আমি মায়াবতী পর্ব-০৪

0
407

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিজভী আহমেদ। তীব্র অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে। মায়াকে সারাজীবন দূরে সরিয়ে রেখেছে সে। যাতে তার পরিবারের কোনো ক্ষতি না হয়। যাতে তার সাগরিকা কষ্ট না পায়। কিন্তু আজ! আজ নিজেই সে মায়ার জন্য ওকে কষ্ট দিল। তার তো বোঝা উচিত ছিল, এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কারোই খাবার খাওয়ার ইচ্ছে করবে না। আহ টাকা। টাকার জন্য কি ই না করেছে সে। একবেলা খাবার খাওয়ার জন্য, একটু ভালো খাওয়ার জন্য সে কেন যে সেদিন সেখানে গিয়েছিলো। সে যদি সেদিন সেখানে না যেতো, তাহলে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। এখন তার কত টাকা। চাইলেই কত দামী খাবার সে খেতে পারে। পরিবারকে খাওয়াতে পারে।কিন্তু, কারো খাওয়ার মতো অবস্থাই নেই। জীবনের একটা ছোট্ট ভুল, সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তার।
“খাবার খাবেনা?”
রিজভী আহমেদ পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারে, এইটা সাগরিকা। তার অর্ধাঙ্গিনী। যে সুখে, দুঃখে, বিপদে-আপদে সর্বক্ষণ তার পাশে ছিল। আর আজ তাকেই সে কষ্ট দিয়েছে। তার কথা ভাবেও নি সে। কথাটা মনে হতেই আপনা-আপনিই মাথাটা নিচু হয়ে আসে তার৷ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে,” তুমি খেয়েছো?”
” হুমম। খেয়েছি। জানোই তো,আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারিনা। ”
আবার কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরবতা যে এতোটা ভয়াবহ, সেটা রিজভী ভালোভাবেই জানে। কিন্তু সাগরিকার আজকের নিরবতা সে মেনে নিতে পারছে না। সে চাইছে সাগরিকা তাকে প্রশ্ন করুক। অনেক প্রশ্ন। যে প্রশ্নগুলোর অপেক্ষায় ছিল সে সতেরো বছর ধরে।
“তোমার মনে আছে সেই দিনটির কথা? যেদিন আমরা প্রথম দেখা করেছিলাম? এক ঠোঙা বাদাম ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারোনি তুমি আমাকে। মা কে বলে এসেছিলাম দুপুরে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে খাবো। তাই না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। তোমার পকেটের অবস্থা তখন শুন্য। আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। আমার কাছে টাকা থাকলেও তোমার সম্মানে লাগবে বলে কিছু কিনে খেতে পারিনি। তবুও খুশি ছিলাম। কারণ, তুমি আমার সাথে ছিলে। তোমাকে কখনোই বলিনি জানো তো, সেদিনের পর থেকে বাসায় খাবার খেতে গেলে খুব কম খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতাম। কারণ জানতাম, তোমার সাথে থাকতে গেলে আমার খাবারের কষ্টও করতে হবে। ”
আবার পিনপতন নীরবতা। রিজভী মাথা নিচু করে আছে। সাগরিকা আবার বললো,” বলোতো, আমাদের সমাজে কোন সম্পর্কটা স্বাভাবিক না?”
