যতনে রাখিবো পর্ব-১৫+১৬

0
63

#যতনে_রাখিবো

১৫
তাথৈয়ের কান্না পাচ্ছে। জুহি ওরফে জু, তার মুখে কী সব লাগিয়ে বসিয়ে রেখেছে। তাথৈ না কথা বলতে পারছে আর না চোখ খুলতে পারছে। তাথৈ জো’কে বলেছিল ,

-অন্তত চোখটা খোলা রাখুন। যতক্ষণই সময় লাগে আমি টিভি দেখে কাটিয়ে দেব।

-একদম চুপ। কোন কথা না।

-এতক্ষণ সময় বসে থেকে আমি কী করবো?

-তোমার নায়কের কথা ভাববে।

বলেই জো দুই পিস শশার চাক দিয়ে তাথৈয়ের চোখ ঢেকে দিয়েছে। এরপর থেকে তাথৈয়ের দুনিয়া অন্ধকার। পাঁচ মিনিট বোবাকালা হয়ে বসে থাকার পর তাথৈ আর পারল না। ঝট করে সোজা হয়ে বসলে চোখ থেকে শশা পড়ে গেল। জো আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,

-এ কী! উঠলে কেন?

-মাফ চাই জো। আমাকে দিয়ে এসব হবে না। প্লিজ আমার ফেস থেকে এসব তুলে দিন।

-তুমি তো ভীষণ অধৈর্য বান্দা। এত কম ধৈর্য নিয়ে সুপারস্টারের বউ হবে কীভাবে?

-হতে চাই না। আমাকে পাগলা কুত্তায় কামড়েছিল যে ব্যাটা বদের কথায় রাজি হয়ে গেছি।

তাথৈ কথাগুলো মনে মনে বলেনি। জুহির সামনে উচ্চস্বরেই বলে ফেলেছে। জুহি বিস্মিত চোখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। জুহির দিকে তাকিয়ে তাথৈ বুঝতে পারল আবার একটা ভুল করে ফেলেছে সে। এসব কথা জুহির সামনে বলা উচিত হয়নি। এখন এসব কথা জুহি যদি মিডিয়ার কানে লাগায়। মিডিয়া অবশ্য জানে না অভয় খান কাকে বিয়ে করছে। নিজের বউকে বিয়ের দিনই সামনে আনবে। ওভার থিংকিং করে তিলকে তাল বানানো তাথৈয়ের স্বভাব। জুহির নামে নয়ছয় কত কথাই মাথায় আসছে। কিন্তু তার মাঝেই জুহি হো হো শব্দে হেসে উঠল,

-তুমি ফেসিয়াল করার ভয়ে বিয়েটাই করতে চাচ্ছ না! ওওওওহ, হাউ কিউট। অভয় তোমাকে কোত্থেকে খুঁজে বের করল বলো তো? এত বছরের ক্যারিয়ারে একমাত্র মেয়ে তোমাকেই দেখলাম যার মেকআপ, জুয়েলারি পছন্দ না।

-মানুষ তার কথাবার্তা আচার-আচরণে সুন্দর হয়। মেকআপের সৌন্দর্য মুখ ধুলেই শেষ হয়ে যাবে৷

-সুন্দর কথা বলেছো। কিন্তু সুইটহার্ট, তুমি এমন একজনের লাইফ পার্টনার হতে চলেছ যার পুরো জগতটাই ফেইক চাকচিক্যে ঢাকা পড়ে আছে। এই জগতে সাধারণত্বের কোন জায়গা নেই। তবে তুমি সাধারণের মাঝেও অসাধারণ। তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

যদিও নকল বিয়ে কিন্তু তাথৈ হাফসাকে না বলে থাকতে পারল না। একটাই তো বান্ধবী তার। হোক শাঁকচুন্নিটার জন্যই এসব ঘটছে। তাথৈয়ের কল পেয়ে হাফসা কতটা খুশি হয়েছে বলে বোঝাতে পারবে না। ভেবেছিল তাথৈ হয়তো রাগ করে আর কথাই বলবে না।

-তাথৈ তুই কল করেছিস! আমি যে কতটা খুশি হয়েছি দোস্ত।

-হাফ-চা’র বাচ্চা তোর দাওয়াত।

-কিসের দাওয়াত দোস্ত?

