যতনে রাখিবো পর্ব-১৭+১৮

0
202

#যতনে_রাখিবো
Jerin Akter Nipa
১৭
তাথৈয়ের চালচলন দেখে তানিয়ার সন্দেহ হচ্ছে। সত্যিই কি এরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে বলে বিয়ে করেছে? এদের বিয়েতে আদোও ভালোবাসা আছে? অভয় তাথৈয়ের পরিবারের সকলের সাথে খুব ভালো ভাবে কথা বলছে। অভয় বাবাইকে পাশে বসিয়ে হেসে হেসে গল্প করলে নূর এসে বাবাইয়ের হাত ধরে টানতে লাগল।

-এই বাজে ছেলে, আমার মামার সাথে কেন বসেছ তুমি? ওঠো। তোমার মামা নেই?

নূরের এমন কাণ্ড দেখে অভয় ঠোঁট কামড়ে হাসছে। মামার ভাগ কাউকে দিতে রাজি না নূর। বাবাইও কম না। জেদও অভয়ের কাছ থেকে উঠবে জেদ ধরে বসে রইল।

-আমি কেন উঠবো? এটা আমার আঙ্কেল।

-তোমার আঙ্কেল না৷ এটা আমার মামা।

তাথৈ পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। আন্ডা দুটাকে মামা/আঙ্কেল নিয়ে ঝগড়া করতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ তাথৈয়ের মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো। সে দু’জনের ঝগড়ার মাঝে হাত ঢুকিয়ে বলে উঠল,

-এই পোলাপান! বাবারে বাবা। এত ঝগড়ুটে তোমরা! তা কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে শুনি?

নূর আগে বলে উঠল,

-মামনী দেখো এই পাঁজি ছেলে আমার মামার সাথে বসে আছে।

বাবাইও খালামনির কাছে বিচার দিয়ে বলল,

-আমি আমার আঙ্কেলের পাশে বসেছি খালামনি। এই ঝগড়ুটে মেয়েটা কেমন করছে দেখো।

তাথৈ দুই পক্ষের অভিযোগই শুনেছে। অভয় নিশ্চুপ বসে থেকে দেখছে তাথৈ কী বলে। গালে হাত দিয়ে তাথৈ কতক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল,

-এটাই সমস্যা তো? নূরেরও একটাই মামা। আর বাবাইয়ের আঙ্কেলও একজনই। এখন চাইলেই একজনকে তোমরা দু’জন নিতে পারবে না। কিন্তু উপায় একটা আছে।

-কী উপায় মামনি?

-উম.. এক কাজ করলে কেমন হয় নূর, তোমার মামাকে মাঝখান থেকে কেটে দু’ভাগ করে একভাগ তুমি নিয়ে যাও। অন্য ভাগ বাবাইকে দিয়ে দাও।

তাথৈয়ের মাথা থেকে বের হওয়া সমাধানের নমুনা দেখে অভয় হতভম্ব। বিয়ের দ্বিতীয় দিনই কি তাকে মার্ডার করতে চায়? বিধবা হওয়ার ভয় নেই?
তানিয়া দূর থেকে দু’জনকে একসাথে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো।

-যাক। ভালোবাসা না দেখালেও ঝগড়া করছে না।

হারুন তার চিন্তিত বউয়ের নাক টেনে দিয়ে বলল,

-মানুষ ভালোবেসে বউকে মায়াবতী ডাকে। আমার তোমাকে চিন্তাবতী ডাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।


অভয়ের আপকামিং মুভির শুটিংয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মুভির প্রথম অংশ বাংলাদেশে শ্যুট হলেও শেষ অংশ শ্যুট হবে প্যারিসে। অভয় সকালে বের হয় বাসায় ফিরতে ফিরতে কোনদিন রাত বারোটাও বেজে যায়। তাই পুরোটা সময় তাথৈকে বাড়িতে একা থাকতে হয়। নায়ককে বিয়ে করে কোনোদিক দিয়েই লাভ হয়নি। বরং জীবন তেজপাতার থেকেও খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে। না পারছে ভার্সিটিতে যেতে। আর না পারছে ফ্রেন্ড’দের সাথে ঘুরে বেড়াতে। হাফসা কক্সবাজার গিয়েছে। দিনে একশোটার উপরে পিক আপলোড দিচ্ছে। এর যন্ত্রণায় ফেসবুকেও ঢোকা যাচ্ছে না। ফেসবুকে না ঢুকলেও হাফসা তাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে? সমুদ্রে নেমে ভিডিও বানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে দিচ্ছে। তাথৈ ভিডিও না দেখলে কল করে মাথা খাচ্ছে।

-হাফ চা-র বাচ্চা! তুই যদি আর একবার আমার কাটা গায়ে নুন ছিটানোর চেষ্টা করেছিস তাহলে তোকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার এমনকি আমার জীবন থেকেই ব্লক দিয়ে দিব।

-আরে দোস্ত চিল। আমরা গরিব মানুষ। তাই কক্সবাজার এসেছি। তুই তো তোর নায়কের সাথে প্যারিস, লন্ডন যাবি। তখন তো আমাদেরও দেখতে হবে।

-তুই কি সত্যিই আমার বান্ধবী?

-ডাউট আছে তোর?

-তোর মতো বান্ধবী থাকার চেয়ে শত্রু থাকাও ভালো। ফোন রাখ শালি। আর জীবনে আমাকে কল দিবি না।

চার দেয়ালের মাঝে আটকা পড়ে তাথৈ ভীষণ ভাবে নিজের আগের জীবনকে মিস করছে। কেন বিয়ে করেছিল সে? সে না করলে তাকে নিশ্চয় কেউ জোর করতে পারত না। নিজের সুখের কপালে কুড়াল মেরে তাথৈয়ের এখন কান্না করা ছাড়া কিছু করার নেই।

—–
অভয় বাসায় ফিরে মাত্রই সোফায় বসেছে। আজকে ভীষণ ক্লান্ত সে। গা এলিয়ে বসে দু-হাত মাথার নিচে দেওয়ার জন্য তুলার সময় ডান হাতের ব্যথাটা টের পেলো। আজকে শ্যুটের সময় ব্যথা পেলে মনে করেছিল সামান্য ব্যথা কিছু হবে না। নোমান বলেছিল, স্যার হেলা করা ঠিক হবে না। ছোট ব্যথা বড় ব্যথার রুপ নিতে সময় লাগবে না। ছেলেটার সব কথা এরকম মিলে যায় কীভাবে?

-আমি আপুর ওখানে যাব।

অভয় হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সাথে সাথে উঠতে পারল না। ওভাবেই ঘাড় উলটিয়ে পেছনে দাঁড়ানো তাথৈকে দেখল। এই মেয়ের আবার কী হয়েছে? প্রতিদিন তো ঠিক থাকে। তাথৈয়ের রাগ অভয় বুঝতে পারেনি। সে তাথৈয়ের কথাটাকে সহজ ভাবে নিয়ে বলল,

-ঠিক আছে যেও। আপুর কাছে যাওয়ার জন্য আমার অনুমতি লাগবে?

-অনুমতি কে নিচ্ছে? আপনাকে জানিয়ে দিলাম।

তাথৈয়ের কন্ঠের রাগের আভাস এবার কিছুটা টের পেলো অভয়। সোজা হয়ে বসে তাথৈয়ের দিকে ফিরে বলল,

-ঠিক আছে।

-না ঠিক নেই। এক্ষুনি যাব আমি।

-এখন রাত হয়ে গেছে তাথৈ। কাল সকালে যেও।

-সকালে কেন? আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে। আমি এখনই যাব। আপনি আমাকে যেতে না দেওয়ার কে? আপনার কথা আমি কেন শুনবো? আমার কথা শুনে যেমন আপনি চলেন না ঠিক তেমনি আমিও আপনার কথা শুনে চলবো না। আমার যা মন চাইবে তা-ই করবো। যেখানে যেতে মন চাইবে যাব। এই জেলখানার জীবন আমি আর নিতে পারছি না।

রাগে কষ্টে তাথৈয়ের কান্না পাচ্ছে। এটা কোন জীবন হলো? ঘরের বাইরে পা দিলেই কোত্থেকে একঝাঁক মিডিয়া এসে মৌমাছির মতো ঘিরে ধরছে। বিয়েটা তো সত্যি না। নকল বিয়ের জন্য এত কষ্ট কেন করবে? তাথৈয়ের কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে অভয় কিছু ভাবলো। তাথৈ মনে মনে ঝগড়া করার জন্য ভালোভাবে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অভয় তাথৈকে নিরাশ করে সামনে রাখা টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে নোমানকে কল করলো।

-হ্যালো স্যার। আপনার হাতের ব্যথা কি বেড়েছে?

