আ না ম পর্ব-১১+১২

0
69

“আ না ম”- ১১
-Azyah সূচনা

-“ভয় পেয়েছিলেন অফিসার শাবাব?”

শাবাবের কদম থামে।কয়েক মুহূর্ত বাদে ফিরে চায়।কালো রাঙা গিটার বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছে লিয়ানা।কোনো কৃত্রিম আলো নেই ছাদে।আছে শুধু অর্ধ চাঁদের মৃদু জ্যোতি।

শাবাব চার পা এগিয়ে আসে।বলে,

-“ভয় না বিরক্তবোধ করছিলাম”

-“দুঃখিত।”

-“মানুষ এই রাতের বেলা গান করে?”

-“আমি করি”

শাবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে,

-“আপনি কি সত্যিই এমন অদ্ভূত নাকি লোক দেখানো?”

-“আপনারা ভালো বলতে পারবেন।কোনটা আসল কোনটা নকল”

ট্রাউজার এর পকেটে হাত গুঁজে শাবাব। ঘাড় ঘুরিয়ে কাটকাট দাঁড়িয়ে।মনের মাঝে অদ্ভুত একটা কথা বারবার তাকে তাড়া করছে।তবে আটকে আছে কোনো অদৃশ্য বাঁধায়। দ্বিমুখী চিন্তাধারা।উভয়ই প্রখরতা চরম পর্যায়ে। লিয়ানার কাজ যেনো সর্বসময় পর্যবেক্ষণ করা। শাবাবের মুখ আর চোখের অব্যক্ত চিন্তা চেতনাকে গ্রাস করছে চোখ দিয়ে। দীর্ঘসময় পরও নীরবতা ভাঙলো না।

লিয়ানা শব্দহীন হাসে।বলে,

-“সেদিন আমি ভুল বলিনি অফিসার।আপনার ইগো আপনাকে আটকাচ্ছে আমায় ‘ধন্যবাদ’ বলতে।”

শাবাব খানিকটা বিস্মিত বোধ করে।মনের কথা পড়তে পাড়ার মতন এই বিচিত্র শক্তি দেখে।তবে মুখে প্রকাশ করলো না।

ভাবমূর্তি বজায় রেখে বললো,

-“আমার ইগো আমাকে আটকাচ্ছে না।আটকাচ্ছে আপনার আচরণ। অস্বাভাবিক, অদ্ভুত!”

কালো রঙের গিটারটা তাঁর বাম দিকে জমিনে ঠেকিয়ে ঘোর লাগানো গলায় উত্তর এলো,

-“মনুষ্যত্বকে মনুষ্য ধ্বংস করে অফিসার।আমি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।”

-“আপনার মতে আমরা ধ্বংস?”

-“ধ্বংসের পথে….”

পাগলে কতকিছুই না বলে!এই চিন্তাধারা এসেছে শাবাবের মাথায়।এমন মানুষের সাথে কথা বাড়ানো মানেই হচ্ছে চোরাবালিতে ফেঁসে যাওয়া।মির্জার কথা ঠিকঠিক বুঝতে পারছে শাবাব।সে মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে।

-“গুড নাইট মিস লিয়ানা…. আর হ্যাঁ!আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা সকলে।”

অর্ধ চাঁদটা প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিলো।লিয়ানা আকাশপানে মুখমণ্ডল তুললে ফিরে আসে।কালো মেঘ চিরে আবার স্পষ্ট হয়।লিয়ানা ধরে নিলো তার কথা শুনতেই এসেছে।চেয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁট নাড়িয়ে যখন কিছু বলবে সে তখন সেই কথনের প্রেক্ষিতেই জবাব দেবে শশাঙ্ক।

লিয়ানা চোখ বুজলো।হিমেল হাওয়া এসে আঁচড়ে পড়লো সারা অঙ্গে।ছোট ছোট চুল আর ঘন চোখের পাঁপড়ি নড়ছে অনবরত।বেগ বাড়ায় পবন।এক লম্বা উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে লিয়ানা বললো,

-“অথচ আমিও ছিলাম তাদের মধ্যেই একজন”

সকাল ছয়টায় ফোন বেজে উঠে শাবাবের।মাত্র চোখ বুজেছিলো।এরই মাঝে বিকট আওয়াজে দ্রুত উঠে বসে।নতুন সিক্রেট নাম্বারটা ভাসছে স্ক্রিনে।যেটা ফিরোজকে দেওয়া হয়েছিল। শাবাব ফোন রিসিভ করে নেয়।

অন্যপাশ থেকে আওয়াজ এলো ফিরোজ এর।দ্রুত গলায় বললো,

-“স্যার!”

-“বলো ফিরোজ।”

-“স্যার ওই ম্যাডাম!উনি হোটেলের সামনের বাস কাউন্টারে বসে আছে।ওনার হাতে লাগেজ।আপনারা দ্রুত আসুন।”

গুনে গুনে দশ মিনিট সময়ে বেরিয়েছে গাড়ি নিয়ে। এখান থেকে কাউন্টার এর দুরত্ব প্রায় ত্রিশ মিনিট এর।ফাহাদ, সাইফা আর শাবাব।আজ ড্রাইভিং এর দায়িত্ব সাইফার হাতে নয় শাবাবের হাতে।গতি অধিক।সম্ভব হলে উড়িয়ে নিয়ে যায় গাড়ি। সৌভাগ্যজনকভাবে রাস্তা ফাঁকা।কোনো গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে।এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে এগিয়ে চলতে লাগলো গন্তব্যে।ত্রিশ মিনিটের রাস্তা বিশ মিনিটে গিয়ে হাজির।ফিরোজ হাতের ইশারায় বাস কাউন্টার দেখিয়ে দিলে তারা তিনজন স্বাভাবিক হয়।সাধারণ মানুষের মতন হেঁটে গিয়ে বাস কাউন্টারে প্রবেশ করলো। মুখে মাস্ক।

শাবাব রুবির পাশের সিটে আরাম করে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে।বুকে হাত ভাজ করে ধীর গলায় বলে উঠলো,

-“পালানো হচ্ছে নাকি?”

