#আসমানী
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“সংসার জীবন কেমন লাগছে আসমানী?শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালো তো?”
“জ্বি,আন্টি।সবাই আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো।আমার শাশুড়ী আর শ্বশুর এর মতো মানুষই হয় না দুনিয়ায়।”
“আর তোমার উনি?সে ভালোবাসে তো তোমাকে?”
আসমানী মাথা নিচু করে হাসে।তারপর সামনে বসে থাকা মহিলাকে বলে,”সেও আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো মানুষ।আমার খুব খেয়াল রাখে।”
“ঝগড়া হয় না তোমাদের মাঝে মাঝেমধ্যে? ”
“হ্যাঁ, তা তো একটু হয়ই।টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়।ভালোই লাগে আমার যদিও।”
“সেটাই তো স্বাভাবিক আসমানী।সংসার করতে গেলে টুকাটুকি লাগবেই।যেখানে ঝগড়াঝাঁটি,অভিমান থাকবে না,সেখানে ভালোবাসাও থাকবে না।”
“হ্যাঁ, সেটাই দেখছি।”
ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া রেদোয়ান তার মা আর মিসের কথা হা করে গিলছে।ওর মা বলে,”এই,এইভাবে আমাদের কথা শুনছিস কেন?তোকে না অংক করতে দিয়েছে, অংক কর।”
আসমানী বলে,”আন্টি,আংকেলের কি অবস্থা?উনি কি আর কখনোই সুস্থ হবেন না?”
“জানি না আসমানী।এভাবে যে আর কতদিন চলবে সেটাও জানি না।আমি একা হাতে আর সবদিক চালাতে পারছি না।তবু ভাগ্য ভালো, এই ফ্ল্যাট টা তোমার আংকেল কিনেছিলেন বলে এর ভাড়া দিতে হয় না।তা না হলে তো রাস্তায় গিয়ে নামতে হতো।”
“আল্লাহ একদিন অবশ্যই আপনাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিবেন।আংকেল আবার সুস্থ হয়ে যাবেন।ডাক্তার রা কি কোনো আশা দিতে পেরেছেন? ”
“আমি যা ইনকাম করছি,তার সিংহভাগই তোমার আংকেল এর চিকিৎসার পিছনে চলে যাচ্ছে।ডাক্তার রা তো বলেছে নিয়মিত থেরাপি নিলে একসময় হয়তো ঠিক হতে পারে।না হলে সারাজীবন হুইল চেয়ারই সঙ্গী।তোমাকেও তো তেমন কোনো কিছুই দিতে পারি না।তুমি দয়া করে আমার ছেলেটাকে পড়াও বলেই ও এখনও প্রাইভেট পড়তে পারছে।কবেই তো ছেলেটাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।তোমাকে তো তেমন কোনো ভালো নাস্তাও দিতে পারিনা।”
“এইভাবে বলবেন না আন্টি।ও তো আমার ছোট ভাইয়ের মতোই।”
“জানো, তোমার আংকেল মানুষটা কেমন শক্তসমর্থ ছিল।কত আত্মমর্যাদা ছিল উনার।কারও কাছে কোনো দিন দু টাকা ধারও করে চলিনি আমরা।কেউ বলতে পারবে না যে আমার দুয়ারে এসে কেউ খালি হাতে চলে গেছে।বিপদে পড়লে মানুষের আসল চেহারা দেখা যায় বুঝলে তো আসমানী?উনার বড় ভাইকে উনি দোকান দিয়ে দিয়েছে।বড় বোনের ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছে।আর এখন উনার পাশে বৃদ্ধ মা আর আমি ছাড়া কেউ নেই।কারো ফোন দিয়ে একটু খোঁজ খবর নেওয়ারও সময় হয় না।”
“ওনারা কি কোনো সাহায্যই করেন না আন্টি?”
“মাঝেমধ্যে এসে আমার শাশুড়ীর সাথে দেখা করে যায়।সেই উছিলায় তাদের ভাইকেও দেখে।এই আর কি।”
“আল্লাহ সবাইকে বোঝার ক্ষমতা দিক।”
“আমিন।”
★★★
“অবশেষে ঘর বানানোর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে কালকে থেকে আসমানী।মিস্ত্রিরা আসতে শুরু করবে।”
“তাহলে তো অনেক কাজ বেড়ে গেল আমাদের।”
“হ্যাঁ,আমাদের ছেলেদের চাইতে তোমার আর মায়ের কাজ বেড়ে গেল।আমি তো বাড়িতে থাকার সময়ই পাবো না তেমন।বাবাও স্কুলে থাকবে।নাবিলকেই কলেজ কামাই দিতে হবে।”
“হ্যাঁ, বেচারা নাবিল।কলেজে উঠেছে কই এখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে তা না করে পাহারা দিতে হবে ওকে।”
“হুমম,কি আর করবে।একটু তো কাজ করতেই হবে।”
“এই ঘর টা কি করবেন?ভেঙে দিবেন নাকি?”
