সাহেব_বিবি_গোলাম পর্ব-১১

0
1427

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১১

,
,
সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো কেউ আমায় আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরে আছে।আমার কেমন যেনো অসস্তি হতে লাগলো।
আমার ঘাড়ে মুখ গুজে আছে সে।নিশ্বাস তার ঘরন ঘন পরছে।হয়তো ঘুমিয়ে আছে।
আমার পেটের কাছে তার হাত রাখা।
আমি ছাড়ানোর জন্য হাত ধরতেই চমকে উঠলাম।
এতো শক্ত হাত!এটা তো আপার হতে পারেনা।মেয়েদের হাত বুঝি কখনো এতো শক্ত হয়?
তাহলে কে হতে পারে এটা?তাছাড়া এ রুমে আসবেইবা কে?এটা তো আপার রুম।আমার চোখ বড় হয়ে গলো মুহূর্তেই।
ভয়ে হাত পা জমে গেলো।
কে হতে পারে সে?আমাকেই বা এমন জাপটে ধরে আছে কেনো?
ভয়ে আমার কথা আটকে এলো।চিৎকারও করতে পারছিনা।
ঘেমে নেয়ে উঠলাম ভয়ে।
মোচড়ামুচড়ি শুরু করলাম ছোটার জন্য।
পেছনের ব্যক্তিটির ঘুম বোধহয় ভেঙে গেলো।সে একটু নড়ে মুখ উচু করে ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,

—কি হয়েছে?মৃগী রোগির মতো মোচড়াচ্ছো কেনো?

আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম।
চোখ কুঁচকে রাগী দৃষ্টি ফেলে বললাম,

—আপনি?আপনি এখানে কি করছেন?

শুভ হাই তুলতে তুলতে উঠে বসলো।

—কি করছি মানে?আমার বউ এখানে তো আমি কি অন্যরুমে থাকবো নাকি?বউ যেখানে স্বামী সেখানে,কথাটা জানোনা?

—তাই বলে আমাকে জাপটে থাকবেন?
আর আপা কোথায়?

—আমার বউকে আমি জাপটে ধরি আর যাই করি,তাতে তোমার কি?
তুমি কে জিজ্ঞেস করার?হু?
আর আপা আমার রুমে।আমি ই অনেক বলে কয়ে তাকে এ রুম থেকে বের করেছি।

—কেনো?

—আরে বিয়ে করেছি বউকে অন্যরুমে থাকতে দেওয়ার জন্য নাকি?

আমি চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকালাম।
লোকটা তো মহা পাঁজি। সাথে বেলজ্জিত ও।নয়তো বড় বোনকে কেউ বলে সে বউয়ের সাথে থাকবে?
বউ কথাটা মনে পরতেই মনটা বিষন্ন হলো আমার।
প্রিতম আমায় বলপছিলো,বিয়ের পর সে কখনো আমার নাম ধরে ডাকবেনা।বউ বলে ডাকবে।
সারাদিন রাত বউ বউ বলতে বলতে জ্বালিয়ে মারবে।
আমি তখন মুখ ফুলিয়ে লিখতাম,

—তখন বুঝি আর আমাকে মায়াবতী বলবে না?

সে তখন রিপ্লাই দিতো,

—ডাকবো তো,কিন্তু সবসময় না।রোমান্টিক মুহুর্তে ডাকবো।

আমার কি যে হাসি পেতো তখন।এমন একটা পাগল ছেলের প্রেমে কি করে যে পরেছিলাম।ভালবাসতাম তো খুব!এখনো বাসি।সারাজিবন বাসবো।
আচ্ছা প্রিতমকে ছাড়া কোনদিন অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবো আমি?এইযে সামনে দাড়ানো ছেলেটাকে?যে আমার স্বামী, তার তো অধিকার আছে আমার ভালবাসা পাবার?আর প্রিতম?সে কি কখনো আমায় মেনে নেবে?তাকে পাবো কখনো?
আমার চোখ থেকে টুপ করে অশ্রুকনা ঝরে পরলো।
শুভ হকচকিয়ে উঠলো।
সে হঠাৎ আমার কান্নার কারন হয়তো বুঝতে পারেনি।তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বলতে শুরু করলো,

—কি হয়েছে পিহু,কি হয়েছে তোমার?খারাপ লাগছে?মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে? আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছো?কে কি বলেছে তোমায়?কি সমস্যা পিহু?
কাঁদছো কেনো?

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম।কি অস্থির দেখাচ্ছে তাকে!কিন্তু আমি কাদলে সে অস্থির হবে কেনো?

আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম।আমার তাকানোর ভঙ্গিমা দেখে শুভ স্বাভাবিক হয়ে দাড়ালো।আমতাআমতা করে মাথা চুলকাতে লাগলো।
আমি চোখের জল হাত দিয়ে মুছতে চাইলে শুভ দৌড়ে এসে নিজের হাতে মুছে দিলো।
কাজ সেড়ে সে আবার পিছিয়ে গিয়ে আগের জায়গায় দাড়িয়ে পরলো।
তার এমন কাজে আমি বেশ অবাক হলাম।ছেলেটা অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত!
কখন কি করে মাথায় ঢোকেনা।
আমাকে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা নিচু করে মিষ্টি হাসলো।
রুম থেকে বাইরে যেতে যেতে বললো,

—রাতে মন ভরে আমায় দেখো বউ,এখন আমার সময় নেই।

আমি আবার কপাল কুঁচকলাম।

,

,

সকালে খাবার টেবিলে বসে বসে আমি আর আপা নাস্তা করছি।শুভ তাড়াহুড়ো করে না খেয়েই অফিসে চলে গেছে।সুট বুট পরে তাকে দেখতে একদম ছবির নায়কদের মতো লাগছিলো।হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে যখন সিড়ি বেয়ে নামছিলো তখন আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম।তবে পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলাম।
ছেলেটা দেখতে যতোই সুন্দর হোকনা কেনো?স্বভাব তার পুরো শয়তানের মতো।
কি পরিমানে জ্বালায় সে আমায়?
খাওয়ার মাঝেই আমার মনে পরলো,আজ সকালে শুভর ফোনটা নিতে চেয়েছিলাম আমি,কিন্তু মনে নেই।
রাতে নেবো ভেবে মনে মনে শান্তি পেলাম।
যাক প্রিতমের সাথে যোগাযোগ তো হবে।
মামা যখন জানতে পারে প্রিতমের কথা তখন থেকেই আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন।যাতে আমি তার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারি।
এ কটা দিন প্রিতম আমাকে না পেয়ে কি অবস্থায় আছে কে জানে?হয়তো কষ্টে আছে খুব!
আমার কষ্ট হলো।
আপা বিষয়টা লক্ষ করলেন।
গম্ভীর গলায় বললেন,

—পুটোটা খাবার শেষ না করলে হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবে না কিন্তু!

আমি মুচকি হাসলাম।গম্ভীর, রাগী হলেও মানুষটা ভালো,খুবই ভালো।রাগের মাঝেই সে তার ভালবাসা প্রকাশ করে।
দুটো দিনেই আমাকে কেমন আপন করে নিয়েছে সে।প্রথমে এসে তাকে ভুল বুঝলেও এখন তাকে মোটেও ভয় করছেনা আমার।উল্টো ভেতরটা প্রশান্ত হচ্ছে এই ভেবে যে,আমাকে ভালবাসার মতো আরেকটা মানুষকে পেয়ে গেছি।
আমাকে বিয়ে করার জন্য শুভর উপরে এতো এতো রাগ পুষে রাখলেও তার প্রতি রাগটা কমে গেছে।কাটন তার জন্যই তো আমি আপাকে পেলাম এখানে!

,
,
,
সারাটাদিন আমি আর আপা গল্প করে কাটালাম।বাড়িটা বিশাল।এতো বড় বাড়িতে দুজন কাজের লোক আর আপা আর শুভ ছাড়া আর কেউ থাকেনা।আমার খুব কৌতুহল হয়েছিলো, বলতে ইচ্ছে করছিলো,
—আপনাদের বাবা মা কোথায়?তারা আপনাদের সাথে থাকেনা?কোথায় থাকেন?পরিবারে আর কেউ নেই আপনাদের?

তবে বলতে পারিনি।মনের ভেতরই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

শুভ বাড়ি ফিরলো রাত করে।
আপা তাকে খাবার বেড়ে দিলেন।
শুভ রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো খাবার খেতে।
আমি উপরে রুমে বসে বসে হাত দিয়ে নখ কাটছি।এভাবে আমার ভালো লাগছেনা।প্রিতমের সাথে কথা না হওয়া পর্যন্ত ভেতরটা ছটফট করছে।
তাছাড়া মায়ের সাথেও কথা বলার আছে।তার সাথেও তো কথা হয়নি।না জানি সে এখন কেমন আছে?মামা মামি কেমন ব্যবহার করছে?
আমি শুভর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম।দরজার দিকে চোখ রেখে বসে রইলাম।
শুভ ফিরলো মিনিট দশেক পরেই।
ছেলেটা সব কাজেই ফাস্ট দেখছি!খুব দ্রুত কাজ সেরে ফেলতে পারে।
আমি তাকে দেখেই ফট করে দাঁড়িয়ে পরলাম।দ্রুত পায়ে তার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে একহাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম।
শুভ আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাতের দিকে তাকালো।
এক ভ্রু উঁচু করে বললো,

—কি?

—আপনার ফোনটা দিন?

—কেনো?কি করবা ফোন দিয়ে?গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি চেক করবা?

আমি কপাল কুঁচকালাম।ছেলেটা সবসময়ই আজেবাজে কথা বলে।
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,

—আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি তা জেনে আমি কি করবো?

—তাহলে আমার ফোনে তোমার কি কাজ?

—কল করবো?

—কাকে?

—মা এবং আর একজন কে।

শুভ চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকালো।কপালে তার ভাজ পরলো।মুখটাও একটু গম্ভীর হয়ে গেলো মনে হয়।
বললো,

—আর একজন টা কে?

—বলা যাবে না!

শুভ থমথমে গলায় বললো,

—সে কি প্রিতম?

আমি চমকে উঠলাম।শুভ প্রিতম নামটা জানলো কিভাবে?তাকে কে বলেছে?মামা?
শুভর দিকে তাকাতেই দেখলাম তার মুখের আদল পরিবর্তন হয়েছে।মুখে রাগী রাগী একটা আভাস দেখা যাচ্ছে। চোখদুটোও লাল বর্ন ধারন করছে।
আমি কিছুটা পিছিয়ে ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললাম।
মাথায় ঢুকলো না আমার কিছুতেই,
শুভ হঠাৎ এতোটা রাগলো কেনো?প্রিতমের কথাটা শুনে?
,

,

,চলবে……