প্রাণেশ্বর পর্ব-০১

0
279

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
সূচনা পর্ব

অতি নিরুপম সৌন্দর্যে মন্ডিত এক পুষ্প নিহিত পালংকে বসেও, অন্তঃস্থলে তীব্র এক ব্যথার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে তনুকা। এই ব্যথা তার নিকট এক মারাত্মক বিষব্যথা। এই একুশ শতাব্দীতে এসেও এমন এক বিবাহ কোনো মেয়েরই কাম্য নয়। কিন্তু, তার সাথেই ঘটে গিয়েছে এহেন নির্দয়, নিষ্ঠুর এক কাজ। ব্যাপারটা বর্তমানে তার নিকটে মাত্রাধিক কুৎসিত ঠেকছে যেন। এই যুগে এসে গ্রামের এক জমিদার ছেলের সাথে বিয়ে? এই সময়ে এসেও জমিদারী চলে? তনুকা আশ্চর্য। তার থেকেও অধিক আশ্চর্য সে তার বাবার ব্যবহারে। তিনিও বা কী করে রাজি হতে পারলেন; এই বিয়েতে? একবারের জন্যও তার কথা ভাবলেন না? “বাবা” নামক মানুষটার সাথে কি আদৌ এত নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্ব মানায়?

এতসব চিন্তার মাঝেই, দরজা ঠেলে হাজির হয় এক লম্বা চওড়া গড়নের পুরুষ মানুষ। এই মানুষটিই তার স্বামী, তার প্রাণেশ্বর। যাকে আজ তিন তিন বার কবুল বলে বিবাহ করেছে সে। “স্বামী” নামক লোকটাকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও বিছানা ছেড়ে নামল না তনুকা। বসে রইল ঘাপটি মেরে। লোকটি নির্নিমেষ কিছুক্ষণ তাকে চেয়ে দেখল। হয়তো বোঝার চেষ্টা করল, তার ভাবমূর্তি। কিন্তু কিছুতেই কিছু ঠাহর করতে না পেরে এগিয়ে গেল সে। ঠিক গিয়ে থামল, পুষ্প সজ্জিত পালংকের নিকটে। অতঃপর ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘বাসর রাইতে স্বামীরে পা ধইরা সালাম কইরা দোয়া নিতে হয়, তুমি বোধ হয় তা জানো না।’

কন্ঠ শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় তনুকা। লোকটা কি এমন অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে? আজীবন এভাবেই কথা বলবে? মাথা ঘুরে উঠে তার। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে এসে, এখন এমন অশিক্ষিত এক ছেলের সাথে সংসার করতে হবে তাকে? এই ছিল ভাগ্যে তার? মনের দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে হলো তনুকার। জবাব দিল না কোনো। তার এহেন নীরবতা দেখে ফের হাসল সেই লোকটি। বেশ আহ্লাদের সুরে বলে উঠল,

‘কথা কইবা না, বিবি?’

এবার অতিরিক্ত রাগ হলো তনুকার। আহ্লাদ যেন উপচে পড়ছে তার। “বিবি” ডাকে মাত্রাধিক ক্ষিপ্ত হলো সে। উঁচু আওয়াজে তাই বলে উঠল,

‘খবরদার, আমার সাথে একদম আহ্লাদ দেখাবেন না।’

লোকটি পাত্তা দিল না তাকে। পা তুলে অতি আয়েশের সমেত তার নিকটে বসল। তনুকা ক্ষুব্ধ হয়ে চাইল তার দিকে। এই প্রথম লোকটিকে দেখছে সে। বিয়ের আগে বাবার সাথে রাগ দেখিয়ে, ছেলের ছবি অবধি দেখিনি। আজ এত কাছ থেকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে নিত্যান্তই এক সুদর্শন পুরুষ। শ্যামলা গায়ের রঙেও কী চমৎকার এক মুখশ্রী। ধারাল চোয়াল, নিকষ কালো এক জোড়া চোখের মনি সেই সৌন্দর্য বাড়াতে যথেষ্ঠ। গাল ভর্তি সূক্ষ দাড়ির উপস্থিতিও চোখ এড়ায়নি তার। ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখা এই চমৎকার সুন্দর হাসি অতিশয় রহস্যময় ঠেকছে যেন।

‘এমনে কী দেখো, বিবিজান? নজর লাগব তো।’

ভ্রু কুঁচকায় তনুকা। এই লোকের মুখাবয়বের সাথে এই ভাষা যাচ্ছে না ঠিক। মনে হচ্ছে যেন, জোর করে বলছে সে। তনুকা নিঃস্পৃহ সুরে বলে উঠে,

‘আপনি কি বাংলা কথা বুঝেন না? বলেছি না, আমার সাথে আহ্লাদ না দেখাতে? তবে কোন সাহসে এমন “বিবি বিবি” বলে চেঁচাচ্ছেন?’

দুর্বোধ্য হাসল লোকটি। বলল,

‘প্রথম দিন আয়সাই আমার সাহস নিয়া কথা কইতেছ, বিবি। আমার সাহস দেখাইলে আইজ হজম করতে পারমা তুমি?’

তনুকা বুঝল না ঠিক। তাই নিষ্পলক চেয়ে রইল। লোকটি আচমকা তনুকার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তার এহেন ব্যবহারে হতভম্ব তনুকা। নির্বাক চেয়ে রইল কেবল।

‘বিবিজান, মাথা ধরছে অনেক। তোমার বাপে বড্ড প্যাঁচাল পাড়ে, সহজ কথা সহজ ভাবে বোঝে না। তাঁরে বুঝাইতে গিয়া এহন আমার মাথা ধরছে। মাথাটা একটু টিইপা দাও তো।’

তনুকা বোকার মতো বসে আছে। লোকটার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝছে না সে। এই লোক তার বাবার সাথে কী কথা বলেছেন? কী নিয়ে প্যাঁচাল হয়েছে তাঁদের? তনুকা বিরক্ত হয়ে মাথায় ঠেলা মেরে বলে উঠল,

‘উঠুন আপনি। আর কীসব বলছেন? বাবার সাথে আপনার কী কথা হয়েছে? কীসের প্যাঁচালের কথা বলছেন? এই, আপনি আবার কোনোভাবে আমার বাবাকে ভয়টয় দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করেননি তো? দেখুন, এমন হলে কিন্তু আমি পুলিশ কেইস করব।’

লোকটি শব্দ করে হেসে ফেলল। উঠে বসল সোজা হয়ে। মুখটা তনুকার দিকে এগিয়ে এনে বলল,

‘পুলিশ কেইস করবা তুমি? আমার নামে? তোমার স্বামীর নামে? হাসালে, বিবি।’

ফের সশব্দে হাসল সে। তনুকা চোখের দৃষ্টি সরু করল। গম্ভীর সুরে বলল,

‘সত্যটা বলুন আমায়। নয়তো এই বিয়ে আমি কখনোই মানব না।’

হাসি থামাল সে। তনুকার দিকে গভীর মনোযোগে চাইল। ফিচেল কন্ঠে বলল,

‘তোমার মানার প্রয়োজন নাই; আমি মানি তাতেই চলব।’

তনুকা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,

‘আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।’

‘কিন্তু, আমি তো তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না, বিবিজান।’

তনুকা দাঁতে দাঁত চাপল। মাত্রাধিক ক্রোধে মাথা ধরেছে তারা। উঠে দাঁড়াল সে। ক্রোধ সমেত বলল,

‘আমি এই রুমেই আর থাকব না। আপনাকে এই মুহূর্তে আমার অসহ্য লাগছে। আপনার সাথে একা এক রুমে থাকা অসম্ভব।’

বলেই এগুতে নিলে তার হাত চেপে ধরে লোকটি। ক্রূর হেসে বলে,

‘আমার অনুমতি ব্যতিত এই বাড়িতে কিছুই হয় না। আইজ এহন এই কক্ষ থেইকা বাইর হওয়া তোমার জন্য নিষিদ্ধ। আর আইজ তো আবার আমাদের বাসর রাইত; এই রাইতে কেউ স্বামীর থেইকা দূরে যাইনা, বরং আরো কাছে আইয়ে, বুঝছ বিবি?’

