#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।
মেহতাবের হাত যুগল সহসাই গিয়ে ঠেকল তনুকার বাঁকানো কোমরের ভাঁজে। তনুকা আবিষ্কার করল, সেই হাতের বাঁধন দৃঢ় বেশ। মেহতাব এগিয়ে এসে কপাল ঠেকাল তার কপালে। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আমি আমার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা তোমার মাঝেই নিংড়ে ঢেলে দিতে চাই। বলেছিলে না, আমি কীভাবে স্বল্প দেখাতেই তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম? সত্যি বলতে এর সঠিক উত্তর আমার কাছেও নেই। আমি জানি না, কীভাবে হলো সব। প্রথম দেখাতেই অনুভূতি আসেনি কিন্তু। অনুভূতি এসেছিল রয়ে সয়ে, ধীরে সুস্থে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মতো পুরুষ আমি নই, তবে প্রেমে আমি পড়েছি, তাও আবার মারাত্মক ভাবে। কবে, কখন, কীভাবে সেটা জানা নেই। শুধু এইটুকুই জানি, প্রেম নামক ভয়ংকর এক ব্যাধিতে আক্রান্ত আমি, যার একমাত্র সমাধান কেবল মৃত্যু। মৃত্যু ব্যতিত আমাকে এই ভয়ানক ব্যাধি থেকে কেউ মুক্তি দিতে পারবে না, তনু।’
মেহতাবের এহেন নিঃসংকোচ বক্তব্যে খানিকটা শিহরিত হলো তনুকা। নিজের অতি নিকটে অবস্থিত মেহতাবের মুখাবয়বের দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। তখনই মেহতাবের কৃষ্ণাভ ওষ্ঠযুগলে নজর আটকাল ততক্ষণাৎ। ইশ, নিজেকে বড্ড বেশরম মনে হলো তার। মেয়ে হয়েও মনে এসব চিন্তা কেন আসে? স্বামী বলে?
মেহতাব আরেকটু নিকটস্থ হয়। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার সমস্ত ভালোবাসা গ্রহণ করবা তো, বিবিজান?’
তনুকা অদ্ভুত ঘোরে আটকাল। নিজেকে খুঁজে পেল যেন অন্য এক রাজ্যে। যেখানে চারদিকে ছড়ানো কেবল অপরিসীম ভালোবাসা, আর সে আর মেহতাব হলো সেই রাজ্যের একমাত্র অংশীদার। মেহতাবের উষ্ণ প্রশ্বাস চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই বুকের কম্পন বৃদ্ধি পায় তার। গায়ে কেমন যেন শির শির অনুভূত হয়। এই অনুভূতি তনুকার নিকট অপরিচিত। এর আগে কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে ছিল না বলে, এখন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে যেন।
তাদের মাঝে বিরাজমান কয়েক ইঞ্চির দৃরত্বটাও যেন সহ্য হচ্ছে না মেহতাবের। মন চাইছে, ঐটুকু দূরত্বও ঘুঁচিয়ে দিতে। এক করে দিতে দু জোড়া তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ। তবে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তনুকার সম্মতি ছাড়া সে এক চুলও অগ্রসর হবে না। তাই সে সরে এল। এত কাছে এসেও হঠাৎ সরে যাওয়াতে খানিকটা বোধ হয় বিরক্ত হলো তনুকা। তবে কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। তাড়া দেখিয়ে বলল,
‘উঠে দাঁড়ান, বিছানা করতে হবে।’
মেহতাব তাই করল। বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল তনুকা। মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এ কি, মশারি কে টানাবে?’
তনুকা ফিরে বলল,
‘আপনি আছেন কী করতে?’
