অনুর উপাখ্যান পর্ব : ২

0
3372

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ২

‘তাই তো এখন জেনে কি লাভ ? আল্লাহ্ তার সাথেই আমার জুড়ি লিখে রেখেছেন । কি করার আছে আমার ! তবুও কেনো জানি আব্বুর প্রতি আমার অভিমান বাড়ছে । কেনো এখানে বিয়ে দিলেন আমাকে ? যদি মারুফের কোনো অতীত সত্যি বের হয়ে আসে ! তখন ? তখন আমি কি করব ? যতই বলি এখন জেনে কি লাভ ! মন কি সেটা মানে ? ভাবিটাকে কত অনুরোধ করলাম, তাও বলল না কিছু । অন্য কারো কাছ থেকে জানা ও সম্ভব না এখন । আমাকে তো বাসার নিচেই যেতে দেয় না শাশুড়ি মা ।আর নিজেদের ছেলের গোমর কি কেউ প্রকাশ করে ? মনের মধ্যে এক অজানা ভয় নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে ।

অনুর বিয়ের ঘটক ছিল অনুর আব্বু জামিল সাহেবের এক বন্ধু । তার বর্ণনায় ছেলে শিক্ষিত খুবই ভালো,ফ্যামিলি ভালো, তেমন ঝামেলা নেই । বাবা, মা আর একটা বোন বিয়ের বাকি ।ছেলের নিজের ব্যবসা আছে । বাড়ি ঢাকার বাহিরে হলেও এলাকা টা খুবই সুন্দর ! জামিল সাহেব সব শুনে আগ্রহী হলেন । অনুর শ্বশুড় বাড়ির পাশের এলাকায় অনুর আপন চাচাতো বোন মিরার বিয়ে হয়েছে । জামিল সাহেব তাই মিরার জামাইকে ছেলের বিষয়ে সব খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব দিলেন । মিরার জামাই ও বললেন ছেলে খুবই ভালো । কিন্তু, পরে বিয়ের কার্ডে ছেলের নাম দেখে মিরার জামাই তো অবাক ! সে, যে ছেলের তথ্য দিয়েছেন এটাতো সে ছেলে না ! তবে তাদের দু’জনের ভালো নাম একই এবং তারা দু’জন ঘনিষ্ট বন্ধু । কথায় আছে : নামে নামে নাকি যমে টানে । অনুর ক্ষেত্রে ও তাই হলো । আর এভাবেই অনুর জীবন ধ্বংসের উপাখ্যান শুরু । বিয়ের মাত্র কয় দিন বাকি,সব আয়োজন শেষ । মিরা আপা ও দুলাভাই পুরো বিষয়টা গোপন করলেন । এদিকে যথাসময় অনুর বিয়ে হয়ে গেলো কথিত মারুফের সাথে । আমি আব্বুর উপর কেনো অভিমান করছি ? আসলে দোষ তো কোনো মেয়ের বাবার না ।মেয়ের বাবা ছেলের চেহারা দেখে কি করে বুঝবেন যে,ছেলে খারাপ ? কারণ, অমানুষ গুলো যে দেখতে অবিকল মানুষের মতোই ।

বিয়ে বাড়ি থেকে একে একে সব মেহমান চলে গেলেন । একদিন সন্ধ্যায় মারুফের মেজো ভাই মাসুদ নিচ তলায় তার ফ্ল্যাটে সবাইকে ডাকলেন । কি নাকি জরুরি কথা বলবেন তিনি । সবাই উনার কথা শোনার জন্য উপস্হিত হলেন । আমি নিরব স্রোতার মতো ঘরের এক কোনে বসে রইলাম ।

— মা, আমার তো মালয়েশিয়ার ভিসা অইছে । এহন সমস্যা অইল টেকা । আমিতো ব্যবসায় লস খাইছি জানেন ই । অহন এত টেকা তো আমার কাছে নাই । কি করমু কন ? টেকা কই পামু ? মারুফ তুই কি কস ?

— ভায়ে, টেকা তো আমি দিতাম পারতাম, যদি এহন বিয়া না করতাম । বিয়াতে এত খরচ অইছে,আমার হাতে তো অহন টেকা নাই । কইত্তে দিমু টেকা ?

