আষাঢ়ে প্রণয় সন্ধি পর্ব-১১

0
361

#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১১

পড়ন্ত বিকাল।রোদের তেজ আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে।এ ক’দিন বেশ গরম পরেছে।পাখিদের ঝাঁক নিজেদের নীরে ফিরছে।রাস্তায় বাচ্চারা খেলছে।চিত্রা আর সাজিয়ার ছাদের এক কোণে বসে গল্প করছে।চিত্রার চুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে।সাজিয়া নিজের হিজাব ঠিক করলো।বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। আষাঢ়,সমুদ্র এবং নিশীথ ছাঁদে উঠে গল্প করতে করতে।তারা কেউ এখনো খেয়াল করেনি অপর ছাঁদে গল্পরত দুই রমনীকে।তারা হাসতে হাসতে এসে ছাদের দোলনার জায়গায় বসে। নিশীথ এবং সমুদ্র দোলনাতে বসেছে আর আষাঢ় রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খিলখিল করে হাসির শব্দে তিনজনের আড্ডার সমাপ্তি হয়। হাসির উৎসের দিকে তাকাতেই চোখ আটকালো আষাঢ়ের।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আষাঢ় সেই রমনীর পানে।যে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সামনের নারীকে কিছু বলছে। আষাঢ়ের হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য চিত্রার হাসিই যথেষ্ট ছিলো।

এই প্রথম সে চিত্রাকে এভাবে হাসতে দেখছে।মন খুলে হাসছে চিত্রা।আষাঢ় আনমনে বলে উঠে,,,“আপনায় হাসলে অসম্ভব সুন্দর লাগে চিত্রা”

আষাঢ়ের অস্পষ্ট কথা শুনে সমুদ্র এবং নিশীথ ও দাঁড়িয়ে পড়লো।অপর পাশে থাকা নিজের হবু বউকে দেখে থমকে গেলো কিছুক্ষণ এর জন্য।তার প্রথম দিনই ভালো লেগেছিলো সাজিয়া নামক রমনীকে।মেয়েটির চুপচাপ স্বভাব তাকে ভীষণ টেনেছিলো।তবে আজ সে অন্য সাজিয়াকে দেখছে।যে কথা বলেই চলেছে।থামার নাম গন্ধ নেই।তখনই চিত্রাদের ছাদের দরজা ঠেলে প্রহর এবং আষাঢ়দের ছাঁদের দরজা ঠেলে অরিহা প্রবেশ করলো।সাজিয়া ও চিত্রা কথা থামিয়ে তাকালো প্রহরের দিকে।তখনই অপর ছাঁদ থেকে অরিহার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো সবাই।সাজিয়া, চিত্রা,প্রহর ও তাকালো পাশের ছাদে। সবাই একে অন্যকে দেখে চমকে উঠলো।প্রহর ছাদের কিনারায় এসে রেলিং এ ভর দিয়ে হাসি মুখে বলল,,,

“আষাঢ় ভাই কেমন আছো?ছাদে কখন উঠেছো?”

আষাঢ় নড়েচড়ে উঠলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলো,,,“এই তো কিছুক্ষণ। তুমিও আসো প্রহর”

প্রহর মাথা নাড়িয়ে নিচে নেমে যায়।অরিহাও চিত্রাকে বলে সে আসবে কি না। চিত্রা হ্যাঁ বলতেই সেও ছাঁদ থেকে নামতে শুরু করে।দেতলায় আসতেই প্রহরের সাথে ধাক্কা খায় সে।পরে যে নিচ্ছিলো ঠিক সময়ে প্রহর হাত ধরে ফেলেছে।অরিহা দ্রুত হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ায়।এরপর চোখ রাঙিয়ে প্রহরকে বলে,,,
“তুমি দেখে চলতে পারো না?সকালেই আমাকে ফেলে এখন আবার ও ফেলে দিতে চাইছো?”

“দোষ আমার একার না তোমার ও। তাই কথা কম বলো।এখন তো আমিই তোমাকে বাঁচালাম। সকালে তো দিয়েও গিয়েছি আমি”

“হুহ ভালো হয়েছে!তুমি এখন বাড়িতে কেনো?ব্যাচে যাও না নাকি?”

“তোমাকে বলবো কেনো?তুমি তোমার কাছে যাও। তোমার সাথে আজাইরা কথা বলার সময় নেই আমার।যাও তো”

প্রহর চলে যেতে থাকলো।অরিহা পেছন থেকে চিল্লিয়ে বলল,,,“তোমার সাথে আমার ও আজাইরা কথা বলার সময় নেই বুঝেছো?ফালতু,বেয়াদব ছেলে”

প্রহর কানে তুলল না। সে চলে গেলো।অরিহা ফুঁসতে ফুঁসতে চিত্রাদের কাছে আসলো। সাজিয়া অস্বস্তিতে পরেছে।কখনো ভাবেনি যে এই সময়ে তার নিশীথের সাথে দেখা হবে।চিত্রার এতে কিছু যায় আসে না।সে তার মতো আছে। অরিহা এসে দু’জনের পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,,,
“কেমন আছো সাজিয়া আপু?”

