#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (অন্তিম পর্ব)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
তখন বিবাহ লগ্ন চলছে। লাল ওড়ানায় বড় ঘোমটা টেনে বসা আছে বধূবেশী মুন। সামনে নিকাহ পার্টিশন।
সহজ ভাষায় ফুলের দেয়াল। দুইপাশে বর কনে। তাদের পাশে স্বপক্ষীয়রা। বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। মুনের হাত পা কাঁপছে। চোখে জল। মাথা নিচু করে বসে আছে। তারিনা মেয়ের হাত ধরে আছেন। রুবাব একটা হাত বোনের মাথায় দিয়ে অভয় দিচ্ছে। সৈকত শান্ত স্বাভাবিক ভাবে বসা। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। তখন কবুল বলতে বলা হলো। সৈকত চোখ তুলে চাইল। ফুলের ফাঁক গলিয়ে আবছা দেখা প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে ঘোর নিয়ে চাইল। ওর বুক কাঁপল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। আকস্মিক শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষটার চোখ চিকচিক করল। সেই ছলছল চোখে চেয়েই বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল
আলহামদুলিল্লাহ কবুল
আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’
সৈকতের ভেতরের তোলপাড় বইছে। চোখে ঘোর লাগছে। সেই ক্ষণে রিনরিনে কাঁপা নারী কন্ঠি ‘কবুল’ ভেসে এলো। চোখের পানি ছেড়ে মায়ের হাত ধরে, সৈকতের দিকে চেয়ে কবুল বলল মুন। সৈকতের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। চোখ ছলছল, ঠোঁটে হাসি। সুখী সুন্দর দেখাচ্ছি ওকে!
সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। সৈকত টিস্যু দিয়ে চোখ মুছল। মনির শেখ এসে আগলে নিলেন। রুবাব এসে কাধ চাপড়ে বলল,
” শেষ অবধি তবে আমার ছোটো বোনের জামাই হয়েই গেলি। এবার আমারে পা ধরে সালাম কর।”
সৈকত উত্তর দেবার আগেই অন্তর মিষ্টি নিয়ে এলো। রুবাব বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
” যা ডিসকাউন্ট দিলাম। আমার পা ধরে সালাম করা লাগবে না। খালি আমার শা লা র সাথে কোলাকুলি করে চাইলেই হবে। ”
সৈকত হেসে বলল, ” শা লা, আউট অব ডেঞ্জার হয়ে গেছে। আর কত শোধ নিবি?”
রুবাব অসন্তোষের স্বরে বলল, “বহুত শোধ। শালা আমারে আগে যেমন জ্বালাইছে, এখনো তেমন জ্বালাচ্ছে। আজ বলে কি না সেঁজুতিরে নিয়ে যাবে। দু’দিন পর দিবে। কী অত্যাচার ভাব! ”
বেচারা বউয়ের বিরহে রাগে ফেটে পড়ছে। বন্ধুরা মুখ চেপে হাসল। সৈকত সত্যিই সাদাত থেকে দোয়া নিল। বিনিময়ে সাদাত হেয়ালি করে বলল,
” তোমার আকাশের চাঁদ তবে তোমারই রইল। অনেক ভালো থেকো।”
সাদাতের মুখে একটা অপ্রতিভ ভাব। ছেলেটাকে ভারি পছন্দ হয়েছিল। রুবাব আর সৈকতের তুলনায়, সব দিক দিয়ে এগিয়ে সৈকত। বোনের জীবনে কেন যে সৈকত এলো না, তার একটা আফসোস রয়ে গেল।
দূর থেকে শ্যালকের মুখ দেখে রুবাব ফুঁসে উঠল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
” অন্তর মিষ্টি আর দুইটা বেশি করে খাওয়া। ”
সৈকত দোয়া নিয়ে আসতেই বলল, ” সৈকত আমি কাল রাতের জন্য টিকেট কাটতেছি। কক্সবাজার যাব। মুনকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবি না?”
সৈকত অবাক হলো, ” কবে প্ল্যান করলি, বললি না।”
রুবাব নাক লাল করে বলল, “এখনই প্ল্যান করছি। কাল যাব মানে যাব। আগামী একমাসে ও ঢাকা ফিরব না।”
বন্ধুরা সবাই কারণটা বেশ বুঝতে পারল। সাদাত টের পেল না, তার আফসোস তাকে বোনহীনা করে দিবে ।
_______________
পরের সময়টা সৈকতের কাছে স্বপ্নই মনে হলো। সেই বহু আগে দেখা অলীকের মতো। সব যেন অলীকের দৃশ্যের সাথে মিলে গেল। সেই উঠোন, সেই স্টেজ, সেই সাজের বধূ।
বন্ধ চোখে অলীকডোরেই পরিণয় বাস্তব হলো। নীল কাগজের বুকে গট গট করে লিখল নিজের নামটা। সাক্ষর করবার পর তার প্রসন্নতা। তারপর লাল টুকটাক বউকে এনে বসাল তার কাছেপাশে। স্টেজে কাছে পাশে দুজনা। অলীকের মতোই দুজনার মাথা এক করে ওড়নায় ডাকা হলো। দুজনার সামনে নকশি আয়না ধরতেই ভেসে উঠল মেরুন শেরওয়ানির সুদর্শন যুবক এবং লাল বেনারসি পরিধেয় লাল টুকটুকে বউয়ের মুখখানা।
বধূবেশী কন্যার পানে সরাসরি চোখ পড়ল সৈকতের। আয়নায় চোখ রাখতেই দৃষ্টি আটকে গেল। গোলাকার মায়া মায়া মুখখানা কী মিষ্টি দেখাচ্ছে! মুখে প্রসাধনীর বাহার, তা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে লাজুকতা। ভারি আস্তরের পল্লব বারবার উঠানাম করছে, লাজুক টানা চোখের দৃষ্টি নিজের কোলেতেই নিবদ্ধ। সৈকতের চোখে চোখ রাখবার সাহসটি হচ্ছে না তার। লজ্জাবধূকে দেখে চোখে ঘোর লাগল সৈকতের। অলীকের মতোই ওদিকে পাশ থেকে সেঁজুতি প্রশ্ন করল ,
“আয়নায় কী দেখতে পারছেন?”
