আ না ম পর্ব-১৩+১৪

0
188

“আ না ম”- ১৩
-Azyah সূচনা

-“ফেলে দেই?”

খোলা ছাদের কোণায় ঝুঁকে আছে লিয়ানা। একপা পেছালেই পিঠের বলে পড়ে যাবে নিচে। মৃত্যুও হতে পারে।তবে মুখ পৃষ্টে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না। কপট স্বাভাবিক।যেমনটা ঐকান্তিক থাকে সবসময়।শেওলা রঙের কনীনিকা জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে শাবাবের দিকে। শাবাবকে আশ্চর্যান্বিত করে নিজের পায়ে বল প্রয়োগ করে পূনরায় সোজা হয়ে ছাদের ভেতরে চলে আসে লিয়ানা।

-“আপনার দলেরই লোক অফিসার।যথেষ্ট ফ্লেক্সিবল!”

পেছন থেকে মির্জা এসেছে হন্তদন্ত পায়ে।এসে বললো,

-“এই!এই! তোমরা দুজন ক্যারাটে শুরু করেছো কেনো?কি সমস্যা?একে অপরকে অপছন্দ করা মারামারির পর্যায়ে চলে গেলো?”

শাবাব দেহ টানটান করে বলে উঠলো,

-“শুরুটা অবশ্যই আমি করিনি।তুমি ভালো করেই জানো আমি অযথা কোনো নারীর গায়ে স্পর্শ করবো না”

লিয়ানা বললো, -“শুরু করেছি আমি।উস্কানি দিয়েছেন আপনি।”

মির্জা কপালে হাত রেখেছে।কেনো এদের এত বেমিল? দোষটা শাবাবকেই দিলো মির্জা।শুরুটা সেই করে।মানসিকভাবে অস্থির হলেও যথেষ্ট শান্ত লিয়ানা।তার ঠিক বিপরীতে শাবাব।অপরাধী থেকে শুরু করে সকলকেই উস্কানির কাজে এক্সপার্ট!

শাবাব বললো, -“এক্স অফিসার তার পাওয়ার দেখালো।”

মির্জা বললো,

-“থামোতো শাবাব!কি হয়েছে সে বহিষ্কৃত?এতে তোমার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।”

-“আমার কোনো সমস্যা নেই।সেদিন ব্যুরোতে অযথা আমার সাথে ঝামেলা না করলেই পারতো!”

-“তুমি বাচ্চাদের মতন সেই কথা ধরে বসে আছো?”

প্রথমবারের মতন চুপ বনে গেলো শাবাব।মস্তিষ্ক সচল হয়। ঠিকইতো!যা করছে সবটাই অযথা।রহস্য বের করবে বলেছিলো।করেছে।এরপর আর লিয়ানার সাথে তার কোনো লেনাদেনা নেই। ঠোঁট কামড়ে স্থান ত্যাগ করে।যাওয়ার পূর্বে ছাদের দরজায় জোরেশোরে ঘুষি দিয়ে গেছে।লিয়ানা আর মির্জা সেখানেই উপস্থিত।

একে অপরের চোখাচোখি হলে লিয়ানা বললো,

-“মানসিক সমস্যা আমার না।আপনার বন্ধুর।নিজেও জানে না তার মধ্যে এতটা প্রতিদ্বন্দ্বী মানসিকতা কেনো!আপনি সবার আগে তার ট্রিটমেন্ট করুন”

_

-“ন্যাচারস ল বলে একটা কথা আছে।মানুষ তার জীবনেই তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করে।তবে তোমার এই পরিণতি দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে রুবি…ওহ সরি! রুবিনা”

সাইফার অনুপস্থিতিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বিছানার এক কোণে বসে ছিলো রুবি।অনেক বছরের পুরোনো কন্ঠস্বর শুনে বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। ধুকপুকানির গতি বাড়ালো হৃদয়।জানালা বেয়ে আসা হাওয়ায় চুল উড়ছে নির্দ্বিধায়।

-“তুমিও আমায় সন্দেহ করছো?”

মির্জা দরজার দিকেই দাঁড়িয়ে রইলো।একা একটা মেয়ে ঘরে উপস্থিত।সে প্রবেশ করলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।চশমার আড়ালে ভেসে থাকা চোখ রুবির দৃষ্টির আড়ালে।

মির্জা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।বলে,

-“সন্দেহ করছি না।আমি পূর্ণ বিশ্বাসী তুমি কিছু করোনি।এতটুকু জানি তুমি স্বার্থবাদী হতে পারো কিন্তু ক্রিমিনাল নয়।”

-“আমার ভুলটা এখনও ধরে বসে আছো।”

-“ভুলে গিয়েছিলাম।মানিয়ে নিয়েছিলাম।তবে ভাগ্য আরো একবার এভাবে একে অপরের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দিবে সেটা ভাবতে পারিনি”

রুবি হাসলো। নিষ্প্রাণ হাসি।বলে উঠলো,

-“প্রফেসরের কেসে না হলেও জীবনের এই কেসটায় আমি অপরাধী।দেখো!আজ নিজের মুখে স্বীকার করছি।আমি তোমার অপরাধী।একজন পুরুষের হৃদয়কে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলাম। স্বার্থপর হয়েছিলাম নতুন জীবনে।চোখে রঙিন চশমা পড়েছিলো।ওই রঙিন চশমা আজ কালো রঙে পরিণত।নিজের এই পরিণতিতে আমি দুঃখিত নই।আমার চিন্তা আমার বাবা মাকে নিয়ে।তারপর যদি দোষে অথবা বিনা দোষে শাস্তি পাই।আমি মঞ্জুর করবো।মাথা পেতে নিবো”

মির্জা ভাবনার সাগরে ডুব দিতে চলেছে।প্রেমটা হয়েছিলো এক ভুল সময়ে। গভীরভাবে এই প্রেমজালে ডোবার পর প্রতিটি মানুষের মতন পরিবর্তিত হয়ে যায় রুবিনার অনুভূতিগুলো। নতুনত্বে মজেছিলো সে।পুরোনো মনে হচ্ছিলো মির্জাকে।ঠুনকো ছিলো না মির্জার অনুরাগ। প্রবলভাবে পাওয়ার ইচ্ছে ছিলো এই নারীকে।অবশেষে হার মেনেছে।

-“একটা প্রশ্ন করি?”

মির্জার দিকে চেয়ে থাকা রুবি উত্তর দেয়,

-“করো!”

-“আমায় ভালোবেসেছিলে?নাকি অভিনয় ছিলো শুরু থেকেই?”

অতীতের স্মৃতি একটি বিশেষ জায়গায় আটকে রয়েছে, যেখানে স্মৃতির পাখি বেচে যায় অনেকটা নাকি অস্তিত্বের গভীর পাথরের মতো। এই স্মৃতির অবস্থায় শোনা যায় যেন সময়ের গভীর সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে সব কিছু, যেন চলার পথে প্রতিদিনের পানিতে হারিয়ে যাচ্ছে।

আচমকা শক্তপোক্ত বক্ষে এসে লেপ্টে গেলো সেই পুরোনো এক প্রিয় মানুষ।খুব দ্রুততম গতিতে এসে জাপ্টে ধরেছে।পুরোপুরি বুঝে উঠার পূর্বেই চিত্ত আর ধীশক্তি অচল হয়ে পড়ে। হাতদুটো শক্ত করে মুঠ করে নিলো মির্জা।আসমানী রঙের শার্টটা অশ্রু জলে ভিজে উঠছে।নিষ্পলক নেত্র ঝাঁপটায়।

রুঢ় কণ্ঠে বলল, -“পুরুষ যেমন ছলনায় নিপুণ ততটা প্রেমও গভীর।ঠিক ততটাই প্রগাঢ় তার ঘৃণা”

-“আমাকে ঘৃনা করো।আমি তোমার ঘৃণার যোগ্যই।”

কেঁদে ভাসাচ্ছে রুবি।নিজে সাথে মির্জাকে।শার্ট চেপে ধরে আছে শক্ত করে।অন্যদিকে পাথরের ন্যায় শক্ত মির্জা।ঘনঘন নিঃশ্বাসের লাগাম টানতে ব্যস্ত। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দুর্বল হওয়ার পূর্বে বলে উঠলো,

-“দূরে সরে যাও রুবি।এভাবে খারাপ দেখায়।আমার বুকে দ্বিতীয়বার তোমার জায়গা হবেনা”

-“ক্ষমা করতে পারবে?”

-“ঠিক বলতে পারলাম না”

পরাজয় স্বীকার করে রুবি।মাথা তুলে ছলছল চোখে চাইলো মির্জার দিকে।নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে।নতুন জীবনের আশায় এই মানুষটাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় কেনো এই কথাটি মাথায় আসেনি?মির্জা এখনও ঠিক তেমনই আছে।রুবি হাত মুঠ করে নিলো।ধারালো নখ গেঁথে যাচ্ছে হাতের তালুতে।হয়তো এটা অনুশোচনা।নিজেকে সাময়িক কষ্ট দিয়ে।কোনো প্রকার আশা রাখলো না।মির্জার এমন কঠোরতা জায়েজ।

-“আমাকে সেদিন বলেছিলে যেনো সুখী হই আমি।আজ তোমার জীবনে সুখের অভাব।আমার ভাগের সুখটা তোমাকে দিলাম।তুমি সুখী হও”

___

চায়ের টংএ বিশেষ নজরদারি।রাত বাড়ছে। অপরাধীদের আনাগোনাতো এই সময়টায় বৃদ্ধি পায়।কে জানে প্রফেসরের সাথে জড়িত সেই ছেলেটির আনাগোনা এখানে হতেও পারে।সেই আশায় ফাহাদ আর রবিন এসেছে।লোকেশন বের করেছে তার।এখনও কক্স বাজার ত্যাগ করেনি।ফাহাদ রবিনের সাথে কিছুটা স্বাভাবিক। শাবাবের মতন বদ মেজাজী নয় সে।

কিছুটা সাহস নিয়ে বললো, -“স্যার?”

বিচক্ষণ চক্ষু এদিক ওদিক ঘোরাতে ব্যস্ত রবিন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, -“বলো ফাহাদ”

-“আজ শাবাব স্যার এর সাথে আসলেন না যে?”

রবিন হেঁসে উত্তর দেয়, -“তোমার শাবাব স্যারের উপর অনেক চাপ পড়ে যাচ্ছে।আজ তাকে রেস্ট করুক।”

ফাহাদ ঠোঁট কামড়ে বলে উঠলো, -“একটা কথা বলি স্যার?ছোট মুখে বড় কথা।কিছু মনে করবেন নাতো?”

-“আরেহ না!বলে ফেলো?”

-“আপনার আর শাবাব স্যারের মধ্যে একটা কম্পেটেটিভ মনোভাব দেখা যায়”

রবিন দোকানীকে ইশারা করলো।আরো এককাপ চা দিতে।এতক্ষনে অন্তত সাত কাপ চা খাওয়া শেষ।অনেক সময় যাবৎ এসেছে।চা একমাত্র ভরসা জেগে থাকার।

জবাবে রবিন বললো, -“আমাদের সকলের মধ্যে এই মনোভাবটা আছে।কে কার থেকে উপরে উঠতে পারে।আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোমার স্যার এর থেকে পিছিয়ে।তবে একটা বিষয় এখানে মুখ্য।সেটা কি জানো?”

ফাহাদ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে জানতে চাইলো, -“কি স্যার?”

