#উষসী_হাসবে_বলে
শেষ পর্ব- প্রথম অংশ
লিখা- Sidratul Muntaz
হাসপাতাল থেকে বের হতে বেশ রাত হয়ে যায়। প্রিয়ন্তি অনেক বার ফোন করেছে উষসীকে। কিন্তু ভীড়ের মাঝে ফোন রিসিভ করার ফুরসত পায়নি সে। ইয়ামিন বলল,” কোনো সমস্যা?”
উষসী মুখ গোঁজ করে বলল,”প্রিয়ন্তি আপু ফোন করেছিল কিন্তু ধরতে পারিনি। এখন দেখলাম মেসেজ করেছে। ওরা নাকি বাড়ি চলে গেছে। তৃষাণ ভাইয়াও উষ্ণতা আপুকে নিয়ে চলে গেছে আরও দু’ঘন্টা আগে। ভাইয়া নাকি খুব রেগে আছে। প্রিয়ন্তি আপু জানতে চাইছে আমরা কোথায়। তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”
ইয়ামিন উষুর কাঁধে হাত রেখে বলল,” চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই।”
উষসী মাথা নাড়ল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল সে। বিয়ে করেও লাভ কি হলো? তাদের এখন আলাদা থাকতেই হবে। এমন অভিনয় করতে হবে যেন কিছুই হয়নি। যতদিন পর্যন্ত না ফ্যামিলি সব জানছে আর মানছে! গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাঁধছিল সে। ঠিক ওই সময় ইয়ামিনের নাম্বারেও একটা মেসেজ এলো। সে ফোনের দিকে অনেকক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইল। তাকে স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখে উষসী হর্ণ বাজাল দুষ্টমি করে। ইয়ামিন চমকে উঠে চোখ তুলে তাকাল।উষসী হেসে বলল,” কোথায় হারিয়ে গেছেন? ভেতরে আসুন!”
ইয়ামিন উষসীর হাসি মাখা মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য সে লাইফ রিস্ক নিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। ড্রাইভিং সিটে এসে বসল সে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ড্রাইভ করতে লাগল। হঠাৎ ইয়ামিনের পরিবর্তন লক্ষ্য করে উষসী বলল,” কিছু হয়েছে নাকি?”
ইয়ামিন বলল,” হু? নাহ…তুমি বাসায় গিয়ে কি করবে এখন?”
” আপনি কি আমাকে রিসোর্টে নিয়ে যেতে চাইছেন?” উষসী ঠোঁট চেপে হাসল।
ইয়ামিন থতমত খেয়ে বলল,” না।”
উষসী খিলখিল করে হেসে উঠল। ইয়ামিন হালকা করে তার দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর পুনরায় বুদ হয়ে গেল দুশ্চিন্তায়।
উষসী সাবধানে বলল,” আরে, সামনে তাকান৷ এ”ক্সিডেন্ট করাবেন নাকি?”
ইয়ামিন সামনে তাকাল ত্বরিতে। উষসী জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আজকের দিনটির কথা ভেবে আনন্দে ঝলমল করছে তার মন। এখন মনে হচ্ছে, আর কোনো সন্দেহই নেই। তারা যে বিবাহিত! আলাদা থাকলেও চিরজীবনের জন্য আলাদা হওয়ার ভ’য় নেই। শুধু পরিবারকে কষ্ট করে একটু মানাতে হবে। আর সেটাও এখন খুবই সহজ লাগছে।
তারই পাশে বসে ইয়ামিন তখন ভাবছে পুরোপুরি ভিন্ন কথা! উষসীকে সে এতো ভালোবেসে ফেলল কি করে তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু এবার সেই ভালোবাসা প্রমাণ করার সময় এসেছে।
উষসীদের বাড়ির সামনে গাড়িটি থামে। যাওয়ার আগে উষসী ইয়ামিনকে আলতো করে একটু জড়িয়ে ধরে। ইয়ামিন চোখ বুজে অনুভব করে উষসীর উষ্ণতা। এই অনুভূতির জন্য সে জীবনের যে কোনো রিস্ক নিতে প্রস্তুত! আর সে নিবেই।
উষসী আলতো গলায় বলল,” জানি না কতদিন এভাবে থাকতে হবে। কিন্তু এখন থেকে আমার মধ্যে কনফিডেন্স এসে গেছে৷ কেউ চাইলেও আমাদের আলাদা করতে পারবে না৷ কারণ আমরা বিবাহিত৷ আমি আপনাকে ছাড়াও থাকতে পারব। কিন্তু আপনার জায়গাটা অন্য কাউকে কখনও দিতে পারব না, বিশ্বাস করুন!”
ইয়ামিন মুহূর্তেই চমকে উঠল। উষসী তাকে ছেড়ে থাকার কথা বলছে? উষসী গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছিল। তখনই ইয়ামিন ডাকল,” শোনো।”
উষসী পেছন ফিরে তাকাল, হাসল, “কিছু বলবেন?”
ইয়ামিন কি যেন বলার জন্য হাঁ করল। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনে চেয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটু আগে যে নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিল সেই নাম্বার থেকেই ফোন এসেছে। উষসী বলল,” দাঁড়াচ্ছি আমি। আপনি কথা বলে নিন সমস্যা নেই।”
ইয়ামিন দুইদিক মাথা নেড়ে বলল,” না থাক, তুমি যাও।”
উষসী ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো খানিকটা। ঝুঁকে বলল,” কে ফোন করেছে?”
ইয়ামিন মোবাইল পকেটে ভ’রে বলল,” নাথিং ইম্পোর্ট্যান্ট।”
তারপর হাসল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কি একটা চিন্তা করে বলল,” খুব আর্লি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা একসাথে থাকব খুব দ্রুত।”
উষসী কিছু বুঝতে না পেরে বলল,” কিভাবে ঠিক হবে?”
ইয়ামিন সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,” ভালো থেকো। বায়।”
তারপর সে গভীর আবেগ নিয়ে উষসীর কপালে চুমু দিল। সেই চুমুতে তৃষ্ণা আর ভালোবাসাময় পরশ মেশানো ছিল। উষসীর কেমন যেন লাগছে। কেমন বুকের মধ্যে হালকা অস্থিরতা। সে বুঝতে পারল না কি কারণ! কিছু কি হচ্ছে? ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেও পারল না বেশিক্ষণ। অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। আজ সারাদিন কম ধকল যায়নি। শারীরিক-মানসিক অনেক চাপ গিয়েছে। বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম নিবে সে।
মিসেস শিমলা প্রিয়ন্তীদের লিভিংরুমে বসে আছেন। প্রিয়ন্তী কোমল কণ্ঠে বলল,” আন্টি, আপনি বাড়ি ফিরে যান। ইয়ামিন এলে আমি ওকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিবো। শুধু শুধুই অস্থির হচ্ছেন।”
শিমলা কাতর গলায় বললেন,” কোথাও যাবো না আমি। এখানেই এভাবে বসে থাকব যতক্ষণ ছেলেটা না আসে। তার কাছে আমার মাফ চাইতে হবে প্রিয়। আমি অনেক খারাপ আচরণ করেছি ওর সাথে। ভেবেই কেমন লাগছে… ওহ গড! ”
প্রিয়ন্তি একটু কাছে এসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলল,” ইয়ামিন আপনার উপর কেন রেগে থাকবে বলুন? সে আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনার মুখ দেখলেই সবকিছু ভুলে যাবে দেখবেন! আপনি অকারণ কষ্ট পাবেন না।”
শিমলার চোখে পানি জমে উঠেছে। তিনি অশ্রু মুছতে মুছতে বললেন,” সব এতো সহজ না প্রিয়। আমি আমার ছেলেকে হার্ট করেছি জঘন্যভাবে। মাত্র অল্প কিছুদিন এর পরিচিত একটা মেয়ের কথা শুনে ছেলেটাকে আমি এতোবড় অবিশ্বাস করলাম! তাকে আমি নিজে জন্ম দিয়েছি অথচ তার মনের কথাই বুঝলাম না। আমি ভালো মা হতে পারিনি।”
” আহা আন্টি, এসব বলবেন না তো। আপনার দোষ নেই এখানে। হয়তো আপনার জায়গায় আমি থাকলে আমিও ভুল করতাম। কারণ ঘটনাটাই ওরকম ছিল।”
কলিংবেল বেজে উঠল। ফারদিন দরজা খুলতেই দেখল ইয়ামিন ঢুকছে। তার মুখ ভাবলেশহীন। কেমন চুপ করে ঢুকে রুমে চলে যাচ্ছে৷ কোথাও যেন তার নজর নেই। লিভিংরুমে যে শিমলা বসে আছেন সেটাও খেয়াল করেনি। এদিকে শিমলা ভাবলেন ছেলেটা তাঁর উপর রেগে আছে তাই ফিরেও তাকাচ্ছে না। তিনি দুঃখ পেলেন। প্রিয়ন্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” ইয়ামিন, কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে আয়।”
ইয়ামিন নিঃসাড় গলায় বলল,” ভালো লাগছে না আপু। পরে কথা হবে। গুড নাইট।”
“আরে… তাই বলে তুই আন্টির সাথেও দেখা করবি না?”
ইয়ামিন এতোক্ষণে পেছনে চাইল৷ মিসেস শিমলাকে দেখে একটু হকচকিয়ে বলল,” মা… তুমি?”
শিমলা কাঁদছেন। মায়ের চোখে পানি দেখে ইয়ামিন ভড়কে গেল। কিছু হয়েছে নাকি? শিমলা কাছে এসে ইয়ামিনের গালে হাত রেখে বললেন,” আ’ম স্যরি। বাবা, আমাকে মাফ করে দে! আমি বাইরের একটা মেয়ের মিথ্যা ড্রামা বিশ্বাস করে তোকে চ’ড় মেরেছি। এই অন্যায়ের এক্সপ্লানেশন আমি কিভাবে দিবো তোর কাছে?”
ইয়ামিন মুচকি হাসল একটু। মায়ের হাতটা কাছে নিয়ে বলল,” তোমাকে এক্সপ্লানেশন দিতে হবে না, মা। আমি জানতাম তুমি আমার কাছে আসবে। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি।”
তারপর মায়ের হাতে নিয়ে চু’মু দিল সে। শিমলা শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। মনের মধ্যে তাঁর অনুতাপের উত্তপ্ত আগুন। ইয়ামিন সেই আগুনে শীতল জল ঢেলে বলল,” আই লভ ইউ মা। কখনও সরাসরি বলা হয়নি তাই না?”
শিমলা একটু অবাক হলেন। ইয়ামিন এভাবে কেন বলছে? তার কণ্ঠে কেমন শূন্যতা! কিছু হয়েছে নাকি ছেলেটার?
তিনি প্রিয়ন্তির দিকে ঘুরে বললেন,” সকালে একবার উষুকে আসতে বলবি প্রিয়?”
