আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-০৫

0
189

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
৫.

মীর ভাই, তুমি এমন কেন? সারাক্ষণ আমাকে জ্বালাতন করো! তুমি কি জানো, মামা আমাকে তোমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর ক্ষমতা দিয়েছে? তোমার সিগারেট ঠোঁটের কালচে রং দেখে আমাকে প্রশ্ন করেছিল। আমি বলেছি, তুমি সিগারেট খাও। সাথে এটাও বলেছি যে, তুমি আমাকে সবসময় জ্বালাও। সবসময় মানে কোন সময় বুঝিয়েছি বলো তো! হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। স্ব জ্ঞানে অজ্ঞানে সবসময়ই জ্বালাও। একটা কথা তো বলতে ভুলেই গিয়েছি, সেদিন ট্রেনে তোমাকে শেষ দেখেছিলাম, ঐ রিপ্তীর সাথে ফেভিকলের মতো লেপ্টে ছিলে কেন? আমার বান্ধবীকে কি পছন্দ হয়েছে? পছন্দ হলেও ভুলে যাও; সে তোমার টাইপের নয়। তোমার জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী যে পাড় করতে পারবে সেই তোমার হবে। আনন্দ নগরে থাকতে রিপ্তী আরেকটা কথা বলছে। আমি জানি এটা শোনার পর তুমি রাস্তাঘাট ভেঙে রিপ্তীকে মা’র’তে যাবে। অবশ্য আমিও ব’কে’ছি! রিপ্তী মেয়েটা আস্ত একটা গু’ণ্ডি। সবসময় পরের জিনিসে নজর দেয়। আমার জিনিসেও কতো নজর দিয়েছে! এখনও দেয়। তোমার দিকেও নজর দিয়েছে। এই যা, আসল কথাই তো বলতে ভুলে গিয়েছি! রিপ্তী বলেছে, তুমি নাকি আমাকে ভালোবাসো। হাস্যকর কথা না! আমিও হেসেছি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে, তুমি কেন আমাকে শাড়ি, আলতা, টিপ, চুড়ি উপহার দিলে? ফোনে এত কথা বললে তো ধমক দিতে তাই লেখে পাঠালাম। বাসায় এসে ভদ্রভাবে জবাব দিতে পারলে আসিও নয়তো আসবে না।
ইতি,
হিমালয়

বারান্দার ফ্লোরে সিগারেটের খণ্ড খণ্ড পড়ে আছে। পুরো বারান্দা ধোঁয়ায় নিমজ্জিত। মীরের হাতে হিমার কাঁচা হাতের অগোছালো চিঠি। স্বভাবগতভাবে হিমা যেমন চিঠিতেও বিপরীত নয়। এই পর্যন্ত মীর কতবার হিঠিখানা পড়েছে তার হিসেব নেই। মীরের মুখে তৃপ্তির হাসি। সে বিড়বিড় করে বলতে শুরু করে, “ তুই না চাইতেও আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাচ্ছিস হিমালয়। যার প্রমাণ, তোর এই চিঠি।”

হিমা যদি এখানে উপস্থিত থাকতো তো নিশ্চিত সে এই হাসি দেখলে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত আর বলতো, ‘ মীর ভাই, তুমি খুব পাজি হয়ে গেছো।’
মীর এসব ভেবেই হাসছে। চিঠিটা ভাজ করে বারান্দা থেকে বের হয়ে আসে। আলমারিতে সযত্নে রেখে মুঠোফোন হাতে নিয়ে ছাঁদের দিকে রওনা হয়।

স্নিগ্ধ বিকালে হিমা বারান্দার গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল। আশা নাস্তা তৈরী করছে। এতক্ষণ সে মেয়েকে নিজের সাথে সাহায্য করার জন্য বকাবকি করছিল। আশা কাজ কর্মে পটু কিন্তু তার মেয়ে সবকিছুতেই কাঁচকলা। কে এই মেয়েকে বিয়ে করবে? কাজকর্মহীন মেয়েকে কীভাবে বিয়ে দিবে? এখনও সে বিড়বিড় করছে। হিমা এসব পাত্তা না দিয়ে ফুল গাছে পানি দিতে ব্যস্ত। হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশনের আওয়াজ পেয়ে হিমা ফোনের দিকে এগোয়। রাদিফ হিমার ছবি পাঠিয়েছে। সবগুলো ক্যান্ডিড ছবি। মারিয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলার সময় তুলেছে। রাদিফের বড়ো ফটোগ্রাফার হওয়ার জন্য দোয়া করে হিমা ঠিকই করেছে সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফটোগ্রাফির দিকে মনোযোগ দিলেই পারে। হিমা দ্রুত রাদিফকে কিছু লেখে পাঠায়, “ রাদিফ ভাই, তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দাও।”
অপরপাশ থেকে রাদিফের জবাব আসে, “ কেনো?”
হিমা তা দেখে কপাল চাপড়ে লেখে,“ থ্রি ইডিয়ট মুভির মধ্যে দেখোনি! ফারহান চার বছর ইন্জিনিয়ারিং পড়েও শেষের বেঞ্চের রোল ছিল। কিন্তু সে শেষে মস্ত বড়ো ফটোগ্রাফার হয়। কারণ কী ছিল! তার প্রাণের বন্ধু সাহায্য করেছিল বলেই তো! এই দেখো, আজ আমি তোমাকে সাহায্য করছি; যাও তুমিও বিলাতে গিয়ে কোনো ভালো ফটোগ্রাফারের নৈকট্যপ্রাপ্ত হও। দেখবে একদিন মস্তো বড়ো ফটোগ্রাফার হয়ে যাবে।”

