#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪১
ঘুম ভাঙতেই ঠিক নিজের শক্ত হাতটা কারো নরম হাতের মুঠোয় পেলো পূর্ণ। অসুস্থ, ক্লান্ত শরীরটা আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। চোখ মেলতেও কষ্ট হলো কিছুটা। বারকয়েক চোখ ঝাপটাতেই রেটিনায় ভেসে উঠে কারো সিগ্ধ কান্নামাখা চোখ। নারীটির নজরও তার দিকেই। পূর্ণ’র ঠোঁটে তখন অদৃশ্য হাসি। সচারাচর হাসা হয় না তার অনেক বছর ধরে কিন্তু তার পূর্ণ্যময়ীটাকে পাওয়ার পর থেকেই তার প্রাণ খুলে হাসতে মন চায়। মন চায় বুকের ভেতর পুরে রাখতে এই নরম তুলতুলে নারীটিকে। এই নারীর চোখের পানি ও যেন তার ভালোলাগে। ভালোলাগাটা অদ্ভুত। এই যেমন ভালোলাগে পরক্ষণেই বুকে বিঁধে। নিজের ভালো হাতটা দিয়ে মৃত্তিকা’র গাল ছুঁয়ে দিতেই মৃত্তিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে। একবার আবারো সেই হাউমাউ কান্না। পূর্ণ থমকে যায় কিয়ংকাল। তার জন্য কাঁদে তার পূর্ণ্যময়ী। ভালো হাতটা মৃত্তিকা’র পিঠে রাখলো সে। থামানোর ভঙ্গিতে হাত বুলালো। কন্ঠ তার আজ বড্ড নরম শুনালো,
— কাঁদে না মৃত্ত। আমি ঠিক আছি। দেখি তাকান আমার দিকে।
মৃত্তিকা তাকায় না। তার কান্না বাড়ে ঠিক যেমন ছোট বাচ্চাদের কান্নার সময় আদর দিলে কান্না বাড়ে। পূর্ণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এবার কন্ঠটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— মৃত্ত? থামতে বলেছি আপনাকে?কেন কাঁদছেন? ঠিক আছি তো আমি।
গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললেও আদুরে হাত বুলাচ্ছে সে মৃত্তিকা’র পিঠে। মৃত্তিকা থামলো তবে সময় নিয়ে। হিচকি তুলছে সে বারবার। বুকে মুখ গুজে রেখেছে। পূর্ণ ও ভালো হাতটা দিয়ে তাকে আদর দিচ্ছে। ভেবে পায় না পূর্ণ, কেউ এতটা আদর পাগল কিভাবে হয়? এই যে মৃত্তিকা’র বাবা অসুস্থ কিন্তু না মৃত্তিকা আদর খেলো বাবা থেকে, এখন পূর্ণ’র এক কাঁধে আঘাত তাকে কি সে পূর্ণ্য’র ভালো হাতে আদর খাচ্ছে। মিনিট পনেরো লাগলো তার ঠিক হলো। মুখটা তুলেই নাক টেনে নিয়ে চোখ রাখলো কাঁধের উপর। জিজ্ঞেস করলো,
— অনেক ব্যাথা?
— না।
— আমি জানি ব্যাথা করছে।
— আচ্ছা করছে।
পূর্ণ’র এহেন খামখেয়ালি উত্তর ভালো লাগে না মৃত্তিকা’র। সে নত মস্তিষ্কে জিজ্ঞেস করলো,
— ফ্রেশ হবেন না?