হৃদয় কেঁপে উঠে রুবির।মাথা এদিক ওদিক করে চোখ গেলো পাশে বসে থাকা পুরুষের উপর। সার্জিকাল মাস্ক এর উপর ক্ষুদ্র তীক্ষ্ম চোখজোড়া ভয় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। কাঁধের ব্যাগ জাপ্টে ধরে পালানোর চিন্তা করে।সুযোগ বুঝে উঠে দৌঁড়াতে চাইলে সাইফা তার হাত টেনে ধরলো শক্তভাবে। কাউন্টারে উপস্থিত মানুষের চোখ নাক সজাগ হয়েছে।মুখ থেকে মাস্ক সরায় শাবাব।রুবি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় অনবরত।তবে সাইফার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাত থেকে রেহাই পেলো না।

শাবাব পরিস্থিতির বিপরীতে সাইফার দিকে চেয়ে বলল,

-“বাহ!তোমার হাতে দেখি ভালো শক্তি আছে অফিসার সাইফা”

অবাক চোখে চাইলো সাইফা।মশকরা করার মানুষ শাবাব নয়। তারপরও করছে।কঠিন গলায় আবার বলে উঠে,

-“তারিফ করেছি বলে ঢিল ছেড়ে দিও না।একে গাড়িতে তোলো।”

সুনাম আর অপমান দুটোর পারফেক্ট ব্যালেন্স। শাবাব ছাড়া আর কেউই পারবে না।গাড়িতে ওঠানো হয় রুবিকে।দ্বিতীয় ধাপে সফল মনে হলো শাবাবের। রুবির কাছ থেকেই প্রফেসর এর অজানা রহস্য জানা যাবে।সাথে আনাম এরও।শিশুদের জ্ঞান অর্জন আর বৃদ্ধদের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আশ্রমে রয়েছে একটি ছোট্ট লাইব্রেরী।বন্ধ পড়ে থাকে প্রায়ই।কে জানে আশ্রমের বাচ্চা আর বৃদ্ধদের কি এমন শত্রুতা বইয়ের সাথে।পিছনের গেট বেয়ে রুবিকে আনা হয়েছে এখানে। লাইব্রেরী এর চেয়ারে তাকে বসতে দিয়ে শুরু হলো প্রশ্ন উত্তর পর্ব।

শুরুটা রবিন করে।বলে,

-“কি লাভ হলো পালিয়ে?অবশেষে ধরা পড়েছেনই।এবার কোনো ঢং ব্যতীত সব সত্যটা বলবেন।”

শাবাব বলে উঠলো,

-“যদি সত্যিটা না বলেন তাহলে কিন্তু আমাদের লেডি অফিসার আছে আপনাকে আপ্যায়ন করার জন্য।….আমার অফিসারকে গুলি করে যেই দুঃসাহস দেখিয়েছেন।আপ্যায়ন ডিজার্ভ করেন আপনি”

রুবি নিশ্চুপ।মাথা নত তার। চোঁখ বেয়ে অনবরত টপটপ পানি পড়তে লাগলো। শাবাব আবার বললো,

-“কি শত্রুতা আপনার প্রফেসর রাজিন এর সাথে?”

রুবি এবারও নিশ্চুপ।রবিন বলল,

-“মুখ খুলেন রুবি আপনার নীরবতার শাস্তি ভয়ঙ্কর হবে।আপনি আমাদের মিথ্যে চিঠি দিয়েছেন।নিজেই চিঠি দিয়ে নিজেই গুলি করেছেন।কেনো?কারণ কি?”

রুবি ভাঙ্গা গলায় বললো,

-“কারণ আমি চাইনি কোনো পুলিশি ঝামেলা!”

-“কেনো চাননি?”

-“আমি সত্যটা বললে অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে স্যার!”

শাবাব বিপরীতে বললো,

-“কোনো বিপদ হবে না।সব বিপদ টেকেল দিবো আমরা।আপনি বলতে শুরু করুন”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে রুবি।বলতে শুরু করে,

-“আমি মাষ্টার্স ফাইনাল ইয়ার এর স্টুডেন্ট।এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করেছি।এখানেই মাষ্টার্স।পড়ালেখা শেষ এর পথে বলে নতুন রেস্টুরেন্ট শুরু করেছি।তবে এর আগেই আমি প্রফেসর রাজিন এর কাছে নানানভাবে উত্যক্ত হয়েছি।শুধু আমি নই অনেক মেয়েরা এর শিকার। বেশিরভাগ মেয়েরা চট্টগ্রামের বাহির থেকে এখানে এসে পড়ালেখা করে।কেউ সম্মানের ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে না।বাজে ইঙ্গিত থেকে শুরু করে পরীক্ষায় নাম্বার বেশি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মেয়েদেরকে কু প্রস্তাব দিতো।তাদের মধ্যে ভুক্তভুগী আমি নিজেও।আমাকে উনি বলেন তার সাথে আলাদাভাবে দেখা করতে।আমি ততদিন তার এসব কুকীর্তি সম্পর্কে জানতাম না কিছুই।আমাকে হোয়াটস অ্যাপে নক করে জানান তিনি আমাকে সি.আর হিসেবে বেছে নিয়েছেন।ক্লাসের বিষয়ে আলোচনা করবেন। প্রথমদিন আমার সাথে তার অফিস রুমে দেখা করেন।ক্লাসে জানান আমি আজ থেকে নতুন সি.আর।আমার সাথে পুরোনো সি. আররাও থাকবে।ধীরেধীরে ক্লাস সম্পর্কিত নানান কাজের জন্য আমার সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন।আমি একজন শিক্ষক হিসেবে সম্মান জানিয়েছি তাকে।তবে অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট এর মেয়েরা আমাকে বারবার সাবধান করতো তার ব্যাপারে।পুরো কথা কেউ বলতো না।তার অনেক ক্ষমতা স্যার!এক নিমিষে সব শেষ করে দিতে পারবেন তিনি।একটা স্টুডেন্ট এর ক্যারিয়ার।সম্মান!সব!”

