ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-১২

0
3981

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১২
রোকসানা আক্তার

সকালের আলো ছড়ায়।মোরগ কুক কুরু ডাকা শুরু করে দিয়েছে।নাতাশা কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরেকটু ঘুমনাোর আপ্রাণ চেষ্টায়।পাশে রুব্বান নাক ঢেকে ঘুমচ্ছে।নিদ,নিতু ঘুম থেকে উঠে মক্তবে রওনা করেছে।
নাতাশার মা হালকা কুয়াশার ঘোরের মধ্যে কোমরে আঁচল গুঁজে চিনি,ময়দা,ডিম নিয়ে পাকঘরের দিকে যাচ্ছেন।
সাধারণত,গ্রাম্য অঞ্চলের মহিলারা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে।আর খুব সকালে পাকঘরে গিয়েই চুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়।তাদের রান্নাকরার খুব তাড়া থাকে।কারণ,পুরুষরা লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে মাঠে, গরু-ছাগল নিয়ে খেতে এবং বিভিন্ন কর্মস্থলে বেরিয়ে পড়ে।
বেলা অনেক হয় তবুও সূর্যের দেখা মিলছে না।কুয়াশার চাঁদর এখনো চারদিক ছড়ানো।ফাঁকে,ফাঁকে হালকা কুয়াশা কেটে গেছে।দূরের বস্তু সুস্পষ্ট না হলেও আবছা দেখাচ্ছে।হুট করে পূব আকাশের মাঝে সূর্যের লালমাখা রং একটু উঁকি মারে।নাতাশার মা সেদিকে লক্ষ করেই নাতাশাকে ডাকতে থাকেন।
-নাতাশা,আর ঘুমাইস না।রোদ চলে আসতেছে। রোদে এসে রোদ পোহাইস।
নাতাশা তার মায়ের কথার ধ্বনি শুনে ঘুম ঘুম ঘোরে কাঁথা সরিয়ে বিছানা উপর উঠে বসে।আর রুব্বানকে হাত দিয়ে ডাকতে থাকে।।
এরইমধ্যে,নিদ,নিতু মক্তব থেকে চলে আসে।দৌড়েই পাকঘরে ঢোকে।
-মা?মা?তয়া মামা কলসি ভরে খেজুরের রস নিয়া আসতাছে আমাদের বাড়ি।
নাতাশার মা কপালের ভাঁজ কুঁচকে আবার স্বাভাবিকে আনেন।তিনি কাল রাতেই তয়াদের বাড়ি গিয়ে খেজুর রসের তালাস করেছিলেন।সে কারণে,তয়া এখন রস নিয়ে আসতেছে।
-হু।জানি।তোরা ঘরে গিয়ে জায়নামাজটা রেখে বারান্দায় গিয়া বস।আমি নাস্তা নিয়ে আসতাছি।
-আচ্ছা,মা।নাতাশা এবং রুব্বান আপা কি উঠছে ঘুম থেকে?
-নাহ।গিয়া জাগিয়ে তোল দুজনকে।
-জ্বী,মা।
নিদ,নিতু চলে যায় ঘরের দিকে।নাতাশা ঘর থেকে বের হয়ে আসে।উঠোনের এসে কলের কাছে যায়।কলের হাতল ধরে চাপ দিয়ে কয়েক কোষ পানি হাতে নিয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে দেয়।সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আড়মোড়া ভেঙ্গে যায়।তারপর মায়ের কাছে যায়।
-রুব্বান কি উঠছে,নাতাশা?
-হু,মা।
-বারান্দায় গিয়ে বস সবাই। আমি নাস্তা নিয়ে আসতেছি।
-আচ্ছা, মা।
নাতাশা পাকঘর থেকে ফিরে এসে বাবার রুমে উঁকি দেয়।বাবা খাটের চৌকাঠের সাথে হেলান দিয়ে বসে বসে তসবি পড়ছেন।নাতাশা ঘরে ঢুকে তার বাবাকে বলে,
-বাবা?নাস্তা করতে এসো।
নাতাশার বাবা মুখটা গোল করে হাসে।তসবিটা নিচে নামিয়ে বলে,
-বাবার যে ডায়বেটিস সমস্যা জানিস না?
-হু,জানিতো।
-তাহলে কিভাবে বাবা মিষ্টি খাবো!?
-মা তোমার জন্যে আলাদা রুটি বানিয়েছে।তোমাকে আমাদের খাবার খেতে হবে না।
-ওউউ,রুটি বানিয়েছে?
-হু,বাবা।
-আচ্ছা চল।
নাতাশার বাবা বিছানা থেকে নেমে গাঁয়ে একটা চাঁদর এঁটে নেন।কাতর শরীর নিয়ে মেয়েকে সাথে করে বারান্দায় আসেন।তারপর সবাই একসাথে নাস্তা শেষ করে।নাতাশা রুব্বানকে আজও বাড়ি যেতে দেয়নি এই বলে যে সে রুব্বানকে নিয়ে কলেজে যাবে।
রুব্বানও মেনে নেয়।তারপর নাতাশা ঘরটা গোছগাছ করতে থাকে।পুরো ঘরের গোছগাছ শেষ হলে বাহিরে বের হয়।উঠোনের দক্ষিণ পাশের টঙয়ের উপর নির,নিদু এবং রুব্বান বসে বসে গল্প করছে।নাতাশা তাদের সামনে এসে রুব্বানকে বলে,
-রুব্বান?মাকে কোথাও দেখেছিস?
-পাকঘরে মনে হয়।
-নাহ পাকঘরে নেই।
-তাইলে যাইয়া দ্যাখ আসমা গো বাইত গেছে।
-ওহহ।আর এই নিদ,নিতু?তোরা স্কুলে যাবি না?
-আজকে আপু…!
-আজ কী!
রুব্বান পাশ থেকে টপকে বলে উঠে,
-তুই যো আইছস সেই খুশিতো আইজ স্কুল কামাই করবো!বুঝলি?
নাতাশা নিদ এবং নিতুর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়।আর তানা স্বরে বলে,