মেহতাবের কুঁচকানো চামড়া আরো দৃঢ় হয়। বলে,
‘বিয়ে করেছি কি নিজে মশারি টানানোর জন্য? তাহলে বিয়ে করে লাভ কী? উঠো বিবি, মশারি টানাও।’
‘উঁহু। আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।’
তনুকা গায়ে কাঁথা জড়িয়ে চোখ বুজল। অগত্যাই বিরক্ত হয়ে মশারি টানাতে হলো মেহতাবকেই। সব শেষ করে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘শুনো বিবি, আইজ আমি করসি কাইল তুমি করবা। দুইজন মিলে মিশে করমু। আর জামাইর কাজ করে দিলে সওয়াব হয়।’
তনুকা চোখ বুজেই বলে উঠল,
‘স্ত্রীর কাজ করে দিলেও সওয়াবের কিছু কম পড়বে না। কাল থেকে বিছানাটাও আপনি গুছাবেন।’
মেহতাব কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল। হতাশ সুরে বলল,
‘তুমি ভালা না, বিবি। স্বামীরে দিয়া কাজ করাইতে হয় না, স্বামীর সেবা করতে হয়; তবেই না জান্নাত পাইবা।’
‘স্ত্রীর সেবা যত্ন করলেও জান্নাত পাওয়া যায়। আপনি কি সেই জান্নাত পেতে চান না?’
বিরক্ত হলো মেহতাব। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘উফ, তোমার সাথে কথা বলে আমি আর পারলাম না। ঘুমাও।’
তনুকা ঠোঁট চেপে হাসল অতঃপর।
_______
ঝোপের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে এসেই স্তব্ধ হয় লোকটি। পরনের লুঙ্গি খামছে ধরে ততক্ষণাৎ। ঢোক গিলে পরপর দুখানা। রোদহীন প্রভাতেও ফরফর করে ঘেমে উঠে শরীর। ভয়ে নিভু নিভু স্বরে বলে উঠে,
‘জমিদারবাবু, আপনে?’
মেহতাব চোখের দৃষ্টি সরু করে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এসময় এখানে কী করছো?’
লোকটি কেঁপে উঠে অযথা। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। মাথা নত করে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘ছোট সাহেবের লগে দেহা করতে আইছিলাম।’
‘এত ভোরে?’
লোকটি ফের ঢোক গিলে। ভয়ে গা গোলাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বমি হবে। মেহতাব তার আপাদমস্তক পরখ করে বলে,
‘কী হলো, জবাব দিচ্ছ না যে?’
ভয়ে জবুথবু লোকটি এবার কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ছোট সাহেব’ই তো ডাকছেন, আমার কোনো দোষ নাই।’
‘ছোট কাকা ডেকেছেন?’
‘জি, সত্যি কইতাছি।’
মেহতাব নিঃশব্দে কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
‘তোমার ভাইয়ের খু’নিকে ধরা গিয়েছে?’
‘না বাবু, কেইস করছি আমি। পুলিশ কইছে খুঁইজা বের করব।’
‘তোমার ভাইয়ের মুখ না কি খুব কুৎসিত ভাবে থেতলে ফেলা হয়েছে? আবার নাকি শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়াও তুলে ফেলা হয়েছে, এমন ভয়ংকর ভাবে কে মারল তাকে? কাকে সন্দেহ হয় তোমার?’
লোকটি ভড়কাল। কী বলবে বুঝতে পারল না। এদিক ওদিক চোরের মতো চেয়ে কী যেন দেখল কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল,
‘আমার ভাই আপনার বিশ্বস্ত লোক আছিল, আপনার শত্রু মানেই আমার ভাইয়ের শত্রু। হয়তো আপনার শত্রুর মাঝেই কেউ আমার ভাইরে মারছে।’
মেহতাব দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে টানটান করে দাঁড়াল। বলল,
‘তা যা বলেছ, আমিও তাই ভাবছিলাম। তবে চিন্তা নেই, খু’নিকে আমি নিজে খুঁজে বের করব। আর যেহেতু তোমার ভাই নেই, সেইজন্য তোমার ভাইয়ের সব কাজের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার। সকালের ভোজন সেরে আমার সাথে এসে দেখা করবে। আর হ্যাঁ, আমার অনুমতি ব্যতিত আমার মহলের আশেপাশে যেন তোমাকে আর না দেখি। মনে থাকবে?’
মেহতাবের নিগূঢ়, কঠিন গলার স্বর যে কারোর হৃদকম্পন বন্ধ করতে সক্ষম। লোকটি পরপর কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে জলদি সেই জায়গা ছেড়ে প্রস্থান ঘটাল। আর সে চলে যেতেই গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো মেহতাব। মনে মনে আওড়াল, “আমার বেড়াল আবার আমাকেই না ম্যাঁও বলে বসে।”
________
তনুকার ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ কচলে তাকায় ঘড়ির দিকে। ঠিক নয়টা বাজে। নয়টা পনেরোতে সবাই সকালের নাস্তা করে। তার এখন পনেরো মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে হবে। তাই আর বিলম্ব না ঘটিয়ে দ্রুত সব প্রাসঙ্গিক কাজ সারল সে। পনেরো মিনিট শেষ হওয়ার পূর্বেই নিচে নামতে সক্ষমও হলো। খাবার ঘরে গিয়ে দেখল, টেবিলে সব খাবার সাজানো। এখনও বসেনি কেউ। সে উঁকি দিয়ে দেখল, রান্নাঘরে ভৃত্যরা সব কাজে ব্যস্ত। তখন মনে পড়ল, আজ তার শ্বশুরমশাইকে খাবার দেওয়ার কথা। মাথায় হাত চাপড়ে ধরে, এক্ষুনি যে ভুলতে বসেছিল। ততক্ষণাৎ আবার মনে পড়ে, মেহতাবের কাছ থেকে তো খাবারের লিস্টটাও নেওয়া হয়নি। কী হবে এখন? পরক্ষণেই মাথায় এল, মা তো নিশ্চয়ই সব জানেন? উনার থেকেই তবে সব জেনে নেওয়া যাক।
মেহতাব দ্রুত আম্বিরা বেগমের কক্ষের দিকে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘মা, আসব?’
‘এসো।’
জবাব আসে সঙ্গে সঙ্গেই। তনুকাও ভেতরে প্রবেশ করে। আম্বিরা বেগম খাবারের জন্য এক্ষুনি কক্ষ ছাড়ছিলেন, তনুকার গলা পেয়ে থমকে দাঁড়ান। তনুকা মৃদু হেসে এগিয়ে আসে। প্রসন্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘মা, বাবার সকালের খাবারে কী দেব?’
‘লতা রেঁধে রেখেছে। রান্নাঘর থেকে নিয়ে নাও।’
উত্তর শুনে তনুকা জবাবে আর কিছু বলল না। চলে এল আবার রান্নাঘরে। তাকে দেখেই লতা বলে উঠল,
‘বউমনি, ঐ যে বড়ো সাবের খাওন, আপনি দিয়া আইয়েন।’
তনুকা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,
‘আপনি কী করে জানলেন যে, আমি বাবার খাবারের জন্য এসেছি?’
লতা হেসে বলল,
‘বড়ো আম্মা তো আগে থেকেই সব কইয়া রাখছিল। আপনে নাকি আইজ থেকে বড়ো সাবের খাওয়েনের সব দায়িত্ব নিবেন, তাই আম্মা কইছে, আমি যেন সব রান্না কইরা আগে থেকেই তৈরি রাখি, আপনার যেন আর কোনো কষ্ট করতে না হয়।’
তনুকা অবাক হলো এই কথা শুনে। তার শাশুড়ি তাকে নিয়ে এত ভাবে? সে কি তবে অযথাই মানুষটাকে এত সন্দেহ করছিল। এই ভেবে ভীষণ বিরক্ত হলো তনুকা। বলল,
‘ঠিক আছে, দিন খাবার। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।
শ্বশুরমশাইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের সম্মুখে এসেই থমকাল তনুকা। দরজার বাইরে উপস্থিত দুইজন পুরুষ মানুষের দিকে নজর পড়ল। এরাই কি তবে শ্বশুরমশাইয়ের সেবকগণ, যাদের কথা মেহতাব বলছিলেন? প্রশ্নটা মনে মনেই আওড়াল সে। আবার ভাবল, সেবক হলে দরজায় এমন পাহারাদারের ন্যায় দাঁড়ানো কেন?