গলা শুকিয়ে এসেছে রুবির।কান্নার জল শুকিয়ে গেছে প্রায়।তার কথা শুনতে থাকা সকলের মনোযোগ নড়চড় হয়।রবিন সাইফাকে ইশারা করলো এক পানি দেওয়ার জন্য। সাইফা দ্রুত পায়ে গিয়ে এক বোতল পানি এনে রুবির কাছে এগিয়ে দিলো।দুয়েক চুমুক দিয়ে রুবি হাতের পিঠে মুখ মুছে।

আবার বলতে লাগলো,

-“আমি তার মধ্যে তেমন কোনো খারাপ নজর ততদিনে দেখতে পাইনি।কিন্তু একদিন সে আমাকে সরাসরি তার বাসায় ডাকে। স্টুডেন্টদের এমন কিছু কাজের জন্য যেটা আমার কেনো তার দায়িত্বও না।তারপরও আমাকে একপ্রকার রাগী গলায় বলে আমি না আসলে আমাকে তার সাবজেক্টসহ সব সাবজেক্ট এ ফেইল করাবে। বিনা কারণে এমন হুমকির মুখে পড়ে আমি ঘাবড়ে যাই।ভাবতে থাকি যাবো কি যাবো না?ঠিক পাঁচ মিনিট পর আবার কল করেন।আমাকে বলেন বাড়িতে তার স্ত্রী এবং মেয়ে আছে।অহেতুক রাগ দেখিয়েছে আমাকে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন।আর দ্রুত আসতে বলেন।তার পাশাপাশি কলে তিনি তার স্ত্রীর আওয়াজও শোনান আমাকে।আমি ভরসা করি।সেদিন বিকেলে আমি তার বাড়িতে যাই।যা চিন্তা করে গিয়েছিলাম তার ঠিক উল্টো হয়।সেখানে তার স্ত্রী কেনো প্রফেসর রাজিন ব্যতীত আর কেউ ছিল না।সেদিন তার আসল রূপ আমার কাছে আসে।আমি বারবার জানতে চাই কি কাজ? কোথায় তার পরিবার।সে উত্তর দেয় না।বলে তারা বাহিরে গিয়েছে দশ মিনিট পর ফিরবে।আমাকে জ্যুস দেয়।আমি খেতে না চাইলে অনুরোধ করে বারবার।আমি দুয়েক চুমুক খাওয়ার পর অনেক সময় অপেক্ষা করি।তারপরও তার স্ত্রী পরিবার আসে না।কিন্তু আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো বারবার।আমি ঠিকঠাক মত কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।এক পর্যায়ে অর্ধ জ্ঞানে আমার মনে হয় সে আমার সাথে সাথে ধস্তাধস্তি করার চেষ্টা করছে।আমার দেহে যতটুক কুলাচ্ছিলো আমি ডিফেন্ড করি।এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম।আমার হুশ ফিরেছে রাত দশটায়।উঠে আমি দেখি…..আমার অবস্থা নাজেহাল।আমি বেরিয়ে যেতে চাইলে আমার চুলের মুঠি ধরে প্রফেসর।বলে আজকের ঘটনা কেউ জানলে খারাপ হবে।আমার ছবি সবাইকে দেখিয়ে দেবে।”

অনবরত সকল কিছু বলে যাচ্ছে রুবি।সবটা রেকর্ড হচ্ছে।তার জবানবন্দী দরকারি।সন্দেহ আছে থেকেই ছিলো প্রফেসরের উপর।এতটা জঘন্য হতে পারে সে কেউ ভাবতেও পারেনি। সাইফা আর শাবাব নিজে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের সাথে কথা বলেছে। ইনফরমেশন নেওয়ার চেষ্টা করেছে।কেউ মুখ খোলেনি।

রবিন বলল,

-“আমাদের অফিসার এর উপর গুলি ছুঁড়লেন কেনো?”

-“সবকিছুই বাধ্য করা হয়েছে আমাকে।প্রফেসর তার একজন পরিচিত ছেলেকে দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করিয়েছেন।”

-“ইমপসিবল!প্রফেসর আমাদের নজরদারিতে আছেন।” বললো শাবাব।

-“ওই ছেলেকে আমার পেছনে লাগিয়েছেন অনেকদিন।হয়তো আপনাদের দৃষ্টির আড়ালে সে কোনোভাবে তাকে দিয়ে আমার সব ইনফরমেশন রাখছে।”

রবিন প্রশ্ন করলো,

-“আমি ঢাকা গিয়েছিলেন কেনো?”

