এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০১

0
252

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#সূচনা_পর্ব

ফ্লাইটে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রূপন্তী।বেচারি উঠতে একটু দেরি করে ফেলেছিলো, যার ফল হিসেবে এভাবে নাকে মুখে এসে ফ্লাইট ধরতে হয়েছে।সে উইন্ডো সিটেই বসেছে। এটা আধা ঘন্টার একটা ট্রান্সিট ফ্লাইট ছিলো, যার ফলে অনেক প্যাসেঞ্জার ই আগে থেকে বসা।সে নিজের ডানপাশে তাকালো। একটা ছেলে মনযোগ দিয়ে ফোন টিপছে।মাথাটা ঝুঁকে থাকায় সে ধরতে পারলো না, তবে তার খুব পরিচিত একটা মুখ মনে হচ্ছে। কিন্তু ওই ফা’জি’ল টা তো এত সুন্দর ছিলো না।এই ছেলেকে এক পাশ থেকে দেখেই বেশ সুদর্শন মনে হচ্ছে।যাই হোক!সে আর পাত্তা দিলো না।একজন কেবিন ক্রিউ এসে তাকে হট টাওয়েল দিয়ে গেলো হাত মুখ মোছার জন্য। মেনু দিয়ে ব্রেকফাস্ট চয়েজ করতে বলল।বিজনেস ক্লাসে এই এক সুবিধা!প্রচুর আপ্যায়ন পাওয়া যায়। অবশ্য টাকাও ঢালতে হয় প্রচুর।
কথাবার্তা শেষ করে সে ঠিকঠাক বসতে না বসতেই টেক অফের এনাউন্সমেন্ট দেওয়া হলো।প্লেন অলরেডি ট্যাক্সি করা স্টার্ট করেছে।এয়ার হোস্টেজ রা সিট বেল্ট পড়া সহ বাকি সব নিয়ম কানুন দেখিয়ে দিচ্ছে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে প্লেন উড়াল দিলো।নিচে মেঘের মধ্য দিয়ে ঝাপসা শহরটাকে দেখে রূপন্তীকে বিষন্নতা ঘিরে ধরলো।আর আসা হবে না! এই দেশে তাও কলিগ, ফ্রেন্ডরা ছিলো।বাংলাদেশে তো তিন কূলে আপন বলতে কেও নেই।আছে মাদার,এতিম খানার মালিক আর গুটিকয়েক বন্ধু-বান্ধব।তবুও তাদেরকে নিকট মানুষ বলা যায়,আপন নয়।
তার মন খারাপের মাঝেই কানে পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসলো,
– কি অবস্থা তোর!মিস বিউটি!না না, মিস চার্ম।
শেষ সম্বোধনটা শুনে রূপন্তী কেঁপে উঠলো।এই নামে শুধু একজন ডাকে, যে তার একমাত্র শত্রু। ছিলো,আছে, থাকবে।
পাশে ফিরে তাকালো। তখন ছোকরা ছিলো, এখন পরিপূর্ণ যুবক।এজন্যই হয়তবা সুন্দর হয়েছে।কয়বছর পর দেখা হলো?!
ওরা এমবিবিএস শেষ করে ইন্টার্নি শেষ করেছে প্রায় চার বছর হবে।এরপর থেকেই আর দেখা সাক্ষাৎ নেই।
সায়ন তখনও তাকিয়ে আছে রূপন্তীর দিকে।মেয়েটার বাচ্চাসুলভ চেহারাটা আর নেই। পরিপূর্ণ নারী! আগে একটু স্বাস্থ্য ছিলো।এখন মেইনটেইন এর জন্য বা কঠোর পরিশ্রমের জন্য একদম মেদহীন শরীর।কিন্তু গালগুলো এখনো হালকা ফোলা ফোলা।
রূপন্তী হালকা হেসে উত্তর দিলো,
– আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।তোর কি খবর?!
