#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-১৭
ওনার গত হওয়ার চারদিন পার হয়েছে। সারোয়ার বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। কথাটথা বলে না, বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকে। বিকেলে ওনার জন্য দোয়ার আয়োজন করেছিলাম। সেসব পাট চুকিয়ে রাতে তিতুন ঘুমিয়ে পড়ার পর সারোয়ারকে ড্রয়িংরুমে ডেকে নিলাম-“তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে সারোয়ার।”
সারোয়ার চুপচাপ এসে বসলো আমার সামনে-“কি বলবে বলো।”
আমি ভনিতা না করে সরাসরি ওকে বললাম-“এভাবে আর কতদিন চলবে?”
সারোয়ার বিস্মিত হয়ে তাকায়-“কিভাবে?”
“এই যে সারাদিন বাসায় থাকা। শোন সারোয়ার সরাসরি একটা কথা বলি তোমাকে। এতো দিন তোমার মা ছিলো, মরণাপন্ন মানুষ তাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে চুপ করে ছিলাম। এখন আর রাখঢাক করে লাভ নেই।”
সারোয়ারের বিস্ময় কমেনি। সে মাথা নেড়ে বলে-“কি বলতে চাও পরিস্কার করে বলো দুপুর।”
“আমি তোমার থেকে ডিভোর্স চাইছি সারোয়ার। তোমার সাথে সম্পর্ক কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না আমার। শুধু তিতুনের জন্য হলেও পারবো না আমি।”
সারোয়ারের চেহারার অবাক ভাব ধীরে ধীরে কেটে গেলো। সামান্য হাসলো সে-“কিন্তু রঙ্গন তো তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ও আর কখনো ফিরবে না এটুকু বেশ বুঝেছি। তাহলে কার আশায় ডিভোর্স দেবে? এতোদিন রঙ্গন ছিল তাই একা থাকতে পেরেছ। এখন কি একদম একা একা তিতুনকে নিয়ে থাকতে পারবে?”
আমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সারোয়ারকে দেখলাম। ওকে বেশ শান্ত আর বিশ্বাসী দেখাচ্ছে। যেন ধরেই নিয়েছে আমি ওকে কখনোই ছাড়বো না। ওর বিশ্বাস দেখে হেসে দিলাম-“মানুষ বেশিরভাগ সময়ই অকারণ ভয়ে ভীত থাকে। নিজেকে চেনে না, মন বোঝে না যার ফলে পদে পদে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নিজেকে চেনে না বলেই বছরের পর বছর অন্যায় জেনেও চুপ করে থাকে, রিস্ক নিতে চায় না, নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরুতে যায় না। আমার কথাই ধরো। আমি ডিভোর্সী তকমার ভয়ে তোমার থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। অথচ সেদিন যদি ভয়কে জয় করে রিস্ক নিয়ে পালিয়ে না আসতাম, বরং নিজে উদ্যোগী হয়ে তোমার কাছ থেকে সরে আসতাম তাহলে আজ এতোদিন পরে তোমাকে সহ্য করতে হতো না। তোমার কারণে রঙ্গনের মতো মানুষকে হারিয়ে ফেলতে হতো না।”
বলতে বলতে থেমে যাই। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে সারোয়ারের মুখপানে তাকাই-“একদিকে ভালোই হয়েছে। এতোদিন সবকিছু চোখের সামনে থাকার পরও অন্ধ ছিলাম আমি। দেখেও দেখিনি বুঝেও বুঝিনি। তুমি এসে চোখ খুলে দিলে। মাঝে মাঝে এমন ভুল করা দরকার বলে মনে করছি। ওই যে বলে না, মাঝে মাঝে অন্ধকারেই আলো খুঁজে পাওয়া যায়। ওইরকম ব্যাপার আর কি।”
সারোয়ার জানতে চাইলো-“তুমি সত্যিই একা থাকবে? আমি থাকবো না রঙ্গন নেই। পারবে থাকতে?”
“পারতে হবে। বলে যে মানুষ একবার ভুল করলে সেটা ভুল। কিন্তু বারবার একই ভুল করলে সেটা আর ভুল হিসেবে গন্য হবে না। সেটা হবে অপরাধ। আর অপরাধের জন্য শাস্তি তো পেতেই হবে, তাই না? যে মানুষটা সবসময় আমার সাথে ছিলো তাকে আমি চিনতে পারিনি। নিজ দোষে হারিয়ে ফেলেছি। এখন একা থাকার এটুকু সাজা তো আমার প্রাপ্যই। এই সাজা আমি মাথা পেতে নেব।”
“আর তিতুনকে কি বলবে? যদি বড় হয়ে বলে কেন ও বাবা ছাড়া বড় হলো? কি জবাব হবে তোমার?”
আমি অবাক হয়ে বলি-“বাবা ছাড়া কেন বড় হবে? তুমি আছো না? যদি বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাও তাহলে দূরে থেকেও করা যায়। তিতুনকে তোমার থেকে কেড়ে নিচ্ছি না আমি। তুমি নিয়ম করে মেয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। কোন বাঁধা নেই এক্ষেত্রে। বড় হলে তিতুনকে বুঝিয়ে বলবো কেন আমরা একসাথে থাকিনি। যদি সে বুঝদার হয় তাহলে তার মাকে বুঝবে আসা করি। আর না বুঝলে তুমি তো আছোই।”
সারোয়ার হা করে তাকিয়ে আমার কথা গিলছিল। হুট করে হেসে দিলো-“বুঝতে পারছি রঙ্গনের চলে যাওয়াটা বেশ ধাক্কা দিয়েছে তোমায়। এই কয়দিনে পরিপক্ব হয়ে গেছ। কিন্তু দুপুর আমার কি হবে বলো তো? মা ছাড়া আমি তো একদম একা হয়ে গেলাম। এখন তোমরাও যদি আমার জীবনে না থাকো তাহলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।”
আমি খানিকটা উদাস হয়ে জবাব দিলাম-“তুমি এতোদিন শুধু নিজের জন্য বেঁচেছ সারোয়ার। এখনও না হয় তাই করো। নিজের জন্যই বাঁচো, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোল। এমনিতেও তোমার প্রতি আমি কোন টান অনুভব করি না। তোমারটা বিবেচনায় আনছি না। কারণ আমার প্রতি তোমার আগ্রহ আগে থেকেই নাই হয়ে গেছিল। এখন তুমি একাকিত্বের ভয়ে আমাদের আগলে ধরতে চাইছো অন্য কিছু না। সব বাদ দিয়ে
আমরা না হয় তিতুনের জন্য ভালো বন্ধু হয়ে থাকবো।”
সারোয়ার একদম লক্ষী ছেলে বনে জিজ্ঞেস করলো-“আজই চলে যাব?”
“না। চল্লিশ দিন হোক। আমি ডিভোর্স পেপার তৈরি করছি। চল্লিশ দিন পরে ডিভোর্স পেপার সাইন করে বিদায় নেবে তুমি। আশাকরি কোন ধরনের কোন পন্থা অবলম্বন করবে না।”
সারোয়ার জবাব দিলো না। চুপচাপ উঠে গেলো। আমি অনেকটা সময় একা একা বসে থাকি চুপচাপ। এলোমেলো ভাবনা মনকে দ্রবিভুত করে। অভিমানেরা পাখির মতো হয়। ওদের খাঁচার বন্দী করে না রাখলে বড্ড জ্বালায়। ফাঁক পেলে একদিন ঠিক ঠিক উড়াল দেয়। সারোয়ার আসাতে রঙ্গনের অভিমান সু্যোগ পেয়েছে। আর কতইবা সইবে বেচারা। সবকিছুর একটা লিমিট আছে তো।
*****
চল্লিশ দিন পার হলো। আমি সারোয়ারের সামনে ডিভোর্স পেপার রাখি। সারোয়ারের মুখ বড্ড করুন দেখায়-“ডিভোর্স কি জরুরি দুপুর? রঙ্গন ফিরলে না দিয়। ততদিন আমি তিতুনের কাছাকাছি থাকতে পারবো।”
আমি মাথা নাড়ি-“যা পাঁচ বছর আগে হওয়ার ছিলো তা আজ নয় কেন? আর একদিনও না সারোয়ার।”
“তুমি রঙ্গনের আসায় আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ৷ বোকামি করছো দুপুর। রঙ্গনকে আমি ভালো মতো চিনি। ও আর ফিরবে না। তিতুনকে নিয়ে কষ্ট হবে তোমার।”
“হলে হবে। রঙ্গনের এতো বছরের কষ্টের তুলনায় তা হবে অতি নগন্য। আমি সয়ে নেব সারোয়ার। তুমি এতো ভেব না।”
“আমি কিন্তু এ শহরেই থাকবো দুপুর।”
আমি হেসে দিলাম-“এতোদিন তো তুমি আমার চোখের সামনেই ছিলে সারোয়ার। কি হয়েছে? আমাদের মাঝে আর কিছু হওয়ার নেই।”
সারোয়ার থেমে যায়। ফিসফিসিয়ে বলে-“তিতুনের কথা ভাববে তো একটা বার?”
আমি ক্লান্ত গলায় বলি-“এবার একটু নিজেকে নিয়ে ভাবি সারোয়ার। তিতুন আমারই অংশ। ওকে নিয়ে আলাদা করে ভাববার কিছু নেই যে। তুমি ভালো থাকো। চাইলে নতুন করে সংসার সাজাও আমার কোন আপত্তি নেই এতে।”
সারোয়ার কলম তুলে নেয়। কয়েকবার আমার দিকে তাকায়। সারা না পেয়ে নিঃশব্দে পেপারে নিজের দস্তক্ষত আঁকে। মাথা নিচু করে বসে থাকে অনেকটা সময়। তখনই কলিংবেল বাজে। মোমেনা খালা দরজা খুলে দিতে মাশরাফিকে দেখা গেল-“ম্যাডাম, সব ঠিক আছে?”
আমি সারোয়ারকে আড়চোখে দেখে অভয় দিলাম-“সব ঠিক আছে ভাই। কষ্ট করে এসেছেন এজন্য ধন্যবাদ।”
“আরে কি বলেন ম্যাডাম। আপনার জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। আপনে আমার মায়ের জীবন বাঁচাইছিলেন। আচ্ছা, যাই তাহলে। প্রয়োজনে এই ক্ষুদ্র মানুষটাকে স্বরণ করবেন কিন্তু।”
মাশরাফি যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেলো। আসলে সারোয়ারকে বিশ্বাস করিনি। ও যদি উল্টো পাল্টা করে। মাশরাফিকে সামান্য হিন্টস দিয়ে রেখেছিলাম। আমার সামান্য উপকার করতে পারলেও সে খুশি। তাই সুযোগ লুফে নিয়েছিল। আমরা মাঝে মাঝে মানুষ চিনতে ভুল করে ফেলি। মাশরাফি আসলে আমাকে শ্রদ্ধাই করে। আমিই ওর অতিরিক্ত আনুগত্যে প্রশ্ন তুলেছিলাম।
