অঙ্গজা পর্ব-০১

0
409

#অঙ্গজা
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|সূচনা পর্ব|

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
আমার আড়াই মাসের বাচ্চা মেয়েকে আমার শাশুড়ি একবারের জন্যও কোলে নেননি, কেবল মাত্র মেয়ের গায়ের রঙ কালো হয়েছে বলে। এই রঙের জন্য আমি দায়ী নই। আবার প্রশ্নটা রঙেরও নয়। সব রঙের মানুষের সৃষ্টিকর্তা একজনই। বাচ্চা সুস্থ আছে, ওজন স্বাভাবিক আছে, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে, এ-ই কি যথেষ্ট নয়?

প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে এলো আমার। সোনাইকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিলাম। গোসল করতে যাওয়া প্রয়োজন এখন। কিন্তু একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
বাড়িতে মানুষ বলতে আমার শ্বাশুড়ি আর স্কুল পড়ুয়া ননদ আছে। আমার বর ও শশুরআব্বু কাজে গেছে।

আমি কাপড় ঠিক করে উঠে দাঁড়ালাম। সোনাইয়ের দু-পাশে ছোটো কোলবালিশ রেখে কপালে ছোট্ট করে চুমু খেলাম৷ এরপর রুম থেকে বেরিয়ে রাহার রুমে গেলাম। দরজা নক করে বললাম,
-“রাহা, ফ্রি আছ?”

রাহা বসে বসে ফোন টিপছিল। আমাকে দেখে বলল,
-“হ্যাঁ, ভাবি। বলো।”

মিহি হেসে বললাম,
-“বোন, একটু আমার রুমে এসে বোসো না। আমি গোসল সেড়ে আসি।”

রাহা বলল,
-“হ্যাঁ, ভাবি। যাচ্ছি।”

রুম থেকে বেরোতেই সরাসরি শাশুড়ির সামনা-সামনি পড়লাম। আমার দিকে কীভাবে যেন তাকিয়ে আছেন। আমি চুপ করে চলে আসতে চাইলাম। সেই মুহূর্তে তিনি বলে উঠলেন,
-“কী গো, বউ? আমার মাইয়াডারে নিজের কামের বেডি পাইছোনি? যখন মর্জি ফরমাইশ খাটাইবা? কী?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করলাম,
-“না মা, ওরকম কিছু না। আমি শুধু এসে একটু বসতে বলেছি। আপনি ভুল বুঝছেন।”
-“যা বুঝার ঠিকই বুঝছি, তুমি বুঝাইতে আইসো না। নিজের ঘরে যাও।”

রাহা তখন আমার দিকে করুণ চোখে তাকাল। আমি কিছু বললাম না। নিজের রুমে চলে আসতে নিলাম। তখন আমার কানে তাদের কথা এলো।

রাহা বলছে,
-“মা, তুমি ভাবির সাথে এমনে কথা বলো কেন?”
-“তোর এত সমস্যা কী? যার সাথে যেমনে কথা কওন লাগে, ওমনেই কই আমি। শখ কইরা পোলারে বিয়া করাইছিলাম। চাইছিলাম একটা বাধ্য বউ আনমু। আমার সব কথা শুনব, এমন। অথচ কপালে জুটছেও এমন, প্রত্যেকটা কথায় তর্ক করোন লাগে ওর। আল্লাহয় বাঁচাইয়া রাখলে আমার পোলারে আমি আবারও বিয়া করামু।”

আমি চলে এলাম ওখান থেকে। কী যে কান্না পাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে কেঁদে বুক ভাসাতে। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। কান্না করে বায়না ধরে খেলনা-গাড়ি পাওয়ার বয়সটা আমার আর নেই। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সোনাইকে আরেকবার ঠিকমতো গুছিয়ে শুইয়ে দিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

আমার বিয়ে হয়েছে সাড়ে তিনবছর। তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরে বসার ঘরে অনেক মানুষ দেখতে পেলাম। আম্মা আমাকে বলল,
-“অঙ্গজা শোন মা, তোকে দেখতে আসছে এরা। ভীষণ ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ আসছে। তৈরি হ।”
তারপর আমাকে রেডি করিয়ে নিয়ে এলো ওখানে। পরে বুঝলাম তারা মেয়ে দেখতে এসেছে। বরাবরের মতোই আনুষ্ঠানিকতার সাথে মেয়ে দেখাটা হয়েছিল। আমি দেখার রীতিনীতি আমার জানা। তাই চুপ করে মেনে নিয়েছিলাম সব। আঁড়চোখে ক’বার আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তাকে দেখে গেছি। লোকটা ভীষণ শান্ত। একবারও আমার দিকে তাকায়নি।
আমার শাশুড়ি এবং কাকিশাশুড়ির আমাকে পছন্দ হয়ে গেল সেদিন। তারপর আমাকে আংটি পরিয়ে রেখে গেল এবং মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ে। বরের নাম জানতে পারি বিয়ের দিন। মাহতাব সিদ্দিকী। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ভীষণ দায়িত্বশীল ও মা-ভক্ত। প্রথমে প্রচুর ভয় থাকলেও, বিয়ের পর যখন শুনতে পারি, আমার শশুরবাড়িতে আমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়া মত নেই, প্রচণ্ড খুশি হয়ে পড়ি আমি।

