ম্লান সন্ধ্যায় পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0
656

#ম্লান_সন্ধ্যায় (২৫)
®️ সুমি খানম

কোয়েলিয়া রান্নাঘরে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল। রুবিনা এসে জানালো আফসার শিকদার বেগুন পোড়া দিয়ে গরম ভাত খাবেন। ভদ্রলোকের এমন ইচ্ছায় ও অবাক হলেও বেশ আনন্দের সাথে ইচ্ছাপূরণের দায়িত্ব নিলো। এমনিতেই সেদিনের জন্য ও মনে মনে অনুতপ্ত।আজ নিজের ভুল শোধরানোর সুযোগ পাওয়ামাত্রই সেটা লুফে নিল ।রুবিনাকে বিদায় করে ও ভাত চাপায়। বেগুনে তেল মেখে পুড়িয়ে, শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ আর ধনেপাতা চটকিয়ে তাতে দিলো আচার তেল।প্রতিটা কাজ ও করলো যত্ন নিয়ে।প্রবীন মানুষটার ছোট্ট আবদার পূরণের চেষ্টায় ও আনন্দিত। তবে ভদ্রলোক মাত্র একটা পদ দিয়ে ভাত খাবেন,এটা কোয়েলিয়ার মনঃপুত হলো না। বুদ্ধি করে সাথে ও টমেটো পুড়িয়ে মেখে নিলো।

কোয়েলিয়াকে খাবার পরিবেশন করতে দেখে আফসার শিকদার প্রতিক্রিয়া করলেন না। চেয়ার টেনে বসতেই কোয়েলিয়া ওনার সামনে ভাতের প্লেট আর ভর্তা রাখে। কনকনে হিমের ভেতর ঝাল ঝাল ভর্তা আর গরম ভাত দেখে যেকারো খিদে বেড়ে যাবে। তিনি আর অপেক্ষা করতে পারলেন। এমনিতেই বয়স বাড়লে নাকি খাওয়া-দাওয়ার প্রতি ঝোঁক বাড়তে শুরু করে।যদিও এখনো সে লক্ষণ ওনার ভিতরে নেই।আজ হঠাৎ এমন ইচ্ছের কারণ নিজেও জানেন না।

আফসার শিকদার বেগুন পোড়া দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ভাত মাখছেন। ওনার ভাত মাখানো দেখার মতো। তিনটে আঙ্গুলের সামান্য টুকু এঁটো করে, তিনি ভাত নেড়েচেড়ে মুখে দিলেন। মুখ গম্ভীর হলেও, খাবারটা মুখে নিয়ে যে তৃপ্ত তা বোঝা গেল। কোয়েলিয়া পাশে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে খাওয়া দেখছে। বেগুন পোড়া বিশেষ খাবার নয়, কিন্তু আফসার শিকদারের খাওয়া দেখে যে কারো ইচ্ছে হবে বেগুন পোড়া দিয়ে একগ্রাস ভাত খেতে। আফসার শিকদার বলেন,
‘খেয়ে দেখতে পারো। এমন খাবার একা বসে খেয়ে আনন্দ নেই।’
‘আমার খিদে নেই, কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।’
‘তাহলে ওখানটায় বসো।একটু গল্প করি, অনেকদিন কারো সাথে গল্প করি না।’
কোয়েলিয়া বিস্মিত হয়। আফসার শিকদার ইতোপূর্বে কখনোই ওর সাথে ভালো করে কথা বলেনি। নিজের শশুরের হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ ওর বোধগম্য হলো না।তাই ও চুপচাপ আফসার শিকদারের মুখোমুখি থাকা চেয়ারের পাশেরটা ফাঁকা রেখে বসলো। তবে প্রসঙ্গ তোলার অপেক্ষা করতে হলো না।

আফসার শিকদার বলেন,
‘কিছু কিছু খাবার মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।এই খাবার আমাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ছোটবেলায় মা’কে দেখতাম শীত এলেই ভরদুপুরে বেগুন, টমেটো পুড়িয়ে অনেকগুলো শুকনো লঙ্কা পোড়া দিয়ে মাখতেন। খুব ঝাল হতো,তাও মায়ের মাখানো ভাতের লোভ কমতো না। খাওয়ার পর মাথায় আগুন ধরে যেত,চোখে ঝাপসা লাগতো।মা হেসে বলতো,কি শিক্ষা হয়েছে!আর খাবি আমার পাতের ভাত! মুখে এমন বললেও, হাসতে হাসতে চিনি এনে মুখে গুঁজে দিতো। তাও কিন্তু মা’র মাখানো ভাতের লোভ গেল না। আমার মা খুব ঝাল খেতো। শেষবয়সে এসে ধরা পড়লো আলসার, শুকনো লঙ্কা, ভাজাপোড়া খাওয়া নিষেধ। তারপরও করতো কি, ফাঁক পেলেই নানারকম ভর্তা মুখে না দিলে চলতো না। অনিকের মা এমন কাজে হাসতো।শাসন করারও উপায় ছিল না। কঠোর গলায় বলতো, তুই আমার পেটে জন্ম নিয়ে আমাকে শাসন করিস। অনিকের জন্মের আগেই মা মারা গেল। ওনার আশা ছিল,নাতি নাতনির সাথে শেষ বয়সটা কাটাবেন। কিন্তু মানুষের সব আশা পূরণ হয়না। মৃত্যুর আগে কোন না কোন আশা বুকে নিয়ে পৃথিবী ছাড়ে।’

আফসার শিকদারের চোখের কোণে জল।পুরোনো কথা মনে পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও, তিনি তা চেপে রাখলেন।একটু থেমে বলেন,
‘তোমাকে এসব কেন বলছি জানো?’
আফসার শিকদার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কোয়েলিয়ার দিকে তাকান‌।যেন এ প্রশ্নের জবাব তার চাই।কোয়েলিয়া ইতস্তত করে বলে,
‘আপনি কথাগুলো বলে মনকে হালকা করতে চান। কেননা খাবারের প্লেট দেখে আপনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন।’
‘আমার পছন্দ ভুল নয়, তুমি বুদ্ধিমতী। কিন্তু জানো,এইযে তুমি ঝাল দিয়ে ভর্তাটা মেখেছো,এটা আমি অনেকদিন বাদে খেলাম।যদিও আমার মায়ের হাতেরটা সেরা, কিন্তু তুমিও আজ হাতের জাদুতে এই বয়স্কের মন ভোলালে।আমি মানুষটা বড্ড কঠোর, কিন্তু যখন আমি প্রিয়জনদের মনে করি, তখন আমার মন হয়ে যায় পেঁজা মেঘের মতো নরম এবং আদ্র। তবে বাইরে আমি মানুষটা বড় স্বার্থপর।’
‘আমি সেদিনের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত।’
‘আমি জানি। রাগের বশে বলা কথা নিয়ে মানুষ পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়। তোমার পরিস্থিতিতে ওইধরনের আচরণ ভুল কিছু ছিল না। তবে একটা কথা মনে রেখো, নিজের দূর্বলতা কখনোই প্রকাশ করবে না। মানুষ সুযোগসন্ধানী।’
‘আমি সবসময় মনে রাখবো।’
‘আমার বকবক তোমার বিরক্তির কারণ হচ্ছে না তো?’
‘নিজের আপনজনদের কথায় বিরক্ত যারা হয়, তাদের কি বলে আমার জানা নেই।’

কোয়েলিয়া মাথা নিচু করে বললো। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে এখন আর কন্ঠে জড়তা আসছে না। আফসার শিকদার খাওয়ার থেকে কথা বেশি বলছেন। ততক্ষনে গরম ভাতগুলো ঠান্ডা হয়ে এসেছে, তবুও এ নিয়ে আপত্তি নেই। তিনি বলেন,
‘তোমার সাথে এসব বলি,কারণ তুমি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। কিন্তু নাজমার সাথে এসব নিয়ে কথা তুললে ওর অতীতকে টেনে আনা হয়। নিজের করা কাজের জন্য ও আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। অথচো আমার বোনটা বোঝেনা, মানুষের জীবন ভুলে ভরা। কতো শত ভুল নিয়ে আমরা বেঁচে আছি‌।’
‘বাবা, আপনি বোধহয় আর খেতে পারবেন না।’
‘ঠিক ধরেছো,আর খাবার ইচ্ছে নেই। অনেকদিন পর মনটা হালকা মনে হচ্ছে।মনের সবথেকে বড় বোঝা চেপে রাখা কথা।’
আফসার শিকদার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।যাওয়ার আগে বললেন,
‘এইসবকিছুর দায়িত্ব অনেক আগেই তোমার ঘাড়ে পড়েছে। অতীত মনে রেখে বর্তমানকে নষ্ট করা বোকার কাজ। তুমি বুদ্ধিমতী। আশা করছি আমাদের ওপর তোমার আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।’
কোয়েলিয়া নিরুত্তর বসে রইল।এই একটামাত্র পরিবার ও পেয়েছে,যাদের কাছে ওর গায়ের রং,ওর যোগ্যতা, বাবার বাড়ির অবস্থা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।যাদের কারণে নিজের ভেতরে থাকা আত্মমর্যাদা বোধ নড়েচড়ে উঠেছে।এই একটি জায়গায় ও পেয়েছে ভিন্ন চরিত্রের কিছু মানুষের দেখা।যারা বাহ্যিকভাবে স্বার্থপর কিন্তু অন্যকে প্রাপ্য সম্মান দিতে কুন্ঠা বোধ করে না।

*
কোয়েলিয়া গোসল সেরে এসে দেখে তখনও অনিক ঘুমুচ্ছে‌।গত তিনদিন সে নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে।ফিরছে মাথাব্যথা নিয়ে। বহুদিন পর হঠাৎ অভ্যাসের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার দরুন ওর মস্তিষ্ক সহজে নিতে পারছে না। ওকে অবশ্য কেউ চাপ দিতে চাচ্ছে না। তুহিন তো বলেই দিয়েছে, এতদিনের অভ্যাস ছাড়তে অনেকটা ভোগান্তিতে পড়তে হবে।তাই ওকে ওর মতো ছেড়ে দেওয়া ভালো। অনিক নিজেও এখন কর্মজীবনকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ঘড়িতে ইতিমধ্যেই নটা বেজে গেছে।এত বেলা হয়েছে, তবুও নিচে আফসার শিকদার ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ভদ্রলোক নিজে খুব সময় মেনে চলে, কিন্তু ছেলেকে ব্যবসামুখী করার জন্য কয়েকদিন দেরী হলে মেনে নিতে সমস্যা নেই।

