#শহর_জুড়ে_আলোর_মেলা
কলমে :লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৩
ভালো খারাপের মিশ্রণে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। একটা পরিবারের প্রতিটা সদস্যের চিন্তা ভাবনা একরকম হবে এমনটা না। অনেকাংশে মিল থাকে তবে বেশিরভাগ অমিল পরিলক্ষিত হয়। ইকবাল মাহমুদের বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই উনার বাকী ভাইবোনদের ছোট থেকে লালনপালন করে মানুষ করেছেন। সেই হিসেবে বড় ভাই ভাবির সম্মান শ্রাবণদের পরিবারে সবচেয়ে বেশি। মানুষদুটো নিজেদের চিন্তা না করে ভাইবোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছে। উনারা গ্রামে থাকেন। গ্রামে জমিজমা আছে সেখানে চাষাবাদ হয়। পুকুর ভর্তি মাছ আছে। খামারে গৃহ পালিত পশুপাখি আছে সবটা দেখাশোনা করেন। উনাদের কোনো সন্তান নেই। দেবরের ছেলেমেয়েদের নিজের ভেবে ভীষণ আদর আরেন। বাচ্চাগুলোও তেমন। বড়মা বলতে অজ্ঞান তবে উনি বেশ কড়া ধাচের মহিলা। সামাজিক অনাচার বা মেয়েদের অধিক স্বাধীনতা সেসব কম পছন্দ করেন।বাড়ির বউদের নিয়ে উনার যতটা মাথাব্যথা ততটা বাড়ির মেয়েদের নিয়ে না। শাশুড়ির সঙ্গে উনার সম্পর্ক ঠিক ততটা ভালো ছিল না। দুজনের চিন্তা ভাবনা বিস্তার তফাৎ ছিল।ভদ্রমহিলা মাঝেমাঝে শহরে আসেন তবে স্থায়ী না। এক বিশেষ প্রয়োজনে উনি শহরে এসেছে। আলোর বিষয়ে জানার পর থেকে উনার মুখ অন্ধকার হয়ে আছে। ইশাকে কোলে নিয়ে চুপচাপ চাচি শাশুড়ির সামনে বসে আছে আলো। শ্রাবণ থানা থেকে ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ফিরবে কখন জানা নেই। আলোর প্রচুর ভয় লাগছে। ভদ্রমহিলা ওকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে। পাশে লিজা বকবক করে পরিস্থিতি ঘেটে দেবার চেষ্টায় আছে। আলো মাথায় আসে না লীজা ওকে অপছন্দ কেনো করে? হঠাৎ আওয়াজ আসলো,
> বাড়ির বউ হচ্ছে বাড়ির সম্মান। সেই সম্মান যদি রাস্তা ঘাটে নিলামে উঠে তখন কেমন লাগে? বউয়েরা দামি আসবাবপত্রের ন্যায় ঘরের শোভা। সুন্দর করে সেজেগুজে বরের মন রক্ষা করা করবে। বাড়ির কাজকর্ম, বাচ্চা পালন করা তাদের দায়িত্ব। অথচ তুমি পর পুরুষের বাড়িতে গিয়ে জানিনা কি করে এসেছো। বাড়ির মান সম্মান কিছু আর রাখলে না। আমার রতনের বউটাকে দেখে কিছু পারলে লিখে নিও। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বিয়ে হয়েছিল। বেচারী পড়াশোনা বাদ দিয়ে সংসার করছে। দুখানা বাচ্চার মা। বাছা সারাদিন পরিশ্রম করে তবুও মুখে কোনো কটু কথা নেই। হাসিমুখে সবটা মেনে চলে। একাতো আসোনি। বোনের বাচ্চা কি নিজের বাচ্চা আল্লাহ মালুম জানিনা ওই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। বাচ্চাটাকে নিয়ে এখানে উঠেছো কৃতজ্ঞতার খাতিরে হলেও ভদ্র হয়ে থাকতে পারতে। ইকবাল কোন শর্তে তোমাকে এই বাড়িতে এনেছে সেটাও পরিস্কার না। ওকে কতবার বললাম আমার পছন্দের মেয়ে আছে আমার শ্রাবণের সঙ্গে মানাবে। ছেলে আমার এতোটা কষ্ট পেয়ে পাষাণে পরিণত হয়েছে। আমি মা হয়ে জানিতো আমার ছেলের মনে কি চলছে। এই মেয়েকে মেনে নিয়ে কিভাবে সংসার করবে? এর না আছে ভদ্রতা আর না আছে কোনো গুণ। থাকার মধ্যে আছে একটু রূপ তাও আহামরি কিছু না।
