#অনুরিমা
#পর্ব_২
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
ফারিজ হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়। বাইকে চাবি দিয়ে দ্রুতই বেরিয়ে পড়ে সর্দারের বাড়ির উদ্দেশ্য। সর্দার বাড়ি যেতে তার ন্যূনতম আধাঘন্টা সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে আবার যেনো কোনো অঘটন না ঘটে যায়। গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগুতেই সামনে এক নারী ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হয়। সে চমকে উঠে মধ্যরাতে সুনশান রাস্তার মাঝে নারী অবয়ব কোত্থেকে উদয় হলো। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে চলে সে। বাইকের আলোতে কিছুটা স্পষ্ট হয়। গায়ে শাড়ি জড়ানো। কেমন উদ্বাস্তুর মত এদিকে ছুটে আসছে। সে জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি ভয়ে হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে উঠল।
ফারিজ মেয়েটাকে অভয় দিলো ভয় পেয়ো না। আমি শেখ ফারিজ ফাজ। তুমি কি সেই মেয়ে যার বিয়ে আমি ভেঙে ছিলাম। কি সমস্যা আমাকে খুলে বলো?
অনুরিমা যেনো এবার প্রাণ ফিরে পেলো। সে দু’চোখের জল ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওই সলিল সওদাগর আর সর্দার আমাকে ধমক দিয়েছে। যদি আমি এই বিয়ে না করি তাহলে আমাকে খারাপ মেয়ে বলে গ্রামে কুৎসা রটিয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করবে। তারপর আমাদের সব জায়গা-জমি ওরা নিয়ে নিবে।
ফারিজ যা বুঝার বুঝে গেছে। সে অনুরিমাকে বললো তুমি আমার বাইকে উঠো সোজা সর্দারের বাড়িতে যাবো। ভয় পেয়ো না আমি আছি তোমাদের পাশে। তুমি নিশ্চিন্তে বাইকে বসো।
ফারিজ সোজা সর্দার বাড়ির উঠোনে বাইক থামায়। তারপর অনুরিমাকে বলে তুমি আমার সাথে সাথে এসো। ফারিজ হাতের মধ্যে মুঠোফোন নিয়ে কাউকে কল ডায়াল করলেন। ওপাশের কথা শুনে তার মুখে প্রসন্ন হাসির রেখা দিলো। সে সর্দারের দরজায় করাঘাত করলেন। মিনিট পাঁচেক হলেও দরজা কেউ খুললো না। বাধ্য হয়ে সে সর্দারের দরজায় লা*থি বসালেন। এতেই কাজ হলো। দশ সেকেন্ড পরেই সর্দার বেরিয়ে এলেন। এসেই হুংকার ছুঁড়লেন,
সমস্যা কি তোমার? এত রাতে এখানে কি চাও?
ফারিজ মুখে কিছুই বললেন না শুধু হাত দিয়ে ইশারা করলেন সর্দারকে। জসিম মিয়া উঠোনের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠলেন। অস্থিরতায় তার বক্ষস্থল ক্ষেঁপে উঠলো। কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করলেন। কিন্তু তার মুখ ফুটে একরত্তি কথাও বেরুলো না। অস্থিরবদনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলেন।
ইন্সপেক্টর শরাফত কনস্টেবল শেখরকে আদেশ করলেন অ্যারেস্ট হিম। জসিম মিয়া এতক্ষণ পর যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলেন। সে গর্জে উঠলো,
ওয়ারেন্ট ছাড়া আপনারা আমাকে কোন সাহসে অ্যারেস্ট করতে আসলেন। কোন আইনের ক্ষমতায় আসছেন এভাবে মধ্যরাতে একজন সম্মানিত ব্যক্তির বাড়িতে। এভাবে কাউরে নেওয়া যায় না। জানেন না।
শরাফত শুকনো মুখে কিঞ্চিৎ হাসলেন। সর্দার উত্তেজিত হবেন না। আপনার নামে ১৫টি মামলা থানায় দায়ের করা হয়েছে। এতিমের হক আত্মসাৎ করা, বিধবা ভাতা জালিয়াতি, নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে প্রদান, মিথ্যা জন্ম নিবন্ধন কার্ড তৈরি, নাবালিকার উপর জোর-জবরদস্তি, নাবালিকার বয়সের দ্বিগুণ বয়স্ক পুরুষের সাথে বিবাহ প্রদান, নাবালিকার অধিকার হরণ, বিয়ের নামে ঘুষ আদায়, পঞ্চায়েতের নামে একক প্রহসন, নারীদের ভয় প্রদর্শন করে নিজ কার্য হাসিল, বিধবা ও বয়স্ক ভাতার নামে ভুয়া কাগজপত্র প্রদর্শন, সরকারকে বোকা বানানো, রিলিফের মাল নিজে ভোগ করা, মদ ও অবাধ জুয়া খেলার অনুমতি প্রদান এবং সর্বশেষ অবৈধ নারী ব্যবসার সাথে জড়িত বলেও আপনার নামে প্রমাণ আছে।
তবে ভয় পাবেন না সবগুলোর প্রমাণ আমাদের হাতেই আছে বলে তো আপনাকে নিতে এলাম। অনেক তো বাইরে খোলামেলা বাতাস খেলেন। এবার জেল থেকেও ঘুরে আসবেন। বেশি না হলেও সবগুলো মামলার জন্য কম করে হলেও আপনি দশ/পনেরো বছরের হাজত বাস করবেন। শুনলাম এ বছরেই আপনি ৮টি বিয়ে সম্পন্ন করেছেন। যার মধ্যে সব মেয়ের বয়সই ১৪ থেকে ১৬ এর মধ্যে। এমনকি বেশিরভাগ মেয়েগুলোই এতিম নয়তো গরিব বাবার সন্তান। এরা বেশিরভাগ অষ্টম বা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কি দারুণ বিজনেস ছিল আপনার। বাকি বিজনেস না হয় জেলে গিয়ে করবেন।