— হব।
বলেই উঠতে নেয় পূর্ণ। কাউচে শুয়াতে কিছুটা পিঠে ব্যাথা করছে তবে ঘুম ভালো হয়েছে তার। ভরটা মৃত্তিকা’র কাঁধে দিয়ে উঠতে নিলেই মৃত্তিকা ধপ করে কাউচে বসে পরলো। পূর্ণ হাসলো দুর্বোধ্য। তার ভর সামলাতে শিখে নি এখনও তার পূর্ণ্যময়ী। মৃত্তিকা লজ্জাই পেলো কিছুটা। এটা কি হলো? পুনরায় উঠে সে পূর্ণ’কে সাপোর্ট দিলো। ওয়াসরুমে নিয়ে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে। পূর্ণ’র আঘাতটা ডান কাঁধে হওয়াতে সে ব্রাশ বা হাতে করতে নেয় কিন্তু কাজটা কষ্টকর। মৃত্তিকা নিজ হাতে তাকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে নিজে মুখটাও ধুয়ে দেয়। রুমে এনে মুখ টা মুছাতে মুছাতে আফসোসের সহিত বললো,
— গতকাল কষ্ট হয়েছে অনেক তাই না?
— ততটাও না। আব্বু হেল্প করেছিলো।
— ওহ।
দরজায় নক হতেই মৃত্তিকা উত্তর করে,
— কে? এসো।
— আপা আমি।
মিঠি’র কন্ঠ পেতেই মৃত্তিকা দরজা খুলে দেয়। সকালেই ওর বাবা ওর রুমে চলে গিয়েছেন। মেয়ে আর জামাই’কে একটু স্পেস দেয়া দরকার। মিঠি’কে দেখেই প্রশ্ন ছুঁড়ে মৃত্তিকা,
— আব্বু উঠেছে?
— না। দুলাভাই এর নাস্তা দিতে বলেছিলো মামা। তার ঔষধ আছে নাকি। আর ডাক্তার আসবে ড্রেসিং করাতে। তাই নাস্তা করে নিলে ভালো হতো।
মৃন্ময় হাওলাদার ভোরেই মিঠি’র মা’কে সবটা বলে রেখেছিলেন তাই সবটা গুছিয়েই মিঠি’কে দিয়ে ডাক পাঠায়। মিঠি ভেতরে এক পলক পূর্ণ’কে দেখে নিয়ে বললো,
— রুমে নিয়ে আয়। সাথে এক গ্লাস গরম দুধ আনিস তো।
“আচ্ছা” বলেই মিঠি চলে যায়। রুমে ঢুকে বিছানায় হেলান দিয়ে পূর্ণ’কে বসাতে সাহায্য করে। পূর্ণ চোখ ঘুরিয়ে রুমটা দেখে বললো,
— আব্বু আজ আমার জন্য এতটা কষ্ট পেলো মৃত্ত। এখনও শান্তি নেই। আমি এসে তার রুম আর মেয়ে দু’টোতেই ভাগ বসিয়ে বসে আছি।
— শুয়ে আছেন।
কথাটা বলেই মৃত্তিকা ওর পাশে বসে। এক হাত পূর্ণ’র গালে রেখে বলে,
— আল্লাহ চেয়েছেন তাই এমনটা হয়েছে।
— এটা আপনার বুলি না। তোতাপাখি না আপনি? বাবা’র বুলি বলছেন।
মৃত্তিকা হাসলো একটু। পূর্ণ’র কাঁধের দিকে দৃষ্টিপাত করে আলতো হাতে একটু স্পর্শ করে বললো,
— আমার কষ্ট হয় আব্বু’কে, আপনাকে এভাবে দেখলে।
পূর্ণ কিছু বলার আগেই দরজায় ঠক ঠক হলো। মৃত্তিকা উঠে ট্রে টা নিয়ে নিজেই পূর্ণ’র মুখে খাবার তুলে দিলো। পূর্ণ খেতে খেতে বললো,
–আপনার হাতের বিরিয়ানি…
— একটুও না। ডক্টর বলেছে লাইট খাবার খেতে।
পূর্ণ কথা বাড়ায় না। মেনে তার মৃত্ত’র কথা। দুধ পুরোটা খায়িয়ে দিয়ে পূর্ণ’র মুখ মুছে দেয় মৃত্তিকা। গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বললো,
— আব্বু’কে দেখে আসি।
পূর্ণ মাথা নাড়ে। মৃত্তিকা অনেকটা সাহস সঞ্চার করে পূর্ণ’র ডান হাতটা মুঠোয় পুরে একটা চুমু খেয়ে বললো,
— জলদি সুস্থ হোন এমপি সাহেব।