তনুকা দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে,

‘হাত ছাড়ুন।’

‘উঁহু, ছাড়মু না।’

‘দেখুন, আমি কিন্তু চিৎকার করব।’

‘ছি! মানুষ কী কইব? আজ বাড়িতে অনেক মানুষ; চিৎকার চেঁচামিচি করলে, কাল আর লজ্জায় মুখ দেখাইতে পারবা না।’

তনুকার ক্রোধ ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে কেবল। এই কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই মানুষটাকে অসহ্য লাগছে তার। এর সাথে সারাজীবন কী করে থাকবে সে? লোকটি হাত ছাড়ল না বলে, সেও আর উপায়ান্তর না পেয়ে বসে পড়ল তার পাশে। ক্লান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কী চান আপনি?’

লোকটি দাঁত দিয়ে তার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। কিছুক্ষণ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তনুকার দিকে চেয়ে থেকে বলল,

‘আপাতত, তোমারে।’

লোকটির এমন দৃষ্টিতে বড্ড অস্বস্তিত আর ভয় হলো তার। মনে মনে আওড়াল, “লোকটি কি এখন তার উপর স্বামী অধিকার খাটাবে? নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া তার কি আর কিছুই করার থাকবে না?” এক সমুদ্র পরিমাণ অসহায়ত্ব নেমে এল তার পুরো অঙ্গ জুড়ে। ভীত কম্পিত সুরে বলল,

‘আমি এখনই এসবের জন্য প্রস্তুত নই।’

ফের হাসল লোকটি। রসিকতার সুরে বলল,

‘ওমা, এর জন্য প্রস্তুতিও লাগে? বিয়ের আগে প্রস্তুতি নাও নাই বুঝি?’

‘না।’

কিছুটা শক্ত গলায় জবাব দিল সে। লোকটি এগিয়ে এসে তনুকার কানের পিছে চুল গুঁজে দিল। জিজ্ঞেস করল,

‘তা, প্রস্তুতি নিতে কতদিন লাগব?’

কিছুটা সাহস নিয়ে সে জবাব দিল,

‘এক মাস।’

‘এক মাস? কী যে কও না, বিবি। এমন সুন্দরী একটা বউয়ের কাছ থেইকা আমি এক মাস দূরে থাকমু? এমনডা সম্ভব? এমনডা করতে পারলে কিতা আর আমি আমার আগের স্ত্রী মারা যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায় আবার বিয়া করি? পারলে তো আর কখনোই বিয়াই করতাম না। পারিনা বইলাই তো চার চারখানা বিয়ে কইরা বইছি।’

তনুকা হতভম্ব, হতবাক। নির্বাক, নিষ্পলক চেয়ে আছে কেবল। তার নিগূঢ়, নিবিড়, নিরেট শূন্য চাহনি দেখে হাসে লোকটি। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তনুকা প্রশ্ন করে,

‘আপনি এর আগেও আরো তিনটা বিয়ে করেছেন? তার মানে, আমি আপনার চার নাম্বার বউ?’

ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে লোকটি স্বগতোক্তি করল,

‘হ্যাঁ, আমি এর আগেও তিনখানা বিয়া করছিলাম। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, বউডি বাঁচে না বেশিদিন; কেমনে জানে মইরা যায়। তুমি হইলা গিয়া আমার চতুর্থ বউ, আর শেষ বউও। তোমারে কিন্তু মইরা গেলে চলবে না, বুঝছো তো বিবিজান?’

চলবে।