এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0
527

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৩৭(অন্তিম)
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রূপন্তী আগুন চোখে সায়নের দিকে তাকিয়ে আছে।হাতে তার কিছুক্ষন আগের পড়ে থাকা শাড়ি যার জায়গায় জায়গায় ছিড়ে একাকার।ব্লাউজের অবস্থাও খারাপ।অথচ এসব যে করেছে তার কোনো হেলদোল নেই। সে নির্বিকার ভাবে বউকে খাওয়ানোর জন্য ভাত মাখছে।
রূপন্তী অগ্নিদৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– নিজের দোষে নিজের শাড়ি হারিয়েছিস।
– তাই বলে তুই এভাবে ছিড়ে ফেলবি?আমার টাকার মূল্য নেই?!
– পাকনামি করে এতগুলো পিন লাগাতে কে বলেছিলো?
– তোকে জ্বালাতে চেয়েছিলাম।
– আমি জ্বলেছি। এজন্য ছিড়ে ছিড়ে তোর শাড়ি খুলেছি।
রূপন্তী মুখ ফুলালো।আর কিছু বলল না।খাওয়ানোর এক ফাঁকে সায়নের চোখ পড়লো রূপন্তীর গলায় আর বুকে। তার আদর করে দেওয়া দাঁতের ছোয়াগুলো দাগে নয়, ঘায়ে পরিণত হয়েছে। তখনই কিছু বলল না।খাওয়ানো শেষ করে রুমে এসে দেখলো রূপন্তী ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে।সায়ন তার ঔষধের বস্তা নিয়ে বসলো।খুঁজে পেতে একটা মলম বের করলো।এরপর বিছানায় এসে রূপন্তীকে টেনে বসালো।জোর করে ওর গায়ের নাইটিটা খুলে ফেললো।রূপন্তী মেজাজ খারাপ করে কিছু বলবে তার আগেই জ্বলতে থাকা স্থানে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো।সায়ন মলম লাগানো শেষ করে কাপড় পড়িয়ে দিলো আবার।রূপন্তী অবাক হয়ে সায়নের ছলছলে চোখ দেখছে।কাঁদার কথা তো তার ছিলো।এই ছেলে কাঁদে কেন?তখনই কিছু জিজ্ঞেস করলো না।শুয়ে পড়লো।সায়নও সব ঠিক করে এসে শুয়ে পড়লো। রূপন্তীকে নিজের কাছে এনে খুব আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো।মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
– ওয়াজ আই দ্যাট রাফ?তোর অনেক কষ্ট হয়েছে?
রূপন্তী এবার আসল কাহিনী বুঝলো।সায়নের সাথে আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে বলল,
– উহু।আই ফেল্ট ইট।একটু রাফনেস তো থাকবেই।আর আমার স্কিন এমনেও অনেক সেন্সেটিভ। একটু ঘষা খেলেও লাল হয়ে যায়।তুই এত গিলটি ফিল করিস না। ইটস আ ন্যাচারাল ফেনোমেনন।
– বুঝছি। এখন ঘুমা। সকালে উঠে মনে করে একটা পিল খেতে হবে।আর নাস্তা নিয়ে চিন্তা করিস না। বাহিরে থেকে আনবোনে।
– হুম।
.
মুগ্ধ-সায়রার বিয়েটা মার্চের পনেরো থেকে তিরিশ তারিখ পিছিয়েছে।কারণ ওরা সিট পায় নাই।
আজকে সাতাশ তারিখ। মুগ্ধর বাবা-মা অনেক বড় করে ওর হলুদ করছে। সায়রা কোনোভাবেই নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি।মুগ্ধ কথা বলতে চেয়েছিলো,তাও দেয়নি।
একদিন রাতে এটা নিয়ে ঝগড়া বেধে গেলে সায়রা মুগ্ধর বুকে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে ফেলেছিলো।মুগ্ধ ওকে এত কাঁদতে আর দেখেনি।তাই দ্রুত নিজের রাগ,মেজাজ সরিয়ে প্রেয়সীকে আগলে ধরেছিলো।সায়রার একটাই কথা,
– ওই মানুষগুলো আমার দুঃসময়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। আমি কখনোই তাদের জন্য ম্যাটার করতাম না।নাহলে তারা একটা মেয়েকে, যাকে ইতিমধ্যে খুবলে খাওয়া হয়ে গেছে,সেই ভয়ংকর পরিবেশেই রাতের আঁধারে একলা ছেড়ে দিয়েছিলো।আমি ভুল করেছিলাম।তাদের উচিৎ ছিলো সেটা সংশোধন করার।সেটা না করে তারা আমাকে ত্যাজ্য করে দিলো।এসব ক্ষত আমি কিভাবে মুছবো মুগ্ধ?!
মুগ্ধ আর একটা কথাও বাড়ায়নি সেদিন।মেয়েটাকে বুকে আগলে আদরে আদরে শান্ত করেছিলো।এই মেয়েটা তার জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ এসেছে। আরাদ্ধার দ্বারা তৈরী ক্ষতটাকে সে সাড়িয়ে তুলেছে।

সাতাশ তারিখে হুলুস্থুল করে ওদের হলুদ হলো। একটা হোটেলের পুলসাইডে অনুষ্ঠিত হলো ওদের হলুদ। জাকজমক একটা রাত কাটিয়ে আঠাশ তারিখ সবাই গেলো রূপন্তীদের বাসায়।
সায়ন আর রূপন্তীর সম্পর্ক সেই রাতের পর থেকে আরো সুন্দর হয়েছে।দুজন যেনো এক আত্মা।একজন আরেকজনের প্রতি কেয়ারনেস,ভালোবাসাতা চোখে পড়ার মতো।দুজনের যদিও খুব কম কাছাকাছি আসা পড়ে। বৃ্হষ্পতিবার ছাড়া তেমন একটা সুযোগ হয় না। কারণ ঘুম মেরে পরেরদিন ডিউটি করতে কষ্ট হয়।তাই বিশেষ করে ছুটির আগের রাত গুলোতে তারা মত্ত হয় একে অপরের মাঝে। প্র‍্যাক্টিসের প্রেশার,পড়াশোনার প্রেশার এসবও বেড়েছে প্রচুর।
আগামীকাল একটা ছুটি আছে। এজন্য আজকে কারো মধ্যেই কোনো তাড়া নেই। ছেলেগুলো সব এক রুমে ঢুকে রীতিমতো ব্যাচেলর পার্টি শুরু করেছে।খালি আরহান মিসিং। সে সাইটের কাজে ঢাকার বাহিরে।

মেয়েগুলো সব বসেছে রূপন্তীর রুমে। তারাও জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মজা নিচ্ছে।বেচারি ছোট্ট মানুষটাকে ফাহাদকে নিয়ে পিঞ্চ মারতে তারা পিছুপা হচ্ছে না।প্রতিবার একটা করে লাগামহীন কথা বলছে আর আরহা লজ্জায় লাল হচ্ছে।
রূপন্তী উঠলো সবাইকে চা দেওয়ার জন্য। মেয়েগুলোকে দিয়ে ছেলেগুলোর জন্যও নিলো।তবে ওদের রুমে ঢোকার সময় কিছু কথা কানে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলো।
ফাহাদ মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করছে,
– তুই কি সায়রাকে নিয়ে সুখে আছিস মুগ্ধ?!
মুগ্ধ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
-মেয়েটা আস্ত একটা সুখ পাখি। ভালোবাসতে না চাইলেও ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছি। এত লক্ষী একটা মেয়ে!
একটু থেমে,
– তবে প্রথম ভালোবাসার ক্ষত সহজে যায় না রে।
এই ব্যাপারের পুরো ফ্রেন্ডগ্রুপ জানে।রূপন্তীরও ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।সবসময় সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।
মুগ্ধ হুট করে আবার ঝড়া গলায় বলে উঠলো,
– আমি অনেক সুখে আছি।মেয়েটা আমাকে যত ভালোবাসে সেটা আরাদ্ধার প্রতি আমার ভালোবাসা থেকেও বেশি।ইদানীং সায়রাকে ছাড়া আমার নিজেরও হাসফাস লাগে।ওকে রেখে নাইট ডিউটি করতে এত কষ্ট হয়!
কথা শেষ করে সায়নের দিকে তাকাতেই মুগ্ধর ভ্রু কুঁচকে এলো।ফাহাদেরও একই অবস্থা।সায়ন হঠাৎ কেমন আনমনে হয়ে গেছে। মুগ্ধ ওকে একটা লাথি মেরে জিজ্ঞেস করলো,
– তোর আবার কী হয়েছে?
সায়ন আনমনেই বলে উঠলো,
– প্রথম ভালোবাসা ভোলা আসলেই দ্বায়।
ফাহাদ তেতে উঠে বলল,
– খবরদার ওই বেয়াদব মেয়ের কথা এখানে তুলবি না।আরিশা নেভার লাইকড ইউ।সি ওয়াজ আ প্লেগার্ল। তুই ওর প্রেমে পড়ে আন্ধা হয়ে গিয়েছিলি।এই একটা কারণে রূপন্তীর সাথে খারাপ ব্যাবহার করতি। এটা আমরা কেউ অস্বীকার করবো না যে তুই মেয়েটাকে কি পরিমাণে মানসিক অশান্তিতে রেখেছিলি!
– আরিশা গট ডিভোর্সড।আজকে আমার সাথে দেখা করেছিলো।কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে ফেলেছিলো।
এবার মুগ্ধ চেতে গেলো,
– তোর লাইফে এখন অনলি রূপন্তী এক্সিস্ট করে। আর একবার ওকে কষ্ট পেতে দেখলে একদম মেরে ফেলবো।
সায়ন আবার কিছু বলবে তার আগেই রূপন্তী ট্রে হাতে ঢুকলো।সেটা রেখে এরপর ঝড়ের গতিতে বের হয়ে গেলো।সায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
– আধা কথা শুনে এখন কেঁদে কেটে ভাসাবে।
ফাহাদ ভেংচি কেটে বলল,
– ভালো হইসে। যা এবার বউ সামলা।
.
গতরাতে দুজনের মাঝে ভয়ংকর একটা ঝগড়া হয়েছে।বিষয় – আরিশা।মূলত রূপন্তীই একটু বাড়াবাড়ি করেছে। বিনিময়ে সায়নও ক্ষেপে গিয়ে যা তা বলেছে। বন্ধুরাও ভালোমতো সব টের পেয়েছে।কিন্তু কেউ তাদের ব্যাপারে নাক গলায়নি।তাদের মান অভিমান তারাই মিটাক।
পুরো একদিন কেউ কারো মুখ দেখালো।অনুষ্ঠানের দিনেও দুজন আলাদা গেলো।সেখানে গিয়েও একজন আরেকজনের দিকে চোখ তুলেও তাকালো না।বন্ধুরা এবার বোঝানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু তারা মানতে নারাজ।রূপন্তীর কথা হচ্ছে – “আমি ওর বউ৷ এক্সের কথা শুনে জেলাস হওয়াকে টক্সিসিটি বলে না।স্বাভাবিক ভাবেই আমি জেলাস হবো।ও বাড়াবাড়ি করেছে,ওকে সরি বলতে বল।
সায়নের কথা হচ্ছে, ” আমার কথাই শুনলো না।তার আগেই রেগেমেগে অস্থির।ও বেশি করেছে,ওকে সরি বলতে বল”
ব্যাস!কারোরই সরি বলা হলো না। বাসায়ও দুজন আলাদা ফিরলো।এবং ফিরে দুজনেই অস্থির হয়ে গেলো।গোটা দুইদিন একজন আরেকজনকে ছাড়া।সহ্য হয়?!
রূপন্তী আর না পারতে ছুটলো সায়নের কাছে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে সে সায়নের রুমে গিয়েই ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো।সায়নও অস্থির ভাবে মেয়েটাকে আগলে নিয়ে সারা মুখে চুমু খেলো।রূপন্তী ক্রন্দনরত কণ্ঠেই বলে উঠলো,
– তুই আমার সাথে কক্ষনো ঝগড়া করবি না। আমার সহ্য হয় না।
– আচ্ছা।
– আমার তোকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়।
– কেন?
– কারণ আমি তোকে ভালোবাসি।
– আর?
-তোর সাথে মিশে থাকতে আমার ভালো লাগে।
– আর?
– তোর গায়ের গন্ধ নিতে আমার ভালো লাগে।
-আর?
রূপন্তী এবার মাথা তুলে নেশালো কণ্ঠে বলল,
– আর তোর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখতে ভালো লাগে।
সায়ন মুচকি হাসলো।আবদার বুঝতে পেরে আর দেরি করলো না।গভীর ভাবে সিক্ত করলো রমণীর ঠোঁটজোড়া।
দুজনের চিত্তই চঞ্চল হয়ে উঠলো।তবে সায়ন আপাতত আর এগোলো না।মেয়েটাকে কোলে তুলে এনে বারান্দায় নামালো। তারপর নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে বলল,
– একটু আকাশের দিকে তাকা তো।
– কেন?
সায়ন দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– তোকে বউ ভেবে কয়েকটা কথা বলবো।
– আমি তো তোর বউই!
– ওহ তাই?! আমি তো আরিশাকে আমার বউ ভেবেছিলাম।
রূপন্তী আর কথা বলল না।সায়নে বুকে পিঠ মিশিয়ে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকালো।আচমকা কানে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
-কোনো এক হেমন্তের ভোরে তাকে পরিপূর্ণ নজরে দেখেছিলাম।তবে সেই নজর ছিলো কামুকতায় ভরা। আমার হৃদপিন্ড সেদিনই ধোকা দিলো যেদিন সেই নারীকে শাড়িতে দেখেছিলাম।হেমন্তের সেই দুপুরে আমার মস্তিষ্ক আমার নিজের জেদ থেকে বেরোতে বাধ্য করলো।একই রাতে মেয়েটার চোখের পানি আমার বুকে দামামা বাজালো।সেই যে মস্তিষ্ক জানান দিলো,”সায়ন!তোর সর্বনাশের দিন সবে শুরু!” তারপর থেকেই জীবন পালটে গেলো।দ্বিতীয় বারের মতো প্রেমে পড়লাম।এক রমণীর জন্য অস্থির হয়ে গেলাম।যে আমার শত্রু ছিলো,তাকে ভালোবাসায় পরিণত করে ফেললাম।সেই যে তাকে বুকে জায়গা দিলাম,সেখানে আজীবন তারই রাজত্ব চলবে। তাকে যে মনটা দিলাম,সেটা আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।এটা সায়ন চৌধুরীর নিজের জীবনের সাথে করা শপৎ।সেই রমনীর জীবনের সাথে করা শপৎ!

রূপন্তী ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।সায়ন তাকে বাধা দিলো না।খালি নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।রূপন্তী একটু শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– মন দিয়ে দিয়েছিস?
– কোনো সন্দেহ?
– আমারটা নিবি না?
– অনেক আগে থেকেই আছে।
– তুই অনেক খারাপ সায়ন!
– আই নো!
আর কোনো কথা হলো না।শুধু একে অপরকে অনুভব করলো।গভীর রাতে যখন রূপন্তীকে কোলে তুলে সায়ন রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে,ঠিক তখনই রূপন্তী সায়নের কানের কাছে ফিসফিস করে গেয়ে উঠলো,
“এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।”
#সমাপ্তি!