পূর্ণ থ হয়ে বসে থাকে। মৃত্তিকা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। “এমপি সাহেব” ডাকটা অন্য রকম লাগে পূর্ণ’র কাছে। গতকাল থেকে অনেকেই তাকে এই নামে ডেকেছে তবে মৃত্তিকা’র মুখ থেকে ডাকটা অদ্ভুত সুন্দর শুনালো। একদম ভিন্ন।
বাবা’কেও আজ নিজ হাতে খায়িয়েছে মৃত্তিকা। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে আপাতত পূর্ণ আর সে এই এখানেই থাকবে। তাহলেই তো হলো। বাবা আর পূর্ণ’কে একসাথে পাবে ও। কিন্তু ওর আশায় গুড়ে বালি ঢেলে ওর শশুড় শাশুড়ী হাজির ছেলের শশুর বাড়ী।
পূর্ণ সহজ গলায় বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— শশুর বাড়ী আমার। যখন খুশি তখন আসতে পারি। বউয়ের টানে আরকি কিন্তু তোমরা কেন টপকালা এই সাত সকালে?
বাবা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
— সকালে দেখি তোমার রুম খালি। এসেছো ভালো কথা। বলে কয়ে আসে না মানুষ? চিন্তা হয় না আমাদের?
ওর মা আবার এসব বিষয়ে নিরুত্তাপ। সে মৃন্ময় হাওলাদারের হাল হকিকত জিজ্ঞেস করছেন। তার ছেলের প্রাণ বাঁচাতেই তো এই অবস্থা তার।
তারা পূর্ণ’কে নিতে চাইলেই পূর্ণ বলে উঠলো,
— দেখো আমার দরকার বউ। আব্বু’র দরকার মেয়ে। তাই আমি এখানেই আছি। বউয়ের কাছে। খবরদার আব্বু ঘরজামাই ভাববে না আমাকে।
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন পূর্ণ’র বাবা। শশুর বাড়ী ঢেরা গেড়ে এখন বলে সে কি না ঘরজামাই না! আশ্চর্য!
_________________
সবাই’কে অবাক করে দিয়ে মৃত্তিকাদের বাসায় বিকেল নাগাদ উপস্থিত হয় সাফারাত মির্জা। মৃত্তিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এটা নিয়ে তৃতীয় বার দেখা এই লোকের সাথে তার। আগের দু’বারের সাক্ষাৎ গুলো মোটেই শোভনীয় ছিলো না। পূর্ণ’র কাছ থেকে কম কড়া কথা ও শুনে নি ও। সাফারাত মৃদু হেসে সালাম জানিয়েই বললো,
— পূর্ণ’কে দেখতে এসেছি।
মৃত্তিকা রুমে ঢুকার জায়গা দিলো। পূর্ণ তখন ঘুমাচ্ছে। ঘন্টা দুই এক হবে তার ঘুমের। গালি গায়ে কাঁধে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। সাফারাত ঠিক ওর পাশে বসে। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তা সরিয়ে নেয়। মৃত্তিকা’র দিকে না তাকিয়েই বলে,
— কেমন আছে এখন ও?
মৃত্তিকা যেন কথা বলার ভাষা পায় না। মৃন্ময় হাওলাদার আগন্তুক ব্যাক্তিকে দেখেই এই রুমে আসেন। সাফারাত তাকে দেখেই সালাম জানিয়ে নিজের পরিচয় দিয়। মৃন্ময় হাওলাদার সালামের জবাব দিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আলাপ চালায় ওর সাথে। মৃত্তিকা কিছুটা না বরং বেশ অবাক হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ওর বাবা’র সাথে কি খাতির সাফারাত নামক লোকটার?