প্রিয়ন্তি আর ফারদিন একবার চোখাচোখি করল। প্রিয়ন্তি বলল,” নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তৃষাণ মনে হয় না ওকে এখানে আর আসতে দিবে। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় যা হচ্ছে…তাছাড়া ওরা কেউই এখনও এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি।”
শিমলা কঠিন মুখে বললেন,” সেটাই স্বাভাবিক। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্কে জড়িয়েছে ওরা৷ তবে আমিও এখন থেকে ওদের সাপোর্ট করি। তাই আমি নিজে কথা বলব উষুর পরিবারের সাথে। প্রয়োজনে তৃষাণের সাথেও।”
ফারদিন হাসার ভঙ্গি করে বলল,” এটা তো উত্তম প্রস্তাব৷ কিন্তু তার আর দরকার নেই। কারণ ওদের বিয়ে তো…”
ফারদিন পুরো কথা শেষ করার আগেই প্রিয়ন্তি প্রায় খামচে ধরল তার বাহু। শিমলা চোখ বড় করে চাইলেন। বিভ্রান্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেন,” কি ব্যাপার প্রিয়? ওদের কি বিয়ে হয়ে গেছে? মানে আমার ছেলে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে?”
অস্থির আর বিচলিত শোনায় শিমলার কণ্ঠ। প্রিয়ন্তি দ্রুত দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” সেরকম কিছু না আন্টি। তুমি ভাবলে কি করে তোমার ছেলে তোমাকে রেখে বিয়ে করে ফেলবে? আসলে আমরাই এটা ভেবেছিলাম যে ওদের বিয়েটা করিয়ে দিবো। কিন্তু পরে তো উষ্ণতা অসুস্থ হয়ে গেল আর হাসপাতালে যেতে হলো।”
শিমলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন এবার। ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললেন,” যা হয় ভালোর জন্যই হয়। পরিবারের অনুমতি ছাড়া যে বিয়ে সেটা কোনো বিয়ে না। আমার ছেলে ওমন কাপুরুষের মতো বিয়ে কখনোই করবে না। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে তবেই বিয়ে করবে।”
কথাটা বলেই গর্বের হাসি হাসলেন শিমলা। প্রিয়ন্তিও হাসার চেষ্টা করল। ফারদিন ভ’য়ে ভ’য়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। প্রিয়ন্তি চোখ রাঙিয়ে তাকানো মাত্র সেও হাসল। ইয়ামিন অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। সে কেমন অন্যমনস্ক আজ। কেউই তার অস্বাভাবিকতা টের পেল না। কিংবা পেলেও তেমন আমলে নিল না।
পরিবারের সবাই একত্রে খেতে বসেছে। উষসী ভ’য়ে ভ’য়ে তৃষাণের দিকে তাকাচ্ছে। সে একদম নিশ্চুপ, গুমোট। অন্যদিন সবার সাথে কথা বলে। অন্তত ডোনা আর যুথির খোঁজ-খবর নেয়। ঔষধ শেষ হয়েছে নাকি, কবে চেকাপে নিতে হবে… এই ধরণের টুকটাক আলাপ করে। আজ কিছুই বলছে না সে। উষসীর বেশ ভ’য় লাগছে। উষ্ণতাও কেমন নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে সে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত। কাউকে প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না উষসীর। সে চুপচাপ খাবার খেয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।
সকালে শিমলা যত্ন করে ছেলের জন্য ব্রেকফাস্ট বানালেন। কিন্তু ইয়ামিনের ঘরে যেতেই দেখা গেল সে ভেতরে নেই। অনেক আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। তার মোবাইলে ফোন করা হলো। কিন্তু সুইচড অফ। সত্যিই চিন্তার ব্যাপার! শিমলা আর কিছু না পেয়ে উষসীকে ফোন করলেন। এই মুহূর্তে উষসী ছাড়া অন্যকারো নাম মাথাতেও আসছে না।
উষসী নিজেও সকাল থেকে ইয়ামিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। মিসেস শিমলার ফোন পেয়ে সে আরও উদগ্রীব হয়ে যায়।
” আন্টি, আমিও উনাকে অনেক বার ফোন করেছি। কিন্তু মোবাইল সুইচড অফ। উনি কোথায় যেতে পারে আপনি কি জানেন?”
শিমলা বিচলিত স্বরে বললেন,” আমি জানি না বলেই তো তোমাকে ফোন করলাম, মা। যাইহোক, আমি এখনি তোমার বাড়িতে আসছি।”
” আমার বাড়িতে মানে? কেন আন্টি?” ভ’য়ে উষসীর গলা শুকিয়ে গেল।
শিমলা জানালেন,” বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসব। তুমি শাড়ি পরে অপেক্ষা করো।”
উষসীর এবার কাশি ওঠার উপক্রম হলো। তার বাড়িতে এমনিতেও ভ’য়াবহ অবস্থা। তৃষাণের মেজাজ খুব উত্তপ্ত হয়ে আছে। সে কারো সাথে কথা না বলে অফিসে চলে গেছে। তার রাগের কারণ হিসেবে সবাই উষসীকে দোষারোপ করছে। ফলাফল- উষসীর সাথেও কেউ কথা বলছে না। এই অবস্থায় যদি মিসেস শিমলা আসেন তাহলে উষসীর নিজের বাড়িতে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। কিন্তু সে নিষেধই বা কিভাবে করবে? শত হলেও মিসেস শিমলা এখন তার শাশুড়ী হোন!
উষসী মোবাইল হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইল। একমনে আল্লাহকে ডাকছে সে সাহায্যের জন্য। একমাত্র আল্লাহর গায়েবী শক্তি ছাড়া এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো উছিলা নেই। মিসেস শিমলা তার বাড়ি এলেন দুপুর বারোটায়। উষসী তটস্থ মন নিয়ে দরজা আটকে ঘরেই বসে রইল। আজ ভূমি”কম্প হলেও সে ঘর থেকে বের হবে না!
যুঁথি বেগম উষসীর ঘরের দরজায় ঠকঠক করে ডাকলেন,” উষু, বের হ। তোর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।”
” কে এসেছে মা? এই সময় আবার কার আসার কথা?” উষসী এমন ভাব করল যেন সে কিছু জানে না।
” তুই বের হলেই দেখবি কে এসেছে!”
যুঁথি রাগান্বিত কণ্ঠে এইটুকু বলেই চলে গেলেন। উষসী বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে বেশ অনেকক্ষণ পর বের হলো। দেখা গেল লাউঞ্জে বসে আছেন মিসেস শিমলা, তাঁর সঙ্গে প্রিয়ন্তি ও ফারদিন। সবার মুখ হাসি হাসি। তাদের পাশেই গম্ভীর মুখে বসে আছেন ডোনা। তিনি উষসীকে নিজের পাশে বসতে ইশারা করলেন।
উষসী তার কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো বসল। যুঁথি ফারজানাকে জলখাবার আনার জন্য বলে নিজেও এসে বসলেন সবার সাথে। প্রত্যেকেই কেমন অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা সবার মধ্যমণি হয়ে মাঝখানেই বসা৷ উষ্ণতা অসুস্থ হওয়ার কারণে সময়ে-অসময়ে ঘুমিয়েই কাটায়। এই মুহূর্তেও সে মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নিজের ঘরে।
অস্বস্তি কাটানোর উদ্দেশ্যে শিমলা তৃষ্ণার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন,” কেমন আছো তৃষ্ণা বাবু?”
তৃষ্ণা জবাব দিল,”ভালো।”
” তোমার ছোটবোন কেমন আছে?”
“ও কেমন আছে সেটা আমি জানি না। ওকে জিজ্ঞেস করুন৷ ”
শিমলা অপ্রস্তুত মুখে বললেন,” ও কি কথা বলতে পারে? ওকে কিভাবে জিজ্ঞেস করব?”
” কথা না বললেও ওর কথা বোঝা যায়। ভালো থাকলে ও হাত-পা নাড়ে, হাসে। আর ভালো না থাকলে কাঁদে, চুল খামচে ধরে।”
” ওমা, তোমার চুল কি খামচে ধরেছে কখনও?”
তৃষ্ণা অসহায় মুখে বলল,” হুম ধরেছিল। কয়েকবার।”
” তুমি কি করেছো তখন?”
” কিছুই না। ওকে কিছু বলা যায় না। বললে পাপা আমাকে ধমকায়। ও হলো পাপার আদরের মেয়ে।”
” আর তুমি? তুমি কি আদরের ছেলে না?”
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ ভেবে সোফায় গা এলিয়ে বসল। একটু গম্ভীর মুখে বলল,” হ্যাঁ আমিও আদরের। কিন্তু ও একটু ছোট তো, তাই হয়তো বেশি আদরের!”
সবাই হেসে ফেলল। ফারজানা ট্রে ভর্তি চা, কেক, হাতে বানানো পিঠা, চকলেট বিস্কিট, মিষ্টি আর কিছু ফল কেটে নিয়ে এসেছে। সবকিছু সেন্টার টেবিলে রাখা হলো।
ডোনা বিনয়ের সাথে বললেন,” শিমলা আপা, নিন শুরু করুন। প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে এসেছেন। বউ মা অসুস্থ বলে বেশিকিছু আয়োজন করতে পারছি না।”
শিমলা আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন,” কোনো সমস্যা নেই। আমি এসেছি জরুরী কাজে। তৃষাণ মনে হয় বাড়িতে নেই, তাই না?”