-নিদ,নিত?তোদের আমি আগে কি যেন বলতাম?
-আআআআআ…
-আআআআ শুনতে চাচ্ছি না।ঝটপট উওর চাচ্ছি।
-সবকিছু কম্প্রোমাইজ হলেও স্কুল কামাইয়ের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ নেই।(নিতু)
-হু,তাহলে মনে আছে তোদের?
-হা।
-ওকে!!তাহলে,স্কুল যাওয়ার জন্যে রেডি হ।আমি তোদের টিফিন প্যাক করছি।
-আচ্ছা আপু।
নাতাশা রুব্বানকে ইশারা করে বলে,
-তুই এখানে থাক।আমি আসছি।
-নাতাশা?আমি একটু বাইত যাই রে।কাইল আইছি,এহনো বাইত যাইনি।মায়ের লগে একটু দেহা কইরা আহি। তারপর চইলা আমু
-আচ্ছা,যা।
রুব্বান টঙ থেকে একলাঁফে নেমে যায়।ওড়না ঠিক করে হনহন করে বাড়িতে চলে যায়।নাতাশা পাকঘরে এসে চারটা রুটি ভাঁজ করে টিফিনে ঢুকায়।রুটির সাথে ডিম ভাঁজিটা মানানসই।এই মুহূর্তে সবজি ভাজি করাও সম্ভব না।নাহলে নিদ এবং নিতুর স্কুল দেরী হয়ে যাবে।কারণ, ক্লাস ৮টার দিকে আরম্ভ হয়।
নাতাশা ডিম খুঁজতে থাকে, খুঁজে পায়নি।কোথায় রাখতে কোথায় রাখতে পারে সে ভেবে নাতাশা অনেকক্ষণ সোঁজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।এরইমধ্যে নাতাশার মা পাকঘরে আসে।নাতাশার ভাবভঙ্গি দেখে বলে,
-কিছু খুঁজছিস,নাতাশা?
-ইয়ে মানে মা ডিম খুঁজে পাচ্ছি না।নিদ এবং নাতাশাকে টিফিন প্যাক করে দিতাম।
-মা ঘরে ডিম নাই।আমি এখন আসমাদের বাড়িতে গিয়া ডিমের জন্যে তালাস করে আসলাম পাইনি।
-মা?ডিমের জন্যে আরেক জনের বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিল?আরেহ আমাকে বললেই ত হত।এখানে একটু থাকো আমি আসতেছি।
নাতাশা তার মাকে পাক ঘরে রেখে বড় ঘরের দিকে ছুটে যায়।নিজঘরে ঢুকে পার্স ব্যাগ থেকে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে মায়ের হাতে নিয়ে দেয়।
-মা, করিম কাকারে দিয়া বাজার করিয়া আনো।মাছ,সবজি যাই পাও।
-কিন্তু ত-তোর কাছে আর টাকা আছে?
-মা? আসার সময় আমার শাশুড়ী আমাকে দশহাজার টাকা দিয়েছেন।টুকটাক জিনিসপত্রে দেড় হাজার খরচ হয়েছে।এখনে আমার কাছে সাত হাজারের মতো আছে।
-আর ভাঙ্গিস না মা ওগুলা রেখে দিস।
-নাহহ মা।বাবাকে ডাক্তার দেখাবো।বাবা ইদানীং কেমন রোগা রোগা দেখাচ্ছে।
নাতাশার মা চুপ হয়ে যান।তারপর মেয়ের কাঁধে হাত রেখে টাকা নিয়ে করিম আলীর বাড়ির দিকে রওনা করেন।
বারান্দার সামনে স্কুল ব্যাগ নিয়ে নিদ এবং নিতু দাড়িয়ে আছে।নাতাশা তার মায়ের আসার অপেক্ষায় বার বার পথের দিকে তাকাচ্ছে।নিদ সূর্যের আলোর দিকে তাকায় আর বলে,
-আপু? মার তো আসতে দেরী হবে।স্কুলে ক্লাস পড়ে যাবো।
-আর একটু অপেক্ষা কর লক্ষী।এই ত মা চলে আসবেন।
নাতাশাার কথায় নিদ, নিতু দাঁড়িয়ে থাকে।অনেকক্ষণ কেটে যায়।নাতাশার মা আসছে না।বাড়ির পাশের হীরা স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিতুকে ডাকতে থাকে
-কইরে নিতু তুই?স্কুল যাবি না?স্কুলের দেরী হইয়া গেসে আজ!
নিতু হাঁক ছেড়ে বলে,
-এই ত হীরা আমি।একটু দাড়া!
-আরেহ তুই ঘড়ির টাইম দেখছস ৭ঃ৫৩ বাঁজে।আর কতক্ষণ দাড়ামু।
নিতু হীরার কথায় চমকে উঠে।ব্যাগটা হাতে আকড়ে ধরে হীরার দিকে ছুটে যায়।গিয়ে বলে,
-চল হীরা!
নাতাশা থতমত খেয়ে বলে,
-আরেহ এই নিতু,আর একটু দাড়াস না।মা এসে পড়লেন বলে।
নিতু হীরার হাত ধরে পথের দিকে তড়িঘড়ি পা বাড়ায় আর বলে,
-আপু?আর দাড়ানোর সময় নাই।একদিন টিফিন না নিলে কিছুই হবে না।
নিদ আর দাড়িয়ে না থেকে সেও নিতুদের পেছনে ছোটে।নাতাশা চোখেমুখে নিরাশ ভাব এনে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ওদিক দিয়ে,
নীর কোটের টাই ঠিক করতে করতে বারংবার ভুল করে।আজ যে কেন টাইটা ঠিল মতো শার্টের সাথে এঁটাতে পারছে না সে নিজেই বুঝে না। টাইটা অনেকক্ষণ হাত দিয়ে নেড়েবড়ে কোনোমতে লাগিয়ে নেয়।বিছানা থেকে স্যুটকেস হাতে নিতেই মোবাইলে একটা এস.এম.এস আসে।
ডলি এস.এম.এস টা দিয়েছে।
-হাই নীর?আমি আজ তোর অফিসে যাবো।এবং আর্জেন্ট কিছু কথা বলার আছে।

নীর মুখে খানিকটা বিরক্তি চাপ এনে ফোনটা হাতের মুঠোয় নেয়।আর অন্যহাতে স্যুটকেস নিয়ে রুম থেকে বের হয়।
নীর বাড়ির বাইরে বের হয়ে গাড়ির সামনে যেতেই ছাদের দিকে নজর পড়ে।কারণ,ছাদের এই স্থানে একজন মানব অনেক দিন দাড়িয়ে ছিল।এই দাড়ানো নিচে থাকা মানবটিকে হায়/হ্যালো ইঙ্গিতের জন্যে নয়।এমনিতেই মনখারাপ মুডটাকে রাঙ্গাতে আকাশ,প্রকৃতিকে হাতছানি দিয়ে ডাকত।সে জানে মানুষের মনটা ভালো করতে প্রকৃতির অবদান অনেক।প্রকৃতির শ্যামল সৌন্দর্যেের কাছে দুঃখ,শোক,মলীনতা,ক্রোধ ইত্যাদি হার মানে।তবে,নীর যে নাতাশার দাড়িয়ে থাকাটা প্রায়শই লক্ষ করত তা বোধহয় নাতাশা জানে না।কখনো দুজনের চোখেচোখে নজরও পড়েনি। দু’জন দুই ধরনের মুড ছিল।নীরের ছিল আধিপ্যতের ইগো।আর সে তার ইগোকে প্রাধান্য দিয়েই নাতাশার উপস্থিতিকে ইগনোর করত।তবে,আজ সেই ইগোটা কোথায়?আজ যে ওই মানবটির অনুপস্থিততে ইগো জিনিসটা হারিয়ে গেলো নীরের।নীর খানিকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে।তারপর গাড়ি রান করে চলে যায়।