সেই প্রশ্নখানার উত্তর দেবার খেয়ালটি নেই সৈকতের। সে তো বিভোর হয়ে আছে তার নারীতে। লোকলজ্জা ভুলে আয়না থেকে চোখ উঠিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সে। যেন আয়নায় দেখে চক্ষুতৃষ্ণা মিটছে না তার। সেই চাওয়া ক্ষণ পেরিয়ে দীর্ঘ হলো, সৈকত চেয়ে রইল অনিমেষ । তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে। ভরা মজলিসে তার ওমন চাহনি দেখে হাসির রোল পড়ল। ঠাট্টা আর হৈহৈ এ পরিবেশ ভারি হলো। এক ভাবি টিপ্পনী কাটল,
“সব দেখা এখনই দেখে ফেলবে না কি দেবরজি! কিছু দেখা রাখো বাসর ঘরের জন্য!”
বরমশাইয়ের সেসবে খেয়াল নেই। সে মত্তমনে দেখছে তার হৃদহরণীকে। বধূবেশি কন্যা এমনিতেই লজ্জায় লাল হয়েছিল উপরন্ত আশপাশ থেকে ভেসে আসা হাসি ঠাট্টা আর বরের ওমন চাহনিতে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে পড়ছিল যেন। ক্ষণ কাটল অনেক। তারপর ধ্যান ভাঙাতে এগিয়ে এলো বন্ধু অন্তর। কাধ চাপড়ে বলল,
“কিছুক্ষণ পর ডিনার করে বাসায় পাঠিয়ে দিব তোদের। তখন বউকে পাশে বসিয়ে সারারাত দেখিস। এখন ঘোর ছ্যাইড়া উত্তর দে।”
এতেই ধ্যান ভাঙল সৈকতের। চারপাশে তখন হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার দৃশ্য চলছে। বেশ বিব্রতবোধ করল সৈকত। নড়েচড়ে বসল সে। সে কী অস্বস্তি তার! সৈকতের অবাক লাগল। সব যেন স্বপ্নের মতোই হচ্ছে। এ যেন স্বপ্নের জীবন্ত রূপ। সে আয়নায় চাইল এক পলক। মেয়েটার অস্বস্তির পরিমাণ তার থেকে বেশিই ঠেকল। সৈকত বোকা হাসল। টিপ্পনী কাটা ভাবি আবার টিপন্নী কাটল,
“তোমার দেখার পর্ব শেষ হলে বলো, আয়নায় কী দেখতে পারছো?”
সৈকত আবার চাইল আয়নায়। লাবণ্যময়ীর পানে এক নজর দিতেই উত্তরটা আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, “আমার অলীকডোরের চন্দ্রকথা।”
মর্মার্থটা কেউ বুঝল না। এমনকি মুন ও না। সৈকতের স্বপ্নের কথা তার ও অজানা। না জেনেও সবাই হৈহৈ করল। প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে বলা কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই আয়নায় বরের মুখ পানে চাইল সৈকতের চন্দ্রকথা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ল দুজনার। তড়িৎ চোখ সরাল লাজুকলতা। এবার তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করা হলো,
“আয়নায় কী দেখতে পারছো, মুন?”
লাজুকবধূ নামানো দৃষ্টি আবার তুলল, চাইল সৈকতের পানে। তার ঠোঁটের কোণে লজ্জার সাথে হাসির রেখা ফুটে উঠল। চোখের ভাষা ভিন্ন। স্থির, প্রগাঢ়, অর্থবহ। যেন সে কথায় নয় চাহনিতেই উত্তর দিল। সেই দৃষ্টির গভীরতা এতখানি ছিল যে সৈকতের হৃদপিণ্ড চলকে উঠল। মুন স্মিত হেসে বলল,
” আমার প্রেমসমুদ্র।”
অলীকে মুনের উত্তর শোনা হয়নি। এই উত্তরের জন্য সৈকত ভীষণ উদগ্রীব ছিল। উত্তরখানা শুনেই সৈকত বিমোহিত। ‘প্রেমসমুদ্র!’ কথাটা ক’বার বাজল কানে। সৈকত টের পেল ওর মনের আলোড়ন। মেয়েটা পুরো হৃদয়টাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
____________________
বিয়ের পর জুতো চুরির পালা এলো। চুরি করছে অন্তর। কায়দা করে জুতা সরিয়ে নিয়ে বাড়ির ভেতরে লুকাতে এলো। লুকিয়ে ফিরবার সময় দেখা হলো রুবাবের বিয়েতে দেখা সেই সুহাসিনীর সাথে। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অন্তর বলল,
” বরপক্ষের হয়ে কনের পক্ষের আশপাশে কী? জুতোর সন্ধান দিবে ওদের? ”
মেয়েটা প্রথমে বোধহয় বুঝে উঠতে পারেনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ধাতস্থ হতেই নাক ফুলিয়ে বলল,
“আমাকে মীরজাফর মনে হয়, আপনার?”
অন্তর তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। ভ্রু কুঁচকে, স্থির চোখে চেয়ে রইল কয়েক পল। তারপর হুট করেই হেসে ফেলল। দু’কদম এগিয়ে মেয়েটার নাকে টোকা দিয়ে বলল,
“না, বেগম লুৎফুন্নেসা মনে হয়।”
সামনের দিকে হাঁটা ধরল অন্তর। মেয়েটা নাকে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। ছেলেটার আচরণ, কথা সব। লুৎফুন্নেসা কে? খানিক বাদে মনে পড়ল, সিরাজুদ্দৌলার স্ত্রী। সে সিরাজুদ্দৌলার স্ত্রী হতে যাবে কেন? কোন এঙ্গেলে বলল কথাটা? মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,
“সিরাজুদ্দৌলা কে?”
