এক আকাশ অভিমান পর্ব-০১

0
207

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#সূচনা_পর্ব

বিয়ের দিন সকালে বর পালিয়ে গেছে শুনেই বাড়িতে লঙ্কা কান্ড বেধে গেছে।চারিদিকে মানুষ কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহেরা বেগম রুমে এসে ঠা*স করে চর বসিয়ে দিলেন তরীর গালে।
মাথা নিচু করে বসে আছে তরী।কিছু বলার সাহস বা ভাষা নেই।
” অপয়া মাইয়া মানুষ। স্বামীডারে তো আগেই খাইছোস এহন কি আমার পোলাডারে বাড়ি ছাড়া করবি? তোর লাইগ্যা আমার পোলা ডা বাড়ি থাইক্কা পালাইয়া গেছে। নিজে তো একটা অপয়া লগে জন্ম দিছস একটা অলক্ষ্মী মাইয়া।জন্ম নিতে না নিতেই বাপ ডারে খাইয়া ফালাইছে। তোগো লাইগ্গা যদি আমার বাজান বাড়ি না আহে তাইলে আমি কাওরে ছাইড়া কথা কমু না।

” চুপ করুন চাচী আম্মা !! আমাকে যা খুশি বলেন কিন্তু দোহাই লাগে আমার নিষ্পাপ মেয়েটা কে কিছু বলবেন না দয়া করে।

” এহহ!! অ*ল*ক্ষ্মী রে অ*ল*ক্ষ্মী কমু না তো কি কমু? জন্ম নিয়াই বাপরে খাইয়া ফালাইছে। তোমার ও বলি হারি বাপু স্বামী গত হবার ৬ মাসের মধ্যে আমার পোলার গলায় ঝুইলা পরবার চাইতাছো? লজ্জা সরমের কি মাথা খাইছো?
তাহেরা বেগম আরো কিছু কথা শুনিয়ে রুম ত্যাগ করলেন।এই দুজন কে তিনি মুঠেও সহ্য করতে পারেন না।

কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছে তরী। নিয়তি তাকে এই কোন পরীক্ষায় ফেললো।
” শুধু মাত্র তোকে নিজের কাছে ধরে রাখতে গিয়ে আজ এই দিন টা এলো রে মা। তোকে কি করে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে যাই বল। তুই যে আমার নাড়িছেঁড়া ধন।আমার বেচেঁ থাকার শেষ আশ্রয় তুই। তোর বাবার শেষ চিহ্ন।

অবুঝ শিশুটি মায়ের কথা কিছুই বুঝলো না। তবে মিষ্টি হাসলো মুখে আঙ্গুল দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত পা ছুড়ে হাসতে লাগলো। মেয়ের মুখে হাসি দেখে সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলো তরী।


” যে করেই হোক তোমার ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনো তাহেরা। তুমি বুঝতে পারছো কত বড় ভুল করেছে তোমার ছেলে। ”

” এইডা আপনে কি কন, আমার পোলা ভুল করছে মানে? ও তো একদম ঠিক কাম করছে। একটা বিয়াতি মাইয়ারে আমার এত সুন্দর পোলা কেনো বিয়া করবো। লগে আবার অপয়া মাইয়া আরেকটা।
আমাগো পোলা কি দেখতে শুনতে খারাপ যে ওই রহম একটা মাইয়া রে বিয়া করবো।তাছাড়া শ্রাবণ একটা মাইয়ারে পছন্দ করে হেরেই বিয়া করবো। শহুরে মাইয়া অনেক সুন্দর।”

” রাখো তোমার শহুরে মাইয়া। এই বিয়েটা হলে তোমার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। বড় ভাইয়ার সমস্ত সম্পত্তি ছিল অনিকের নামে। অনিক মারা যাওয়ায় ওর সমস্ত সম্পত্তির মালিক ওই তরী আর ওর মেয়ে চাঁদ। চাঁদের বয়স যখন ১৮ হবে তখন সব কিছু চাঁদের নামে হবে। আমাদের তো কিছুই নেই তুমি শুধু ভাবো যদি একবার তরীর সাথে শ্রাবণের বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে সমস্ত সম্পত্তি হবে আমাদের শ্রাবণের। তখন তোমার ছেলের ভবিষ্যৎ সোনায় সোহাগা। আমাদের ও অভাব থাকবে না। সমস্ত ধার দেনা শোধ করে দিতে পারবো। ”

রমিজুল সাহেবের কথা শুনে চোখ দুটি চিকচিক করে উঠলো তাহেরা বেগমের। ” এইডা তো আমি ভাইব্বা দেখি নাই। আমি তো মনে করেছি সম্পত্তি সব বড় ভাইয়া ভাবির নামে। অনিকের নামে থাকতে পারে হেইডা জানতাম না। এই কথাখান আপনে আমারে আগে কইতে পারেন নাই ? তাহলে পোলাডা রে পালাইতে সাহায্য করতাম না। কিন্তু ভাই ভাবী কি সম্পত্তি দিবে শ্রাবণ রে। ওরা তো সম্পত্তি বাঁচানোর লাইগ্যা তরী রে আবার বিয়া দিয়া নিজেদের কাছেই রাখতে চাইতাছে।”

” একবার বিয়ে হয়ে গেল আর চাঁদ ১৮ বছরের হলে ভাইয়া ভাবী আর কিছু করতে পারবে না । ওকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বলো। যে করেই হোক সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না তাহেরা। যদি তোমার ছেলের জন্য সম্পত্তি হাতছাড়া হয় তাহলে তোমার ছেলেকে আমি ত্যাজ্য করবো।”
_________________

” হ্যা মা বলো! ঐদিকের কি অবস্থা? বিয়ে কি ক্যান্সেল নাকি অন্য পাত্র জোগাড় করেছে।”

” এত কিছু কইবার সময় নাই তুই যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয় বাপ।এই বিয়ে তোর করতেই অইবো। হেইডা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই,,!”

