#যতনে_রাখিবো
২৭
এখানে অভয়ের সব কাজ শেষ। কালপরশুই দেশে ফিরে যাবে। প্রথমে ভেবেছিল এই কথাটা তাথৈকে জানাবে না। পরে ভাবল, তার বউ কোন সাধারণ মেয়ে না। দেখা গেল বউকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে কোন কারণে নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে বসে আছে। তাই তাথৈকে আগেই জানিয়ে দেওয়া ভালো মনে করল।
ফোন বাজার শব্দ পেয়ে তাথৈ সবার মাঝ থেকে যেভাবে দৌড়ে উঠে গেল তাতে তানিয়া
হারুন দু’জনই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসল।
ঘরে গিয়ে ফোনের উপর হামলে পড়ে কল রিসিভ করে বলল,
-হ্যালো।
তাথৈ হাঁপাচ্ছে বুঝতে পেরে ভ্রু কুঁচকিয়ে অভয় জিজ্ঞেস করল,
-দৌড়ে এসেছ?
-কীভাবে বুঝলেন? ফোন রুমে ছিল।
-আপু দুলাভাই সবাই কেমন আছে?
-ভালো।
তাথৈ একটা কথা জানার জন্য উত্তেজনায় ওড়নার চুমকি টেনে প্রায় উঠিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অজানা কোন কারণে কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারছে না। তাথৈকে অবশ্য জিজ্ঞেস করতে হলো না। অভয় নিজেই জানাল পরশু দেশে ফিরছে সে।
অভয়ের ফিরে আসার খবর শুনে তাথৈ কেমন রঙিন প্রজাপতির মতো এক ফুল থেকে আরেক ফুলে উড়ে বেড়াতে লাগল। লোকটার ফেরার কথা শুনে এত খুশি লাগছে প্রকাশ করার মতো না। তাথৈ প্রকাশ না করলে কী হবে? ওর এই খুশি কারোরই চোখ এড়াল না। দুলাভাই তো সকাল থেকে নানাভাবে ক্ষেপিয়ে যাচ্ছে।
-তোমার স্বাধীন জীবন তো শেষের পথে।
-কেন দুলাভাই?
-শুনেছি নায়ক সাহেব দেশে ফিরে আসছে।
-তো?
-তুমি না নিজ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা লোক। বর চলে এলে কি নিজের মতো চলতে ফিরতে পারবে? ওই লোকের কথা কিছু হলেও মেনে চলতে হবে।
দুলাভাইয়ের কথার জবাব তাথৈ ভাব নিয়ে দিল,
-আমার বর আপনার মতোই বউ ভক্ত বেডা। আপনি যেমন আমার বোনের উপর হাত ঘোরাতে পারেন না৷ আমার বর তাই চেষ্টাই করে না।
হার মেনে নিয়ে দুলাভাই বলল,
-বুদ্ধিমান পুরুষ। জানে কী করলে সংসারে সুখ শান্তি বজায় থাকবে।
তাথৈকে নিজের বাসায় ফিরতে হবে। এতদিন ধরে তালাবদ্ধ ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা না দেখলে লোকটা ভাববে তার বউ কোন কাজেরই না। এতদিন শুধু খেয়েছে আর ঘুমিয়েছে।
—-
এয়ারপোর্টে তার দুই বোনকে দেখা গেলেও আসল মানুষটাকেই দেখা গেল না। যাকে অভয়ের দু-চোখ খুঁজছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও আয়েশা, মিম কেউই কিছু বলল না। তাথৈ আসেনি দেখে গাড়িতে বসেও অভয়কে কেমন আনমনা দেখাচ্ছে। এতদিন পর দেশে ফিরল সে। তাথৈ তাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এলো না!
বাসায় পৌছানোর আগে অভয় ভাবতে পারেনি তার জন্য এত বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। তার ওয়েলকামের জন্য এই সারপ্রাইজ পুরোটাই যে তাথৈ প্ল্যান করেছে তা জানতে বাকি রইল না। দু’জনের সরাসরি কোন কথা না হলেও চোখে চোখে অনেক অনুভূতিই আদানপ্রদান হয়ে গেছে। দু’জনের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। বোনেরা সবাই তাকে ছাড়লে অভয় তাথৈয়ের কাছে এলো।
-কেমন আছো?
এই কেমন আছো কথাটা শুনতে শুনতে তাথৈয়ের কান পঁচে গেছে। কল করে হ্যালো বলার পরই কেমন আছো। এখন সামনাসামনিও এই কথাই জিজ্ঞেস করবে! তাই তাথৈ বলল,
-কেমন দেখতে পারছেন?
অভয় হাসল। তাথৈয়ের থেকে এমন উত্তরই আশা করেছিল। প্রশ্নই সে বোকার মতো করেছে। তাথৈ চোরা চোখে অভয়কে হাসতে দেখছে। লোকটা হাসেও মেপে ঝেঁপে। অট্টহাসি হয়তো জীবনেও হাসে না। মুচকি হাসতেই কাজ চালিয়ে নেয়। তাথৈ মনে মনে বলল,
-শুধুমাত্র আপনার মুচকি হাসির উপরই জীবন উৎসর্গ করতে দিতে পারবো। নায়ক হয়েছেন বলে কি আপনাকে এত সুন্দর হতে হবে?
-কিছু ভাবছো?
-হু? না। না তো।
নিজের মাথাতেই চাটি মারতে ইচ্ছে করল। বলদের মতো মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কী ভাবছেন উনি? তাথৈকে লজ্জা থেকে বাঁচাতেই হয়তো বাবাই এসে অভয়ের হাতে ঝুলে পড়লো।
-আঙ্কেল আমার জন্য কী এনেছো?
তাথৈ তাড়াতাড়ি এখান থেকে কেটে পড়ল। অভয় বাবাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-তোমার কী চাই?
বাবাই তার ছোট্ট চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড়ো করে বলল,
-আমার যা চাই তা-ই এনেছো?
-হুম।
-কিন্তু তুমি কী করে জানো আমার কী চাই!
-ম্যাজিক!
-তুমি সত্যিই ম্যাজিক জানো?
-কেন, বিশ্বাস হয় না?
-আমার খালামনিও তোমার মতো ম্যাজিক জানে।
-তাই নাকি?
-দেখবে তুমি? চলো। আমি খালামনিকে বলবো তোমাকে ম্যাজিক দেখাতে।
বাবাই অভয়কে টেনে তাথৈয়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে অভয় বলল,
-চলো আগে তোমার গিফট দেখে আসি। ম্যাজিক পরে দেখব।
-ঠিক আছে চলো।
আয়েশা, মিম, তানিয়া তিন মহিলা মিলে রান্নাঘরে কী করছে দেখার জন্য তাথৈ এসেছিল। এসে শুনতে পেলো মিম বলছে,
-আপু শুধু শুধু কেন এতকিছু রাঁধছো বলো তো। ভাইয়া খেলেও তো এক দু’চামচই খাবে।
-আজ সব খেতে হবে। ছবির কাজ শেষ। এখন মোটা হলেও সমস্যা নেই।
তাথৈ ভাবছে মোটা হলে লোকটাকে কেমন দেখাবে? কলেজ জীবন থেকে লোকটাকে এরকম দেখে আসছে। একটুও পরিবর্তন নেই। বাইরে নূরের গলা শোনা যাচ্ছে। তাথৈ আয়েশা ও তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-দুইটা আবার ঝগড়া লেগেছে!