অন্তর ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। কেমন রহস্য করে হাসল। তারপর চলে গেল। মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভাবতে বসল।
এখানে হাজার দশেক টাকা খসিয়ে নিল অন্তর। সৈকত ক্ষোভ নিয়ে বলল,
” যতটাকা নিচ্ছিস, সব সুধে আসলে যদি শোধ না করব। খালি তোর বিয়েটা হতে দে। আমিও কনেপক্ষ হবো।”
________________
বিদায়বেলা। কান্নার রোল পড়েছে। মাকে ধরে কাঁদছে মুন। তারিনাও কাঁদছেন। রুবাব চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সৈকতের চোয়াল গম্ভীর। মুনের কান্না দেখতে ভালো লাগছেনা তার। বোন নেই বলে বিদায়ের মুহুর্ত ঠিকঠাক অনুভব করতে পারেনি কখনো । তবে এটুকু বুঝতে পারে যে, এটা বেশ কষ্টদায়ক মুহুর্ত। মুন শেখ বাড়ির প্রাণ। সেই প্রাণ চলে যাচ্ছে, কষ্ট হবারই কথা। তারিনার আর্তনাদ বুকে বিঁধল খুব। মুনের কান্না দেখে ইচ্ছে হলো বলতে, কষ্ট হলে থেকে যাও, আমি জোর করব না। তাও প্লিজ কান্না করোনা! তোমার কান্না সহ্য হয় না আমার।
কিন্তু বলতে পারল না। নিয়ম যে নিয়ে যাবার। রেখে যাবার সাধ্য কি তার? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৈকত। রুবাব বন্ধুর পাশে এসে বলল,
“তুই আমার বোনটাকে নিয়ে যাবি?”
সৈকত অসহায় চোখে তাকাল। রুবাব কী বিষন্ন, করুণ দেখাচ্ছে। চোখমুখ গুমোট, রক্তিম হয়ে আছে। রুবাব অনুরোধের সুরে ফের বলল,
“প্লিজ তুই ওকে নিয়ে ঢাকায় থাকিস। দূরে যাস না। আমরা ওকে কখনো দূরে রাখিনি।”
সৈকত বন্ধুর পিঠে হাত দিল, ” তোদের অফিসের পাশেই বাসা নিয়েছি। যখন তখন দেখতে পারবি। মন খারাপ করিস না।”
রুবাব হুট করে ইমোশনাল হয়ে গেল। গলা কাঁপিয়ে বলল,
“আমি কখনো মুনের সাথে উঁচু গলায় ও কথা বলিনি। ও সবসময়ই ভালোবাসাতেই থেকেছে। ওকে ভালোবাসাতেই রাখিস।”
সৈকত হাসল একটু, ” আমার ভালোবাসাতেই আমার বউ হয়েছে। চিন্তা করিস না। আমি ওর খেয়াল রাখব। ”
রুবাব ফের বলল, ” মুনের জন্য তোর সাথে আমি খুব রুড হয়েছি। তুই ভাবিস না এতদিন যা করছি, তার জন্য তোকে স্যরি বলব। আমি স্যরিনোটে আস্ত একটা বোন দিয়ে দিয়েছি তোকে। কষ্ট দিস না ওকে।”
সৈকত আকস্মিক জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে। কৃতজ্ঞ সুরে বলল, “থ্যাঙ্কিউ! ”
রুবাব বন্ধুর পিঠ চাপড়ে বলল, ” আমার বোনটাকে নিয়েই সুখে থাক। ওকে খুব ভালো রাখিস। ”
রুবাব নিজেই সৈকতের হাতে বোনের হাত তুলে দিল। তখন ওর চোখ ভিজে এলো। বোনের মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
“ভাইয়া আছি সবসময় তোর সাথে। একটুও মন খারাপ করবি না। এই শা লা রুড হলে বলবি আমায়। বন্ধু টন্ধু মানব না। গিয়ে হাত পা ভেঙে আসব।”
মনির শেখ এসে বিদায় দিলেন। মুন কেঁদে মুর্ছা যাবার মতো অবস্থা। শেষে সইতে না পেরে সৈকত এসে হাত ধরল ওর। নরম সুরে বলল,
” চন্দ্রকথা, তুমি আমার সাথে যাচ্ছো। দু’দিনের জন্যই তো। তারপরই নিয়ে আসব এখানে। পর হচ্ছো না, এ বাড়ির মেয়েই আছো, থাকবে। কান্না থামাও প্লিজ!”
গাড়িতে নিয়ে তুলল মুনকে। পিছনে ওরা দুজন বসল। সামনে অন্তর আর ড্রাইভার। মুনের কান্না থামেনি তখনো। সৈকত ওর কাছ ঘেঁষে বসল। আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আর কান্না নয়। এবার শান্ত হও প্লিজ! ”
মুন যেন এক টুকরো ভরসা পেল, এমন করে ছলছল চোখে চাইল সৈকতের পানে। সৈকত চোখে চোখ রেখে হাসল। ভরসা দিল। মাথাটা টেনে নিল কাধে। মুন মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝল। সৈকত আলতো হাতে আগলে নিল।মুন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত নেমেছে। অন্তর গাড়িতে উঠেই ওদের স্পেচ দিতে গাড়ির বাতি নিভিয়েছে। সৈকত অন্ধকারে পথ দেখছেনা। চারদিকে ইতিউতি করে বলল,
“কতদূর এগুলো অন্তর?”
” সবে মিনিট বিশেকের পথ পেরিয়েছি। ঢাকায় এখনো। ” ধীরে উত্তর দিল অন্তর। সৈকত অবাক হয়ে বলল,
” আমরা রওনা দিয়েছি ঘন্টা পেরিয়েছে। আর তুই বলছিস মিনিট বিশের রাস্তা! তোরা যাচ্ছিস কোনদিক দিয়ে। ”
অন্তর ক্ষীণ স্বরে বলল, ” মুন ঘুমিয়েছে?”