-“মুখ্য বিষয় হচ্ছে কেসটা সলভ করা।আমি যেখানে ঢিল দিচ্ছিলাম শাবাব সামলে নিচ্ছিলো।এখন শাবাবের অনুপস্থিতিতে আমি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করছি।কাজে ব্যালেন্স দরকার।আমি এখানে কিছুটা হেয়ালি করেছি।এটা আমার দোষ।এই পরিবেশটা মানিয়ে উঠতে পারছিলাম না।এখন ধীরে ধীরে অনেকটা ইজি হয়েছে।তোমাদের স্ট্রেটিজি ধরতে পারছি। আই উইশ পুরো দমে আমার শ্রেষ্টটা দিবো”

-“কি সুন্দর বুঝালেন।এখানে শাবাব স্যার হলে আমাকে গুলি করে উড়িয়ে দিতো”

শব্দ করে হেসে উঠে রবিন।কথার উত্তরে কিছু বললো না।শান্ত আর ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ সে।রাগ জিনিসটা নেই বললেই চলে।

ফাহাদ দুষ্টুমির সুরে আবার বললো, -“আমি কিন্তু বিচিং করছি না স্যার।আপনাদের দুজনের পার্সোনালিটি আমার কাছে দু রকমভাবে ভালো লাগে।একজন আগুন হলে আরেকজন পানি।”

-“পৃথিবীতে দুটোরই প্রয়োজন আছে তাই না?আর আমাদের কেসেও”

-“ইয়েস স্যার!”

ঘন্টার পর ঘন্টা পেরোচ্ছে এভাবেই বসে।খবর এসেছে এই এরিয়াতে বেশ কিছুবার ওই ছেলেকে দেখা গিয়েছে।নজর গেড়ে চারিদিকে।প্রত্যেকটা মানুষকে এই পেশায় সন্দেহজনক মনে হয়।তাদের চাল চলন লক্ষ্য করে বেশ প্রগাঢ়ভাবে।মুখের ভঙ্গি বলে অনেক কথা।

ফাহাদ বললো, -“স্যার আমরা প্রফেসরকে ধরলেই ওই ছেলেকে পাবো।”

রবিন জবাব দিলো, -“প্রফেসর এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেশ কিছু এভিডেন্স দরকার।একটা পেয়েছি রুবির কাছ থেকে।এই ছেলেকে একটু ভয় দেখালে সে সব বলতে।তারপর আমরা তার সামনে কেস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কিছু ভুক্তভুগী মেয়েদের স্টেটমেন্ট নিবো।”

-“আর আনাম?”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে রবিন বললো, -“তাকেও পাবো।আবির ওই বিশেষ পয়জনটা ল্যাবে টেস্ট করিয়েছে। কোথায় এটা তৈরি হচ্ছে এটা সর্বপ্রথম জানতে হবে।আমরা আগেও চেষ্টা করেছি।তবে যা বুঝলাম এটা আলাদা কোনো জায়গায় তৈরি হচ্ছে। নিজস্বভাবে।”

কথার তালে হুশ হারিয়েছিল।কথা বলতে বলতে ডান পাশে চোখ পড়তে একজনকে দেখতে পায় রবিন।পকেটে রাখা ছবির সাথে মিলিয়ে নিলো।চোখের ইশারায় এলার্ট ফাহাদও। আলগোছে গান বের করে এগিয়ে যেতেই ছেলেটি দৌড় লাগায়।একই দমে রবিন আর ফাহাদও।রাস্তায় তিনজন মানুষকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখে লোকজন এর মধ্যে ভয়ের রেশ দেখা গেলো।দুয়েক মিনিট দৌড়ানোর পর নির্জন এক গলিতে রবিন চিৎকার করে।

বলে, -“আমি শুট করবো!”

সামনের পথ বন্ধ।রাতের আঁধারে অনেকটাই ঝাপসা।ছেলেটি আর কোনো উপায় খুঁজে পেলো না।পকেট থেকে পিস্তল বের করে তাক করলো রবিন আর ফাহাদ এর দিকে।

বললো, -“সামনে আসলে একদম মেরে ফেলবো!”

রবিন বলে উঠে, -“কর শুট।সাহস থাকলে”

-“আমি গুলি চালিয়ে দিবো বলছি!”

-“গো এহেড!”

ছেলেটি গুলি চালানোর পূর্বে রবিন তার পায়ের দিকে শুট করে।গুলির বিকট আওয়াজে তার হাতের পিস্তল জমিনে পড়ে গেলো।বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে মুহূর্তে।সেই সুযোগে রবিন আর ফাহাদ এগিয়ে আসে।তাদের এগিয়ে আসা উপলদ্ধি করে ফের পিস্তল হাতে তুলতে চাইলেই ফাহাদ তার হাত চেপে ধরলো।

সাথে রবিন ঘাড় চেপে ধরে বললো, -“অনেক হয়েছে চোর পুলিশের খেলা।এবার চল!”

শাবাব জানতো।প্রফেসর এর চ্যালাকে ধরে আনবেই রবিন।যেমন চিন্তা তেমন কাজ।আশ্রমের থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে তারা।এই ছেলেকে আশ্রমের দিকে নেওয়া রিস্কি। শাবাবকে কল করলো দ্রুত। জবানবন্দী নেওয়ার জন্য সাইফাকে সাথে নিয়ে গেছে। কক্স বাজার থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।তার দেওয়া পনেরো মিনিটের জবানবন্দীতে সবটা পরিষ্কার।রুবির কথা সত্য। জঘন্যতম কাজে লিপ্ত প্রোফেসর রাজিন। পারমিশন নেওয়া হয়েছে উপর মহল থেকে।আজ রাতের জন্য তাকে জেলে রাখা হবে।তার অবৈধ পিস্তল জব্দ করা হয়।থানার ওসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসেছে আশ্রমে।আগামীকাল ফিরবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। প্রফেসরের কৃতকর্মের ফল তাকে সুদে আসলে প্রদান করতে।

___

-“এখানে কি করছো রামশা?”

বাগানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ভরকে উঠে রামশা।পেছন থেকে লিয়ানার ভারী স্বর তাকে আরো ভীত করে তুলেছে।লিয়ানা তার হাতে থাকা ফোনটির দিকে একবার নজর বুলিয়ে নেয়।

রামশা আমতা আমতা গলায় বললো, -“কিছুনাতো!আমি…আমি রবিনের অপেক্ষা করছিলাম।”

-“কিন্তু তারাতো পাঁচ মিনিট আগেই ফিরে এসেছে।”

-“ওহ!আমি জানতাম না।চলো দেখি।এত রাত করলো যে”

সন্দেহের চোখে চেয়ে আছে লিয়ানা।প্রত্যেকটা চাল চলন লক্ষ্য করছে রামশার। ভয়ার্ত দেখাচ্ছে তাকে। অস্থির অঙ্গি ভঙ্গি।কপাল কুঁচকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রামশা মৃদু হাসে।

বলে, -“কি দেখছো?চলো!”

-“হুম”

রবিন আর শাবাবসহ বাকি সকলেই মিটিংয়ে।এতটুকু শিউর রুবি নির্দোষ। সস্তি পেলো যেনো মির্জাও।কোনোভাবেই চাচ্ছিলো না তার গায়ে অপরাধীর ট্যাগ লাগুক।তার চোখের সামনে শাস্তি পাক।তবে প্রফেসর এর কারণে সে যে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেই কথা ভেবে জাগছে আক্রোশ।সকলের সামনে দমিয়ে রাখলো।হাসি খুশি মির্জা আজ চুপ করে বসে।

রবিন বলল, -“আগামীকাল তাহলে চট্টগ্রাম ফিরছি?”

উত্তরে শাবাব বলে, -“হুম…কিন্তু তার আগে একটা কাজ আছে।”

-“কি কাজ?”

শাবাব সাইফার দিকে চাইলো।বললো, -“ওই শেওলা পাগলকে ডেকে আনো”

সাইফা ঠোঁট চেপে হেঁসে উঠে।সে ব্যতীত আর কেউই জানে না শাবাব কার কথা বলছে।অবাক চোখে চেয়ে রইলো।হিসাব মিলিয়ে হয়তো আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। সাইফা মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে লিয়ানাকে নিয়ে হাজির।

শাবাব পা দিয়ে চেয়ার টেনেছে নিজের বরাবর।হাত তুলে চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললো, -“বসুন এখানে”

লিয়ানা কথা বাড়ায়নি।সোজা এসে বরাবর চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। শাবাবের কাছে তার এই ভঙ্গিটাও অপছন্দ হয়।এক ধ্যানে আবারো চোখের দিকে চেয়ে অসস্তি ফেলছে শাবাবকে।সবুজ রাঙা চোখের মণিতে ভিন্ন রকমের ভ্রম। শাবাব এড়িয়ে গেলো।চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বললো,

-“আপনাকে দেখলে আমার কেনো রাগ হয় বলতে পারবেন?”

-“আমাকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবছেন তাই”

সোজাসাপ্টা উত্তরে অবাক চারিদিকে উপস্থিত সকলে। শাবাব কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া দিলো না।সে অল্প দিনে বুঝেছে এই মেয়ে দমে যাওয়ার পাত্রী নয় কোনদিকেই।সব কথার উত্তর আছে তার কাছে।এমনকি শাবাবের ধারালো কথার মোকাবেলা করার।কাটকাট উত্তর ছুঁড়ে দেওয়ার।

-“আমি আপনাকে নিয়ে ভাবছি না।ভাবার সময় নেই।আপনার যত পাগলের কর্মকাণ্ড আমার চোখের সামনেই ঘটে।আবার কিছু রহস্যও আমার সামনেই উদঘাটন হয়েছে। যার ফলে আপনি দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছেন।”

-“আগামীকালতো চলে যাচ্ছেন। আরতো দেখা হচ্ছে না আমাদের।আগামীকাল থেকে অসহ্যও হতে হবে না আপনাকে।তাহলে?”

শাবাব লক্ষ্য করে দেখে।কথার বলার সময় চোখের পলক অব্দি পড়েনা লিয়ানার।এক ঘোর লাগানো চোখে চেয়ে থাকে। আই কন্টাক্ট এ বেশ পটু। তাছাড়াও তার বলা কথা। সত্যিইতো কাল চলে যাবে।তাহলে অযথা কেনো এই আক্রোশ?

সময় নিজে জবাব দেয় শাবাব, -“আগামীকাল চলে যাচ্ছি তাই ডেকেছি আপনাকে।”

-“ বলুন”

-“এই আশ্রমের ব্যয়ভার বহন করেন কি করে?”

-“কিছু অনুদান আর বাকিটা আমার আশ্রমের মানুষরা কাজে পটু।তাদের তৈরিকৃত পোশাক, মৃৎশিল্পের কাজে আশ্রমের সকল খরচ চলে।”

-“আপনি কি করেন?বসে থাকেন?”

-“আমি কি করি সেটা না জানলেও চলবে”

-“তারা কাজ করে আর আপনি বসে বসে খান।তাই না?”

মির্জা মুখ খুলে।খানিকটা রাগী গলায় বলে উঠলো,

-“শাবাব!”

শাবাব গুরুত্ব দিলো না মির্জার এরূপ স্বরের। পুনর্বার লিয়ানার দিকে চেয়ে বলল,

-“কোন শ্রেণীর মানুষ কেমন কাজ করে?আর বাচ্চারা তাদের পড়ালেখার কি খবর?আর মেডিক্যাল সেবা?”