সত্যিই অভয়কে নিয়ে নূর ও বাবাই ঝগড়া লেগেছে। একজন বলছে আমার মামা। আরেকজন বলছে আমার আঙ্কেল।
-বাজে ছেলে তুই আমার মামাকে ছাড়।
-তুই পঁচা মেয়ে। এটা আমার আঙ্কেল।
তাথৈ ছুটে এদের কাছে চলে এসেছে। তার পেছনে বাকিরা। অভয় অসহায় ভাবে তাথৈয়ের দিকে তাকাল। তাথৈ দেখল দুই পিচ্চির ঝগড়া হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেছে। নূর বলছে,
-আমি কিন্তু তোকে কামড় দিবো। ছাড় আমার মামাকে।
-আমিও তোর দাঁত ভেঙে ফেলব। বলেছি না এটা আমার আঙ্কেল। আমি কেন ছাড়বো?
নূর সত্যি সত্যিই বাবাইকে কামড় দিতে এলে অভয় ওকে জড়িয়ে ধরে থামিয়ে দিল। দুইটা একসাথে হলে ঝগড়া হবেই। নূর অভয়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলছে,
-মামা আমাকে ছাড়ো। ছাড়ো মামা।
-নূর কাউকে কামড় দেওয়া ভালো না আম্মু।
-না আমি কামড় দেব। ওই বাজে ছেলে কেন আমাদের বাসায় আসে? তুমি ওর আঙ্কেল না। তুমি আমার মামা।
তার মেয়ে এমন ঝগড়ুটে হয়েছে দেখে আয়েশার চিন্তার শেষ নেই। এটুকু বয়সেই এই অবস্থা। বড় হলে এই মেয়েকে কীভাবে সামলাবে! তানিয়া বাবাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
-বাবাই তুই চলে আয় বাবা। নূর ছোট। তুই তো বড় হয়েছিস।
বাবাইও কম না। সে কিছুতেই অভয়ের কাছ থেকে যাবে না।
-না। আমি যাব না। এটা আমার আঙ্কেল না? তাহলে আমি কেন যাবো?
অভয় না পারছে নূরকে শান্ত করতে। না পারছে বাবাইকে কিছু বলতে। দু’জনই বাচ্চা। কাউকেই বোঝানো যাবে না। এদের এসব কাহিনি দেখে মিম বলেই ফেলল,
-আল্লাহ ভাইয়াকে বাঁচিয়েছে আমারও একটা ল্যাদাপ্যাদা নেই। নাহলে ওইটাও মামার ভাগ চাইত।
আয়েশা চিন্তিত মুখে বলল,
-আমি ভাবছি তাথৈয়ের ছেলেমেয়ে হলে কী হবে? এরা তো মামা আঙ্কেলের ভাগ চাচ্ছে। অভয়ের নিজের ছেলেমেয়ে হলে ওরা কি বাবার ভাগ দিতে চাইবে!
অভয়ের সামনেই আপু এই কথা বলে ফেললে কেনই যেন লজ্জায় তাথৈয়ের কান গাল গরম হয়ে গেল। অভয়ও এই কথা শুনে সর্বপ্রথম তাথৈয়ের দিকেই তাকিয়েছিল। দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলে তাথৈ আরও লজ্জা পেলো।
অভয় সবার জন্যই কিছু না কিছু নিয়ে এসেছে। সকলের সবকিছু দেওয়াও শেষ। তাথৈ অপেক্ষায় ছিল কখন তার পালা আসবে। তার জন্য অভয় কী এনেছে এটা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ছিল। কিন্তু সবার পরও যখন তার নাম এলো না তখন ভেবে নিল অভয় তার জন্য কিছুই আনেনি। লোকটা কতটা কিপ্টে ভাবা যায়! আপুরা কেউই থাকলো না। যদিও তাথৈ সবাইকে থেকে যাওয়ার জন্য অনেক সেধেছিল। প্রকাশ না করলেও অভয়ের উপর তাথৈয়ের রাগ আছে। সবার জন্য উপহার আনলো। শুরু নিজের বউয়ের কথাই মনে ছিল না! অবশ্য মনে থাকবে কীভাবে? বিয়েটাই তো আসল না। তাথৈ রুমে চলে এলো। গজগজ করতে করতে বিছানা গোছাচ্ছে।
-আমারই তো দোষ। আমি কেন আশা করি? এত লোভী মন কেন আমার? আশা যেমন করেছিলি, আশা ভঙ্গ হওয়ায় তেমন কষ্ট পেয়েছিস তো? উচিত হয়েছে। তুই এটারই যোগ্য ছিলি।
অভয় কখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাথৈ খেয়াল করেনি। দরজায় দাঁড়িয়ে তাথৈয়ের কথাগুলো শুনতে পেয়ে অভয় নিঃশব্দে হাসছে।
-জীবনে যত কম এক্সপেকটেশন করবি। কষ্টও কম পাবি। এটা তোর জন্য একটা শিক্ষা।
ঘাড়ের পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে তাথৈ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে শীতল কিছু একটা গলায় নেমে এসেছে। দ্রুত পেছনে ফিরতে গিয়ে অভয়ের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। তাথৈ অভয়কে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে ভেবেছিল ভূত-পেত্নী কিছু হবে। কিন্তু অভয় অমন ভূতের মতো তার পেছনে দাঁড়িয়ে কী করছিল প্রশ্নটা ঠোঁটে আসার আগেই অভয় পেছনে চলে গেল। শীতল কিছুর স্পর্শ পেতে তাথৈ গলার দিকে তাকিয়ে দেখল তার গলায় অসম্ভব সুন্দর একটা নেকলেস শোভা পাচ্ছে। এটাই কি তাহলে তার উপহার ছিল! সবার সামনে কেন দেয়নি? তাথৈ আরও মনে মনে কতকিছু ভেবে বসে ছিল। অভয় তাথৈকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-পছন্দ হয়েছে?
-ডায়মন্ডের?
-হুম।
-এত দামী উপহার আমি নিতে…
-দামী মানুষের জন্য দামী উপহার। তাছাড়া উপহারের দাম মাপতে নেই। এতে উপহারের অমর্যাদা হয়।
চলবে
#যতনে_রাখিবো
২৮
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তাথৈ নীল রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই অভয় এক হাঁটু গেড়ে বসে আছে। লোকটা তার ডান পা-টা নিজের হাঁটুর উপর রাখল। পকেট থেকে একটা নূপুর বের করে এনে তাথৈয়ের পায়ে পরিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় কোত্থেকে হাফসা এসে তাথৈয়ের হাত ধরে টানতে লাগল। গুণ্ডারা নায়িকাদের হাত ধরলে নায়িকারা যেভাবে সাহায্যের জন্য ডাকে তাথৈ সেভাবে বলল,
-ছাড় আমাকে। ছাড় শয়তান। কে আছো বাঁচাও। বাঁচাওও!
হাফসা ভিলেনদের মতো দাঁত বের করে হা হা হু হু করে হাসতে হাসতে বলল,
-চিৎকার করেও লাভ হবে না সুন্দরী। আজ আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
অভয় হিরোদের মতো ওকে না বাঁচিয়ে হা করে চেয়ে এই দৃশ্য দেখছে। তাথৈ হাত মোচড়ামুচড়ি করেও নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ। এর মাঝেই জোরে জোরে তাথৈয়ের ফোন রিংটোন হচ্ছে। তাথৈ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। প্রথমে নিজের হাত ও আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। ফোন বেজেই চললে হাতে নিয়ে দেখল হাফসা। তাথৈ নাক ফুলিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-শালি! আমার জীবনে তো ভিলেন ছিলিই। এখন আমার স্বপ্নেও ভিলেন হয়ে আছসিস!
তাথৈ সময় দেখল। রাত বারোটার থেকে কিছু বেশি। এত রাতে এ আবার কেন কল করছে?
ফোন রিসিভ করেই তাথৈ চেঁচিয়ে বললো,
-আমি তোর মার্ডার করবো হাফ চা-র বাচ্চা। তোর সমস্যা কী? আমার জীবনের ভিলেন সাজতে চাচ্ছিস কেন?
-তুই কিসের পিক দিয়েছিস?
তাথৈয়ের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। অভয় তাকে নিজের হাতে নেকলেসটা পরিয়ে দিলে খুশির চোটে সেল্ফি তুলে বান্ধবীর সাথে শেয়ার করেছিল। শালি ফ্রি ইউজার মাঝরাতে পিক দেখে এখন কল করছে!
-তোকে দেখব? নাকি তোর গলার হীরের হারটা? দুলাভাই নিয়ে এসেছে! দোস্ত আমাকেও একটা হিরো খুঁজে দে না। এরকম একটা হীরের হার তো আমিও ডিজার্ভ করি।
যদি ফোনের ভিতর দিয়ে যাওয়া যেত তাহলে তাথৈ হাফসার ওখানে গিয়ে লোভী বান্দরনীটাকে আচ্ছা মতো পিটিয়ে আসত। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে আবোলতাবোল বকছে।
-সেদিন হসপিটালে চ্যালেঞ্জটা তোকে না দিয়ে আমি নিজে ধরলেই আজ তোর জায়গায় হীরের ওই নেকলেসটা আমার গলায় থাকত।
-লোভী শালি তুই তো জাহান্নামেও জায়গা পাবি না। এত লোভ কেন তোর? তোর বাপের তো টাকাপয়সার কোন কমতি নেই।
-বাপের টাকা দিয়ে কী করবো? অভয় খান হাতছাড়া হয়ে গেল। আমার মন কি নেকলেসের জন্য কাঁদছে? নেকলেস যে এনে দিয়েছে সেই বেডার জন্য কাঁদছে।
-এই বেডাকে এতই পছন্দ হলে তোকে আমার সতীন বানিয়ে নিয়ে আসি।
তাথৈয়ের শেষের কথাটা শুনে অভয় দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বারবার ফোনকল আসায় তাথৈয়ের ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে বাইরে গিয়ে কল তুলেছিল। ভেবেছিল লোপার পাগলামি হয়তো আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কিন্তু বেচারি নিজের সমস্ত ভুলের জন্য তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। লোপাও বুঝে গেছে জোর করে আর যা-ই হোক কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। অভয়ের কাছে আজ অনুতাপ প্রকাশ করছিল। যাক লোপা নিজেই তার ভুল বুঝতে পেরেছে। অভয় স্বস্তির একটা ভাব নিয়ে রুমে ফিরছিল। কিন্তু তাথৈয়ের কথা শুনে তার স্বস্তি কোথায় যেন উড়ে গেল। এই মেয়ে কাকে সতীন বানানোর কথা বলছে!
-পৃথিবীতে তো আর হ্যান্ডসাম গুড লুকিং বেডা নাই। তোর মন আমার জামাইয়ের উপরই আটকেছে। এখন আর কী করবো? বেস্ট ফ্রেন্ডকে তো আর চিরজীবন কুমারী থাকতে দিতে পারি না। তোকে আমার সতীনই বানাবো। চিন্তা করিস না।
এতটুকু শুনে অভয় ঠিক থাকতে পারলো না। কাশতে লাগল। তাথৈ চোখ বাঁকিয়ে সামনে তাকিয়ে অভয়কে দেখতে পেলো। এই লোক এতক্ষণ রুমে ছিল না? এত রাতে কোথায় গিয়েছিল? সবথেকে বড় কথা তার এই আজগুবি কথাগুলো শুনে নেয়নি তো! হাফসাকে কিছু না বলেই তাথৈ কল কেটে দিন অভয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-আপনি কি বাহির থেকে ফিরছেন?
অভয় কাশতে কাশতেই মাথা উপর-নীচ নেড়ে জানালো, সে বাইরে থেকেই এসেছে।
-কোথায় গিয়েছিলেন জানতে পারি?
অভয়ের কাশি এখনও পুরোপুরি থামছে না দেখে তাথৈ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। খুঁজে দেখল রুমে আজ পানি এনে রাখেনি। তাই পানি আনতে বাইরে চলে গেল।
-দাঁড়ান পানি নিয়ে আসছি।
কিন্তু তাথৈ ফিরতে ফিরতে অভয়ের কাশি থেমে গেছে। তাথৈ এটা জানার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হচ্ছে অভয় এত রাতে কোত্থেকে ফিরল। তাকে ঘুমে রেখে কোথায়ই বা গিয়েছিল। পানির জগ যথাস্থানে রাখতে গিয়ে ফ্লোরে বিছানো পাপোশে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পানি ভর্তি কাচের জগ হাত থেকে পড়ে সাথে সাথে ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। সবটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল অভয় চেয়েও তাথৈকে ধরতে পারল না। সে উঠে আসার আগেই তাথৈ পড়ে গেছে। অভয় ছুটে এসে তাথৈয়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,
-ঠিক আছো তুমি? কোথাও লাগেনি তো?
তাথৈয়ের পায়ে কাচ না বিঁধলেও উল্টো ভাবে পড়ে গিয়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে। এভাবে অভয়ের সামনে পড়ে গিয়ে লজ্জাও কম পাচ্ছে না। উঁচু নিচু জায়গা তো না, রুমের ফ্লোর। পাপোশে কীভাবে উস্টা খায় কেউ!
ফ্লোরে ছড়ানো পানিতে তাথৈ সাতার কাটছে। কাপড়চোপড় ভিজে শেষ। অভয় ওর হাত ধরে বলল,
-ওঠো। ভিজে গেছো। চেঞ্জ করে নাও।
তাথৈ লজ্জায় মানুষটার দিকে তাকাতেই পারছে না। লোকটা হয়তো মনে মনে হাসছে। তার সামনে কেউ এভাবে পড়ে গেলে সে তো জোরেই হেসে ফেলত। লোকটা হয়তো ভাবছে, কত বড় ধিঙ্গি মেয়ে হয়েও ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারে না।
অভয় কিন্তু এসব কিছুই ভাবছে না। বরং তাথৈয়ের জন্য চিন্তিত হচ্ছে। তার জন্যই পানি আনতে গিয়েছিল। অভয় তাথৈকে ধরে দাঁড় করানোর সময় ব্যথায় বেচারি মাটিতে পা-ই রাখতে পারল না। ব্যথিত মুখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-মনে হয় পা মচকে গেছে।
-পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে?
-কিছুটা।
তাথৈ পা মেলিয়ে বিছানায় বসে আছে। সামনেই লোকটা কী ভীষণ যত্ন সহকারে মনোযোগ দিয়ে তার পায়ে গরম পানির সেক দিয়ে দিচ্ছে। শুরুতে তাথৈ লুকিয়ে দেখছিল। কিন্তু যখন দেখল অভয়ের সব মনোযোগ তার পায়ে, তার দিকে তাকাচ্ছে না, তখন থেকেই সরাসরি দেখে যাচ্ছে। তাথৈ দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। হঠাৎ অভয়ও এদিকে তাকালে তাথৈ তাড়াহুড়ো করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অভয় জিজ্ঞেস করল,
-এখনও কি আগের মতো ব্যথা লাগছে?