ওদের কথার মাঝে পূর্ণ জেগে উঠে। নিজের পাশে সাফারাত’কে দেখেই কিছুটা আশ্চর্য হয়। মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কি চাই? আমার শশুড় বাড়ী এটা। যে না সেই কেন এসে দই জমাস?
সাফারাত হেসে পূর্ণ’র কথার প্রতিত্তোরে বললো,
— কি করব বল,মৃত্তিকা’র একটা বোন থাকলে নাহয় তাকে বিয়ে করে নিতাম। তখন আমারও শশুর বাড়ী হতো এটা।
পূর্ণ এবার ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,
— কেন এসেছিস? আমার খোঁজ নিতে? নেয়া শেষ? বিদায় হ!
মৃন্ময় হাওলাদার ওদের কিছু না বলে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— আম্মা? মিঠি’র মা কে দিয়ে বিকেলের নাস্তা রুমে পাঠাতে বলুন।
মৃত্তিকা আবুলের মতো চলে গেল বাবা’র কথা শুনে।
মন্ময় হাওলাদার পূর্ণ’র দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
— নিউজ দেখা উচিত তোমার পূর্ণ।
— তার দরকার নেই আব্বু। স্বয়ং সাংবাদিক সামনে বসা।
কথাটা সাফারাতের দিকেই তাকিয়ে বলে ও। সাফারাত বাঁকা হাসে তাতে। সরস গলায় জানায়,
— নিউজে রেকর্ডিং ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মুহুর্তেই ভাইরাল।
পূর্ণ চোখ বুজে নিলো। ধ্বংস তো মাত্র শুরুর পথে। মহা প্রলয় ঘটাবে এবার পূর্ণ।
ঐ দিন যখন নির্বাচনের আগে শোয়েব মির্জা সাফারাত’কে দিয়ে ডাকায়। টাকা সহ বিভিন্ন কিছু অফার করে নির্বাচন থেকে হটে দাঁড়াতে। তার সকল কথাই রেকর্ড করা হয়েছিলো পূর্ণ’র ফোনে। বুদ্ধিটা ছিলো সাফারাতে’র। আজ ঠিক নির্বাচনের পরদিন তা ভাইরাল। যদিও পরিকল্পনা হিসেবে কথা ছিলো ওটা ঠিক নির্বাচনের আগ মুহূর্তে করা হবে কিন্তু শোয়েব মির্জা’র হামলার কারণে তা কারো স্মরণে ছিলো না৷
মিঠি দরজায় টোকা দিতেই সকলে ওর দিকে তাকায়। আড়ষ্টতা নিয়েই মিঠি বলে,
— আপা দুলাভাই’কে ফ্রেশ করাবে।
সবাই বুঝে। উঠে ড্রয়িং রুমে পা বাড়ায়। পূর্ণ তখনও বিছানায় বসে। তার মস্তিষ্ক তাকে ভিন্ন কিছু জানান দিচ্ছে। সবাই বের হতেই মৃত্তিকা রুমে এসে পূর্ণ’কে ধরে উঠায়। ফ্রেশ হতেই সবাই খেতে বসে। মৃত্তিকা ওর বাবা’কে সবটা গুছিয়ে দিয়ে স্যুপ পূর্ণ’র মুখে তুলে তুলে খাওয়াচ্ছে। নির্লিপ্ত পূর্ণ ও খাচ্ছে এবং আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। মৃন্ময় হাওলাদার সন্তুষ্ট হলেন মেয়ের উপর। এটাই চেয়েছিলেন তিনি। তার মেয়েটা তাকে ছাড়া ও একজনকে আঁকড়ে ধরুক। ভরসার স্থান হোক। বাবা’র বুক থেকে সরে পূর্ণ’র বুকে শান্তি খুঁজুক।
#চলবে…..