বিশাল লম্বা ম্যাসেজ লেখে হিমা মিটমিট হাসছে। সে জানে রাদিফ আর কোন উত্তর দিবে না। সে তো কথা বলতে জানেই না। তার জায়গায় মীর থাকলে হিমার মনকে এতক্ষণে তেঁতো করল্লা বানিয়ে দিত। মীরের কথা ভাবতে ভাবতেই হিমার ফোনে নোটিফিকেশন চলে আসে। রাদিফ একটা ছবি পাঠিয়েছে নিচে লেখেছে, “ দেখতো ছবিটা কেমন হয়েছে?”

হিমা ছবিটাকে জুম করে দেখে। রাদিফের থেকে দশহাত দূরে মীর কারোর পিঠে হাত রেখে হাসছে। হিমা সেখানেই জুম করে। মীরের হাসির দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে।
হিমাকে ভাবনার জগত থেকে টেনে আনা আর হিমালয় পর্বত জয় করা দুটোই সমান। মীরের হাসিমাখা মুখে হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করে, “ কত বড়ো দুরন্ত তুমি মীর ভাই! আমার বান্ধবীকে বশ করে নিলে! রাস্তা ঘাটে পথে বাজারে শুধু তোমার কথাই বলে। এই তুমি কী জাদু জানো?”

হিমার কথা শেষ হতেই ফোন বেজে উঠে। সাথে সাথে ভয়ে ফোন হাত থেকে পড়ে যায়! ফোনের দেয়ালে ফোনদাতার নাম সেভ করে রাখা হয়েছে ‘ জাদুকর ‘ লেখে। হিমা মীরের নাম এই নামে সেভ করেছে। দুইদিন আগে অবশ্য মীর ভাই নামেই সেভ করা ছিল সে রিপ্তীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে রেগে নাম পাল্টপ দেয়। হিমা বুকে তিনবার থু থু দিয়ে আশেপাশে তাকায়। সে ভেবেছে মীর আশেপাশে আছে। হিমার কথা সব শুনেও ফেলেছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে ফোন রিসিভ করে। হ্যালো বলার পূর্বই অপরপাশ থেকে মীরের কণ্ঠস্বর শেনা যায়, “ প্রেমপত্র লেখা শুরু করেছিস, হিমালয়? তোর ইন্জিনিয়ার বাপ শুনলে তো আমাকে জে’লে ভরবে।”

“ ঐটা প্রেমের পত্র হলো কীভাবে, মীর ভাই? আমি কি একবারও ‘ভালোবাসি মীর ভাই’ বলেছি?”

হিমার উত্তর যেন ঠোঁটের আগায় ছিল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলেও দিল কথার মর্মার্থ না বুঝেই। মীর তা শুনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ বুঝে লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলে, “ এখন তো বললি।”

হিমার মুখের হাসি মুহূর্তেই উবে যায়। সে ভাবতেও পারেনি মীর তার কথার মানে এমন কিছু ধরে নিবে। সে মাথা না বোধক ইশারা করে বলে, “ এমা! না না আমি তা বলিনি।”

অপরপাশে মীর হাসছে। ছাঁদের শেষ প্রান্তে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, “ নিজের মুখেই স্বীকার করে অস্বীকার করছিস, এই তোর মায়ের শিক্ষা, হিমালয়!”