কোয়েলিয়া অনিককে ডাকলো। অনিকের ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। কোয়েলিয়া বেশ কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়াশব্দ পায়না, তখন মাথায় ছোটবেলার সেই দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হলো।এই কাজটা সেলিমের থেকে শেখা।ও তোয়ালে জড়ানো চুলগুলো ছাড়লো। একগোছা চুল অনিকের নাসাগহ্বরে প্রবেশ করতেই অনিক বারকয়েক হাঁচি দিয়ে প্রচন্ড রাগ বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে। মুখের ওপর কোয়েলিয়ার হাসিমুখ দৃশ্যমান হতেই রাগ উড়ে গেল। এজন্যই মহামনীষীরা বলেছেন, নারীর নয়নে নয়ন জুড়লে তুমি শেষ। কোয়েলিয়া হেসে বলে,
‘আরো ঘুমান! উঠলেন কেন?’
অনিক কোয়েলিয়ার হাত ধরে টান দিতেই ও ওর ওপর এসে পড়ে। অনিক দুহাতে কোয়েলিয়াকে আঁকড়ে ধরলে, কোয়েলিয়া ওর নাক টেনে দিয়ে বলে,
‘নটা বাজে। তাড়াতাড়ি উঠুন,বাবা অপেক্ষা করছে।’
‘আমি বুঝি না, তোমাদের হাতটা আমার নাকের দিকেই কেন যায়?মা মেয়ে নাক টেনে লম্বা করে দিলো।’
‘আমাদের ইচ্ছা।’
কোয়েলিয়া ফের ওর নাকে হাত দিতে যাবে,তার আগে অনিক ওর কোমরে চিমটি কাটে। কোয়েলিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘এটা কি হলো?’
‘আমার ইচ্ছা। এখন সরো তো , অফিসে যেতে হবে আমাকে।’
‘আপনি আগে আমাকে ছাড়ুন।রোজ রোজ বাচ্চাদের মতো ঘুম ভাঙাতে হবে। আপনার থেকে সাফিয়া অনেক ভালো। সকাল সকাল আপনার বাবার সাথে জগিং করে এসেছে।’
‘কোথায় ও।’
‘ফুফুমণির কাছে।’
কোয়েলিয়া আরো একবার অনিককে তাড়া দিয়ে ওর জন্য কফি আনতে নিচে গেল।

অনিক তৈরি হচ্ছিল, সাফিয়া দরজায় টোকা মেরে বললো,
‘বাবা আসবো?’
অনিক চমকে উঠলো। দরজার কাছে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে দুগালে চুমু খেয়ে বললো,
‘বাবার কাছে আসতে অনুমতি লাগে না ,মা।’
‘তুমি জানো না কারো ঘরে যেতে হলে পারমিশন নিতে হয়!দাদুমণি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে।’
‘তাই নাকি! কিন্তু আমার কাছে আসতে অনুমতির প্রয়োজন নেই।’
‘এখন আমাকে নামাও বাবা। তুমি খুব অলস, দাদাভাই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।’
‘তোমার বাবা অলসের থেকেও বেশি অলস।’
কোয়েলিয়া শব্দ করে কফির মগ রাখলো।অনিক চুল ব্রাশ করে বললো,
‘টাইটা বেঁধে দেও তো।’
সাফিয়া বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছিল,অবাক হয়ে বললো,
‘বাবা, তুমি টাই পরতে জানো না?খুব ইজি।’
‘সাফিয়া, তোমার দাদাভাই তোমাকে ডাকছেন।’
‘কখন ডাকলো, আমি তো শুনিনি।’
‘তুমি যখন কথা বলছিলে তখন।’
‘মিথ্যে বলছো,বাবা। কেউ ডাকেনি।’
‘তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, দাদভাইয়ের থেকে শুনে এসো।’
সাফিয়া একরকম দৌড়ে বের হলো। কোয়েলিয়া এতক্ষনে বাবা মেয়ের কথা শুনছিলো। এবার বললো,
‘আপনি তো দেখছি, বাচ্চাদের সাথেও মিথ্যে বলেন।’
‘ওইটুকু বলতেই হয়। এখন টাইটা বাধো তো।’
কোয়েলিয়া টাই বেঁধে,ওর ঘড়ি এগিয়ে দিলো।গত কয়েকদিন এ দায়িত্ব ওর কাঁধে এসে পড়েছে।
‘শুনুন আজ আমরা বাইরে যাবো।’
‘আমরা বলতে।’
‘ইরা,সারাহ, আমি।’
‘কোথায়?’
‘ইরার জন্য কমিকস আর ফিকশন কিনবো।’
‘রাতে এসে নিয়ে যাবো।’
‘কিন্তু আমরা আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছি। এখন আপনার অনুমতি লাগবে।’
অনিক কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো,
‘আচ্ছা,যেও।’

