অন্তরালে তুমি পর্ব-২৭

0
2371

#অন্তরালে_তুমি
#Part_27
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
সময় যে কিভাবে গড়িয়ে চলে যায় তা বুঝা বেশ দুষ্কর। এইতো কয়েকদিন আগেই শরৎ এর প্রভাব ছিল চারদিকে। পাখির কলরবে পরিপূর্ণ একটি মিষ্টি সকাল ছিল। কিন্তু আজ শীতের কুয়াশায় ঘেরা শিশির ভেজা স্নিগ্ধ সকাল। কখন যে শরৎ শীতকে আহ্বান জানিয়ে নিজে বিদায় নিলো বুঝাই গেল না। উত্তরা বাতাস বইতে শুরু করেছে। হাল্কা শীতের প্রকোপও ছড়িয়ে পড়েছে সকলের মাঝে। পাখিরাও এখন সারাদিন অলস ভঙ্গিতে শুকনো গাছের এক কোন চুপটি করে বসে থাকে। এই ঋতুর সাথে অলসতার যেন এক নিবিড় সম্পর্ক। এইদিনে মানব প্রজাতিও প্রচুন্ড রকমের অলস হয়ে উঠে। সাথে গাঢ় হয়ে আসে তাদের ঘুম। শীতের সকালে ঘুম যেন দুই নয়ন হতেই যেতে চায় না। চম্বুকের মত চোখের পাতার সাথে লেগে থাকে।
যেমনটা আজ হচ্ছে আরিহা আর ইহানের সাথে। ঘুম যেন আজ তাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। জানালার গ্রিলের ফাঁক নিয়ে হাল্কা সোনালী রোদ উঁকি ঝুঁকি করছে। বারান্দা থেকে ৩ হাত দূরে ইলেক্ট্রিক তারের মধ্যে একটি কাক অলস ভঙ্গিতে বসে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠছে। আরিহা এইবার ধীর গতিতে চোখ খুলে তাকায়। ঘুমের রেশ এখনো কাটে নাই। আরিহা উঠে বসতে নিবে কিন্তু পারলো না। ইহান ওকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে শুয়ে আছে। আরিহা মাথা তুলে ইহানের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। ইহানের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। হাল্কা কালছে ঠোঁট দুটো উল্টিয়ে ঘুমিয়ে আছে। একদম বাচ্চার মত লাগছে তাকে। আরিহা আলতো হাতে ইহানের এলোমেলো চুলগুলো আরেকটু অগোছালো করে দিল। তারপর মিষ্টি সুরে ইহানকে ডাকতে থাকে,

— ইহান উঠো! দেখ কত বেলা হয়ে গিয়েছে। এই ইহান উঠো?

আরিহার ডাক ইহানের কানে পৌঁছাতেই ইহান একটু নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার বদলে আরিহাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর ইহান আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকায়। অতঃপর আরিহাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি হেসে বলে,

— গুড মর্নিং জানপাখি।

আরিহা এইবার একটু কাঠ কাঠ গলায় বলে,
— গুড মর্নিং পড়ে বলো আগে আমাকে ছাড়। দেখ কত বেলা হয়ে গিয়েছে।

ইহান ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— আমি এত সুন্দর করে গুড মর্নিং বললাম আর তুমি কি বিশ্রী ভাবে বললে। এইটা কোন কথা? এখন এর শাস্তি স্বরুপ তোমাকে অতি সুইট ভাবে আমাকে গুড মর্নিং উইশ করতে হবে আর একটা মর্নিং কিস দিতে হবে। তা না হলে নো ছাড়াছাড়ি অনলি জড়িয়ে ধোরা-ধোরি।

আরিহা কিছুটা উঁচু গলায় বলে,
— ইহাননন!! ছাড় বলছি আমায়।

ইহান ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
— আগে কাছে আসা-আসি তারপর ছাড়াছাড়ি। আই ওয়ান্ট মাই মর্নিং কিস।

এই বলে আরিহাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে সে। আরিহা কতক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে উপায় না পেয়ে অতি বিনয়ী সুরে গুড মর্নিং বলে তারপর টুপ করে ইহানের গালে চুমু দিয়ে বসে। ইহান এইবার মুচকি হেসে আরিহার কপালে ভালবাসার এক স্পর্শ একে উঠে পড়ে।

?