— মারুফ, ক্যান তুমি টেকা দিতে পারতানা ? তুমি বিয়াত এত টেকা খরচ করছ, তোমার বউরে গয়না দিছো । আর নিজের ভাইরে টেকা দিতে পারতা না কেমন কতা এইডা ! টেকা তুমিই দিবা, কইত্তে দিবা জানি না ।

মায়ের আদেশ শুনে মারুফ বলে উঠল : ঠিক আছে আমি অনুর গয়না বেইচ্চা টেকা দিমুনে ।

ভায়ের কথা শুনে সীমার মুখে তৃপ্তির হাসি ! কারণ সে তার বড় বোনকে ডিঙিয়ে পালিয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছে । তাই তার ভাগ্যে কোনো গহনা জুটেনি । অথচ অনু বাবার বাড়ি থেকে এক সেট গহনা, আবার এখান থেকেও এক সেট গহনা মিলে দুই সেট গহনা ! কেনো থাকবে তার এত গহনা ? তাই তো ! কেনো থাকবে ? সীমা হচ্ছে একজন নারী । আর নারী যে সবসময় ত্যাগ এ সুখি হয় তা সত্য নয় ; নারী ক্ষেত্র বিশেষে অন্যের দু:খেও সুখি হয় ! চোখের সামনে অনু আজ তারই প্রমান পেলো ।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

মারুফের কথার কোনো হেরফের হলো না । সকালে উঠেই তার দেয়া অনুর গহনার সেট নিয়ে ঢাকা চলে গেলো বিক্রি করতে । কিন্তু, সত্য তো প্রকাশ পাবে এক দিন না এক দিন ।কিছু দিন পর অনু বুঝতে পারল এসবই ছিলো সাজানো ঘটনা, অনুর গহনা ফেরত নেয়ার জন্য । কারন মারুফ গহনা গুলো কিছুদিনের জন্য ভাড়া এনেছিল ! গহনা নিয়ে অনুর কোনো আফসোস নেই । এমন পরিবেশ তো সে আগে কখনও দেখেনি । তার কাছে এই অদ্ভুত বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে থাকাটাই বড় বিষয় এখন । আর গহনা দিয়ে কি হবে, যদি মনেই শান্তি না থাকে ।

ক’দিন ধরে অনুর শরীরটা কেমন যেনো খারাপ লাগে । বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হয় তার । প্রতিদিন সকালে এ জন্য শাশুড়ি মায়ের কথা শুনতে হয় ।সব মিলিয়ে মনটা খারাপ । মনের কথা বলার কেউ নেই । মারুফকে বলার প্রশ্নই আসেনা । সে তো বাসায় এসে মায়ের ঘরে গিয়ে বসে থাকে ।পরে রাতের খাবার শেষে অনুর শরীর নিয়ে কিছুক্ষন মেতে উঠে । তারপর প্রতিদিনের মতো সে তার ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুম দেয় । রাতে তার আচরণ দেখে মনে হয় যেনো রুটিন ওয়ার্ক করছে সে ! কোনো ভালোবাসার ছোঁয়া নেই তাতে । মারুফের কাছে মনের কোনো দাম নেই । সহজ ভাবে তাই তাকে বলতে পারছেনা যে এক মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু, তার পিরিয়ড হয়নি এখনো । আম্মুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে । টেলিফোন সেট ড্রয়িংরুমে, তাই মন খুলে কথা বলা যায় না । আর ঢাকায় কল দিলে বিল ও বেশি আসবে । কিন্তু, আম্মু ছাড়া কাকে বলব সমস্যার কথা ? দুনিয়াতে আম্মুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাকে বুকে আগলে রাখবেন । ইসস ! কতদিন আম্মুর মুখটা দেখি না !

— হ্যালো আম্মু, আসসালামু আলাইকুম ।কেমন আছ তুমি ? আব্বু কেমন আছেন ?

— অনু ! হ্যাঁ মা, আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি । তুমি কেমন আছ ?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি । আম্মু, একটা সমস্যা হয়েছে আমার ।

— কি হয়েছে মা ? তাড়াতাড়ি বলো আমাকে ।

— এ মাসে আমার পিরিয়ড হয়নি । একমাস পার হয়ে গেছে । শরীর কেমন যেনো লাগে আম্মু। অনেক দূর্বল লাগে !

— সর্বনাশ, জামাই কোনো ব্যবস্হা নেয়নি ?

— না, তার কথা বাদ দাও । আমি কি করব তাই বলো !

— শোনো, আর এক সপ্তাহ দেখে তারপর ইউরিন টেস্ট করাবা । মনে হয় তুমি প্রেগন্যান্ট মা । মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নাও । আল্লাহ ভরসা ।

— আম্মু, আমি এখন কি করব ? তোমাদের জামাইকে কী বলব ? সেদিন বলছিল তার নাকি বাচ্চা পছন্দ না !

— কি ! বাচ্চা পছন্দ না, তবে ব্যবস্হা নিল না কেনো ? তুমি যে ছোট সেটা সে জানে না ? আচ্ছা বাদ দাও মা । মন দিয়ে শোনো : তুমি এখন থেকে আনারস খাবে না, পেঁপে খাবে না আর কালোজিরা খাবে না । উঁচু জুতা পরবে না ।বাথরুমে খুব সাবধানে যাবে ।ভারী কাজ করবে না মা । খুব সাবধানে থাকবে । অবশ্যই এ নিয়ম গুলো মানবে কিন্তু ।

— কেনো আম্মু ? আনারস,পেঁপে খেলে কি হবে ?

— বাচ্চা পেটে নিয়ে এগুলো খেলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায় । কোনো ভাবেই এ গুলো খাবে না ।আর চিন্তা করবে না মা । হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করবে সবসময় । দেখি তোমার আব্বুকে পাঠাবো তোমাকে আনতে । একদম চিন্তা করবে না মা ।

— আচ্ছা আম্মু খাবো না, তুমি চিন্তা করো না । আব্বুকে সালাম দিও ।এখন রাখি, বিল বাড়ছে ।আল্লাহ হাফেজ ।

— আল্লাহ হাফেজ মা ।

মিসেস জামিলের মনটা কেমন করছে মেয়ের জন্য ! মেয়ে যদি সত্যি প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে তবে তাকে নিজের কাছে এনে রাখবেন । কিন্তু, জামাই যদি রাজি না হয় ? তবে তো মেয়েটার অনেক কষ্ট হবে ওখানে । কেনো জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা ঐ বাড়িতে ভালো নেই । হুট করে কেনো যে বিয়েটা দিতে গেলাম ! এখন আল্লাহই একমাত্র ভরসা ।

ফোন রেখে অনু ঘরে গিয়ে শুয়ে রইল । ভালো লাগছে না কিছু । যদি সত্যি বাচ্চা পেটে হয়, তবে তো আম্মু যা যা বলেছেন সব মেনে চলতে হবে । আজ যে ভাবেই হোক মারুফের সাথে কথা বলতে হবে । কিন্তু, কিভাবে ? এই লোকটার সাথে মনে হয় আমার প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক ! কোনো ভাবেই তার সাথে সহজ হতে পারছি না । সে তো আমার সাথে একটু মন খুলে কথা ও বলে না । যা খুশি বলুক না কেনো, সে সন্তানের বাবা হবে জানলে নিশ্চই খুশি হবে ।এটাই এখন আমার একমাত্র শান্তনা ।

— একটা কথা বলব ?

— কি কইবা কও ।

— আমার তো এ মাসে পিরিয়ড হয়নি । কি করব ?

— কি করব মানে ? এহন কোনো বাচ্চা নেওন যাইতো না । আজাইরা কতা কইয়া লাভ নাই ।

— মানে ? নেয়া যাবে না মানে কি ?

— মানে যদি বাচ্চা ধরে, তয় বাচ্চা নষ্ট করবা ।

— কি ! আল্লাহ যদি আমাদের সত্যি বাচ্চা দিয়ে থাকেন, তাকে মেরে ফেলব ! আপনি কি মানুষ ? আমি জীবনে ও এ কাজ করতে পারব না ।

— ঐ, বিয়া করছি মাত্র এক মাস । এহন বাচ্চা ধরলে ফুর্তি করুম কেমতে ?

— ছি ! আপনি এত খারাপ ! এতই যদি চিন্তা আপনার তবে ব্যবস্হা নিতে পারলেন না ? আমি না হয় ছোট, কিন্তু আপনি তো আর ছোট না । বিয়ে করলে যে বাচ্চা হতে পারে সেটা আপনি জানতেন না ?

— বেশি কতা কইবা না । যা কইছি তাই অইব । কবে টেস্ট করতে যাইবা কও ?

— আরও সাত দিন পর । তবে আপনি মাথায় রাখেন বাচ্চা নষ্ট আমি কখনো করব না ।

— হ দেখমুনে করো কিনা ।এহন এদিকে আইয়্যো ।

— কেনো ? হাত ছাড়েন প্লিজ, আমার শরীর অনেক খারাপ লাগছে ।

— শরীর খারাপ তাতে আমি কি করতাম ? কাছে আইয়্যো শরীর ভালো অইয়া যাইবো ।

চলবে……

✍? নায়না দিনা