রিজভী আড়চোখে সাগরিকার দিকে তাকালো। নিচু গলায় জবাব দিল, “অবৈধ সম্পর্ক? ”
” উহু! নাহ।”
” তাহলে কি? কোনটা স্বাভাবিক না?”
” সৎ মায়ের সাথে তার বাচ্চাদের সম্পর্ক। ”
রিজভী মাথা নিচু করে রইলো। সাগরিকা আবার বললো,” জানো তো, কোনো মেয়েই কিন্তু চায়না, সে কারো সৎ মা হবে। কোনো মেয়েই না। কারণ, আমাদের সমাজে সৎ মায়েদের ভালো চোখে দেখা হয় না। মা যেমনই হোক, মা তো মা ই। সে সৎ হোক বা নিজের জন্মদাত্রী মা। মা বাচ্চাদের সুপথে আনার জন্য আধমরা করলেও কেউ বলার নেই। কিন্তু সৎ মা যদি একটা ফুলের টোকাও দেয়,তাতেই সবার সমস্যা। ভুল বললাম?”
নাহ। সাগরিকা ভুল বলেনি। সৎ মায়ের দেয়া কষ্ট আর কেউ না জানুক,রিজভী ভালোভাবেই জানে। সাত বছর বয়সে মা মারা গেলে বাবা পরের বছরই তাকে দেখাশুনার জন্য একটা অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিল। প্রথম প্রথম সব ভালো গেলেও সময়ের সাথে সাথে সবই পরিবর্তন হয়ে যায়। সৎ মায়ের ছেলেটা হওয়ার পর তো তার অস্তিত্বও ছিল না কারো কাছে ওই বাড়িতে৷ উঠতে বসতে যে যন্ত্রনা সে সহ্য করেছে, সেটা যেন কারো কপালে না জুটে। সে জানে, সৎ মায়েরা ভালো হয়না। কিন্তু সে এটাও জানে, সাগরিকা সবার থেকে আলাদা৷ মায়াকে সে ভালো না বাসলেও কষ্ট দিবে না।
“দুনিয়াটা কি অদ্ভুত, তাইনা? মেয়ের বাবা-মা টাকা পয়সার লোভে বউ মরা,বাচ্চাওয়ালা অর্ধবয়স্ক এক লোকের কাছে কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়।আবার বিয়ের সময় সবাই এটাও বলে দেয়, বাচ্চা দেখাশুনার জন্যই মেয়েটাকে আনা হয়েছে। কোনো অযত্ন যেন না হয়। কুমারী মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে। বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে কোথাও ঘুরতে যাবে,রাত জেগে চন্দ্রবিলাশ করবে। মাঝে মাঝে অভিমান করবে,স্বামী তার মান ভাঙাবে। কিন্তু এইসব মেয়েদের কপালে কি জুটে? সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চার জন্য খাবার বানাও। তারপর বাচ্চার বাপের জন্য। পরিবারের সবার জন্য। তারপর সারাদিন বাড়ির কাজ আর কাজ।স্বামীর কাছে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেও সে মেয়েটাকেই দোষারোপ করবে। কেন? সে যে সৎ মা। ঠিক এই কারণেই। তার উপর তো আছেই প্রতিবেশীরা। বাচ্চার সাথে একটু চোখ গরম করে কথা বললেও বলবে মা ডাইনি। আবার বেশি আদর সোহাগ করলেও বলবে নিজের সংসার গোছাও৷ পান থেকে চুন খসলেই কৈফিয়ত দিতে হবে সবাইকে। এক মাঘে শীত যায় না জানো তো? ঐ সৎ মায়ের হাতেও একসময় ক্ষমতা আসে। তখন এতো বছরে তার উপর করা অন্যায়ের সব রাগ চলে যায় সেই মা মরা বাচ্চাটার উপর। কারণ, তার জন্যই তাকে সবার গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে একসময়।”