“নাহ,আসমানী।এই ঘর ভাঙবো না।এইভাবেই থাকবে।আমাদের আর নাতাশার ঘরের মাঝের দেয়াল ভেঙে দিব।তখন অনেক বড় একটা রুম হবে।”
“কেন?এতো বড় রুম দিয়ে কি করবেন?নতুন ঘরেই তো অনেকগুলো রুম হবে।কতগুলো রুম হবে মোট বলেন তো?”
“আমার আর তোমার জন্য একটা, বাবা-মায়ের জন্য একটা, নাতাশার একটা, নাবিলের একটা আর একটা ছোট রুম হবে কেউ আসলে তাকে থাকতে দেওয়ার জন্য।অর্থাৎ বেডরুম ৫ টা।আর ড্রয়িং ডাইনিং একসাথে।আর একটা কিচেন।”
“আর উপরে?”
“উপরে ছোট ছোট দুইটা রুম হবে।”
“তাহলে এই ঘরের মাঝখানের দেয়াল ভাঙবেন কেন?”
“মাঝে মাঝে এই ঘরে এসে বসে থাকবো সবাই মিলে।আড্ডা দিবো।আমাদের সন্তানেরা দৌঁড়ঝাপ করবে।খেলাধুলা করবে।কোনো বড় অনুষ্ঠান করলে এই ঘরে সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবো।”
“বুঝেছি।অনেক আগাম চিন্তা-ভাবনা।”
“আগাম হবে কেন?”
“এই যে,বাচ্চাদের কল্পনা করা।এইটা কি আগাম চিন্তা না?”
নাহিদ আসমানীর কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আমার বাচ্চা অনেক ভালো লাগে।আমাদের অনেকগুলো বাচ্চা হবে।অনেক গুলো।তবে আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে মেয়েবাবু।”
“বাহ,ভালো।অনেক ভালো চিন্তা।তা এতো যে আগাম চিন্তা করেছেন,ছেলেমেয়ের নামও কি ঠিক করে রেখেছেন নাকি?”
“নাহ।এখনও ঠিক করিনি।”
“কেন?আপনি যেভাবে বললেন আমি তো ভেবেছি নাম ঠিক করে ফেলেছেন।”
“করবো তো।অবশ্যই করবো।তোমার আর আমার নামের মধ্যে মিল রেখে নাম রাখবো।কি নাম রাখা যায় বলো তো?”
“আমি কি জানি।আপনিই ঠিক করেন।”
“আসমানীর আ আর নাহিদের না।’আনা’?এই আসমানী,’আনা’কি কারো নাম হয়?”
আসমানী এবার খিলখিল করে হাসে।হাসতে হাসতে বলে,”হয়।কিন্তু এইসব নাম আমাদের দেশে চলে না।”
“কেন চলে না?”
“আমাদের মেয়ে রাস্তায় বের হলে লোকে জিজ্ঞেস করবে,তুই কয় আনা?১আনা নাকি ৪ আনা?আমাদের মেয়ে তখন কাঁদবে না?”
“যে কাঁদাবে তাকে গিয়ে ঘুষি মেরে আসবে না ওর বাবা?”
আসমানী নাহিদের নাক টিপে দিয়ে বলে,”তাই নাকি?মেয়ের বাবার এতো সাহস আর শক্তি আছে নাকি?”
নাহিদ আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলে,”প্রমাণ লাগবে ম্যাডাম।”
আসমানী বলে,”লাগবে না।ঘুমান এখন।কালকে থেকে কত কাজ বেড়ে যাবে না আমাদের?”
নাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে,”আরও একটা কারণ আছে জানো তো আসমানী?”
আসমানী ভ্রু কুঁচকে বলে,”কি কারণ?”
“আমরা যাতে বড় ঘরে থেকে কখনোই ভুলে না যাই আমরা কি ছিলাম।এই ঘরটা বানানোর আগে আমরা আরো ছোট একটা ঘরে থাকতাম।সেটাও বাবা রেখে দিয়েছিল।কিন্তু আগুন লেগে পুড়ে গেছে ঘরটা।আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানেরা যেন বুঝতে পারে আমরা কষ্ট করে এই পর্যায়ে এসেছি।নিজেদের অতীত যেন আমরা কখনোই ভুলে না যাই,সেইজন্য হলেও ঘরটা রাখবো।”
আসমানী নাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকে।নাহিদ বলে,”এইভাবে তাকিয়ে থেকো না সখী।প্রেমে পড়ে যাবে আমার।বুঝলে?”
★★★
আসমানী রান্না ঘরের ভিতরে বসে নাস্তা বানাচ্ছে।বারবার তার হাত কাঁপছে।ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় সে মারা যাচ্ছে।বুঝতে পারছে না যে সে কি করবে।দুপুরের দিকে যখন গোসল করে সে আর তার শাশুড়ী খাবার খাচ্ছিল,তখন সেই রাতের সেই লোকটি আসে।তার শ্বশুর বাড়ির কাজ করা মিস্ত্রীদের সাথে কথা বলছিল।সেই রাতের মতো আজও লোকটা সেইরকমই হুডি পরে এসেছে।সেদিন না হয় রাতের বেলায় কারো থেকে নিজেকে আড়াল করতেই হুডি পড়েছিল।কিন্তু আজ দিনের বেলায় কেন এসেছে?আবার হুডি পড়েই কেন এসেছে?