ডোনা মাথা নেড়ে বললেন,” না৷ ও তো এই সময় অফিসেই থাকে।”
শিমলা বললেন,” প্রিয় আমাকে সেটাই বলেছে। তবুও আমি এসেছি কারণ উষুর মেইন গার্ডিয়ান হিসেবে যুঁথি আপা তো আছেনই। আমার কথা উনার সাথেই।”
যুঁথি বিপাকে পড়ে গেলেন। মিসেস শিমলা এখানে কেন এসেছেন তা সবারই জানা। তবে সেই কথা কেউ শুনতে চায় না। যুঁথি হাসি মাখা গলায় বললেন,” তৃষাণই উষুর মেইন গার্ডিয়ান। ছোট থেকে ওকে বড়ভাইয়ের মতো মানুষ করেছে। বাবা আর ভাই দু’জনের দায়িত্ব একাই পালন করেছে। সম্পর্কে মেয়ের জামাই হলেও তৃষাণকে আমি নিজের ছেলে মানি। তাই আমার এবং আমার মেয়ের প্রধান অভিভাবক তৃষাণ। তাকে ছাড়া আমি আসলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না ”
পরিস্থিতি সামলাতে আপাতত যুঁথি হড়বড় করে তৃষাণের ঘাড়েই সবকিছু চাপিয়ে দিলেন। যাতে মিসেস শিমলা তৃষাণের সাথেই কথাটা বলেন। কিন্তু শিমলাও কম নয়। তিনি বিগলিত কণ্ঠে বললেন,” তা তো অবশ্যই৷ তৃষাণের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করতেই হবে যেহেতু সে এই পরিবারের মাথা। কিন্তু আপনি তো তৃষাণের মায়ের মতো। আর ডোনা আপা তো তৃষাণের মা-ই। দু’জন মা মিলে এক ছেলেকে একটু শাসন করে বোঝাতে পারবেন না? নিশ্চয়ই পারবেন। আমি সেজন্যই আপনাদের কাছে এসেছি বিশেষ আর্জি নিয়ে।”
এই পর্যায় ডোনা এবং যুঁথি দু’জনেই কেমন ইতস্তত করতে লাগলেন। অন্যঘর থেকে সোফিয়ার কান্না শোনা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কেঁদে কেঁদে উঠছে। ফারজানা তাই সেখানে চলে গেছে। ডোনা প্রসঙ্গ এড়ানোর উদ্দেশ্যে বললেন,” আমার নাতনি মনে হয় উঠে গেছে। একটু দেখে আসছি গিয়ে কি সমস্যা…আপা, আপনারা কথা বলুন।”
ডোনা এমনভাবে উঠে গেলেন যেন বড়জোর বাঁচলেন। এবার যুঁথির পালা। শিমলা একরাশ আশা এবং আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। যুঁথি ইতস্তত মুখে বললেন,” আপা, চুলায় ভাত বসানো হয়েছে। আমি একটু দেখে আসছি। একমিনিট…”
ঠুনকো বাহানা বানিয়ে তিনিও উঠে পড়লেন। শিমলা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আশেপাশে তাকাচ্ছেন। প্রিয়ন্তি মলিন মুখে বলল,” দেখেছো আন্টি, বলেছিলাম না? এরা কেউই তৃষাণ ভাইয়ের কথা ছাড়া নড়বে না।”
শিমলা উষসীর দিকে চাইলেন,” তুমি কি বলো উষু? আমি কি এখন তৃষাণের অফিসে যাবো?”
উষসী দ্রুত দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” ভুলেও এটা করবেন না আন্টি। এই মুহূর্তে তৃষাণ ভাইয়ের মেজাজ খুবই খারাপ। কালরাত থেকে উনি কারো সাথেই কথা বলছেন না। তাই এখন তাকে কিছু না বলাই ভালো। আর আন্টি আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন? বিয়ে তো আমাদের হয়েই গেছে। এবার অপেক্ষা করতেও কোনো সমস্যা নেই। আস্তে আস্তে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তখন সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দিলেই হলো।”
পাশে থেকে প্রিয়ন্তি প্রাণপনে ইশারা করছে থামার জন্য। কিন্তু উষসী তার কথা বুঝলই না৷ এদিকে শিমলা প্রায় হতবিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,” তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে?”
উষসী দ্বিগুণ হতবিহ্বল হয়ে বলল,” কেন আপনি জানতেন না আন্টি? আমি তো ভাবলাম এই কথা জেনেই আপনি এখানে এসেছেন!”
এবার অসহায় চোখে সে তাকাল প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তি কপালে হাত ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে। ফারদিন হতাশ গলায় বলল,” তোমাকে এতোক্ষণ এজন্যই চুপ করতে বলছিলাম উষু।”
উষসী মাথা নিচু করে বলল,” আই এম স্যরি।”
শিমলা ক্ষণকাল বিস্ময় নিয়ে বসে রইলেন। তারপর কিছুটা তেজ নিয়ে বললেন,” কাজটা তোমরা মোটেও ঠিক করোনি।”
উষসী যেন আরও গুটিয়ে গেল এবার। কালরাত থেকে এজন্যই অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছে সে৷ বাড়ির কারোর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলার সাহস হয়নি। শিমলা রাগী স্বরে বললেন,” ব্যাপারটা কাউকে না জানানোই ভালো। কারণ এই বিয়ে কোনো বিয়ে না। অভিভাবক ছাড়া এভাবে নিজেদের মর্জিমতো বিয়ে হয় নাকি? সবাই মেনে নিলেও তো আমি এমন বিয়ে কখনোই মানব না। তোমাদের আবার বিয়ে দেওয়া হবে। এই বিয়ের কথা তোমরা ভুলে যাও।”
উষসী তাকাল প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তি চোখের ইশারায় তাকে রাজি হতে বলল। উষসী মাথা দুলিয়ে বলল,” ঠিকাছে আন্টি। আপনি যেটা ভালো মনে করেন।”
এমন সময় রান্নাঘর থেকে যুঁথি ডাকলেন,” উষু, একবার এদিকে আয় তো।”
উষসী শিমলার দিকে তাকিয়ে বলল,” আন্টি, আই এম স্যরি। প্লিজ আপনি আমাদের উপর রেগে থাকবেন না।”
শিমলা নিজেকে সামলে বললেন,” ঠিকাছে। আমি রেগে নেই। তুমি যাও, তোমার মা ডাকছে। হয়তো জরুরী কিছু।”
উষসী মাথা নিচু করে রান্নাঘরে এলো। যুঁথি সবেগে তার হাতের বাহু চেপে ধরলেন। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল উষু। যুঁথি কটমট করে বললেন,” এসব কি শুনলাম আমি? তোরা গোপনে বিয়েও করে ফেলেছিস?”
উষসী চোখ বড় করে তাকাল,” তুমি এতোক্ষণ আড়ি পেতে কথা শুনছিলে? ছি, মা!”
” চুপ, ভাগ্যিস আড়ি পেতে শুনেছিলাম৷ নাহলে জানতাম কিভাবে এতোবড় ঘটনা? দাঁড়া আমি এক্ষুণি তৃষাণকে এই ব্যাপারে জানাচ্ছি। তোদের তো সাহস কম না!”
ভ’য়ে উষসীর কলিজা শুকিয়ে আসছে। সে ছো মেরে যুঁথির হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে অনুরোধ করে বলল,” প্লিজ মা, এরকম কোর না।”
যুঁথি উষসীর গালে একটা চড় মারলেন। তারপর তার থেকে ফোন ছিনিয়ে সত্যি সত্যি তৃষাণের নাম্বারে ডায়াল করলেন। উষসী করজোড় করে মিনতি করতে লাগল,” প্লিজ মা, প্লিজ। তৃষাণ ভাইয়া এসব জানলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।”
যুঁথি অগ্নিকণ্ঠে বললেন,” ডোনা আপা তোদের সম্পর্কের কথা জেনেও গোপন করেছিলেন। এজন্য তৃষাণ এখনও তার মায়ের উপর রেগে আছে। এখন আমিও যদি এতোবড় একটা কথা জেনে তাকে না বলি তাহলে ও আমাদের কাউকে আর বিশ্বাসই করবে না। যেভাবেই হোক, আমি ওকে এই কথা জানাব। তারপর ও যা ভালো বুঝবে সেটাই করবে। হ্যালো তৃষাণ, বাবা!”
ওই পাশ থেকে ভেসে এলো আহমেদের বাধ্য কণ্ঠ,” মাঐ আন্টি, স্যার একটু ব্যস্ত আছেন। জরুরী মিটিং। আপনার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন।”
” তোমাকে কেন বলতে যাবো? আর একবার না বলেছি আমাকে মাঐ আন্টি ডাকবে না?”
” স্যরি মাঐ আন্টি।”
যুঁথি কপট গলায় বললেন,” তৃষাণের মিটিং কখন শেষ হবে? ওর সাথে আমার খুবই জরুরী কথা আছে। আর সেটা শুধু ওকেই বলতে হবে। তোমাকে বলা যাবে না।”
” স্যার কখন আসবে সেটা তো বলতে পারছি না। উনি আজ অনেকদিন পর মতিঝিলের পুরনো বাড়িটায় গেছেন। বলছিলেন খুব জরুরী আর গোপন একটা মিটিং আছে। আমাকেও বলেননি যে কিসের মিটিং। ওটা কোনো অফিসিয়াল মিটিং বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে তো আমাকে জানানো হতো।”
উষসী ফোনে কান পেতে সব শুনছিল। তার বুকের ভেতরটা কেমন ধ্বক করে উঠল। যুঁথিও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,” মতিঝিলের পুরনো বাড়ি? সেখানে এই সময় ওর আবার কিসের মিটিং?”
উষসী একছুটে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ইয়ামিনের নাম্বারে আবার ডায়াল করল সে। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। ইয়ামিনের ফোন সকাল থেকে সুইচড অফ, তৃষাণের ফোন আহমেদের কাছে। আবার সে গিয়েছেও মতিঝিলের পুরনো বাড়িতে। এসব ঘটনা কেন একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হচ্ছে?
কালরাতে ইয়ামিনের কথাগুলোতেও কেমন ধোঁয়াশা ছিল। সে বলছিল সব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। এই কথা কেন বলেছিল? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে তখনি তৃষাণ ইয়ামিনকে মেসেজ করেছিল। দেখা করার জন্য নির্জন জায়গায় যেতে বলেছিল। আর ইয়ামিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সত্যি সেখানে চলে গেছে! হায় আল্লাহ! সে কি এখনও তৃষাণকে চিনতে পারেনি?
মতিঝিলের একটা পুরনো, শূন্য বাড়ির বিশাল করিডোরে মাথা নিচু করে বসে আছে ইয়ামিন। গতরাতে তাকে মেসেজ করে আগন্তুক এখানেই আসতে বলেছিল। নাম উল্লেখ না থাকলেও সে ভালো করেই জানে আগন্তুকের আসল নাম। আর জানে বলেই ভাগ্যের উপর নিজেকে সমর্পন করতে পেরেছে অনায়াসে।
অনেকক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ হলো। ইয়ামিন সোজা হয়ে বসল। ধীর পায়ে কেউ হেঁটে আসছে। গটগট শব্দ হচ্ছে। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসে একটি লম্বাকৃতির ছায়াবয়ব। গম্ভীর, থমথমে কণ্ঠে অবয়বটি বলল,” তোমার এটাকে কি বলা যায় ইয়ামিন ইব্রাহীম? সাহস না দুঃসাহস?”
ইয়ামিন কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। তৃষাণ একটু কাছে এসে পকেটে হাত গুঁজে বলল,” তোমাকে আমি মৃ’ত্যুর হু’মকি দিয়েছিলাম। তুমি বোধহয় সেটা সিরিয়াসলি নাওনি। তাই এখানে এমন নিশ্চিন্তে বসে আছো।”
ইয়ামিন পরিষ্কার গলায় বলল,” উষসীর সাথে জড়িত সবকিছু আমার কাছে সিরিয়াস৷ তাই আপনার হু’মকি সিরিয়াসলি না নেওয়ার কিছু নেই।”
তৃষাণ চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,” তাহলে নিশ্চিত মৃ’ত্যু জেনেও তুমি এখানে কেন এসেছো? এই রকম একটা রিমোট প্লেসে আমি তোমাকে মে’রে ফেলতে দুইবার চিন্তা করব না। সেটা নিশ্চয়ই তুমি জানো।”
” আমাকে মে’রে আপনার লাভটা কি?”