-“আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি।ঢাকা গিয়ে আমার ফ্রেন্ডকে সব জানাই।সে আমাকে কিছু টেস্ট করতে বলে।টেস্ট করে জানতে পারি সৌভাগ্যবশত আমার কোনো ক্ষতি হয়নি।সে শুধুই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে।আপনার অফিসারদের আমি হাসপাতালের বাহিরে দেখেছি।সাথে ওই ছেলে সব জায়গায় চোখ রাখছে আমার উপর।আমাকে বাধ্য করে ওই ছেলেটা কল করে।জানায় আপনারা আমাকে খুঁজছেন।আমি উপায় না পেয়ে কক্স বাজার আসি।আমার আরেক বন্ধুর বাসায়। মিথ্যে চিঠি পাঠাতে বলে।আমি কাউকে না পেয়ে ফিরোজকে পাই।টাকা দিয়ে কাজ করাই।আমার কাছে গান পাঠায় ওই ছেলেকে দিয়ে।আপনাদের অফিসার এর পিছু নেয় সে।এরপর আমাকে দিয়ে শুট করায়।পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পূনরায় ঢাকা ফিরে যাবো।কিন্তু এর আগেই আপনারা!”

চুল খামচে ধরেছে শাবাব।একটার পর একটা ঝামেলা বেড়েই চলেছে।একজন খুনিকে খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে আরো আরো অপরাধ।

শাবাব আবার প্রশ্ন করলো,

-“সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনি ছিলেন?যে প্রফেসর এর খাবারে বিষ মিশিয়েছে?”

-“বিষ মিশিয়েছে?”

-“আপনি জানেন না এসব?”

অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে রুবি বলল, -“না স্যার!”

-“কেনো বিশ্বাস করবো?আপনি প্রফেসর এর থেকে প্রতিশোধ নিতে বিষ মিশিয়েছেন!আপনি তাকে মারতে চেয়েছেন।হতে পারে আপনি একের পর এক খুন করে যাচ্ছেন।অথবা অন্য কাউকে দিয়ে করাচ্ছেন।আনাম নামী কাউকে দিয়ে?আপনার রেস্টুরেন্টে যখন প্রফেসর আসে তখন তাকে মারতে চেয়েছেন কোনো না কোনোভাবে।তাই না রুবি?”

রুবি পুনরায় বললো,

-“আমি এমন কিছুই করিনি স্যার!আমি ঢাকার জন্য রওনা হই রাত আটটায়।এর মাঝে আমাকে আমার ম্যানেজার কল করে।আমি ব্ল্যাকমেইল এর ভয়ে বলি তাকে আপ্যায়ন করতে।আর আমি কোথায় আছি সেটা না বলতে।ফোনটা অফ করে দেই।মাঝেমধ্যে দরকারে অন করতাম।”

রবিন বলল,

-“যখন অন করেছেন তখনই আপনার আরেক লোকেশন ট্র্যাক করি আমরা।”

নিজের পক্ষ হয়ে রুবি বললো,

-“সেটা আমি জানতাম না স্যার।আমি শুধু জানতাম পুলিশের কেস হয়েছে।কেনো হয়েছে সেটা আমার জানা ছিলো না স্যার।বিশ্বাস করুন আমায়!”

-“আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছি না আমরা এখনো। এভিডেন্স চাই মিস রুবি!” বলে শাবাব উঠে দাঁড়ায়।

এতোটা কড়া সিকিউরিটি এর পরও কি করে প্রফেসর যোগাযোগ করলো ওই ছেলের সাথে!এই ভেবে মাথা দাউদাউ করে জ্বলছে শাবাবের।কল মেলায় চট্টগ্রাম।গলার উচ্চ আওয়াজে কেঁপে উঠলো সকলে।

শাবাব সিকিউরিটিতে থাকা অফিসারকে বললো,

-“ডিউটিতে কি করো ঘুমাও!নাকি মশা মারো!প্রফেসর কি করে যোগাযোগ এর সুযোগ পায়!”

অন্যপাশ থেকে জবাব আসে,

-“স্যার প্রফেসর এর ফোন আমাদের কাছে।সে কিভাবে কারো সাথে যোগাযোগ করবে?”

ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে শাবাব।সেখানে উপস্থিত সকলে নিশ্চুপ।মুখ চলছে শাবাবের।কপালে রগ ফুটে উঠেছে।হাত মুঠ করায় হাতের রগও স্পষ্ট বোঝা গেলো।

বললো,

-“ওর ফ্যামিলির কল,মেসেজ সব রেকর্ড পাঠাও আমাকে।ইউ হ্যাভ ওনলি ওয়ান আওয়ার। ডু ইট ফাস্ট!”

শাবাব ঘুরে তাকালো রুবি আর বাকিদের দিকে।আদেশ ছুড়লো,

-“ওনার সাথে তুমি থাকবে সাইফা।আরো যত ইনফরমেশন নেওয়ার নাও।ফাহাদ! চট্টগ্রাম থেকে রিপোর্ট আসার সাথে সাথে প্রফেসর এর চ্যালাকে খুঁজতে বের হবো।রেডি থাকবে।নাও লিভ!”

