যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
390

#যেখানে_পথচলা_শুরু |৩৩|
#লেখনীতে_সাদিয়া_মেহরুজ
পরিশিষ্ঠঃ

তীরুর পৃথিবী লণ্ডভণ্ড! চোখের সামনের দৃশ্য দেখে বুকে জ্বালা শুরু হয়েছে তারা। চক্ষুযুগল অশ্রুতে টইটম্বুর! তার পাতলা অধর জোড়া তির তির করে কাঁপছে। পাশেই তীরুর কোমল হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল অরোন। তীরুর অস্বাভাবিক হাল দেখে ও অন্তরালে কিয়ৎ হাসল! তীরুর আনন্দের পরিমাণ অনুভূত করতে পেরে ভীষণ শান্তি পেলো। ঠিক এতটুকু আনন্দ নিজ চোখে পরখ করার জন্যই তো এতো এতো পরিশ্রম, এতোটা কঠোর চেষ্টা তার!
পৃথিবীর একান্ত আপন, ভরসার মানুষ, শান্তিদাতা ব্যাক্তি এখন কেবল তো তীরুই। মেয়েটার প্রশান্তি দেখলে এতো আনন্দ লাগে। পরক্ষণে নিজের দৃষ্টি হটাল অরোন, তাকাল তীরুকে প্রশান্তি দেয়া মাধ্যম এর পানে।

সবুজে আচ্ছাদিত বিশালাকার পর্বত। সফেদ রঙের আকাশটা যেন গা এলিয়ে দিয়েছে পাহাড়ের বুকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বাতাসে বুনোফুলের মাদক মাদক ঘ্রাণ! গোধূলি বেলা হওয়াতে আলোর তীব্রতা কমে এসেছে অনেকটা। অন্তরীক্ষে লালচে রঙেরা এলোপাথাড়ি আঁচড় কেটে রেখেছে। পশ্চিমকাশে বৃহদাকার সূর্যটা গা এলিয়ে দিয়েছে প্রায়। হলদে, লালাভ আভায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে তেজ নিয়ে। নাম না জানা একঝাঁক শুভ্র পাখি ছুটছে নীড়ে ফেরার তাড়নায়। বিশাল পাহাড় সবুজ রঙা লতাপাতায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে মুড়িয়ে রেখেছে। বৃষ্টি হয়নি তবুও কোথা হতে সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে প্রবল বেগে। চোখের সামনে যে ক্ষুদ্র এক স্বর্গ রাজ্য! চোখ পড়লে প্রকৃতির রূপ দর্শন করে চোখে জ্বলুনি শুরু হয়। চোখের পল্লব পড়ে না। মানুষ কেবল স্থির হয়ে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে পরখ করে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাখেলা।

চারিদিকে কোলাহল। অনেক পর্যটক এসে ভীড় জমিয়েছে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখতে। আঁধার হওয়ার পূর্বেই এখান থেকে প্রস্থান প্রয়োজন। অরোন পাশে তাকাল। তীরু তার কাঁধে মাথা রেখে সামনে দৃষ্টি ফেলে রয়েছে। অরোনের ইচ্ছে করছিল না তীরুর ধ্যান ভাঙানোর। কিন্তু সন্ধ্যা নামবে যেকোন সময়। আঁধার হয়ে গেলে পাহাড় ছেড়ে হোটেলে ফেরাটা বড় দুষ্কর হয়ে উঠবে! সে ধীর গলায় তীরুকে ডাকল,

-” তীরু, তীরু! ”

কিয়ৎ কেঁপে তীরু মাথা উঁচু করে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো,

-” কি হয়েছে? ”

-” আমাদের ফিরতে হবে তীরু। দেখো সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। সবাই চলে যাচ্ছে।ওদের সাথে আমাদেরও প্রয়োজন। আমরা তো আর এখানকার স্থানীয় না। পথ চিনতে অসুবিধা হবে। ”

প্রাপ্তবয়স্ক তীরুর হটাৎ বারো, তেরো বছরের কিশোরদের ন্যায় জেদ ধরতে মন চাইল। কিন্তু তা কি আর সম্ভব! এখন ফেরা আসলেই জরুরি। ও নিম্ন কন্ঠে আওড়াল,

-” চলো যাই। ”

অরোন তীরুর হাত ভীষণ কোমলভাবে আঁকড়ে ধরে হাঁটা শুরু করলো। আশপাশ হতে সম্পূর্ণভাবে ধ্যান হটিয়ে নিয়েছে তীরু।অরোনের মুখাবয়বে এখন দৃষ্টি তার। আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি পুরুষের মতোই অরোন দেখতে। তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই তার চেহারায়। হলিউডের নায়কদের মতো দেখতে দারুণ সুন্দরও না, রূপকথার রাজকুমারের মতো দেখতে আকর্ষণীয়ও না। অরোনের এই সাধারণ চেহারাই তীরুর হৃদয়কে হিমশীতল করার অসাধারণ এক দৈবশক্তি রয়েছে। রয়েছে আকর্ষণ করার মতো চমৎকার ব্যাক্তিত্ব। নারীদের সৌন্দর্য তার নমনীয়তা তে হলে পুরুষের আসল সৌন্দর্য লুকায়িত থাকে তাদের ব্যাক্তিত্বে।