-আমার বিয়ের।

তাথৈয়ের বিয়ে! হাফসা কতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থেকে পরমুহূর্তে চিৎকার করে বলে উঠল,

-কিহ! বিয়ে! কার বিয়ে? কবে? কাকে বিয়ে করছিস?

-এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। নিজেই এসে দেখে নিস কাকে বিয়ে করছি।

-সত্যিই তুই বিয়ে করছিস! আমার সাথে মজা করছিস না তো?

-ফোন রাখ তো। ভাঙা রেকর্ডের মতো এক কথাই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিস। মন চাইলে বিয়ের আগের দিনই চলে আসিস। কিন্তু খবরদার যদি তোর পাঠা বয়ফ্রেন্ডটাকে সাথে নিয়ে এসেছিস।

-আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। ওই কুত্তার সাথে ব্রেকআপ করে নিয়েছি।

-এই কাজ আরও আগেই করা উচিত ছিল। ব্যাপার না। সব কাজই তুই লেট করে করিস। কিন্তু আমার বিয়েতে আসতে লেট করিস না।

—-
বিয়ের ডেট মিডিয়াকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে অভয়। কিন্তু বিয়েতে খুব বেশি আয়োজন করা হবে না। ফ্রেন্ড ফ্যামিলি আর কাছের কিছু রিলেটিভস। মিডিয়া থেকেও খুব বেছে কয়েকজনকে ইনভাইট করা হয়েছে। পুরো বিয়ে কভার করবে। অভয়ের বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই লোপার পাগলামি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ডেট এনাউন্সমেন্টের দিনই অভয়ের বাড়িতে এসে উঠেছিল। অভয় দারোয়ানকে আগেই বলে রেখেছে লোপাকে যেন ভেতরে ঢুকতে না দেয়। অভয় ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। আয়েশা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,

-তোর ফোন কিন্তু আমি ভেঙে ফেলব। আজও তুই ফোনের পেছনে পড়ে আছিস!

অভয় ফোন কানে ধরেই হাতে ইশারায় আপুকে বোঝালো, দুই মিনিট প্লিজ।

-দুই মিনিটের বেশি আর এক সেকেন্ডও না।

ফোনে কথা বলার সময় অভয়কে ভীষণ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। কথা বলতে বলতে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নোমান এসে দরজায় নক করল। অভয়ের এতক্ষণে কথা বলা শেষ। সে বলল,

-এসো।

রুমে ঢুকেই নোমান বলল,

-স্যার আজ আপনার বিয়ের দিন। আজ অন্তত আপনার দুই বোন আমাকে চাকরি থেকে বের করার ভয় না দেখালেও পারেন।

-আজই তো তোমার উপর দিয়ে বেশি চাপ যাওয়ার কথা।

-চাপে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি স্যার। এক মিনিট, আপনার পাগড়ি।

-পাগড়ি কী?

-বাঁকা হয়ে আছে। দাঁড়ান ঠিক করে দেই।

নোমান এগিয়ে এসে অভয়ের পাগড়ি ঠিক করে দিল। অভয় বাহির থেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে-ও নার্ভাস ফিল করছে।

-নোমান, বিয়ের দিন পুরুষদের অনুভূতি কেমন হয়?

-কীভাবে বলবো স্যার? আমি তো এখনও বিয়ে করিনি।

-করা উচিত ছিল।

স্যার নিজে এখনও পুরোপুরি ভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি। কিন্তু এখন থেকেই তার পেছনে পড়েছে! নোমান মনে মনে বলল,

-আমার জীবনে আপনি কি কম আছেন? নতুন করে আমি আবার বউয়ের আপদ ঘাড়ে নেব!

—–
তাথৈয়ের তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। চোখে আলগা পাপড়ি লাগানোর কি খুব দরকার ছিল? চোখের পাতা এত ভারী লাগছে বেচারি চোখ পিটপিট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। চোখও জ্বালা করছে। মাথায় দেওয়া ওড়নায় টান লেগে চুল উঠে আসছে মনে হচ্ছে। বিয়েটাই তাথৈয়ের কাছে আজাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

-এনি প্রবলেম?

