অনুরিমা পর্ব-০৪

0
204

#অনুরিমা
#পর্ব_৪
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে অনুরিমা। বক্ষস্থলের ঢিপঢিপ শব্দের গতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। লজ্জা আর অস্থিরতায় মাথা নত করে রেখেছে। একবারের জন্য আশেপাশে মাথা তুলে তাকায়নি সে। সামনে ফারিজ আর তার পাশে জায়েদা সমানতালে পায়ের কদম বাড়িয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অফিসরুমে আসে। সে এখনো ফারিজের পিছনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।

ফারিজ অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। প্রধান শিক্ষক হাসমাত উল্ল্যাহকে সালাম দেয়। হাসমাত উল্ল্যাহ সালামের উত্তর নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে কে তুমি? তোমাকে ঠিক চিনলাম না।

ফারিজ কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,

আমার নাম শেখ ফারিজ ফাজ। আসলে আমি অনুরিমাকে নিয়ে কথা বলতে এসেছি। সে আবার স্কুলে আসবে। নিয়মিত ক্লাস করবে। এবার থেকে ওর সবরকম দায়িত্ব আমি নিলাম। যেকোনো অভিযোগ থাকলে সেটা আপনারা আমাকে জানাবেন।

হাসমাত উল্ল্যাহ নিজের মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁকে একবার ভালো করে ফারিজকে দেখে নিলেন। তারপর মোলায়েম গলায় বললেন,

খুব ভালো লাগলো তোমার কথা। যাক বিয়ের পরেও স্ত্রীকে পড়াচ্ছো। বেশ ভালো।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনুরিমা আর তার মা হাসমাতের কথায় লজ্জায় সিটিয়ে গেলেন। তাদের অস্বস্তি ফারিজ বুঝতে পারলেন। সে হাসমাত উল্ল্যাহর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,

স্যার’ আমি অনুরিমার স্বামী নয়, না সে আমার স্ত্রী। আমি একজন সেচ্ছাসেবক। গ্রামের অসহায়, দুস্থ নারী বা মহিলা কিংবা তাদের পরিবারকে সবরকম ভাবে সাহায্য করে থাকি। সেই সুবাধে অনুরিমার পরিবারের দায়িত্ব আমি নিয়েছি।

হাসমাত উল্ল্যাহ চোখে থাকা নিজের মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে ভালো করে ফারিজকে দেখে নিলো। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। তিনি প্রসন্ন হলেন ফারিজের ব্যবহারে। মুখে কিঞ্চিৎ হাসি রেখে বললেন,

খুব ভালো উদ্যোগ। তোমাকে সত্যিই অনেক ধন্যবাদ তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু অনুরিমার তো বিয়ে হওয়ার কথা ছিল? সে পুনরায় কিঞ্চিৎ রসিকতার সুরে বললেন তবে তুমি ওর স্বামী হলেও মন্দ হবে না।

বিয়ে’টা আমি ভেঙে দিয়েছি। একজন নাবালিকার বিয়ে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অবশ্যই চাইলে একজন শিক্ষক হিসেবে আপনিও প্রতিবাদ করতে পারতেন। যাই হোক করেননি সেটা আপনার ব্যাপার। আমি এখন অনুরিমার স্কুলের রেকর্ড দেখতে এসেছিলাম। ওর বাকি বকেয়া কত আছে। আর ওর আগের রেজাল্ট কার্ড আমাকে দেখাবেন।

হাসমাত উল্ল্যাহ হ্যাঁ বলে ফারিজের কথার সাথে সম্মতি দিলেন। ফারিজ অনুরিমার বাকি বকেয়া পরিশোধ করলেন। কিন্তু রেজাল্ট দেখে কিছুটা আৎকে উঠলেন। খুবই বাজে অবস্থা রেজাল্টের।

অফিসের কাজ শেষ করে ফারিজ অনুরিমাকে ক্লাসে পাঠালেন।

ক্লাস মাত্রই শুরু হয়েছিল। ফারিজ স্যারের সাথে কথা বলে চলে আসেন। তারপর জায়েদাকে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্দেশ্য রওনা দেন।

ক্লাসে অনুরিমা ঢুকতে সবাই তার দিকে হা’ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। স্যার রসিকতার সুরে বলে উঠল,

পড়ার ভয়ে ক্লাস ছাড়লি সেই তুই আবার ক্লাস করতে এলি। কি লাভ হলো পড়ালেখা ছেড়ে অনুরিমা?

