#সূচনা_পর্ব
#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
এই মুহুর্তে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঠা’স ঠা’স করে দুটো চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।ইউ নো, তুমি আমার বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছো।এখন টু’স করে কল দিয়ে ঠু’স করে নিজের অনুভূতি’টা জানাও।ওয়েট করছি।
স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করা বার্তাটা পড়তেই মাথা ঘুরে গেল পাভেল শিকদারের।হাত-পায়ে যেন ঘাম ছুটে যাচ্ছে।সামনের দিকে তাকিয়ে অনবরত বক্তৃতা দেওয়া ফোনের মালিককে একবার দেখে নিলো। তারপর আরেকটু কাছে ঘেঁষে নিচু স্বরে বললো-
ভাই,একদিনে দু-দুটো গুড নিউজ।আমি তো হার্ট ফেইল করবো।
বলেই ফোনটা পরশ শিকদারের সামনে ধরলো।স্ক্রিনের বার্তাটা পড়তেই হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পরশ।বারকয়েক সেক্রেটারি রুপি নিজের ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জনসমাবেশের দিকে তাকালো।এরইমধ্যে পুনরায় একই নাম্বার থেকে মেসেজ আসলো-
এই যে মশাই,আপনি যদি এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবথেকে ব্যাস্ততম লোক হয়েও থাকেন, তাতেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না।এক্ষুনি ফোন দিন নইলে কিন্তু আমার বাচ্চাকে কোলে নিতে দিব না।
হাতের মাইক্রোফন’টা মুখের সামনে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-
এক্সকিউজ মি!
তারপর পাশেই অবস্থানরত অনুষ্ঠানের আহবায়ক সামিউল সাফি’র হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে ছোট্ট আওয়াজে বললো-
তোমরা কন্টিনিউ করো।
পাভেলের হাত থেকে নিজের পারসোনাল ফোন’টা নিয়ে ত্রস্ত পায়ে স্টেইজ থেকে নেমে যায় পরশ শিকদার।কৌতূহল দমাতে না পেরে পাভেল ও পিছু ছোটে পরশের।
স্টেইজের ডানদিকে প্রায় বত্রিশ হাত দুরেই ছোট্ট একটা নিমগাছ।আপাতত ওই জনশূন্য জায়গাটায় গিয়ে দাড়ালো পরশ।ইতোমধ্যে পাভেল ও ছুটে এসেছে।হাত পাচেক দূরে তিনজন বডিগার্ড আসতেই পরশ হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বললো।ব্যাস সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো তারা।অনুষ্ঠানে এখনো বলিষ্ঠ ভাবে বক্তৃতা দিচ্ছে সামিউল সাফি।
হাতের ফোনের লক খুলে কিছুক্ষণ নাম্বারটার দিকে তাকালো পরশ।মস্তিষ্কে বারকয়েক চাপ দেওয়ার পরেও এই নাম্বার’টা অচেনা লাগছে তার।পারসোনাল ফোন হওয়ার দরুন মাত্র জন চারে এই নাম্বার জানে।সেখানে হঠাৎ এরকম মেসেজ আসার প্রশ্নই ওঠে না।তাহলে কি রং নাম্বার।ভ্রু কুচকে এসব ভাবতেই পাভেলের দিকে তাকালো পরশ। তিন বছরের ছোট্ট ভাই’টা মুখটাকে বেশ সিরিয়াস করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।এটা মাঠ না হয়ে বাড়ি হলে এতোক্ষণে বিশাল কেলেংকারি বাধিয়ে ফেলতো পাভেল।আর যাই হোক,পাভেলের সামনেই ব্যাপার’টা ক্লিয়ার করতে হবে ভেবেই অচেনা নাম্বার’টিতে কল করলো পরশ।
মুহুর্তে’ই বি’ক’ট শব্দে বিস্ফোরিত হলো স্টেইজ।সেকেন্ডের মধ্যেই আনন্দ উৎসবের স্থান টা পরিণত হলো ভয়াবহ কোনো রণক্ষেত্রে।হাজার-হাজার মানুষ প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে।চারদিকে ধোয়া-বালি, লোকজনের ছোটাছুটি দেখে কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলো পরশ।এরইমধ্যে শ-খানেক গাড়িতে হাজির হলো ডিবি পুলিশ,ফায়ার সার্ভিস,বম ডিটেক্টর ফোর্স,এবং আরো নিরাপত্তা বাহিনীর দল।সাথে রয়েছে অগণিত এম্বুলেন্স।