সৈকত আঁধারেই ঘুমন্ত নববধূর পানে চেয়ে একটু হাসল,
” হ্যাঁ। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম।”
অন্তর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
“কাল রুবাবের বউ বাড়ি নেয়ার পর যা কাহিনি হইছে, তুই মিস করে গেছস।”
সৈকত আগ্রহ নিয়ে বলল, ” কী হইছে।”
অন্তর রুবাবের রাগের কথা বলল। সৈকত হেসে ফেলল। “শা লা একটু বেশি হাইপার।”
“হাইপার হইয়্যা ও বউরে উদ্ধার করতে পারেনাই। সেঁজুতি ভাবি আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে প্যানিক এ্যাটাক করে ফেলতো। মেয়েটা কেঁদেকেটে অস্থির, তার উপর পান চিনির নামে যা টর্চার হইছে। কয়েকজন পারলে মাথায় বন্দুক ধরে মিষ্টি খাওয়ায়। দেখে আমার নিজেরই রাগ লাগছিল। ” অসন্তোষের গলায় বলল অন্তর।
সৈকত ভ্রু কুঁচকাল। পরক্ষনেই ভ্রু ভাঁজ মিলিয়ে গেল। সে ইঙ্গিত পেল কিছু। এই ক্ষণে অন্তরের লম্বা কেচ্চা শুনানোর মানে ধরতে পারল। সে শান্ত স্বরে বলল,
” চিন্তা করিস না, তোর বোন পড়বে না সেই পরিস্থিতিতে। ”
অন্তর ফের অসন্তোষের গলায় বলল, “সিফাতের সাথে কথা বলে জানলাম, তোদের ওদিকে এরচেয়ে বেশি প্রথা আছে। ইভেন, মুরুব্বি মহল আগে রওনা হয়েছে তার প্রস্তুতি নিতে। মুন কেঁদেকেটে অস্থির, তারউপর লং জার্নি। যেতে যেতে কাহিল হবে, এর উপর এত রীতি পালন করতে হবে। কী পরিমাণ প্রেশার যাবে, জানিস? রুবাব হাইপার হইয়্যাও আটকাইতে পারেনি, তুই কূল হইয়্যা কিভাবে আটকাবি ?”
সৈকত ড্রাইভারকে বলল, ” চাচা, গাড়ি দ্রুত টানেন। মাঝে লম্বা ব্রেক নিতে হবে।”
অন্তর উত্তর পেয়ে গেল। প্রথমে চমকে চাইল। পরক্ষণেই হেসে বলল, “এই না হইলে দুলাভাই! ”
সৈকত হাসল, ” তা শালাবাবু আপনার প্ল্যানটা কী ছিল?”
” ঘুরে টুরে সাড়ে এগারোটা বারোটায় পৌঁছাব। ততক্ষণে মহিলামন্ডল ছত্রভঙ্গ। ”
” তবে তাই হোক। আমার দুইমাত্র শালা বলে কথা, মানতেই হয়।”
মাঝপথে সৈকতের ডাকে ঘুম ভাঙল মুনের। হকচকিয়ে উঠে বলল,
“আমরা পৌঁছে গেছি!”
অন্তর আর ড্রাইভার গাড়ির বাইরে। সৈকত হেসে বলল,
” তুমি তো দেখি ভালোই এক্সাইটেড। ”
মুন ঘুম জড়ানো সুরে মুখ কুঁচকাল, “বাজে বকবে না।”
সৈকত হেসে ফেলল।
“চলো!”
“কোথায়? কেন?”
মুনের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ” টু সেলিব্রেট আওয়ার ফার্স্ট নাইট।”
মুন বিস্মিত চোখে চাইল। সৈকত ওর হাত ধরে বের করল। সম্মুখে চাইতেই মুন হতভম্ব হয়ে গেল। এক নদীর ধারে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ছোট্টো একটা টেবিল, বেলুন বাতি। মুন অবাক হয়ে চাইতেই সৈকত ওকে এগিয়ে নিতে নিয়ে বসাল। টেবিলে সাজানো মুনের পছন্দের সব খাবার। একপাশে একটা কেক রাখা। তাতে লেখা,
“ওয়েলকাম টু মাই লাইফ, চন্দ্রকথা।”
মুন অভিভূত হয়ে বলল,
“এসব আমার জন্য?”
“না মিসেস সাফায়েতের জন্য।” কোমল হাসল সৈকত।
মুন মুগ্ধ চোখে চারদিক তাকাতে লাগল। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। চাঁদের প্রতিবিম্ব এসে পড়ছে নদীর বুকে। এক পালি আলো এসে পড়ছে সৈকতের লাল টুকটুকে বউয়ের মুখপানে। চাঁদনি আলোতে মুনকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছিল। সৈকত মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে হাসি বাড়ল। মুখোমুখি চেয়ার থেকে উঠে পাশের চেয়ারটায় বসল। মুন চকিত চাইল। সৈকত অধর বন্ধনে জড়িয়ে নিল। মুনকে আরক্তিম করে বলল,
“আমার চন্দ্রকথা!”
মুন হৃদ ছলকানিতে কথা বলতে পারল না। চুপটি করে রইল অনেকক্ষণ। হুট করেই সৈকতকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এ কান্না সুখের। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাবার সুখ। শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
“আমি তোমাকে হারাইনি তবে!”
সৈকত ওর মাথায় হাত রেখে হাসল। বার দুয়েক হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়ে মেয়েটা এত কাঁদছে। তবে তার কেমন কান্না করা উচিত? সে তো হাজারবার হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে। কত রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছে। হুট করেই বাড়িতে ছুটেছে, ওর থেকে পালাতে যেতে এক্সিডেন্ট করে হাত ভেঙেছে। বিয়ের কথায় হৃদয় ভেঙেছে, কত কষ্টে বিয়ে ভেঙেছে, এই মেয়েটার জন্য বন্ধুর সাথে যুদ্ধ করেছে, মায়ের সাথে বেয়াদবি করেছে, পাগলের মতো পড়ে বিসিএস দিয়েছে। কত হাজার মন ভাঙার গল্প আছে আজকের দিনটা আসার পেছনে, মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য। সবকিছুর পর সে পেয়েছে, হারায়নি। সে গল্প কি জানে মেয়েটা? জানে না। সৈকত কইল মৃদ্যু স্বরে,
“চন্দ্রকথা
তুমি আমার জীবনে স্বপ্ন হয়ে এলে,
বাস্তব হয়ে ধরা দিলে
প্রেম হয়ে হৃদয় ছুঁলে
বউ হয়ে পূর্ণতা দিলে। ”
” স্বপ্ন!” ভ্রু নাড়াল মুন। সৈকত হাসল,
“হ্যাঁ, স্বপ্ন, অলীক। অলীকডোরেই আমি তোমাকে প্রেমের চোখে প্রথম দেখেছি।”
মুন মাথা তুলল। বিস্মিত চোখে চেয়ে বলল,
” অলীকে কারো প্রেম হয়?”
