ভুলিনি তোমায় পর্ব-১৮

0
3127

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :১৮

.
.
.
উনি বারবার আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করছেন কিন্তুু আমি একইভাবে কান্না করতেছি..!!আমাকে থামাতে না পেরে উনি জোরে এক ধমক দিলেন সাথে সাথে আমার কান্নার আওয়াজ একদম বন্ধ হয়ে গেলো তবে চোখের পানি পড়া বন্ধ হয় নি।ভয়ে গুটিশুটি মেরে উনার বুকের সাথে মিশে রইলাম। উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,,”একটু আওয়াজ যদি শুনি তাহলে আমি তোমাকে ওর কাছে দিয়ে আসবো..!!”

আমি ভয়ে চুপ করে গেলাম।কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খবর ই ছিলো না..!!

হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমাকে ডাকছে।আদো আদো চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম উনি আমার উপর ঝুঁকে আমাকে ডাকতেছে।উনাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা হ্যাং হয়ে গেলো। উনার মাথায় সাদা টুপি পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর ব্লাক ট্রাউজার। ভাগ্যিস ট্রাউজার অন্য কালারের ছিলো না হলে সব সাদা দেখে আমি ভুত বলে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। কেনো জানি উনাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো,,আমি অদ্ভুদভাবে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। তখনই উনি এক ধমক দিয়ে বললেন,,”উঠো না কেনো,নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে তো..!!এতো কুম্ভকর্ণেরর মতো ঘুমাচ্ছো কেনো???”

হুটহাট ধমক শুনে কেঁপে উঠলাম,আমি দ্রুত উঠে বসে পড়লাম।উনি হয়তো বুঝেছেন যে আমি একটু ভয় পেয়েছি।উনি মিষ্টি হেসে আমার পাশে বসে বললেন,,”সরি,আসলে তোমাকে কখন থেকে ডাকতেছি আর তুমি উঠতেছো না।তাছাড়া আমার দেরী হলে তো সবার সাথে পড়তে পারবো না তাই।”

আমি মুখ গোমড়া করে বসে বসে ঝিঁমাতে লাগলাম।উনি আমার দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকালেন তারপর উঠে চলে গেলেন।একটুপর ব্রাশ নিয়ে এসে আমার মুখে ডুকিয়ে দিলেন।আচমকা এমন হওয়ায় আমি চমকে উঠলাম।চোখে-মুখে হাজার হাজার বিরক্তি ফুটে উঠলো।উনার দিকে এমনভাবে চাইলাম যেনো উনাকে খুন করে ফেলবো।উনি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে ব্রাশ করাতে লাগলেন।

ব্রাশ করানো শেষ হওয়ার পর আমাকে ওয়াশরুমে যেতে বললেন।আমার কোনো হেলদোল না দেখে উনি কোলে করে নিয়ে যেতে লাগলেন।কিন্তুু বিছানা থেকে দুই কদম নিয়ে নামিয়ে দিয়ে উনার কোমর ধরে বললেন,,”মাগো মাআআ..আমার কোমর শেষ।”

এ কথা বলে উনি একটু সোজা হয়ে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
—“ভাবলাম তোমাকে সিনেমার নায়কের মতো কোলে নিবো,কিন্তুু তোমার যে ওজন। তোমারে দেখলে মনে হবে তুমি জীবনেও কিছু খাও না,,শুকনো লাঠির মতো।আর এখন দেখি তুমি কুমড়ার মতো।আল্লাহ্,,এত ভারী..!! ”

উনি আমার উপর থেকে নিচ একবার তাকিয়ে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,,”এই তুমি কী খাও বলো তো,,না মানে দেখতে ফিটফাট বাট.. ”

এটুকু বলেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি ভয়ানক রেগে আছি,,আমি চোখ রাঙ্গিয়ে উনার দিকে একবার তাকিয়ে হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।খুব রাগ লাগতেছে,,,ওয়াশরুমে এসে ফোসফোস করে মুখ ধুয়ে বের হলাম।

আমি রুমে ডুকতেই দেখলমা উনি দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতেছেন,,এটা দেখে আমার আরো রাগ লাগলো। আমি আবারো গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

আমাকে আবারো বিছানায় দেখে উনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,,”কি হলো, শুয়ে পড়লে যে..!!নামাজ পড়বে না??”

উনার প্রশ্ন শুনে আমার মুখের রং বদলে গেলো,,,মাথা নিচু করে বসে রইলাম।উনাকে কি বলবো,কীভাবে বলবো??

উনি আমার পাশে বসে বললেন,,”কী হলো নামাজ পরবে না?”

আমি আগের ন্যায় চুপ কর রইলাম।আসলে আমি নামাজ পড়া ভুলে গিয়েছি,,এখন এটা উনাকে কীভাবে বলবো??কতদিন পড়ি নাই এখন ঠিক মতো মনেও নাই।

—“কী হলো?কোনো সমস্যা আছে নাকী?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হুম..!!”