ভদ্রমহিলা শুরু করলেন কিন্তু থামার লক্ষণ নেই। আলো থম মেরে বসে আছে। ভেতর থেকে কান্না ধলা পাকিয়ে উগ্রে আসার মতো অবস্থা। গলা চেপে ধরেছে। লিজা মিটিমিটি হাসছে। লিমা বেগম ছাদে আছেন। আলো নিজেকে শক্ত করে বলল,
> বড়মা আমি ভুল কিছু করিনি। আপনার ছেলে সবটা জানেন। আর আমার অনেকগুলো বন্ধু বান্ধবী নেই যে অযথা বাইরে ঘুরে আপনাদের সম্মান নষ্ট করি।আমি কলেজের নাম করে রেস্টুরেন্ট বা পার্কে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করিনা। বিশ্বাস না হলে লিজার থেকে জিঞ্জাসা করেন। ওতো পার্ক আর রেস্টুরেন্টে রেগুলার যায়।
আলো কথাটা বলে লিজার দিকে চাইলো। লিজা মুখটা এবার দেখার মতো হলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো,
> আম্মু বিশ্বাস করো আমি কলেজের বাইরে কোথাও যায়না। আলো মিথ্যা বলছে। তুমি দেখলে না ভাইয়ার চ্যানেলে কিসব বলছিলো? ও নিজে এসব করে আমাকে তোমার থেকে বকা শোনাতে চাইছে।
আলো অবাক হলো লিজার মিথ্যা শুনে। এই মেয়ে চাইছে কি? ভদ্রমহিলা ধমক দিলেন,
> নাম ধরছো কেনো? ভাবি বলতে পারোনা? তোমাকে এখানে পাঠানো উচিত হয়নি। আমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলবো। আর আলো নিজের রুমে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আমরা সঙ্গে তোমরা গ্রামে যাচ্ছো। পড়াশোনা ছেড়ে এবার সংসারে মনোযোগ দাও। অনেক উড়েছো আর না। আমাদের সম্মান তোমার হাতে।
আলো মাথা নাড়িয়ে উঠে আসলো। কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কখনও পরিবর্তন হয়না। এদের সঙ্গে অযথা তর্ক করা বেমানান। তাই নিজের কষ্ট গুলো চেপে মেয়েটাকে বুকের সঙ্গে আগলে নিলো। মা মরা মেয়েটাকে সুযোগ পেলে অপমান করতে কেউ ছাড়েনা। নিজের চরিত্র নিয়ে মানুষ হাজার কথা বলুক তাইবলে ইশাকে নিয়ে কেনো বলবে? ইশা ফুলের মতোই পবিত্র। ওর শরীরে বিন্দু পরিমাণ পাপ নেই।
******
শহর থেকে গ্রামে আসতে চার ঘন্টার কাছাকাছি সময় লাগলো। দুঃখের বিষয় অনেক অনুরোধ করেও শ্রাবণকে আনা যায়নি। তবে তুলির মেডিকেল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ছিল বিধায় ওদের সঙ্গে জয়েন হয়েছে। ইশার তুলিকে খুব পছন্দ করে। আসার পর থেকে ওর কাছেই আছে।মেয়েটার বয়স সাত মাস চলছে। শ্রাবণদের গ্রামের বাড়িটা অনেক বড় এরিয়া নিয়ে। চারভাইয়ের ছেলেমেয়ে আর পরিবারের সদস্যের জন্য এই বিশাল বাড়িটা তৈরী করেছে মাত্র পনেরো বছর আছে। পুরাতন বাড়িটাতে এখন আর তেমন কেউ থাকে না। কাজের মানুষেরা কয়েকজন মাঝেমাঝে থাকে। আলো নিজের কক্ষে এসে চেঞ্জ করে নিয়েছে। এখানে শাড়ি পরে থাকতে হবে বিধায় আনাড়ি হাতে এলোমেলো শাড়িতে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিলো। দেখতে মোটামুটি খারাপ লাগছে না। এর মধ্যে ডাক পড়লো দরজা থেকে,
> নতুন বউ আসবো?