একে একে সকলে বেরিয়ে গেছে। সম্পূর্ণ লাইব্রেরী রুমে একাকী রয়ে গেলো শাবাব।রাগ মস্তিষ্ককে কাজ করা থেকে বিরত রাখছে। বারবার একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।একটি প্রবাদে শব্দের পরিবর্তন করে।রক্ষক এর পরিবর্তে যোগ হয় শিক্ষক যোগ হয়।‘শিক্ষক যখন ভক্ষক’। শিক্ষাদানের আড়ালে এত নিকৃষ্টতম কাজ? ঘৃণায় শরীর রিরি করে উঠলো।নিজেকে একটু ঠাণ্ডা করা দরকার।সবার অজান্তে শখ পেলেছে শাবাব।বই পড়ার।আইনি বই নয় উপন্যাসের বই। লাইব্রেরীতে আছে।উঠে দাঁড়ায় শাবাব।বাহিরে লিখা ছিলো “শূন্যের লাইব্রেরী সকলের জন্য উন্মুক্ত” সেই কথা স্মরণে রেখেই শেলফে বই খুঁজতে লাগলো নিজের মন মত।শেলফ এর উপরিভাগে হাত রাখতেই একটি পুরোনো ধুলোমাখা ফাইল গায়ের উপর পড়ে শাবাবের।কাগজ ছড়িয়ে পড়েছে নিচে।জমিন থেকে তুলে ঝাড়া দিতেই চোখে স্পষ্ট ভাসলো কিছু লেখা।

ঠিক তখনই লিয়ানা এসে হাজির।এসেই প্রশ্ন করলো,

-“কাজ শেষ হয়ে থাকলে বেরিয়ে আসুন।আমি লাইব্রেরী বন্ধ করবো”

লিয়ানার কথা যেনো শুনেও শুনলো না শাবাব।ফাইলের দিকে চোখ সরিয়ে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখলো।বললো গুরুগম্ভীর স্বরে,

-“তাহলে এই আপনার আসল পরিচয়! বহিষ্কৃত ইন্সপেক্টর লিয়ানা!”

চলবে…
“আ না ম”- ১২
-Azyah সূচনা

-“তাহলে এই আপনার আসল পরিচয়! বহিষ্কৃত ইন্সপেক্টর লিয়ানা!”

ফ্যাকাশে মুখমণ্ডলে রাগের আভাস দেখা গেলো। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে।চোখ নামিয়ে দৃষ্টি রেখেছে ফর্সে।একহাত দরজায় রেখে শক্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে লিয়ানা। প্রশ্নবিত্ত শাবাবের কাছে।অপরিচিত একটা মানুষের সামনে অতীতের কিছু খসড়া কাগজ। যার কথা হয়তো ভুলে গিয়েছিল।নয়তো এখনও মনে আছে।কে জানে?জানে শুধু লিয়ানার হৃদয়।

শাবাব দুয়েক কদম এগিয়ে এলো। কাগজগুলো লিয়ানার মুখের সামনে ধরে বললো,

-“বলছেন না যে?”

চোয়াল শক্ত করে লিয়ানা জবাব দেয়,

-“কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে এত নাক গলাতে নেই।”

-“কেনো?অবশ্যই আপনার বহিষ্কৃত হওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে!”

-“আপনি কারণ জেনে কি করবেন?”

-“আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কি করবো?আফটার অল একই বিভাগের লোক আমরা।এসব বিষয়ে আমাদের ইন্টারেস্ট বেশি থাকে।কেনো জানেন না!”

শাবাব পুনর্বার বলে উঠে, -“এই ফাইলের বাকি অংশ গায়েব।যেখানে হয়তো আপনার বহিষ্কৃত হওয়ার কারণ লেখা ছিল।…কোনো না কোনো বিশাল কারণ অবশ্যই আছে লিয়ানা!”

বিনিময়ের নীরবতায় নিষ্ফল হাসে শাবাব।লিয়ানার দৃষ্টির অগোচরে।তবে হাসির মৃদু আধ্বান লিয়ানার কানে এসে বারি খেয়েছে।নিজেকে দমাতে পারলো না।ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে শাবাবের দিকে।ক্রোধ ঝড়ছে লিয়ানার সর্বাঙ্গে।বেশ বুঝেছে শাবাব।লিয়ানা তার সামনে এক পা পিছু হটবে না তাও খুব করেই জেনেছে তার সল্প সময়ের আচরণে।

শাবাব বললো,

-“এই শেওলা পড়া চোখের সব রহস্য আমি জানবো”

__

বিষাদকে হৃদয়ে জায়গা দিতে ইচ্ছুক নয় লিয়ানা।খুব করে চেষ্টা করছে।সরে যাক। বরাবর মুখের ভঙ্গি বদলাচ্ছে।যুদ্ধ করছে।অতীতের বিষাদ যেনো কোনো রূপে ফিরে না আসে।কিসের অতীত!কোনো অতীত নেই।নেই কোনো পিছুটান।যা আছে এখানেই আছে।চক্ষু সম্মুখে।তার আশ্রম তার সাথে থাকা তার কল্পনারা।আর কিছুই নেই তার এই ইহজগতে।

মির্জা অনেক সময় যাবৎ অপেক্ষা করছে। শাবাবের মুখ থেকে যা শুনলো সেটা কি সত্য?তাই জানতে এসেছিল এখানে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে মির্জা বললো,

-“মিস লিয়ানা?”

লিয়ানা আকাশের দিকে চেয়েই উত্তর দেয়,

-“হুম”

-“কি ভাবছেন?”

দৃষ্টি নামিয়ে লিয়ানা উত্তর দিলো,

-“অজানা পথে হারিয়ে,চলা আমি সবুজ বনে।স্বপ্নের রাজ্যে পাহাড়ে,ভ্রমণ করি অতীতের সনে।”

এমন ভারী গলায় ছন্দ সুন্দর শোনালো।মির্জা হেসে বলল,

-“বেশ বলেছেন।”

মির্জার দিকে গাঢ় দৃষ্টিপাত করে লিয়ানা বলে উঠে,

-“কেনো দ্বিধায় ভুগছেন?যা জানতে এসেছেন বলুন।”

-“আপনি বলুনতো আমি কি ভাবছি?”