-না। অনেকটাই কমেছে।
-তাহলে মনে হয় পা মচকায়নি। তারপরও কাল একবার ডক্টর দেখাতে হবে।
—
অভয় খানের নিউ মুভি রিলিজ হয়েছে। তা নিয়ে ভক্তদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে না এমনটা কখনও হয়নি। অভয়ের ফ্যানরা বাকি সব হিরোদের ফ্যানদের থেকে অনেকটাই আলাদা। অভয়কে শুধু তারা পছন্দ করে না, ভালোবাসে। অভয়ের টিমও প্রচারে কোন কমতি রাখছে না। রিলিজের প্রথম দিনই অভয়ের আগের সব মুভির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ডিরেক্টর প্রডিউসাররা কল করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এত এত সাকসেস পাওয়ার পরও যেন লোকটা খুশি না। তাথৈয়ের এত আনন্দ লাগছে অথচ সে এখনও মুভিটাই দেখেনি। তাথৈ মনে মনে ভাবে,
-এসব কি উনার জন্য নতুন যে আমার মতো এত বেশি এক্সাইটেড হয়ে লাফানো শুরু করবে। উনি এত সাকসেস, ভক্তদের ভালোবাসা পেতে পেতে অভ্যস্ত।
পুরোটা দিন অভয়ের ব্যস্ততায় কেটেছে। তাথৈও দেখছে অভয় কত ছোটাছুটি করছে। ফোন কল তুলতে তুলতেই বেচারার অবস্থা কাহিল। নোমান এসে অপেক্ষা করছে। অভয় এখন আবার কোথাও বেরুবে। তাথৈ নোমানকে চা দিলে নোমান হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বলল,
-আমি জীবনে অনেকের হাতে বানানো চা খেয়েছি ভাবী। কিন্তু আপনার চায়ের সাথে কারোর চা-র তুলনা হয় না।
তাথৈ খুশি হয়ে বলল,
-প্রশংসা করার জন্য শুকরিয়া।
-আপনি স্যারের নিউ মুভিটা দেখেছেন?
তাথৈ মন খারাপ করে বলল,
-এখনও সুযোগ হয়নি।
-স্যার তো..’
কথাটা বলে ফেলতে গিয়েও নোমান নিজেকে আটকে নিলো। বলে দিলে স্যারের প্ল্যান খারাপ হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে স্যার ভাবীকে সারপ্রাইজ দিবে। যাক স্যারের তাহলে একটু হলেও সুবুদ্ধি হয়েছে। বউকে কীভাবে ইমপ্রেস করতে হয় জানা আছে।
তাথৈ কল্পনাও করতে পারেনি তার জন্য এত বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। সন্ধ্যায় অভয় বাড়ি ফিরে তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার কথা বললে তাথৈ ভেবেছিল লোকটার মাথায় আবার কী গন্ডগোল দেখা দিল। কোনদিনও তো বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে না। তাথৈয়ের জীবনে সবথেকে কষ্টের কাজ কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া। তাই সে জিজ্ঞেস করল,
-যাওয়াটা কি জরুরি?
-হুম।
-অনেক সেজেগুজে যেতে হবে?
-তোমার ইচ্ছা।
তাথৈ মনে মনে বলল, আমি তো ফকিন্নির বেশেও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু আপনার তো একটা স্ট্যাটাস আছে। আপনার বউ হওয়ার সুবাদে এখন আমাকেও টিপটপ রেডি হয়ে বাইরে যেতে হয়।
-কারো বাসায় নিয়ে যাবেন?
-উঁহু।
-কোন পার্টিতে?
-না।
-তাহলে কোথায়? আপনি না বললে আমি রেডি হতে পারবো না। কারণ প্রতিটা প্রোগ্রামের জন্য আলাদা সাজ হয়। পার্টির জন্য হেভি মেকআপ। কারো বাসায় গেলে…
অভয় হতাশ হয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তাথৈকে বলল,
-তুমি যেমন আছো তেমনই চলো।
তাথৈয়ের আসল উদ্দেশ্য ছিল এসব বলে অভয়কে কনফিউজড করে দিয়ে কোথায় যাচ্ছে এই কথাটা জেনে নিবে। কিন্তু নায়ক ব্যাটা তার থেকেও চালাক। পেটের কথা কিছুতেই বলবে না।
চলবে
Jerin Akter Nipa