তৃষাণ হাসল একটু। একহাতের আঙুল দিয়ে ভ্রু চুলকে বলল,” লাভের কথা বলছো? আরে, তোমার মতো কীটকে জীবন থেকে বহিষ্কার করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। দশবছর আগে সেটা করতে পারিনি।’বাচ্চা ছেলে’ ভেবে মাফ করে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু এবারও সেই একই ভুল করব না।”
ইয়ামিন কয়েক মুহূর্ত তৃষাণের চোখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল,” মাঝে মাঝে আপনাকে আমার সাইকো মনে হয় শাহবাজ তৃষাণ। কিন্তু আপনি মোটেও সাইকো না। বরং আপনি সাইকো সাজার ভাণ করেন। সবাই আপনাকে ভ’য় পাবে, আপনার আতঙ্কে অস্থির হবে- এটাই আপনি চান। আতঙ্ক সৃষ্টি করতে আপনি ভালোবাসেন। এটাকে ঠিক সাইকো বলতে হয় নাকি ব্রেইন ডিফেক্ট আমার জানা নেই।”
তৃষাণ হেসে ফেলল। হাসতেই লাগল। তারপর খুব আচমকা ইয়ামিনের শার্টের কলার টেনে ধরল আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। ইয়ামিন তখনও স্বাভাবিক। তৃষাণ তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে সরাসরি তাক করল ইয়ামিনের মাথায়।
ইয়ামিন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। বিকট একটা শব্দ হয়। ছাদের উপর অজস্র কাকের সারি দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারা আতঙ্কে অস্থির হয়ে উড়াউড়ি শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরেই বিষণ্ণ নিস্তব্ধতায় চারদিক কেমন ছেয়ে যেতে লাগল।
উষসী তার ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা অবিরাম পায়চারি করছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে তার। এতোটা অস্থির আগে কখনও লাগেনি। মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে শ্বাস আটকে ম’রে যেতে পারে।
বাইরে থেকে শোর-গোলের আওয়াজ শোনা গেল। মিসেস শিমলা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন। উষসীর পা কাঁপছে। মাথা ঘুরছে। সবকিছু ঝাপসা, অন্ধকার। চারদিকে এতো হাহাকার কেন? সে কোনমতে বাইরে পা বাড়াল। লাউঞ্জে ইয়ামিনের নিথর দেহ পড়ে আছে। র’ক্তাক্ত তার শরীর। তৃষাণ গম্ভীর মুখে সোফার এক কোণায় বসে আছে। তার হাতে পিস্তল।
উষসী কাউকে কিছু বলল না৷ সোজা গিয়ে তৃষাণের সামনে দাঁড়াল। কঠিন মুখে বলল,” এভাবে কারো জীবন কেঁড়ে নেওয়ার অধিকার তোমার নেই।”
তৃষাণ অকপট জবাব দিল,” যে আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখা বোকামি। চূড়ান্ত অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার আগেই আমি ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তুমি এখন বুঝতে পারছো না উষু, কিন্তু আমি সবসময় তোমার ভালো চেয়েছি।”
এই কথা বলেই তৃষাণ তার মাথার উপর হাত রাখল। উষসী পাগলের মতো চিৎকার করে ঝটিতে সরিয়ে দিল সেই হাত। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” তুমি পাষাণ, আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে পাষাণ মানুষ তুমি। আই হেইট ইউ!”
উষসী হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ঘুমের মধ্যে তার এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন ডোনা। আলতো করে তার গালে চাপড় দিয়ে ঘুম ভাঙালেন। চোখ খুলতেই উষসী বুঝতে পারল, স্বপ্ন ছিল পুরোটাই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। এতো অদ্ভুত স্বপ্ন সে আর কোনোদিন দেখতে চায় না!
প্রিয়ন্তির কোলে সোফিয়া শুয়ে আছে। বড় বড় চোখে তাকাচ্ছে সে চারপাশে। প্রিয়ন্তি বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” মাশআল্লাহ, কি মিষ্টি একটা মেয়ে! উষ্ণতা ভাবি, তুমি খুব লাকি। ছেলে-মেয়ে দু’টোই একদম রসগোল্লার মতো হয়েছে। কি কিউট!”
উষ্ণতা মুচকি হাসল। বিছানার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা শিমলার দিকে চেয়ে বলল,” আন্টি বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
” সমস্যা নেই৷ আমি দাঁড়িয়েই থাকি। একটু পর বাইরে গিয়ে বসবো৷ শুধু তোমার মেয়েটাকে একটু দেখতে এসেছিলাম। খুব সুন্দর হয়েছে মাশআল্লাহ।”
” ধন্যবাদ আন্টি। তবুও একটু বসুন। প্রথমবার আমার ঘরে এসে আপনি দাঁড়িয়ে থেকে গেলে আমারই খারাপ লাগবে।”
শিমলা কিছুক্ষণের জন্য বসলেন। উষ্ণতা আর তার নবজাতকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খোঁজ-খবর নিলেন। একটু পর যুঁথি এসে ডাকতেই তিনি উঠে চলে গেলেন। এবার শুধু প্রিয়ন্তি আর উষ্ণতাই বসে আছে ঘরে। প্রিয়ন্তি ফিসফিস করে বলল,” উষসী খুবই টেনশনে আছে ভাবী।”
” কেন? কি হয়েছে?”
” তোমার গুণধর স্বামী মানে আমার ভাই ভেজাল বাঁধিয়েছে একটা। সে নাকি মতিঝিলের কোন পুরনো বাড়িতে গেছে মিটিং করতে।”
উষ্ণতা আশ্চর্য হয়ে বলল,” তৃষাণ ওই জায়গায় মিটিং করতে যাবে কেন? মিটিং এর জন্য জায়গার অভাব আছে নাকি?”
” আরে সেটাই তো। এটা নাকি কোনো অফিসিয়াল মিটিং না। আহমেদ ভাইও তো কিছু জানে না। তার কাছে আবার ফোন রেখে গেছে তৃষাণ ভাই। এজন্য তার সাথে যোগাযোগ করাও যাচ্ছে না। এদিকে আবার ইয়ামিনেরও সকাল থেকে মোবাইল বন্ধ। বুঝতে পারছো কাহিনী? সামথিং ইজ ফিশি। উষু ধারণা করছে তৃষাণ ভাই ইয়ামিনকে ওখানে ডেকে নিয়ে গেছে।”
উষ্ণতা এই কথা শুনে ভ’য় পেয়ে গেল৷ তার মুখ-চোখ কেমন সাদা হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে বলল,” তুমি এমন করে তাকাচ্ছো কেন? উষুর মতো ভ’য় পেয়ে গেছো নাকি? ওহ গড! তোমাদের অবস্থা দেখে তো আমারও ভ’য় লাগছে এবার। ইয়ামিনের কিছু হবে না তো?”
উষসী দুপুর থেকেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এক মুহূর্তের জন্যেও শান্ত হয়ে বসছে না। সে তৃষাণের পুরনো বাড়ি মতিঝিলের ঠিকানা জানতে চায়। কিন্তু সেই ঠিকানা কেউ দিতে পারছে না। উষসী সেজন্য আরও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিচ্ছিল। ডোনা তাকে খুব কষ্টে শান্ত করেছেন। ঘরে এনে বসিয়েছেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছেন,” শান্ত হ মা, একটু শান্ত হ!”
উষসীর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে কিভাবে শান্ত হবে? কিভাবে শান্ত হওয়া সম্ভব? কিভাবে! অনেক বেশি উত্তেজিত তার নার্ভ। গতরাতে ঘুম ঠিক না হওয়ার কারণে ক্লান্তও লাগছিল৷ তাই সে এই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নটা দেখার পর আরও দিশেহারা লাগছে। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ইয়ামিনের ফোন এখনও বন্ধ। মিসেস শিমলাও এবার খুব দুশ্চিন্তা করছেন। যদিও তিনি এখনও কিছু জানেন না।
উষসী উত্তাল কণ্ঠে বলল,” প্লিজ ভালো আন্টি, আমাকে একটু বাইরে যেতে দাও। ঘরে বসে থাকতে আমার সাফোকেশন লাগছে।”
” ছাদে যাবি?”
” না। আমি বাইরে যাবো। গাড়ি নিয়ে বের হবো।”
” বুঝেছি, তুই মতিঝিল যেতে চাইছিস তাই তো? কিন্তু ওই বাড়ির ঠিকানা কি তুই জানিস? গিয়ে কি করবি? শুধু খুঁজবি কিন্তু পাবি না। পরে তোর কোনো বিপদ হলে?”
উষসী ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। উচ্চ কণ্ঠে বলল,” কিচ্ছু হবে না আমার। উফ, তুমি কেন বুঝতে পারছো না এভাবে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে আমি দম আটকে ম’রে যাবো।”
ডোনা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন উষসীর দিকে। তাঁর বেশ মায়া লাগছে মেয়েটার জন্য৷ তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, তৃষাণ আজ বাড়ি ফিরলে একটু ভালো করে শাসন করবেন। কি এমন হয় ওদের সম্পর্কটা মেনে নিলে? তৃষাণ অযথাই জেদ করছে!
কলিংবেল বেজে উঠল। উষসীর মনে হলো তার বুকের ভেতর দামামা বাজতে শুরু করেছে। সে স্তব্ধ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ডোনা বিছানা থেকে নামলেন। কে এসেছে দেখার জন্য বাইরে গেলেন। উষসী যেতে পারল না। নড়া-চড়ার শক্তি নেই তার মাঝে। মন কেমন কু ডাকছে। কে এসেছে বাইরে? দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই সে দুইহাতে মুখ ঢেকে নিল। শোরগোলের শব্দে কান ভারী হয়ে আসছে। সবাই এতো চিৎকার করছে কেন?
চলবে
#উষসী_হাসবে_বলে
শেষ পর্ব- শেষাংশ
লিখা- Sidratul Muntaz
উষসীর সারা শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। সে কোনমতে বিছানায় বসল। তার মনে হচ্ছে এখনি জ্ঞান হা’রাবে সে। স্বপ্নের মতো ওই বীভৎস দৃশ্য সে বাস্তবে দেখতে চায় না। একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। পরিচিত সুঘ্রাণে ভরে উঠেছে সারাঘর। উষসীর গা ছমছম করে উঠল। সে কিছুতেই চোখ খুলে তাকাবে না।
হঠাৎ ঠান্ডা দু’টো হাত স্পর্শ করল তার বাহু। উষসী স্থির হয়ে গেল৷ তার শরীরের কম্পন থেমে গেল। চোখ দু’টো এখনও বন্ধ। একটা শীতল স্বর শোনা গেল” তাকাও।”
উষসী দুই পাশে মাথা নাড়ল। তাকাবে না সে। তারপর কি ভেবে যেন তাকাল। ইয়ামিনের মুখটা দেখেই আবেগে বিগলিত হয়ে গেল মন। চোখের কোণ খুশির অশ্রুতে চিকচিক করে উঠল। তৃপ্তির হাসি ফুটল ঠোঁটে। বুক ভরে গেল অসীম মায়ায়! পর মুহূর্তেই সে খুব সাবধানে দেখতে লাগল, ইয়ামিনের গায়ের কোথাও র’ক্ত লেগে নেই তো?