তনুকা প্রশ্নবিদ্ধ মন নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। তাকে দেখা মাত্রই কুর্নিশ জানিয়ে সটান সরে গেল দুই প্রহরী। তনুকা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। এই সময় অগত্যাই কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না তার। তাই সহসাই প্রবেশ ঘটাল শ্বশুরের কক্ষে। গিয়ে দেখল, গত রাতের ন্যায় নিমীলিত চোখে শায়িত তিনি। তনুকা এগিয়ে যায়। খাবারের প্লেটটা রাখে সাইড টেবিলে। মৃদু আওয়াজে ডাকে,
‘বাবা, বাবা শুনছেন?’
পিটপিট করে এক জোড়া চোখ ঈষৎ পল্লব মেলে তাকায়। তনুকার মুখাবয়ব চোখের সম্মুখে ঠাহর করতে পেরেই উত্তেজনার এক ভারি ছাপ প্রকাশ পায় বৃদ্ধর চোখে মুখে। তনুকা কিঞ্চিৎ হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘আমাকে চিনতে পেরেছেন, বাবা? আমি তনুকা, আপনার বড়ো ছেলে মেহতাবের স্ত্রী।’
চোখ মুখের অস্থিরপনা ভাব কমার নাম গন্ধ নেই। লোকটা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে যেন। চোখের দৃষ্টি এমন যে, তিনি তনুকাকে আগে থেকেই চেনেন। তনুকা মাথা ঘামাল না সেসব নিয়ে। হেসে হেসে বলল,
‘বাবা, আমি আপনাকে খাইয়ে দিতে এসেছি। আর আজ থেকে তিন বেলা আপনাকে খাওয়ানোর দায়িত্বও আমার।’
মোহন লাল মজুমদারের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার দেখা মেলল না। তিনি চেয়ে রইলেন আগের মতোই। তনুকা স্যুপ এর বাটিটা হাতে তুলল। ডান হাতে চামুচ নিয়ে অল্প স্যুপ তুলে এগিয়ে দিল শ্বশুরের মুখ পানে। তার বৃদ্ধ শ্বশুরের জন্য ঠোঁট নাড়ানোও বড্ড দায়। তাই সে নিজেই চামুচ দিয়ে হালকা চাপে নিচের ঠোঁটখানা ফাঁকা করল। স্যুপটা পুরোটা মুখে পুরে বলল,
‘আজ যদিও আমি রান্না করিনি, তবে কাল থেকে আমিই রাঁধব। ধীরে ধীরে আপনার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিব, বাবা। আপনার এত কাছের মানুষ থাকতে, বাইরের দুইজন ছেলে কেন আপনাকে সেবা করবে? তাই ভেবেছি, সব আমিই করব। আর মা আর আপনার ছেলে তো আছেই আমাকে সাহায্য করার জন্য।’
শ্বশুরমশাইয়ের মুখ দেখে প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। তাই তনুও বুঝল না কিছুই। আস্তে ধীরে খাইয়ে দিল কেবল। খাওয়ানো শেষ করে একটা ছোট্ট রুমালে মুখ মুছে দিল। তারপর প্রসন্ন সুরে বলল,
‘এবার আপনি শুয়ে রেস্ট নিন, দুপুরে আবার খাবার নিয়ে আসব।’
তনুকা উঠে দাঁড়াতেই আঁচলে টান পড়ল। চেয়ে দেখল, আঁচলের কোণে ঝুলে থাকা ছোট্ট সুতার ঝালর তার শ্বশুরের আঙ্গুলের নিচে। তনুকা মৃদু হেসে আঁচল টেনে সরিয়ে নিল। মোহল লাল মজুমদারের চোখে মুখে অদ্ভুত উৎকন্ঠা। তিনি চেয়ে আছেন। তনুকার অত শত ভাবল না কিছুই। বেরিয়ে গেল সে। চেয়ে রইলেন এক বৃদ্ধ অপলক। প্রাণহীন, স্বচ্ছ সেই চাহনি; যেন কতকিছু বলে দিচ্ছেন ঐ চোখ জোড়া দিয়েই। অথচ কেউ দেখল না, কেউ বুঝল না।
তনুকা চলে যেতেই সেই দুই যুবক আবারও এসে দরজার সম্মুখে দাঁড়াল। তনুকা সোজা গেল শাশুড়ির কক্ষে। সকালের খাবার শেষে তিনি নিজ কক্ষে বই নিয়ে বসেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তনুকা বলল,
‘আসব মা?’
অনুমতি দিলেন আম্বিরা বেগম। বললেন,
‘এসো।’
তনুকা ঘোমটা ঠিক করল, এরপর ঢুকল শাশুড়ির কক্ষে। আম্বিরা বেগম চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘শ্বশুরমশাইকে খাইয়ে এসেছ?’
তনুকা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি, মা।’
‘তোমাকে দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন তিনি?’
‘তেমন কিছুই না, কেবল তাকিয়ে ছিলেন।’
আম্বিরা বেগমের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। বললেন,
‘তিন বছর তো তাকিয়ে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলেন, এভাবে যে আরো কত বছর কাটাবেন কে জানে?’
‘বাবার কী হয়েছিল, মা?’
‘স্ট্রোক করেছিলেন তিন তিনবার, তারপর থেকে এই অবস্থা।’
তনুকার চিত্তপটে বিষন্নতার স্রোত ঝলমলিয়ে ওঠল। সে বলল,
‘বাবাকে কি কোনো ডাক্তার দেখছেন না?’
‘শহরের সবচেয়ে নামি দামি ডাক্তার দিয়ে মেহতাব উনার চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছে, তাও আশানুরূপ কোনো ফলই পাচ্ছি না আমরা।’
‘এত চেষ্টা করেও কি ডাক্তার কোনো আশা দিতে পারছেন না?’
‘না। কেবল বলছেন, আস্তে ধীরে উনি ঠিক হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেই অপেক্ষার প্রহর কতটা বিশাল সেটা কেউ বলছেন না।’
কথাগুলো বলার সময় কেমন থেমে থেমে যাচ্ছিলেন তিনি। তনুকা যেন টের পেল শাশুড়ির বুকে চাপা প্রকাণ্ড আর্তনাদের ধ্বনি। সে ম্লান সুরে বলল,
‘কষ্ট পাবেন না, মা। বাবা একদিন ঠিক হয়ে যাবেন। আমার একজন পরিচিত ডাক্তার আছেন, আমি উনার সাথেও কথা বলব। আমরা সবাই একসাথে বাবাকে সাহায্য করলে, বাবা ঠিক একদিন সুস্থ হয়ে ওঠবেন।’
আম্বিরা বেগম তনুকার মাথায় হাত ঠেকালেন। আপ্লুত সুরে বললেন,
‘আজ মনে হচ্ছে, আমি ছেলের বউ না, আরেকটা মেয়ে নিয়ে এসেছি। জীবনে অনেক সফল হও, মা।’
তনুকা খুশি হলো ভীষণ। জিজ্ঞেস করল,
‘আজ দুপুরে কী রাঁধব, মা?’