রিজভী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তারও মনে পড়েছে, তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকেও সবাই প্রথমদিকে এইভাবে কথা শুনাতো। বিশেষ করে দাদী। বাবার চাইতে বয়সে অনেক ছোট ছিল সে। কত আর বয়স হবে তখন? পনেরো কি ষোল। রিজভীর জন্য বাবার বাড়িতেও যেতে পারেনি সে। কিন্তু বিয়ের ছয় বছর পর যখন দাদী বিছানায় পড়ে গেল, সংসারের চাবি তার হাতে আসলো, সেও ঠিক তাই করতে লাগলো। তখন থেকেই রিজভীর দুঃখের দিন শুরু। পাড়া প্রতিবেশীরাও তখন কিছু বললে সৎ মা উল্টো তাদের অনেক কথা শুনাতো। সৎ মায়ের উপর রিজভীর অনেক দিনের ক্ষোভ ছিল। রাগ ছিল। আজকে সাগরিকার কথাগুলো শুনে রাগগুলো যেন অভিমানে পরিনত হচ্ছে। নিজেরই খারাপ লাগছে।

“তোমাকে এই কথাগুলো কেন বলছি বুঝতে পেরেছো? আমিও এখন কারো সৎ মা। কিন্তু আমি যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক। তাই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। কিন্তু ভালোবাসাও আশা করোনা আমার থেকে। ”
রিজভী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সাগরিকা এবার ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,” আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল বলোতো,যার কারণে তুমি ওর মায়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে?”
” সাগরিকা, আমি জানি আমার কথাগুল অবাস্তব শুনাবে। কিন্তু আমার ওর মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক কখনোই ছিল না।”
সাগরিকা এবার রাগে কান্না করতে গিয়েও হেসে ফেললো। পাগলের মতো হাসতে হাসতে বললো,” তাহলে কি এখন এইটা বলছো যে এতো বড় মেয়েটাকে আকাশ থেকে আল্লাহ টুপ করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে? বিশ্বাস করতাম,যদি সে তোমার মতো দেখতে না হতো। কিন্তু তোমাদের দুজনকে দেখতে তো একেবারেই এক রকম। আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়?”
“বাচ্চারা খেয়েছে?” কথা ঘুরানোর জন্য প্রশ্নটা করে রিজভী।
“হুমম, খেয়েছে। মায়াও খেয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছে।”
” আমাকে প্রশ্ন করবে না? প্রশ্ন করছো না কেন কোনো?”
” আমি জানি তুমি বলবে না। বলার হলে ১৭ বছর আগেই বলতে। ”
“হুমম, বলবো না। কারণ আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি চাইলেও বলতে পারবো না।”
“জানি। তাই জিজ্ঞেস ও করবো না আর। ”
“কিছুদিন পর হয়তো তুমি নিজেই জানতে পারবে সব। শুধু একটাই অনুরোধ, এই কয়েকটি দিন আমার কাছেই থেকো। আমাকে ছেড়ে যেও না।”
সাগরিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,” ভয় পাচ্ছো? আমি চলে যাবো ভেবে? নাহ,যাবো না। কখনোই যাবো না। বাবার বাড়ি ছেড়ে রাতের আধারে সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে এসেছিলাম। একবেলা খেলে দুইবেলা না খেয়ে থেকেছি। রাজকন্যা হয়ে জন্মেছিলাম।তোমাকে ভালোবেসে তোমার কুঁড়েঘরে এসে থেকেছি। কত কষ্ট করে এক কামরার ফ্ল্যাট এ থেকেছি। তিল তিল করে টাকা জমিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি। এই ফ্ল্যাটটার অর্ধেক মালিক আমিও। দুঃখের সময় তোমার পাশে থেকেছি। তাহলে সুখের সময় কেন ছেড়ে যাবো? তোমার কাছে চলে আসার জন্য বাবার মরা মুখটাও দেখতে পারিনি আমি। এইবার তোমাকেও হারাবো নাকি?কখনোই না। যেখান থেকে সারাজীবনের জন্য চলে এসেছি, সেখানে আবার চলে যাবো নাকি? কখনোই না।”কথাগুলো বলেই সাগরিকা ছাদ থেকে চলে যায়।
রিজভী আহমেদ এর বেশ হালকা লাগে নিজেকে। যাক, এইবার আর সবকিছু থেকে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না। তার পরিবারকে হারানোর ভয় পেতে হবে না। মায়াকেও দূরে সরিয়ে রেখে কষ্ট পেতে হবে না। যতোই হোক, সেও তো তারই মেয়ে৷ তার জীবনের প্রথম সন্তান। প্রথম বাবা ডাক শুনার অনুভূতির কথা সে ভুলবে কিভাবে?

