এসো রূপকথায় পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
342

#এসো_রূপকথায় (১১) [ সমাপ্তি পর্ব ]

চোখ পিটপিট করে চাইল রিয়া। ফাহমিদা তখনো কেঁদে চলেছেন। ইব্রাহিম বিহ্বল। তিনি যেন খুশি হতে পারলেন না। মেয়েটার দুষ্টুমি আজও গেল না। ফাহমিদা চোখের জল মুছে নিলেন। আড়মোড়া ভা ঙ ল রিয়া।

“কী হয়েছে? শান্তি মতন ঘুমাতেও দিবে না?”

ইব্রাহিমের মুখশ্রী গুমোট। ফাহমিদা সপাটে মেয়ের শরীরে দুটো বসিয়ে দিলেন।

“শ য় তা ন মেয়ে।”

“উফ, লাগছে মা।”

“লাগুক, বেয়াদব কোথাকার।”

এবার হেসে ফেলল রিয়া। বেড থেকে নেমে হাতের সাহায্যে চুল গুলো খোঁপা করে নিল।

“তোমরা কী ভেবেছিলে? ঘুমের ঔষধ খেয়ে ম রে গেছি? খুব ই ফানি ছিল এটা।”

এত সময় পর কথা বললেন ইব্রাহিম। তিনি রেগে আছেন কী না বোঝা গেল না।

“কিছু সময় পর ছেলের বাড়ি থেকে লোক আসবে।”

রিয়া তেমন কিছু বলল না। আলমারি খুলে একের পর এক শাড়ি দেখতে লাগল।

“মা, কোনটা ভালো মানাবে বলো তো?”

মেয়ের আচরণে ফাহমিদা বিস্মিত। তার মাতৃ মন মেয়ের মস্তিষ্কের পরিকল্পনাটি ধরতে পারছে না।

“ও মা। দেখো না কোনটায় ভালো লাগছে?”

নিরুত্তর ফাহমিদা। আলমারি ঘেটে নিজেই একটি শাড়ি বের করে নিল রিয়া। এই শাড়িটি ওর বিশেষ ভালো লাগার। প্রথমবারের মতন রিসানের দেওয়া উপহার এটি।

বিস্ময়ের আরো বাকি ছিল বটে। বেশ সুন্দর করে সেজে গুজে বের হলো রিয়া। পাত্র পক্ষ তখন বসে আছে। মা,বাবা সমেত এসেছে। ছেলেটা হা হয়ে তাকানো। দেখতে ও ভালো। রিয়া তার বরাবর বসল। ইব্রাহিম মেয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে ভয় পাচ্ছেন। ফাহমিদা নাস্তা সাজিয়ে দিলেন। ছেলের বাবা প্রশংসা করে বললেন,”মাশআল্লাহ। ইব্রাহিম ভাই, আপনার কন্যার সৌন্দর্য নিয়ে যাই বলব কম হয়ে যাবে। সেই ছোট্ট দেখেছিলাম, আর আজ ছেলের বউ করার জন্য এসেছি।”

কথাটি বলেই একটু শব্দ করে হাসলেন ভদ্রলোক। তবে উপস্থিত কেউ হাসির সাথে সেভাবে যোগ দিলেন না। কথাটিতে আদৌ হাসির কিছু ছিল কী না এটা নিয়েও সন্দেহ আছে। রিয়া ফ্যালফ্যাল করে সামনের পুরুষটিকে দেখে যাচ্ছে। লম্বায় রিসানের সমান ই হবে। ত্বকের রং ও ফর্সা। সৌন্দর্যে রিসানকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে সব থেকে বড়ো সমস্যা লাজুকতা। ছেলেটা এমন ভাবে বসে আছে যেন লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। রিয়ার মনে হলো মেয়েটি সে নয়, বরং সামনে থাকা ব্যক্তিটিই মেয়ে মানুষ। ও কিছুটা বিরক্তই হলো। কিছু সময় বাদে ওদেরকে পাঠানো হলো আলাদা করে কথা বলার জন্য। পাঁচ মিনিট পার হলো তবে কোনো কথাই বলল না লোকটা।

“আপনি কী বোবা?”

যারপরনাই অবাক হলো রাফিদ। কিছুটা আমতা আমতা করে বলল,”না তো।”

“তাহলে কথা কেন বলছেন না?”

“কী বলব?”

“আমার মাথা।”

রাফিদ মন খারাপ করে রইল। রিয়া ভেংচি কেটে শুধাল,”জি এফ আছে?”

“জি এফ?”

“জি। জি ফর গার্ল এফ ফর ফ্রেন্ড। মানে গার্লফ্রেন্ড।”

রাফিদ যেন দ্বিধায় পড়ল। এমন অবস্থা সে কখনো কল্পনাও করে না।

“কী মিস্টার? এত ভাবছেন কেন? আছে নাকি?”

“না মানে, নেই।”

রাফিদ এমন ভাবে উত্তর করল যেন জি এফ না থাকাটা কোনো বড়ো রকমের অপরাধ। মনে মনে এক চোট হেসে নিল রিয়া।

“শুনেন, আমার কিন্তু বি এফ আছে।”

“ও আচ্ছা।”

“শুধু এইটুকুই?”

“জি?”

“আচ্ছা লোক তো আপনি। আপনার হবু স্ত্রীর বি এফ আছে। এটা শুনেও এমন ভাব করলেন যে কিছু হয় নি।”

রাফিদ এবার হাসল। রিয়া কিছুটা ভরকে গেল যেন। তার মনে হলো গেম চেঞ্জ হয়ে গেছে।

“দুঃখিত, আমি আসলে কিছুটা লাজুক স্বভাবের। মেয়েদের সাথে ওভাবে কখনো কথা হয় নি তাই আর কি।”

রিয়া উত্তর করল না। শুধু অন্যদিক ফিরে ভেংচি কাটল। মনে মনে বলল আহা বড়ো ভদ্রলোক এসেছেন।

“আপনার বয়ফ্রেন্ডের নাম জানতে পারি?”

“না।”

“আচ্ছা। লোকে বলে আমি সুদর্শন। তিনি কী আমার থেকেও সুদর্শন?”

রিয়া একটু কল্পনা করল। সুদর্শনের দিক থেকে দুজনের কাউকেই প্রথম করা যাচ্ছে না। এ যেন দ্বিধায় সমুদ্র। ও চুপ করেই রইল।

“আপনি কী বিয়েটা করতে চান না?”

এত সময় পর রিয়ার বুকটা হু হু করে ওঠল। সে তো বিয়েটা করতে চায় না। ও ঘুরে তাকাল। রাফিদ নিশ্বাসের তপ্ততা লুকিয়ে মৃদু হেসে বলল,”ভয়ের কিছু নেই। আপনি না চাইলে এই বিয়েটা হবে না। তবে আমার দুর্ভাগ্য আপনার মতন একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলাম না।”

শেষ কথাতে দুুঃখ মিশে আছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মন খারাপ হলো রিয়ার। ওরা নেমে এল। দুই পরিবারের মাঝে বেশ হাসি খুশি ভাব বিরাজ করছে। তখনো বিয়ে না করার কথাটা ওঠে নি। দুপুরের খাবার খেয়ে ওনারা চলে গেলেন। রিয়া উদাস হয়ে বসে আছে। গোসল করার নাম অবধি নেই। ফোনটা বেজে ওঠল। রিসিভ করে কোনো কথা বলল না ও।

“তুমি খুব বাজে মেয়ে। জানো কতটা ভয় লাগছিল। কল রিসিভ কেন করছিলে না? মেহনূরের থেকে গতকালকের বিষয়টা জানতে পেরেছি।”

“হুম। ছেলে পক্ষ থেকে দেখতে এসেছিল।”

“কী বলল?”

“ছেলেটা বলল, আমার মতন একজনকে জীবনসঙ্গী রূপে না পাওয়াটা তার জন্য দুর্ভাগ্যের।”

মেয়েটির কণ্ঠে মন খারাপের সুর। রিসান এবার দাঁত কিড়মিড় করে ওঠল।

“আর?”

“সে জানতে চাইল আপনি কী তার থেকেও বেশি সুদর্শন।”

“তুমি কী বললে?”

“আমি কিছু বলি নি।”

“কেন?”

“কারণ কে বেশি সুদর্শন আমি বুঝে ওঠতে পারছিলাম না।”

কথাটি বলতেই ওপাশ থেকে রাগী কণ্ঠটা ভেসে এল।

“জানে মে রে ফেলব। ঐ ছেলের জন্য মনের ভেতর মায়া জমেছে তাই না?”

রিয়া হেসে ওঠল। রিসানের হিং সাটা ভালো লাগছে তার।

“আসলেই সে খুব সুন্দর।”

“ও আচ্ছা। তাহলে বিয়ে করে নাও।”

“হ্যাঁ বিয়ে করে নিই। আর আপনি বিয়ের প্রথম রাতেই আমার স্বা মী কে খু ন করে আমায় বিধবা করেন তাই না?”

রিয়া মজা করলেও রিসান কিন্তু মজা করছে না। ও একটা ক্লান্তির নিশ্বাস ফেলল। রিয়া এবার চুপ করে গেল। ওর কান্না পেল হঠাৎ।

“রিসান, বলতে পারেন আমাদের ভবিষ্যৎ কী?”

“ভবিষ্যৎ কখনো বলা যায় না রে বোকা।”

“কেন যায় না? আমার খুব দুঃখ লাগছে।”

“কাঁদছ কেন?”

“জানি না। শুধু মনে হচ্ছে আপনাকে হারালে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলব।”

মৃদু হাসল রিসান। রিয়ার আবেগ, ভালোবাসা, সবটা বুঝতে পারে ও। মেয়েটি তার জন্য কতটা পারফেক্ট সেটি খুব ভালো করেই অনুভব করা যায়।

রিসানের চলন বলনের মাঝে পরিবর্তন এসেছে। বাসায় ঠিক মতন আসছে না। খাবার খাচ্ছে না। তার এই ভবঘুরে স্বভাবটি দেখে রাশেদুল অস্থির বোধ করলেন। একটি মাত্র ছেলে ওনার। মেয়েটা ও বিয়ের পর থেকে একটি বার কল করে নি। সব মিলিয়ে বুকের য ন্ত্র ণা টা তিনি বেশ অনুভব করছেন। ছেলের ফেরার অপেক্ষা করছেন। অথচ ছেলে ফিরছে না। রাত প্রায় দেড়টা। তিনি অস্থির বোধ করলেন। ঘড়ির কাঁটা যখন তিনটা স্পর্শ করল তখন বাড়িতে ফিরল রিসান। হাতে সিগারেট। আগে থেকেই খেত। তবে বাবার সামনে কখনোই স্পর্শ করে নি। আজ নির্বিঘ্নে সিগার মুখে দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাশেদুল কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন।

“রিসান, দাঁড়াও।”

বাবাকে সম্মান দেখিয়েই কী না দাঁড়াল রিসান। তবে ফিরে চাইল না। রাশেদুল নিজেই ছেলের কাছে উপস্থিত হলেন। আপাদমস্তক দেখলেন। সুপুরুষ বটে।

“এত রাতে সিগারেট হাতে বাড়িতে ফিরছ কেন?”

কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করেই সদর দরজার দিকে চলতে লাগল রিসান। পুরোদস্তুর বিস্মিত বোধ করলেন ভদ্রলোক। কিছুটা পায়ের জোর খাটিয়ে ছেলের সামনে উপস্থিত হলেন।

“কোথায় যাচ্ছ?”

“তুমি ই তো বললে, এত রাতে সিগারেট নিয়ে বাড়ি ফিরেছি কেন। তাই বেরিয়ে যাচ্ছি।”

“আশ্চর্য!”

রিসান জবাবহীন। বরং সে মনের সুখে সিগারেটে ঠোঁট দুটো জ্বা লি য়ে নিচ্ছে।

“তুমি বিয়ে করতে চাও? এমনটি হলে আমরা মেয়ে দেখা শুরু করব।”

খিটমিটে হাসল ছেলেটা। রাশেদুল ছেলের দুই বাহুতে হাত চেপে ধরলেন।

“রিয়াকে ভুলার জন্য সব রকম সাহায্য করা হবে তোমায়। জাস্ট তুমি সঙ্গ দাও।”

“সিগারেট,মদ,গাঁজা সব ট্রাই করেছি বাবা। ভুলতে পারি নি। পারি নি ভুলতে। কোনো নেশাই পারল না ওকে ভুলিয়ে দিতে।”

কথাটি বল‍তে বলতে রিসানের গলা ধরে এল। ও ধীর পায়ে দোতলায় ওঠে গেল। সেদিকে তাকিয়ে রাশেদুলের মনে হলো পুরো পৃথিবী বুঝি তাকে রিক্ত করার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে।