নাতাশা তার মায়ের সাথে রান্নাবান্না শেষ করে রুব্বানকে নিয়ে কলেজের দিকে রওনা করে।রিক্সা থেকে নেমে ডিপার্টমেন্টের দিকে যেতেই উল্লাসকে দেখতে পায়।সে নাতাশার দিকে হাত উঠিয়ে হায় বলে।নাতাশাও হাত উঁচিয়ে হায় গ্রহণ করে।উল্লাস দৌড়ে নাতাশাকে বলে,
-দোস কেমন আছিস?
-হু ভালো।তুই?
-এই ত চলে আমাদের সিঙ্গেল লাইফ!
নাতাশা চোখবুঁজে হেসে দেয়।উল্লাসও নাতাশার সাথে হাসতে হাসতে বলে,
-ভাবলাম তোর সাথে পিরীত করবো।কিন্তু তোর ত বিয়েই হয়ে গেল।হায় রে আমার কপাল!
-আমার জন্যে কি আছে!আমি ছাড়া ত আরো কত মেয়ে আছে!
-নাহ রে আমার চোখে শুধু তোকেই ভাল্লাগে।
রুব্বান খিলখিল হেসে দেয়।নাতাশার হাত চেপে বলে,
-নাতু,তোর বন্ধুটা ত হেব্বিরে।পিরীতের লাইগা যেহেতু মনটা এত্ত আনচান করতাসে তাইলে আমার সাথে ঘটিয়া দে।আমি ত এহনো সিঙ্গেল।
-আরে আস্তে কথা বল গাধী!ও ত শুনে ফেলবে।
-শুনলে শুনুক গা।আমি ত চাই একটু শুনবার যাতে আমি পিরীত করতে পারি।

উল্লাহ অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
-তোরা নিজেদের মধ্যে কিছু বলছিস?
-নাহ উল্লাস।
-তাহলে?
নাতাশা রুব্বানকে ইঙ্গিত করে উল্লাসের দিকে তাকিয়ে তর্জনী আঙ্গুল দেখায়।উল্লাস মুখ চেপে হেসে বলে,
-আচ্ছা আগে যা যা।পরে আবার কোনো কার্বার ঘটিয়ে বসবে।
রুব্বান ক্রদ্ধ হয়ে নাতাশার দিকে তাকায়।আর উল্লাসের উপর ক্ষেপে যায়।উল্লাসকে পাশ কেটে আসতেই রুব্বান বলে উঠে,
-তুই এইডা কি করলি রে?
-কি করছি রুব্বান?
-তুই একটা ছেমরার সামনে আমার মান-সম্মান বেইকগিন খাইলি?আমি কি টয়লেটে যাওয়ার কথা কইছিলাম?হু?
-আরেহ বোকা এই তর্জনী আঙ্গুল দেখানো মানে তাকে বোকা বক দেখানো।বুঝিস না তুই?
-তুই আমারে বোকা বানাইতে আইছস!এহন ওই পোলা আমারে কি ভাববো!ভাবলাম পোলাডার লগে একট পিরীত করমু।আর তুই!

রুব্বান হাউমাউ কেঁদে দেয়।

চলবে…