#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০৬)
লেখাঃ- সুহাসিনী
কেউ বাক্সটা খুলছে। কিন্তু এপাশে তো সানা ঠিকই বসে আছে। ওর অস্তিত্ব আমি তো ঠিকই বুঝতে পারছি। চমকে উঠে বুকশেলফের দিকে চোখ ফেরালাম। কেবল একটা বড় লম্বা হাত শেলফের বাক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অথচ কোনো মানুষ নেই।
হাতটা খুঁজে খুঁজে আমার কালার পেনটা বের করে দিলো। আমার চোখ দুটোকেও যেন বিশ্বাস করাতে পারছি না আর। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। একটা মানুষের হাত এত লম্বা হতে পারে! তাও আবার আমার বোন সানা। ভয়ে মাথাটা ঘুরে উঠলো। শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আবার এপাশে সানার দিকে ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য! সানা চুপচাপ পা দুলিয়ে বিছানায় বসে আছে। এমন ভাব করে আছে যেন কিছুই ঘটেনি। প্রথম প্রথম আমার গলার স্বর আটকে রইলো। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে সানাকে বললাম,
-এইসব কী হচ্ছে সানা?
-কোথায় কী হচ্ছে? এভাবে বকা দিচ্ছো কেন আজ তুমি?
– বকা দেবো না? তোর কী হয়েছে সত্যি করে বল।
-আমার আবার কী হবে। বরং তোমার কী হয়েছে সেটা বলো। বাসায় আসার পর থেকে কিসব পাগলামি করছো তুমি।
টেবিলের উপর খেয়াল করে দেখি কালার পেনটা রেখে দিয়েছে। ওটা হাতে নিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলাম,
-একদম আমার সাথে উলটাপালটা বকবি না। তুই এখানে বসে আছিস, অথচ তোর হাত ওই বুকশেলফে কীভাবে গেল? এত লম্বা হাত কীভাবে হলো? ব্লাকম্যাজিক শিখেছিস, তাই না?
সানা আমার দিকে কিছুই না বুঝার মতো অদ্ভুতভাবে চেয়ে রইলো। আমার কথা যেন কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। কেবল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওভাবে চেয়ে থেকে সানা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
-কাকে কী বলছো বোকার মতোন, তুমিই ভালো জানো। আগে আমাকে জানো, তারপর কথা বলো।
-তোকে জানবো মানে?
সানা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। দুই হাত সামনে পিছে দোলাতে দোলাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বইয়ের দিকে আর মনোযোগ দিতে পারছি না। আমার চোখের দৃষ্টি কখনোই ভুল হতে পারে না। আমি স্পষ্ট দেখেছি ওকে হাত লম্বা করে বুকশেলফ থেকে পেনটা খুঁজে বের করতে। রাগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। “এরা আমায় একদম পাগল করে দেবে। সবাই যেন আমাকে মানসিক রোগী প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি সত্যিই মারা যাবো। রিদম তো মরে গিয়ে ভালোই করেছে। ”
আমার চিৎকার শুনে মা হঠাৎ ছুটে এসে আমার ঘরে ঢুকলেন। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। মায়ের পায়ের আওয়াজ পেয়েই চোখ মেলে তাকালাম। বিরক্ত হয়ে উনি বললেন,
-এত চেচামেচি করছিস কেনো? আর কে মারা গেছে বলছিস?
মায়ের কথায় সম্ভিত ফিরে পেলাম। মা কী রিদমের মৃত্যুর কথা শুনে নিয়েছে? ভয় ভয় দৃষ্টিতে ধরা পড়া চোরের মতোন মায়ের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে রইলাম। মায়ের তখনো বিরক্ত মাখা চেহারা। আমার দিকে আরো একটু সরে এসে বললেন,
– কী হয়েছে তোর? এমন পাগলামি কেন করছিস?
আমি চুপ করে আছি। মা আবার বলতে লাগলেন,
-কে মারা গেছে রে?
আমতা আমতা করে জবাব দিলাম,
-কই, কেউ মারা যায়নি তো। কে মারা যাবে?
– অহ, আচ্ছা। ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে চিৎকার কেন করছিস,বল তো?
মা আমার গলায় হাত দিয়ে পেচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নিজের বুকের সাথে জাপ্টে ধরলেন। মায়ের দুই হাতের মাঝে আমি গলন্ত বরফের মতোন আগলে আছি। এর চেয়ে সুখের আর কোনো জায়গা সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তামাম পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কিছুই সৃষ্টি করে নি। মা’কে জবাব দিলাম,
-তোমার ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে সানা, আমাকে কীসব অদ্ভুত কথা শুনিয়ে গেল এখন।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-সানা.!
– হ্যাঁ। ও এখন আমার রুমে এসে বিছানায় পা দুলিয়ে বসল। আমি বুকশেলফ থেকে কালার পেনটা চাইতেই এখান থেকে এত্তবড় লম্বা হাত ওই শেলফে এগিয়ে গেলো। তারপর পেনটা দিয়েই পালিয়ে গেল ঘর থেকে। একটা জবাবও দিল না।
-তুই কী সানাকেই দেখেছিস?