– এই তো আছি। দিনকাল ভালোই যাচ্ছে।
তাদের কথা বার্তার মাঝেই ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা হলো।খেতে খেতে আরো টুকটাক কথা বার্তা হলো।এই যেমন অস্ট্রেলিয়ায় কতদিন থাকে।ক্যারিয়ার কতদূর এগোলো।দেশে গিয়ে প্ল্যান কি!এসবই।
খাওয়া শেষে রূপন্তী ঘুমিয়ে পড়লো।বেচারি রাতে মাত্র দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে।
সায়নও সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবার ফোন নিয়ে মগ্ন হলো।প্লেন সবে মাত্র তখনও ইন্ডিয়ান মহাসাগরের উপর।৯ ঘণ্টার ফ্লাইটে মাত্র এক ঘন্টা গিয়েছে৷বাংলাদেশের সময় হিসেব করলে সন্ধায় ছয়টা নাগাদ ফ্লাইট ল্যান্ড করবে।
.
সায়ন বিগত ৫মিনিট ধরে হেসেই যাচ্ছে। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষন হাসতেই থাকবে। সে আপাতত নিজের বাড়ির পথে। বিমানবন্দর থেকে সাভার খুব একয়া দূর না।কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ায় রাস্তায় জ্যাম আছে।
তার এই দাঁত কেলানো হাসির একমাত্র উৎস রূপন্তী।এয়ারপোর্টে বেশ ভালোই জব্দ করে এসেছে মেয়েটাকে।
কাহিনী অনেকটা এরকম:-
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর।বিকেল ৫:৫০ বাজে।মাত্রই কলকাতার ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট হলো।যাত্রীদের গেটে যেতে বলা হলো।সবাই হুড়মুড় করে দৌড় লাগালো।এরা চলে গেলেও ২নম্বর টার্মিনাল ভালোই ভীড়।টিভি স্ক্রিনের ফ্লাইট সিডিউল হিসেবে সন্ধ্যা ৭পর্যন্ত পরপর ১২টা ফ্লাইট ভিন্ন গন্তব্যে উড়াল দিবে।এর ফলেই মানুষের ভীড় এত।দশ মিনিটের মাঝে অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত একটা ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট দেওয়া হলো।মিনিট দশেকের মাঝে টার্মিনাল আরো মানুষে ভরে গেলো।সবাই অপেক্ষায় বেল্ট থেকে লাগেজ নেওয়ার জন্য।কিছুক্ষনের মাঝেই লাগেজ আসতে শুরু করলো।এবং তার মিনিট পাঁচেক পরেই গোটা টার্মিনালের প্রায় ৪০০ মানুষের মনযোগ পড়লো এক জোড়া যুবক-যুবতীর দিকে।
কেননা তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে
অবস্থা বেগতিক দেখে সেখানে থাকা অফিসাররা এগিয়ে গেলো।কারন জিজ্ঞেসে করতেই মেয়েটা অভিযোগ জানালো,
– আমাকে বয়রা বলেছে, কানা বলেছে।আমার লাগেজ নিয়ে চলে যাচ্ছিল সে।
অফিসাররা ছেলেটার দিকে তাকারেই ছেলেটা ঠোঁট উলটালো।আফসোসের সুরে বলল,
– মেয়ে মানুষের প্যাচ বোঝা আসলেই কঠিন!
তারপর নড়েচড়ে অফিসারের দিকে তাজিয়ে বলল,
– স্যার আমি আপনাকে আসল কাহিনী বলছি।তার আগে বলে দেই আমরা পূর্ব পরিচিত। আসলে আমাদের লাগেজ দেখতে একই রকম।আমি ভুল করে উনার টা নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।উনি সেটা খেয়াল করে দৌড়ে আমার কাছে আসলো।এসে চিৎকার করা শুরু করলো।আমি উনাকে থামাতে খালি বলেছিলাম যে আস্তে কথা বল,আমি বয়রা না।এরপর থেকেই সে ঝগড়া করে যাচ্ছে।
মেয়েটা ফুঁসে উঠে আবার কিছু বলবে, তার আগেই অফিসার হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন।গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-ম্যাম, দেখুন এটা পাব্লিক প্লেস।অযথা আর সিন ক্রিয়েট করবেন না।নিজের লাগেজ টা নিয়ে যান।
রূপন্তী আগুন চোখে তাকালো সায়নের দিকে।সায়নেট মুখ স্বাভাবিক।রূপন্তী লাগেজটা নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আরেকবার তাকালো ফা’জি’লটার দিকে।এবং সায়নের ঠোঁটের কোণের মিটিমিটি হাসিটা মুহূর্তেই তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটা দিলো গেটের দিকে।তার জ্বলতে থাকা শরীর কখন নিভবে সেটা সে নিজেও জানে।সে ভুলেই গেছিলো ছেলেটা সায়ন। দ্যা গ্রেট বে’য়া’দ’ব ‘সায়ন চৌধুরী’।
.