*
সাফিয়ার জন্য অনেকগুলো কমিকস আর ইংরেজি ফিকশন কেনা হলো। এগুলো অবশ্য সারাহ পছন্দ করেছে। কোয়েলিয়ার বই নিয়ে তেমন ধারণা নেই।ও শুধু বই নেড়েচেড়ে দেখেছে। বারবার মনে পড়েছে সিজু রেণুর কথা।সিজুকে নিয়ে এভাবে ও লাইব্রেরীতে যেত, প্রতিমাসে অন্ততঃ তিনটে বই কিনে না দিলে মেয়েটা মুখ ভার করে বসে থাকতো। মোতালেব মেয়ের বইয়ের বহর দেখে, ছোটখাটো একটা বুকশেলফ কিনে এনেছিল।যদিও শেলফ পুরোপুরি ভর্তি হতে এখনো বাকি এবং সিজু অপেক্ষায় আছে সেই দিনটার। কোয়েলিয়ার মনের কথা সারাহ বুঝলো কিনা কে জানে! তবে সারাহ ওকে বলে,
‘সেজুতি তো বই পড়তে ভালোবাসে।ওর জন্য কয়েকটা নিয়ে নেও।’
কোয়েলিয়া অবাক হলো,সারাহ ওর বোনেদের কথা মাথায় রেখেছে!ও কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সারাহর দিকে তাকায়। তবে বইগুলো ও নিজের ফোনের একাউন্টে জমা টাকাগুলো দিয়ে কেনে।এই টাকাটা ও সিজুর পরবর্তী বই এবং রেণুর পোশাকের জন্য রেখেছিল।তবে তার আর সুযোগ হয়নি,তার আগেই হুট করে ওর বিয়েটা হলো‌।এই মুহূর্তে রেণুর জন্য পোশাক ও কিনতে পারবে না,তবে তিন ভাইবোনের জন্য অনেকগুলো বই কিনলো এবং লাইব্রেরীর অনলাইন সার্ভিসের সাহায্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। মনে মনে ও খুব আনন্দিত।সিজু যখন এই অপ্রত্যাশিত উপহার পাবে, নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে।অপ্রত্যাশিত ভালোবাসায় মানুষ সবথেকে বেশি খুশি হয়।

কেনাকাটা শেষ করতে প্রায় দুটো বাজলো। কোথাও বের হলে সময় রকেটের গতি ধারণ করে।আর শীতের সময় যেন সময় একটু বেশি দ্রুতই চলে।সারাহর জন্য ওদের রেস্তোরাঁয় যেতে হয়,যেজন্য বাড়ি ফিরতে অনেকটা দেরি হলো।
সাফিয়া সারাহর সাথে নাজমার কাছে গেল। কোয়েলিয়া ঘরে ঢুকে দেখল,ঘর অন্ধকার করে অনিক শুয়ে আছে।ও একটু অবাক হলো, অনিকের তাড়াতাড়ি ফিরে আসায়।অনিক কি অসুস্থ!ও বাতি জ্বালালো না, জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে, অনিকের কাছে গিয়ে বললো,
‘খারাপ লাগছে?’
‘না।’
‘মাথা টিপে দেব?’
‘না।’
‘ঘুমাবেন?’
‘হু।’
‘এই অসময়ে?’
‘বিরক্ত করো না।’
‘রেগে আছেন?’
‘ঘুম পাচ্ছে।’
কোয়েলিয়া কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে গেল। কিন্তু বারবার মাথায় ঘুরছিল,অনিক কি কোন কারণে ওর ওপর রেগে আছে! কারণটা কি হতে পারে!তবে এ লোককে ঘাঁটানো ঠিক হবে না। রাগের মাথায় কি বলে বসবে,তার ইয়াত্তা নেই।