একটু কাঁপা হাতে সে ইয়ামিনের পুরো দেহ মর্দন করতে লাগল। ইয়ামিন তার হাত দু’টো চেপে ধরে নিজের কাছে এনে চোখে চোখ রেখে বলল,” লেটস ম্যারি এগেইন।”
উষসী হতভম্ব। দরজার কাছেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ডোনা আর মিসেস শিমলা। উষসী তাদের কাউকে খেয়াল করল না। সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইয়ামিনের গায়ে, তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে।
ডোনা আর শিমলা এই দৃশ্য দেখে লজ্জায় দরজার সামনে থেকে সরে গেলেন৷ উষসী ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,” আপনি ঠিকাছেন? কিছু হয়নি তো আপনার? আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।”
” কিচ্ছু হবে না আমার। এতো সহজে তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না, ডন্ট ওরি।”
এই কথা বলেই ইয়ামিন হাসল। স্নিগ্ধ আর সুন্দর হাসি। উষসীর মনের শূন্যতা কানায় কানায় পূর্ণ হচ্ছে চমৎকার অনুভূতিতে। সে হেসে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া সত্যি আপনাকে ওই পুরনো বাড়িতে ডেকেছিল?”
ইয়ামিন অবলীলায় উচ্চারণ করল,” হুম।”
উষসী চিৎকার করে বলল,” আপনি গেলেন কেন? যদি কিছু হয়ে যেতো? এতোবড় রিস্ক কেন নিলেন? কেন কাউকে কিছু জানালেন না?”
ইয়ামিন শান্ত গলায় উত্তর দিল,” যেখানে পুরো পৃথিবী সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে আমাকে আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে চরিত্রহীন সাব্যস্ত করেছিল… সেখানে একমাত্র তুমি পরিবার ছেড়ে আমার হাত ধরেছিলে। বলেছিলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। আমার পাশে থাকবে সবসময়।
আমি এই কথা ভুলি কি করে উষু? তোমার জন্য এইটুকু করতে পারব না? তোমার হাসি মুখ দেখার জন্য আমি লাইফ রিস্ক নিতে পারি হাসতে হাসতে।”
উষসী তার আঙুলটা ইয়ামিনের ঠোঁটের উপর চেপে ধরল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,” হাসতে হাসতে লাইফ রিস্ক নিতে হবে না৷ কারণ আপনি পাশে না থাকলে উষসী কখনোই হাসবে না।”
ইয়ামিন নিজের মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে সহাস্যে বলল,” ঠিকাছে। তাহলে উষসী হাসবে বলে ইয়ামিন ইব্রাহীম সবসময় তার পাশে থাকবে।”
উষসী ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর চাতকের মতো পুনরায় জড়িয়ে ধরল তাকে। ইয়ামিন দুই হাতে উষসীকে আগলে নিয়ে বলল,” আই লভ ইউ উষসী।”
” আবার বলুন।” উষসীর কণ্ঠে তীব্র পিপাসা।
ইয়ামিন আনন্দিত গলায় বলল,” আই লভ ইউ।”
উষসী নিঃসংকোচ আবদার করল,” বলতেই থাকুন।”
” আই লভ ইউ, আই লভ ইউ, আই লভ ইউ….”
উষ্ণতা হাসছে। প্রিয়ন্তি কাছে এসে মিনমিন করে বলল,” কেন হাসছো ভাবি?”
উষ্ণতা জবাবে বলল,” তোমরা সবাই তো টেনশনে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলে। কিন্তু আমি একটুও টেনশন করিনি। কারণ আমি জানতাম ইয়ামিনের কিছুই হবে না।”
প্রিয়ন্তি হাঁ করে তাকাল। অসন্তুষ্ট মুখে বলল,” কি দুষ্ট তুমি! আমাকে বললে না কেন? এটলিস্ট উষুকে বলতে পারতে! মেয়েটা তো হার্ট এটাক করতে নিচ্ছিল।”
উষ্ণতা হাসতে হাসতে এক চোখ টিপে বলল,” আগে বলে দিলে তো মজাই শেষ হয়ে যেতো ননদী!”
প্রিয়ন্তিও হেসে ফেলল এবার। উষ্ণতার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,” আচ্ছা, তুমি কিভাবে শিউর হলে যে কিছু হবে না? প্লিজ বলো!”
” কালরাতে হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় গাড়িতেই আমি এই ব্যাপারে তৃষাণের সাথে কথা বলেছিলাম।”
” সত্যি? কি বলেছিলে? ডিটেলস বলোতো!”
বিস্তারিত- গাড়িতে বসেই উষ্ণতা কিছুটা ঘামছে। তার হাতে মোবাইল ফোন। ভলিউম কমানো বলে কথা শোনা যাচ্ছে না৷ তবে এই মুহূর্তে বিখ্যাত নিউজ পেইজ থেকে লাইভে একটা ভিডিও তার ফীডে এসেছে। সেই ভিডিও দেখেই উষ্ণতার আতঙ্ক লাগছে। তৃষাণ তার পাশে বসা। আঁড়চোখে উষ্ণতা ভ’য়ে ভ’য়ে তার দিকেই তাকাচ্ছে বার-বার। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই তৃষাণ তাকাল,” এনি প্রবলেম? সমস্যা হচ্ছে তোমার? খারাপ লাগছে নাকি উষ্ণ?”
তৃষাণ উষ্ণতার কপালে হাত রাখল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে বিচলিত গলায় ড্রাইভারকে বলল,” খলিল ভাই, এসিটা ছেড়ে দিন তো। আপনার ম্যাডামের গরম লাগছে।”
উষ্ণতা নিচু গলায় বলল,” এসি ছাড়তে হবে না। জানালাগুলো ভালো করে খুলে দাও৷ তাহলেই হবে।”
তৃষাণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে জানালা খুলতে লাগল। সে উষ্ণতার ব্যাপারে সবসময় খুব সিনসিয়ার৷ তাও উষ্ণতা তার সঙ্গে কথা বলতে একটু ভ’য়ই পায়। যেমন এই মুহূর্তে ভ’য় পাচ্ছে। কিন্তু ইয়ামিন-উষসীর কথাটা এখন না বললেই নয়। তৃষাণ ফোন খুললে নিশ্চয়ই দেখবে। তাছাড়া তার অফিসের পরিচিত কেউ যদি এই ভিডিও দেখে আর উষসীকে চিনতে পারে তাহলে নিশ্চয়ই জানাবে। অন্যকারো থেকে জানলে তৃষাণ আরও রিয়েক্ট করতে পারে৷ তাই উষ্ণতা ভাবল নিজেই বলবে। পরিষ্কার, স্পষ্টভাবে কথা বলবে।
” তুমি উষুর ব্যাপারটা নিয়ে কি কিছু চিন্তা করেছো?”
” কোন ব্যাপার?” তৃষাণ ভ্রু কুঁচকে এমনভাবে তাকাল যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। আসলেই কি বুঝতে পারছে না? নাকি সে ভাবতেও পারেনি যে উষ্ণতা এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কথা বলবে? আসলে সব জানা-জানি হওয়ার পর উষ্ণতা বা তৃষাণ একবারও এই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করেনি৷ এই প্রথম উষ্ণতা এই প্রসঙ্গে কথা বলল তাও গাড়িতে, হাসপাতাল থেকেই ফেরার পথে৷ তৃষাণ অবাক হবে এটাই স্বাভাবিক।
উষ্ণতা অকপট কণ্ঠে বলল,” আমি উষু আর ইয়ামিনের কথা বলছি। আমার মনে হয় এই সম্পর্ক নিয়ে ওরা দু’জনই খুব সিরিয়াস৷ তাই আমাদেরও এটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিৎ। ”
তৃষাণের সহজ-স্বাভাবিক মুখ গম্ভীর হতে শুরু করেছে। সেই সাথে বাড়ল উষ্ণতার হৃৎপিন্ডের লাবডুব শব্দ৷ ব্যাপারটা চরম অস্বস্তিকর তার নিজের কাছেও। কিন্তু কি করার আছে? পরিস্থিতিটাই এমন!
উষ্ণতা বলল,” এসব কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নিশ্চয়ই মা তোমাকে বলেছিলেন। আমাকেও বলেছেন৷ আসলে সুইজারল্যান্ডে ইয়ামিনও প্রিয়ন্তির বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। সেখানেই ওদের দেখা হয় তারপর এইসব কিছু। পুরোটাই ভাগ্য৷ আর ভাগ্যের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। যা হয়ে গেছে সেটা তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না৷ তাই না? এর জন্য উষুকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। ”
এটুকু বলেই থামল উষ্ণতা। তাকিয়ে রইল তৃষাণের দিকে। তার উত্তরের অপেক্ষায়৷ তৃষাণ অবশ্য কিছু বলছে না। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সামনে৷ দৃষ্টি ধারালো। কিছুটা সময় যেতেই সে থমথমে গলায় বলল,” আসলেই কি সব ভাগ্য? তোমার কি মনে হচ্ছে না এখানে প্রি-প্ল্যানড কিছু থাকতে পারে? উষসী তোমার বোন জেনেও ইয়ামিন কিভাবে ওর সাথে জড়ালো? ওর জন্য নিশ্চয়ই মেয়ের অভাব ছিল না? তাহলে আমাদের উষুই কেন? ইউ হ্যাভ টু থিংক এবাউট ইট উষ্ণ। সামথিং ইজ ভেরি ফিশি।”
উষ্ণতা মৃদু হাসল। মাথা নেড়ে বলল,” আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। আসলে তোমার মতো প্রথমে আমিও কিছুটা এমন ভেবেছিলাম। কিন্তু ইয়ামিনের সাথে দেখা হওয়ার পর সব ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”
” তোমার ওর সাথে দেখা হলো কবে আবার?” বেশ বিস্ময় নিয়ে তাকাল তৃষাণ। এই ঘটনাটা তার জন্য অপ্রত্যাশিত।
উষ্ণতা বলল,” হসপিটালেই দেখা হয়েছিল আজকে। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছিলাম৷ হঠাৎ সামনে ও চলে এলো। বিশ্বাস করো ওর সাথে কথা বলতে আমার একবারও অস্বস্তি লাগেনি। যদি লাগতো তাহলে বুঝতাম এখনও আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু আমি ফীল করতে পেরেছি যে ইয়ামিন এখন পুরো বদলে গেছে। ও এখন আমার প্রতি আগের মতো সেই ফিলিংসটা ক্যারি করে না। আর উষুর প্রতি ওর ভালোবাসাটাও আমার কাছে প্রি-প্ল্যান্ড কিছু মনে হয়নি। বরং খুবই ন্যাচরাল লেগেছে। আমি ওদের দূর থেকে একসাথে দেখছিলাম৷ কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল উষুর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কেউ হতে পারে না। এতো পারফেক্ট লাগছিল ওদের!”