“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি অরিহা। তুমি কেমন আছো”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আচ্ছা শোনো এরপর থেকে তোমাকে আপু বলবো না ভাবি?নিশীথ ভাইয়াকে তো আমি অনেক আগে থেকে চিনি”

সাজিয়া বিব্রত হলো।অতঃপর বলল,,, “তোমার যা ইচ্ছে তাই বলে ডেকো। আমার সমস্যা নেই।পড়াশোনা কেমন চলছে?স্কুলে যাচ্ছো তো?”

“মোটামোটি হচ্ছে আরকি। পড়তে ভালো লাগে না।”

করুন কন্ঠে বলল অরিহা শেষের কথাটা। চিত্রা এবং সাজিয়া হেসে ফেললো।তারা এমন কতো করেছে। তাদের ও কি ভালো লাগতো পড়তে।তারা ও তো কতো ফাঁকি দিতো।এখনও দিয়ে যাচ্ছে। চিত্রা তো বই ধরতেই ইচ্ছে করে না। তবুও পড়া ঠিক রাখে। তার ব্যাপারটা এমন হচ্ছে।তবে পরীক্ষার একমাস আগে থেকে ইচ্ছে মতো পড়াশোনা করে। আর প্রতিদিন তো ক্লাস করছেই।এতেই হয়ে যায়।অরিহা তো আজকে স্কুলে গিয়ে কি কি করেছে সে গুলো বলতে শুরু করে দিয়েছে। চিত্রা আর সাজিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

“দোস্ত সাজিয়া এখানে এসেছে?”

আষাঢ় আনমনে উত্তর দিলো,,,,“হু”

সমুদ্র কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে।সে তো জানেই না সামনের ছাঁদে বসে থাকা রমনীর মাঝে একজন তার বন্ধুর হবু স্ত্রী।কারণ সে তো ছবিই দেখেনি এখনো সাজিয়ার।সে যদি জানতো তবে কেমন রিয়াকশন দিতো শুধু সেই জানে।শেষমেশ কি না চিত্রারা এবং তার প্রিয় বান্ধবী তারই দুই বন্ধুর কপালে জুটবে এটা ভেবেই তো সমুদ্র হ্যার্ট এট্যাক করতো।সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো,,,
“সাজিয়াটা কে?”

প্রহর দাঁত কেলিয়ে বলল,,,“তুমি জানো না সমুদ্র ভাই আমার আপুর বান্ধবী ওই যে ওই ছাদে আপুর সাথে যে আছে ওইটা নিশীথ ভাইয়ার হবু বউ”

সমুদ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দু’জনের দিকে।প্রহর হাসছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। আষাঢ় ও নিশীথ তাকালো একে অপরের দিকে।সমুদ্র যে এখন তাদের মাথা খাবে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।আষাঢ় বিরক্ত হয়ে তাকালো সমুদ্রের দিকে।সমুদ্র বলল,,,
“নিশীথ তুই বিশ্বাসঘাতকতা করলি?আমাকে এই আমাকে বললি না।আর সাথে তুই ও আষাঢ়। এতো বড় ধোকা।আমি এখনই কথা বলবো হবু ভাবির সাথে”

নিশীথ বিরক্ত হয়ে বলল,,,“মোটেও না। সেদিন ফোন করেছিলাম,দুপুরে একসাথে খাবো বলেছিলাম না তোকে।তুই না করলি কেনো?সেদিন গেলেই তো সাজিয়াকে দেখতে পেতি।এখন আর সম্ভব না।বিয়ের সময় দেখে নিস”

সমুদ্র মন খারাপ করলো।সেদিন তাহলে এর জন্যই ফোন করেছিলো নিশীথ।সেদিন ব্যস্ত থাকায় না করেছিলো সে।তবে এখন আফসোস হচ্ছে। সে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে চিত্রাদের ছাদে উঁকি দিলো।উঁকি দেওয়ার কারণ সাজিয়াকে দেখা।তবে সাজিয়া উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে বিধায় দেখতে পারছে না।আষাঢ় নিশীথ প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখছে সমুদ্রের কান্ড।আষাঢ় ধমক দিয়ে বলল,,,
“সোজা হয়ে চুপচাপ দাঁড়া।ওদিকে মোটেও তাকাবি না। আমরা আড্ডা দিবো এখন”

সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ।আরমান সাহেব,চিত্রা সাজিয়া,মরিয়ম সুলতানা,প্রহর সবাই মিলে সন্ধ্যার নাস্তা করতে বসেছে।আরমান সাহেব টুকটাক কথা বললেন সাজিয়ার সাথে।দোয়াও করলেন তার ভবিষ্যতের জন্য।সে মেয়েটির ভালো চায়।সন্ধ্যার নাস্তা করে বের হলো সে।সাজিয়া তাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

“আমি আসবো।রিকশা ঠিক করে দেবো আমি?”