*
আগামীকাল শুক্রবার হওয়ায় সরফরাজ মা’কে নিয়ে যাবে।তাই অফিস করে সোজা এখানে এসেছে।ড্রয়িং রুমে কোয়েলিয়ার সাথে দেখা হতেই বললো,
‘সবকিছু ঠিকঠাক।’
প্রতিত্তরে কোয়েলিয়া হেসে বলল,
‘ফুফুমণি আপনার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করুন।’
সরফরাজ কৃত্রিম বিস্ময়ের ভান করে বললো,
‘সে কি! আমি এসব বিয়ের ভেতরে নেই। জেনেশুনে বিপদে কেউ পড়ে!’
‘বিয়ে ব্যাপারটাকে বিপদ কেন মনে হয়!’
সরফরাজ উত্তর দিলো না। টেবিলের ওপর থেকে সাফিয়ার রুবিকস কিউবটা নিলে মেলানোর চেষ্টা করলো। তারপর বললো,
‘বিপদ যে কিসে আপনি বুঝবেন না। আপাতত কিছুদিন একা থাকতে চাই।সামনের মাসে নেপাল ঘুরে এসে ভাববো বিয়ে করা ঠিক হবে কিনা।’
‘বয়স তো পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে।’
‘ভুল বললেন,বয়স বাড়ে না,কমে।প্রত্যেকের আয়ু নির্দিষ্ট, সেখান থেকে একটু একটু করে কমছে‌।’
‘আপনার যুক্তিগুলো চমৎকার।’
সরফরাজ হাসে। মেয়েটার সাথে কথা বলতে ওর এতো ভালো লাগে কেন,ঠিক বুঝতে পারেনা। তবে নিজেকে ও সামলায়, যে ওর না,তার প্রতি ভালোলাগা আসা অনুচিত।ও সিঁড়ির দিকে একবার তাকিয়ে কোয়েলিয়ার দিকে তাকায়, অপেক্ষাকৃত নিচুস্বরে বলে,
‘আপনার জন্য শুভকামনা।’
কোয়েলিয়া বিস্মিত হলো। সরফরাজের কথায় সতর্কবার্তা।ও বললো,
‘হঠাৎ!’
‘পেছনে তাকান।’
কোয়েলিয়া পেছন ফিরে তাকালে, সিঁড়িতে অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে ওদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর। কোয়েলিয়া বুঝলো অনিক রেগে আছে।ও হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘কিছু লাগবে?’
‘না।’
অনিক আর দাঁড়ায় না।সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়।

কোয়েলিয়া তখনই যাচ্ছিল, কিন্তু নাজমার জন্য ওকে থামতে হলো। নাজমা ওকে বললো,
‘সাফিয়াকে নিয়ে যাচ্ছি। অনিকের সম্মতি আছে,তবে তোমার আপত্তি থাকলে ওকে নেব না।’
কোয়েলিয়া বিব্রত হলো।এটা কোন ধরনের প্রহসন হতে পারে। হঠাৎ আজ ওর মতামতের এমন গুরুত্ব প্রকাশ পাবার কোন মানে খুঁজে পেল না। নাজমা বলে,
‘বিব্রত হবার প্রয়োজন নেই। সম্পর্কে তুমি সাফিয়ার আরেকটি মা।তাই তোমার অনুমতির প্রয়োজন অবশ্যই আছে।’
নাজমা উত্তরের জন্য কোয়েলিয়ার দিকে তাকায়।ও ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে।
‘ও যাতে খুশি থাকে, তাতে আমার আপত্তি নেই।’
সাফিয়া কে নিয়ে ওরা চলে গেল।যাওয়ার আগে সাফিয়া ওর কোলে চেপে দুগালে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়।ও চলে যাওয়ার পর কোয়েলিয়ার খারাপ লাগে।এই বাচ্চাটা কিভাবে যেন ওর জীবনের সাথে জুড়ে গেছে।ওর কাছে বাড়িটাকে কেমন শূন্য শূন্য লাগলো।ও জানে দুদিন পরেই সাফিয়া ফিরবে,অনিক মেয়েকে বেশিদিন দূরে রাখতে নারাজ। তবুও মনজুড়ে কালো মেঘের বিস্তার হলো।গাড়ি বেরিয়ে গেলেও,ও ওভাবেই কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