-“কিভাবে আমাকে প্রশ্ন করবেন?আমার অতীত জানতে চাইছেন।আপনি আমার অস্বাভাবিক মানসিকতার চিকিৎসা করতে চাইছেন।জানতে চাইছেন আমার সম্পর্কে।”

মির্জা স্বল্প বিস্মিত হলো।লিয়ানার বলা কথাগুলো সঠিক।এটা শুধুই অনুমান নাকি অন্য কিছু?নাকি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে?মির্জা শান্তভাবে হ্যান্ডেল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বলে,

-“আপনি দেখছি মানুষের মন পড়তে জানেন? অন্তর্যামী নাকি?”

মুখখানা মলিনতায় ভরপুর।চোখ ভেসে উঠেছে।সামান্য ঘাড় বেঁকিয়ে লিয়ানা বললো,

-“আপনাদের ভাষায় মেন্টালিস্ট হতে পারি”

মির্জা মৃদু হেসে উত্তর দেয়,

-“আমাদের ভাষায় এম্প্যাথি বলে একে।….আর আপনার মধ্যে আমি সেটা দেখতে পাই।খুব মনোযোগ দিয়ে আপনি অবজার্ভ করেন মানুষকে।আপনার চোখ দেখলে সেটা বোঝা যায়।তাদের ভাবনা বুঝেন।তার কথা শুনেন।যেহেতু এম্প্যাথি শব্দটা সহানুভূতি এর সাথে জড়িত।আমি বলবো আপনার সহানুভূতিশীল হৃদয়টাও আছে।নাহয় কেনো এই আশ্রমে এত মানুষ?এত সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছে?”

লিয়ানা উত্তরে হেয়ালি করে বললো,

-“মানুষের মনেরও কত বিজ্ঞান তাই না?”

-“তাতো বটেই…তা আপনি যেহেতু জেনেই গেছেন আমি আপনাকে কি প্রশ্ন করতে চাই।তাহলে বলুন?কেনো আপনাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।”

লিয়ানা উঠে দাড়ায়।চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।যাওয়ার পূর্বে বললো,

-“এগুলো আপনার বাক্য না এটাও জানি।আপনি অফিসার শাবাবের বুলি বলছেন।তারই শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া সব।সে একবারে হার মেনে নিলো?আপনাকে পাঠালো জানতে?অথচ সে আমায় বলেছিলো শেওলা পড়া চোখের রহস্য সে নিজে জানবে।”

__

সাইফার কাছে প্রফেসর রাজিন এর পরিবার এর কল আর মেসেজ লিস্ট এসেছে।প্রিন্ট করানোর সাথেসাথে শাবাবের কাছে হাজির হলো।ল্যাপটপে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে করতে শাবাবের চোখে পড়ে আরো একটি ছেলে। এতদিন যে প্রফেসর এর হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো।রুবিকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো।বাসের টিকিটে এতটুকু প্রমাণ হয়েছে রুবি সেদিন রাত দশটার আগেই চট্টগ্রাম ত্যাগ করে।সাইফা অপেক্ষায়।কখন কাগজটি তুলে দিবে তার হাতে।

দৃষ্টি ল্যাপটপ স্ক্রিনে রেখেই হাত উঁচু করে শাবাব। ইঙ্গিত করে কাগজটি তাকে দেওয়ার জন্য। সাইফা ঝটপট এগিয়ে দিলো।

ল্যাপটপের দিকে পূর্ণ মনোনিবেশকৃত শাবাব ঝুঁকে বসে আছে।কপালে বলিরেখা ফুটে আছে স্পষ্ট।ক্ষুদ্র চোখে জুম ইন,জুম আউট আর পজ করতে ব্যস্ত।অন্যহাতে কাগজে প্রত্যেকটা ছোটোখাটো বিষয় লিখে লিখে রাখছে। সাইফার দেওয়া কল লিস্টটাও চেক করে নিলো কয়েকবার।লাল কালির কলমের নিপ মুখে আটকে মার্ক করে রাখলো কল লিস্টের কিছু নাম্বার।প্রত্যেকটা বিষয়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সাইফা।দুজনই মনোযোগী ভিন্ন দুটো কাজে।

-“দেখা শেষ নাকি আরো দেখবে?”

শাবাবের প্রশ্নে নড়েচড়ে উঠে সাইফা।প্রশ্নের বিপরীতে বললো,

-“কি বললেন স্যার ঠিক বুঝলাম না?”

-“আমাকে দেখা শেষ নাকি আরো দেখবে?সেটা জানতে চাইছি।”

আমতা আমতা স্বরে সাইফা জবাব দিলো,

-“আমি আপনাকে দেখছিলাম না”

মুখ তুলে চাইলো শাবাব।মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো।আর বললো,

-“আমি ব্যতীত এখানে কেউ নেই।তাহলে কি আমি ধরে নিবো তুমিও ওই শেওলা ভূত এর মতন পাগল? হ্যালুসিনেট করছো?”

-“শেওলা ভূত,পাগল?….আপনি কি লিয়ানার কথা বলছেন স্যার?”

-“পাগল আর কয়টা আছে এই আশ্রমে?”

কাটকাট গলায় সাইফা বললো, -“এমন কিছুই না স্যার।”

শাবাব আবারো মাথা ঝুকায়।বলে,

-“আমার মুখ দর্শন শেষ হলে এস. আই রবিনকে ডাকো।”

-“রবিন স্যার ফাহাদকে নিয়ে সার্চ করতে গিয়েছেন।ওই ছেলের লাস্ট লোকেশনে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাবাব বলে উঠে, -“তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হ্যালুসিনেট করতে থাকো!”

