ভুলিনি৷ তোমায় পর্ব-১৯

0
3317

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :১৯
.
.
.
–“এই বলো না,তুমি আমাকে লুচু কেনো বলেছো?”

বারবার উনার এক কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম।উনার দিকে একবার ট্যারা চোখে তাকিয়ে আবার নিজের খাওয়াতে মন দিলাম। চা টা বেশ ভালো ই হয়েছে,, বাবাও ঠিক এভাবে বানায়। লাস্ট যেদিন বাবার হাতের চা খেয়েছিলাম সেদিন বাবা কত হাসিখুশি ছিলো।চায়ের দিকে তাকাতেই বাবার চেহারা টা ভেসে উঠলো।আমার চোখে জল চিকচিক করতে লাগলো। কোনোরকম চোখের পানি আটকালাম।

উনি আমার সামনে এসে বললেন,,”এই,তুমি শুনতে পাচ্ছো,আমি কী বলছি??”

উনার কথা শুনে আমি কিছুটা কেপে উঠলাম,,আমি তৎক্ষণাত মাথা নাড়িয়ে বললাম হুম।উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,”এই তুমি এমন কেনো?প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তোমার মুখের রং বদলায় কেনো?একটু আগে দেখলাম রাগ,আর এখন দেখি কান্না করতেছো??”

আমি মুখ ফুলিয়ে উনার দিকে এক পলক তাকিয়ে কিচেনের দিকে হাটা ধরলাম।কিচেনে ঢুকে কাপ রাখতেই দেখতে পেলাম রেশমি আপু সেমাই বানিয়ে প্লেটে নিচ্ছেন।আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে কাপ টা ধুয়ে রাখলাম। উনার দিকে আড় চোখে তাকতেই দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।দুজনে চোখাচোখি হতেই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

রেশমি আপু হাসিমুখে দুই বাটি সেমাই আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,,”এই নেও,,তুমি আর এহসান ভাইয়া খেয়ে দেখে বইলো তো কেমন হয়েছে,,আমি আবার এত ভালো বানাতে পারি না..!! খারাপ হলে বলার দরকার নেই তবে ভালো হলে বলিও, বুঝেছো..!”

এ কথা বলে উনি আমার হাতে ট্রে ধরিয়ে দিলেন আর উনি আরেকটা ট্রে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে চলে গেলেন।আর আমি ট্রে হাতে নিয়ে উনার যাওয়ার দিকে বোকার মতো চেয়ে রইলাম।মনে মনে একটা কথাই আওড়াতে লাগলাম,,”এটা কী ছিলো??”

রুমে আসতেই দেখতে পেলাম এহসান মোবাইলে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে কি যেনো বলছেন।আমাকে দেখে উনি সাথে সাথে সেটা লুকিয়ে ফেললেন আর এমন ভান করলেন যেনো উনি কারো সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন। আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে উনার দিকে এক পলক তাকালাম। তারপর এক বাটি সেমাই উনার দিকে এগিয়ে দিতেই উনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।আমি কিছু না বলে উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম।

উনি আমার দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকালেন,কেমন বিরক্তিকর মুখ করে সেমাই টা খেতে লাগলেন।সেমাই মুখে দিতেই উনার মুখের বিরক্তিভাব টা চলে গেলো।উনি মিষ্টি হেসে বললেন,,”খুব ভালো হয়েছে।কে বানালো?তুমি?না না তুমি কীভাবে বানাবে তুমি তো আমার সাতেই ছিলে তাহলে এত মজারর সেমাই কে বানালো???”

উনি কিছুটা চিন্তিত ভাব করলেন,, কয়েক সেকেন্ড পর হাসিমুখে বলে উঠলেন,,”রেশমি!!!ইয়েস,আই এম ড্যাম শিউর এটা রেশমি বানিয়েছে।রেদোয়ান একবার আমাকে বলেছিলো রেশমি নাকী খুব ভালো রান্না পারে।সত্যি তো,অসম্ভব ভালো হয়েছে।ওয়াওও”

বলে উনি মজা মজা করে খেতে লাগলেন।উনার এসব দেখে আমি নিজের বাটি থেকে সবগুলো উনার বাটিতে ঢেলে দিতে লাগলাম।উনি হা হয়ে বললেন,,”এই,এই,কী করছো??”
আমি উনার দিকে পাত্তা না দিয়ে সবগুলো দিয়ে দিলাম। একদম পুরো বাটি খালি করে আমি রুম থেকে বাহির হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।তখনই উনি পিছন থেকে গেয়ে উঠলেন,,” ফাইটা যা,বুকটা ফাইটা যায়..!!”