-“সমাজেতো আবার ভদ্র মানুষের অভাব নেই।প্রতি মাসে এসে সবার চেক আপ করে যায় বিভিন্ন মেডিক্যাল ক্যাম্প।অধিক বয়স্ক সাত জন আছে এখানে।তারা একদম অক্ষম।তারা কোনো কাজ করেনা।বাকি আঠারোজন কর্মক্ষম।তারা কাজ করে।বাচ্চা আছে এগারোজন।তাদের প্রাথমিক শিক্ষা আমিই দিচ্ছি।”

শাবাব বললো, -“বাচ্চাদের এই প্রাথমিক শিক্ষায় চলবে না।স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন না কেনো?”

-“টাকা আপনি দিবেন?….. অবশ্যই না!এই আশ্রমটা এই আশ্রমের মানুষগুলো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে এটাই অনেক।তারা সুখে আছে এটাই অনেক।”

শাবাব প্রত্যুত্তরে তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিলনা। দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ভাবনার জন্য কিছু সময় নিয়েছে। উপস্থিত সকলের নজর এদের দুজনের মধ্যেই।মির্জা জানে শাবাব কি ভাবছে।

কিছু সময় বাদে শাবাব বললো, -“আ’ম ইন।ওদের স্কুলে ভর্তি করান।যা যা প্রয়োজন আমি দেখবো। অনুদান এর চেক আগামীকাল পেয়ে যাবেন।আর আমার বাকি অফিসাররা চাইলে তারাও যোগ দিতে পারে।….. ওকে অফিসার লিয়ানা?”

চলবে…

“আ না ম”- ১৪
-Azyah সূচনা

-“আ’ম ইন।ওদের স্কুলে ভর্তি করান।যা যা প্রয়োজন আমি দেখবো। অনুদান এর চেক আগামীকাল পেয়ে যাবেন।আর আমার বাকি অফিসাররা চাইলে তারাও যোগ দিতে পারে।….ওকে অফিসার লিয়ানা?”

অফিসার লিয়ানা ডাকটা সরাসরি অন্তরের গিয়ে আটকালো। অনেকটা সময় পর হয়তো ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছে এই দাম্ভিক হৃদয়ে।কানে বেজে উঠছে পুরোনো ওই ডাকটা।অনেকেই ডাকতো তাকে এই নামে।এক বিশাল মর্মযন্ত্রণার মরুতে বৃষ্টির মতন নামছে এই ডাক।মন মস্তিষ্ক পুরো দমে পুনরাবৃত্তিতে মেতে উঠেছে।ড্রাম বাজিয়ে কানের কাছে ওই ডাকটা শুনিয়ে যাচ্ছে বারেবারে।

মির্জা বললো,

-“আমিও এই কাজে যোগদান করতে চাই”

বাকিরা সকলে বিস্মিত।অফিসার? শাবাব লিয়ানাকে অফিসার কেনো ডাকলো? নির্বোধ সবার মাঝে সবার প্রথমে প্রশ্নটা ছুঁড়েছে রবিন।

জানতে চাইলো, -“অফিসার লিয়ানা মানে?”

শাবাব লিয়ানার দিকে দৃষ্টি রাখে একবার।চেয়ে দেখলো তার ঠোঁটে নামমাত্র হাঁসি। শেওলা পড়া চক্ষু নিম্নে।পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী শাবাবের ইচ্ছে হলো না বেশি রুষ্টটা দেখাতে। খোঁচা মারা কথা আপাদত এড়িয়ে যায়।

রবিনের প্রশ্নের জবাবে শাবাব বলে, -“হ্যাঁ সে আমাদের মতনই একজন অফিসার ছিলেন।”

রবিন ফের প্রশ্ন করে, -“ছিলেন?”

-“হুম।এখন সেই চাকরি ছেড়ে আশ্রমে সন্ন্যাস নিয়েছেন”

রবিন কৌতুহলী নেত্রবিশিষ্ট লিয়ানার দিকে রেখে আবার জিজ্ঞেস করে,

-“কিন্তু কেনো?”

শাবাব জবাব দেয়,

-“এতকিছু জানি না।জানার প্রয়োজনও নেই।”

-“আমিও আশ্রমে অনুদান করতে আগ্রহী।”

একে একে সকলেই রাজি হয়।হোক তাদের বেতনের পরিমাণ স্বল্প অথবা বেশি।আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিনা দ্বিধায়।বাচ্চাদের সমস্ত শিক্ষার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে শাবাব।নিজেকে ঋণী মনে হচ্ছিলো তার।ছোট্ট অবদান তার মনের উসখুস ভাবকে কাটিয়ে তুলছে। সাথে সেই ছোটছোট পরিবারহীন বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পেরে ভিন্ন প্রশান্তি অনুভব করছে।এক ঢিলে দুই পাখি।এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাবাব।

লিয়ানা সবার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চাইলো।সবসময় স্বল্প বাঁকা চাঁদের ন্যায় হাসির আজ একটু বেশিই প্রসারিত।মলিন মুখখানায় হাসিটা মায়াময় দেখাচ্ছে।কেউ অতটা লক্ষ্য না করলেও শাবাব করেছে।ধ্যান তার দিকে প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই চোখ নামিয়ে নিলো।

লিয়ানা সবার উদ্দেশ্যে বললো, -“ধন্যবাদ”

পরপর শাবাবের দিকে চেয়ে বলল,

-“আমার নিজের এই শব্দটা অপছন্দ হলেও আমি কাউকে ধন্যবাদ দিকে কার্পণ্য করিনা।….আপনাকেও ধন্যবাদ।”

শাবাব তার পূর্বের রগচটা রূপে ফিরে এসেছে।বলে ফেললো,

-“আকার ইঙ্গিতে খোঁচা মেরে ধন্যবাদ জানালেন”

লিয়ানা ধীর গতিতে মাথা দোলায় দুদিকে।বলে,

-“আপনার সাহায্যের বিনিময়ে একটা সাহায্য করবো?”