উনি ধীর কন্ঠে বললেন,,”ওহ্..!!”
উনি উঠে চলে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই আমি মাথা নিচু করে বললাম,,”আমি আগে পারতাম, কিন্তুু এখন ভুলে গিয়েছি..!!”

উনি প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন কিন্তু আমার কতা শুনে থেমে গেলেন। উনি অবাক হয়ে বললেন,,”মানে???”

আমি মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো হয়ে এক নিশ্বাসে বলে বললাম,,”আব্ আসলে আমি নামাজ পড়া ভুলে গিয়েছি..!!”

উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।হয়তো বিশ্বাস করতে পারতেছে না যে এত বড় মেয়ে নামাজ পড়তে পারে না।এবার আমার কান্না পাচ্ছে। উনি দরজা থেকে ফিরে আমার কাছে আসতে লাগলেন।আমার ভেতর অজানা ভয় হতে লাগলো। উনি চুপচাপ আমার পাশে বসলেন।

—“তুমি নামাজ পড়তে পারো না??”

আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালাম।উনি মিষ্টি হেসে বললেন,,,”তো আমাকে সেটা বলবে না?আমি তো অন্যকিছু ভেবেছিলাম..!!”

আমি অবাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম,,যার অর্থ “মানে??”

উনি দাত বের করে হাসি দিলেন।সাথে সাথে আমি বুঝে গেলাম।এতো সময় আমার মুখে লজ্জা ছিলো কিন্তু এখন রাগ এসে ভর করলো।উনি এত খারাপ কেনো?সবসময় অন্যকিছু কেনো বুঝে?

—“আচ্ছা তুমি নামাজ পড়তে ভুলে গিয়েছো এটা নিয়ে এতো শরম কেনো পাচ্ছো?স্বাভাবিক এমন হতেই পারে,,,অনেকেই তো ভুলে যায়।তাই বলে শরম পাবো বলে চুপচাপ থাকবে নাকি?উল্টো উচিত শরম-লজ্জা উপেক্ষা করে নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম শেখা। একটা কথা জানো,শিক্ষার কোনো বয়স নেই,,যে কোনো বয়সে যে কোনো কিছু শেখা যায়।কিন্তুু আজকাল সবাই তথা কথিত ইজ্জতের ভয়ে সঠিক শিক্ষা নেয় ও না।এখনও অনেক মানুষ রয়েছে যারা নামাজের সঠিক নিয়ম জানে না,, এবং এ বিষয় টা তারা নিজেও জানে। কিন্তুু সঠিক টা শিখতে চায় না,কেনো জানো কারন তারা ভাবে লোকে কী বলবে?আচ্ছা বলো তো লোকের বলা দিয়ে কী আসে যায়?লোকের বলাতে কী উনাদের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে? সমস্যা টা উনাদের না,, সমস্যা টা হচ্ছে উনাদের চিপ মাইন্ডের। কবে যে এমন চিপ মানসিকতা পরিবর্তন হবে।”
এটুকু বলে উনি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।তারপর আমাকে বললেন,,
—“যাও গিয়ে ওজু করে আসো..!!”

আমি উঠে চলে আসলাম।আর ভাবতে লাগলাম কতটা উচ্চমানের উনার ভাবনাচিন্তা।কত সুন্দরে উনি আমার বিষয়টা বুঝলেন,,উনার পরিবর্তে অন্য কেউ হলে নিশ্চয় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।মনের ভেতর কোথাও একটু নিজের প্রতি তিক্ততা ছিলো কিন্তু এখন উনার কথা শুনে কিছুটা কমে গেলো।

ওজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলাম উনি দুটো জায়নামাজ একসাথে বিছিয়ে রেখেছেন। আমাকে বের হতে দেখে উনি মিষ্টি
হাসলেন। আমি ওড়না টা ভালো করে মাথায় পেঁচিয়ে নিলাম।উনি এক পাশে দাড়ালেন আর অপর পাশে আমি দাড়ালাম। উনি আমার জন্য মসজিদে যান নি।অতঃপর দুজনে মিলে একসাথে নামজ পড়লাম।যদিও উনি আমাকে সব বলেছেন আবার দেখিয়ে দিয়েছেন।যেহেতু আগে পারতাম তাই সমস্যা হয় নি একবার দেখেই পেরেছিলাম। একটা জিনিস খুব ভাবলাম উনার পরিবর্তে যদি সৌরভ থাকতো তাহলে কী সৌরভও এমন করতো?

♣♣

সকাল সকাল রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিলেন উনি।আমাকে শুধু বলেছেন, উনার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিতে..!! উনার কথা শুনে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গিয়েছিলো,কারন আমি তো কিছুই বানাতে পারি না।সবসময় তো বাবা রান্না করতো।আমাকে কখনও কিছু শিখাই নি তাই পারি না।কিন্তুু এ কথা উনাকে কীভাবে বলবো,উনি হয়তো বলবেন যে তুমি কী পারো?কিছুই তো পারো না..!!