পরশ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেইজের সামনে।যে লেকচার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে বক্তৃতা দিচ্ছিলো তারই নিচে লুকানো ছিলো ছোট্ট টাইম বোমাটি।অত্যন্ত ছোট্ট হলেও বিস্ফোরক যন্ত্র’টি ভীষণ বাজে ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে স্টেইজ এবং তার আশে-পাশের মানুষ মিলিয়ে প্রায় সতেরো জনকে আহত করেছে।সব থেকে বাজে-ভাবে আহত হয়েছে অনর্গল বলিষ্ঠ কন্ঠে বক্তৃতা দিতে থাকা অনুষ্ঠানের আহবায়ক সামিউল সামি।ইতোমধ্যে সবাইকে এম্বুলেন্সে করে স্থানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মীরা নানাভাবে জায়গা গুলোতে ইনভেস্টিগেশন করে জানিয়েছেন আসল সত্য।এটা তারা না বললেও সাধারণ চুনোপুটিরাও বুজবে এই আক্রমণের কারন।দীর্ঘ অনেক মাস ধরে নানা মিছিল-মিটিং এর পরে আজকের সাংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এমপি হয়েছেন পরশ শিকদার।কৈশোর থেকেই বলিষ্ঠ ভাষন,দুঃসাহস,এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারনে রাজনীতির প্রতি এক আমূল ঝোক তার।সেই ঝোক’কে কেন্দ্র করেই পড়ালেখা শেষ হওয়ার পরে আর চাকরিতে মনোনিবেশ করে নি সে।যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে।ফলস্বরূপ, আজ আঠাশ বছরের এই টগবগে যুবক জনসাধনের বিপুল ভোটে জয়লাভ করে হয়েছেন এমপি।
ভোটে জয়লাভ করার পরেই দলের সবাই আনন্দ-উৎসব হিসেবে মাঝারি ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো নির্বাচন মাঠে।সেই আনন্দ কে ধূলিসাৎ করার জন্যই হয়তো বিরোধী পক্ষ এই নিকৃষ্ট কাজটি করেছে।তবে সরাসরি শক্ত কোনো প্রমাণ ছাড়া কারো উপর আঙুল তোলা উচিত হবে না ভেবেই দলের সমস্ত সদস্যদের চুপ থাকার হুকুম দিয়েছে পরশ। যুবলীগ-ছাত্রলীগ সহ অজস্র টগবগে যুবক নিজেদের কে সামলে রাখছে শুধুমাত্র পরশের কথায়।নইলে এতোক্ষণে বিরোধী দলের নেতা সোভাম সরদারের লোকের উপর ঝাপিয়ে পড়তো মর্মান্তিক ভাবে।
সারাদিন হাসপাতাল,প্রেস-কনফারেন্স,মিডিয়া,অফিস এসবে দৌড়া -দৌড়ি করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে পরশ।বাড়ি থেকে লাগাতার কল আসছে একের পর এক।সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে দলের সমস্ত লোকদের বুঝিয়ে শান্ত করে বাড়ি ফিরলো পরশ।এই সমস্ত সময়’টা ভাইকে এক চুল ও ছাড়ে নি পাভেল। ছায়ার মতো সর্বক্ষণ পাশে পড়ে রয়েছে।
রাত এগারোটা,গোসল সেরে ডাইনিং এ বসে সবেমাত্র ভাতের লোকমা মুখে তুলেছে পরশ।সারাদিনের ক্লান্তি,ঝামেলা,ছোটাছুটি তে পাভেল একরকম ভুলেই গেছিলো ফোনের মেসেজের কথা।মাথায় আসতেই খাওয়া ছেড়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো-
ভাই,ভাবিকে তো কংগ্রাচুলেশন করা হয়নি।ফোন দিয়েছিলি তার পরে।এত বড় একটা সু-খবর জানালো তোকে।
স্তব্ধ,হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পাভেলের মুখের দিকে।যতই সে পরশকে ভয় পাক,কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকলেই একে একে যত রকম কথা বলে পরিবারের থেকে বকা খাওয়ানো যায় সে ব্যাপারে মশগুল থাকে সে।বাড়িতে এলে যেন চিরশত্রু হয়ে যায় পরশ।ডাইনিং টেবিলে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ নিরব হয়ে তাকিয়ে আছে পাভেলের মুখের দিকে। ভাতে তরকারি দিতে দিতে ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়াশা শিকদার শুধালেন-
কোন ভাবি?কি সু-খবর?
পাভেল যেন হাতে চাঁদ পেয়ে বসলো।সে তো চেয়েছিলোই এটা। যাতে কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করুক আর সে গড়গড় করে সারাদিনের পেটে পচানো কথাটা উগড়ে দিতে পারে।মুরগীর লেগ-পিসে কামড় দিয়ে বেশ আয়েশ করে তাকালো পরশের দিকে।ভাই তার শান্ত ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে।হয়তো সে বুজতে পেরেই গেছে কথাটা কোনোভাবে তার একার মধ্যে থাকবে না।
আসলে মা হয়েছে কি জানো?আমিও বা কি বলি,তুমি কি ভাবে জানবা?চব্বিশ ঘন্টা ওর সাথে আমি থাকি,সেই আমিই জানি না। আর তো তুমি?বাদ দাও।ঘটনা টা হচ্ছে আজকে একই দিনে দু-দুটো গুড নিউজ পেয়ে বেশ স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম আমি।ঝামেলা টা না বাধলে ঘটনা টা আরো আগেই জানতে পারতে।
ধমক মেরে বসলেন মহীউদ্দীন শিকদার।খেতে খেতে বললেন-
তোমাকে এতো সাজিয়ে উপস্থাপন করতে কেউ তো বলেনি।ঘটনা টা কি সেটা বলো?
