#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব -১৮
যখনই সে রওনা দেবে ঠিক তখনই পল্লবীর ফোনে একটা কল আসলো। পল্লবী কলটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন
– পল্লবী আমি আশালতার মা। তোমাকে একটা প্রয়োজনে কল করেছি।
আশালতার মা সুরাইয়া খাতুনের অস্থির কন্ঠ শুনে পল্লবী বলে উঠল
– আন্টি কোনো সমস্যা কী হয়েছে?
সুরাইয়া বেগম অস্থিরতা নিয়েই বললেন
– পল্লবী একটা কথা বলব। আশা করি কিছু মনে করবে না।
– জ্বি বলুন আন্টি।
– তোমার তো সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। এ সময়ে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে, যাদের বিয়ে তাদের অমঙ্গল হবে। তোমরা এ যুগের মেয়ে তাই কোনো বাছ, বিচার করো না। আমি মা হয়ে তো মেয়ের ক্ষতি করতে পারব না। তাই তোমার বান্ধবী আশালতার ভালোর জন্য হলেও তুমি এসো না। আমি যে তোমাকে এ কথা বলেছি এটা সাদেক বা আশালতা কেউ যেন না জানে।
পল্লবী সুরাইয়া খাতুনের কথা শুনে একদম চুপ হয়ে গেল। কী জবাব দিবে বা কী বলবে সেটার উত্তর যেন সে পাচ্ছে না। কিছুটা স্থির হয়ে রইল। এরমধ্যে ওপাশ থেকে সুরাইয়া খাতুন পুনরায় বলে উঠল
– কী হলো পল্লবী রাগ করেছো নাকি? কথা বলছো না যে?
– না আন্টি রাগ করেনি। আমি তো এ বিষয়টা জানতাম না। ঠিক আছে আমি আসব না।
বলেই পল্লবী কলটা রেখে চুপ হয়ে খাটে বসে পড়ল। আনায়নাকে পাশে বসিয়ে ধরে রাখল। ভেতরে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে তবে প্রকাশ করতে মন বাঁধা দিচ্ছে। এর মধ্যেই আতিক এসে বলল
– কী রে পল্লবী এতক্ষণ তাড়হুড়ো করে তৈরী হয়ে এখন বসে পড়লি কেন?
– ভাইয়া যাব না ঐখানে। শরীর ভালো লাগছে না। এ শরীর নিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই।
– কী বলিস।
– হ্যাঁ ভাইয়া খারাপ লাগছে একটু। তুমি কোথায় যাচ্ছ?
– এ সময় আর কোথায় যাব। রোজ যেখানে যাই সেখানে। অফিসে যাচ্ছি। আমি নিরাকে ডাক দিচ্ছি আনায়নাকে ধরার জন্য। আর তুই শরীরের যত্ন নে।
পল্লবী মাথা নাড়ল। আতিক নিরাকে ডাকতে ডাকতে বলল
– নিরা কোথায় তুমি? পল্লবীর খারাপ লাগছে। আনায়নাকে একটু ধরো
– আসতেছি আমি। তুমি যাও।
বলেই নিরা মিনেট দুয়েকের মধ্যে পল্লবীর কাছে উপস্থিত হলো ততক্ষণে আতিক অফিসের পথে রওনা দিল। নিরা এসে পল্লবীকে চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে আনায়নাকে কোলে নিয়ে পল্লবীকে জিজ্ঞেস করল
– যাবে না তুমি?
– না ভাবী শরীর ভালো লাগছে না।
বলেই মাথাটা খাটে এলিয়ে দিল। নিরা পল্লবীকে আস্তে গলায় বলল
– বিশ্রাম করো সব ঠিক হয়ে যাবে।
পল্লবী খাটে মাথাটা হেলান দেওয়ার মিনেট দশেক পর সাদেক সাহেব কল দিয়ে বলল
– আপাই রওনা দিয়েছ?
– না রে আসতে পারব না। তুই যা।
– তোমাকে ছাড়া যাব না। আজকে বাবা, মা ও তোমাকে দেখতে চেয়েছে তুমি আসো তো।
– আমার শরীরটা ভালো না। এ শরীর নিয়ে আসলে বাবুর ক্ষতি হবে।
সাদেক এবার আর কিছু বলার সাহস পেল না। সাদেকের কল কাটতে কাটতেই আশালতাও কল দিয়ে একই কথা জিজ্ঞেস করছে পল্লবীকে। আশালতার প্রশ্নের জবাবে পল্লবী ঠিক একই উত্তর দিয়ে কলটা কেটে শুয়ে পড়ল। আজকে বড্ড বিষন্ন লাগছে তার মন। সবকিছুতে এত নিয়ম , যে নিয়মের কোনো যুক্তি নেই। আর নিয়মগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয় পল্লবীর মতো মেয়েদের উপর। কষ্টে থাকা একটা মেয়ে যে আনন্দ করবে সে উপায় ও নেই। প্রতিটা পদক্ষেপে তাদের বুঝাতে হবে তাদের একটা অতীত ছিল। আর সে অতীতটা অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণে হালকা পানি গড়িয়ে পড়ল।
অপর দিকে পরশ আর অধরার মধ্যে চলছে মান অভিমানের পালা। পরশ পল্লবীকে বিষয়টা না জানাতে বললেও পরশ নিজেই নিজের অপরাধ বোধ থেকে অধরাকে সবটা বলে দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। অধরা জানার পর টানা ছয়দিন শুধু চুপ হয়ে আছে। পরশের ভেতরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে অধরার এই নীরবতা দেখে। অধরা এখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। পরশ অধরার কাছে এসে বসলো। তারপর হাত দুটো ধরে বলল
– তুমি আমাকে যা ইচ্ছা করো। তবে তোমার এ নীরবতা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। আমি চরম ভুল করেছি আমাকে শাস্তি দাও। তবে নীরব থেকে নিজেকে কষ্ট দিও না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। অপরাধবোধ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরা অনেক কষ্টদায়ক। দয়াকরে কষ্ট দিও না আর। পারছি না তোমার এ মলিন মুখ দেখতে।
পরশের কথা শুনে অধরার চোখ দিয়ে ছলছল করে পানি পড়তে লাগল। অধরা পরশের হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ দুটো মুছে পরশকে জড়িয়ে ধরে বলল
– যে কাজটা করেছ সেটা একটা মেয়ের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর। কোনো মেয়েই চাই না তার স্বামীর ভাগ অন্য কেউ পাক। আমার নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগছে তাই চুপ হয়ে আছি।
– দয়াকরে আমাকে ক্ষমা করে দাও অধরা। যা শাস্তি দেওয়ার দাও তবে তুমি নিজেকে কষ্ট দিও না। আমি আর নিতে পারছি না তোমার এ মলিন মুখ।
অধরা এবার পরশকে শক্ত করে ধরে বলল
– শাস্তি দিব না। তবে তুমি আমাকে আগের বিশ্বাসটা আবারও অর্জন করে ফিরিয়ে দিও। এছাড়া আর কিছুই চাই না। যেদিন সবটা বলে ক্ষমা চেয়েছ সেদিনেই ক্ষমা করে দিয়েছি। নতুন করে ক্ষমা করার কিছু নেই।
পরশ অধরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতরটায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে অধরার এ কষ্ট দেখে। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিল আর কোনোদিন এমন কাজ করে অধরাকে কষ্ট দিবে না। দুজন দুজনকে ক্ষাণিকক্ষণ জড়িয়ে ধরে অভিমানের বিশাল বড় অধ্যায়টা শেষ করল।
এদিকে সাহিল আর রুশির সম্পর্কের অবনতি দিন কে দিন বেড়েই চলছে। সাহিলের পরিবার আর সাহিল হারে হারে টের পাচ্ছে তাদের জীবনটা কত এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রতিটা মুহুর্তে সাহিল পল্লবীকে অনুভব করে। প্রতিটাক্ষণ সাহিলকে নিজের অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজেকে শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ ও সে পাচ্ছে না। পল্লবীর পেটের বাচ্চাটা কার এ কথাটাও সাহিলের মাথা থেকে এখনও যায় নি। সম্পর্কের যোজন বিয়োজন টানা পোরণের মধ্যে সাহিলের জীবনটা অতিষ্ট প্রায়। কী করবে বা কী করলে ভালো হবে সেটা যেন তার মাথায় আসছে না। শুধু ভুগে যাওয়ার ছাড়া আর কোনো উপায় সাহিলের চোখে পড়ছে না।
এদিকে পল্লবী শুয়ে থাকতে থাকতেই পল্লবীর চোখটা লেগে আসলো। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজে পল্লবীর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আস্তে করে উঠে বের হয়ে পল্লবী অবাক হয়ে গেল। আশালতা আর সাদেক চলে এসেছে। সাথে তাদের পরিবারও। তাদের দেখে পল্লবী বুঝতে পারছে না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব । এমন সময় সাদেক সাহেব পল্লবীকে বলে উঠল
– তোমাকে ছাড়া এনগেজমেন্ট হবে নাকি। তাই সবাইকে নিয়ে চলে আসলাম।
আশালতাও বলে উঠল
– তোকে ছাড়া আংটি একা একা পড়ে নেব নাকি।
পাশ থেকে সাদেক সাহেবের বাবা মা পল্লবীর দিকে তাকিয়ে হালকা চোখের জল ফেলে বলল
– সাদেকের মুখে তোর কথা অনেক শুনেছি। তোকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিল। তুই একদম আমার মাধবীর মতোই মা। আল্লাহ তোর ভালো করুক।
পল্লবীর তাদের একটু জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
– আমাকে এতটুকু কাছের করে নিয়েছেন এটাই তো অনেক।
সুরাইয়া বেগম পাশেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। পল্লবীকে কল করে এত কথা শুনিয়েছে সেটা যেন তার মনে একটু নাড়া দিয়েছে। তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরেও কিছু প্রকাশ করতে পারছে না। নুরজাহান বেগম সবাইকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলল
– আরে আপনারা আসবেন কেউ কিছু বলে নি আমাকে। আমি কোনো আয়োজন করতে পারে নি।
সাদেক সাহেব নুরজাহান বেগমকে ভরসা দিয়ে বলল
– তেমন কিছুই করা লাগবে না। খাবার অর্ডার দেওয়া আছে সময় মতো চলে আসবে। আনায়না কোথায়? আনায়নার সাথে সুবাইতার পরিচয় করিয়ে দেই। ওরাই তো ভবিষ্যতে বেস্ট ফ্রেন্ড হবে।
আনায়নার কথা শুনতেই নিরা আনায়নাকে নিয়ে বের হলো। আনায়নাকে কোলে নিয়ে সাদেক সাহেব আশালতার কোলে থাকা সুবাইতা দেখিয়ে বলল
– এই যে মামনি এইটা হলো সুবাইতা। তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড। এক সময় তোমরা একই স্কুলে ভর্তি হবে। একসাথে স্কুলে যাবে। কত মজা হবে তাই না মামনি।
সাদেক সাহেবের কথা শুনে সবার মধ্যে হাসির জোয়ার বইছে। বেশ আনন্দ ঘন পরিবেশের মধ্য দিয়েই সাদেক সাহেব আর আশালতার এনগেজমেন্ট হলো। এনগেজমেন্ট শেষে খাবার খেয়ে সবাই সবার গন্তব্যে গেল।
সবাই চলে যাওয়ার পর সুরাইয়া বেগম পল্লবীকে কল দিয়ে বলল
– মা তোমাকে এভাবে বলা আমার উচিত হয় নি। কুসংস্কারে ডুবে ছিলাম কিছু মনে করো না। আজকে আমার চোখ খুলে গেছে।
– আন্টি আমি কিছুই মনে করে নি।
– কিছু মনে না করলে কালকে সকাল সকাল চলে এসো। পরদিন তো আশালতার বিয়ে। আমি একা সব সামলে নিতে পারব না। তোমার পরিবার সহ চলে এসো।
– পরিবার কালকে আসতে পারবে না আন্টি। তবে আমি চলে আসব সময় মতো। বাকিরা বিয়ের দিন আসবে।
বলেই কলটা কাটল পল্লবী।
পরদিন সকাল সকাল আনায়নাকে নিয়ে চলে গেল আশালতার বসায়। গিয়েই আনায়নাকে আশালতার কোলে দিয়ে সব কিছু গুছগাছ করতে লাগল সুরাইয়া বেগমের সাথে। সারাদিন কাজের মাঝখানে একটু খেয়ে নিয়ে আর আনায়নাকে খাইয়ে দিয়ে আবার কাজে লেগে যেত। গুছগাছ শেষে রাতে আশালতার কাছে যেতেই দেখল আশালতা ইতোমধ্যে আনায়নাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আনায়নার পাশে শুইয়ে পড়ল পল্লবী। আশালতা তখন বলে উঠল
– জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত তাই না?
– কেন বল তো?
– এই যে আমরা কখনও সুখের জন্য হায় হুতাশ করি তখন সুখ পাই না। তবে সুখ কিন্তু সঠিক সময়ে এসেই ধরা দেয়।
– হুম। প্রতিটা কষ্টের মধ্যেই স্বস্তি লুকিয়ে থাকে যা আমার সহজে দেখতে পাই না। জীবন মানেই তো সুখ আর দুঃখের খেলা। দুঃখ না থাকলে সুখ অনুভব করার স্বস্তি মিলত না। দুঃখ আছে বলেই সুখ নামক বস্তুটাকে আমরা অনুভব করতে পারি। যাইহোক এখন এসব চিন্তা না করে ঘুমা। কালকে তোর বিয়ে নতুন সংসার কীভাবে গুছাবি সেটা নিয়ে ভাব।
আশালতা হালকা হেসে পল্লবীকে বলল
– ঘুম আসছে না রে।
– বিয়ের আগের রাতে ঘুম সহজে আসে না। আমারও আসেনি।
বলেই পল্লবী একদম নির্বাক হয়ে গেল। তার আর সাহিলের স্মৃতি পল্লবীর মনে পড়তে লাগল। কিছুটা খারাপ লাগছে এসব মনে করে তবে নিজেকে সাথে সাথে সামলে নিয়ে বলল
– বকবক না করে চোখ বন্ধ করে থাক। আমাকে ঘুমাতে হবে। তা না হলে সকালে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না।
আশালতা পল্লবীর হাতটা ধরে বলল
– ঘুমা। আমিও ঘুমাই।
বলেই আশালতা ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর পল্লবী ওপাশ ফিরে ফেলে আসা স্মৃতি গুলো কল্পনা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেল।
পরদিন খুব ধুমধাম করে হলো সাদেক আর আশালতার বিয়ে। পল্লবীর সময়টা এতই ভালো কেটেছে যে জীবনের সবটা সুখ যেন পল্লবীর জীবনে এসে কড়া নড়ছে৷
এভাবেই সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে পার করলো কিছুদিন। ডেলিভারির এক মাস আগেই অফিস থেকে পল্লবীকে ছুটি দিয়ে দিল সাদেক সাহেব৷ পল্লবীও বাসায় বসে বিশ্রাম করতে লাগল আর অপেক্ষা করতে লাগল নতুন অতিথির জন্য। ডেলিভারির আরও ১৫ দিন বাকি।
কিন্তু-