এই কয়েকমাসে সব কিছু অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে সকলের জীবন। সেই রাতের পর থেকে আরিহা আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। গাম্ভীর্য ভাবটা যে চলে গিয়েছে তা কিন্তু নয়। আরিহার মধ্যে গাম্ভীর্য, রাগ, সেই শান্ত চাহনি সবই আছে শুধু মুখের হাসিটা নতুন করে যোগ হয়েছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে সে। সেই হার্টলেস আরিহাটা যেন আজ একটু হলেও নরম হয়েছে। নমনীয় হয়েছে ওর ব্যবহার।

সেইদিন নিজের কষ্ট গুলো একজনের সামনে খোলা বইয়ের মত তুলে ধরতে পেরেছিল বলে আজ সে মুক্ত পাখির মত ডানা ঝাপটে উড়তে পারছে। হাসতে পারছে। অতীতের সেই তিক্ত স্মৃতি গুলো আর তার পায়ের মধ্যে শিকল রুপে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সবই ইহানের জন্য হয়েছে। ইহান তার কথা রেখেছিল। আরিহাকে সে একা ফেলে দেয় নি। বরং অতি নিবিড়ভাবে আরিহাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছিল সে। আরিহার সকল কষ্ট গুলো নিজের ভালবাসার চাদরে মিশিয়ে দিয়েছে সে। নিজের অন্তরালে তুমি বানিয়ে নিয়েছে আরিহাকে। আরিহার সকল কিছুর দায়িত্ব সে নিজের উপর নিয়ে নিয়েছে। ওকে টাইম টু টাইম খাওয়ানো, মেডেসিন দেওয়া, প্রতিদিন নিজের বুকে জড়িয়ে ঘুমানো, ওকে নিয়ে খুনসুটি করা সবই যেন ইহানের অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছে। আরিহাও মেনে নিয়েছে সব। ইহান যে তারও অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। ইহানের ভালবাসায় আজ আরিহা পরিপূর্ণ। আরিহাও মনের গহীন হতে নিজের অজান্তে ইহানকে ভালবেসে ফেলেছে। নিজের অন্তরালে ইহানকে জায়গা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু এখনো ইহানকে ভালবাসি কথাটা বলা হয় নি। বলা হয়নি আমার অন্তরালে তুমি।

এইদিকে, ২ সপ্তাহ হলো রাহুল আর অর্পির বিয়ে হয়েছে। আপাতত তারা রাঙ্গামাটি গিয়েছে হানিমুনের জন্য। সেখানে তাদের সময় বেশিরভাগ খুনসুটির মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।

সোহেল আর এরিনার মধ্যে এখন ফোনেই আলাপ হয়। মাঝে মধ্যে ভিডিও চ্যাটে। এরিনা ঠিক করেছে ও দেশে ফিরে আসতেই দুইজন মিলে ইহানকে তাদের কথা জানিয়ে দিবে। অতঃপর ইহান যা বলে তাই তারা মেনে নিবে।

তীব্র আর পুষ্পিতার এংগেইজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে তাদের বিয়ের ডেট পড়েছে। দিনে দিনে দুইজনের মধ্যে থাকা ভালবাসাটি যেন গভীর হতে গভীর হয়ে চলেছে।

জিসান বাংলাদেশেই সেটেল হয়ে গিয়েছে। ঢাকা মেডিক্যালে একটা চেম্বারও পেয়েছে সে। আপাতত সেখানেই কাজে লেগে পড়েছে। এরই মধ্যে নীরার সাথে জিসানের বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে৷ নীরা তো মনে মনেই জিসানকে ভালবেসে ফেলেছে কিন্তু জিসানের মনে কি আছে তা এখনো জানা হয় নি। তাই তো নীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে নিজ থেকেই জিসানকে ভালবাসি কথাটা বলবে। এখন শুধু মাত্র নির্ধারিত দিনটির অপেক্ষা।

?