” মাত্র একবার দেখাতেই এতো কিছু বুঝে গেলে?”
তৃষাণ যেন উপহাস করল। উষ্ণতা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,” তোমার ওকে এতো অপছন্দ কেন?”
” কিছুদিন আগে ও আমার অফিসে এসেছিল। সরাসরি উষসীকে বিয়ে করার কথা বলেছে। তুমি ভাবতে পারছো ওর সাহসটা? আমার তো মনে হয় এই পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে তামাশার মতো। ”
উষ্ণতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। অভিযোগের স্বরে বলল,” এই কথা আমাকে আগে কখনও বলোনি তুমি।”
তৃষাণ এবার কিছুটা নরম হলো। কৈফিয়ৎ দেওয়ার স্বরে বলল,” তুমি অসুস্থ ছিলে উষ্ণ। এইসব বলে আমি তোমাকে টেনশনে ফেলতে চাইনি৷ তুমি এমনিতেও উষুর ব্যাপারে অনেক সেন্সিটিভ৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আমিও ওর খারাপ চাই না৷ ও আমার ছোটবোন।”
” আমি জানি, উষুকে তুমি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো। ছোট থেকে ও তোমার কাছে বড় হয়েছে। তুমি ওকে অস্থি-মজ্জায় চেনো৷ তাই বলছি ওর ফিলিংস্টাও বোঝার চেষ্টা করো।”
” আমি ওর ফিলিংস অস্বীকার করছি না। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। আমিও চাই না যে ও আমার জন্য কোনো কষ্ট পাক। কিন্তু ইয়ামিনকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
” ঠিকাছে… তাহলে তুমি প্রাইভেটলি ওর সাথে কথা বলো। প্রয়োজনে ওকে টেস্ট করো। এটা তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ পারবে না।”
“আর টেস্টে যদি ও পাশ না করে?”
উষ্ণতা কিছু না ভেবেই বলল,” তাহলে তোমার যা ইচ্ছে হয়, তুমি তাই করো৷ আমিও আর কিছু বলব না।”
” প্রমিস তো?”
” হুম, প্রমিস।”
প্রিয়ন্তি চোখ পিটপিট করে তাকাল। অবিশ্বাসী গলায় বলল,” ভাইয়া এতো সহজে মেনে নিল?”
উষ্ণতা হাসি মুখে বলল,” ও আমাকে বলেছিল ইয়ামিনের সাহস পরীক্ষা করবে। তার মাথায় নকল পিস্তল ঠেকিয়ে হু’মকি দিবে। তখনও যদি সে নরমাল থাকতে পারে তাহলে ওকে। আমার মনে হয় ইয়ামিন পরীক্ষায় পাশ করেছে।”
প্রিয়ন্তি মুখে হাত রেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর বলল,” তোমরা স্বামী-স্ত্রী দু’টোই সাংঘাতিক! একেবারে হিটলার মার্কা বুদ্ধি। ইশ, ইয়ামিন-উষুর জন্য আমার মায়াই হচ্ছে। কতকিছুই না সহ্য করেছে দু’জন আজ সারাদিন। ইয়ামিন তো কালকে থেকেই টেনশনে ছিল। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, জানো?”
ফারদিন খুব বিচলিত গলায় ডাকল,” প্রিয়, প্রিয়, একটা কথা শুনে যাও প্রিয়!”
প্রিয়ন্তি এগিয়ে গেল। রুক্ষ গলায় বলল,” এভাবে ডাকছো কেন? ভূ’মিকম্প হচ্ছে?”
“অবশ্যই হচ্ছে। আমার পায়ের তলায় সত্যি ভূমিকম্প হচ্ছে।”
” মানে?”
” আরে কাজী তো নকল।”
প্রিয়ন্তি হতবাক হয়ে শুধাল,” কোন কাজী?”
ফারদিন বিপর্যস্ত গলায় বলল,” যেই কাজীকে দিয়ে গতকাল ওদের বিয়ে পড়ানো হলো। বেটা একটা বাটপার ছিল। সে বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এর আগে কখনোই কারো বিয়ে পড়ায়নি। এই মাত্র সুধীলের থেকে জানতে পারলাম।”
প্রিয়ন্তি কোমরে হাত গুঁজে কটমট করে বলল,” তোমাকে এই ফাউল লোকের সন্ধান কে দিয়েছিল?”
” সুধীলই তো দিয়েছিল। মানে আমি তো এখানে কাউকে চিনি না! ইমারজেন্সী কাজীর যোগাড় করতে গিয়ে বাটপারের পাল্লায় পড়বো এটা বুঝিনি।”
ফারদিন অসহায়ের মতো মাথা চুলকাচ্ছে। প্রিয়ন্তি ফট করে তার গালে আলতো চ’ড় মা’রল। ফারদিন চোখ বড় করে বলল,” কি হলো এইটা? আমাকে তুমি মা’রতে পারলে?”
” সিনিয়র হই আমি তোমার। এখনও যে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিইনি সেটাই ভাগ্য। গাঁধা কোথাকার!”
” এবার কি হবে প্রিয়? আমরা যে একটা ভুল করে ফেললাম৷ ভাগ্যিস ওদের বাসর-টাসর হয়নি। বাসরের পরে জানতে পারলে তো…”
” চুপ!”
ফারদিন চুপ করল। প্রিয়ন্তি ক্ষীণ স্বরে ” যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এখন ওদের ভালো করে আবার বিয়ে হবে। সবাই তো সব মেনেই গেছে। সবকিছু এমন স্মুথলি মিটে যাবে জানলে আমি তাড়াহুড়ো করে বিয়ের কথাটা ভাবতামই না।”
” কিন্তু ওই বেটা যে আমাদের সাথে বাটপারি করে এতোগুলো টাকা নিল? তাকে ধরতে হবে না?”
” থাক, তোমাকে আর দারোগাগিরি করতে হবে না! বাদ দাও।”
উষসী আর ইয়ামিন নিরিবিলিতে বসে আছে বারান্দায়। ইয়ামিনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে উষসী। তার মনের মধ্যে ভালো-লাগার শীতল স্রোত। সে বিভোর কণ্ঠে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া আপনাকে ওখানে কেন ডেকেছিল? কি বলেছে?”
“তেমন কিছু না। আমার সাহস পরীক্ষা করতে চেয়েছিল হয়তো। এজন্যই ওভাবে মেসেজ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে যেতে বলেছিল। হঠাৎ উনি আমার মাথায় পিস্তল চেপে ধরলেন।”
উষসী প্রায় আৎকে উঠল। তার স্বপ্নের দৃশ্যের সাথে মিলে যাচ্ছে ঘটনাটা। সে হতবাক চিত্তে জানতে চাইল,” তারপর? আপনি কি করলেন?”
” কিছুই না। তোমার কথা মনে করছিলাম। তখনি মনে সাহস চলে আসলো। তৃষাণ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি করতে পারি? আমি পিস্তল মাথায় থাকা অবস্থাতেই জবাব দিলাম, যেকোনো কিছু। উনি কতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আমাকে ছেড়ে দিলেন। তারপর চলে যাওয়ার আগে বললেন মাকে দিয়ে যেন তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসি। সবকিছু আনুষ্ঠানিক নিয়ম মেনে শুরু হবে।”
উষসী হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তৃষাণ ভাইয়া এই কথা বলেছে এটাই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” আমিও ঠিক এভাবেই তাকিয়েছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না নিজের কানে শোনা কথাটা। অনেকক্ষণ লেগে গেছিল নিজেকে সামলাতে। ওখান থেকে বের হয়েই মোবাইল সুইচড অন করলাম। তারপর মাকে ফোন করলাম। মা বলল এখানে চলে আসতে। তুমি নাকি দুশ্চিন্তায় সবাইকে পাগল করে দিচ্ছো!”
উষসী হাসল। মুখে হাত চেপে আবেগ সামলালো। ইয়ামিন প্রশান্ত গলায় বলল,” বলেছিলাম না, সব ঠিক হয়ে যাবে? আমরা খুব দ্রুত একসাথে থাকব!”
” আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে জীবনটা সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন।”
ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটে চু’মু দিয়ে বলল,” আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন তুমি।”
সাল ২০৪৩। একটি বৃষ্টিময় সকাল। ধূসর মেঘে গুমোট আকাশ গর্জন করছে থেকে থেকে। প্যারিসের একটি উঁচু ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাজ তৃষ্ণা। তার হাতে ইলেকট্রনিক ছাতা। সে ছাতার বাতাসে শুকাচ্ছে নিজের ভেজা শার্ট। ঘণ্টাখানেক ধরেই সে দাঁড়ানো। রাগে কপালের নীলাভ শিরা ফুলে উঠেছে। অপেক্ষা করে একটুও অভ্যাস নেই তার। অথচ একটা ‘ম্যানারলেস’ এর জন্য রোজ তাকে অপেক্ষা করতে হয়!
এখনও নামছে না ইয়াসী। হাতে লাগানো স্মার্ট আইওয়াচ টিপে ফোন করল সে। ক্লাসে বসেই বোধ হয় ফোনটা রিজেক্ট করে দেয় ইয়াসী। তৃষ্ণার মেজাজ আরও চড়ে যায়। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে সে? রাগে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মেসেজ লিখল,” আমাকে কি তোর বাপের আমলের চাকর পেয়েছিস? দ্রুত আসতে হয় তো আয়। নয়তো আমি গেলাম।”
রিনিঝিনি কণ্ঠে ভয়েস মেইল এলো ,” চাকরই তো তুমি। ফরমালি যাকে বলা যায় বডিগার্ড! আর দশমিনিট অপেক্ষা করো, ওকে? নামছি আমি।”
তৃষ্ণা আশ্চর্য হলো। ক্লাসে বসে ভয়েস মেইল কিভাবে পাঠাচ্ছে ইয়াসী?এর মানে সে ক্লাস থেকে বের হয়েছে অনেক আগেই। তবুও নামছে না কেন? তৃষ্ণা বিড়বিড় করে ক্রোধ প্রকাশ করল,” মিথ্যাবাদী! আমার সাথে নাটক? একদম বাপের মতো হয়েছে। ম্যানারলেস কোথাকার!”