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সে উবার কল করলো।উদ্দ্যেশ্য এয়ারপোর্ট থেকেই খানিক দূরে অবস্থিত একটি হোটেল।রাইড কনফার্ম করে অপেক্ষা করতে লাগলো গাড়ির।কিছুক্ষন পর ঠিক ওর সামনে এসে একটা গাড়ি থামলো।রূপন্তী একটু এগিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু তার আগেই সায়ন ঝড়ের গতিতে এসে গাড়িতে উঠে বসলো।রূপন্তী ভড়কালো।স্বাভাবিক হতেই সায়নকে দেখে শরীরের জ্বলনটা আবার ফেরত এলো।
সায়ন জানালার কাচ নামিয়ে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলল,
– দিস ইজ মাই কার মিস চার্ম।
রূপন্তী কিছু বললো না।সামনে গাড়ির লাইন থাকাতে সায়নের গাড়িটা আস্তে ধীরে আগালো। রূপন্তী তখন ফোনে নিজের গাড়ির লোকেশন দেখছে। সেই মুহুর্তে আবারও একটা পুরুষালি কণ্ঠ কানে হানা দিলো,
– ‘চার্ম’ এর ‘সি’ও নাই অথচ নাম নাকি রূপন্তী। তোর নাম জ্বলন্তী হওয়া উচিত ছিলো। যত্তসব আজাইরা তেজ!
রূপন্তী অবাক হয়ে সামনে তাকাতে সায়ন তাকে একটা ভেংচি মারলো।বেচারির সবটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো।যতক্ষনে বুঝলো ততক্ষনের গাড়ি বেশ দূরে চলে গিয়েছে।তবুও সে চিৎকার করে বলল,
-সায়ইন্নার বাচ্চা।আমি রূপহীন হলে তুই একটা বান্দর।একটা বে’য়া’দ’ব,অ’স’ভ্য,ম্যানারলেস।
রাগে দুঃখে কখন যে ফোনটা আছাড় মেরেছে খেয়াল করলো না।হুশ এলো কলের আওয়াজে।হাতে তাকিয়ে দেখলো ফোন নেই।সেটা আপাতত মাটিতে স্থান নিয়েছে। ফোনটা তুলে আগে রিসিভ করে ড্রাইভারের সাথে কথা বলল।তার বর্ণনা অনুযায়ী গাড়ি খুজে বের করলো। তারপর গাড়িতে উঠে বসে দম ফেললো।
ফোনে ভালোমতো চেক করলো।দিন রাত পরিশ্রম করা ঘামের দরুন অর্জন করে কেনা আইফোন১৪।নিঃসন্দেহে এটা তার কলিজাতুল্য।এই ফোনের কিছু হইলে সে সহজে আর দামি ফোন কিনতে পারবে না।আপাতত টাকা জমাচ্ছে একটা ল্যাপটপ কেনার জন্য।এসব ডিভাইসের প্রতি তার প্রচুর ঝোঁক।
স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলতেই চলে যাওয়ার রাগটা ফেরত এলো।তার জীবনে সায়ন বরাবরই একটা আ’প’দ।এতদিন পর দেখা হলো, প্লেনে কি সুন্দর কথা হলো।কিন্তু অভ্যাস মানুষের দাস।সায়নের বরাবরই অভ্যাস রূপন্তীকে দেখামাত্র চেঁতিয়ে দেওয়া। আজও তার ব্যাতিক্রম করেনি ছেলেটা।
রূপন্তী একটা ক্লান্তিকর শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলো,
“আশা করি তোর চেহারাটা আর কখনো দেখা লাগবে না।ভালো হয়ে যা সায়ন, ভালো হয়ে যা।ভালো হতে টাকা লাগে না।”

আর সায়ন?!সে এখনো মনের আনন্দে হেসেই যাচ্ছে।খুবই ভালো লাগছে এত বছর পর মেয়েটাকে আবার জ্বালাতে করতে পেরে।
#চলবে।