আমি মায়াবতী পর্ব-০৩

0
270

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

গেস্টরুমের পর্দার এক অংশ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এই রুম থেকে সরাসরি ড্রয়িং রুমটা দেখা যাচ্ছে। অনেক মানুষ সেখানে। একটা বাচ্চা শুকনো মুখে বসে আছে সোফার উপর। পা দুইটাও সোফার উপরেই রেখেছে। মুরুব্বি মত একটা মানুষ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ একজন কে কুলাঙ্গার বলে সম্বোধন করছে। তার পাশে ফর্সা করে মোটামত একটা মহিলা বসে আছে। তার মুখ রাগান্বিত। থেকে থেকে সেও মুরুব্বি মত মহিলার সাথে রাগারাগিতে যোগ দিচ্ছে। আর কিছুক্ষন পরপর ফোন করে কাদের কে যেন আসতে বলছে। আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা। বয়স হয়তো চল্লিশ এর কাছাকাছি হবে। সে নির্বিকার ভঙিতে বসে আছে। কিন্তু একটু আগেই আকাশ বাতাস এক করে গগনবিদারী চিৎকার করে পরিবেশ টা ভারীও করে তুলেছিল। কিছুক্ষন পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছিল। আর অনবরত বলছিল, আমাকে ঠকালে কেন? আমি তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে তোমার কাছে এসেছিলাম আমাকে কেন ঠকালে? সোফায় বসে থাকা বাচ্চাটা মাঝে মাঝে মা মা বলে মহিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কখনো এসে জড়িয়ে ধরছে। আরও একজন আছে। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। সে আমি আসার কিছুক্ষন পরেই অপর পাশের একটা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি, এই মেয়েটি ওর বোন। কারণ এই মেয়েটিও দেখতে প্রায় তার মতো। বলতে গেলে মেয়েটিও তার বাবার মতোই হয়েছে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটি হয়েছে তার মায়ের মতো। মেয়েটির বয়স বারো কি তেরো হবে হয়তো। ছেলেটির হয়তোবা দশ, এগারো। আর ওদের মায়ের বয়স ও কম৷ আমার মায়ের চাইতেও কম। আমার হঠাৎ মনে হলো, আমার মা হয়তোবা বাবার প্রথম স্ত্রী। আর এই মহিলা দ্বিতীয়। কারণ, এর বয়স ও কম। আবার এই বাচ্চাদের বয়স ও কম। আমিই এদের চাইতে অনেক বড়। কিন্তু যদি এই মহিলা বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হয়, তবে এরা এতো কান্নাকাটি করছে কেন? এরা কি বাবার আগের পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানতো না? ইশশ! বাবাটাই বা কোথায় গেল?

আমাকে এই বাসায় এনে সবার উদ্দেশ্যে কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,” ও মায়া। আমার বড় মেয়ে। সাবিহা, সাব্বির, ও তোমাদের বড় বোন। আজ থেকে ও তোমাদের সাথেই থাকবে। আর সাগরিকা, আমি জানি তোমাদের সবার মনেই অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু আমি এখন কোনো কিছুর জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। তোমরা ধীরে ধীরে সবই জানতে পারবে।”
কথাগুলো একদমে বলেই বাবা আমার হাত ধরে এই ছোট্ট গেস্টরুম টায় এনে বললো,” তুমি আজ থেকে এইখানেই থাকবে। বাসায় রুম ৪ টা। স্যরি তোমাকে একটু ম্যানেজ করে নিতে হবে। বাকি ৩ টা রুমই সবার দখলে। আশা করি, তোমার কোনো সমস্যা হবে না। আমি বের হচ্ছি, রাতে ফিরবো। ততক্ষন সাবধানে থেকো।”

আমি কোনো কিছু বলার আগেই বাবা রুম থেকে বের হয়ে গেছে। ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাইকে উপেক্ষা করে সে বের হয়ে গেছে। কারো প্রশ্নের কোনো জবাব সে দেয় নি। আমি আরো একবার ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালাম। মোটামত মহিলাটি আবারও কাকে যেন ফোন করছে। তাকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে। মুরুব্বি টাইপ মানুষটার জন্যই যে সে এইখানে এখনো আছে, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি দরজার সামনে থেকে সরে এসে আমার রুমটার দিকে নজর দিলাম। ২ জন মানুষ থাকার মতো ছোট একটা খাট, একটা পড়ার টেবিল, একটা ওয়ারড্রোব,একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা আলনাও আছে। রুমটার সাথে এক্সট্রা একটা ওয়াশরুম ও আছে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু রুমটায় জানালা মাত্র একটা। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আগে যেখানে থাকতাম, সেখানটা ছিল মফস্বল শহর। অতো বড় বড় বিল্ডিং ছিল না।আমাদের বাসাটা ২ রুমের হলেও, অনেক আলো বাতাস ছিল। চারপাশে গাছপালা ছিল। কিন্তু এই ঢাকার শহরে এসে তার দম বন্ধ লাগছে। আলো আছে যথেষ্ট কিন্তু গাছপালা নেই। কি জানি, এই ফ্ল্যাট টা কত তলায়। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বাবার সাথে যখন লিফটে আসলাম, তখন বাবা ১২ তে প্রেস করেছিল। তারমানে এইটা ১৩ তলা। ভাবা যায়? পাহাড়ের চাইতেও উঁচু হয়তো। আমি জানালার কাছে গিয়ে নিচে তাকালাম। নিচে চোখ পড়তেই মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠলো। এতো উপরে আমি তো আগে কখনোই উঠিনি। যাক, বাবা পাহাড়ে না নিয়ে গেলেও, এইখানের এই এতো উপরের বাসায় নিয়ে এসে পাহাড়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে। হঠাৎ মনে হলো, বাবা কি তার পরিবারের সাথে ঘুরতে যায় কখনো? হ্যাঁ, যায়। এইজন্যই তো ড্রয়িংরুমে তাদের সবার সমুদ্রের সামনের একটা ছবি দেখলাম। ইশশ! আমিও যদি সমুদ্র দেখতে পেতাম।
****
” আপু, বাবা কি আমাদের আর ভালোবাসবে না?”
ছোট ভাই সাব্বিরের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকে সাবিহা প্রশ্ন করে,” বাবা যে তোকে ভালোবাসবে না, তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?”
” জানো, আমার বন্ধু জায়ান আছে না, ওর বাবাও আরেকটা বিয়ে করেছে। সেখানে ওর আরেকটা ভাই ও আছে। এখন নাকি ওর বাবা আর ওকে ভালোবাসে না। শুধু ওর সেই ভাই আর ভাইয়ের মাকেই ভালোবাসে। ওদের সাথে থাকেও না। এখন কি বাবা ঐ আপুটার মা কে আনতে গেছে? তাহলে আমাদের মায়ের কি হবে আপু?”
সাবিহা কষ্টের মাঝেও মুচকি হাসে। বাবা যে কেন এমন করলো কে জানে। আর বাবা এখন কোথায় গেছে সে তাও জানে না।সাবিহার ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে গিয়ে বলবে বাসা থেকে চলে যাও। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে ঐ মেয়ের ধারেকাছেও যাবে না। কেন সে এসেছে আমাদের বাড়িতে।
” আপু, মায়ের কাছে যাবে? মা অনেক কান্নাকাটি করছে। নানু মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আবার বকাঝকাও করছে। আবার বাবাকে বলছে কুলাঙ্গার। আপু, কুলাঙ্গার কি?”
সাবিহার মেজাজ মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেল। এইজন্যই নানুকে ভালো লাগেনা তার। কথায় কথায় বাবাকে ছোট করার চেষ্টা করে। আর এখন তো বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবে না মোটেই। বাবা যাই করুক না কেন, বাবাকে বাজে কথা বলার অধিকার নেই উনার। সাবিহার অনেক ইচ্ছে ছিল, ওর একটা বোন থাকবে। বড় কিংবা ছোট, একটা হলেও হতো।সাব্বির এর জন্মের সময় সে খুব করে চাইতো হাসপাতাল থেকে মা যেন একটা বোন নিয়ে আসে। কিন্তু মা ভাই এনেছিল বলে সে ভীষণ রাগ করেছিল। একসময় সাব্বির এর প্রতি মায়া জন্মালেও একটা বোনের ইচ্ছে সবসময়ই ছিল তার৷ বাবা আজ তাকে সত্যি সত্যিই একটা বোন এনে দিয়েছে। প্রায় তারই মতো দেখতে। কিন্তু আফসোস! সে এমন কোনো বোন চায়নি যে বোনের মা তার নিজের মা নয়।

****

” হলো তো? হলো? আমি বলেছিলাম না, তুই এই ছেলের সাথে থাকলে জীবনেও সুখি হবি না? বলিনি তোকে?” রাগে গজগজ করতে করতে নিজের মেয়েকে কথাগুলো বলে মরিয়ম খানম। সে সাবিহা আর সাব্বির এর নানু।
সে একা একাই মেয়ের সাথে বকবক করছে। কিন্তু মেয়ে তার কথার কোনো জবাব দিচ্ছে না। মেয়ের দিকে একবার আড়চোখে তাকালো সে। তিন মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত স্বভাবের মেয়ে এই মেয়েটাই। কিন্তু কে জানতো, মেয়ে প্রেমে পড়বে এক বেকার ছেলের উপর । অনার্স শেষ না করেই তার হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালাবে? মান সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিবে? যদিও মেয়ে বলেছিল সেই বেকার ছেলের ব্যাপারে। কিন্তু আমেরিকায় সিটিজেনশিপ পাওয়া ছেলের কাছে মেয়েকে না দিয়ে কোন পাগলে বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিবে? তারাও রাজি হয়নি। মেয়েটি কি দেখেছিল সেই বেকার ছেলের মাঝে কে জানে, যে রাতের আধারে তার হাত ধরে পালাতে হলো?মেয়েকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সে আবার বলে,” মিলেনি আমার কথা? আরেহ যে ছেলে তার বুড়ো বাপ মা কে শুধু টাকা পাঠিয়েই খালাস, তাদের সেবাযত্নের নাম নেয় না মুখেও, সেই কুলাঙ্গার যে সবই করতে পারে। তা এখন সে গেছে কই? তার সেই বউকে আনতে গেছে নাকি? তাকে নিয়ে আসলে তুই এখানে থেকে কি করবি? তুই আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে যাবি। বলেছিলাম না তোকে, একদিন না একদিন তোকে আমাদের বাড়ি ফিরতেই হবে। মিললো তো কথা?”

সতীন নিয়ে আসবে মানে? মানে মেয়েটার মাকেও এইখানে নিয়ে আসবে? নাহ! সব মিথ্যে, সব। সাগরিকা বারবার চোখ বন্ধ করে রাখছে আর ভাবছে, সে চোখ খুলবে, তার দেখবে যে সব কিছু ঠিকঠাক। সে বারবার চোখ বন্ধ করে নিজের মতো থাকতে চাইছে। কিন্তু নিজের মায়ের কথার জন্য কিছুই পারছে না। কিন্তু এখন মায়ের উপর ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার৷ অন্য রুমেও যে যাবে, সেই উপায়ও নেই। এক রুমে সাবিহা, সাব্বির। আরেক রুমে তার ভাইয়ের বউ। এই রুমে তারা আছে। আর গেস্টরুমে মেয়েটা আছে। সাগরিকার ইচ্ছে হলো, একবার গিয়ে মেয়েটাকে সব জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু ওর সামনে যেতেও কেমন যেন লাগছে। কেমন অনুভূতি সে জানে না। অস্বস্তি হচ্ছে কিংবা লজ্জা লাগছে। সে বুঝতে পারছে না ঠিক।
***

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। আমি সেই ভোর রাতে খাবার খেয়েছি । তারপর আর কিছুই খাইনি। এতোক্ষণ ক্ষুধা না লাগলেও এখন পেট জানান দিচ্ছে, তার খাবার চাই। মায়ের মৃত্যুর দিনের কথাও মনে পড়লো আমার । মায়ের মৃত্যুর পর মনে হলো সে সবকিছুর উপরে উঠে গেছে। তার ক্ষুধা পিপাসা আর কিছুই নেই। কিন্তু ১২ ঘন্টা পার হওয়ার আগেই ভীষণ ক্ষুধা আর পিপাসা পেয়েছিল। তার শুকনো মুখ দেখে খালামনি আমাকে খেতে দিয়েছিল। কিন্তু এইখানে কেউ তার আপন নয়। কেউ তার খবর নিবে না। সে খাবার খেলো নাকি না খেলো, তাতে কারো কিছু যায় আসে না।

” তুমি কে?বাবা বললো তুমি নাকি আমার বোন। তুমি কি আসলেই আমার বোন?”
একটা বাচ্চা ছেলের আওয়াজ পেয়ে আমি জানালার কাছে থেকে সরে আসি। বাচ্চাটা ভীষণ কিউট। আমি হেসে বলি,”হ্যাঁ, আমি তোমার বোন। তুমি তো অনেক কিউট। তোমার নাম কি?”
” সাব্বির।”
আমার আবার অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। একটা ভাইবোনের খুব শখ ছিল আমার। ছোটবেলায় বন্ধুদের কারো ভাই বোন হলেই আমিও মায়ের কাছে ছুটে যেতাম। আমিও বায়না করতাম হাসপাতাল থেকে আমাকে একটা ভাই কিংবা বোন এনে দিতে। মা মাঝে মাঝে হাসতো। আবার মাঝে মাঝে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাপুস নয়নে কান্না করতো। আমি কিছুই বুঝতে চাইতাম না। মা কে বলতাম বাবাকে বলবে বেশি করে টাকা দিতে। হাসপাতালে কেউ বাচ্চা না দিলেও যেন মা কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু যখন সবকিছু বুঝতে শিখলাম, তখন আর এইসব বলে মা কে বিব্রত করতাম না। ভাবতেই অবাক লাগছে, আমারও এখন দুটো ছোট ভাইবোন আছে। আমি সাব্বির এর দিকে তাকিয়ে বললাম,” তুমি কোন ক্লাসে পড়ো ভাই?”
“ক্লাস ফোর এ পড়ি। তুমি আমাদের বাসায় কতদিন থাকবে?”
“জানিনা ভাই।”
” তুমি এখানে কেন এসেছো? তুমি এসেছো বলে মা কান্না করছে। আপুও কান্না করছে আর কষ্ট পাচ্ছে। নানু বাবাকে বকাবকি করছে। জানো কি বলেছে? নানু বলেছে বাবা কুলাঙ্গার। আচ্ছা, কুলাঙ্গার কি?”
আমার ভীষণ খারাপ লাগলো বাবার জন্য। সবার জন্য। বাবা তো চাইলেই আমাকে নানাবাড়িতে দিয়ে আসতে পারতো।
” আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছিল। তাই বিস্কুট খাচ্ছি। মামী ভাত খাচ্ছে। আমার ভাত ভালো লাগে না। আপু, মা, নানু কিছুই খায় নি। তুমি কি কিছু খাবে? তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?”
” নাহ। আমি খাবো না। তুমি খাও।”

***

রাত আটটার দিকে বাবা বাসায় ফিরলো। কলিংবেল এর শব্দ পেয়ে সাব্বির ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। সাবিহাও ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। নানু কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু বাবা কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার ঘরে আসলো। আমি বাবাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলাম। বাবাও বিনিময়ে একটু হেসে আমার দিকে একটা ফোন দিয়ে বললো,” তোমার ফোন। তোমার মামা,খালা আর নানীর নাম্বার আছে সেইভ করা। আমার টাও আছে। প্রয়োজন হলে আমাকে কল দিও। ”
আমি অল্প হেসে জবাব দিলাম,” আচ্ছা।”
“তোমার মুখ দেখতে এমন লাগছে কেন? কেমন মরা মরা। খাওনি কিছু সারাদিন?”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলাম। বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললো,” সাগরিকা। সাগরিকা। কোথায় তুমি? এখানে এসো জলদি।”
সাগরিকা। মানে বাবার স্ত্রী। কিছুক্ষণ পরই এসে হাজির হলো রুমটায়। আমি এই প্রথম ভালোভাবে উনার মুখের দিকে তাকালাম। গোলগাল চেহারা। বেশ স্নিগ্ধ দেখতে৷ বাবার সাথে খুব সুন্দর মানায় হয়তো। চোখের নিচে এখনো পানির চিহ্ন রয়েছে। উনি প্রায় সারাদিন ই কেঁদেছে।
বাবা আবার রেগে যাওয়া গলায় বললো,” তুমি কি মানুষ? নাকি অন্যকিছু? সারাদিন একটা মেয়ে না খেয়ে আছে। তুমি তাকে খেতে দাওনি কেন? সেই ভোর সকালে সে হালকা কিছু খেয়েছে। আর এখন আট টা বাজে। এখন ও কিছুই খায়নি৷ আমি মানছি ওকে মেনে নিতে তোমার সমস্যা হচ্ছে। তাই বলে একজন মানুষ হিসেবে কি তোমার ওকে খেতে দেওয়া উচিত ছিল না?”

বাবার কথা শুনে মহিলাটি অবাক হয়ে গেল। যেন বাবার কাছ থেকে এমন কিছু আশাই করেনি সে৷ কান্না চেপে রেখে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভোর সকালে খেয়েছে? আমি আর আমার বাচ্চারা কখন খেয়েছে জানো তো? গতকাল রাতে। রাতে তুমি ফোন দিয়ে বললে যে সকালেই আসবে। ছেলে মেয়ে দুটো না খেয়ে তোমার জন্য বসে ছিল। আর তুমি এসে ওকে রেখেই চলে গেলে। বলে গেলে ও তোমার বড় মেয়ে। এরপর কি আর আমাদের গলা দিয়ে খাবার নামে? তোমার বাকি বাচ্চা দুটো কাল রাতে খেয়েছে। সারাদিনই না খাওয়া। আমরা কার কাছে কৈফিয়ত চাইবো।”
বাবা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার বাবাকে এইরকম অসহায় অবস্থায় দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না। বাবার স্ত্রী বাবার দিকে এগিয়ে এসে খুব শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বললো, ” আঠারো বছরের সংসার জীবনে না হলেও সতেরো বছর ধরে ঠকাচ্ছো আমাকে। কেন? এর জবাব তো নিশ্চয়ই তোমার কাছে আছে। বলো তো আমাকে৷ কি ছিল না আমার মাঝে? যার কারণে তুমি অন্য নারীতে মত্ত হয়েছিলে?”
আঠারো বছর?উনাদের বিয়ের বয়স আঠারো বছর। কিন্তু আমার মায়ের সাথে বাবার বিয়ে হয়েছে সতেরো বছর আগে। তার মানে? তার মানে আমার মা- ই বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী? আমার মাথা কাজ করছিল না। চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল। মাথা অসম্ভব রকম যন্ত্রণা করতে লাগলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি পড়ে যেতে নিলাম। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহুর্তে দেখলাম, আমার মা আমার কাছে এসে বলছে হাল ছেড়ো না মা। টিকে থাকো৷ যেভাবে পারো সেইভাবেই।

চলবে….