সোফার এক প্রান্তে বসে আছে আরিহা। কোলে তার ল্যাপটপ। খুব মনোযোগ সহকারে কাজ করছে সে। ইহান তার পাশেই থাল ভর্তি ভাত নিয়ে বসে আছে। নিজে তো খাচ্ছেই সাথে আরিহাকেও নিজ হাতে খায়িয়ে দিচ্ছে। আরিহা খেতে না চাইলেও ইহান জোড়পূর্বক ভাবে খাওয়াচ্ছে। এইদিকে খাবারের গন্ধে আরিহার গা গুলিয়ে আসছে। একদমই সহ্য হচ্ছে না। ইহান তা দেখে লেবু কেটে এনে তা ভাতের সাথে মেখে তারপর খাওয়াচ্ছে। তাও সে আরিহাকে না খেয়ে উঠতে দিবে না। ভাতে লেবুর মাখার ফলে আরিহারও এখন গা গুলাচ্ছে না। যার জন্য সেও চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। এইভাবেই আরিহার শরীর প্রচন্ড পরিমাণে দূর্বল থাকে। নিজের যত্ন না নেওয়ার কারণে কেমন রোগা রোগা ভাব চলে এসেছে ওর মধ্যে। তাই তো ইহান এইবার মাঠে নেমেছে আরিহাকে একদম স্বাস্থ্যবান বানানোর উদ্দেশ্যে।
অপর পাশের সোফায় জিসান চিপস খাচ্ছে আর ইহান আর আরিহার কান্ড কারখানা দেখছে। জিসানের বেশ মজাই লাগছে এইসব দেখছে। উপভোগ করছে এইসব দেখে। মাঝে মধ্যে টি-টেবিলে রাখা কোকের বোতলে চুমুক দিচ্ছে। আরিহা এইবার জিসানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি সুরে বলে,

— জিসান!!

আরিহার এত মধুর ডাক কানে পৌঁছাতেই জিসানের ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকায় তারপর বলে,
— কি??

আরিহা হাল্কা হেসে বলে,
— একটু কোক দিবি আমায়?

জিসান আরিহার দিকে ভ্রু কুচকে রেখে বলে,
— ওই তুই আমার খাবারের দিকে নজর দেওয়াও শুরু করেছিস। শরম করে না নিজের স্বামী থাকতে স্বামীর সতীনের কাছে কোক চাইতে। নির্লজ্জ মহিলা!

আরিহা এইবার কিছুটা মুখ ফুলিয়ে বলে,
— আর তুই মনে কত সাধু? তোর লজ্জা করে না আমার স্বামীকে সতীন বানিয়ে বসে আছিস। অন্যের সংসারে কু নজর দিস। নির্লজ্জ পুরুষ!

দুইজনের কথা শুনে ইহানের মাথা ঘুরে যায়। সে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে বলে,
— ভাই রে ভাই! কে কার সতীন আগে ওইটা ক্লিয়ার করো। আমি জিসানের সতীন না নাকি ও আমার সতীন?

ইহানের এমন কথায় আরিহা আর জিসান কিছুক্ষণ দুইজন দুইজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। অতঃপর দুইজন উচ্চ সরে হেসে উঠে। ইহান এইবার নিজের প্রশ্ন বুঝতে পেরে সেও হেসে উঠে। জিসান উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে আরেকটা কোকের বোতল নিয়ে এসে আরিহাকে দেয় খাওয়ার জন্য। আরিহা সেটা নিয়ে প্রথম চুমুক দিতেই মুখ বিকৃত করে ফেলে। হুট করেই তার কোকের টেস্টটা কেমন বিদঘুটে লাগছে। আরিহা সাথে সাথে তা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বলে,

— এইটা টেস্ট এমন কেন?

জিসান আর ইহান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর জিসান কোকটা নিয়ে টেস্ট করে দেখে কোক তো ঠিকই আছে। তাহলে আরিহা এমন বলছে কেন? জিসান আরিহার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে যে,

— কোকের টেস্ট তো ঠিকই আছে। তুই এমন নাক ছিটকাচ্ছিস কেন?

আরিহা কিছুটা ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
— আমার কাছে তো কেমন বিদঘুটে লাগলো। অবশ্য এখন প্রায় জিনিসের টেস্টই কেমন বিদঘুটে লাগে।

জিসান কিছুক্ষণ আরিহার দিকে ভ্রুকুটি কুঞ্চিত চেয়ে থাকে। আরিহাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তখনই আরিহার ফোন বেজে উঠে। আরিহার ফোন রুমে থাকায় সে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে ওর মাথা ঘুরে উঠে আর সে সোফায় ধপ করে পড়ে যায়। এই দেখার সাথে সাথে জিসান আর ইহান একটু চেঁচিয়ে বলে উঠে,

— আরিহা!!!

#চলবে