-জীবনটাই তো প্রবলেম।

ক্যামেরাম্যান ছবি তুলছে। অভয় মুখে হাসি রেখে বলল,

-খুব বেশি সময় লাগবে না। সব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে।

অভয় বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা বললেও তাথৈ ভেবে নিলো অভয় তাদের নকল বিয়ের কথা বলছে। নূর মামা মামীর কাছে চলে এলে অভয় ওকে কোলে বসিয়ে নিল। তাথৈকে দেখে নূর বলল,

-তোমাকে পুতুলের মতো লাগছে। তোমার মতো আমার একটা বউ পুতুল আছে।

তাথৈ নূরকে চিনতে পারেনি। আগে কখনও দেখা হয়নি। অভয় নূরের পরিচয় দিয়ে বলল,

-বড় আপুর মেয়ে।

তাথৈ হেসে নূরের গাল টেনে দিয়ে বলল,

-তুমি তো একটা রিয়েল ডল।

আয়েশা নূরকে নিতে এসেছিল। বর বউয়ের সামনে রিপোর্টারদের ভিড় দেখে ওদের তাড়াতে বলল,

-শুধু বউ বরের ছবি নিলে হবে? আপনাদের পুরো বিয়ে কভার করতে ডাকা হয়েছে। যান, মেহমানদেরকেও একটু গুরুত্ব দিন।

রিপোর্টারের দল চলে গেছে আয়েশা তাথৈকে জিজ্ঞেস করল,

-তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

এতক্ষণ কেউ জিজ্ঞেস করেনি বলে তাথৈ বলতে পারেনি। কিন্তু এখন লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকার কোন মানে নেই। সে কাচুমাচু মুখে বলল,

-আপু মাথার ক্লিপে চুলে টান লাগছে।

তাথৈকে আয়েশার আহামরি পছন্দ না হলেও বেচারির করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। তার ভাইটা কি গাধা? মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করবে না।
আয়েশা ওড়না ঠিক করে দিয়ে ক্লিপ খুলে নিয়ে বলল,

-তোমার যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে কেমন।

-হুম।

আয়েশা চলে গেলে তাথৈ মনে মনে ভাবল, বোন দু’জন এত ভালো। কিন্তু ভাইটা শয়তানের দাদা শ্বশুর হলো কীভাবে?
হাফসা সেন্টি খাওয়া মুখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তাথৈয়ের বিয়ে অভয় খানের সাথে হচ্ছে! এটা কি কোন স্বপ্ন? হাফসার হাত ধরে টেনে ঝুকিয়ে তাথৈ ফিসফিস করে বলল,

-তুই আমার বান্ধবী। একটা স্ট্যান্ডার্ড তো রাখবি। হাবলার মতো বেডারে দেখে যাচ্ছিস।

-তুই কোন কথাই বলিস না। নিজে ছক্কা মেরে দিয়ে আমাকে মাঠের ভেতরে থাকতে নিষেধ করছো। উনি তো তোর ক্রাশও না। তোর সাথে কেন বিয়ে হচ্ছে?

-আমার পালানোর ব্যবস্থা করে দে। নায়ক বেটাকে তোকে দিয়ে আমি পালিয়ে যাই।

—–
বিয়ে শেষে অভয় রিপোর্টারদের সময় দিতে এসেছে। তাথৈয়ের মুখে হাসি নেই। কারণ জুতো পড়ে পায়ের অবস্থা শেষ। তার উপর এসব নাটক শেষ হচ্ছে না। আর কতক্ষণ এই ভারি শাড়ি গহনা পরে থাকতে হবে। তাথৈ অভয়কে দেখছে। এই ব্যাটা কত হাসিখুশি রিপোর্টারদের বিরক্তিকর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

-স্যার আমরা ম্যামের থেকে জানতে চাই।

তাথৈকে যেন বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে না হয় সেজে অভয় বলল,

-ম্যাম আজ একটু টায়ার্ড। তাই একজনই প্রশ্ন করবেন।

-ঠিক আছে। তাথৈ ম্যাম আপনি আমাদের বলুন, আপনাদের পছন্দ দেখা কবে এবং কোথায় হয়েছিল?

তাথৈ অভয়ের দিকে দেখল। এসব নিয়ে তাদের কখনও কথা হয়নি। আগে থেকেই উত্তর ভেবে রাখা থাকলে সুবিধা হতো। তবুও উত্তর তো দিতেই হবে।

-প্রথম দেখা।

চট করে তাথৈ কোন গল্প বানাতে পারছে না। কী মুসিবত! অভয় বুঝতে পারছে তাথৈ উত্তর দিতে পারবে না। সে তাথৈয়ের হয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাথৈ বলে উঠল,

-আমাদের দেখা এক বৃষ্টির দিন হয়েছিল।

অভয় মনে মনে ভাবল,

-বৃষ্টির দিনে!