কিন্তু সংসার আর পড়াশোনা, দুটো একত্রে সামলাতে পারিনি। আমার শাশুড়ি কখনও আমাকে রান্না-বান্না করতে বলেননি। তবে তাঁকে একা সব রান্না করতে দেখতে আমার বিবেকে বাঁধত। আমার শাশুড়ি আমাকে কখনও বলেননি বাড়ির কাজ করতে। তবে চুপচাপ বসে আয়েশ করতে আমার বিবেকে বাঁধত। আমার শাশুড়ি আমাকে কখনও মাছের মাথাটা খেতে বারণ করেননি। কিন্তু ননদ ভারি পছন্দ করে। ওকে ফেলে নিজের পাতে মাছের মাথাটা তুলে নিতে আমার বিবেকে বাঁধত। আমার শাশুড়ি আমাকে কখনও পড়াশোনা ছাড়তে বলেনি। কিন্তু কাকিশাশুড়িরা যখন পরনিন্দা ও পরচর্চা করতে রোজ রোজ এ-বাড়িতে এসে গরম খবর হিসেবে বাড়ির বউয়ের বাড়ির সব কাজ-টাজ শাশুড়ির ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে কথা বলত, দিনের নামে কলেজে গিয়ে হিল্লিপনা করার ওপর লাগাম টানার উপদেশ আমার শাশুড়িকে দিত, আড়ালে তা শুনতে আমার বড়ো বিবেকে বেঁধেছিল।
পরদিন শাশুড়িমাকে গিয়ে বলি,
-“মা, আমার না আর কলেজে যেতে ভালো লাগছে না। আমি বরঞ্চ শুধু এক্সামগুলোই দিই।”

মা সায় দিয়েছিলেন। আমি পুরোপুরি সংসারে মন দিই। আর তারপর হুট করেই মনে হয়, পড়াশোনা করে আর কী হবে? আমার পুরো জীবনটা তো আপাতত আমার স্বামী আর সংসার। আমি সংসারী হয়ে উঠি, আমি পড়াশোনাকে জলাঞ্জলি দিই। অথচ একসময় ডিপার্টমেন্টের টপার ছিলাম।

ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস আসে আমার। গোসল দিয়ে রুমে এসে দেখি সোনাই জেগে আছে। আমি শাড়ির আঁচল গোছাতে গোছাতে ওর কাছে চলে এলাম। আমার দিকে কেমন বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আমি দু’হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-“আম্মুর কাছে আসবে, সোনা?”

সোনাই হাত-পা তুলে হাসতে লাগে। দন্তবিহীন মাড়িগুলো দেখা যায়। আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বলি,
-“ওরে আমার লক্ষ্মী সোনাটারে! খিদে পাচ্ছে? তখন তো খেলেই না। বাবাকে মিসসু মিসসু করছ?”

সোনাই আবার খানিকটা ঘুমোলেই আমি ওকে ঠিকমতো শুইয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। রাতের রান্নাটা করতে হবে। মা আমাকে রান্নাঘরে আসতে দেখেই অন্যদিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। আমি নীরবে শ্বাস ফেলে মুরগীটা কাটতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ বাদে মেয়ের কান্নার আওয়াজ এলো। আওয়াজ পেয়েই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। হাতের মুরগী ফেলে হাত ধুয়ে যেতেও সময় হবে। রাহাকে ডাকলাম। রাহা ডাকটা বোধহয় শুনতে পেল না। মা সোফায় বসে টিভি দেখছেন। আমার রুমের পাশেই। আমি উঠে হাত ধুয়ে জলদি রুমে এসে দেখি মেয়ে কোলবালিশসহ বিছানা থেকে পড়ে গেছে।
আমার পুরো শরীর অসার হয়ে এলো। আমি ক্ষণিকেই কান্নারত মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আমার বিছানাটা বেশি উঁচু না। এক হাতের মতো হবে। উবু হয়ে কোলবালিশের ওপর পড়েছে। অল্প লেগেছে। বোধহয় নাকে-কপালে আর ঠোঁটে। ঠোঁটের সম্মুখে কেটেছে হয়তো। সামান্য রক্ত!