অরোনের সাথে তীরু পাড়ি দিয়েছে অনেক গুলো বছর। আজ তার বয়স ঠেকেছে বত্রিশের কোঠায়। তীরুর সুন্দর সময় গুলোর সাক্ষী অরোন। দুঃখের সময় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে কি দারুণ আগলে রাখে তাকে। এইযে এদেশ – ওদেশ ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন তার। তা পূরণ করতে তো অরোনই সহযোগিতা করেছে। বয়স কেবল বত্রিশের কোঠায় থাকাকালীন ও পৃথিবীর সাতটি দেশে নিজের পদচিহ্ন ফেলে এসেছে। এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে অরোনের জন্য। লোকটা পাশে না থাকলে হয়ত দেশের বাহিরে পা রাখার দুঃসাহসটা ওর আর করা হতো না। ওর সব স্বপ্ন পূরণে তার থেকেও যেন অরোনের দ্বিগুণ চেষ্টা, দ্বিগুণ আগ্রহ। এইযে সে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক এর পেছনে অনুপ্রেরণা এবং সফলতার গল্প বলা হলে সর্বপ্রথম উঠে আসবে তানহা এবং অরোনের নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন তার ছোট থেকেই। যা ত্রিশে পা দিতেই পূর্ণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার পেছনে তার শ্রম, মেধা, ও কঠোর পরিশ্রম ছিল। তবে সেই রাত গুলো যখন তীরু ভেঙে পড়তো এই ভেবে হবে না তার দ্বারা, সে ব্যার্থ! কিংবা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের পর ব্যার্থতার গল্প গুলো? তখন মানষিকভাবে ভেঙে পড়ার পর মনকে শক্ত করতে, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করেছে অরোন, তানহা। অতঃপর পছন্দের দেশ গুলোয় চষে বেড়ানোর গল্পটা? এর কৃতিত্ব অবশ্যই অরোনকেই দিতে হয়। সাংসারিক মনোভাব আসার পর তীরু অরোনকে একা ফেলে কিংবা একা একা কোথাও যাওয়ার সাহস করতো না!’একা দাপিয়ে বেড়াব’ সেই সাহসটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়ছিলো তার। শত হোক মেয়ে তো! তার নিরাপত্তা দেবে কি ঐ ভীনদেশে? তীরুকে একা কোথাও যেতে দেয়ার মনোভাব ছিল না অরোনের নিজেরও। মেয়েটাকে নিয়ে ও ভীষণ পসেসিভ। তাই সে চেষ্টা করেছিল যাতে দু’জনেরই একান্ত সময় কাটানোর পথ হয় পাশাপাশি তীরুটার ইচ্ছেও পূর্ণ হয়! এইতো, এরপর বাকিসব গুছিয়ে নিতো কেমন কেমন করে।

___

-” হ্যা আম্মু, আমরা কালই ফিরে আসছি। ” ফোন স্পিকারে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল গুলো দ্রুত হাতে তোয়ালে দ্বারা মুছে নিতে নিতে ফোনের ওপাশে চিন্তিত তানহাকে উত্তর দিল তীরু। আজ রাতই ওদের অস্ট্রেলিয়াতে শেষ রাত। কাল বেলা বারোটার দিকে প্যারিসের ফ্লাইট ওদের।

-” সাবধানে আসিস কিন্তু। তাড়াহুড়ো লাগাস না। আস্তে ধীরে কাজ করিস। প্লেনে ওঠার আগে ফোন দিস। ”

লাগেজের ওপর ভেজা তোয়ালেটা ছড়িয়ে দিয়ে তীরু খানিক হাসল। তানহা তো আর জানেন না, তীরু আর আগের তীরু নেই! সে বদলে গিয়েছে ভীষণ। নিজেকে তৈরি করেছে অন্য এক তীরু হিসেবে। তার এই পরিবর্তনটা এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার পর। যতই হোক শিক্ষক সে। তাকে কি আর এলোমেলো হলে চলে? তানহা এখন অব্দি অবশ্য তীরুর পরিবর্তনটাকে খেয়াল করেননি। সে প্যারিসে এসেছে এইতো কয়েকমাস হলো।অবশেষে এতো গুলো বছর পর তাকে রাজি করানো গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে আসার এক সপ্তাহ আগে তানহা এসেছিলেন প্যারিসে। তীরুকে কাছে পেয়েছেন এক দিনের জন্য। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পূর্বের দিন। তীরুর বিশ্ববিদ্যালয় প্যারিসের শেষ প্রান্তে। বলা চলে প্যারিসের বাহিরে। তাই যেদিন প্রচুর কাজ জমে যায় সেদিন ও আর বাড়ি ফিরেনা। ইলির সাথে মেসেই থেকে যায়। নয়তো দেখা যায় তার কাজ শেষ হয় রাতে, সেখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময় হয়ে যায়।