আমি এক কদম পা বাড়িয়েছিলাম কিন্তুু উনার কথা শুনে থেমে গেলাম।আমার পুরো শরীর জ্বলে উঠলো,,”এটা,কী বললো?? ” রেগেমেগে ধুপধাপ পা ফেলে আবারো উনার সামনে এসে দাড়ালাম।উনারর মুখে তখনও শয়তানী হাসি লেগে রয়েছে।

আমি ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলাম,,”আপনি কী বললেন???”

উনি অবাক হওয়ার ভান করে বললো,,”কই,কী বললাম??”

উনার হেয়ালী দেখে আমার রাগের পরিমান আরো বেড়ে গেলো। আমি দাত চেপে বললাম,,”একটু আগে যে টা বললেন,,ওই কী যেনো,,ফেটে যায় না কী যেনো।ওইসব কেনো বললেন??”

উনি ইনোন্সেন্ট ফেস করে মুখ নাড়িয়ে বললেন,,”ওহ্,,ওইটা?আরে আমি তো গান গেয়েছিলাম,,সুন্দর না??”

আমি দাত চেপে চোখ কুচকে উনার দিকে তাকাতেই উনি বাম হাত দিয়ে উনার সামনের চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,,, “আই নো আই নো, খুব সুন্দর হয়েছে।”

আমার রাগ টা যেনে এবার আসমান ছুঁই ছুঁই হয়ে গেলো। উনার দিকে একবার রাগী চোখে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।

♣♣

এহসানের ফ্ল্যাটের গেস্ট রুমের জানালা দাড়িয়ে বাহিরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছি।মনে মনে একটা প্রশ্ন আওড়াচ্ছিলাম “আচ্ছা এখন তো বর্ষাকাল না তাহলে এখন বৃষ্টি কেনো হচ্ছে?” যদিও বৃষ্টির পরিমান টা তেমন বেশি না,,হালকা হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কেমন একটা শীত শীত অনুভব করছিলাম। কয়েক দিন থেকে আমি আমার মধ্যে একটা বিষয় খুব ভালো করে খেয়াল করেছি,,আর সেটা হলো,,আমি যেকোনো সময় একা হলেই অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার এ বিষয়টার উপর আমি নিজেই বিরক্ত।আরো কয়েকটা জিনিস দেখলাম,,যেমন,হুটহাট হেসে উঠা,হুটহাট কেঁদে দেওয়া আবার একেক সময় এতো বকবক করি অন্যসময় একদম চুপ থাকি। নিজের এমন বিষয়গুলোতে নিজেই যখন চরম বিরক্ত নিশ্চয় অন্যরা আরো বিরক্ত।

—“ইশশ,কী সুন্দর একটা রোমান্টিক ওয়েদার।আর এ সময় আমার জামাই টা আমার সাথে রোমেন্স না করে কোথায় কেথায় ঘুরঘুর করছে।ধুরর,বিরক্তিকর..!!”

আচমকা এমন কথা শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম।পিছনে তাকতেই দেখলাম এহসান স্টাইল করে আমার দিকে হেটে আসতেছেন,,উনি আমার দিকে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,,”কী এটাই তো ভাবতেছিলে, তাই না???”

উনার এমন কথা শুনে আমি রেগে গেলাম।বলে কী এসব?আমি এসব কখন ভাবলাম?আমি রেগে নাক মুখ ফুলিয়ে চোখ বড় করে উনার দিকে তাকালাম।

আমার এমন তাকানো দেখে উনি ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বললেন,,”তুমি এমনভাবে তাকাচ্ছো কেনো?আমি তো এমনিতেই বলেছিলাম..!!”

আমি জবাব দিলাম না।একবার চোখ ট্যারা করে তাকিয়ে আবারও নিজের ভাবনায় মনোযোগ দিলাম।উনি এসে আমার গা ঘেষে দাড়াতেই আমি চোখ ছোট করে উনার দিকে তাকালাম।উনি কিছু না বলে শুধু দাত কেলালেন।আমি বিরক্তিকর চাহনী নিয়ে একটু সরে দাড়ালাম।

—“যাও,রেডী হয়ে নাও,,আর দশ মিনিট পর আমরা বের হবো??”

উনার কথা শুনে আমি উনার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালাম।উনি গা ছাড়া ভাব করে বললেন,,”এতো তাকানোর কী আছে??তুমি বুঝো না আমরা কই যাবো?নতুন নতুন বিয়ে করে মানুষ কই যায়,জানো না??”

আমি কপাল কুচকে তাকাতেই উনি লাজুক মুখে বললেন,,”আরে হানিমুনে যাবো..!!”

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,,”কিহহহ??”

উনি থতমত খেয়ে বললেন,,”আরে চিল্লাচ্ছো কেনো?আমি তো এমনিতেই বলেছি,হসপিটালে যাবো।ভুলে গেছো, আজকে তোমার ডাক্তারের কাছে ১০ টার সময় ভিজিট আছে।”

আরে হ্যা, সোমবার ১০ টার সময় তো আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তারিখ।ওহ্ আজকে তাহলে সোমবার। সেদিন তো উনারা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তখন তো আপু আর ভাইয়ারা নিতে দেয় নি।সে সময় ডাক্তার বলেছিলো আমাকে নিয়ে যেনো উনার কাছে চেক আপ এর জন্য নিয়ে যায়। উনারা যাওয়ার সময় আমাকে কতগুলো ঔষধ দিয়ে ছিলেন, এগুলো খাওয়ার পর আমার অবস্থা কেমন হয় সেটা দেখবেন।

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি আমি, আমার পাশেই বসে আছেন উনি। ডাক্তার রিপোর্টের পাতাগুলো এপাশ ওপাশ করতে করতে বললেন,,”মিঃ এহসান,,,উনার সমস্যা টা ছোট থেকেই,,আমরা ভেবেছিলাম হয়তো উনি উনার বাবার মৃত্যুর ধাক্কা টা নিতে পারে নি তাই উনার এমন অবস্থা হয়েছে।কিন্তুু বিষয় টা মোটেও এমন নয়, ছোট থেকেই উনার সমস্যা রয়েছে,রিপোর্ট অনুযায়ী উনার মানসিক বিকাশও ঠিক মতো হয় নি।প্রচুর পুষ্টির অভাব রয়েছে,,উনার মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমার ধারনা মতে,উনি হয়তো বেশিরভাগ সময় একা একা থাকতেন। আপনারা যদি এখন উনার প্রোপার ট্রিটমেন্ট না করান তাহলে ভবিষ্যৎ এ সমস্যা টা বড় আকারের ধারন করবে।”

এহসান এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন,,

–“আমাদের কী করা উচিত???”

ডাক্তার ঔষদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,,,

–“হুম,,আমরা যে ঔষধগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো অনেকটা উপকারী হয়েছে।আপনার কথামতে পেশেন্টের অবস্থা তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এগুলো রেগুলার কন্টিনিউ করবেন পাশাপাশি এ ঔষধগুলোও দিবেন।আর হ্যা প্রতি সপ্তাহে একবার চেকআপ করিয়ে নিয়ে যাবেন।আশা করি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।”

উনি একটু ইতস্ত ইতস্ত করে বললেন,,,

–“জ্বি।স্যার একটা প্রশ্ন ছিলো,যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আর কী করতাম।

ডাক্তার স্বাভাবিকভাবেই বললেন,,

–“জ্বি অবশ্যই করুন।”

এহসান একটু দম নিয়ে একদমে বললেন,,

—“স্যার আপনার মতে রিপোর্টে নাকি এতো টাও খারাপ নয়।তাহলে আপনাদের নার্সরা নায়লাকে কেনো মেন্টাল হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলো???”

ডাক্তার এবার একটু আমতা আমতা করতে লাগলেন।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলেন।আমাদের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললেন,,,

–“আমাদের কী দোষ।পেশেন্টের ফ্যামিলি মেম্বার ই তো বলেছিলো, পেশেন্ট নাকী অনেক অদ্ভুদ আচরন করে এবং অনেক মানুষকে নাকি আঘাতও করেছে।তাই তো আমরা চেক আপ ছাড়া ই উনাকে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তুু শেষে তো আর নিতে পারলাম না তাই চেক আপ এর জন্য আসতে বলেছিলাম।আমরা কী জানতাম নাকী যে পেশেন্টের অবস্থা এতটাও খারাপ নয়।”

এহসান দাত চেপে বললেন,,

–“আপনি কী আমাকে বলতে পারবেন যে এসব বলেছে সে কে??”

ডাক্তার একটু চিন্তিত ভাব নিয়ে বললেন,,,

–“উনার নাম তো জানি না তবে উনি সেদিন ডার্ক ব্লু কালারের জামা পরে ছিলেন। ”
.
.
.
চলবে???