পারিবারিক প্রথা, এটা সহজেই ভা ঙে না, ভা ঙা যায় না। রিসান একবার দু বার তিনবার করে করে বহু বার চেষ্টা করল। বোঝানোর চেষ্টা করল নিজের সবটুকু দিয়ে। অথচ এরা নড়ল না এক পা ও। বরং ছুঁড়ে দিল অবহেলা, অবজ্ঞা। পরিবারের মানুষ গুলোকে ফেলে আসতে চায় না কেউ ই। রিসান ও চায় নি। ও চেয়েছিল সবাইকে নিয়ে এক রূপকথা তৈরি করতে। কিন্তু হলো কোথায়? শেষমেশ প্রিয়তমার হাতটি ধরেই বের হয়ে যেতে হলো। রিয়া নিজের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতেই কী না রিসানের হাতটি আগলে নিয়েছে। ঠিক পালিয়ে এসেছে বলা চলে না। বাবা মা কে জানিয়েই এসেছে ও। কন্যাকে যেমন অনুমতি দেন নি, তেমনই বাঁধা ও দেন নি ইব্রাহিম আর ফাহমিদা। মাঝে অনেক গুলো মাস পেরিয়ে গিয়েছে। তারা চেষ্টা করেছে। ফলাফল রিক্ততা দিয়েছে। তাই আজ নিজেদের জন্য ভাবছে শুধু। ওরা বসে আছে বাসের অপেক্ষায়। গন্তব্যস্থল নতুন। কষ্ট হবে মানাতে। তবে অসম্ভব তো নয়। এই যে ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। বোধহয় শীতের আগমনী বার্তা। রিসান নিজের গায়ের ব্লেজার খুলে দিতেই রিয়া নাকোচ করল। রিসান এক গাল হেসে কন্যাটিকে ব্লেজারের ভেতর নিয়ে এল। দুজনের ত্বকের উত্তপ্ততা ছড়িয়ে যাচ্ছে একে অপরের মাঝে। এতটা ভালো লাগা ভালোবাসা আগে অনুভব হয় নি রিয়ার। রিসান তার শুষ্ক ঠোঁটটি কন্যাটির কপালে ঠেকিয়ে দিল।

“প্রিয়তমা,কথা দিচ্ছি নিজের সবটুকু দিয়ে তোমায় রূপকথা দেখাব।”

এই যে রিসান কথা দিল। সে কিন্তু কথাটি রাখল ও বটে। কিছু মাসের ব্যবধানে ওদের গল্পটি ভিন্ন হয়ে গেল। রিসান এখন ছোট্ট একটি কোম্পানি খুলে বসেছে। তার যোগ্যতা দিয়ে চলছে কোম্পানিটি। তাদের ছোট্ট সুন্দর একটি সংসার হয়েছে। পুরো ঘটনা স্মরণ করে রিয়া হেসে ফেলল। ওমন সময়ই প্রেসার কুকারের সিটি বেজে ওঠল। ধ্যান ভাঙল ওর। চুলায় স্যুপ বসিয়ে দিয়ে অন্য খাবার গুলো তৈরি করতে লাগল। শীত প্রায় শেষ হতে চলেছে। চারপাশে কেমন ফুলেরা জেগে ওঠেছে। সেই ফুলের গন্ধে ‘ম’ ‘ম’ করছে চরপাশ। খানিক বাদেই ডোর বেল বেজে ওঠল। হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলল রিয়া। দু হাত ভরাট করে জিনিস পত্র এনেছে রিসান। সেগুলো নিতে সাহায্য করল ও। রিসান হাত মুখ ধুয়ে এসে ডাইনিং এ বসল। দুজন এক সাথে খাবার খেল। খাওয়া শেষে সব কিছু একসাথেই ঘুছিয়ে রাখল। মাঝে মধ্যে চলল খুনশুটি। মাঝ রাতে রিয়ার যখন ঘুম ভা ঙে। দেখতে প্রায় তার ব্যক্তিগত মানুষটিকে দু হাতে আগলে রেখেছে তাকে। তখনই তার ঠোঁট জুড়ে প্রশান্তি জাগে। মনে হয় এই তো তাদের সুন্দর একটি জীবন। ঠিক রূপকথার মতন। জীবনে ভালো থাকার জন্য খুব বেশি কিছুর কী প্রয়োজন আছে? উহু না। তারা দিব্যি ভালো আছে। ঠিক রূপকথার মতন।

~সমাপ্ত~
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি