#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_২৮
আবির নিশোর রুমে আছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। বাসায় সকালের নাশতা তৈরি করা শেষ হয়েছে। তোয়া সেগুলো খাবার টেবিলেও রেখেছে অনেক আগেই। রূম্পা বেগম জাফর সাহেবের নাশতা বক্সে নিয়ে একটু বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছেন। চেনা পরিচিত কোন গাড়ি চালককে পেলে তার কাছে দিয়ে দেবেন বলে।
তোয়া খাবার টেবিলে সবকিছু বারবার দেখছে। চুলায় পানি বসিয়েছে সে। চা করবে। আবির এ বাড়িতে এলেই আগে তাকে চা করতে বলতো। আজ যদিও বলেনি তবুও তোয়া স্থির থাকতে না পেরে নিজেই পানি বসিয়েছে চা করার জন্য। পানি ঠিকঠাক গরম হলে দুই কাপ চা করে নিশোর রুমের দিকে এগুলো সে। ঘরের দরজা কিছুটা ফাঁকা করা। দুইবার আঙুলের উল্টোপাশ দিয়ে করাঘাত করে প্রবেশ করল সে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল আবির একা বসে বসে ফোন টিপছে। নিশো কোথাও নেই। তোয়া এগিয়ে গিয়ে চাসহ ট্রে টেবিলের ওপর রেখে একটা কাপ হাতে নিয়ে আবিরের দিকে এগিয়ে দিল।
মৃদুগলায় বলল,
“তোর কড়া লিকারের রঙচা।”
“সকালে আমি চা খাই না।” ফোনস্ক্রিনে তাকিয়েই রইল আবির। চোখ না তুলে সেদিকে তাকিয়েই কথাখানা সংক্ষেপে বলল সে।
তোয়া চায়ের কাপ সেভাবেই ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এ বাড়িতে এলেই তো আমাকে চা করতে বলিস সেটা সকাল হলেও।”
“ চা খাই না। বাদ দিয়েছি। এখন কি এ বাড়িতে আসাও বাদ দিতে হবে?”
“সেটা কখন বললাম আমি?”
”নিশোও এখন চা খাবে না। ও ফ্রেশ হচ্ছে। বের হলেই ওকে নিয়ে বের হব। এগুলো নিয়ে যা।”
“আজব! তুই এভাবে কথা বলছিস কেন আমার সাথে?”
তোয়ার দিকে চাইলো আবির। একদম চোখে চোখ পড়ল। কড়া গলায় শুধালো,
“কীভাবে কথা বলছি আমি?”
“বিয়েতে না করেছিলাম বলে এমন ব্যবহার করছিস?”
আবির প্রত্যুত্তর না করে উল্টো শুধালো,
“ধরে নে তাই। ভালো ব্যবহার পেতে কি এখন বিয়েতে রাজি হবি?”
তোয়া চুপ রইল৷ কিছুক্ষণ পরেই মাথা নামিয়ে গলা খাঁদে নিয়ে বলল,
“তুই খুব খারাপ ব্যবহার করছিস, আবির। সেদিনের জন্য আমি আসলেই স্যরি। জানি না কী হয়েছিল আমার, কেন আমি ওমন ব্যবহার করেছিলাম। আ’ম স্যরি।”
আবির আগের মতোই কঠোর রইল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,“তোর স্যরি এক্সেপ্টেড। এখন যা।”
তোয়া মাথা উঁচু করে আবিরের দিকে চাইল। মুখ মলিন। চোখ দুটো যেন নিভু নিভু করছে। জ্যোতিহীন লাগছে। দূর্বল চাহনি।
“তোকে মিস করেছি খুব। তুই এতগুলো দিন আসিসনি। নিজেও তোদের বাড়িতে যাওয়ার সাহস পাইনি।”
তোয়ার কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আবির চাপা গলায় বলল,
“একদম আমার বিয়েতে যাওয়ার সাহস করিস৷ তোকে একসময় ভালোবেসেছে এমন মানুষটার বউ দেখে আসিস। তোকে কখনো বোন হিসেবে না ভাবা লোকটার সারাজীবনের সঙ্গীকে দেখে আসিস। তোর জন্য নিজেকে আমানত হিসেবে রাখা পুরুষটা কোনকিছু না ভেবেই সবার সামনে কারো দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবে সেটা দেখে আসিস। কোন নারীর সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিয়ে স্বামী হব ভাবতে পারছিস? ওহ তুই তো আবার আমার বোন। স্যরি।”
তোয়ার বুকটা কেঁপে উঠল। আবিরের কথাগুলো যেন সূঁচের মতো সমস্ত শরীর খুঁচিয়েই যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ঘন ঘন ফেলছে সে। চোখ অশ্রুপূর্ণ হতে চাইছে। সে তো আবিরকে ভালোবাসে না। আবির তাকে নিয়ে না ভেবে অন্যকাউকে বিয়ে করুক সেটাই তো সে চেয়েছিল তবে এখন কেন আবিরের এমন কথাবার্তায় পুরো শরীর ঝ*লছে যাচ্ছে?