-রাস্তায় উনার গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন কলেজ থেকে ভিজে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনই উনি আমাকে দেখে প্রেমে পড়ে গেছেন। তারপর থেকে আমি যেখানেই যাই উনি আমাকে ফলো করতে থাকেন। উনি সেলিব্রিটি মানুষ। তবুও আমার জন্য নিজের সব কাজ ফেলে আমার কলেজ, বাড়ির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। এটা দেখে আমিও উনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর যখন দু’জন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে তখন দেরি না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেওয়া উচিত।

তাথৈয়ের বানানো গল্প শুনে অভয় কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। এত বাজে স্ক্রিপ্ট! তাথৈ মনে মনে ভাবছে, গল্পই বানাতে হবে তাহলে সেই গল্পে আমি কেন নায়কের পেছনে ঘুরবো। মানুষ জানুক নায়ক ব্যাটা আমার পেছনে ঘুরেছে। গল্পটা যে তাথৈ বানিয়ে বলেছে এটা তানিয়া হারুনও বুঝে গেল। তানিয়া স্বামীর কানে কানে বলল,

-এরা বিয়ে কেন করছে এটাই বুঝতে পারছি না। দু’জনের মধ্যে ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।

বিদায় বেলা তাথৈ কান্না করলো না। বিয়ের ফিলিংসই আসছে না চোখে পানি কোত্থেকে আসবে? তারপরও হাফসা কনে কানে বলেছে,

-কিরে কাঁদছিস না কেন? জানি মনে মনে লাড্ডু ফুটছে। কিন্তু বিদায়ের সময় মিথ্যা হলেও কাঁদবি তো!

-কান্না না পেলে আমি কী করব? একটা কাঁচামরিচ এনে দে। মরিচ ভেঙে চোখে লাগিয়ে কাঁদি।

গাড়ি পর্যন্ত আসার সময় অভয় তাথৈয়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

-আমার মুভির স্ক্রিপ্টও এত বাজে হয় না যতটা বাজে আমার লাইফের স্ক্রিপ্ট আপনি লিখেছেন।

-নিজের স্ক্রিপ্ট নিজে লিখে নিতেন তাহলে।

-সেটা করলেও ভালো হতো।

এই জুতা পরে হাঁটতে তাথৈয়ের কষ্ট হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে পড়লে অভয় বলল,

-দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?

-এক মিনিট।

নিচু হয়ে বসে পড়ে তাথৈ জুতার বেল্ট খোলার চেষ্টা করছে। পা থেকে জুতা খুলে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এর থেকে খালি পায়ে হাঁটা ভালো। এত ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে তাথৈ উঠে দাঁড়াতে পারছে না। হাত বাড়িয়ে দিয়ে অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-সাহায্য করুন।

অভয় তাথৈয়ের হাত ধরে ওকে উঠতে সাহায্য করেছে। গাড়িতে বসেই তাথৈ মাথা থেকে ওড়না খুলে ফেলল। নাকের নথ টান দিয়ে খুলে ফেলে লম্বা দম নিয়ে বলল,

-জীবনে আর বিয়ে করব না। বাবাহ, বিয়ে এত প্যারা! বিশ/ পঁচিশ কেজি ওজনের লেহেঙ্গা সাথে কয়েক মণ ওজনের গহনা পরে বিয়ে করার কথা নিজের ফ্যান্টাসি আর হিন্দি সিরিয়ালে দেখতেই ভালো লাগে। মানুষ কীভাবে পারে?

অভয় তাথৈকে দেখে ভাবছে, এই মেয়ে সবার থেকে আলাদা কেন? এর কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার সব কিছুই অন্যদের থেকে ভিন্ন।
এই গাড়িতে শুধু বর বউই এসেছে। বাকিরা অন্য গাড়িতে আগেই পৌঁছে গেছে। অভয়ের বোনেরা তাথৈকে বরণ করে ঘরে তোলার জন্য আগেই দাঁড়িয়ে আছে। তাথৈকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে আয়েশা জিজ্ঞেস করল,

-পায়ে কী হয়েছে তোমার?

-নতুন জুতা পরে পা মনে হয় একটু ছিলে গেছে।

-সে কী! তোমার পায়ে জুতা ফিট হয়নি। অনেকখানি ছিলেছে? দেখি তো।

তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে দেখে তাথৈ তাড়াতাড়ি করে বলতে লাগল,

-আমি ঠিক আছি আপু। তেমন কিছু হয়নি। আপনি প্লিজ ব্যস্ত হবেন না।

চলবে

#যতনে_রাখিবো

১৬
বাদবাকি সব আচার-অনুষ্ঠান শেষ করে ওদেরকে রুমে দিয়ে আসা হলো। তাথৈ রুমের ভেতর পা দিয়ে কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। এমন এমন সব ফুল দিয়ে ঘরটা জানানো হয়েছে যেগুলো তাথৈ এর আগে কখনও দেখেনি। ঘুরেঘুরে পুরো ঘরটা দেখছে সে। অভয় ভেবেছিল তাথৈকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলবে। কিন্তু ওকে রুম দেখতে দেখে নিজেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। তাথৈ মুগ্ধ হয়ে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে,

-নায়ক নায়িকাদের জীবন কি এরকমই হয়? একসাথে চেনা অচেনা এতগুলো ফুল দেখলে মানুষের আর কোন দুঃখ থাকবে? দুঃখ জিনিসটা মনে হয় এদের জীবনে নেই। মন খারাপ হলে দেশবিদেশ ঘুরতে চলে যাবে। শপিং করবে। কত সুখ।

রুমের ভেতরের বাতাসে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ মিশে আছে। তাথৈয়ের হঠাৎ হাঁচি উঠতে লাগল। প্রথমে একটা, তারপর দু’টা এভাবে একের পর এক হাঁচি দিতেই থাকল। অভয় চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসেছে। তাথৈকে এভাবে হাঁচি দিতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

-আপনি ঠিক আছেন?

হাঁচি দিতে দিতেই তাথৈ জবাব দিল,

-দেখতে পারছেন না ঠিক আছি কি-না?

এক সেকেন্ডের জন্য হাঁচি থাকছে না। বেচারীর নাক মুখ লাল হয়ে অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। তাথৈ নিজেও বুঝতে পারছে না হঠাৎ তার সাথে কী হচ্ছে। তাথৈ না বুঝলেও অবশ্য অভয় বুঝলো।

-কোনো ফুলে আপনার এলার্জি আছে?

-জানি না।

-এখানে হয়তো এমন কোন ফুল আছে যাতে আপনার এলার্জি। আপনি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। ততক্ষণে আমি ফুলগুলো সরিয়ে ফেলছি।

এতো সুন্দর সুন্দর ফুলগুলো সরিয়ে ফেলবে শুনে তাথৈয়ের ভালো লাগল না। কিন্তু কী করার? শেষমেশ ফুলে তার এলার্জি! এলার্জি হওয়ার মতো পৃথিবীতে আর কোন জিনিস ছিল না?
মেকআপ তুলে নিজেকে শাড়ি গহনার ভার থেকে মুক্ত করতে অনেকটা সময় লেগে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তাথৈ রুমটাকে চিনতেই পারল না। একটু আগেই তো এটা একটা ফুলের বাগান ছিল। এখন সামান্য একটা পাতাও নেই। তাথৈ মন খারাপ করে বলল,

-তাই বলে সব ফুল সরিয়ে ফেলতে হবে? ফুল গুলোকে কি উনি ফেলে দিয়েছেন?

-স্যার আপনাকে বাসরঘর থেকে বের করে এনেছি। আপনি রাগ করেননি তো? বিষয়টা ছোট হলে আমিই হ্যান্ডেল করে নিতাম। কিন্তু…

-আসল কথা বলো নোমান।

-লোপা চৌধুরী পাগল হয়ে গেছে স্যার। আপনাকে নিয়ে যা-তা স্টোরি রটাচ্ছে।

-রটাতে দাও।

নোমান চোখ বাঁকিয়ে অভয়কে দেখছে। বিয়ে করলে পুরুষ মানুষ বদলায়। তাই বলে দুই তিন ঘন্টার বিবাহিত জীবনে স্যার এতটা বদলে গেছে!

-আমরা উনাকে থামাবো না?