জসিম মিয়া দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নিচে দপ করে বসে পড়লেন। হাত দিয়ে বার বার নিজের মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছেলেন। তাদের বাক বিতন্ডার মাঝে তার স্ত্রী জোবেদা উঠে এলেন। পুলিশের বহর দেখে সে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল। নিজের জামাইকে নিচে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে সে আৎকে উঠলো। গগনবিদারী চিৎকারে সে চারপাশ কাঁপিয়ে তুললো। কিন্তু তার চিৎকারে খুব বেশি কাজে এলো না। শেখর এগিয়ে এসে জসিম মিয়াকে টেনে তুললো। তারপর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাদের সাথে গাড়িতে তুললো।
জোবেদা পেছন পেছন এসে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন। তার ছেলে মেয়েরা কেউ বাড়িতে নাই। মেয়েগুলার অনেক আগে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেগুলো ব্যবসা করে, আবার কেউ বিদেশ থাকেন। তার এত বড় বাড়ি এখন মানুষ বিহীন হয়ে আছে। কাউরে যে সে ডাকবে তার সময়ও নাই। সে এদিক ওদিক ছুটলো স্বামীকে ছুটানোর জন্য কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পুলিশ গাড়ি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
ফারিজ বন্ধুকে শেষবার জড়িয়ে ধরে বললো ধন্যবাদ বন্ধু। শরাফতও বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলেন। তবে এত সুন্দর মূহুর্তে এক দুঃসংবাদ শুনলেন তারা দু’জন। সলিল সওদাগর পালিয়েছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শরাফত ফারিজকে নিশ্চিন্তে থাকতে বললেন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঐ অমানুষকে সে ধরবেই। তার নামেও ৮টি মামলা থানায় দায়ের করা আছে। সহজেই এ মানুষ নামের অমানুষদের সে ছাড়বে না।
শরাফত ফারিজ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। গাড়ি ছুটলো নিজ গন্তব্যে।
অনুরিমা এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। কৃতজ্ঞতায় সে দু’চোখ ভিজিয়ে ফেলেছে। ফারিজের সামনে এসে বললো আপনি এত কিছু আমাদের জন্য করেছেন।
ফারিজ তার দিকে না তাকিয়ে বললো, না।
অনুরিমার মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ছলছল চোখে সে ফারিজের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ফারিজ একপলক মেয়েটাকে দেখলো। তারপর পূর্বের ন্যায় বাইকের উপরে বসলো। তারপর অনুরিমাকে বলল বাইকে উঠো। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
অনুরিমার বেশ অভিমান হলো। গম্ভীর গলায় বললো আমি হেঁটে যেতো পারবো। পনেরো মিনিট লাগবে।
ফারিজ বিস্মিত হয়ে অনুরিমার দিকে তাকালো। রসিকতার সুরে বললো তাই না’কি? ঠিক আছে তাহলে তুমি একা একা বাড়ি যাও। আমি গেলাম। সে বাইক চালিয়ে তার গন্তব্য ছুটলো।
অনুরিমা তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে কিঞ্চিৎ রাগ করে এই কথা বলেছে তাই বলে সত্যি রেখে চলে গেলো। যদিও সে ভূত জ্বীনকে একদম ভয় পায় না। কিন্তু তাই বলে এত রাতে তাকে সত্যিই একা রেখে চলে গেলো। সে সাহস করে সামনে তার কদম বাড়ালো। পেছনে এখনো জোবেদার আর্তনাদ ভেসে আসছে। আশেপাশে বাড়িঘরগুলো দূরে হওয়ায় কেউ টের পায়নি। নয়তো এখন মানুষের ভীড় লেগে যেত।
দৈবাৎ অদূরে কুকুরের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিলো। অনুরিমা এতক্ষণ ভয় না পেলেও কুকুরের আর্তচিৎকারে তার ভীষণ ভয় লাগছিলো। কুকুরকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার উপর সে শুনেছে রাত-বিরাতে কুকুর জ্বীনের আকৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এসব ভাবতেই আচমকাই তার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো।
সর্দারের বউ তাকে মিথ্যা বলে এই বাড়িতে নিয়ে আসছে। অথচ তার মা এই মিথ্যা ধরতেই পারলো না। তার বোন তাকে আসতে বার কয়েক নিষেধ করেছিলো। সে না চাইতেও আসতে হয়েছে। আসার পর তাকে সর্দার প্রথমে বুঝিয়েছে তারপর ইচ্ছেমত শাসিয়ে গেছে। কিন্তু এখন সর্দার নিজেই জেলের ঘানি টানবে। কিন্তু তার ভয় এখনো দূর হয়নি। সত্যিই তাদের জীবনে আলো আসবে তো। মাঝে মাঝে তার ভীষণ রাগ হয়। সে দেখতে কুৎসিত কেনো হলো না। তাহলে তো কারো নজর তার উপর পড়তো না। সে নির্বিঘ্নে বাঁচতে পারতো। এতসব ভাবনা চিন্তার মাঝেও তার এখন ভয় হচ্ছে রাতের সুনশান নিরবতাকে।
রাস্তাঘাট একদম জনমানবহীন। অনুরিমা দোয়া দরুদ পাঠ করে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দূরত্ব যেনো শেষই হচ্ছে না। কিন্তু অতর্কিত সে একটা অবয়ব দেখে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,