কথায় না পেরে হিমা কেঁদে ফেলবে ভাব। সে নাক টেনে বলে, “ তুমি দূরে থেকেও আমাকে জ্বালাও, মীর ভাই। আমি আর তোমার সাথে কথাই বলবো না।”

অপরপাশ থেকে ফোন কে’টে যাওয়ার শব্দ আসলেও মীর ফোন কান থেকে নামায় না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ এই কোন যন্ত্রণায় ফেললে তুমি। আমি তো শান্ত হতে পারছি না। আমার মন তার কাছে। যে চুরি করে নিয়েছে কিন্তু সে-ই বুঝে না।”

_________________________

শুক্রবার শনিবার সরকারি ছুটির দিন। স্কুল কলেজ আদালতও বন্ধ ছুটি থাকে। শুধু ছুটি থাকে না মায়েদের। এই দুইদিন তাদের কাজ আরো বেড়ে যায়। ধোয়ামুছা থেকে শুরু করে সপ্তাহিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও এই দিনে করে। বেলা দশটা বাজে। হিমা ঘুমে মগ্ন। রাতে সজাগ থেকে রোমান্টিক মুভি দেখেছে। এখন সে স্বপ্নের রাজ্যে রোমান্টিক বর খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু সে তো আর জানে না! তার রোমান্টিক রাজ্যে রোমান্স নিয়ে আসার মানুষ চলে আসছে। কলিং বেল অনবরত বাজছে। আশা সবজি কা’ট’তে ব্যস্ত ছিল। ছুটির দিনে হিমেল বউকে টুকটাক কাজে সাহায্য করতে রান্নাঘরে চলে আসে। আজও এসেছে। মুরগীর রোস্ট নাড়াচাড়া করছে আর আশাকে এই সেই বলে লজ্জা দিচ্ছে। কলিং বেল অনবরত বেজেই চলছে। আশা কিছুটা বিরক্ত হয়েই দরজা খুলতে চলে যায়।

“ ভিতরে কি প্রেম করছিলে, মাই ডিয়ার ফুফু?”

মীরের আকস্মিক আগমনে আশা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। ফুফুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মীর বিরক্ত হয়ে নিজেই বাড়িতে প্রবেশ করে। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে ফুফাকে দেখে দুষ্ট হেসে বলে, “ বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরছেন, ইন্জিনিয়ার সাহেব? ভালো ভালো।”

হিমেল সাহেব কিছুটা লজ্জা পায়। আশার স্তম্ভিত থেকে ফিরে এসে সোজা মীরের কান চেপে ধরে। কঠিন স্বরে বলে, “ বেয়াদব ছেলে, ফুফার সাথে মশকরা করছিস? আজ আসবি বললি না কেন?”

“ কেন, বলে আসলে কি রোস্টের বদলে আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করতে!”

আশা মীরের মাথায় চা’টা মেরে হেসে উত্তর দেয়, ” বদমাশ ছেলে।”

দুজনের কথার মধ্যে হিমেল সাহেব এসেও উপস্থিত হয়। সে মীরকে দারুণ পছন্দ করে। একমাত্র মেয়ের জন্য মীরকে পারফেক্ট মনে হয়। তবে তিনি তা প্রকাশ করেননা। আজকাল ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দমতো চলে। হিমেলরাও সেই কালে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। হিমার কথা মীরকে বললে যদি হিতে বিপরীত কিছু হয়! তাই তিনি চুপচাপ থাকেন। মীরকে দেখে বলেন, “ এবার অনেকদিন থেকে যাবে। হিমারও পরীক্ষা শেষ। আমিও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সবাই একসাথে দূরে কোথাও বেড়াতে যাবো।”

“ কথাটা মন্দ বলোনি। হিমারও ভাল লাগবে।”

আশার কথা শেষ হতেই মীর উপরে তাকায়। সেদিকে চোখে ইশারা করে আশাকে জিজ্ঞেস করে, “ তোমার বোকা মেয়েটা কোথায়, ফুফু। আমাকে দেখে যদি এবার বোকা বোকা কথা বলে তো থা’প্প’ড় দিয়ে লাল করে ফেলবো।”

“ যা ইচ্ছে করিস, আমি বাকী রান্না শেষ করি। তুই উপরে গেস্ট রুমে গিয়ে রেস্ট কর।”

মীর আর কথা বাড়ায় না। তার অবচেতন মন হিমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ব্যাগ কাঁধে তুলে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠতে থাকে। হিমার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। হিমাকে একটি পলক দেখার লোভ জাগে। সে না চাইতেও আবারো হিমার অনুমতি ছাড়া তার ঘরে প্রবেশ করে।
হিমা ডানপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। কাঁধ বরাবর কাঁথা মুড়িয়ে রাখা। ডান হাতের তালুর উপর বাম হাত রেখে তার উপর ঘুমাচ্ছে। মীর বিনা আওয়াজে নিচে বসে। তার হাতের পিঠের সাহায্যে হিমার গাল ছুঁয়ে দেয়। হিমা নড়েচড়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর ঘুমের ঘোরে মুচকি হাসে। মীর তা ক্যামেরাবন্দী করে নেয়। এরপর মাতাল সুরে বলে, “ তোর স্বপ্নের কারণ যেন আমি হই, হিমালয়!”

চলবে ইনশাআল্লাহ…………..