পাভেল-আহা আব্বু,সুন্দর কথা তো সাজিয়েই বলতে হয়।তোমার ছেলে সুন্দর ভাবে আমাদের থেকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে।আজ আবার জানতে পারলাম তাদের বেবিও হবে।আহা সেকি প্রেম?মেসেজে জানিয়েছে কথাটা তাতেই আমি হতভম্ব। বিশ্বাস কর আব্বু,মেসেজ টা তূমি দেখলেই বুজতে পারতে কি প্রেম ওদের মাঝে।মোবাইল উপচে প্রেম গুলো গড়িয়ে পড়ছিলো। আহাহাহাহা।
স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো শিকদার মঞ্জিল।পাভেল নিত্যনতুন নানা কথা পরশের নামে বলেই থাকে সেই নিয়ে আজকে তেমন ভাবে কেউ কথাগুলো শোনে নি।কিন্তু তাই বলে সরাসরি বিয়ের কথা। পাভেল আর যাই বলুক,মিথ্যে কথা যে বলবে না এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত।
মাথায় হাত দিয়ে পাশের চেয়ারে বসে চুপচাপ পরশের দিকে তাকিয়ে আছে পিয়াশা। ছেলের নিরবতা পেয়ে ধমকে বললেন-
এই কথা শোনার জন্য আল্লাহ আমাকে বাচিয়ে রাখছিলো এতোদিন।তোমার মেয়ে পছন্দ,তাকে বিয়ে করবা,সংসার করবা আমাদের বলতেই পারতা।আমরা কি বাধা দিতাম?কি দরকার ছিলো এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করার?
পরশ বুক ভরে দম নিলো। তার খাওয়া শেষ। পাভেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললো-
সে রকম কিছু না মা।আজকাল এরকম রঙ নাম্বারে অহরহ মেসেজ আসতেই পারে। আমি ওই নাম্বার টা চিনি না আর নাতো ওই মহিলাকে।আর আমার ফোন তো ওর কাছেই থাকে,ও হয়তো চিনে থাকবে।
দুম করে উঠে বসলো পাভেল।সবার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো-
তুই কি করে জানিস ওই নাম্বার টা কোনো মহিলার?পুরুষের ও তো হতে পারে।আগে পিছে কথা না বলে শুধু মেসেজ দেখেই কিভাবে বললি ওটা মেয়ে মানুষ?পাগল পাইছিস আমাদের?
পুনরায় পাভেলের কথায় সায় দিলো শিকদারের মঞ্জিলের সবাই। পরশ দাতে দাত চেপে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো।পাভেলের পাশে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো-
তুই রুমে আয়?তোকে আমি প্রেগন্যান্ট বানাচ্ছি।
বলে ফোন নিয়ে হনহন করে উপরে চলে গেল পরশ।জিহবায় কামড় দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পাভেল।
ইশ,ওই মেসেজে তো বলেছিল প্রেগন্যান্ট। তারমানে ওটা মেয়ে’ই ছিলো।(বিরবির করে বললো)
পিয়াশা ছোট ছেলের পাশে এসে বসলেন।ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-
ও বাবা,সত্যিই কি পরশ বিয়ে করছে।নাকি তুই আবার মজা করছিস।
পাভেল-ঊফফফ মা,আরে তেমন কিছু না।আমি আগে নিযে ইনভেস্টিগেশন করি।পরে তোমাদের জানাচ্ছি।
নিজের রুমে যেতেই পরশ ফোন হাতে নিয়ে বসলো।যাই হোক,আজ ওই নাম্বার থেকে এমন উদ্ভট মেসেজ না আসলে বমে দগ্ধ হতো সে।কে এই অপরিচিতা?আদোও কি সে অপরিচিত না কি চেনা কেউ।তাকে বাচানোর জন্যই কি কৌশলে এমন মেসেজ পাঠিয়েছে।যেই হোক না কেন এই লোকের ব্যাপারে বেশ খবর নিতে হবে পরশের। সুচ হয়ে ঢুকে যেন পরবর্তীতে ফাল হয়ে না বের হয় সে রাজনীতির প্রতিটা কদমে বেশ পরিক্ষা করে ফেলতে হয় পা।নইলে এখানে টেকা বেশ মুশকিল। ফোন হাতে নিয়ে কল করলো অপর প্রান্তের অচেনা নাম্বারে।
“আপনার হা’গু আপনার সম্পদ। দয়া করে উহা অন্যকে প্রদর্শনের জন্য রাখিবেন না।নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করবেন।”
মাঝারি আকারের সাইনবোর্ডে সাইনপেন দিয়ে বড় বড় অক্ষরে কথাগুলো লিখে দম নিল স্পর্শীয়া।এরই মধ্যে পিছন থেকে রিংটোন বাজা অবস্থায় ফোন হাতে ছুটে এলো অনন্দা।
এই স্পর্শী,তোর ফোন।
#চলবে?