ডান পার্শ্বে ভ্রু উঁচু করে শাবাব জানতে চাইলো, -“কেমন সাহায্য?”

-“কেস সলভ এর আড়ালে একটা পয়েন্ট মিস করে যাচ্ছেন।”

নড়েচড়ে বসলো শাবাব।বললো,

-“কোন পয়েন্ট?আর আপনি আমাদের কেস সম্পর্কে কি করে জানেন?”

-“শুনেছি আপনাদের কথা।কি করবো বলুন?মাঝেমধ্যে পুরোনো পেশার প্রতি অনেক আগ্রহ জেগে উঠে।শুনেছি কিছু রুবি থেকে,কিছু সাইফা থেকে।কিছু আন্দাজ করেছি আপনাদের কথাবার্তা, চালচলন দেখে।আপনারা যেই কিলার এর খোঁজ করছেন তার সম্পর্কে অনেক বড় একটা ক্লু মিস করে যাচ্ছেন।কিলার কেনো খুন করছে সেই উত্তর প্রফেসর সে কেস এর মাঝেই আছে।খেয়াল করেছেন?”

-“মানে?”

-“আপনার মনে হয় না এস. আই শাবাব প্রফেসরকে সেই কিলার এই কারণে মারতে চেয়েছে কারণ সে মেয়েদের সাথে কুকর্মে লিপ্ত ছিলো।হয়তো এটাই তার মোটিভ?আমি জাস্ট গেস করছি।বাকিটা আপনাদের কাজ।”

শাবাব এর মস্তিষ্ক জ্বলে উঠে।বলে,

-“মানে কিলার এর টার্গেট তারা যারা এসব মেয়েদের হয়রানি করে?”

মির্জা দ্রুত গলায় বলে,

-“এটাকি সম্ভব যে প্রত্যেকটা ভিকটিম কোননা কোনোভাবে মেয়েদের উত্যক্ত করতো?”

রবিন তার মতামত প্রকাশ করে বললো,

-“আর সেই পুরুষদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিলার নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে?”

দুহাতে চুল টেনে ধরেছে শাবাব।পুরোনো অভ্যাস।দেহের সাথে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে অনেকটা।চোখ খিঁচে বন্ধ করে ভাবতে লাগলো এই চিন্তাটা কেনো আসেনি তাদের মাথায়?এই পয়েন্টটা কি করে মিস করে যাচ্ছিলো?একটাবারের জন্যে কারো মস্তিষ্কে এই সন্দেহটা এলো না?

সাইফা জানতে চাইলো,

-“কিন্তু স্যার এমন যদি হয়?তাহলে সে আমাদের সাহায্য নিতে পারতো?পুলিশের কাছে যেতে পারতো?”

মির্জা উত্তর দেয়,

-“সিরিয়াল কিলাররা নিজেকে আইনের উর্ধ্বে মনে করে।তারা আইন ভাঙতে আর আইনের সাথে জড়িত লোকদের উস্কাতে পছন্দ করে।সে ভাবছে তার হাতে সমস্ত শক্তি।সে চাইলেই কারো প্রাণ নিতে সক্ষম।আর এই মানসিক হিংস্রতা তাকে দিয়ে একের পর এক খুন করিয়ে যাচ্ছে।মোটিভ যেটাই হোক”

আবির বললো,

-“যদি এমনটা না হয়?কারণ অন্যকিছুও হতে পারে তাই না?”

-“এটা কারণ হোক আর না হোক।আমরা ইনভেস্টিগেট করবো।প্রত্যেকটা ভিকটিম এর জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি সমস্ত ডিটেইলস বের করতে হবে।” মাথা তুলে জবাব দেয় শাবাব।

পরপর সাইফাকে আদেশ করলো শাবাব।বললো,

-“রুবিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করো।জানতে চাও যে প্রফেসর তার সাথে যা যা করেছে সেটা ওর বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে কিনা?তারপর চট্টগ্রাম গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রত্যেকটা মেয়েকে খুঁজে বের করবে যে প্রফেসর রাজিন এর শিকার ছিলো।”

রবিনের দিকে চেয়ে বলল,

-“আপনার ঢাকার অফিসারকে ওয়ারেন্ট নিয়ে রুবির ওই বান্ধুবি জিজ্ঞাসাবাদ আর তার জবানবন্দী এর রেকর্ড নেওয়ার আদেশ দেন। কক্স বাজারে যে আছে তাকে আমরা দেখছি”

প্রত্যেকের মাঝে বৈদ্যুতিক সঞ্চারণ ঘটছে যেনো।লিয়ানার একটা কথায় সকলে সেই বিষয়ে মাথা ঘামানো শুরু করে। সাইফাকে যেমনটা আদেশ করা হয়েছে সে ঠিক সেই কাজে লেগে পড়লো।তবে হৃদয়ে অসুবিধে হচ্ছে মির্জার।রুবি অল্পতে ভীত হয়ে পড়া মেয়ে। বেশি চাপ নিতে পারে না আগে থেকেই।পুরোনো প্রেম রোগ জেগে উঠতে চাইছে বারেবারে।যাকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল।উঠে পিছু নিলো সাইফার।

শাবাবও উঠে দাঁড়ায়।সাথেসাথে লিয়ানাও।নিজের ইগোকে সাইডে চাপিয়ে দিলো নিজে নিজেই।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শাবাব বললো,

-“থ্যাংক ইউ”

“যদিও এই থ্যাঙ্ক ইউ নামক শব্দজোড়া আমি কখনো কারো কাছ থেকে গ্রহণ করিনা….তারপরও ওয়েলকাম”

-“অদ্ভুত আপনি আর আপনার কথা!” বলে স্থান ত্যাগ করে শাবাব।

__

মির্জা ঘরের দরজা অব্দি সাইফার পিছু গিয়েছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডেকে বললো,

-“সাইফা?”