ক্লাসের অনেকেই অনুরিমাকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে আর কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তার পাশে বসা ললিতা তাকে বললো অনু তুই এতদিন পর স্কুলে আসলি। বইয়ের অর্ধেক তো শেষ। আমাদের টেস্ট পরীক্ষার আর মাত্র দুইমাস আছে। কিভাবে শেষ করবি সব?

অনুরিমা হতভম্বের মত চেয়ে আছে ললিতার দিকে। সত্যিই সে জানে না কি হবে তার?

পরের ঘন্টায় ম্যাথ শিক্ষক জহিরুল স্যার অনুরিমাকে পরেরদিন থেকে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে বললেন। অনুরিমা বিস্মিত হয়ে দীর্ঘক্ষণ চেয়েছিলো। কাল থেকে সত্যি সে প্রাইভেট পড়বে। তার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে।

স্কুল শেষে ফারিজ বলেছে অনুরিমাকে দাঁড়াতে। সেজন্যে সে স্কুলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। পাশের দোকান থেকে কাদের তাকে দেখে এক বিকৃত হাসি দিয়ে বলে উঠল,

আরে অনুরিমা যে, তা কার জন্য অপেক্ষা করছো। জামাই তো নাই। বিয়ে ভাইঙ্গা গেছে না তোমার। আবার বিয়ে করতে চাইলে আমারে বইলো পাত্র হিসেবে আমি কিন্তু খারাপ না। সলিলের থেকে বয়স একটু বেশি হইলেও কি হইবো তোমারে স্বামীসুখ দিতে পারমু ঠিকমত। রাজী হইয়া যাও জলদি।

অনুরিমার ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো। মাটি ফাঁক করে সেখানে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। সেই দোকানে থাকা উপস্থিত বাকি লোকজনও কাদেরের কথা শুনে হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অনুরিমা দোকান থেকে সরে দাঁড়ালো। অপেক্ষা করতে করতে তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। আধাঘন্টা পর ফারিজের বাইক এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সে অনুরিমাকে ইশারা দিলো উঠার জন্য।

অনুরিমা বাইকে উঠে দেখলো ফারিজের বাইক বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে যাচ্ছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো আমরা কোথাই যাচ্ছি?

ফারিজ কিছু না বলে বাইক দ্রুত গতিতে চালিয়ে একটা শপিং মলের সামনে নিয়ে আসলো। তারপর বললো নামো।

অনুরিমার এখনো জিজ্ঞাস্যু দৃষ্টি। সে ফারিজকে আবার কিছু বলার আগে সেই বললো দোকানে চলো।

কিন্তু কেনো?

গায়ে জড়ানো হিজাব আর এ্যাপ্রোন তো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তোমার নতুন এ্যাপ্রোন আর হিজাব কিনতে। আর কিছু নতুন জামা নেয়ার জন্য।

আপনি আমার জন্য এতকিছু কেনো করছেন? নিজের টাকা কেনো খরচ করছেন আমাদের জন্য।

ফারিজ মুখে রসিকতা রেখে বললো,

এই যে, ক্ষুদ্রকণা’ তোমার কি মনে হয়? টাকা গাছে ধরে আর আমি সেখান থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসছি তোমার জন্য। তোমাদের টাকা খরচ করছি আমার টাকা নয়। তোমার আম্মা আর দাদুর দুই বছরের ভাতা পেয়েছে। প্রায় আটাত্তর হাজারের মত টাকা পেয়েছে তোমার পরিবার। সেখান থেকেই আমি তোমার জন্য খরচ করছি। বুঝলে অনুকণা।

অনুরিমা ফারিজের কথা শুনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তার তো বিস্ময়ে আক্কেলগুড়ুম। কৃতজ্ঞায় তার আবারও চোখ ছলছল করে উঠলো।

তারা দোকানে গিয়ে কিছু কাপড় কিনে আবার বেরিয়ে পড়ে।

বাইকে বসে অনুরিমা ইস্ততঃবোধ করছিলো কিছু কথা বলতে। পরে অনেক সাহস সঞ্চার করে বললো,

আচ্ছা, আমি আপনাকে ফারিজ ভাই বলে ডাকতে পারি।

ফারিজও ছোট্ট করে বলল, হু।

বাইক চলাকালীন অনুরিমা ফারিজকে দত্ত বাড়ির সামনে থামাতে বললো। ফারিজ ব্যগ্র কন্ঠে বললো কেনো? সে আমতা আমতা করছিল বলতে।

আসলে দত্ত বাড়ির সামনে একটু থামালে ভালো হত। আমার বান্ধুবীর শ্বশুর বাড়ি এটা। ওর সাথে অনেকদিন কথা হয় নাই। একটু কথা বলতাম।

অনুরিমার মুখে বান্ধুবীর কথা শুনে সে তৎক্ষণাৎ বাইকের ব্রেক কষলো। তারপর তার দিকে মুখে ঘুরে বললো,

তোমার বান্ধুবী দত্ত বাড়িতে। কি নাম তার?

ওর নাম সবিতা। বিয়ে হয়েছে পাঁচমাস আগে।

ফারিজ চটজলদি ভাবলো। তাহলে এই মেয়েকে সে খুঁজচ্ছিলো। তার লিষ্টের আরও একটা মেয়ের নাম খুঁজে পেয়েছে সে। সে ত্বরিত প্রশ্ন করলো,

সবিতার বয়স কতো?

আমার মতোই। তার এখন ষোলো। কিন্তু বিয়ের সময় পনেরো ছিল।
________________

বাড়ির পাশে লোক সমাগমে ভর্তি। অনুরিমা বোনকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে’রে আপ্তি? এত লোকের ভীড় কেনো আমাদের বাড়িতে?

আপ্তি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

আমাদের জমিন এতদিন দত্তবাড়ির লোকেরা জোর-জুলুম করে দখল করে রেখেছিলো? কিন্তু আজ ভূমি অফিস থেকে লোক আসছে। আমাদের জমিন পুনরায় মাপ-ঝোপ দিয়ে দত্ত বাড়ির লোকেদের থেকে উদ্ধার করছে। আপু আমার যে কি খুশি লাগতেছে। আমাদের জমি আবার ফিরা পাইছি। আমার বাবায় তো অনেক চেষ্টা কইরাও ওদের দিকে নিতে পারে নাই। কিন্তু ফারিজ ভাইয়া এক ঝটকায় সব ঠিক করে দিছে। বিশ্বাস করো ফারিজ ভাইয়াকে ইচ্ছে করতেছে কি’যে করি?

অনুরিমার মুখে তৃপ্তির হাসি। সে তার বাবার হারিয়ে যাওয়া জমির পুনরুত্থান দেখছে। এ যেনো সোনার হরিণ খুঁজে পাওয়ার মত। সত্যি ফারিজ ভাইকে আল্লাহ দীর্ঘজীবী করুক।
____________________

দত্ত বাড়ির লোকেদের মাথায় হাত। এ যেনো নিজেদের পাতের ভাত কেঁড়ে নেওয়ার মত অবস্থা হয়েছে তাদের। সবাই বসার ঘরে জড়ো হয়েছে। ফারিজের দিকে আঙ্গুল তুলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো এই ছেলে গ্রামে এসেছে দু’দিন হয় নাই। এত তথ্য এই ছেলে পেয়েছে কোথায়? তারা এই জমি দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে দখল করে ছিলো। কিন্তু আচমকা ফারিজ নামক কীট এসে তাদের সবকিছুতে ভাগ বসাচ্ছে। কাল নাকি আবার ভূমি অফিস যেতে হবে।

দত্ত বাড়ির প্রধান সুব্রত দত্ত বললেন,

মাথা ঠান্ডা রাখো। কাল ভূমি অফিস যাওয়ার আগে চেয়্যারম্যানের কাছে যাবো আমরা।

সুব্রতর বড় ছেলে সুলভ বললো,

কিন্তু বাবা চেয়্যারম্যান সাহেব কি আমাদের সাথে থাকবেন। নিজের ছেলের পক্ষেই তো থাকবে। বরং আমাদের দোষ বেরিয়ে আসবে। তখন আমও যাবে ছালাও যাবে।

সুব্রত কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফারিজ ছেলেটার আকবরের বাড়িতে দেখি আজকাল যাতায়াত বেশি। তোমরা ঐ ছেলের উপর নজর রাখো। ঐ ছেলের প্রতিটা কদমের উপর নজর রাখো। এমন কিছু করতে হবে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে।

চলবে,,,,,,,,,,