ইয়াসীর চোখে ইলেকট্রনিক লেন্স চশমা। সে জানালা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তৃষ্ণার কপালের ভাঁজ গোণার জন্য জুম করছে বার-বার৷ এই ছেলেটাকে রাগাতে তার এতো ভালো লাগে আজ-কাল! ওই পাশ থেকে সোফিয়া বলল,” অনেক হয়েছে ইসু, এবার নাম৷ ভাইয়ার ধৈর্য্য লিমিট ক্রস করলে কিন্তু সত্যি চলে যাবে।”
ইয়াসী এবার ভ’য় পেল একটু। তৃষ্ণার যা রাগ! সত্যি চলে যেতেও পারে। সে বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা, আমি নামছি। রাখি এখন সফু। বায়।”
ইয়াসীকে নামতে দেখে তৃষ্ণা একটা কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে যেতে লাগল। পকেটে হাত গুঁজে পুরো রাস্তায় ঘুরছে সে। জুতোর যান্ত্রিক চাকা বের করে রাস্তাজুড়ে স্কেটিং করে সামনে এগুচ্ছে। এই ধরণের জুতোয় খুব দ্রুত দূরত্ব অতিক্রম করা যায়। ইয়াসী দৌড়েও তৃষ্ণাকে ধরতে পারছে না।
” আরে, থামো প্লিজ। তুমি তো খুব খারাপ! ইচ্ছে করে এমন করছো তাই না যেন আমি তোমাকে ধরতে না পারি? আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে খুব তাই না?”
তৃষ্ণা গম্ভীর গলায় বলল,” আমি আর বেশিদিন এখানে নেই। নেক্সট মান্থ মম-ডেড এর কাছে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাচ্ছি।”
ইয়াসী মনে মনে কিছুটা আহত হলো। কিন্তু ভেতরের আবেগ প্রকাশ না করে বেশ সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল,” তাই? খুব ভালো তো। কিন্তু হঠাৎ কেন?”
” তোর বাবার জন্য।”
” আমার বাবা? এখানে আমার সুইট ফাদার কিভাবে এলো? সে কি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে?”
তৃষ্ণা একটা হতাশাময় নিশ্বাস ছাড়ল। উপহাসের কণ্ঠে বলল,” তাড়াচ্ছে না। কিন্তু যা শুরু হয়েছে… তাতে এখানে থাকাও সম্ভব না।”
” কেন সম্ভব না? কি শুরু হয়েছে?”
ইয়াসী তৃষ্ণার গা ঘেঁষে দাঁড়াল৷ তার চোখের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করল।
তৃষ্ণা একটু দূরে সরে বলল,” তোর এইসব স্বভাবের জন্যই তো। এই তোর কি বন্ধু-বান্ধব নেই? আমি তোর কয়বছরের বড় জানিস? সারাক্ষণ আমার সাথে চলা-ফেরা করিস বলেই ইয়ামিন আঙ্কেল ভাবছে আমি বুঝি তোর সাথে ডেইট করছি। ছি, যে কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না সেই কথা উনি কিভাবে ভাবলেন আমার মাথায় আসে না! ন্যারো মাইন্ডেড পিপল!”
লজ্জায় প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল ইয়াসী। কয়েক মুহূর্ত ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল সে। না কোনো কথা বলতে পারল আর না একটু নড়তে পারল। তৃষ্ণা অনেক দূর এগিয়ে গেছে ততক্ষণে। ইয়াসীর অনুপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে তাকাল সে। তারপর অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ডাকল,” কিরে, আসবি না? স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন?”
ইয়াসীর সম্বিৎ ফিরল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত হেঁটে এলো সে। যান্ত্রিক জুতোর চাকা বের করে স্কেট করতে লাগল। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেই তার ভালো লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে মন চাইছে।
তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে বলল,” কিছু বললি না যে? তোর বাবা শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করছে। মুখে না বললেও আমি সেটা বুঝতে পারি। তোর উচিৎ ক্লিয়ারলি উনার সাথে কথা বলা। নাহলে উনি কি-নাকি ভাববে আল্লাহ মালুম।”
ইয়াসী অভিমানে পূর্ণ কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার বাবাকে ন্যারো মাইন্ডেড বলেছো কেন?”
তৃষ্ণা একটু নরম গলায় বলল,” স্যরি, কিন্তু আর কি বলব? তুই আমার কাছে সোফিয়ার মতো। আর উনি আমাদের নিয়ে কিসব চিন্তা করছেন! ছি, ছি!”
ইয়াসী তার ছাতাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। চোখের পানি আড়াল করার জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর নেই বোধহয়। তৃষ্ণা ধমক দিয়ে বলল,” কি করছিস স্টুপিড? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাবি নাকি?”
” আমার ভিজতে মন চাইছে। তোমার কোনো প্রবলেম?”
” না, আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমি আর এখানে আছিই কয়দিন? সর্বোচ্চ একমাস! তারপর তোরা বাপ-মেয়ে যা ইচ্ছা কর, আমার কিছুই যায়-আসে না, হুহ।”
ইয়াসী নিজের মুখ মুছল। অর্থাৎ চোখের জল মুছল। তারপর দুইহাত মেলে দিল। সর্বোচ্চ গতিতে স্কেট করছে সে। মনে হচ্ছে যেন এখনি আকাশে উড়ে যাবে। তৃষ্ণাকে সে ভালোবাসে। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে! এই কথাটাই নিজের বাবাকে জানিয়েছিল কিছুদিন আগে। কারণ তৃষ্ণার বয়স প্রায় ত্রিশ। তার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।
ইয়াসীর মা মিসেস উষসী কোমরে আঁচল বেঁধে নেমেছেন উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান করতে। অথচ নিজের বিশ বছর বয়সী আস্তো যুবতী মেয়েটিকে চোখে দেখছেন না৷ প্রতিদিন একটা ভ’য়ে ভ’য়ে থাকতে হয় ইয়াসীকে। সকালে তার ঘুম ভাঙে ভ’য় নিয়ে৷ রাতে ঘুমাতেও যায় ভ’য় নিয়ে। এই বুঝি তৃষ্ণার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তারই চোখের সামনে অন্য একটা মেয়ে এসে তার কিশোর বয়সের প্রেমকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে! এই নিষ্ঠুরতা সে দেখতে পারবে না।
মায়ের থেকেও বাবার সাথে ইয়াসী বেশি মিশুক। তাই বাবাকেই মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাবাই যে এভাবে তার শত্রু হয়ে যাবে তা কে জানতো? ঠিকই কৌশল করে তৃষ্ণাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। উফ, ইয়াসীর মনটা আকাশের কালো মেঘের মতোই বিষণ্ণতার অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে।
তৃষ্ণা হঠাৎ বলল,” আমার কি মনে হয় জানিস? পুরো ব্যাপারটাই হিস্টোরিক্যাল।”
” হিস্টোরিক্যাল মানে?” চমক নিয়ে তাকাল ইয়াসী। সে তৃষ্ণার কথার সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না।
তৃষ্ণা ভাবুক স্বরে বলল,” হিস্টোরিক্যাল মানে পাস্ট হিস্ট্রির কথা বলছি। খালামণি আর আঙ্কেলের বিয়ের আগের ঘটনা।”
ইয়াসী দুষ্টমি করে বলল,” তুমি নাকি ছোটবেলায় আমার মাকে এন্টস বলে ডাকতে? এখনও সেটাই বলো না! আমি একটু শুনি।”
” শাটআপ। কথার মাঝখানে বামহাত ঢুকাবি না। যা বলছি তা মনোযোগ দিয়ে শোন।”
” ওকে, ওকে।” ইয়াসী মুখে কুলুপ আঁটল।
তৃষ্ণা বলল,” ইয়ামিন আঙ্কেল আসলে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। তার আমাকে নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। আসল প্রবলেম হচ্ছে আমার বাবা।”
” তোমার বাবা? মানে বড় খালুজান? উনাকে নিয়ে বাবার আবার কি প্রবলেম? বড় খালুজান তো বাবাকে খুবই ভালোবাসে!”
তৃষ্ণা একটু বাঁকা হাসল। কোমরে হাত রেখে বলল,” তুই কি বুঝবি দুইদিনের গেন্দা বাচ্চা? কেয়ামত তো দেখেছিলাম আমি। তখন তোর পয়দা হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না। কারণ তোর বাবা আর মায়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছিল আমার ডেড-এর ডিসিশনের উপর।”
ইয়াসী খুব আগ্রহী কণ্ঠে বলল,” আরে, এই ব্যাপারে তো সেদিন প্রিয়ন্তি আন্টিও কথা বলছিল। বিয়ের জন্য নাকি বাবা আর মাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। প্লিজ একটু ডিটেলস বলো না তাদের গল্পটা। আমি শুনতে চাই!”
তৃষ্ণা বিরক্তি নিয়ে তাকাল। রুক্ষ মেজাজ নিয়ে বলল,” আমার এতো সময় নেই। তাছাড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতোবড় ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে গেলে সন্ধ্যা নেমে আসবে। কোনো হলিডে’তে বলবনে। এখন বাদ দে।”
” প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ! চলো আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। তোমাকে ট্রিট দিবো প্রমিস।”
তৃষ্ণা একটু ভাবল। ঠোঁট কামড়ে বলল,” ক্ষুধা তো লেগেছে… আচ্ছা চল। কিন্তু বেশি জ্বালাবি না। আমিও এতোকিছু জানি না। তখন আমার মাত্র নয়বছর বয়স। আর সোফিয়া তো বাচ্চা। জন্ম নিয়েছিল মাত্র।”
ইয়াসীর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটল। আরও কিছুটা সময় তৃষ্ণার সাথে কাটাতে পারবে ভেবেই খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,” ইয়ে!”
আটশো দশ তলা ভবনের একটি আধুনিক রেস্তোরাঁয় বসে আছে তারা। এখানে মানুষের অস্তিত্বটুকুও নেই। রোবট আর লেন্স ক্যামেরা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জায়গাটা। এখন আর কেউ লেবারের কাজ করে না। প্রায় সব মানুষই শিক্ষিত। তাই ওয়েটারের মতো ছোট-খাটো কাজের জন্য রোবটই ভরসা! তারা বাটন চাপতেই রোবট হাজির হলো। যান্ত্রিক কণ্ঠে তাদের আমন্ত্রণ জানাল। ইয়াসী নিজের পছন্দমতো খাবার অর্ডার করল। তারপর তৃষ্ণার দিকে চেয়ে শুধাল,” কি খাবে?”
তৃষ্ণা মেন্যু দেখেই বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিন্তু খুব স্বাস্থ্য-সচেতন হওয়ার কারণে
সে বুঝতে পারছে না কোনটা নেওয়া উচিৎ। এমন কি আছে যাতে পেট ভরবে কিন্তু ক্যালরি বাড়বে না?
ইয়াসী যেন ঠিক তার মনের কথা বুঝেই বলল,” ভেজিটেবল আর চিকেনের এই ক্রিম সালাদটা নিতে পারো। এতে তোমার পেট ভ’রে যাবে আর ফ্যাটও নেই তেমন।”
” আমিও তাই ভাবছিলাম।”
তৃষ্ণা মেন্যুবুক রেখে হাসিমুখে ইয়াসীর দিকে তাকাল। মাঝে মাঝে ইয়াসী তাকে খুব চমকে দেয়। এমনভাবে তার মনের কথা বুঝে ফেলে যে সে আশ্চর্য হয়ে যায়। ব্যাপারটা সুন্দর! সিয়াও যদি এইভাবে বুঝতো তাহলে হয়তো তাদের ব্রেকাপ হতো না।
” আচ্ছা, সিয়া আপুর সাথে তোমার ব্রেকাপ কেন হয়েছিল?”