-তার প্রয়োজন পড়বে না।

-মানে, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি ঠিক বুঝলাম না স্যার।

-কোন কথাটা তুমি বুঝো গাধা? প্রথমত, লোপা শুধু মুখেই আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথা মিডিয়াকে বলে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ভবিষ্যতেও যে পারবে এমনটাও সম্পর্ক না। কারণ নিজের কথা সত্য প্রমাণ করার জন্য ওর কাছে তেমন কোন প্রমাণই নেই। আর সবথেকে বড় কথা…

এটুকু বলে অভয় থামল। কী মনে করে যেন কথা শেষ না করেই বলল,

-এসব বিষয় নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না। তুমি বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

স্যারের কি ম্যামের কাছে যাওয়ার তাড়া কাজ করছে? করবেই তো। বেচারার ফার্স্ট নাইট আজ। সে-ই গাধা। আলতো ফালতু সব বিষয় নিয়ে স্যারকে বিরক্ত করতে চলে আসে।

-ঠিক আছে স্যার। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি ম্যামের কাছে যান।

একদণ্ডও না দাঁড়িয়ে নোমান চলে গেল। অভয় ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-বিয়েটাকে এরা রিয়েল ভাবছে। যদিও বাস্তবে সম্পূর্ণ উল্টো।

এখানে না দাঁড়িয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে অভয় ভাবছে, লোপাকে নিয়ে আর টেনশন করার কিছু নেই। লোপা তার কিছুই করতে পারবে না। বিয়ের সময় ইন্টারভিউতে তাথৈ যে স্টোরি বানিয়েছে তার কাছে লোপার স্টোরি ফিকে পড়ে যাবে। তাথৈ রুমে একা একা কী করছে ভেবেই অভয় দ্রুত পা চালালো। রুমে এসে দেখতে পেলো তাথৈ ফার্স্টএইড বক্স খুলে বসে কিছু করছে। অভয়ের মাত্র মনে পড়ল তাথৈ গায়ে ব্যথা পেয়েছিল। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল তখন। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাথৈ মাথা তুলে দেখল। অভয়ের দৃষ্টি ফার্স্টএইড বক্সের দিকে দেখে তাথৈ বলল,

-অনেক খোঁজাখুঁজি করে এটাকে পেয়েছি। জানতাম না কোথায় ছিল। সেজন্য আপনার জিনিসপত্র একটু এলোমেলো হয়েছে।

-এই রুমের প্রতিটা জিনিস এখন তোমারও। তোমার যা কিছু প্রয়োজন নিঃসংকোচে নিতে পারো। তার জন্য আমার অনুমতি বা কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

তাথৈ একদৃষ্টিতে কতক্ষণ অভয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। হায়, সিনেমার ডায়ালগ! এমন চিজি লাইন মুভিতেই শোনা যায়। কিন্তু এখন বাস্তবে শুনতেও খারাপ লাগছে না। এতসব ভাবনার মাঝেও হুট করে তাথৈ বলে উঠল,

-এক সেকেন্ড। আপনি কি আমাকে তুমি করে বলেছেন?

তাথৈয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে অভয় এক হাঁটু গেড়ে তাথৈয়ের সামনে মেঝেতে বসল। হঠাৎ অভয়ের এমন আচরণে তাথৈ পুরাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। তাথৈয়ের হাতে ধরা তুলা ও গজ নিয়ে নিজেই ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগল। তাথৈ অবাক নয়নে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এত বড় একজন সুপারস্টার তার কেয়ার করছে! দূর কেয়ার হতে যাবে কেন? সবসময় ভুল শব্দ ব্যবহার করা তাথৈয়ের মুদ্রা দোষ। ইনি তো তার হেল্প করছেন। কেয়ার আর হেল্প কি এক হলো?

-বিয়েটা তো হয়েই গেল। কিন্তু আপনি আমাকে দিয়ে কোন কাগজে সই করালেন না?

তাথৈয়ের দিকে না তাকিয়েই অভয় জানতে চাইল,

-কিসের কাগজ?

-কন্ট্রাক্ট পেপার।

-রেজিস্ট্রি পেপারে সই করেছেন তো।

-হুম কিন্তু বিয়েটা যে নকল এটা আপনিও জানেন আমিও জানি। তাই নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি করে নিলে ভালো হতো না? চুক্তি অনুযায়ী আপনি আমার কোন কথাগুলো মানবেন। আমি আপনার কোন কথাগুলো মানবো। আরও নানান বিষয়।

-চুক্তিপত্রে সই করা ছাড়া এই জিনিস গুলো করা যাবে না?