” প্রেম হয় তো, যেমন আমার হয়েছিল তোমার প্রতি। এক দেখার এক পলকেই। আমি স্বপ্ন ভুলে যাই, কিন্তু সে স্বপ্ন ভুলতে পারিনি। পারিনি তোমায়। আমি বারংবার পালাতে চেয়েছি, কখনো পাওয়ার ভয়ে, কখনো হারানোর ভয়ে। কিন্তু আমি পারিনি পালাতে, না তোমার থেকে আর না অনুভূতি থেকে। আমার আকাশে সেই যে অলীকডোরে চাঁদ এসে বসল, আর নামল না কখনোই। ভালোবাসা কমল না, বরং বেড়ে গেল। আমার মন, ঘর সবটা ছেয়ে গেলে চন্দ্রকথায়। ”
প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে বলল সৈকত।
মুন বিমোহিত। বাকরুদ্ধ। মুগ্ধতায় মুখ ঘিরে গেল। চমৎকার এই কথাগুলো জানতো না সে। স্বপ্নপ্রেম! চন্দ্রকথার পেছনকার ঘটনা কী সুন্দর! মুন চমৎকৃত হলো। মনটা হুট করেই ভালো হয়ে গেল। ওর মন প্রজাপতিদের উড়িয়ে সৈকত গভীর স্বরে বলল,
“ভালোবাসি চন্দ্রকথা, সেই অলীকডোর থেকেই। ”
মুনের শ্বাসটা আটকে এলো ফের। বারবার কানে ধ্বনি তুলল ‘ভালোবাসি’ শব্দটা। আবেশে চোখ বুঝল। সৈকত পরম আদরে আগলে নিয়ে বলল,
” হাজার মন ভাঙার গল্পের পর পেয়েছি আমি তোমাকে। আমার চন্দ্রকথা, আমার বউ!”
___________________
রাত করে বাড়ি ফিরে, সকল দোষ নিজের কাধে তুলে নিল অন্তর। মুরুব্বিমহল ক্ষেপে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তা পরিস্কার। সুরমা একাই বউবরণ করে ঘরে তুললেন। রাত বেশি হওয়ায় ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। অন্তর হাঁফ ছেড়ে ছাদে গেল। যাক, এবার নিশ্চিন্ত সে। নাহিদ বন্ধুকে দেখে বলল,
” শা লা এত দেরি করলি ক্যান, কথা প্যাঁচাইতে প্যাঁচাইতে জিলাপি বানাইয়্যা ফেলছি। গ্রামের মুরুব্বিগুলো এত জটিল!”
অন্তর সার্থকতার হাসি দিল, ” দুলাভাই আপারে নিয়া রোমান্টিক ডেটে গেছিল, আমি বইসা পাহারা দিছি। ”
থেমে বলল, “জটিল বইলাই দেরি হইছে। সোজা হইলে তাড়াতাড়িই আসতাম।”
নাহিদ অন্তরের দিকে তাকাল। অন্তরকে ভীষণ সুখী দেখাচ্ছে। মনির শেখ সৈকতকে মেনে নেয়ার পর এমন সুখী দেখিয়েছিল রুবাবকে। সেই সুখটা এখন ভাসছে অন্তরের মুখে। ছেলেটা মুনকে একবারে বোনের জায়গা দিয়ে দিয়েছে। বন্ধু অন্তরকে দেখেছে অনেক, কিন্তু ভাই অন্তরকে যেন এই প্রথম দেখছে নাহিদ। ছেলেটা সম্পর্কের মর্যাদা দিতে জানে। বোনের পারলে, বউয়ের পারবে না?
নাহিদ ভাবুক হয়ে ভাবছিল। অন্তরই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
” শুনলাম তুই না কি আমারে ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করছস? ঘটনা কি?”
নাহিদ অবুঝের ভান করল, ” কিসের ঘটনা?”
অন্তর হেয়ালি করল, ” শা লা টালা হইয়্যা যাইতাছস না কি! সৈকত তো বন্ধুর বোনরে বিয়ে কইরা লোভে পইড়া গেছে। সেই লোভের পাপ বানাইতেই আমার পিছে পড়ছে।”
নাহিদকে শান্ত দেখাল, ” তুই কী ভাবছিস?”
অন্তরের হেয়ালি গেল না, ” ভাবলে কি তুই পুলিশ হইয়্যা সাদাত ভাইয়ের রোল প্লে করবি? ডান্ডা নিয়া তাড়াইয়্যা গুয়ের টাংকিতে ফেলবি? ”
ওর হেয়ালি দেখে নাহিদ রেগে গেল,
” শা লা কবে সিরিয়াস হবি তুই? তোর চিন্তায় আধামরা হইয়্যা যাইতেছি আমরা। এবার তো সিরিয়াস হ!”
অবচেতন মনেই বলে দিল নাহিদ। অন্তর অবাক হয়ে চাইল,
“আমারে নিয়া কী চিন্তা করতেছস সবাই? ”
” তুই বাপ্পারাজ হইয়্যা ঘুরবি আর আমরা ভাং খেয়ে নাচব?”