-না। নোমান এখন একবার আসতে পারবে?

-ঠিক আছে স্যার। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।

-হুম।

নোমান ভেবেছিল অভয়ের হাতের ব্যথা হয়তো বেড়েছে। স্যার ফোনে তাকে বলছে না। কিন্তু এখানে এসে ঘটনা অন্য কিছুই বুঝতে পারল। নিশ্চয় দু’জনের ঝগড়া হয়েছে। এখন কি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলেও মাঝরাতে তাকে ডেকে আনবে?

-নোমান তোমার ভাবীকে তানিয়া আপুর ওখানে দিয়ে আসো।

-কিন্তু স্যার…

অভয় কঠিন চোখে নোমানের দিকে তাকালে ভয় পেয়ে নোমান চুপ হয়ে গেল। তাথৈও ভাবেনি এত সহজে অভয় হার মেনে নিবে। তাই তার রাগ আরও বেড়ে গেল। রুমে গিয়ে এত বড় একটা সুটকেস গুছিয়ে বেরিয়ে এলো। নোমান তাথৈয়ের সুটকেসের দিকে তাকিয়ে ইশারায় অভয়কে কিছু বললো। অভয় তা বুঝলেও পাত্তা দিল না। তাথৈ অভয়কে কিছু না বলেই নোমানের আগে বেরিয়ে গেল। অভয়ও তাথৈকে আটকানোর কোন চেষ্টাই করল না। নোমান তাথৈয়ের জন্য গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিয়ে বলল,

-বসুন ভাবী।

সুটকেসটা পেছনে সিটে রেখে নোমান গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। তাথৈ যেটা চাচ্ছিল তা-ই হচ্ছে তবুও তার রাগ কমছে না কেন? নোমান আড়চোখে তাথৈকে দেখছে। কী নিয়ে দু’জনের ঝগড়া হয়েছে নোমান জানে না। কিন্তু এই কাজটা কি স্যার ঠিক করেছেন? বউ যেতে চাইলেই তাকে যেতে দিতে হবে? জোর করে আটকাতে পারলো না।

-ভাবী!

-হুম।

-গান চালাবো?

তাথৈয়ের গান শোনার মন না থাকলেও বলল,

-আপনার শুনতে মন চাইলে চালান।

নোমান আসলে তাথৈ রাগের পরিমাণ আন্দাজ করার জন্য গান চালানোর কথা বলেছিল। অর্ধেকের বেশি রাস্তা চলে এসেছে। তাথৈ এখনও চুপ করে বসে আছে। নোমান নিজে থেকেই বলল,

-একদিন শুটিং সেটে যাবেন ভাবী?

-কেন?

-কীভাবে শ্যুট হয় দেখবেন। স্যারকে শ্যুট করতে আগে কখনও দেখেছেন?

-আপনার স্যারকে দেখার আমার কোন ইচ্ছে নেই।

নোমান মনে মনে বলল,

-বাপরে! স্যার তো গেছেন। ভাবী এবার এক মাস আগে বাড়ি ফিরবে বলে মনে হয় না। যে পরিমাণ রেগে আছে!

-জানেন ভাবী, আজকে সেটে বাজে একটা ঘটনা ঘটেছে। অ্যাকশন সিনে শ্যুট করার সময় স্যার ট্রাকের উপর থেকে নিচে পড়ে গেছে। যদিও অ্যাকশন সিন গুলো খুব সেফটির সাথে শ্যুট করা হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা যেকোনো সময় ঘটতে পারে। বোঝাই যাচ্ছিল স্যার অনেক ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু আপনি তো জানেনই স্যার কেমন জেদি। আমি কত বলেছি ডক্টর দেখিয়ে নিন প্লিজ। সিরিয়াস ইনজুরি হতে পারে। কিন্তু স্যার আমার কোন কথা কানেই নিলো না। ওভাবেই পুরো শ্যুট শেষ করেছেন। দেখলেন না স্যার নিজে আপনাকে ছাড়তে না এসে আমাকে পাঠাল। আমি নিশ্চিত বলতে পারি স্যার ড্রাইভ করতে পারবেন না বলেই আমাকে পাঠিয়েছে।

নোমানের কাজ সে করে ফেলেছে। বাকিটা স্যারের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। বাকি পথ নোমান আর কিছু বলেনি৷ তাথৈও চুপ ছিল। তানিয়াদের বাড়ির সামনে এসে নোমান গাড়ি থামালেও তাথৈ নামছে না। তাথৈকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন সে। নোমান ডাকল,

-ভাবী!