সাইফা ঘুরে তাকায়।মির্জার দিকে এগিয়ে এসে বললো, –

“জ্বী স্যার?”

-“আচ্ছা আমি রুবির সাথে কথা বলি কেমন?তুমি নাহয় তোমার শাবাব স্যারের কাছে যাও।”

সাইফা কপাল কুঁচকে বললো, -“আমার শাবাব স্যার?”

ফিক করে হেঁসে উঠে মির্জা।তার মনের খবর চোখে প্রকাশ পায়।আজকাল লিয়ানার ছায়াতলে সেও মন পড়ার দুইগুন বেশি অভিজ্ঞ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো।

বললো, -“মেয়ে তুমি আগুনে হাত বাড়িয়েছো। পুড়তেতো হবেই।যাও গিয়ে পুড়ো।পুড়ে শাবাবের সাথে কাবাব হও “

-“আপনিও আজব স্যার!”

বলে চলে গেলো সাইফা।ওই আগুনের গোলার কাছে যাবে?অসম্ভব। সাইফাকে হাসিখুশি বিদায় করে নিজেকে প্রস্তুত করলো। গম্ভীরতায় ভরে গেলো সর্ব মুখ।একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে আবার ছাড়লো।দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো আনমনা মেয়েটিকে।জানালার জং ধরা গ্রিলে হাত রেখে আকাশপানে চেয়ে আছে। চাঁদতো তার ভীষণ প্রিয়।কলেজ জীবনে লুকিয়ে একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ যখন হতো?তখন তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিলো এই সুন্দর শুভ্র চাঁদ।অনেকটা অপরিপক্ব বয়সে এসেছিল প্রেম।প্রতিদিন কলেজ।কলেজ শেষে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া।সন্ধ্যায় একে ওপরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা।সেগুলো সবটাই স্মৃতি।শুধুই স্মৃতি। হাসিখুশি মির্জাকে একজনই পেরেছিল বিষাদতলে ডুবিয়ে দিতে।পুরো নাম তার রুবিনা।তার অবাধ্য উড়ে চলা কেশমালাকে ঠিক করে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগলো।তবে নিজেকে আটকায় মির্জা।

দরজায় টোকা দিয়ে বলে, -“আসতে পারি?”

-“এত সময় দাঁড়িয়ে থেকে এখন অনুমতি চাইছো?” অকপটে বলে উঠলো রুবি।

স্মিথ হাসে মির্জা।বলে, -“বুঝে ফেললে কি করে?”

একি দিকে চেয়ে রয়ে রুবি বললো,

-“স্বার্থপর হৃদয়ে পুরোনো অনুভূতিরা দরজা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।তাই অনুভব করতে পেরেছি।”

-“আমি কাজের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে রুবি।ফিরে এসে চেয়ারে বসলো জড়োসড়ো হয়ে বসলো।সামনে থাকা আরেকটি চেয়ার মির্জাকে দেখিয়ে বললো,

-“আসুন অফিসার।জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করুন।”

ছুরি চালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বাক্যযুগল।ভাবতে পারেনি এরুপভাবে জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য একে অপরের মুখোমুখি হতে হবে!কতবার নিজেকে কঠোর করবে মির্জা?নড়বড়ে স্তম্ভটাকে সামলে রাখতে কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে।

সামনে এসে বসলো।বললো,

-“আমি কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসিনি।কিছু কথা জানতে এসেছি। যার উত্তর হয়তো আমাদের কেসে সাহায্য করবে।”

-“হুম!আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো কো অপারেট করার”

-“থ্যাংকস। তো শুরু করা যাক?”

-“শিউর”

-“তো রুবি আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে প্রফেসর তোমার সাথে…. মানে সে যে এই জঘন্য কাজটা করছে এটা কেউ জানে?তোমার বন্ধুরা বা অন্যকেউ?”

রুবি নত চোখে উত্তর দিলো, -“আমার দুজন বান্ধুবি জানে।আর কেউ না”

-“তোমার বাবা মা?অথবা কোনো রিলেটিভ?কোনো পুরুষ?”

-“নাহ্”

-“ভুক্তভোগী মেয়েদের মধ্যে কারো ডিটেইলস জানো?”

রুবি চোখ তুলে চাইলো একবার।মির্জার শুষ্ক মুখটা দেখে নেয় একবার।চোখে তার হাজারো দ্বিধা।কথা বলতে ভীষণ জড়তা নিয়ে।

জবাবে রুবি বললো,

-“ডিটেইলস জানি না।তবে হ্যাঁ জানতে সাহায্য করতে পারি।যদি আপনারা আমায় পুলিশ প্রটেকশন দেন”

-“শিউর!অবশ্যই দিবো।আর প্রফেসরের কঠোর শাস্তি হবে।কঠোর!”

স্মৃতির অতীতে যে বৃষ্টি পড়ে?সেই বৃষ্টির দামী জড়ি হয়ে অতীতের স্মৃতি তার নক্ষত্রে।স্মৃতির গহন কোণায় নীলিমা প্রতিচ্ছবি,হৃদয়ের কোনায় অবিরাম দেখা করা প্রাণ।সন্ধ্যায় আলোর অভাবে, নীরবতা শহরে প্রবেশ করেছে।বাতাস ভরে উঠে কালো নিস্তব্ধতার ছায়ায়। উত্তপ্ত সূর্যের নিচে অবস্থান করে মনে হয় আধাঁরে ডুবে যাচ্ছে।জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব শেষ।প্রেমিক হৃদয় তরতরিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে।

-“আমাকে একটা বিশাল শাস্তি দাও।যেনো তোমার হৃদয় স্বস্তি পায় মির্জা।”

-“ক্ষমা মহৎ গুন।”

-“জানো?আমি তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমার মাঝে কোনো অনুশোচনা ছিলো না।….আজ তোমার এই মলিন মুখ দেখে কেনো নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে?”