****

আজ রাতে ভালো ঘুম হয়নি। প্রথমত নতুন জায়গা। দ্বিতীয়ত ভয়। আজকে কিভাবে যেন সে অজ্ঞান হয়ে গেল। সারাদিনের অভুক্ততা আর ভয় থেকেই হয়তো। বাবা বলেছে কালকে আমাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে। সাবিহা, সাব্বির যে স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলে। ওদের সাথেই নাকি স্কুলে যেতে হবে। সাব্বির এর সাথে আজকে একটু সখ্যতা গড়ে উঠলেও,সাবিহার সাথে কোনো কথাই হয়নি। সে একবার ও আমার কাছে আসেনি। না আসাটাই স্বাভাবিক। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। তবে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আমার খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু,সাবিহার নানু আর মামীকে ভালো লাগেনি।আমার সাথে কি রকম ভাবে কথা বললো। কেমন ঝাঁঝালো গলায়। কাছের মানুষদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। মনে পড়লো বাবা আমাকে যে মোবাইলটা দিয়েছে, তার মাঝে নানীর নাম্বার আছে। একবার মনে হলো নানীকে কল দিই। নানীর নাম্বার এ ডায়াল করেও কল ঢুকার আগ মুহুর্তে কেটে দিলাম। মনে হলো, আমি কল দিলে নানী হয়তো আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবে। ভাববে, আমি এইখানে ভালো নেই। আমার জন্য এইখানের সবাই ভালো নেই। আবার নানীকে কল দিয়ে তাদের শুধু শুধু দুশ্চিন্তায় ফেলতে ইচ্ছে হলো না। খুব অস্থির লাগছিল। তাই জানালা খুলে দিলাম। হুহু করে বাতাস আসতে লাগলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম,লাল নীল অনেক বাতি জ্বলছে।নীচের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলাম, অনেক গাড়িও চলছে। এই শহরের মানুষদের কত কাজ। রাতেও কাজের শেষ নেই। এই শহরে মানুষেরও অভাব নেই। কিন্তু, আমাকে ভালোবাসার জন্য মানুষের বড়ই অভাব। সেইরাত টা কিভাবে শেষ হয়েছে জানিনা। ফজরের আজান হওয়ার সাথে সাথেই আবার ঘুম টা ভেঙে গেছে। অভ্যাস মতো ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ পড়ে আবার শুয়েছিলাম। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে দেখলাম বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বললো,” ঘুম ভালো হয়েছে মা?”
“হুমম।”
” শোনো, তোমার তো সামনের বছরই পরীক্ষা। সময় তো বেশি নেই। এখন ও রেজিষ্ট্রেশন হয়নি তোমার আগের স্কুলে। তাই তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি এখানে আনতে পেরেছি।আমি এইখানের একটা স্কুলের সাথে তোমার ব্যাপারে আগেই কথা বলে রেখেছিলাম। আজকে আমরা যাবো সেখানে ভর্তি করাতে তোমাকে। সাবিহা, সাব্বির এর সাথে তুমিও যাবে। সমস্যা হবে না তো?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। বাবা আবার বললো,” এই যা। স্কুলে তো যাবে। কিন্তু তোমার ব্যাগই তো কিনে আনা হয়নি। যাওয়ার সময় কিনে নিতে হবে। তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমাদের আবার মার্কেটেও যেতে হবে। ”
” বাবা, আমার ব্যাগ আছে। খাতা-কলম ও আছে। সমস্যা হবে না। ”
“আচ্ছা, তাহলে আজকে থাক। আজ ঐগুলোই নিয়ে চলো৷ আজ রাতে না হয় আমি নতুন ব্যাগ কিনে এনে দিব তোমাকে। ”
বাবা চলে গেলে আমার একটু ভালো লাগলো। এই বাসায় সারাক্ষন থাকতে আমার কেমন দমবন্ধ লাগে। নতুন স্কুলে গেলে তো তবুও অনেকের সাথে মিশে ভালো লাগবে।
আমার একা একা বসে থাকতে খারাপ লাগছিল। ভাবলাম একটু বের হবো। বাবার কাছে যাবো। কিন্তু তার আগেই সাব্বির আমার জন্য হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আসলো। তিনটে রুটি আর একটা ডিম ভাজি। খাবারের পরিমান আমার জন্য অনেক বেশি কিন্তু আমার খারাপ লাগলো। ভীষণ খারাপ লাগলো। আমি কি সবার সাথে একসাথে খাওয়ার অধিকার রাখি না? চোখের কোণে আপনা আপনিই পানি চলে এলো। আমি চোখ মুছে খেতে যাব, তখন সাব্বির আমাকে বললো, ” এই তুমি কাঁদছো কেন? তোমার হয়েছে কি? তোমার কি খাবার ভালো লাগে নি? আমারও ডিম ভালো লাগেনা। আমার জ্যাম পাউরুটি ভালো লাগে। কিন্তু মা আমাকে খেতে দেয় না। বলে ঐসব নাকি ভালো না।তুমি কি জ্যাম পাউরুটি খাবে? আমার জন্য আছে, তোমাকে দিব?”
আমার ভীষণ ভালো লাগলো।যাক, কেউ তো আছে আমার। যে আমার জন্য কিছুটা হলেও ভাবে। যে আমার চোখের পানি দেখে নির্দ্বিধায় নিজের পছন্দের জিনিস আমাকে দিয়ে দিতে পারে। আমি হেসে বললাম,” নাহ, আমি জ্যাম পাউরুটি খাবো না। আমি রুটিই খাবো।”
” আচ্ছা, তোমার মা কই? সে কোথায় থাকে?”
মুখে খাবার দিতে গিয়েও আবার থেমে গেলাম। গলা ভারি হয়ে আসলো। কান্নামাখা গলায় বললাম,” আল্লাহর কাছে চলে গেছে সাব্বির।”

***
” তুই তাহলে আমাদের সাথে যাবি না? এইখানেই থাকবি? তোর বাচ্চারা এইরকম একটা বাজে পরিবেশে বড় হবে? তাই চাস তুই?”
“আমি যাওয়ার জন্য আসিনি মা। আমি এইখানেই থাকবো। মৃত্যু ছাড়া আর কেউ আমাকে এইখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।”
“আজ মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাল যদি তোর সতীন চলে আসে এইখানে? তাহলে কি করবি?
সাগরিকা সাব্বির এর টিফিন প্যাক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। নাহ, এমন কখনোই হবে না।সে জানে, রিজভী আর যাই করুক না কেন, তার সংসারে অন্য কাউকে আনবে না।

***
বাবা বারবার তাড়া দিচ্ছে সবকিছু নিয়ে বের হতে। কিন্তু আমি দেরি করে ফেলেছি। আমার স্কুল ব্যাগের ভিতরেও আমার কিছু ড্রেস ছিল। সেগুলো গোছাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। একটার ভেতরে হাত দিতেই আমার মায়ের সেই ডায়েরিটা বের হয়ে আসলো। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সাব্বির এর মা কে এইটা দিতে হবে। কিন্তু এখন সময় নেই। তাই ড্রেসিংটেবিল এর উপরে রেখেই বের হয়ে আসলাম। আমি বের হওয়ার পরপরই সাবিহাও বের হলো ওর রুম থেকে। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” উনি কোথায় যাচ্ছে? ”
আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা উত্তর দিল,” ওকে ও তোমার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।’
ও মুখ গোমড়া করে বললো,” উনি গেলে আমি যাব না। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করবে উনি কে। আমি কি বলবো সবাইকে?”
” কেন? ও তোমার যা হয় তাই বলবে। বলবে তোমার বড় বোন। আর তুমি তো বোন ভালোবাসো।”
সাবিহা হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই ওর মা বললো,” সাবিহা, এখন এইসব বলার সময় নয়। সবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার বাবাকেও আবার অফিসে যেতে হবে। কথা বাড়িও না।”
“কিন্তু মা উনি…”
” কোনো কিন্তু নয়। পরে কথা হবে। এখন যাও।”
আমার মন কিছুটা খারাপ হলেও গাড়িতে বসে অনেক ভালো লাগলো। আমার বাবার একটা গাড়িও আছে তাহলে। সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বাবার সাথে স্কুলে যাব। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। আমার ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে। ইশশ! যদি আগের স্কুলের বন্ধুরা এইটা দেখতে পেতো।
***
সারাদিন ভালোই কেটেছে আমার। কিছু বান্ধবীও হয়েছে। বাসায় সাবিহার সাথেই এসেছি। এক গাড়িতেই। তবে এইবার ড্রাইভার গিয়েছিল আনতে। সাব্বির এর ক্লাস আগেই শেষ হয়ে যায়। তাকে আগেই নিয়ে আসা হয়েছে স্কুল থেকে। বাসায় এসে মায়ের ডায়েরির কথাটা মনে পড়লো। সাব্বির কোচিং এ গেছে। সাবিহা ওর রুমে। ওদের নানু আর মামীকেও দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো চলে গেছে। এখন ওদের মা কে ডায়েরিটা দিয়ে আসতে হবে। এর চাইতে ভালো সময় হয়তো আমি আর পাবো না। তাই যখন ডায়েরিটা নিতে ড্রয়িং টেবিলের কাছে গেলাম, আমার দম টা যেন বের হয়ে আসছিল। ডায়েরিটা সেই জায়গায় নেই। আমি তন্নতন্ন করে সারারুম খুঁজলাম। কিন্তু হায়, কোথাও নেই। কি করবো আমি এখন? মায়ের গোপন কথাগুলো কিভাবে জানবো? কিভাবেই বা সাবিহার মাকে জানাবো?

চলবে….