সাজিয়া মৃদু হেসে জানালো,,,“উহু প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো”

চিত্রা বিদায় নিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য দাঁড়ালো।তবে রিকশার কোনো খোঁজ নেই।বিরক্ত হয়ে হাঁটা ধরলো সে।মেইন রোডের কাছাকাছি এসে রিকশার জন্য দাঁড়ালো।পাশ ফিরে তাকাতেই নিশীথকে দেখে চমকে উঠলো।নিশীথ মৃদু হাসলো।মেয়েটি তাকে দেখে যে চমকেছে তা মুখ দেখেই বুঝেছে সে।আসলে বিকালে সাজিয়াকে দেখার পর তার খুব ইচ্ছে করছিলো সাজিয়ার সাথে কথা বলার।যদিও তা সম্ভব হয়নি।কিছুক্ষণ আগে সে আর সমুদ্র যখন বের হচ্ছিলো আষাঢ়দের বাড়ি থেকে তখনই সাজিয়াকে দেখেছে।সমুদ্রকে যেতে বলে পিছুপিছু এসেছে সে সাজিয়ার।সাজিয়া নিজেকে সামলে বলল,,,

“আপনি!আপনি এখানে যে?কোনো কাজ আছে?”

“উহু নাহ।তোমাকে চিত্রাদের বাড়ি থেকে বের হতে দেখে আসলাম তোমার পিছুপিছু।তোমার কি সমস্যা হচ্ছে আমি তুমি বলাতে?”

“নাহ বরং আপনি যদি আমায় তুমি নদ বলতেন তাহলে আমার অদ্ভুত লাগতো।”

“সাজিয়া তুমি চাইলে আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি?যাবো তোমার সাথে”

নিঃসংকোচ আবদার নিশীথের।সাজিয়া ফেলতে পারলো না। দুদিন পরই তো এই লোকটা তার সব থেকে আপন হবে।তাই মানা না করে বললো,,,
“আপনি যেতে চাইলে আমার সমস্যা নেই নিশীথ সাহেব”

নিশীথ হাসলো।অতঃপর রিকশা ঠিক করলো।দু’জন চড়ে বসলো তাতে। নিশীথ যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে।ভালো লাগলো বিষয়টি সাজিয়ার।লোকটাকে তার ভালো লেগেছে।সুদর্শন,ব্যবহার ভালো আর কি চাই।সব দিক দিয়ে সে তার জন্য ঠিক আছে।তার এই সব নিয়ে চিন্তা নেই তবে চিত্রাকে নিয়ে সে চিন্তিত।চিত্রার জীবনে কি আদেও কেউ আসবে?চিত্রার সব ভুল ধারণা দূর করে দিবে।এটা নিয়েই চিন্তিত সে।তবে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে সে।আষাঢ়!হ্যাঁ আষাঢ়কে তার চিত্রার জন্য পছন্দ হয়েছে।পুরুষটির চোখে মুখে সে চিত্রার জন্য মুগ্ধতা দেখেছে।সে ধারণা করেছে লোকটি পছন্দ করে চিত্রাকে।নিশীথের এমন নিস্তব্ধতা পছন্দ হলো না।

“সাজিয়া আম্মা বলছিলো আগামীকাল আপনাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে যেতে।আপনি কি যাবেন?”

সাজিয়ার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো।সে জবাব দিলো,,,“আপনি মামাকে বলতে পারেন।মামা যদি বলেন তাহলে যাবো”

“আচ্ছা ঠিক আছে তবে আমি তাকে ফোন করে রাতে জানাবো।আপনি সকাল সকাল রেডি থাকবেন সাজিয়া।আর যদি আপনার আমার সাথে একা যেতে অস্বস্তি হয় তাহলে আপনি কাউকে নিয়ে যেতে পারেন।”

সাজিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।এরপর দু’জন চুপ।কেউ কোনো কথা বলছে না।সাজিয়া চুপ করে রাতের শহর দেখছে।আর নিশীথ সে আড়চোখে তার হবু বউকে দেখছে।তার বেশ ভালো লাগছে এভাবে সাজিয়ার সাথে যেতে।সে বিড়বিড় করে বলল,,,

“এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলতো?”

#চলবে~