নতুন মানুষের কণ্ঠ পেয়ে আলো চুপসে গেলো। দরজায় ঘোমটা টেনে একটা বউ দাঁড়িয়ে আছে। আলো ব্যস্ত হয়ে বলল,
> জ্বী আসুন। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। যদি বলে দিতেন।
মেয়েটা মলিন হাসলো। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,
> আমি রাকা । তোমার বরের চাচাতো ভাই রতনের বউ। আমাকে বুবু বলতে পারো কেমন? বড় মা ডাকছে। চলো নিচে যেতে হবে। সাবধানে চলাফেরা করবে কেমন? আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। শুনেছি তোমার ভীষণ সাহস।
আলো বিব্রত বোধ করছে। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে বাড়িতে এসে উঠেছে। কথা মেপে বলতে হবে কেনো? নতুন বউ আসলে সকলে দৌঁড়ে আসে অথচ কেউ ওকে পাত্তা দিলোনা। আলো বাইরে যেতে চাইলো কিন্তু রাকা ওর পা হতে মাথা অবধি নজর ঘুরিয়ে বলল,
> এমা তুমি এভাবে শাড়ি পরেছো কেনো? এলোমেলো হয়ে আছে। তাছাড়া নতুন বউকে দেখতে সকলে অপেক্ষা করছে। একটু সাজতে হবে তো?
আলোর অনুমতির তোয়াক্কা না করে ওকে সাজিয়ে দেওয়া হলো। কয়েকটি ভারি অলঙ্কার আর শাড়িটা নতুন করে গুছিয়ে দিলো। আলো যেনো কাঠের পুতুল। রাকার নির্দেশ অনুযায়ী ওর সঙ্গে নিচে চলে আসলো। বেশ কিছু মহিলাদের সামনে ওকে বসানো হলো। সম্মুখে কেউ খারাপ কিছু বললো না তবে মাঝখানের মহিলাটা বলে উঠলো,
> আগে শ্রাবণ বাবা গ্রামে আসলে যাওয়ার নাম নিতো না। কি থেকে কি হয়ে গেলো। অথচ চার বছর ওখানে পা রাখেনা। প্রয়োজন হলে রাস্তা অবধি আসে। ছেলেটার সঙ্গে খারাপই হয়েছে। যাইহোক কপালের লিখন কিভাবে খণ্ডন করবে?
আলোর কান খাড়া হয়ে উঠলো। কি হয়েছিল শ্রাবণের সঙ্গে? আলোর মনে এমনিতেও ওকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। শহরে এতো এতো মেয়ে থাকতে ইকবাল মাহমুদ ওকেই কেনো ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন? শ্রাবণের জন্য মেয়ের অভাব ছিল না। তাহলে আলোর মধ্যে কি এমন দেখেছিলেন? অবহেলিত অসহায় মেয়েকে সাহায্য করার ছিল তবে কি শহরে এমন মেয়ের অভাব ছিল? অলিতে গলিয়ে বরং অহরহ মেয়ে আছে। কতকি প্রশ্ন মনে। আলোকে ভাবতে দেখে লিমা বেগম উঠে আসলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন,
> আলো তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার খাবার আমি রুমে পৌঁছে দিবো। ইশাকে নিয়ে ভেবোনা। এমনিতে কপালটা কতখানি কেঁ*টেছে। রাতে জ্বর না আসে। তোমার বাবা বারবার বলেছে বিশ্রাম নিতে। আমার মেয়েটার উপরে নজর লেগেছে। জানিনা কপালে কি আছে।
লিমা বেগম আলোকে উঠিয়ে ছাড়লেন। এখানে থাকলে নানারকম কথাবার্তা শুনে মেয়েটার মন খারাপ হবে। আলো চুপচাপ প্রস্থান করলো। এমনিতেও দুর্বল লাগছে। একটু ঘুমানোর প্রয়োজন। রাত হয়ে এসেছে। বিশাল করিডোর দিয়ে হেটে আসার সময় একটা কক্ষের ভেতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শুনে ও থমকে গেলো। কে আছে দেখার জন্য উঁকি দিতেই কানে বেজে উঠলো,
> বউ আর প্রাক্তন প্রেমিকা এক বাড়িতে,যাইহোক কেমন অনুভব করছো মিতু আপু? শ্রাবণ ভাইয়ার বউকে দেখেছো? তোমার থেকে সুন্দরী কিন্তু। তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছো। ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলো। তুমিই করলে না। ওরকম এখন অহরহ হচ্ছে মাঝখানে তুমি অতিরিক্ত বুঝে কপাল পুড়ালে।
আলো থমকে গেলো। ভেতর থেকে লিজার কণ্ঠ ভেসে আসছে। আজকের দিনটা আলোর চমকের উপরে আছে। অপর পাশের মানুষটার উত্তর শুনতে আলো মনোযোগ দিলো,
> শ্রাবণের বয়স কম ছিল। আবেগ দিয়ে কি জীবন চলে? অনেক ভেবে দেখলাম মাহিদ ভালো ছেলে। বিদেশে সেটেল একটা ভুলের জন্য ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত হবে না। তাই বিয়েতে মানা করিনি। সোনিয়ার বিয়ের জন্য চার বছর পর দেশের ফিরলাম। শ্রাবণকে ভীষণ মনে পড়ে জানিস? মাহিদের মতো আমাকে অবহেলা করতো না। আগলে রাখার চেষ্টা করতো। জানিনা তখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিনা। এখন আফসোস করে কি হবে বল?
বাকীটা শোনার জন্য আলোর সাহস হলোনা। শ্রাবণের এমন বদলে যাওয়ার পেছনে এই নারীর অবদান কতটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কতটা ভালোবাসা থাকলে একজন পুরুষ নিজেকে বদলে ফেলতে পারে? সমাজ সংসারের প্রতি বিরুপ মনোভাব এমনি এমনি হয়নি । আলোর কষ্ট হচ্ছে। এমনটা না যে শ্রাবণকে ও ভীষণ ভালোবাসে। শুধু ভেবেছে ওই মানুষপা ওর একান্ত নিজের। যার উপরে কারো অধিকার নেই। কিন্তু মানুষের মনের গণ্ডি কি অধিকারের বেড়াজালে আটকে রাখা যায়? সম্ভব না। আলো নিজের কক্ষে ফিরে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। নিজের পরিবারটাকে ভীষণ মনে পড়ছে। সংসারে অভাব অভিযোগ ছিল ঠিকই কিন্তু লতিফ সাহেব ছেলেমেয়েদের বিষয়ে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। আলো ফুপিয়ে উঠলো। ক্লান্ত শরীর চোখ বন্ধ হয়ে আসতে বেশি সময় লাগলোনা। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
***
মধ্যরাত,কারো ভারি নিশ্বাস আলোর মুখের উপরে আঁড়ছে পড়ছে। ঘরে আবছা অন্ধকার বিরাজমান। ব্যালকনি থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে দরজার পর্দা নাড়িয়ে দিচ্ছে। তপ্ত গরম আঙ্গুলের ছোঁয়া মুখে তীব্রভাবে পেয়ে আলোর তন্দ্রা ভাঙলো। চোখ খুঁলে অচেনা অগন্তুককে মুখের উপরে ঝুলে থাকতে দেখে আলোর গলা শুকিয়ে আসলো। অন্ধকারে মানুষটার আকৃতি বোঝা যাচ্ছে তবে মুখটা পরিস্কার না। আলো চিৎকার করতে চাইলো তার আগেই হাতটা এসে ওর মুখ চাপা দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
> চিৎকার করছো কেনো? ফোন কোথায় তোমার?