“আসমানী,হয়েছে নাস্তা বানানো?”
শাশুড়ীর কথায় চমকে উঠে আসমানী বলে,”হ্যাঁ, হ্যাঁ মা।হয়ে গেছে।আমি নিয়ে আসছি একটু পরেই।”
শাহেদা বেগম চলে গেলে আসমানী ভাবতে থাকে লোকটি কি কোনোভাবে তার পরিচিত? যদি এখানে সবাইকে তার আসল পরিচয় বলে দেয়?এখন কোনোভাবে যদি ফোনটা নিয়ে লোকটির ছবি তুলে রাহার মা কে পাঠাতে পারতো,তাহলে কিছু সময়ের মধ্যেই লোকটির পরিচয় জানা যেতো।
“ভাবী,কি করছো?”
আসমানী পিছনে ফিরে দেখে সেখানে নাবিল দাঁড়িয়ে আছে।আসমানী বলে,”কে? নাবিল?নাস্তা বানাচ্ছি।”
“ঐ লোকটা বাবার কাছে কেন এসেছে ভাবী?”
আসমানী খুব অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,”ঐ লোকটা কে নাবিল?চিনো তুমি?”
নাবিল মাথা নিচু করে বলে,”হ্যাঁ।”
আসমানী উঠে এসে নাবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”কে উনি?”
“রোজি আপুর অনেক আগের ভালোবাসার মানুষ।তুমি হয়তো শুনেছো কিছুটা ওনার ব্যাপারে।”
আসমানীর বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে গেল।আসমানী এবার বেশ হাসিমুখেই নাস্তাগুলো নিয়ে শাশুড়ীকে ডেকে নিজে ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়।
★★★
“রোজিনার ডিভোর্সের তো মাত্র কিছুদিন হইছে।এখনই তো আর বিয়ে হয় না বাবা।”
নাসিরুদ্দিন সাহেবের কথায় হুডি পড়া লোকটি বলে,”সমস্যা নেই চাচা।আপনি শুধু ওকে জানান।আমার এতো সাহস নেই যে আমি ওর বাবার সামনে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিব।তাছাড়া… ”
“তাছাড়া কি বাবা?”
“এতোদিন পর ও আমাকে দেখে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে জানিনা।আর আমি আসলে এতো আগে জানাচ্ছি কারণ ওর বাবা হয়তো ওকে আবার অন্য কোথাও বিয়েও দিয়ে দিতে পারে।তবে,আমি আগে যেমন ছিলাম এখন তেমন নেই।রোজিনাকে হয়তো অনেক বড় ঘরে নিয়ে থাকতে পারবো না।কিন্তু দু বেলা খাওয়া আর টুকটাক বিলাসিতা পূরণ করার ক্ষমতা আমার এখন আছে।” কথাটা বলেই হুডি পড়া লোকটা মাথা নিচু করে থাকে।
শাহেদা বেগম চা আর নাস্তা দিয়ে গেলে নাসিরুদ্দিন সাহেব চা এর কাপে চুমুক দিয়ে বলে, “তুমি কি জানো,রোজির কেন ডিভোর্স হয়েছে?সব জেনেই আসছো তো?”
“জ্বি,চাচা।সব জেনেই আমি এই পদক্ষেপ নিয়েছি।”
“তোমার সন্তান চাই না?”
হুডি পড়া লোকটা হেসে বলে,”চাচা,আমি অনেক ছোট বেলা থেকেই এতিম।মায়ের গর্ভে থাকতেই বাবা মারা গেছে।জন্মের কয়েক বছর পর মা।থাকার মধ্যে এক বিধবা ফুপি ছিল।সেও বছর দুয়েক হলো গত হয়েছেন।আমি জানি কষ্ট কাকে বলে।আর রোজির সাথে আমার সম্পর্ক তো আপনার অজানা নয়।আমরা না হয় একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে নিবো।অন্ততপক্ষে এতিমখানার একটা বাচ্চা তো বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাবে।”
নাসিরুদ্দিন সাহেব হুডি পড়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়।কৃতজ্ঞতায় তার চোখে পানি চলে আসে প্রায়।রোজিনার আবারও যে এই রকম স্বামী আর ঘর সংসার হবে সেটা তো কল্পনারও অতীত ছিল তার কাছে।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”চা নাও,ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।আমাদের নাহিদের বউ বানিয়েছে।সেও তোমার মতোই এতিম ছিল।আমরাই এখন তার বাবা-মা।তুমিও আর নিজেকে এতিম মনে করো না।রোজির সাথে বিয়ে হলে আমরা তোমারও পরিবার হবো।”
চলবে….