-যাবে। আমি কিন্তু আপনার কথা ভেবেই বলেছিলাম। আপনি আমাকে দিয়ে কোন চুক্তিতে সই করালেন না। ভবিষ্যতে আপনি ডিভোর্স চাইলেন তখন দেখা যাবে আমি বেঁকে বসেছি। দেশের সুপারস্টারকে কোন মেয়ে হাতছাড়া করতে চাইবে? আমি আপনাকে অন্যভাবেও ফাঁসিয়ে দিতে পারি। আপনার ক্যারিয়ারও নষ্ট করতে পারি। আপনার কিন্তু আমাকে ভয় পাওয়া উচিত।

ব্যান্ডেজ করা শেষ হয়ে গেলে অভয় তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে স্বভাবসুলভ হাসলো। এই লোকের হাসি মারাত্মক। বিশেষ করে মুচকি হাসি। তাথৈ মনে মনে নিজেকেই বলল,

-তাকাস না তাথৈ। একদম দেখিস না।

অভয় ফাস্টএইড বক্স রাখতে চলে গেলে বিড়বিড় করে তাথৈ বলল,

-এত বেশি কথা বলার দরকার কী তোর? চুপ থাকতে পারিস না? আর কী সব ফালতু কথা বলছিলি। তুই কেন উনাকে ছাড়তে চাইবি না? মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

তাথৈয়ের সামনে ফিরে এসে অভয় বলল,

-শুয়ে পড়ুন। আজকের দিন আপনার জন্য কঠিন কেটেছে।

—–
তানিয়া বোনের চিন্তায় অস্থির হয়ে সকাল সকালই অভয়ের বাড়িতে চলে এসেছে। তাথৈকে তানিয়া যতটা চিনে তা পৃথিবীর কেউ চিনবে না। গণ্ডগোল পাকানো এই মেয়ের রক্তে মিশে আছে। একটা রাতও ওখানে ভালোভাবে কাটাতে পেরেছে কি-না আল্লাহ জানেন।
নোমান তানিয়াদের নিয়ে এসেছে। তাথৈ রুমে ছিল। মিম এসে ওকে জানালো,

-ভাবী তোমার বোন এসেছে।

তাথৈ দৌড়ে এসে বোনকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল। তানিয়া আগের বোনের খোঁজ খবর না নিয়ে এটা জিজ্ঞেস করল,

-এখানে আসার পরে কোন ঝামেলা বাঁধাসনি তো?

তাথৈয়ের চেহারা হাওয়া বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। এটা তারই বোন তো? কোথায় জিজ্ঞেস করবে কেমন আছিস তুই। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে না তো।

-তোমার কেন মনে হয় আমি ঝামেলা বাঁধাবো।

-কারণ আমি তোকে ছোট থেকে চিনি।

দুই বোনের মধ্যকার ভালোবাসা দেখে বাকিরা আপ্লুত হচ্ছে। তানিয়া বোনকে ছেড়ে বাকিদের সাথে কথা বলছে। নোমান এখন তাথৈকে আগের থেকেও বেশি ভয় পায়। এসব কিছুর জন্য তাথৈ অর্ধেক দোষ নোমানকে দেয়। নোমান যদি সেদিন তাথৈকে তার স্যারের সাথে কথা বলতে না পাঠাত তাহলে ওই ছবিগুলো লিক হতো না।

-নোমান সাহেব।

-জি ম্যাম।

তাথৈ ভ্রু কুঁচকে নোমানের দিকে তাকাল। মুখ চোখা করে বলল,

-আমি আপনার টিচার?

নোমান থতমত খেয়েও জবাব দিল,

-জি না।

-তাহলে নিশ্চয় আপনার অফিসের বস।

-তা-ও না ম্যাম।

-আমি আপনার বস না। আর না আপনার টিচার তাহলে কেন আমার নামের পেছনে হাজার বার ম্যাম শব্দটা জুড়ে দেন।

-আপনি আমার স্যারের ওয়াইফ।

-এটা নিশ্চয় আমার একমাত্র পরিচয় না। আপনি আমার নাম ধরে ডাকুন। আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আর একবার যদি আমাকে ম্যাম ডাকতে শুনেছি তাহলে আপনার খবর আছে।

নোমান ঢোঁক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,

-ঠিক আছে ম্যাম।

চলবে
Jerin Akter Nipa