“অসম্ভব! এই বিয়ে আমি কিছুতেই করবো না। তুমি তো জানো মা আমি নদী কে কত ভালোবাসি। তরী অনিক ভাইয়ার স্ত্রী। সম্পর্কে আমার ভাবী হয়। আমি কিছুতেই এই বিয়ে করবো না। ”

” তুই এই বিয়ে না করলে তোর বাপ তোরে ত্যাজ্য পুত্র
করবে বাবা। এই বাড়ির দরজা তোর লাইগ্গা চিরতরে বন্ধ অইয়া যাইবো। সাথে তোর বাপ আমারেও বাড়ি থিক্কা বাইর কইরা দিবো। তুই তাড়াতড়ি বাড়ি আয় বাজান।তুই বাড়ি আইলেই তরে সব বুঝাইয়া কমু আগে বাড়ি আয়। তোরে আমার কসম দিলাম…””

কল কেটে মাথার চুল খামচে ধরলো শ্রাবণ। এই বিয়ে টা হলে নদীকে কি বলবে। মেয়েটা অনেক ভালোবাসে শ্রাবণকে। তিনটা জীবন নষ্ট হবে।উফফ সবাই কেনো আমার দিক টা ভেবে দেখছে না। আর ওই তরী কি করে রাজি হলো বিয়েতে। সে বারন করে দিলেই তো পারতো। নাকি পুরনো হিসাবের খাতাটা আবার খুলতে চাইছে?
নাহ কিছুই ভাবতে পারলো না শ্রাবণ। ওই দিকে তাহেরা বেগম বার বার কল দিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ির উদ্দেশ্যে।


” কি ব্যাপার রমিজুল, তোমার ছেলে শ্রাবণ কোথায়?
শুনলাম পালিয়ে গেছে। তা তোমার ছেলে কি বিয়েটা করবে না নাকি আমি অন্য ছেলে দেখবো ”

সিরাজুল সাহেবের কথায় মনে মনে ভয় পেলেন রমিজুল। ভাই কি তাহলে অন্য পাত্র দেখেছেন? না না এটা হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনো মূল্যে এই সম্পত্তি চাই।
” পালাবে কেনো ভাইজান! শ্রাবণ তো ওর খালার বাড়িতে গেছে। ওর খালা খুব অসুস্থ। একটু পরেই শ্রাবণ চলে আসবেন তুমি চিন্তা করো না ভাইজান। ”

” চিন্তা কি আমি সাধে করি। যে করেই হোক তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো। তরী কে এখানে আটকে রাখার একটাই উপায়। না হলে ওর মা যে করেই হোক নিয়ে যাবে আর অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবে।তরী যা মেয়ে প্রতিবাদ টুকুও করবে না। আমার নাতনি কে আমার থেকে দূরে থাকতে দিবো না আমি। আমার বংশের একমাত্র প্রদীপ চাঁদ। তরী চলে গেলো চাঁদকে নিয়েই যাবে। আমি চাই না চাঁদ এই বাড়ির বাইরে যাক। তাছাড়া এখানে আমার সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা ব্যাপার আছে। আশা করি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। না হলে আমি অন্যকাউকে দেখতে বাধ্য হব।। যা করার তাড়াতাড়ি করো।”
বলেই সিরাজুল সাহেব চলে গেলেন।
__________________

সন্ধ্যে হতেই কাজী সমেত হাজির হলেন রমিজুল।শ্রাবণ মাথা নিচু করে আছে। রাগে গজগজ করছে আর সব কিছুর জন্য তরীকে দায়ী করছে। কাজী সাহেব বিবাহের কাজ শুরু করলেন।

মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে তরী।পাশেই বসে আছেন রাবেয়া বেগম। পুত্রবধূ তরীকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন তিনি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ছেলের বউ নাতনী কে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। তবে তরীর বাড়ির লোক তরীকে নিয়ে যেতে চাইছিল। তাই বিয়ে দিয়ে তরীকে আর চাঁদ কে রেখে দেওয়ার এই ব্যাবস্থা নিয়েছেন সিরাজুল সাহেব। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাবেয়া বেগম। এরই মধ্যে কক্ষে কাজী সাহেব এসে কবুল বলতে বলেন ।

কবুল বলার সময় অনিকের সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্ত, খুনসুঁটি,বিয়ে , সন্তান, চাঁদের আগমনী বার্তা সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠল। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে বসে আছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু নিঃশ্বাস গুলো ও আটকে আছে।বড্ডো অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। একবার মেয়ের দিকে তাকালো। রাবেয়া বেগম তরীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তরীর মাথায় হাত দিয়ে ভরসা রাখতে বললেন। বেশ সময় নিয়ে কবুল বললো তরী।

তরী কবুল বলেছে শুনেই শ্রাবণের রাগ যেনো সপ্তম আকাশে। ” তুমি কাজটা ঠিক করো নি তরী। বিয়ের খুব শখ ছিল তোমার তাই না। তাহলে দেখো তোমার জীবনটা আমি কিভাবে নরক করি।তৈরি হও তরী। নতুন এক অভিশপ্ত জীবনের জন্য তৈরি হও। তোমার জন্য আমি কাঁটার বিছানা পেতে রাখব। নরক যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য তৈরি হও……….

#চলবে ইনশাআল্লাহ…..