আলোর বুক ধড়ফড় করছে। শ্রাবণ এখানে আসবে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া বন্ধ ঘরে ও কিভাবে আসলো? আলো উঠতে চাইলো। শ্রাবণ বুঝতে পেরে মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিজেও সরে গেলো। কক্ষের লাইট জ্বালিয়ে দিলো। আলো কোনোরকমে উঠে শ্রাবণের দিকে চেয়ে কিছুটা ছুটে এসে ওকে ধরলো। শ্রাবণের হাতের বেশ কিছুটা জায়গা কেঁ*টে গেছে। ঠোঁটের কোনা থেকে র*ক্ত ঝরছে। শার্টে র*ক্তের দাগ। আলো উত্তেজিত হয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
> এসব কিভাবে হলো? আপনি আমাকে না ডেকে কাঁ*টাছেড়া নিয়ে মজা করছেন? আপনি সত্যি মানুষ না।
আলোর চোখ ছলছল করে উঠলো। হন্তদন্ত হয়ে শ্রাবণকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করলো। এখন গরম পানি ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কিচেন খুঁজে পাওয়া কঠিন।তাই কোনোরকমে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো। শ্রাবণ চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে। আজ চার বছর পর এই বাড়িতে পা রেখলো কিভাবে জানি সেটা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। একবুক কষ্ট আর হতাশা নিয়ে এই বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল সবটা এখনো চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে বলল,
> আমার এসবের প্রয়োজন নেই। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন প্রচুর বিজি ছিলাম। তাছাড়া বিকালে একটা গাড়ির সঙ্গে আমার গাড়ির ধাক্কা লেগেছিল। একটু লেগেছে তেমন কিছু না। তোমাকে জাগানোর ইচ্ছা ছিল না কিন্তু তুমি ঘুমের মধ্যে কি জানি বলছিলে। ভাবলাম আলো রাণী কার স্বপ্নে বিভোর একটু যাচাই করে দেখি।
আলো কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
> আলো বাইরের পুরুষের স্বপ্ন দেখে না। কারো মতো প্রাক্তনের টানে গভীর রাতে ছেড়ে যাওয়া স্থানেও পা রাখেনা।
শ্রাবণের কপালে ভাজ পড়লো। আলো ওকে খোচা দিয়ে কথাগুলো বলেছে বুঝতে বাকী নেই। কথাটা ভেবে ওর মেজাজ চরম খারাপ হলো। ঠোঁটের কাটা জায়গায় আলোর ওষুধ লাগাচ্ছিলো শ্রাবণ খপ করে ওর হাতের কব্জিটা ধঁরে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
> আমার থেকে দূরে থাকো। প্রয়োজন নেই তোমার আলগা দরদের। লাথি দিয়ে পরক্ষণে বুকে টেনে নেওয়া লোকদের আমি ঘৃণা করি। তোমার ছোঁয়া জাষ্ট সহ্য করতে পারছি না।
শ্রাবণ ঝাড়ি দিয়ে উঠে পড়লো। একটা বালিশ নিয়ে বিছানার এক পাশে গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। আলোর তোয়াক্কা করলোনা। মেয়েদের এই একটা স্বভাব স্বামীদের প্রাক্তন বা কোনো দুর্বল জায়গা থাকলে আঘাত দিতে খোটা দেওয়া। প্রতি মূহুর্তে সেটা মনে করিয়ে কষ্ট দ্বিগুণ করে দেওয়া। আলোর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। শ্রাবণ বরাবর এভাবেই কথা বলে। আজকাল ওর আঘাত আলোর সহ্য হয়না। ভীষণ কষ্ট হয়। আলো চুপচাপ শ্রাবণে পাশে গিয়ে বসলো। ভয় লাগে আবারও যদি ধমক দেয়? তবুও সাহস নিয়ে আলগোছে পাতলা কম্বলটা সরিয়ে ওর হাতটা বের করলো। শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে আছে। নড়াচড়া করছে না দেখে আলো সাহস পেলো। হাত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করলো। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। অথচ মুখে কেমন শক্ত? আলো তাড়াতাড়ি পানি এনে ওর কপালে পানিপটি লাগালো। শাশুড়ি মায়ের কাছে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু কোন রুমে আছে কিছু জানা নেই। সারারাত আলোর ঘুম হলো না। শ্রাবণে জ্বর ভোররাতের পর কম হলো। আলো নামাজ পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো তখন চারদিক পরিস্কার হয়ে গেছে। পাঁচটার বেশি। নিচে এসে আলোর চোখ ছানাবড়া।সকলে উঠে গেছে আর ডান দিকের রান্নাঘরে হুলস্থুল অবস্থা। পালা ধরে রান্না চলছে। শাশুড়ি কাছেপিঠে নেই। কি করবে ভেবে রান্নাঘরে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওকে দেখে ভেতর থেকে কাজের মেয়েটা বলল,
> বউমনি কিছু লাগবে?
আলো ইতস্তত করে বলল,
> কিছু খাবার পাওয়া যাবে? আর একটা কফি যদি হতো।
> অপেক্ষা করো এখুনি দিচ্ছি।
আলো খুশি হলো কিন্তু ওর খুশীটা স্থায়ী হলোনা। পাশ থেকে রিনরিনে আওয়াজে গতকাল রাতের দেখা সেই মেয়েটা বলে উঠলো,
> সকালে উঠে অর্ডার করার অভ্যাসটা ছোট থেকে নাকি আমাদের বাড়িতে এসে হয়েছে? শুনেছি তোমার বাবার বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না। নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যায়। সেই পরিবেশে থেকেও এতো বেলা করে ঘুম থেকে কিভাবে উঠো? আমিতো বাপু পারিনা। চার বছর অষ্ট্রেলিয়া থেকেছি তবুও অভ্যাস পরিবর্তন হয়নি। মেয়ে মানুষ এমন হলে হয়?
আলো পাশ ফিরে চাইলো। সাদা থ্রিপিচ পরিহিত মেয়েটাকে দেখতে খুব একটা সুন্দরী না হলেও খারাপ না। দীর্ঘদিন ঘর বন্দী মানুষের মতো ফ্যাকাশে গায়ের রঙ। চুলগুলো উঁচু করে ক্লিপে আটকানো। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা নিজের সাজ পোশাক নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। শরীর থেকে বেলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। আলো তীক্ষ্ণ নজর দেখেছে। ওকে চুপচাপ দেখে মেয়েটা আবারও বলল,
> শুধু রূপ দিয়ে পুরুষ মানুষের সংসার করা যায়না। কাজকর্ম জানোনা কেমন মেয়ে তুমি?
আলো জবাব দিতে চাইলো তার আগেই পেছনে থেকে উত্তর আসলো,
> আলো তুমি এখানে কি করছো? সকাল সকাল লেকচার শুনতে তোমার ভালো লাগছে তাইনা? নিজে এক বেকুব আরেক বেকুব মহিলার লেকচার শুনছো। ঘরে এসো। এই বাড়ির কিছু মহিলার সামনে তুমি একদম আসবে না। কিছু মানুষ আছে নিজের অতীত ভুলে গিয়ে ভাবে আমার মতো হাজী সারা পৃথিবীতে আর একটাও নেই। এই বাড়িতে তেমন টাইপ কিছু মানুষ আছে। লজ্জা ঘৃণা যদি সামান্যতম থাকতো তবে এভাবে লেকচার দিতে আসতো না। যাইহোক অন্যদের লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। এই বাড়ির খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। আমি ফিরবো। তুমি ঘরে আসো।
শ্রাবণ চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ালো। সারারাত জ্বরে পুড়ে যাওয়া মুখটা লাল হয়ে আছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো লাগছে। শার্টের হাতা কুনোই পযর্ন্ত গুছিয়ে রাখা। বড্ড এলোমেলো তবুও ভীষণ সুন্দর লাগছে। আলো ওর মুখের দিক চেয়ে আছে। শ্রাবণ একবার ওকে দেখে নিয়ে মিতুর দিকে চাইলো।
> শোন আমার বউয়ের থেকে দূরে থাকবি। আমার বউ বাড়ির কাজের মহিলা না। তুই তোর বরের দাসী হয়ে আছিস আজীবন থাক তাই বলে কি আমার বউ তোর মতো মেয়েকে অনুসরণ করবে? ও আলো, সারা পৃথিবী আলোকিত করার জন্য ওর জন্ম। আমি নিজে ওকে আমার উপযুক্ত করে গড়ে নিবো। তোকে ওর চিন্তা করে মাথা খারাপ করতে হবে না।
মিতুর ভেতর থেকে কান্না উতলে উঠছে। এক সময় এই মানুষটা ওর কতটা আপন ছিল আর আজ? অন্য একটা মেয়ের জন্য ওকে অপমান করতে ছাড়লোনা। মিতু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা। কান্না আটকে বলল,
> তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো শ্রাবণ। আমি ওকে জাষ্ট বলছিলাম আমাদের বাড়িতে কেউ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে না। তুমিতো সবটা জানো বলো?
শ্রাবণ ওর কথা পাত্তা দিলোনা। সোজাসুজি আলোর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> ঘরে আসো। এরা ন্যাকামি করে তোমাকে কোন ফাঁদে ফেলে দিবে চিন্তাও করতে পারবা না। কুমিরের কান্না দেখে মায়া করতে নেই।
শ্রাবণ টানতে টানতে আলোকে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। মিতুসহ বাড়ির অনেকেই শ্রাবণের এই নতুন রূপ দেখে থমকে গেলো।আগেকার শ্রাবণ আর এখনকার শ্রাবণের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিতু ফুপিয়ে যাচ্ছে। পছন্দের মানুষটার এমন বদল ওকে আরও যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনের মধ্যে হিংসার জন্ম নিচ্ছে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য শ্রাবণ কিভাবে এমন করতে পারে ওর বুঝ আসছে না।
চলবে