আক্রোশে ফেটে পড়ল নাহিদ। অন্তর হতভম্ব। ওরা কিভাবে টের পেল! সে তো কারো কাছে প্রকাশই করেনি। ইভেন, সবার সামনে হাসিখুশিই থাকছে।
খানিক বাদে স্মরণে এলো ওর বন্ধুদের তো মন পড়ার ক্ষমতা আছে। বন্ধুদের সব বলা লাগে না। বলার আগে বুঝে ফেলাটাই ওদের বন্ধুত্বের ধর্ম। সৈকতের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলার কারণ এতক্ষণে বুঝতে পারল অন্তর। রুবাব ও আজ সকাল বেলাও ওকে বলছিল,
” অন্তর গোছগাছ শুরু কর। আমাদের বিয়া শেষ হইলেই তোর পালা। তোর বিয়েটা এবার দিয়েই ছাড়ব। আমরা দুঃখে ভাসব আর তুই বিন্দাস ঘুরবি, তা হবে না।”
জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিয়ে। সেই বিয়েতে মানুষ নিজের ভাবনায় মত্ত থাকে, অথচ তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে ভাবছে! নিজেদের সাথে তার জীবনের হেতু করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে! আর আরেকজন নিজের বোনটাই বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে। নাহিদের চোখমুখ দেখেই ধরে ফেলেছে, নাহিদ যে বিয়ের জন্য রাজি। অন্তর আনমনে হাসল, এমন বন্ধু কজনার হয়! ভাগ্য করে পাওয়া যায়। নাহিদ ওকে হাসতে দেখে বলল,
” এই রাত দুপুরে হুদাই হাসতাছস ক্যান? জ্বিনে ধরছে? ওঝা ডাকব?”
অন্তর হাসল ফের।
“ওঝা না, লুৎফুন্নেসারে ডাক।”
“লুৎফুন্নেসা কেডা? ” ভ্রু কুঁচকাল নাহিদ। অন্তর চুলে ব্রাশ করে বলল,
“সিরাজুদ্দৌলার বউ।”
“আমারে ইতিহাস শিখাইতে আসবি না। কাহিনি কি ক? ”
অন্তর মাথা চুলকে বলল, ” কাহিনি হইল, লুৎফুন্নেসারে পছন্দ হইছে আমার।”
নাহিদ অবাক হয়ে অন্তরের দিকে তাকাল। অন্তরের মুখে আড়ষ্টতা। সত্যিই পছন্দ হয়েছে কাউকে? একটু হতাশ হলো নাহিদ। এবার সাদাত ভাইয়ের মনের ব্যাথা অনুভব করতে পারল। তা সরিয়ে বলল,
“তুই লজ্জা পাচ্ছিস! দাঁড়া, ছবি তুলি। কাল রুবাব আর সৈকতরে দেখাব। লজ্জাবতা অন্তর! ”
অন্তরের গলায় ক্যামরা ঝুলানো ছিল। নাহিদ ওর ক্যামরায় ওর ছবি তুলল। অন্তর বাঁধা দিল না। আরও পোজ দিল। নাহিদ শান্ত হয়ে বসল অন্তরের পাশে। অন্তর ওর পাংশুটে মুখ দেখে বলল,
“আমারে তোর এতই পছন্দ হইছে যে, বোন বিয়ে দিতে না পারায় দুঃখের সাগরে ভেসে যাচ্ছিস!”
নাহিদ প্রতিবাদ করল,
“আমি বলিনাই যে বোন বিয়া দেয়ার জন্য মত দিছি।”
” খালি তোরাই আমার মন পড়তে পারিস, আমি পারি না?”
নাহিদ অসন্তোষের শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তাইলে ওই চ্যাপ্টার বাদ। তোর কথা ক, ক্যামনে কী?”
“কালকে রুবাবের বিয়েতে দেখতেই ভালো লেগে গেছে। মনে হইতেছে, ওমন একটা মেয়ে আমার মনে ঘরে থাকলে মন্দ হয়না। ” সুন্দর হাসল অন্তর।
“রুবাবের বিয়েতে? কে? আমি চিনি?” উদগ্রীব হলো নাহিদ। অন্তর উৎফুল্ল হয়ে বলল,
” ছবি আছে, দ্যাখ, চিনিস কি না!”
নাহিদ থেকে ক্যামরা নিয়ে রুবাবের বিয়ের দিন তোলা ছবিটা দেখিয়ে বলল,
“সি ইজ মাই লুৎফুন্নেসা।”
ছবিখানা দেখে নাহিদ আক্কেলগুড়ুম। হতভম্ব হয়ে গেল। অন্তর উঠে দাঁড়াল। ক্যামরা নিয়ে বলল,
” কিউট না? ওর হাসি থেকে রাগ বেশি সুন্দর। ”
নাহিদ রেগে তাকাল। অন্তর হাসি থামিয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আই সোয়্যার, কালকের আগে আমি কিছু ফিল করিনি।”
নাহিদ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ” শা লা….
ওকে থামিয়ে অন্তর বলল,
“বর্তমানের সিরাজুদ্দৌলা আমি। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”
অন্তর ছাদের দরজার দিকে হাঁটা ধরল। কয়েক কদম এগিয়ে ফের পিছু চাইল। নাহিদকে বলল,
” হিস্ট্রি রিপিট হলে মন্দ হবে না। ”
____________________
সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় ভাগ্যক্রমে লুৎফুন্নেসার সাথে দেখা হলো। কন্যামহল না ঘুমিয়ে কোণার এক ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেয়েটা পানি খেতে বেরিয়েছে রুম থেকে। অন্তরকে দেখেই দুপুরের কথা ভেবে রাগ নিয়ে চাইল। অন্তর হাঁটা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
” কী খবর না হওয়া বেগম লুৎফুন্নেসা? এত রাগ কেন?”
লুৎফুন্নেসা নাক ফুলাল,
“আশ্চর্য, আপনি আমাকে লুৎফুন্নেসা ডাকছেন কেন?”
অন্তর উত্তর দিল না। স্থির চোখে চেয়ে রইল। লেমন কালারের একটা থি-পিস পরেছে মেয়েটা। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। পাঞ্চ ক্লিপ বেধ করে ক’টা চুল গালে বেয়ে নিচে নেমেছে। মুখে প্রসাধনীর লেশমাত্র নেই। শ্যামবরণ মুখ, টানা চোখ। উঁচু নাকটা লাল হয়ে গেছে রাগে। চাহনিতে রাগ মিশিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে চেয়ে আছে ওর দিকে। অন্তর অবাক হয়ে চাইল,
রাগলে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে! নাক লাল করাটাতে কী মায়া! খানিক চেয়ে অন্তর বলল,
“আমার ইচ্ছে।”
“আপনার ইচ্ছেতে সব হবে না কি!”