তীরু ফোন হাতে নিয়ে মা’কে বিদায় দিয়ে কে টে দিলো। সবকিছু গোছানো শেষ। রাত পোহালেই ছাড়তে হবে এই সুন্দর শহরটাকে। সে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। অরোন তখন শাওয়ার নিচ্ছে। তীরু বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ানোর কিয়ৎক্ষণ পর তার আগমন ঘটলো। তীরুর অবস্থান নিশ্চিত করে সে তার নিকট গেল। তার উপস্থিতি টের পেতেই তীরু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

-” খালি গায়ে ঘুরঘুর করছো কেন? জামা – কাপড় নেই তোমার? ”

নিশ্চুপ অরোন! তার সম্মুখে দাঁড়ানো ত্রিশ বছর পার করা নারীটিকে দেখছে সে অবাক নয়নে। তার হটাৎ মনে হলো, তীরু ত্রিশের কোঠা ছুঁয়ে ফেললেও তার চোখে তীরু এখনো সেই ছাব্বিশ বছরের নারীই যেন। মেয়েটার বয়স বেড়েছে কিন্তু চেহারার গড়ন ঠিক আগের মতোই। বয়সের ছাপ পড়েনি। সময়ের সাথে একটুও বদলায়নি মুখের আদল। সবকিছুই যেন একই রয়ে গেছে। ও হাত বাড়িয়ে তীরুকে হেঁচকা টানে নিজের সন্নিকটে নিয়ে এলো। মুখ থুবড়ে তীরু পড়লো তার বুকে। বিরক্ত হলো তীরু! কঠিন গলায় শুধাল,

-” কি সমস্যা আপনার? ”

-” অনেক অনেক সমস্যা। সব সমস্যার জন্য দায়ী তুমি। ”

-” আমি আবার কি করলাম? ”

-” আমার প্রাণহীন জীবনে প্রাণ দিয়েছ, বেঁচে থাকার কারণ দিয়েছ! এতো কিছু দিয়ে তো লোভ লাগিয়ে দিয়েছে মেয়ে। স্বপ্ন মনে হয় সবকিছু। আমার কপালে এতো সুখ লিখা ছিল? ভয় হয় তোমাকে নিয়ে। কখনো ছেড়ে যেওনা। আমি সত্যি মা রা যাব তবে। ”

পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হলো তীরু। অরোনের কপালে টুপ করে চুমু বসিয়ে বলল,

-” যতদিন বেচে আছি ততদিন পাশে থাকব। ”

চারদিকে মৌনতা নেমে এলো হুট করে। তীরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে আওড়াল,

-” আপনাকে আরো অনেক কিছু দেয়ার আছে অরোন। আপনাকে বাবা ডাক শোনানোর জন্য অধির আগ্রহে বসে আছি। আল্লাহ তায়ালা একটু যদি মুখ তুলে তাকাত আমার পানে। একটু যদি রহমত করতো। ”

সন্তান নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল তীরু, অরোন। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না। ডাক্তার দেখানো হলো, তিনি আশ্বাস দিলেন তারা দু’জনই সুস্থ তবে কিছু চিকিৎসা করতে হবে। তাহলেই একদিন তারা দুজন বাবা, মা হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। সেই থেকে চার বছর হয়ে এলো। চিকিৎসা চলছে। তীরু যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল এখন অব্দি ধরাছোঁয়ার বাহিরে। তবে আশা হারায়নি দু’জন। একদিন না একদিন হয়তবা তাদের কোল আলো করে কেও আসবে।

সকাল হতেই ওরা দু’জন খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লো। দেরী হয়ে গিয়েছে দু’জনের ঘুম থেকে উঠতে। পথিমধ্যে তানহা, তনু দু’জনকে ভিডিও কলে নিজেদের আসার বার্তা জানিয়ে দিলো। এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছুতেই ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে আশপাশ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছিল তীরু। অরোন তাকে ডেকে হাত বাড়িয়ে বলল,

-” তবে যাওয়া যাক? যেখানে আমাদের পথচলা শুরু। ”

অরোনের বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখে তীরু। শক্ত করে তার হাত আঁকড়ে ধরলো অরোন।

সমাপ্ত।