-হুম।

-চলে এসেছি।

তাথৈ বাইরে তাকিয়ে দেখল গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি ফেরার জন্য কতটা ব্যাকুল ছিল সে তা শুধু তাথৈই জানে। কিন্তু এখন বাড়ির সামনে এসেও ভেতরে যেতে মন টানছে না। নোমানও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,

-ভাবী, রাত অনেক হয়েছে। এখন আপনাকে দেখে আপনার বোন খুশি হওয়ার বদলে টেনশন বেশি করবেন। আজ ফিরে যান ভাবী। প্রমিজ করছি। কাল সকালে আমি নিজে আপনাকে দিতে আসবো। এখন ফিরে যাই ভাবী?

খুব ক্ষীণ স্বরে তাথৈ বলল,

-হুম।

নোমান মনে মনে হাসল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ির পথে ছুটলো। স্যারের বিয়ে কোন সিচুয়েশনে হয়েছে নোমানের থেকে ভালো কেউ জানে না। দু’জনের মধ্যে ভালোবাসা কোনকালেই ছিল না৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দু’জনের মনেই একে অপরের প্রতি কিছু একটা তো জন্ম নিয়েছে। সেটা ভালোবাসা না হলেও মায়া অবশ্যই তৈরি হয়েছে। তাই তো ভাবী বাড়িতে এসেও ভেতরে না গিয়ে স্যারের কথা ভেবে ফিরে যাচ্ছে। এটা স্যারের প্রতি মায়া নয়তো কি? মায়া থেকে ভালোবাসা জন্ম নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নোমান মনে মনে বলল,

-আপনি সবসময় বেস্ট জিনিসটাই ডিজার্ভ করেন স্যার। তাথৈ ভাবীই আপনার জন্য সবথেকে বেস্ট। আর ভাবী, আপনিও পৃথিবীর সমস্ত সুখ ডিজার্ভ করেন। আপনাকে সেই সুখ একমাত্র স্যারই দিতে পারবেন। একজন আরেকজনকে ছাড়া কোনদিনও পরিপূর্ণ হতে পারবেন না।

চলবে

#যতনে_রাখিবো

১৮
চোখ বন্ধ অবস্থায় কপালের উপর হাত রেখে বসে আছে অভয়। চারিদিকে নিস্তব্ধ নীরবতা। তাথৈয়ের থেকে অভয়ের কোন এক্সপেকটেশন নেই। তাথৈ চলে যেতে চাইলে সে আটকাবে না। এই অধিকার তাথৈ তাকে দেয়নি। তাদের বিয়েটাই তো নকল। এই বিয়ে থেকে কোন চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই। তারপরও অভয়ের মন অশান্ত হচ্ছে কেন? তাথৈয়ের চলে যাওয়ায় তার মধ্যে কি খারাপ লাগা কাজ করছে! নোমান মনে হয় ফিরে এসেছে। অভয়ের সব ক’টা বাসার এক্সট্রা চাবি নোমানের কাছে আছে। তাই তাকে গিয়ে দরজা খুলতে হলো না। নোমানের দিকে না তাকিয়েই অভয় জিজ্ঞেস করল,

-তোমার ভাবীকে পৌঁছে দিয়ে এসেছ?

অভয় তাকালে দেখতে পেত নোমান একা ফিরেনি। তাথৈও তার সাথে ফিরে এসেছে।

-স্যার।

-এখন যাও নোমান। আমি একটু একা থাকতে চাই।

বউয়ের চলে যাওয়ায় স্যার তো পুরো দেবদাস হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি তো জানেনই না উনার বউয়ের মনটা এতটাও পাষাণ না। তাথৈ বাড়িতে ফিরে এসেছে দেখে যে তার রাগও শেষ হয়ে গেছে এমনটা না। রাগ এখনও আছে। তাই অভয়কে কিছু না বলে তাথৈ নোমানকে বলল,

-নোমান সাহেব, কল করে উনার ডক্টরকে আসতে বলুন।

তাথৈয়ের কন্ঠ শুনে অভয় সাথে সাথে চোখ খুলে তাকাল। তাথৈ আপুর বাসায় যায়নি? ফিরে এসেছে কেন? তাথৈ অভয়ের সাথে কথা বলার কোন প্রয়োজনই মনে করল না। লাগেজ নিয়ে রুমে চলে গেল। সে যাবার সময় আটকায়নি। তাকে চলে যেতে দিয়েছে। তাহলে এখন কেন কথা বলবে?