‘তুমি কেন রাঁধতে যাবে? বাড়ির কাজের লোকেরাই সব করবে। জমিদারের বউ তুমি, সেভাবেই চলো।’
তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,
‘আমি কি কিছুই করব না?’
‘না, কেবল তোমার হুকুম চালাবে।’
তনুকা অবাক হলো। আম্বিরা বেগম হেসে বললেন,
‘যাও এবার।’
নিজ কক্ষে ফিরে এসে তনুকা ভাবল, শাশুড়ি মা তার মোটেও খারাপ না, বরং ভালো ভীষণ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা তাঁর এখনো কমেনি। তখন কথা বলার সময় কেমন চোখগুলো ছলছল করছিল যেন, টুপ করে এক্ষুনি এক পশলা বৃষ্টি নামবে। তনুকার বক্ষঃস্থলে শান্তির স্রোত বইল তাই। মনের চিন্তা কিছুটা হলেও ক্ষীণ হলো। তবে একটা ব্যাপারে এখনও কিঞ্চিৎ প্রশ্ন জাগছে। সেটারও সে সমাধান বের করে ফেলবে, মেহতাব এলে। মনে প্রশ্ন জমা রাখতে নেই, সময় সুযোগে সমাধান করে ফেলা ভালো।
__________
‘ছোট কাকা।’
বিচার মহল ছেড়ে কেবলই বেরুচ্ছিলেন মতিব মজুমদার। মেহতাবের স্বর পেয়েই পদযুগল স্থির হলো। ফিরে চাইলেন। না চাইতেও হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু বলবে?’
মেহতাবের চোখের দৃষ্টি নিগূঢ় এক চাদরে আবৃত। সেই চোখ দেখলেই গলা শুকায় কিছু প্রতারকদের। আজ তবে মতিব মজুমদারের গলা শুকাচ্ছে কেন? সেও কি তবে প্রতারক?
মেহতাব চোয়াল শক্ত করল। এগিয়ে এসে ঠিক মুখ বরাবর দাঁড়াল তাঁর। গম্ভীর সুরে বলল,
‘আপনি জানেন কাকা, প্রতারকদের একটা হারও আমি অবশিষ্ট রাখি না, তারপরও কী করে এত সাহস পাচ্ছেন?’
ভয় পেলেন মতিব মজুমদার। ঘাম ছুটল সঙ্গে সঙ্গেই। মেহতাব পকেট হাতড়িয়ে তার রুমাল এগিয়ে দিল কাকার দিকে। হেসে বলল,
‘আরে আরে, ঘামছেন কেন? শুধু কথাতেই এত ঘেমে গেলে কাজের বেলায় কী করবেন?’
মতিব মজুমদার ঢোক গিললেন। ভীত সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী বলতে চাইছো তুমি?’
মেহতাব এগিয়ে কাকার কাঁধে হাত রাখল। একপাশের পাঞ্জাবী ঝেরে বলল,
‘আমার খেয়ে, আমার পরে আবার আমার সাথেই শত্রুতা, এটা মূর্খের কাজ বৈ আর কিছু নয়। সময় থাকতে শুধরে যান, নয়তো পরে আফসোস করতে হবে।’
চলে গেল মেহতাব। মতিব মজুমদার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সেই যাওয়া পথে। হঠাৎই প্রচন্ড রাগে শরীর কেঁপে উঠল তাঁর। মেহতাবের রুমালটা ছুড়ে মারলেন দূরে। রাগে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘এভাবেই দিন যাবে না, ভাতিজা। সময় একদিন আমারও আসবে। আর আমার সবথেকে বড়ো তুরুপের তাসও তো ইতিমধ্যেই চলে এসেছে, এবার তাকে দিয়েই তোমার জীবননাশ ঘটাব। প্রস্তুত থাকো, ভাতিজা।’
বলেই ক্রূর হাসলেন তিনি।
চলবে….