বুকে এসে সোনাইয়ের কান্না থেমেছে। আমার চোখ ছলছল করে উঠল। মেয়েকে বুকে নিয়েই বাইরে গেলাম। মা কি কান্নার আওয়াজ শোনেননি? এত পাষাণ কেউ হয়?
আমি বসার ঘরে গিয়ে মায়ের মুখোমুখি হয়ে টিভির সামনে দাঁড়ালাম। তিনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে বললেন,
-“এগুলা কীসের নাটক মারাইতেছো? সরো এহান থেকে।”

আমার চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। বিতৃষ্ণায় মুখ বিষিয়ে উঠল। বোধহয় এই সাড়ে তিনবছরে প্রথমবার গলার আওয়াজ উঁচুতে তুললাম,
-“আপনি মানুষ, মা? এটা আমার একার মেয়ে? আপনাদের রক্ত না? একটুও দয়া-মায়া হয় না আপনাদের? কীভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেন? আড়াইটা মাস হলো। একবারও কোলে নেননি। তাকিয়ে দেখেননি। কেন?”

চোখ রাঙিয়ে উঠলেন মা,
-“অঙ্গজা! তোমার হেডাম দেইখা অবাক হইতাছি। কার লগে কথা কইতাছো, ভুইলা গেছো?”

আমি প্রুত্যুত্তর করলাম,
-“মা, ভুল বলতেছি না আমি। আপনি দেখেন। আপনার ছেলেরই তো সন্তান। কীভাবে পারেন মুখ ঘুরিয়ে থাকতে।”

মা ধমকে উঠলেন,
-“চুপ! এত কথা কই পাইতেছিস? বাড়ি থেকে বাইর করে দিতে পারি, ভয়-ডর লাগে না? হ্যাঁ? এটারে তোর বাপের বাড়ি পাইছোস?”

আমি থমথমে আওয়াজে বলে উঠলাম,
-“আপনি আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলতে পারেন না, মা। আমি যেমন এই বাড়ির বউ, আপনিও বউ। এই বাড়ির মেয়ে নন। আপনারও এই বাড়ির ওপর অধিকার নেই।”
-“আমারে অধিকার চেনাইতেছোস?”

আমি নরম হলাম,
-“বেয়াদবি মাফ করবেন, মা। আপনি সোনাইকে দেখেন একটু। গায়ের রঙের ওপর ওর কী দোষ। আমরা তো ইচ্ছা করে করিনি, মা। একটু তাকিয়ে দেখুন। কী মায়াময় চেহারা ওর। কীভাবে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখুন। কোলে নেবেন না? আপনাদের রক্ত না ও?”

এবারে শাশুড়ির বলা কথাটা আমার অন্তরআত্মা কাঁপিয়ে তুলল,
-“এই কালা মাইয়ারে আমি আমার রক্ত মানি না। কোনকান বেজন্মা এইটা। কোনখানে কোন কুকাম কইরা আইসা পয়দা করছোস এইডারে, কে জানে। তোদের দুইটারে যে এই বাড়িতে এতদিন জায়গা দিছিলাম, এই তোর সাতকপালের ভাগ্য ছিল। আর তুই ওড়া শুরু করছোস! থাকতে-খাইতে পারতেছিলি, ভালো লাগতেছিল না?”

আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। একবার মেয়ের দিকে তাকালাম, একবার মায়ের। মেয়েটা আবার কান্না করে যাচ্ছে একনাগাড়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি। এমন সময় কলিং বেল বাজল। মা দৌড়ে দরজার কাছে গেলেন। দরজা খুলে আমার বরকে দেখতে পেয়েই কুমিরের কান্না কেঁদে বলে উঠলেন,
-“বাবু, আমি কী সর্বনাশ করলাম এডা! তোর লাগি এমন বউ আনলাম, বড়ো-ছোট মানে না। কুকাম কইরা একটারে পয়দা করছে, আমি জানতে পারায় আমারে গালাগাল করতাছে। কইতাছে এই বাড়িতে আমার অধিকার নাই, দুইদিন পর বাড়িত্তে বাইর কইরা দিব। আমি এখন কই যামু রে? কী কপাল কইরা এমন বউ আনছিলাম!”

শাশুড়ি মায়ের হায় হায় দেখে আমি এখনও চুপ। শুকনো মুখে তাকিয়ে আছি মাহতাবের দিকে। বাড়ি আসতে না আসতেই এসব শুনল। ওর রাগ বেশি, তারও বেশি ধৈর্য। এখন মাহতাবই শেষ ভরসা। মাহতাব, তুমিও কি মায়ের কথায় আমাকে অবিশ্বাস করবে?

চলবে?