তোয়া আবিরের কথার প্রত্যুত্তরে আর কোন কথা বলল না। এই আবিরকে সে চিনতে পারছে না। দূরের কোন অপরিচিত মানুষ মনে হচ্ছে। বড্ড অচেনা লাগছে।
চায়ের কাপটা ট্রে-তে রেখে সেটা নিয়ে বাহিরের দিকে পা বাড়াতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো।
“ কী রে তুই?”
নিশোর গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেল তোয়া। পিছনে ফিরতেই আবির নিশোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চা নিয়ে এসছিল তোয়া। বললাম আমরা কেউই এখন চা খাব না। বের হতে হবে।”
নিশো তোয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপ দুইটা দুই হাতে নিয়ে বলল,
“তোয়া চা বানিয়ে এনেছে আর তুই খাবি না? খেয়ে নে। আমি রেডি হই। সকাল সকাল এই এক কাপ চা হারানো যাবে না। তোয়া, তুই যা। ”
নিশো গিয়ে আবিরের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। তোয়া আর দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সে মনে মনে আন্দাজ করল আবির হয়তো চা খাবে না। তাকে ত্যাগ করেছে তার চা কী করে খাবে?
মিনিট দশেক পর নিশো আর আবির বেরিয়ে গেলে তোয়া আরেকবার নিশোর রুমে এলো। টেবিলের দিকে তাকাতেই বুক দ্বিগুণ ভারি হলো তার। একটা কাপ খালি আর আরেকটা কাপে যেমন চা ছিল ঠিক সেরকমই রয়ে গেছে। চা ভরতি কাপের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোয়া।
_______
নিশোকে আবির নিজের অফিসেই বসিয়ে রেখেছে। সকাল থেকে ওকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরেছে সে। নিশো যেন বসে বসে বাড়িতে বোর না হয়, চিন্তায় যেন ক্লান্ত না হয় মূলত সে কারণের আজ সকাল সকাল ওদের বাড়ি গিয়েছিল সে। বেলা বাড়লে, রোদ প্রখর হলে মাত্রই দুজন এসে বসেছে। কোনকিছুতে মন বসছে না নিশোর। বার-বার ওয়েবসাইট ভিজিট করার চেষ্টা করছে সে। বারবার লোডিং দেখাচ্ছে। আজ ভীষণ চাপ পড়েছে সাইবারে। কেটে গেল প্রায় আধাঘণ্টা। বাড়ি থেকে কল আসছে। ওদিকে ফালাকের মেসেজ৷ কোনকিছুতে রেস্পন্স করছে না নিশো। দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সে৷ মনোযোগ দিয়ে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে নিশো। ভীষণ চুপচাপ সে। হঠাৎ আবির চিৎকার দিয়ে উঠল। আবিরের চিৎকারে নিশো বুকে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে আবিরের দিকে তাকালো।
“ শা*লা, ভয় পাইয়ে দিয়েছিস। এভাবে কেউ চিৎকার দেয়? আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে।”
আবির হাসতে হাসতে নিজের ল্যাপটপটা নিশোর দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে চকিতে বলে উঠল,
“দেখ কী ঘটে গেছে!”
নিশো স্ক্রিনে চোখ বুলালো। মলিন মুখটা ধীরে ধীরে হাস্যোজ্জ্বল হলো। ওষ্ঠধরের উভয় প্রান্ত প্রসারিত হলো। সহসা বলে উঠল,
”বাবাকে কল দেই? তাকে জানাই তার ছেলে এই সময়টায় এসে জিতে গিয়েছে। আজ তার ছেলের পূর্ণতার দিন।”
আবির মৃদু হেসে বলল,“তাড়াতাড়ি জানা সবাইকে। আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি। একসাথে বাড়ি ফিরব৷”
আবির খুশি খুশি বেরিয়ে গেল। নিশো বাবার নম্বরটা বের করে কল দিল। জাফর সাহেব হয়তো ফোনের কাছেই ছিলেন। রিং হওয়া মাত্র রিসিভ হলো। নিশো কম্পিত গলায় বলে উঠল,
“আপনি কি নিশোর বাবা বলছেন? আপনার ছেলের রেজাল্ট পজেটিভ। আপনার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। আপনি কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার ছেলের রেজাল্ট সচক্ষে দেখতে পারবেন।”
জাফর সাহেব ছেলের সাথে নিজের খুশির এই অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করবেন? সামনে স্ত্রী আর মেয়ে বসে আছে। জাফর সাহেবের মুখে হাসি দেখে তোয়া মিটিমিটি হাসতে থাকলো। মাকে ডেকে বলল,
“ভাইয়ার রেজাল্ট ভালো এসেছে, মা।”
রূম্পা বেগম সাথে সাথে চলে গেলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে।
জাফর সাহেব শুধু মৃদু গলায় বললেন,“বাড়িতে এসো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি৷ আজ বাপ-বেটা মিলে মিষ্টি বিলি করব।”
______
রাত আটটা। পুরো বাড়িতে আজ ইদ ইদ আমেজ। চারদিক থেকে মানুষ এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ফোনের ওপর ফোন আসছে আত্মীয়স্বজনের কাছে থেকে। জাফর সাহেব নিজে এক গাদা মিষ্টি কিনে এনেছেন। দুই প্যাকেট মিষ্টি নিশোর হাতে দিয়ে বললেন,
“দুই ভাইবোন হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের কাকার বাড়ি ঘুরে এসো। অনেকদিন ধরে তোমাদের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তুমি কোনভাবেই অংশ নাওনি। আজ অন্তত গিয়ে ঘুরে এসো।”
তোয়া পাশে থেকে বলে উঠল,“আমি যাব না, বাবা। ভাইয়া যাক। ঘুরে আসুক।”
জাফর সাহেব ভ্রু উঁচিয়ে শুধালেন,“তোমার আবার কী অসুবিধা? যাও ঘুরে এসো।”
জাফর সাহেব বারবার বলা সত্ত্বেও তোয়া আসতে চাইছিল না। নিশো বাবার কথামতো তোয়াকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফালাকদের বাড়ি এলো।
বাড়িতে প্রবেশ করেই নিশো খাবার টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট রেখে জাভেদ সাহেবের গলা শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল। তোয়ার বান্ধবী কল করায় সে একটু বাহিরে দাঁড়িয়েছিল। দুই মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে কল কাটলো সে। তোয়া ভেতরের দিকে যাবে তখনই গলা খাঁকাড়ির আওয়াজ পেল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই আবিরকে দেখে মুখটা আবার চুপসে গেল। আবির বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলল,
”তুই এখানে?”
#চলবে…….
নিশো ফালাকের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার স্পর্ধা দেখালো। শীত, ঠান্ডা বাতাস তার ওপর মানুষটার প্রথম ছোঁয়ায় শরীরে যেন কল্পনীয় বরফ জমতে শুরু করল।
“ভালোবাসি।”
নিশোর এই কথাটা পুনরায় কানে পৌঁছতেই ফালাকের সমস্ত শরীর একবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল৷ নিশো সাথে সাথে ফালাকের হাত জোড়া শক্ত করে ধরে অবাক চোখে তার দিকে তাকালো।
“কী হলো? খারাপ লাগছে তোমার?”
”না, কেমন একটা লাগলো।”
“আমার এতবার বলা শব্দটা খারাপ লাগা সৃষ্টি করল? আমার তো সবসময় তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
“অদ্ভুত লাগলো।”
“ভালোবাসো?”
ফালাক নিশোর চোখে চোখ রেখে মনের বিপরীত কথাটা উচ্চারণ করল, ”উহু, মন্দবাসি।”
নিশো ফালাকের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ঠোঁটের দিকে তাকালো। সজ্ঞানে ভুলের পথে এগুতে থাকল সে। হাত ছেড়ে দিল মুহূর্তেই। এক হাত ফালাকের গাল স্পর্শ করল আর অন্য হাত ফালাকের গলার ওপরের দিকের অংশটা। ঠোঁটের দিকে নজর নিবদ্ধ রেখে এগুতে থাকলে ফালাক নিশোকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“আমি এসবে অভ্যস্ত নই, নিশো। আমি ওই ধরনের টিপিক্যাল, গ্রাম্য টাইপ মেয়ে যারা কথায় কথায় বলে বিয়ের আগে এসব চুমুও খেতে পারব না।”
নিশো অবাকমিশ্রিত গলায় বলল,“চুমু খেতে হলেও কি বিয়ে করতে হবে?”
“এখন আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আমার দিকে দেখতেও আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে।”
“ভেবে বলছো?”
চলবে।