-“রুবি তুমি নিজেও একটা খারাপ পরিস্থিতির শিকার।তাই আমাকে দেখে মায়া হচ্ছে তোমার।আনন্দে উচ্ছাসে দিন অতিবাহিত করলে আমার দিকে দৃষ্টিও ফেলতে না।এটা মানুষের ধর্ম”

তুচ্ছ হাসি ঠোঁটের এক কোণে রুবির।কতবড় ধরণের স্বার্থপর হতে পারে সে?যাকে নিঃস্ব করে ফেলে রেখে গিয়েছিলো অজানা পথে?তাকেই আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে। লজ্জায় আবার চোখ নামায়।

-“আমি চেষ্টা করবো প্রায়শ্চিত্ত করার।তবে চিন্তা করবে না ফিরে আসতে চাইবো না।মানুষ ছেড়ে যাওয়ার সময় বলে না?তুমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো?….তোমার ক্ষেত্রে এই কথাটা শতভাগ সত্য।তুমি সত্যিই ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো।”

“আমার জীবনে আমি কোনো দ্বিতীয় নারীকে জায়গা দিচ্ছি না।আমি জানি….একা বেঁচে থাকা যায়….হয়তো।”

মির্জা উঠে দাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।এখানে থাকলে শুধুই হীনবল হবে অঙ্গপ্রতঙ্গ।চিত্ত দুর্বল হয়ে উঠবে।চলে যাওয়া শ্রেয়। রুবির চোখের কোণ বেয়ে এক শিশির বিন্দু গড়ালো।কে জানে? অনুশোচনা নাকি ব্যাথা?

মির্জা বললো,

-“কান্না করে না।তোমাকে কান্নারত মুখে এখনও আগের মতনই মায়াবী দেখায়।”

দেহের ভার তুলে হাটা দিলো।রুবি দ্রুত মুখ মুছে দেয়।নিজের প্রতি ঘৃণার জেদ উঠালো নিজের চুলের উপর। কেশের গভীরে হাত মুঠ করে রেখে শান্ত করতে চাইলো নিজেকে। বারবার হৃদয় তোড়জোড় করছে। মির্জাকে ফিরে পেতে চাইছে। অসম্ভব এই কার্য! আবারও জানালার গ্রিলে কপাল ঠেকায়।একাকী চলতে চেয়েছে?আর একাকিত্ব গ্রাস করবে না? তা কি করে হয়?

ক্ষণিক সময় বাদে এক কাতর,কম্পিত গলার সুর ভেসে এক পেছন থেকে। পুরুষালী ভারী এক গলা কিছুটা দুরত্ব থেকে বলছে,

-“আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না।দুর্বল হয়ে উঠেছি আবার।আমার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের তোমাকে আবার প্রয়োজন।….এতদিন চোখের আড়ালে ছিলে।মনের আড়াল করার চেষ্টা করেছি।সম্মুখে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।আমি নব্য সূচনা চাই রুবি”

___

-“লিয়ানা? কি হয়েছে?খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”

ধড়ফড় করে উঠে যাওয়া লিয়ানার উদ্দেশ্যে বললো রামশা।চোখের এক কোণায় অল্প শিরির বিন্দুর মতন জল দেখা গেলো।চোখে পড়ছে রামশার।ঠোঁটজোড়া অল্প ফাঁক করে আছে সে।সবুজ মনির চোখগুলো ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে বিদ্যমান।পলকহীন চেয়ে আছে বিছানার উপর বসে।কি যেনো ভাবছে।বিচিত্র মলিন তার মুখের ভঙ্গি।

রামশা আবার প্রশ্ন করে, -“কাঁদছো যে?”

ডান দিকের ভ্রু উঁচিয়ে লিয়ানা উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে,

-“হুম?….কাঁদছিলাম?”

-“চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরলো মাত্র। অনুভবও করোনি?”

-“নাতো”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামশা।হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।হাত দুটো হাঁটুতে রেখে নিষ্পলক দেখতে লাগলো এই অদ্ভুত মেয়েটাকে।এখনও ওই ফ্যানের দিকে চেয়ে আছে।কি আছে সেখানে?কি আছে দেখার মতোন?
আজ রামশা এতদিনের জমিয়ে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেললো।

বললো, -“একটা কথা সত্যি করে বলবে লিয়ানা?”

-“সত্যি কথা?”

-“হ্যাঁ সত্যি কথা।বলবে?”

-“প্রশ্ন করো”

লিয়ানার ডান বাহুতে হাত রেখে রামশা প্রশ্ন করলো,

-“তোমার অতীতে এমন কিছু ছিলো? যার কারণে তুমি আকাশ,মেঘ,চাঁদ,সূর্য,তারা,গাছপালা এদেরকে আপন করে নিয়েছো?”

-“অতীত জানতে চাও?”

-“হ্যাঁ লিয়ানা চাই জানতে”

-“কিভাবে বলবো?”

অবোধের মতন করে কথা বলছে লিয়ানা।এটা তার স্বভাবগত। সবসময়ই তার কণ্ঠের ভঙ্গি থাকে বিচিত্র।

রামশা বললো, -“মুখ দিয়ে বলো লিয়ানা।যদি থেকে থাকে কোনো অতীত বলে নিজেকে হালকা করো।কি তোমার অতীত?”

-“নেইতো অতীত।মুছে ফেলেছি।জীবন থেকে,মস্তিষ্ক থেকে। হৃদয়তো আমার কখনো ছিলোই না।কিছুই মনে নেই অতীতের।এক কালো আঁধার দেখা যায় সেখানে।বলো কি করে ওই অন্ধকার থেকে গল্প আনবো তোমার জন্য?”

চলবে….