মনের ভাবনায় এলো ‘আপনার মুখটা কোনো হ্যালুসিনেশনের চেয়ে কম নয়।আপনার মতন রুক্ষ মানুষটাকে কেনো আমার ভালো লেগে যাচ্ছে?’।পরপর আরো এক ভাবনা এসে হাজির ‘আপনি একটা ইতর প্রজাতির লোক জানেন?ভালোভাবে কথা বলাটাও শিখেননি’।পড়ে আবার মনে হলো এর চেয়েতো লিয়ানা ভালো।মেয়েটা চোখ পড়ে বুঝে নেয় কার মনে কি? যার বোঝা উচিত সেই বুঝে না।

শাবাব চোখ তুলে তাকালে উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করে সাইফা।বিড়বিড় করতে করতে চলে যায় ক্যান্টিনের দিকে।বিশাল আয়োজন হচ্ছে এখানে।রান্না করছে সকলে মিলে।এখানে কোনো রাধুনী নেই।অর্ধ বৃদ্ধ নারী পুরুষরা ডেকচি সামলাচ্ছে। বাকিরা কাটাকুটিতে ব্যস্ত।বাচ্চাদেরও কি ভালো শিক্ষা।খুব উৎসাহ নিয়েই টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে।এমন দৃশ্যে মুগ্ধ হলো সাইফা।

সামনেই লিয়ানাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। রামশাও তার সাথেই আছে।

গিয়ে বললো, -“কি করছো?”

রামশা উত্তর দেয়, -“তোমাদের জন্য টেবিল সেট করছে লিয়ানা।”

আলাদা চারকোনা টেবিল দেখে সাইফা বললো,

“আলাদা কেনো?একসাথে খেতাম?”

লিয়ানা কাজ করতে করতে বলল, -“তোমরা আমাদের গেস্ট তাই বিশেষ ব্যবস্থা”

-“তারপরও!”

-“ব্যাপার না সাইফা।সবাইকে ডেকে আনবে?”

রামশা বললো, -“আমার মহাশয় এসে গেছেন হয়তো।তাকে আমি ডাকছি।”

রামশা চলে গেলো বলার পরপরই।লিয়ানা সাইফার দিকে চেয়ে বলল,

-“তোমার মহাশয়?”

লজ্জায় চোখ নামায় সাইফা।মুখে বাঁধলো না এই কথাটি বলতে? মহাশয় না ছাই! সাইফা বললো,

-“আমার মহাশয় নেই কোনো।যদি শাবাব স্যারের কথা বলে থাকো তাহলে আমি ওনার সামনে যাবো না।অযথা ক্যাটক্যাট করে।তুমি যাও তাকে তুমিই পারবে টেকেল দিতে।”

-“তুমিই যাও সাইফা।আমি বাকিদের ডাকছি।”

-“না না আমাকে চোখ রাঙানি দিয়েছে একটু আগে।আমি মির্জা স্যার,ফাহাদ আর আবির স্যারকে ডাকছি। তুমি যাও যম এর কাছে।”

লিয়ানা বাঁকা হাসে।সে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখে না শাবাবকে।হয়তো তার প্রতি অনুভূতি আছে বলেই সাইফার এই অবস্থা। নির্দ্বিধায় হেঁটে গেলো।দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দেয়।

শাবাব মুখ তুলে চেয়ে বললো, -“কি?”

-“খাবার দেওয়া হয়েছে”

-“আসছি”

-“এখানে সবাই দশটার মধ্যে খাবার খায়”

-“বললাম তো আসছি।”

“পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসুন”

লিয়ানার চলে যাওয়ার পানে চোখ রসগোল্লার মতন করে চেয়ে আছে শাবাব।প্রচুর তেজ!ঠান্ডা স্বভাবের আড়ালে ভীষণ জেদি। শাবাব উঠে হাঁটতে লাগলো খাবার ঘরের দিকে। নেহাতই সাহায্য করেছে আর এটা তার ব্যুরো না।নাহয় একদফা দেখে নিত এই মেয়েকে!

লম্বা টেবিল দুটোয় সব আশ্রমের মানুষ খাওয়া দাওয়া করছে।পালাক্রমে খাবার সার্ভ করার পর্ব চলছে।পিছিয়ে নেই লিয়ানাও।সবাইকে খাবার নিজ হতে তুলে দিতে থাকে।মুখখানা গম্ভীর।চুপচাপ।বিনাবাক্যে কাজ করা যায়?সে হয়তো পারে।একে একে সকল অফিসাররা হাজির হলে লিয়ানা তাদের জন্য বরাদ্দ টেবিলের দিকে নিয়ে গেল।রুবিকে তাদের সাথেই রেখেছে। সাইফা তার উপর বিশেষ নজরদারি করছে।অপরাধীর নজরে দেখলেই মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পিছুপা হয়নি কেউই।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হলে রামশা বললো, -“তুমিও চলে এসো লিয়ানা”

-“আমি পড়ে খাবো।তোমরা শুরু করো”

সবার মাঝে রুবি খেতে পারলো না।খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে চুপচাপ।যখন থেকে এখানে আছে ঠিক তখন থেকেই নিশ্চুপ সে।মুখে বিষাদের ছায়া। হঠাৎ বলে উঠলো,

-“আমার পরিবারকে প্রটেকশন দিবেন বলেছিলেন স্যার?তারা ঠিক আছেতো?আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন!….অথচ সেখানে”

-“এতদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন পরিবারের খেয়াল ছিলো না?” রবিন খেতে খেতে প্রশ্ন করলো।

-“বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিছু করিনি।আপনাদের সব হুমকি ভরা মেসেজ দেখিয়েছি।টিকিটের কাগজ আমার মেডিক্যাল ডকুমেন্ট সব দিয়েছি আপনাদের।তারপরও কেনো বিশ্বাস করছেন না?আমি নিজে ভুক্তভুগী স্যার।আমি হামলা চালাইনি প্রফেসরের উপর!নাই কেউ জানে এই বিষয়টা!আমার আড়ালে কে তাকে মারতে চেয়েছে?আদৌ আমার জন্য কেউ এতবড় স্টেপ নিয়েছে কিনা তাও জানা নেই।আমি প্রফেসরের কৃতকর্ম ফাঁস করতে চাই। শিক্ষকতার আড়ালে সে এসব করে বেড়াচ্ছে আমি সবটা সমাজের কাছে তুলে ধরতে চাই।এতদিন সাহস পাচ্ছিলাম না।আমি আশা করি আপনারা আমাকে হেল্প করবেন।অন্য কোনো মেয়ের জীবন নিয়ে যেনো খেলতে না পারে এই লোক!পাশাপশি আমার বাবা মা বৃদ্ধ।তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন”

শাবাব জবাব দেয়, -“আপনার পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।ডোন্ট ওয়ারি।”

লিয়ানা এসে বসলো।ঠিক দুরত্বে চেয়ার টেনে।পূর্বের তদন্তকারী মস্তিষ্ক জেগে উঠছে হয়তো।বরাবর রুবির দিকে চেয়ে বলল,

-“আমি জানি না আপনারা কি কেস নিয়ে কথা বলছেন।আপনার কথার ধাঁচে আন্দাজ করে পরামর্শ দিচ্ছি। অফিসাররা যা করছে করতে দিন।তাদের কথা মতন চলুন”

শাবাব এখানেও ব্যঙ্গ করে বললো, -“ওনার অ্যাডভাইজ নিয়ে নিন।উনি আবার ফ্রি অ্যাডভাইজার”

উপস্থিত কারোই শাবাবের এমন কথা পছন্দ হয়নি।মুখের ভঙ্গিতে স্পষ্ট।কে জানে লিয়ানার সাথে কি এমন সমস্যা তার!দু মেরুর দুই মানুষ।লিয়ানা বিরক্ত করার পাত্রী নয়। শাবাবই পায়ে পাড়া দিয়ে আসছে যুদ্ধ ময়দানে।মুখ শক্ত করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লিয়ানা।কেউ কোনো কথা বলেনি।দুজনের একে ওপরের জন্য ধারালো দৃষ্টি শুধু দেখেই যাচ্ছে।

__

-“আজ থেকে চার বছর আগে মানসিকভাবে অসুস্থ এক লেডি অসিফারকে বহিষ্কার করা হয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ থেকে। তাছাড়াও তার অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তার বহিষ্কারের অন্যতম কারণ এর মধ্যে একটি।আরো কিছু কারণ উল্লেখিত পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।আমার জন্য এতটুক জানাই যথেষ্ট”

গিটারের টুংটাং শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজের সাথে যুক্ত হয় আরো একটি কন্ঠস্বর। এতদিনে এই গলার আওয়াজটা আয়ত্তে এসেছে।শখের জিনিসে আঘাত করে না লিয়ানা।তবে ইচ্ছে হচ্ছিলো জোরেশোরে ছুঁড়ে ফেলতে গিটারটাকে।

হাতে একটি কাগজ নিয়ে শাবাব এগিয়ে এসে বলল,

-“বলেছিলাম না শেওলা পড়া চোখের রহস্য বের করবো? খুবতো মির্জাকে বলেছিলেন।আমি তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছি।আমি নিজে পারি না বের করতে?….কয়েক ঘন্টায় খবর নিয়ে ফেলেছি।এই কাগজটা তারই প্রমাণ।”

লিয়ানা হাত এগিয়ে দেয় কাগজটি নেওয়ার উদ্দেশ্যে। শাবাবও বিনা শব্দে এগিয়ে দিলো। কাগজটি স্পর্শ করার পূর্বেই তৎক্ষনাৎ সরিয়ে ফেলে শাবাব।

লিয়ানা বললো, -“কাগজটি দিন”

-“আমিতো দিচ্ছি।আপনিই নিতে পারছেন না।”

উচ্চতার সুযোগ নিয়ে হাওয়ায় তুলে রাখে কাগজটি।হাত তুলে রাখলো উচুঁতে। নাগাল যেনো না পায়।লিয়ানা চুপ রইল। অতটা খাটো নয় সে।যতই হোক সাবেক ইন্সপেক্টর।তবে শাবাবের উচ্চতা তার চেয়ে একটু বেশিই।কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না লিয়ানা। শাবাবের ধ্যান সরলে তার হাত পেঁচিয়ে ধরলো ধরে বিদ্যুতের গতিতে।ঘুরিয়ে পিঠের দিকে শক্ত করে চেপেছে। বিমূঢ় হয়ে পড়ে শাবাব কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

পেছন থেকে ভারী গলায় বললো, -“পেশা ছেড়েছি!তবে এখনও ওই বুদ্ধি আর বল দুইটাই আমার মাঝে বিদ্যমান।”

শাবাবের যেনো কিছু যায় আসেনা।হেসে বললো,

-“আমি বল প্রয়োগ করা শুরু করলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে!”

-“আই নো ইউর নেক্সট মুভ!”

-“অ্যান্ড এই নো হাউ টু ডেফিট ইউ!”

নিজের পারদর্শিতা দেখিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শাবাব। লিয়ানাকে ঠেলে দিলো ছাদের একদম কোণায়।লিয়ানার হাতের কব্জি সামান্য ঢিল দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে বললো,

-“ফেলে দেই?”

চলবে…..গল্পের