তৃষ্ণা মুখে কফি নিয়েও কেশে ফেলল। রূঢ় বাচ্যে বলল,” সেটা জেনে তুই কি করবি?”
ইয়াসী মুখ ভোঁতা করে বলল,” স্যরি। এতো রাগ করার কি আছে? বলবে না বললেই হয়।”
” যেটা বলতে এসেছিলাম সেটা শোন। খালামণি আর ইয়ামিন আঙ্কেলের গল্প।”
ইয়াসী মনোযোগী শ্রোতার মতো গালে হাত ঠেকালো। বাবা-মায়ের গল্প শোনার আগ্রহে তার চোখ ঝলমল করছে। তৃষ্ণা বলতে শুরু করল এখন থেকে প্রায় বিশ বছর আগের অতীত।
২৯শে মে, ২০২৩( বাংলাদেশ)
উষসী ড্রাইভ করছে উৎফুল্লচিত্তে। এখন বর্ষাকাল চলছে। ভেজা রাস্তা পরিষ্কার, স্নিগ্ধ। মিউজিকে বাজছে ইয়ামিন ইব্রাহীমের গান। উষসী তন্ময় হয়ে শুনছে প্রিয়তমের কণ্ঠস্বর। তীব্র আবেগে তার চোখ থেকে বাহিত হচ্ছে অশ্রুধারা। আজ তার জীবনের সবচেয়ে বিশেষ একটা দিন। এতোটাই বিশেষ যে সে একাই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়েছে দীর্ঘ যাত্রায়। তার গন্তব্য ঢাকা থেকে সিলেটের দিকে।
সিলেটে ইয়ামিনের একটা কনসার্ট আছে। গতবার যখন ইয়ামিন সিলেটে কনসার্টে এসেছিল তখনি তাদের প্রথম দেখা হয়। তখন শীতকাল ছিল আর এখন বর্ষাকাল। আরেকটা পরিবর্তন হলো তারা এখন বিবাহিত।
হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় বসে আছে কাঠের চেয়ারে। একটু পর ইয়ামিন ইব্রাহীম আসবেন, স্টেজ মাতাবেন। উষসীও জনতাদের মাঝে বসে অপেক্ষা করছে। ইয়ামিন গিটার হাতে স্টেজে উঠতেই শোরগোল পড়ে গেল চারদিকে। আলোড়িত হলো পরিবেশ। উষসী নিশ্চুপ বসে আছে। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছে তার স্বামীকে। সবার করতালির শব্দে মনের মধ্যে আন্দোলিত হচ্ছে খুশির ঢেউ।
ইয়ামিন গান শুরু করল,” ভালোবাসবো বাসবোরে বন্ধু… তোমায় যতনে..”
উষসী চোখ বন্ধ করে শুনছে একমনে। কখন যে কনসার্ট শেষ হয়ে যায় আর দর্শক সারিতে সে একাই বসে থাকে তা যেন খেয়াল নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, চারদিক সুনশান নীরব। অনম তার পাশে এসে দাঁড়াল। চমকিত গলায় বলল,” আরে ম্যাডাম, কখন এসেছেন? স্যারকে আমি এখনি ইনফর্ম করছি দাঁড়ান…”
উষসী তাকে থামিয়ে বলল,” লাগবে না। আমি তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি অনম ভাই। আপনি রুম নাম্বারটা বলুন, আমি নিজেই চলে যাচ্ছি।”
” ওকে ম্যাডাম।”
ইয়ামিন গায়ের ব্লেজারটা খুলে রাখছিল। পেছন থেকে উষসী এসে ধরল। ইয়ামিন চমকে তাকাল। উষসীকে দেখতে পেয়ে হতভম্ব চিত্তে শুধাল,” তুমি কখন এলে?”
” সারপ্রাইজ!”
ইয়ামিন হেসে উষসীকে জড়িয়ে ধরল,” মিস করছিলাম খুব। আসার আগে আমাকে জানাতে পারতে। একাই এসেছো নাকি? তোমার সাথে আর কেউ নেই।”
” উহুম। বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছি।”
ইয়ামিন হাসবে নাকি রাগ হবে বুঝতে পারছে না। উষসীর মায়াবী হাসিমুখের দিকে চেয়ে রাগ করতে ইচ্ছে হলো না। শুধু বলল,” আহমেদ ভাইকে নিয়ে আসলেও পারতে।”
” বললাম না পালিয়ে এসেছি? সত্যি সত্যি পালিয়ে এসেছি কিন্তু। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?”
” তোমার বাচ্চামি আর গেল না উষু।”
উষসী লাজুক মুখে বলল,” প্রায় ছয়মাস আগে আমার ভার্সিটিতে এসে জনসম্মুখে যে আমাকে প্রপোজ করেছিলে সেই কথা মনে আছে?”
” মনে থাকবে না কেন?”
” কি যেন বলেছিলে?”
ইয়ামিন মুখস্তের মতো আওড়াল,”সুর আর রঙের চেয়েও আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি হলো আমার উষসী আর তার হাসি। সে হাসবে বলে আমি হাজারও পাগলামি সারাজীবন করে যেতে পারি। তার খুশির জন্য আমি এক পৃথিবী সুখ তার মুঠোয় এনে দিতে পারি। উষসী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। চলো বিয়ে করি এবার! অনেক তো হলো, এবার সারাজীবনের জন্য তোমার হাত ধরতে চাই আমি। সেই অধিকার কি আমাকে দিবে?”
উষসী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খুশিতে ঝলমল করছে তার চেহারা। সে ভাবেওনি এতোদিন পরেও ইয়ামিন কথাগুলো ঠিক একইভাবে মনে রাখবে৷ সে প্রসন্ন কণ্ঠে বলল,” প্রপোজের অফারটা কি এখনও ভ্যালিড আছে ইয়ামিন ইব্রাহীম?”
ইয়ামিন আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল,” জ্বী আছে লামিয়া ইমরোজ উষসী। আপনার জন্য এই অফারের ভ্যালিডিটি লাইফটাইম।”
উষসী ফিক করে হেসে ফেলল। ইয়ামিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” কংগ্রাচুলেশনস, ইয়ামিন ইব্রাহীম। আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। এই সুসংবাদ দেওয়ার জন্য ২৩৫ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে এসেছি। এখন বলুন, আমাকে কি গিফট দিবেন?”
ইয়ামিন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এমন অপ্রত্যাশিত সুখবরে শুনে প্রায় নির্বাক হয়ে গেছে সে। কতক্ষণ পর উষসীর কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে উপরে তুলল। তারপর ভরাট কণ্ঠে চিৎকার করল,” ইয়াহু! আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি সেটা এক্সপ্লেইন করতে পারব না উষুফুল! এতোবড় গুড নিউজ শুনে কি উপহার দিতে হয় তাও আমার জানা নেই। আ’ম স্যরি। কিন্তু আমি খুব, খুব খুশি, সত্যি খুব খুশি।”
ইয়ামিন হাঁপাচ্ছে, বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। উষসীর গালে, নাকে, কপালে হড়বড় করে কয়েকটা চু’মু দিয়ে ফেলল। উষসী টলমল চোখে তাকিয়ে দেখছে ইয়ামিনের অস্থিরতা। একটু পর বলল,” কোনো গিফট লাগবে না। শুধু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন তো, তাহলেই হবে।”
উষসী দুইহাত মেলে দিল। ইয়ামিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। বাইরে বর্ষণ শুরু হয়েছে। ভেতরেও আবেগময় বর্ষণ। বিশেষ অতিথির আগমনী বার্তায় তারা তুমুল আনন্দে উচ্ছ্বসিত! তাদের মন-প্রাণ প্রবল ভালোবাসার অনুভূতিতে সিক্ত!
২০৪৩( প্যারিস)
“হোয়াট আ গ্রেইট লভস্টোরি! সো ট্র্যাজিক, সো ইমোশনাল! ইশ, এতো বাঁধার পরেও তারা এক হতে পেরেছিল। তাহলে আমরা কেন পারব না?”
বিমুগ্ধ চিত্তে কথাটা বলেই ইয়াসী জীভ কাটল। তৃষ্ণা অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,” আমরা মানে? তুই কাউকে ডেইট করছিস নাকি?”
ইয়াসী থতমত খেল একটু। আমতা-আমতা করে বলল,” হ্যাঁ… করছি। তাতে তোমার কি? কোনো প্রবলেম?”
তৃষ্ণা মাথা নিচু করে একটু তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” আমার কেন প্রবলেম থাকবে? বরং আমার তো মায়া হচ্ছে তোর বয়ফ্রেন্ডের জন্য। বেচারা! তোর মতো পাগলকে সামলাতে তাকে কত কষ্টই না করতে হয়।”
ইয়াসী চোখ সরু করে বলল,” তুমি একটা… আই হেইট ইউ।”
” সেইম টু ইউ।”
তৃষ্ণা সময় দেখে উঠে দাঁড়াল। ইলেকট্রনিক ছাতা হাতে তুলে নিয়ে বলল” অলরেডি দুইঘণ্টা শেষ। এখন না উঠলে সত্যি সন্ধ্যা হয়ে যাবে। চল।”
গালে হাত রেখে কয়েক মুহূর্ত বসে রইল ইয়াসী। তার পিয়াসী মন ক্ষণে ক্ষণেই হতাশায় ভরে উঠছে। এ জন্মে বোধহয় তার প্রেম হবে না। ওই নাক উঁচু, রুক্ষ স্বভাবের নির্বোধ মানব জীবনেও তার ভালোবাসা বুঝবে না। রোবট পেমেন্ট বুক নিয়ে এসেছে। যান্ত্রিক স্বরে সে বিলের এমাউন্টের হিসাব দিচ্ছে। উষসী রোবটের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,” তোদের হৃদয় বলতে কিছু নেই তাই না? তোদের মতো আরেকজন আছে। ওইযে, শাহবাজ তৃষ্ণা। ওই লোকটিরও হৃদয় বলতে কিচ্ছু নেই। হুহ!”
মানি ট্রান্সফার করে উঠে দাঁড়াল ইয়াসী। তৃষ্ণা হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতো। তাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু হাঁটছে ইয়াসী। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। স্নিগ্ধ বাতাসের ঘ্রাণ মিশে আছে পরিবেশে। তৃষ্ণার মাথার ব্রাউনিশ চুলগুলো মৃদু বাতাসের তালে উড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধতায় বুদ হয়ে যাচ্ছে ইয়াসী। ঠিক এভাবেই পাশাপাশি হেঁটে সে কাটিয়ে দিতে রাজি পুরো একটি জীবন!
সমাপ্ত।