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। একটু বিরক্তির সুরে জবাব দিলাম,
-তো আমার চোখ কী অন্ধ হয়ে গেছে? ওকেই তো দেখলাম।
-সানা তো সেই তখন থেকেই আমার পাশে বসে আছে। তোর চিৎকারে ওকে চুলো পাহারা দিতে বসিয়ে রেখে আমি ছুটে এলাম। এর ফাঁকে সানাকে কীভাবে এই ঘরে দেখেছিস? কীসব পাগলের মতোন কথা বলিস।
মা সানাকে ডেকে বাইরের রান্নাঘর থেকে ভিতরে আসতে বললেন। সানা মায়ের আদেশ মতো ধীর পায়ে আমার ঘরে এল। মুখে পিঠার ময়দাও কিছুটা লেগে আছে। মা’কে এই মুহুর্তে ছেড়ে দিয়েছি অজান্তেই। সানা আমাকে জিজ্ঞাসা করল,
-তোমার কী হয়েছে আপু?
-সানা, তুই এখানে আমার কাছে এসেছিলি তো?
-কখন?
-মাত্র একটু আগে।মিথ্যে বলবি না একদম। আমি স্পষ্ট দেখেছি তোকে। ওই লম্বা হাতটা তোর, না? তুই আজকাল ব্লাকম্যাজিক করছিস? এখানে এই বিছানায় বসে অতদূরের বুকশেলফে কোনো সাধারণ মানুষের হাত যাবে না। এই তোর মধ্যে কোনো আত্মা ভর করেনি তো? মিথ্যে কথা বলতে দুই গালেই থাপ্পড় দেবো।
সানা আমার দিকে বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলতে লাগলো,
-মা, আপু এসব কী বলছে? আমি তো তোমার কাছেই ছিলাম। আর এইসব অদ্ভুত কাজ আমি কীভাবে করবো?
সানার মিথ্যে কথা মোটেও সহ্য হল না। কিছুদিন ধরে সবার চোর পুলিশ খেলা দেখতে দেখতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। ধীরে ধীরে আমাকে সবাই মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছে।
রাগে চেয়ার থেকে উঠে সানার দিকে এগিয়ে কষে সানাকে একটা থাপ্পড় মারবো, ঠিক সেই সময় মা খপ করে আমার হাত আটকে ধরলেন। বেশ কয়েক মুহুর্ত সেভাবেই শক্ত করে ধরে আছেন। মায়ের দিকে চোখ লাল করে কড়া দৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু সেই শক্ত দৃষ্টি ধরে রাখা সম্ভব হল না। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই মাথা নামিয়ে নিলাম। মা বললেন,
-তুই কালই মানসিক ডাক্তার দেখাবি। নিজের আপন ছোটবোনের গায়ে হাত তুলতেও বাধছে না আজকাল? তোর মনে হচ্ছে মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগামীকালই তোকে ডাক্তার দেখাতে হবে।
চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম। সত্যিই তো, আমি তো সানাকে কখনো মারি না। ওর গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, চোখ রাঙিয়েও কথা বলি না। ওর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম,
-সারা, আমার কাছে আয় বোন।
সারা কেবল মুখের মধ্যে আঙুল পুরে অসহায়ের মতোন তাকালো। তারপর মায়ের আঁচল ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমার কাজে ওর ভারি কষ্ট লেগেছে। আবার বললাম,
-আচ্ছা, আমি এই কানে ধরছি। প্লিজ বোন আমার, কষ্ট পাস না। আপু ক্ষমা চাচ্ছে তো।
সানা হাসলো না। তেমনি নির্বাক দাঁড়িয়ে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন,
-তুই বরং একটু বিশ্রাম নে। মনকে স্থির কর। কাল ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে তোকে।
নিজের কথা শেষ করে আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মা সানাকে নিয়ে চলে গেলেন। সারা তেমনি চুপচাপ। একটা ধমকেই মেয়েটা এমন নির্বাক হল কেন? খুব বেশিই কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
রাতে বই পড়তে পড়তে কখন জানি ঘুমিয়ে গেছিলাম। আজ সারার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করা আমার মোটেও উচিত হয়নি। ওদিকে ত্রাত্রি আর ফাইজা আপুকেও এখনো কল দিতে পারিনি। কী করছে, কে জানে। ফ্ল্যাটে কী এখনো সেইসব অদ্ভুতুড়ে ঘটছে? ওদের কী সমস্যা হচ্ছে! ওদের যদি সমস্যা হয়েও থাকে, তবে আমার এখানে কেনই বা আজ আমার সাথে এমনটা ঘটলো। একটা লম্বা হাত আমাকে শেলফ থেকে বই বের করে দিল।
ভয়ে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারছি না। ভয় আর ক্লান্তির যে মিশ্রণ মানুষকে কাবু করে দেয়, সেই সেন্স থেকেই বোধহয় কখন যেন সামান্য ঘুমের ঘোর নেমেছিল।
হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই মনে হল, কোথাও যেন নূপুরের শব্দ বাজছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর সেই শব্দ…
(to be continue…)