তুমিময় নেশা পর্ব-০১

0
212

#তুমিময়_নেশা
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

পাত্রের ছোট ভাই কে প্রপোজ করে দিল অদ্রিতা। বিস্ময়ে হতবাক বাড়ির লোক। কিছুক্ষণ আগেই ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে অদ্রিতাকে। এর ই মাঝে এমন কান্ড করে বসবে মেয়েটা, কেউ কল্পনা ও করে নি।
পাত্র পক্ষের চোখ মুখ করুণ দেখাচ্ছে। লজ্জায় টলমল করছে পাত্রের ছোট ভাই। বড়ো ভাইয়ের জন্য দেখতে আসা মেয়েটা এভাবে প্রপোজ করে দিবে তা ধারণার বাইরে। অদ্রিতার বাবা এক গাল হেসে মেয়ে কে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। অদ্রিতার ভাব খানা এমন যেন কিছু ই হয় নি! বরং ডাইনিং থেকে নাসপাতি নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। মেয়ের এমন কান্ডে চোটে গেলেন লুবনা। মুজাহিদ শেখ কোনো মতে অতিথি বিদেয় করলেন। লজ্জায় ওনার নাক কাটা গেছে।

“অদ্রি অদ্রি বের হ রুম থেকে। আজ তোর একদিন আর আমার একদিন। অনেক বেড়ে গেছিস। আজ তোর পিঠে খুন্তি ভা ঙ ব। শ য় তা ন মেয়ে।”

“আহ লুবনা তুমি থামবে।”

“দেখো, মেয়ের হয়ে একদম সাফাই গাইবে না বলে দিচ্ছি। তোমার আস্কারা পেয়েই এত সাহস হয়েছে ওর।”

বাবা মায়ের কথা শুনে বের হয়ে আসে অদ্রিতা। হাতে আধ খাওয়া নাসপাতি।
“কি হয়েছে আম্মু? এত চিৎকার করছো কেন? বাসায় কি ডাকাত পড়ল নাকি?”

“ব দ মা শ মেয়ে। আজ তোর ঠ্যাং ভা ঙব। লাজ লজ্জা বলে কিচ্ছু নেই। শেষ মেশ পাত্রের ছোট ভাই কে প্রপোজ করে ফেললি!”

“লুবনা তুমি থামবে। আমার মেয়ের কোনো দোষ নেই এতে।”

“তুমি চুপ করো। মেয়ের কোনো দোষ নেই। মান সম্মানের কিছু রেখেছে আজ?”

অদ্রিতা মুখ চেপে হাসল। নাসপাতিটা টেবিলে রেখে বলল,”বলেছিলাম না তোমায় এই সব পাত্র দেখা বন্ধ করো। তুমি শুনেছ আমার কথা? শোনো নি তো? আমি কেন শুনব তোমার কথা?”

“হ্যাঁ তাই তো। অদ্রি মামুনি একদম ঠিক বলছিস। আমি তোকে ফুল সাপোর্ট করছি।”

লুবনা ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলেন। কপালে হাত রেখে বললেন,”আমার পো ড়া কপাল। বাপ বেটি তে মিলে আমার হাড় মাস কালি করে দিল। এত ভালো পাত্র এসেছে আর এরা পায়ে ঠেলে দিল!”

খুন্তি হাতে চেঁচামেচি করতে লাগলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট একই বুলি আওড়ালেন। বাবা মেয়ের দিকে র ক্ত চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে তারপর ই কিচেনে চলে গেলেন।

মুজাহিদ হো হো করে হেসে উঠলেন। অদ্রিতা ও হাসতে লাগল,বাবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে নিল। মুজাহিদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”যাই বলিস না কেন আজ কিন্তু একদম ই ঠিক করিস নি।”

“কি করব আব্বু? এরা তো আজ ফাইনাল ডেট দিয়েই যেতেন।”

“তাই বলে এমন করবি? তোর মামা প্রচন্ড রেগে আছেন। যাওয়ার আগে ফ্যাচফ্যাচ করেছেন।”

“ধ্যাত রাখো তো মামার কথা। আমি টাইট দিব দেখবে সোজা হয়ে যাবে।”