” সব হতে কে বলল? কেবল লুৎফুন্নেসা সিরাজের হয়ে গেলেই হবে।”
শান্ত স্বর অন্তরের। লুৎফুন্নেসা ফের নাক ফুলাল,
” কে সিরাজ? কোন সিরাজ? আমি কোন সিরাজকে চিনিনা।”
অন্তর চাপা হাসল, ” সিরাজ হলো, লুৎফুন্নেসার না হওয়া বর।”
মেয়েটা দ্বিধায় পড়ল। কিছুই বুঝল না। ঝগড়ায় না পেরে চোখ লাল করল। ফের নাক ফুলিয়ে বলল,
” কী আজব কথা বলছেন! আমি কিন্তু ভাইয়াকে বলে দিব।”
অন্তর কয়েক কদম এগিয়ে এলো। ফুলো নাকটা টেনে বলল,
” আপনার বলা লাগবে না। সবেই আমি আপনার ভাইকে বলে এলাম। আপনার ভাই আগেই সিরাজকে বেছে নিয়েছেন আপনার জন্য। ”
লুৎফুন্নেসা নাকে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। কোন সিরাজ? ভাইয়াকে কী বলেছেন উনি? কী হচ্ছে তার সাথে? লুৎফুন্নেসা বিভ্রান্ত হয়ে বলল
“মানে?”
ওর চোখের পলক পড়ছে ঘনঘন। ঠোঁট কাঁপছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল অন্তর। এমন রাগমাখা মুখটা প্রতিদিন দেখতে পারলে মন্দ হয়না।
অন্তর লুৎফুন্নেসার বিভ্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানে হলো, এ সপ্তাহে আমরা বিয়ে করছি। আগামী সপ্তাহে হানিমুনে যাচ্ছি। সিরাজের লুৎফুন্নেসা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন, না হওয়া বেগম।”
অন্তর ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে চলে গেল। হুট করেই কেন যেন বিয়ের ভূত চেপেছে বুঝতেই পারছেনা সে। প্রেম টেন না এবার সরাসরি বিয়ে করবে।
__________
সৈকতদের বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। পুকুরের দু’দিকে শান বাঁধানো ঘাট। একটা ঘাটে আয়েশ করে বসে আছে তিনবন্ধু। অপেক্ষায় আছে আরেক বন্ধুর। বাড়ির উঠোনে বিশাল ভোজনের আয়োজন চলছে। কোথায় কথা বলবার ফুরসত নেই। কাজ আর মানুষের ভীড়ে সৈকত বন্ধুদের সাথে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারেনি। একটু ফুরসত পেতেই ভীড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। এদিকটা নিরিবিলি আছে। তেমন কারো আনাগোনা নেই। রুবাব সৈকতকে বলল,
” সৈকত, আজ যাচ্ছিস তো নাকি!”
সৈকত ভ্রু কুঁচকাল, “কোথায়?”
রুবাব রাগ নিয়ে বলল, “কোথায় মানে? তুই কি ভুলে গেলি আজ আমাদের কক্সবাজার যাবার কথা? আমি অলরেডি টিকেট কেটে ফেলছি। ন’টার বাস। ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়েই একবারেই বেরিয়েছি। এখান থেকে ফেরার সময় তোদের নিয়ে যাব। ”
কাল থেকে আজকে ওদের সম্পর্ক ভিন্ন । কাল ছিল বন্ধু। আজ হলো শালা-দুলাভাই। অথচ ভাব পরিবর্তন নেই কিঞ্চিৎ। আগের মতোই আছে। কোন জড়তা নেই।
সৈকতের গলা চুলকে বলল, ” ভুলে গেছিলাম। আমি ভাবছিলাম, তুই ফান করতেছিস। এখন দেখি ত হুলস্থুল কান্ড বাঁধাই ফেলছস। বিয়ার পরদিনই হানিমুন! মা ছাড়বে কি না সন্দেহ। ”
” আমি আমার মাকে মানাতে পারলে তুই পারবি না? ”
“পারব। কিন্তু….
রুবাব ভ্রু কুঁচকাল, সৈকত অন্তরের দিকে ইশারা করল। এই ব্যাটার মতিগতি ভালো ঠেকছেনা। রুবাবের প্রসঙ্গ বদলে গেল। দুজনে কপাল কুঁচকে তাকাল অন্তরের দিকে। অন্তর স্থির চোখে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে মনোযোগ নেই ওর। অন্য ভাবনায় মত্ত সে। সৈকত ওরে ধাক্কা দিল,
” এই ব্যাটা? দার্শনিকদের মত কোন ভাবনায় হারাইয়্যা গেছস?”
অন্তরের ধ্যান ফিরল। দুই বন্ধুকে দেখে নিয়ে বাড়ির দিকে চাইল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘এই শা লা আইতেছে না ক্যান? ”
প্রসঙ্গ ঘুরানো দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল সৈকত অন্তর। গভীর চোখে পরখ করল বন্ধুকে। অন্তর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বারবার। খানিক বাদেই ওর ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল বন্ধুরা। একদল মেয়ে যাচ্ছে পুকুর পাড় দিয়ে। তাদের কারো দিকে তাকিয়ে আছে অন্তর। কার দিকে তাকাচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। রুবাব আর সৈকত রা না করে অন্তরের গতিবিধি পরখ করল। মেয়েগুলো ওদের পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল, তখন অন্তর হঠাৎ ডেকে উঠল,
“এই লুৎফুন্নেসা?”
মেয়ের দল থেমে গেল। কৌতুহলী হয়ে পিছু ফিরল। ফিরল না কেবল একজন। সে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাল রাতে লোকটা ওমন কথার পর লুৎফুন্নেসা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেছিল। সত্য হোক কিবা মিথ্যা, অন্তর ওর চোখে চেয়ে বলেছিল কত কথা! কিভাবে বলছিল, ” এ সপ্তাহে আমরা বিয়ে করছি! আগামী সপ্তাহে হানিমুনে যাচ্ছি। ” কী নির্লজ্জ! তবে কোথাও এক যোগসূত্র যে আছে তা ঢের ধরতে পারল। লজ্জায় সকাল থেকে সামনে আসেনি। বাড়িতে থাকলে যদি সামনে পড়ে এ জন্য বেরিয়েছিল, সামনের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে কোণার দিক দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানেই সামনে পড়তে হলো! লুৎফুন্নেসা পিছু ফিরল না। তাকাল ও না।
রুবাব সৈকতকে বলল, “এই ব্যাটার নজর কার দিকে?”