-তোমার ম্যাম যায়নি?

নোমান হতাশ নয়নে অভয়কে দেখল। এই লোক ক্যামেরার সামনে এত কেয়ারিং হাসবেন্ডের অভিনয় করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে পুরোটাই ভিন্ন।

-স্যার এই ব্যাপারটায় আপনি আমাকে ভীষণ হতাশ করলেন।

অভয় বুঝতে না পেরে বলল,

-কোন ব্যাপারে?

-থাক আপনার জানতে হবে না। বললেও আপনি বুঝবেন না।

ডক্টর এসে ব্যথার ধরন পরীক্ষা করে জানাল,

-হাড় ভাঙেনি। তবে ফ্যাকচার আসতে পারে। এক্সরে করানো প্রয়োজন।

আপাতত ব্যথা কমানোর জন্য কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে ডক্টর অভয়কে আরও কিছু জ্ঞান দিতে লাগল।

-তুমি নিজেকে নিয়ে এতটা কেয়ারলেস হলে কীভাবে হবে? তোমার প্রফেশনটাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়া। গুণ্ডাদের মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেলা এসব কেমন কথা।

-ওসব তো অ্যাক্টিং। বাস্তবে কেউ আঘাত পায় না।

-তাহলে তোমার হাতের আঘাতটাও অ্যাক্টিং বলবে?

লোকটা বয়স্ক। তাছাড়া অনেক বছর ধরেই অভয়কে দেখছে। অভয়ও উনাকে বাবার মতোই সম্মান করেন। তাই চুপ করে শোনা ছাড়া তার কিছু বলার নেই। তাথৈও পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা এবার অভয়ের দায়িত্ব তার উপর দিলেন।

-দেখো মা, তোমার স্বামীর সবদিকে খেয়াল থাকলেও নিজের প্রতি কতটা অবহেলা। আমি তোমার উপর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। ওর হাতের ব্যথা পুরোপুরি সেরে না যাওয়া পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যেন এক পা-ও না রাখতে পারে। এ কয়দিন শুটিং ফুটিং সব বন্ধ থাকবে।

শুটিং বন্ধ থাকলে প্রোডাকশনের লস হয়ে যাবে। সেট তৈরি করা। তাছাড়া দেশে যে অংশ শ্যুট করা হবে তার কাজ পিছিয়ে গেলে পরের অংশ শ্যুট করতেও দেরি হবে। তাথৈ তীক্ষ্ণ চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে অনেক কথাই বলছে,

-হাত-পা ভেঙে হিরোগিরি দেখাতে এসেছে। নিজেকে টম ক্রুজ মনে করেন নাকি যে, পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়বে। সামান্য ট্রাকের উপর থেকে পড়ে হাত ভেঙে বসে আছে। তিনি নাকি আবার কতবড় নায়ক! দেশের সুপারস্টার। হুহ্।

অভয়ের হাতে ব্যথা পাবার খবর তার দুই বোন সহ পুরো দেশবাসী পেয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা টিভি চ্যানেলে এই নিউজ প্রচার হচ্ছে। ডক্টর, নোমান সবাই চলে গেলেও তাথৈ অভয়ের সাথে কথা বলছে না। অভয় এখন পর্যন্ত এটাই জানে না তাথৈয়ের রাগটা কী নিয়ে।
ভাইয়ের বেখেয়ালি স্বভাবের জন্য আয়েশা অভয়ের ক্লাস নিচ্ছে। অভয় বোনকে বোঝাতে বোঝাতে ব্যর্থ।

-আমার কিছু হয়নি আপু। মিডিয়ার কাজই তিলকে তাল বানানো। তুমি ওদের কথা বিশ্বাস করছো?

-তোকেও তো বিশ্বাস করতে পারি না। দিন দিন মিথ্যাবাদী হচ্ছিস।

-এই অপবাদ দেওয়াটাই বাকি ছিল।

-তুই সত্যি কথা বলিস?

-বলি।

-ঠিক আছে। আমি এসেই দেখতে পারবো কেমন সত্য কথা বলিস।

-কাল আসো আপু। এখন অনেক রাত।

-থাক রাত। তোর মতো মিথ্যাবাদী ভাই থাকলে রাত আর দিন কী!