মুজাহিদ মৃদু হাসলেন। মেয়েটা অবুঝ। মধ্য বিত্ত ফ্যামিলির মেয়েরা একটু বড়ো হলেই মানুষের কাছে দৃষ্টি কটু হয়ে উঠে। তাদের নানা দিকে বুঝে শুনে চলতে হয়। না হলে চুন থেকে পান খসলেই কেচ্ছা রটে যায়।

এই তো কিছু দিন আগের ঘটনা। অদ্রিতার ই ক্লাস মেট লিজা। মেয়েটা পড়াশোনা তে বেশ ভালো। মধ্য বিত্ত ফ্যামিলির হাসি খুশি মেয়ে। এডমিশন টেস্ট এর জন্য কোচিং করে রোজ। একদিন কোচিং এ বয়ফ্রেন্ড আসে। তাদের মাঝে রাগারাগি চলছিল। ওরা নিজেদের মাঝে মিট মাট করতে থাকে। রাগারাগি মিটে যাওয়ায় ছোট্ট করে সেলিব্রেশন করতে ক্যাফতে যায়। এলাকার কিছু বদ্ধ মতিষ্ক যুক্ত মানুষের চোখে পড়ে সেটা। ব্যাস হয়ে গেল। মেয়েটা কে বে শ্যা অবধি বলে দিয়েছে! ও নাকি ছেলেটার সাথে আলাদা এক রুমে সময় কাটিয়েছে। আর ও বিশ্রী কিছু ভাষা। তাই মেয়েটার বাবা মা জোড় করেই অন্য ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। না হলো পড়াশোনা আর না হলো প্রেমিকের সাথে ঘর। আর সেই থেকেই লুবনা ভয়ে আছেন। যদি তার মেয়েটা কোনো ভুল করে বসে। কি করে সমাজে মুখ দেখাবেন? মধ্য বিত্তদের আর যাই হোক, সমাজের ভয়টা একটু বেশি।

“দেখো আপা অদ্রি কিন্তু অনেক বাড়ছে। দুলাভাই অতি আদরে মাইয়াটারে বাঁদর বানাইছে। এখনো সময় আছে মাইয়া বিদায় করো। না হলে কোনো অঘটন করে ফেলব।”

“আহ বাবলু থাম একটু। জানি অদ্রি একটু বাঁদর, ছেলে মানুষ তবে আজে বাজে কাজ কখনোই করবে না।”

“আপা সময় গেলে বুঝবা। মেয়ের নামে কোনো কেচ্ছা নাই। এখনই বিদেয় করার সঠিক সময়।”

মুজাহিদ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মেয়ের নামে কথা গুলো হজম করে নিলে ও বেশ রাগ হলো। মামার দায়িত্ব পালন না করে পাড়া প্রতিবেশীর দায়িত্ব পালন কেন করছে? সমালোচনার জন্য পাড়া প্রতিবেশীর কি অভাব আছে?

“বাবলু অনেক তো হলো। বোনের কানটা তো পঁচিয়ে ফেলেছ। নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল আছে?

“দুলাভাই!”

“থামো তো তুমি। বাবলু তুই আমার সাথে আয়। রাতে খেয়ে যাবি কিন্তু।”

মুজাহিদ হাসলেন। মানুষ বিচিত্র রঙের প্রাণী। নিজের ঘরের ঠিক নাই অন্যের ঘরে এসে আ গু ন লাগায়। বাবুলর মেয়েটা তো অদ্রি’র ও ছোট। এই ছোট বয়সে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে কি লাভ টাই বা হলো? সেই তো সংসারে ঝামেলা আর ঝামেলা। মাঝ খান থেকে মেয়েটার জীবন নষ্ট।

বিকেলের ঘটনা। অদ্রি স্কুল থেকে এসে বলল,”আপা এই আপা।”

“হুম। কি হয়েছে বল?”

“তুই কি করে প্রপোজ টা করলি রে? আমার তো সাহস ই হবে না।”

“সাহস থাকতে হয়।”

“ইস কেন যে আজ স্কুলে গিয়েছিলাম। সিনেমা টা মিস হয়ে গেল।”

বিছানায় বালিশ দুটো রেখে অদ্রি গম্ভীর দৃষ্টি তে তাকাল। সেতুর কান টেনে দিয়ে বলল,”তোর না সামনে পরীক্ষা? পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমার সাথে মশকরা করছিস?”

“আহ আপা! ব্যথা পাচ্ছি তো।”

“পড়তে বস। না হলে আম্মু কে গিয়ে বলব আমার জন্য নয় এখন থেকে তোর জন্য যেন পাত্র দেখে। বিয়ের পাখনা গজিয়েছে।”

“আমি তো এক পায়ে রাজি।”

“সেতু!”

অদ্রিজার ধমকে নুয়ে গেল মেয়েটা। টেবিল থেকে বই নিয়ে স্টাডি রুমে চলে গেল। ফোঁস করে দম ফেলল অদ্রিজা। কিছু দিনের মাঝেই এডমিশন নিতে হবে। অথচ মায়ের পাত্র দেখা দেখি শুরু হয়ে গেছে। আচ্ছা বাবা কি পড়া শোনা তে সাপোর্ট দিবেন?

সকাল সকাল বেশ মেজাজে আছেন লুবনা। মায়ের এমন মিষ্টি আচরণে খটকা লাগছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি তে লুবনার দিকে তাকিয়ে আছে সেতু। তার পরিষ্কার মস্তিষ্ক বলছে আপার বারো টা বাজতে চলেছে।
“কি হয়েছে খাচ্ছিস না কেন?”

“না মানে আপা এলে খাব।”

“আচ্ছা। তাহলে এটা রেখে দে অদ্রি এলেই না হয় গরম গরম পরোটা ভেজে দিব।”

মায়ের এমন নরম আচরণে সেতু হা হয়ে গেল। বাবা ফাইল হাতে কাজ করছেন। টেবিল জুড়ে হরেক রঙের ফাইল। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জন্মের পর থেকেই বাবা কে ফাইলের গোডাউনে বসে থাকতে দেখেছে । তাই বিষয়টা স্বাভাবিক। মুজাহিদ একটা ব্যাংকে চাকরি করেন আজ ষোলো বছর।
আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বেতন কম হওয়াতে ছেড়ে দিয়েছেন।

মুজাহিদের সামনে চা এগিয়ে দিলেন লুবনা। লুবনার হাতের চা অত্যন্ত বিষাদ ময়। কারণ অতিরিক্ত চিনি দেন চায়ে। মুজাহিদ তবু ও চা টা নিল। গত বাইশ বছর ধরে এই সরবত চা ই পান করে যাচ্ছেন। কখনো রাগা রাগি করেন নি। বরং সব সময় প্রশংসা ই করেছেন। মুজাহিদ চায়ের কাপে চুমুকু দিলেন। আজ ও বললেন,”চা টা ভালো হয়েছে খুব।”

লুবনা একটু হাসলেন। মুজাহিদের পাশে বসে মিষ্টি কণ্ঠে বললেন,”বাবলু যে সমন্ধটা এনেছিল,ঐ যে পাত্রের ছোট ভাই শুভ।”

“তো?”

“ওরা ওদের ছোট ছেলের জন্য ই অদ্রি কে পছন্দ করেছেন। আমি না তোমাকে না বলেই হ্যাঁ বলে দিয়েছি।”

মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকালেন। একটু সময় নিয়ে ভাবলেন। কিছু বলবে তার আগেই অদ্রিতার কণ্ঠ ভেসে এল।
“মানা করে দাও। আমি এই সব বিয়ে তে রাজি নই।”

টিউশনি পড়িয়ে সদ্য বাইরে থেকে আসা ঘামে ভেজা অদ্রির শরীর কাঁপছে। এক কথা বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত ও।

“অদ্রি ঘরে যা। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলছি।”

“তুমি তো আমার বিষয় নিয়েই বলছো মা? আর কত বার বলব আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আব্বু…..”

“চুপ। তোর আব্বু আমায় কি বোঝাবে? ছেলে কুয়েত থাকে। তুই নির্লজ্জ মতো কাজ করেছিস তারপর ও তারা তোকে বউ হিসেবে চায়। তোর জন্য বড়ো ছেলে কে বাদ দিয়ে ছোট ছেলেকেই বিয়ে করাতে চায় আর তুই নাকোচ করছিস?”

“শোনো আম্মু আমি এই বিয়ে করব না। ছেলে কে কি করে এই সবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। ওনারা বেহায়া না হলে আবার আসতেন না।”

“অদ্রি!”

মুজাহিদ আহ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। মা মেয়ের মাঝে যেতে চাইছিলেন না ওনি। তবু ও যেতে হচ্ছে।
“অদ্রি মা।”

“আব্বু তুমি অন্তত বিয়ের কথা বোলো না।”

অদ্রির কথায় অসহায় ভাব। চোখে পানি চিক চিক করছে। মুজাহিদ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললেন,”তুই যা বলবি তাই হবে।”

লুবনা রেগে গেলেন। হাতে থাকা গ্লাসটা ধুম করে টেবিলে রাখলেন। চোখে পানি নিয়ে চেঁচাতে লাগলেন,”আমার আর কি? আমি এই সংসারের কে? কোনো মূল্য আছে আমার কথার? যা ইচ্ছে তাই কর। কিচ্ছু টি বলব না। বাপ মেয়ে তে আমার মাথা টা চিবিয়ে খেল। আমি ও দেখব কতো দিন বিয়ে না করিস তুই।”

অদ্রিতা সে দিকে কান দিল না। বাবার দিকে মায়াময় দৃষ্টি তে তাকাল। মুজাহিদ চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তার এই মেয়েটা বড্ড আবেগে ঠাসা। অদ্রিতার মুখের সাথে নিজের মায়ের মিল পান ওনি। আর তাই তো মেয়েটার কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে পারেন না।

“আব্বু !”

“হুম মামুনি?”

“আমি পড়াশোনা করতে চাই। সপ্তাহ খানেক আগেই তো রেজাল্ট এসেছে। হ্যাঁ গোল্ডেন প্লাস টা মিস হয়েছে। তবে প্লাস তো এসেছে।তবে কথা দিচ্ছি এবার আরো মনোযোগ দিয়ে পড়ব। প্লিজ আব্বু।”

মুজাহিদ চিন্তায় পড়লেন। এই এলাকায় কিছু দিন আগে যা ঘটেছে তাতে অদ্রিতা ভার্সিটি তে গেলে সবাই জ্বলে উঠবে। কলঙ্কের তকমা লাগিয়ে দিবে। তাছাড়া কলেজটা এলাকাতেই ছিল। ভার্সিটি তো বিশ কিলোমিটার দূরে। তা ও ভালো নয় তেমন।

“আব্বু।”

“মা আমি ও চাই তুই পড়াশোনা কর। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে….”

মুজাহিদ কথা শেষ করতে পারলেন না। অদ্রিতা ডুকরে কেঁদে উঠল। চাঁপা কান্নায় আর্তনাদ করছে সে। বাবার দিকে না তাকিয়েই রুমে চলে গেল।

মুজাহিদের বুকে যেন তীর বিঁধে গেল। মেয়ের কান্নাটা কিছু তেই সহ্য করতে পারছেন না। কিছু করতে হবে। এভাবে মেয়ের পড়াশোনাটা বন্ধ হওয়া উচিত নয়। বিয়ের বয়স হয়েছে মাত্র , পার তো হয়ে যায় নি। তবে এখান থেকে ভার্সিটিতে কীভাবে পড়বে?

ভীষণ মন খারাপ অদ্রিতার। ও খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সুন্দর চাঁদ আকাশের বুকে। তবে সেসব তাকে ছুঁতে পারছে না। ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা ছুঁয়েছে। ফোনটা বেজে ওঠল। আননোন নাম্বার। অদ্রিতার হৃদয় অনুভূতিহীন। একবার দু বার করে একাধিক বার কল এল। শেষমেশ কল রিসিভ করল অদ্রি। তবে দু প্রান্তের কেউ ই কথা বলছে না। অদ্রি বড়ো বিরক্ত হয়ে বলল,”হ্যালো কে বলছেন? কথা না বললে কল কেন করেছেন। আজব লোক!”

অদ্রি কলটা রাখতেই যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠটি বলল,”অদ্রি বলছেন? আমি শুভ।”

চলবে…..