সৈকত ঠোঁট চেপে হেসে বলল, “তীর একবারে নিশানায়। ”
রুবাব বুঝল না। অন্তর ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
” না হওয়া বেগম লুৎফুন্নেসা, সিরাজ থেকে না পালিয়ে জোহরার মামাকে ডেকে দাও। ”
লুৎফুন্নেসা ইতিহাসের ছাত্রী বলে ন্যানো সেকেন্ডে জোহরার পরিচয় ধরে ফেলল। জোহরা নবাব সিরাজুদ্দৌলা আর লুৎফুন্নেসার মেয়ে। লুৎফুন্নেসার মুখখানা আরও লাল হলো। রুবাব কিংবা মেয়ের দল কেউ বুঝল না কথার মর্মার্থ। বুঝল কেবল তিনজন। একজন লাজুক হলো, একজন তার লজ্জায় মুগ্ধ হলো, আরেকজন অবাক হলো, এ শা লা তো রকেটের গতিতে চলতেছে।
মেয়ের দল হাঁটা ধরল। সৈকত প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল। সে চাহনি বুঝে অন্তর গলা ঝেড়ে কেশে বলল,
” আমি নাহিদকে হ্যাঁ বলে দিছি।”
এতক্ষণ না বুঝলেও এবার বুঝল রুবাব। খুশিতে লাফিয়ে উঠল, “সিরিয়াসলি! সাব্বাশ! এতদিনে একটা কাজের কাজ করছস। এবার বিয়া কইরা তিনজন একলগে কান্দুম।”
সৈকত ও হৈ হৈ করে উঠল। কাধ চাপড়ে বলল, ” আইসিইউতে না যাইয়্যাও সিরিয়াস হইলি তবে। ধন্য সিরাজদ্দৌলা।”
অন্তর বলল, “এদ্দিন বিয়া বিয়া করে মাথা খাইছস। এবার আমি রাজি হইছি। এসব প্রেম আমার দ্বারা হবে না। আমি সোজা বিয়ে করব। তাও এ সপ্তাহে । কিভাবে ব্যবস্থা করবি তোদের ব্যাপার। ”
হানিমুন নিয়ে হাজার স্বপ্ন সাজানো রুবাব খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
” সৈকত, আজকের যাওয়া ক্যান্সেল। অন্তরের হইলে একসাথে যাব।”
যেতে যেতে শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ করে সবটা শুনল লুৎফুন্নেসা। এতক্ষণে ঘটনা বিশ্বাস হলো। সে ভেবেছিল, নিচক ফ্লার্ট করছে। কিন্তু ভাইয়ের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব গিয়েছে জানেনা। যেভাবে কথা বলল, মনে হচ্ছে সত্যিই এ সপ্তাহে বিয়ে হয়ে যাবে। বুক কেঁপে উঠল লুৎফুন্নেসার। তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। দেখল প্রাণবন্ত পুরুষ তার পানে চেয়ে আছে। গভীর চাহনি। চোখাচোখি হতেই কিভাবে যেন হাসল। হৃদস্পন্দন থেমে গেল মেয়েটার। শ্বাস আটকে এলো। তড়িৎ চোখ সরাল। ছুটে পালাল।
অন্তর শব্দ করেই হেসে ফেলল। নাহিদ এলো এর মাঝে। রুবাব আর সৈকত ওকে ঘিরে ধরল। রুবাব গম্ভীর মুখে বলল,
” নাহিদ, অন্তর আজ তোরা দুজনই আমাদের বাসায় ফিরবি। কাল আমি আর সৈকত মিলে বিয়ের কথা উঠাব। তোরা জাস্ট নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকবি। বাদবাকি ম্যানেজের দায়িত্ব আমাদের।”
নাহিদ অবাক হয়ে বলল, “তোরা না আজ হানিমুনে যাইতেছস?”
রুবাব দৃঢ়স্বরে বলল, ” আগে অন্তরের বিয়া, তারপর বাকিসব।”
সৈকত অন্তরকে বলল, ” আমার বিল্ডিংয়ে দোতলায় একটা বাসা খালি আছে। বিয়ে শাদী করে বউ নিয়ে উঠে যা। বিবাহিত জীবনের দুঃখলাপ করব দুজন একসাথে। ”
নাহিদ এসে অন্তরের পাশে দাঁড়াল। অন্তর হেয়ালি করল,
” বোন তো দিয়া দিতাছস, এখন পারলে জ্ঞান ও দিতে পারিস। ”
নাহিদ গম্ভীরমুখে বলল, ” এবার যদি তোর জীবন না দৌড়ায় তবে আমি সাদাত ভাইয়ের রোল নিয়ে তোরা দৌড়ানি দিব। নেক্সট ইয়ার যদি বিসিএস না হয় তবে আমি বোন নিয়া যাব। ”
অন্তর সবসময় আফসোস করতো, বন্ধুর বোনের অভাবে বিসিএস ক্যাডার হতে পারল না। জীবন থেমে গেছে। নাহিদ সে কথাই টানল। অন্তর নিশ্চুপ হাসল। তার চোখ লাগল বন্ধুদের উৎফুল্লতা। বন্ধুদের চিন্তা, নাহিদের রাজি হওয়া, রুবাবের হানিমুন ক্যান্সেল করা, সৈকতের সবটা ম্যানেজ করা, সব কিছু এসে ধাক্কা দিল। হৃদয়ে প্রশান্তি ছুঁলো। প্রাণ ভরে এলো। নিজের ভাগ্যকে আরেকবার ধন্যবাদ দিল। কী সুন্দর ভাগ্য তার! ভাগ্য সুন্দর না হলে এমন বন্ধু মিলে? মিলে না। সে ভাগ্যবান। জীবন সুন্দর। অন্তর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বিড়বিড় করে বলল,
” এমন বন্ধু থাকলে জীবন কখনো অসুন্দর হতেই পারেনা। ”
সমাপ্ত………
____________________