হঠাৎ অনিকের কথা মাথায় আসতে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে ও ওপরে যায়। লোকটা ওর ওপর রাগ করে রয়েছে। অনিকের রাগ সমন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।তার ওপর সবেমাত্র বদভ্যাসগুলো ত্যাগের চেষ্টায় আছে, এরমধ্যে যদি আবার উল্টো গো ধরে বসে!ও দ্রুত পায়ে কক্ষের দিকে গেল।অনিক ঘরে ছিল না।ও ছাদের দিকে গেল।
অনিক এককোণে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে।কোয়েলিয়ার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও ঘুরে তাকায় না। কোয়েলিয়া ধীর পায়ে ওর পাশে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
‘আপনি কি রেগে আছেন?’
‘না।’
অনিকের ভাবভঙ্গি অতিরিক্ত শান্ত।ঝড় ছাড়ার আগে চারপাশ যেমন ঠান্ডা থাকে। কোয়েলিয়া মনে মনে প্রমাদ গোনে।অনিক প্রচন্ড রেগে আছে বুঝলেও ঠিক কোন কারণে রেগে আছে,এটা ধরতে পারলো না। তবে সরফরাজকে দেখে যদি রাগ করে তবে তা একেবারে ভিত্তিহীন। কেননা ও নিজেই অনিককে বুঝিয়েছে, সরফরাজ তাকে মোটেও সেভাবে দেখে না। কিন্তু তবুও লোকটাকে কে বোঝাবে? এখন ভালোয় ভালোয় রাগটা পড়ে গেলে হয়।

কোয়েলিয়া ওর পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও অনিক তা ভ্রুক্ষেপ করে না।ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘আপনি কি কারণে রেগে আছেন,বললে ভালো হতো।’
‘আমি রাগ করিনি।’
‘মিথ্যা বলবেন না।’
‘তোমার সাথে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ! বিরক্ত করো না। আমাকে একা থাকতে দেও।’
‘এভাবে বলছেন কেন?’
অনিক ধমকে ওঠে,
‘যেতে বললাম না।’
কোয়েলিয়ার দুচোখ ছলছল করে ওঠে।ও আর দাঁড়ায় না।দ্রুতপায়ে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে কয়েক পা এগোতেই শাড়িতে বেঁধে পড়ে যায়।অনিক সিগারেট ফেলে ওর দিকে এগিয়ে এসে একহাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কোয়েলিয়া ওর হাত ধরতে নারাজ।একা একা ওঠার চেষ্টা করতে ফের পড়ে যাবার উপক্রম হতেই অনিক ধরে ফেলে।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
‘দেখে শুনে চলতে পারো না।এতো ঠান্ডার ভেতরে একটা শাল জড়িয়ে ছাদে এসেছো কেন?’
কোয়েলিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
‘আমার ইচ্ছা।’
অনিক হাসে। এতক্ষণ ওর ভেতরে যে রাগ অভিমান ছিল,তার কিয়দংশ বোধহয় কোয়েলিয়ার ভেতরে স্থানান্তরিত হয়েছে।ও বললো,
‘অভিমান তো আমার করার কথা। তুমি কেন দেখাচ্ছ?’
‘কি কারণে আমার ওপর অভিমান দেখাবেন?’
‘ফিরতে দেরি করেছিলে কেন?’
কোয়েলিয়া অবাক হয়ে বললো,
‘এইটুকু কারণে কেউ রাগ করে!’
‘তুমি বুঝবে না।’
‘কিন্তু আমি বুঝতে চাই?’

অনিক হাসে। এমন গম্ভীর মুখে মাঝেমাঝে হাসির ছটা দেখতে কোয়েলিয়ার ভালো লাগে।ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।অনিক সেটা খেয়াল করে বলে,
‘ভরসন্ধ্যায় এভাবে তাকাতে নেই।’
কোয়েলিয়া লজ্জা পেয়ে চোখ নামায়। অনিকের রাগ পড়ে গেছে।কোয়েলিয়াকে টেনে বুকে নেয়। একহাতে কোয়েলিয়াকে আঁকড়ে ধরে,অন্যহাতে কোয়েলিয়ার বাম হাতটা চেপে ধরে। উষ্ণ স্পর্শে কোয়েলিয়া পুলকে অনিকের বুকে মাথা রেখে হৃৎস্পন্দনের ছন্দ শ্রবণে মত্ত হয়।
চারপাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কলোনির রাস্তা এখন ব্যস্ত।সবাই অফিস থেকে ঘরে ফিরছে। কিন্তু সেদিকে এদের খেয়াল নেই। অনিক মোহিতের ন্যায় প্রেয়সীর পানে চেয়ে আছে।এই সন্ধ্যা,পাশে দাঁড়ানো মানুষটা যে ওর জীবনে এসে এমন পরিবর্তনের ঝড় তুলে দেবে,তা কি কখনো ভেবেছিল? নিজের জীবনকে তো একরকম রুটিনে ফেলে দিয়েছিল। তবুও সে নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করলো এই মেয়েটি।ও জানে না, কতদিনে নিজের পরিবর্তন হবে।তবে ও খুব করে চায়,এই মেয়েটাকে এভাবে বুকে নিয়ে বাঁচতে।ও আবেশ ছড়ানো গলায় বলে,
‘আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
‘বিশ্বাস করে নেব।’
‘তোমার ইচ্ছে।’

কোয়েলিয়া আঁকড়ে ধরা হাতের দিকে চেয়ে বললো,
‘দেখুন আমাদের দুজনের গায়ের রং দুরকমের। সন্ধ্যা আমাকে ঢেকে দেবার চেষ্টা করলেও, আপনাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।’
অনিক কোয়েলিয়ার মনের খেদ বোঝে।অতীতে কালো মেয়েদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ঘটনা কমবেশি চোখে পড়েছে। কোয়েলিয়ার অতীতে এমন কিছু থাকাটা স্বাভাবিক, বরং না থাকাটাই বেমানান। কিন্তু এই মেয়েকে ও কিভাবে বোঝায়, ওর যে সারাক্ষণ প্রেয়সীর পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে। বিশেষ করে ওই চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বারংবার খেই হারিয়ে ফেলে। তবুও ও মৃদুস্বরে বলে,
‘স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে দুজনকে দুরকম না হলে মানায় না। তুমি দেখতে কালো,তাই আমি সুন্দর। আঁধার না থাকলে যেমন আলোর গুরুত্ব নেই। তেমনি শ্যামা ছাড়া গৌর মূল্যহীন।পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ সুন্দর। তুমি অন্যের চোখে খারাপ দেখতে হলেও আমার চোখে অপরূপা।’
‘হয়েছে মশাই।আর সাহিত্যের বুলি আওড়াতে হবে না।’
‘লজ্জা পাচ্ছো বুঝি।’
‘তাতেই বা দোষ কি!’
‘দোষের কিছু নেই। লজ্জা নারীর সৌন্দর্য বাড়ায়।’
‘আজ আপনার কথার বাঁধ ভেঙেছে মনে হচ্ছে।’
‘তোমার ভাগ্য মন্দ নীরস লোককে পেয়েছ।’
‘তবুও আমি সুখী।’
‘সত্যি!’
কোয়েলিয়া উত্তর হিসেবে অনিকের বুকে মুখ গোঁজে।অনিক পরম আবেশে আরও শক্ত করে কোয়েলিয়াকে আঁকড়ে ধরে। ততক্ষনে চারপাশে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।এই সন্ধ্যার প্রকৃতি বিষাদের ন্যায় হলেও,এই মুহূর্তে ওরা সুখী।অনিক কোয়েলিয়ার কপালে চুম্বন করে ফিসফিস করে বলে,
‘এই ম্লান সন্ধ্যাকে সাক্ষী রেখে তোমার হাতটা ধরলাম। কথা দিলাম আজীবন আগলে রাখবো।’

(শেষ)