এই সময় তাথৈ রুমে এসেছে। অভয়কে ফোনে কথা বলতে দেখে তাথৈ আওয়াজ করেনি। কিন্তু অভয় তাথৈকে দেখে বলে উঠল,

-ঠিক আছে। আমি নাহয় মিথ্যাবাদী। কিন্তু তাথৈকে তো অবিশ্বাস করবে না। ওকেই নাহয় জিজ্ঞেস করো।

-হ্যাঁ দে। তাথৈ মিথ্যা বলবে না।

অভয় ফোন স্পিকারে দিয়ে তাথৈয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। তাথৈ কটমট চোখে অভয়ের দিকে তাকালেও কাজ হলো না। কারণ ততক্ষণে আপু কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।

-হ্যালো তাথৈ।

আপুর সাথে কথা বলতে তার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এই লোক তাকে মিথ্যা কথা বলতে বলছে। তাথৈ রাগে একপ্রকার ফোনটা কেড়ে নিয়েই এলো।

-আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপু?

-ভালো থাকার উপায় আছে বলো? তোমার বাঁদর বরটা লাফালাফি করে হাত-পা ভেঙে এসেছে।

তাথৈ অভয়ের দিকে ফিরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-সত্যিই আপু। বাঁদরই।

ফোন স্পিকারে থাকায় অভয়ও ওদের কথা শুনতে পারছে। আপু তার মানইজ্জত নিয়ে খেলছে। বউয়ের সামনে বরকে বাঁদর বলছে।

-তাথৈ তুমিই বলো কী হয়েছে। কারণ ওই বাঁদর তো সত্য কথা বলবে না।

যদিও তাথৈয়ের সত্য বলে দিতেই ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সত্য শুনলে আপু এই মাঝরাতেই নূরের ঘুম ভাঙিয়ে চলে আসবে।

-ডক্টর এসেছিল আপু। ঔষধ লিখে দিয়ে গেছে। নোমান সাহেবও এতক্ষণ এখানেই ছিল। একটু আগেই গেল। আপনি কিন্তু কাল সকালেই চলে আসবেন। এখন না এলেও সমস্যা হবে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। নূর নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে।

অভয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বাবা, তাথৈ সামলে নিয়েছে।

—-
ডান হাত একটুও নাড়ানোর জো নেই। এই হাতে কিছু করতে গেলেই ব্যথায় মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে। এক হাতে শার্টের বোতাম খুলে শার্ট খুলতে পারলেও টিশার্ট পরতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে। কিছুক্ষণ চেষ্টা চালানোর পর অভয় হার মেনে নিল। কিন্তু সমস্যা একটাই। তাথৈয়ের সামনে খালি গায়ে থাকতে পারবে না। তাথৈ কী করবে জানা নেই কিন্তু তার নিজেরই অস্বস্তির শেষ থাকবে না। তাথৈ রুমে এসে দেখল অভয় টিশার্ট পরার চেষ্টা করছে। তাই সে পানির জগ রেখে কিছু না বলেই আবার ঘর থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেও যখন তাথৈ রুমে এসে দেখল অভয় আগের মতোই টিশার্ট নিয়ে কোস্তাকুস্তি করছে তখন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সাহায্য লাগলে কি তাকে ডাকা যেত না? রাগ, ইগো বাদ দিয়ে তাথৈ নিজে থেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। অভয়ের সামনে এসে বলল,

-সাহায্য লাগবে?

অভয় তাথৈয়ের দিকে তাকাল। এই মেয়ের মন বোঝা দায়। তার উপর রাগ করে আছে ভেবেই তো সাহায্য চাইতে সাহস হয়নি।

-করলে উপকার হতো।

অভয়কে টিশার্ট পরতে সাহায্য করে তাথৈ মনে মনে বলছে,

-তিন ঘন্টা ধরে চেষ্টা করছে। আরে মাথা মোটা বেডা, না পারলে থাকতে দিতি। এমনিতে তো এমন কোন মুভি বাদ নেই যেখানে শার্ট লেস তিন চারটা সিন না থাকে। দেশের মানুষ দেখতে পারে, তাহলে আমার দেখায় সমস্যা কী? ঘরের নারী দেখলেই যত শরম। পরনারী দেখলে ফ্যান গার্ল বাড়ে। চরিত্রহীন পুরুষ।

চলবে