গত ২০ মিনিট যাবৎ কিচেন রুমে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবতেছি, কি করবো?কীভাবে করবো?
একটা মাঝারি সাইজের পাতিল নিতেই উনি কিচেনে প্রবেশ করলেন।

আমার হাতে পাতিল দেখে হা করে রইলেন,,উনি অবাক হয়ে বললেন,,”মাত্র পাতিল নিয়েছো?এতক্ষন তাহলে কী করেছো?এই,তুমি কী আদৌ চা বানাতে পারো তো?”

আমি চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ালাম যার অর্থ পারি না।উনি কিছু না বলে আমার হাত থেকে পাতিল নিয়ে বললেন,,” আজকে দেখো আমি কীভাবে করি..কালকে কিন্তুু তোমাকেই করতে হবে..!!”

আমি চোখ ছোট করে উনার দিকে তাকালাম,,উনি কীভাবে পারেন?

উনি পাতিলে পানি নিয়ে চুলায় বসাতে বসাতে বললেন,,”আমি তোমার মতো নই।একটু আধটু সব পারি।”

উনি কীভাবে বুঝলে,যে আমি এটা ভাবতেছি..!!

—“দেখো প্রথমে পাতিলে দুই কাপ পানি দিবে,,তারপর চুলায় মিডিয়াম আগুন দিয়ে বসিয়ে দিবে।একটুপর দেখবে পানি ফুটেছে তখনই চা পাতা দিবে।কয়েক মিনিট পর পাতিল নামিয়ে নিবে। এরপর আলাদা একটা কাপে দুই চামচ দুধ আর এক চামচ চিনি নিবে।তারপর চা ছাঁকনি দিয়ে ওই কাপে চায়ের লিকার দিবে।তারপর একটা চামচ দিয়ে নাড়াবে,,ব্যাস হয়ে গেলো চা..!!দেখেছো কত সহজ..!!”
(বিদ্র:আম্মু বলছে এভাবে চা বানায়..!!ভুল হলে বলে দিয়েন এডিট করে ঠিক করে নিবো!)

কথা বলতে বলতে উনি দুই কাপ চা বানিয়ে এক কাপ আমাকে দিলেন আরেক কাপ উনি নিজে নিলেন।আমি এতসময় উকি দিয়ে উনার চা বানানো দেখছিলাম,,ওমা আসলেই কত সহজ।এখন আমার মন বলতেছে,,”এটা তো আমিও পারতাম..!!”

উনি হাসিমুখে আমাকে বললেন,,”খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে?”

আমি একবার উনার দিকে তো একবার চায়ের দিকে তাকাচ্ছি।উনি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন কী? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,কিছু না। চায়ের কাপ টা মুখের সামনে নিয়ে এক চুমুক দিলাম।মাথা তুলে তাকাতেই দেখে উনি অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

উনি ঠোট প্রসারিত করে বললেন,,”কেমন হয়েছে?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,, ভালো।উনার মুখের রিয়েকশন টা একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছে,,,হয়তো অন্য কিছু আশা করেছিলেন।

উনি বললেন,,”ওহ্,,আচ্ছা রুমে চলো।”

বলেই উনি রুমের দিকে হাটা দিলেন।আমিও উনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম,কিন্তুু একটু যেতেই দেখলাম উনি সিড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন।আমি উনার দৃষ্টি অনুসরন করে সেদিকে তাকাতেই দেখলাম,,” রেদোয়ান ভাইয়া বালতি কাপড় নিয়ে ছাদে যাচ্ছেন।”

আমিও সেদিকে তাকিয়ে উনার পাশে গিয়ে দাড়াতেই শুনতে পেলাম উনি বিরবির করে বলছেন,,”এটা কী হলো?কালকেই তো ওরা ঝগড়া করছিলো তাহলে??”

উনার কথা শুনে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।আমি একটু জোরেই বললাম,,,”ছিঃ,কি লুচ্চা..!!”

উনি আমার কাছে থাকায় কথাটি শুনে ফেললেন, আমার দিকে তাকিয়ে দাত বের করে বললেন,,,”আমি কখন লুচ্চামি করলাম?তুমিই বলো আমি কী কিছু করেছি?”

উনার কথা শুনে আমার গা জ্বলে উঠলো।এতক্ষন উনাকে কত কিছুই না ভেবেছিলাম,আর এখন উনি?আমি দাত চেপে উনাকে পাশ কেটে রুমে চলে আসলাম। উনিও আমার পিছন পিছন রুমে আসতে লাগলেন আর পিছন থেকে বললেন,,,”তুমি আমাকে লুচু কেনো বললে?? বলো না,আমি কী কিছু করেছি???”
.
.
.
চলবে???