান পার্শ্বে অবস্থিত সরু জলধারা দেখিয়ে বললো,
” চল ওখানে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। ”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। স্বামীর সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে পৌঁছালো গন্তব্যে। বসলো জলধারা সংলগ্ন সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে।
চলবে.