সারোয়ার মাথা নিচু করে বসে ছিলো। মাশরাফি চলে যাওয়ার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ায়-“আসছি দুপুর। ভালো থেকো। আর কোন প্রয়োজন হলে বিনা দ্বিধায় আমাকে ডাকবে। এতোদিন কিছু করতে পারিনি এখন থেকে চেষ্টা করবো করতে। অন্তত আমার মেয়ের জন্য হলেও।”
আমি জবাব দিলাম না। সত্যি বলতে নিজেকে ভীষণ ভারমুক্ত লাগছে। তিতুন ক’দিন খুব জ্বালাবে জানি। তাই তো ওকে নিয়ে কাল সাগরে যাচ্ছি। তিনদিন থাকবো ওখানে। তিতুনকে সময় দেব সেই সাথে নিজেকেও। একজনার অভিমান ভেঙে ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কাটাতে হবে এখন থেকে। সেই সাথে নিজের আর মেয়ের খেয়াল রাখতে হবে। তাই তো সামনে দিনগুলোর জন্য অনেক অনেক মানসিক শক্তি প্রয়োজন আমার। আমি সাগরের বিশালতা থেকে কিছু শক্তি নিয়ে ফিরবো।
সারোয়ার চলে যাওয়ার পরে আমি মোবাইল নিয়ে বসি। জানি রঙ্গন দেখবে না তবুও প্রতিদিন ওর সব যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ম করে ম্যাসেজ পাঠাই। কোনদিন যদি ওর নজর পড়ে। যদি অভিমান ভেঙে ফিরে আসে। প্রতিদিনের মতো আজও হতাশ হলাম। কোথাও রঙ্গনের কোন অস্তিত্ব নেই। পরক্ষণেই নিজেকে বুঝ দিলাম। হতাশা কাটিয়ে পুনরায় নতুন উদ্যমে লিখতে শুরু করলাম-“জানিস রঙ্গন, তুই দূরে চলে যাওয়ার পরই টের পেলাম কি ভীষণ ভালোবাসি তোকে। এতোদিন কাছাকাছি পাশাপাশি থাকার পরও কেন বুঝলাম না বলতো? নাকি ভেবেছিলাম জীবনটা এভাবেই চলে যাবে? হয়তো মনের কোনো এক কোনে সারোয়ারের জন্য সুপ্ত অনুভূতি লুকিয়ে ছিল। আমি ভাবতাম আমি ওকে ভালোবাসি এখনো। এতোদিন সারোয়ারের কাছে থেকে টের পেলাম ওর প্রতি কোন অনুভূতি আর জমা নেই আমার মাঝে। যা আছে সেটা কেবল করুনা। ঠিক যেমন তোর প্রতি ভালোবাসা বুঝিনি। দূরে গিয়ে বুঝিয়ে দিলি তুই আমার কতটা জুড়ে ছিলি। যা হয়েছে ভালো হয়েছে, ঠিক হয়েছে। অনেক সময় সবকিছু হারিয়েই অমূল্য জিনিসটা পেতে হয়। আমিও পেয়েছি। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো রঙ্গন। হাসিমুখেই অপেক্ষা করবো। এই অপেক্ষার জন্য কোন অনুযোগ করবো না। যবেই ফিরিস আমি আর তিতুন হাসিমুখে তোকে সম্ভাষণ জানাব।”
লিখতে লিখতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তারই দু’এক ফোটা ফোনের স্ক্রীনে পড়লো। আমি সেল্ড বাটনে ক্লিক করে চোখ মুছে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখলাম আাকাশে মেঘ জমছে। শীত কেটে গিয়ে গরমের আগমনী বার্তা ছিলো আবহাওয়ায়। তবুও বৃষ্টি হওয়ার সময় না এটা। এই অবেলায় গগনে মেঘ জমা যেন আমার মনের প্রতিচ্ছবি। কি মনে হলো, ছুটে গিয়ে ফোনটা এনে মেঘলা আকাশের একটা ছবি তুলে নিলাম। রঙ্গনকে ছবিটা পাঠিয়ে আরও দু’টো লাইন যোগ করে দেই ম্যাসেজে-“তুই ফিরে আয় রঙ্গন। প্লিজ ফিরে আয়। এই মেঘ ভেজা দুপুরের নিমন্ত্রণে ফিরে আয়। দুপুরের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার নিমন্ত্রণে ফিরে আয়। বৃষ্টির শেষে রংধনু হয়ে ফিরে আয় আমার জীবনে।”
সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin