প্রেম আমার পর্ব-৪৯+৫০

0
7021

#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪৯♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
বিছানায় পা ঝুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বসে আছে রুশো ভাইয়া। রুশো ভাইয়ার পেঁচার মতো মুখ দেখে খিল্লি উড়িয়ে যাচ্ছে অগ্নি ভাইয়া! পাশেই মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে নীবিড় ভাইয়া। এদিকে রাত্রিও রুশো ভাইয়ার মতো মুখ ফুলিয়ে রেখে বসে রয়েছে। আর নিত্য আপু চেয়ারে আরাম করে বসে আমসত্ত্ব খাচ্ছে।

দিদুনে আমসত্ত্ব ভীষণ ভালো বানাতে পারে৷ একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করে। নিত্য আপুও প্রথমে খেতে চায়নি তবে একটু মুখে দেওয়ার পর ননস্টপ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। যদিও আমি অনেক খেয়েছি তবুও লোভ সামলাতে না পেরে একটু একটু করে নিত্য আপুর থেকে নিয়ে মুখে দিচ্ছি।
.
বর্তমানে রুশো ভাইয়া আর রাত্রি মুখ ফুলিয়ে রাখার কারণ তারা দুজনেই দিদুনকে বালতি বালতি অপবাদ দিয়ে গোডাউন বানিয়ে ফেলেছে আর এখন এসে বুঝতে পারছে যে দিদুন ইচ্ছে করে এসব করে নি। রুশো ভাইয়া কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে উঠলো,
.
—- হেই আমার এতো গিল্টি ফিল হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। ওই বার না বলে আম পেরে খাওয়ায় আমাকে আমচোর ভেবে তাড়া করেছিলো দিদুন, এন্ড এবার তো দুধ ফেলে দেওয়ার জন্য আমাকে লালুর দুধ দুইতে পাঠিয়েছিলো। আর ওই লালুর বদলে ভলু আমার ধোলাই করে ছেড়েছে। এক কথায় আমার ভর্তা বানিয়েছে দিদুন সো আমিও নাহয় চুলকানি দিয়ে শোধ নিলাম।
.
রুশো ভাইয়ার এমন যুক্তিহীন যুক্তি শুনে অগ্নি ভাইয়া আগের থেকেও উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে দিয়েছে। এদিকে এতোক্ষণ ধরে মুখ ফুলিয়ে রাখা রাত্রিও রুশো ভাইয়ার কথায় ফিক করে হেসে ফেলেছে। মাঝখান থেকে চুপ শুধু আমি আর নিত্য আপু। কারণ দুজনেই মুখেই আমসত্ত্ব। হাসতে গেলেই গলায় লেগে যাবে! যার ফলে হাসি কন্ট্রোল করার যুদ্ধে নেমে পড়েছি আমরা।
নীবিড় ভাইয়া হাসতে হাসতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখটা বুজে জোড়ে একটা শ্বাস নিলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে উনি বললেন,
.
—- অনন্যা, একটু এদিকে আসো তো!
.
উনার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি। উনি আবারও চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলেন, “কি হলো আসো!” উনার কথায় নড়েচড়ে উঠলাম আমি। পা টিপেটিপে উনার পাশে বসতেই আমার ডান হাত আঁকড়ে ধরে নিজের বকের সাথে চেপে ধরলেন উনি। সবার সামনে এভাবে আমার হাত নিজের বুকে রাখায় নিমিষেই চোখ বড়বড় হয়ে এলো আমার। লজ্জায় এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই সবাইকেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত আবিষ্কার করলাম আমি। অগ্নি ভাইয়া এখনোও রুশো ভাইয়াকে নিয়ে খিল্লি উড়াচ্ছে, রাত্রি একটু পর পর ফিক করে হেসে উঠছে আর নিত্য আপু আপন মনে আমসত্ত্ব খেয়ে যাচ্ছে। কেউ একটি বারের জন্যও আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না।
উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলে উঠলেন,
.
—- এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি দেখছো? কোথায় আমাকে মুগ্ধ চোখে দেখবে। কপালে ঠোঁট ছুইয়ে ঘুম পারিয়ে দেবে তানা এদিক-ওদিক তাকিয়ে যাচ্ছো। এমন চোখ যা আমায় দেখে না তা না রেখে আগের মতোই পকেটে খুলে রাখো!
.
আমাকে নিয়ে নীবিড় ভাইয়ার এমন মন্তব্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাতেই উনি চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। আমার হাতটা নিজের বুক থেকে উঠিয়ে ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে আলতো করে স্পর্শ করলেন। উনার ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। উনি ক্লান্তিমাখা মুখেই মুচকি হেসে আমার হাত ধরেই হেঁচকা টান মেরে নিজের আরোও কাছে নিয়ে এলেন আমায়। এদিকে আমার গলা আবারও শুকিয়ে আসছে। গোলক রন্ধ্র বড়বড় করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় উচ্চারণ করলাম, “পা..পা…পানি…!”
.
এই মুহুর্তে আমার মুখে পানি চাওয়ার আবদার উনার পছন্দ হলো না মোটেই। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে নিত্য আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন উনি,
.
—- বোন, এটাকে গিয়ে পানির ট্যাংকি তে চুবা তো প্লিজ! একটুতেই গলা শুকিয়ে যায় কিভাবে?
.
নিত্য আপু মুখে থাকা আমসত্ত্বটা আর একটু চিবিয়ে গিলে নিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
—- ওর পেট তো এমনিতেই ট্যাংকি! আলাদা করে ট্যাংকিতে চুবাতে হবে কেনো?
.
বলে আবারও আমসত্ত্ব খাওয়ায় মনোযোগ দিলো নিত্য আপু! অগ্নি ভাইয়া আমার দিকে একবার তো রুশো ভাইয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে হঠাৎ চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলো,
—- এই অনু, রুশো তোদের ঝাক্কাস একটা নাম পেয়েছি। অনুর নাম আজ থেকে ট্যাংকি আর রুশো নাম নেইল কাটার! সুন্দর না?
.
অগ্নি ভাইয়ার দেওয়া এমন উদ্ভট নাম শুনে আমি আর রুশো ভাইয়া একে অপরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। নিত্য আপু আমসত্ত্ব খেতে খেতেই মুখ বাকিয়ে অগ্নি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
.
—- আর নিজে যে ভূমিকম্প তার বেলায়?
.
নিত্য আপুর বলা ভূমিকম্প শব্দটা শুনে অগ্নি ভাইয়া থতমত খেয়ে আমতাআমতা করে বলে উঠলো,
.
—- মা..মানে?
.
নিত্য আপু নিজের চোখের দৃষ্টি সরু করে ভাইয়াকে ব্যঙ্গ করে বলে বললো,
—- তুমি কি মনে করেছো আমি অন্ধ? একটু ভয় পেলেই যে তোমার হাটু কাঁপে তা কি জানি না আমি?
.
নিত্য আপু ভাইয়ার মারাত্মক রহস্যটা জেনে ফেলায় বিষম খাওয়া শুরু করলো অগ্নি ভাইয়া। রুশো ভাইয়া সুযোগ বুঝে অগ্নি ভাইয়ার পিঠে থাপ্পড় দিতে দিতে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
—- শাট শাট! ভাবীই তো জেনেছে অন্য কেউ তো না। সো নো টেনশন ব্রো!😁
.
বিনিময়ে অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট উল্টে করুন চোখে তাকালো রুশো ভাইয়ার দিকে। রুশো ভাইয়া অগ্নি ভাইয়ার এমন চাহনি দেখে আবারও একদফা দাঁত কেলিয়ে দিলো। অগ্নি ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললো,
.
—- ভেটকাইস না! আমারও সময় আসবে। তোর বউয়ের সামনে উড়াধুরা ইজ্জতের ফালুদা বানাবো তোর! হুহ!
.
অগ্নি ভাইয়ার কথায় রুশো ভাইয়া মুখটা ছোট করে মিনমিন করে বললো,
—- তা তো অলরেডি হয়েই গিয়েছে। নতুন করে কি ফালুদা বানাবে। এবার পারলে কাস্টার্ড বানিয়ো!
.
রুশো ভাইয়ার মিনমিন করে বলায় আমরা কেউ কথাটা শুনতে পেলাম না। অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার কাছাকাছি থাকায় শুধু ভাইয়াই শুনতে পেলো। সাথেসাথেই হাসিতে ফেটে পরে নীবিড় ভাইয়ার ওপর গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করলো অগ্নি ভাইয়া। রাত্রি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
.
—- এবারের কথাটা এভাবে বেড়ালের মতো মিনমিন করে বললেন কেনো?
.
রুশো ভাইয়া জবাবে কিছু বলবে তার আগেই আমি হাত উঠিয়ে বলে উঠলাম,
—- আরে সাদা বিলাই তো নীবিড় ভাইয়া! রুশো ভাইয়া কি করে বেড়াল হবে?
.
আমার কথায় চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকালো সবাই। সবার এমন চাহনির কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না আমি। রাত্রি ঠোঁট কামড়ে আমায় আড়চোখে পাশে তাকাতে ইশারা করতেই “আরে পাশে আবার কি?” বলে পাশে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম আমি। সাথেসাথে ৯০° এংগেলে মাথা ঘুরিয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। এতোক্ষণে বুঝলাম সবাই আমার মুখে এতো সাধারণ একটা বাক্য শুনে এমন রিয়াকশন কেনো দিচ্ছে। আমার পাশে যে স্বয়ং সাদা বিলাই ই রয়েছেন তাতে আমার কোনো হুশই ছিলো না। হাউ স্টুপিড আই এম!

উনি চোখ ছোট ছোট করে দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে। যেনো এক্ষুনি টুপ করে গিলে ফেলবেন আমায় এক নিমিষেই!
নিজের বোকামির জন্য নিজেই নিজের মাথায় ঠাস করে চাটি মেরে দিলাম আমি। উনি চোখের ইশারায় সবাইকে পাশের ঘরে যেতে বলতেই বাধ্যগত সন্তানের মতো সুরসুর করে বেড়িয়ে গেলো সবাই। রুশো ভাইয়া দরজা চাপিয়ে দিতে দিতে “বেস্ট অফ লাক ছুটকি!” বলে আস্তে করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো। আমার করুন চাহনি ফিরেও দেখলো না কেউ। মানুষ রূপি বেড়ালের মাসি থুক্কু মেসো বাঘের কাছে রেখে গেলো এই ছোট্ট কলিজার ভোলাভালা বাচ্চাটাকে।
.
আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতেই ভ্রু নাচিয়ে “আব কিধার জায়েগি বাচ্চি!” বলেই খাট থেকে নেমে এক পা এক পা করে আমার দিকে এগোতে লাগলেন উনি।
আবারও ঢোক গিলে এক পা এক পা করে পেছাতে লাগলাম আমি। উনি এগোতে এগোতে একদম কাছে এসে পড়লেন আমার। আমি আর পেছাতে না পেরে পিঠে দেয়ালের স্পর্শে বুঝলাম আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। উনি বাঁকা হেসে আমার দু কাধের ওপর দিয়ে নিজের দুহাত দেয়ালের ওপর রাখলেন উনি। আমি এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে পালানোর পথ খুঁজে চলেছি। কিন্তু আফসোস পালানোর বিন্দুমাত্র অবকাশও রাখেন নি উনি।
.
—- আবার বলো কি যেনো বলছিলে আমায়?
.
আমি এদিকে ওদিক চোখ বুলিয়ে জোড় পূর্বক দাঁত বের করে বললাম,
—- “হেহে…! না না কি যে বলেন! আমি আবার আপনাকে কি বলবো? আপনি কতো সুন্দর! হ্যান্ডসাম!ফর্সা! বেড়ালদের মতো সফট আপনার ত্বক। বেড়ালদের মতো জ্বলজ্বল করে আপনার চোখ!
আমি তো শুধু আপনার সৌন্দর্যটা বর্ণনা করার জন্য এক কথায় ” সাদা বিলাই ” বলেছিলাম আর কি। 😅
.
উনি আমার কথায় বাম সাইডের ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটে আবারও বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,
—- ওহ রিয়েলি! তা আমাকে দেখে এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? লুক এট মি!
.
উনার কথায় আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতেই উনার নেশা ভরা চাহনি দেখে থমকে গেলাম আমি। উনার চোখে ডুব দিলাম আমি নিজেও। ঠিক এইজন্যেই আমি উনার কিউট কিউট চোখগুলোর দিকে তাকাই না। তাকালেই যেনো আমার পুরো সিস্টেম হ্যাং হয়ে যায়! নিজের মধ্যে থাকি না আমি আর, ডুব দেই উনার সেই মায়াভরা প্রেমময় গোলক রন্ধ্রে!
.
উনি মুচকি হেসে আমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে আমার দিকে ঝুকে পড়তে লাগলেন। উনার ঘনঘন উষ্ণ নিঃশ্বাস সোজা এসে পড়ছে আমার মুখের ওপর।
যার দরুন গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে আমার। শিরা-উপশিরায় এক অজানা শিহরণ বয়ে চলেছে।
উনি এক হাতের আমার কোমড় জড়িয়ে হেঁচকা টান মেরে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসা মাত্রই দরজায় কোনো এক ফেরেশতা এসে কড়া নাড়লো। উনি তৎক্ষণাৎ আমায় ছেড়ে দিতেই চট করে সরে দূরে চলে আসলাম আমি। উনি রেগেমেগে বোম্ব হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
.
—- ঠিক রোমান্সের টাইমেই কেনো সবাই ফালুদা বানাতে আসে! জাস্ট ডিজগাস্টিং!
.
বলেই রাগে ফোসফাস করতে করতে দরজা খুলে দিলেন উনি। জুঁই ভাবী হাতে মিষ্টির বাটি নিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,
—– বাকিরা কোথায়? সবার জন্য মিষ্টি নিয়ে এলাম।
.
আমি জুঁই ভাবী গলা পেয়ে বুঝলাম ফেরেস্তা না আপাতত ভাবীই আমায় বাঁচালেন। আমি চট করে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললাম,
—– ভাবী, হঠাৎ তোমায় এতো খুশি খুশি লাগছে যে! কিসের মিষ্টি এগুলো?
.
ভাবীর গাল দুটো লাল আভা ধারণ করেছে। ভাবী লজ্জায় লাল হয়ে গদগদ কন্ঠে বললো,
—- তোমরা ফুপা-ফুপ্পি হতে যাচ্ছো।
.
বলেই মিষ্টি একটা হাসি দিলো জুঁই ভাবী। আমি মিষ্টির বাটিটা নীবিড় ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে খুশিতে ভাবীকে টাইডলি হাগ করে বললাম,
.
—- এতো খুবই খুশির খবর ভাবী! বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে! ওয়াও!
.
ভাবী লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নাড়ালো। ভাবী যেতেই আমি সুযোগ বুঝে পাশের ঘরে লক্ষ্য করে দৌড় মারলাম। বর্তমানে এই সাদা বিলাইয়ের থেকে পালানোটাই আমার কাছে মূখ্য! উনি মুখ ফুলিয়ে পেছন থেকেই বললেন, “একবার হাতে পাই খালি, বুঝাবো মজা!”
উনার পুরো কথা না শুনেই আমি হুড়মুড় করে আপু-ভাইয়াদের ঘরে ঢুকে পড়লাম। আমাকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে রুশো ভাইয়া চমকে উঠে বলে উঠলো,
.
—– হেই ছুটকি, ব্রো কি পাটাকা ফুটাইলো নাকি যে এভাবে পালিয়ে এলি?
.
রুশো ভাইয়ার প্রশ্নে বাকিরাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আমি একটা ভেংচি কেটে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—- আজ্ঞে না! একটা গুড নিউজ আছে। জুঁই ভাবী প্রেগন্যান্ট! সেই খুশিতেই ভাবী মিষ্টি পাঠিয়েছে সবার জন্য। পাশের ঘরে চলো সবাই।
.
আমার কথা শেষ হবার আগেই রুশো ভাইয়া মিষ্টির নাম শুনে “ওহ মাই লাভ, সুইটস!” বলেই ভোঁ দৌড় দিয়ে নীবিড় ভাইয়ার ঘরে চলে গেলো। রুশো ভাইয়ার এভাবে ঝড়ের বেগে যাওয়ায় আমার চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেলো। সাথেসাথে মুখ আগের থেকেও বেশি ফুলে উঠলো আমার। নিত্য আপু, অগ্নি ভাইয়া আর রাত্রি ফিক করে হেসে ফেললো! সবাই খুশি হয়েই চললো পাশের ঘরে।
.
🌸
.
আমরা সবাই আড্ডায় মেতে উঠেছি এমন সময় আম্মু এসে দরজায় করাঘাত করে বললো, “বাচ্চা পার্টির মাঝে কি একটু সময় আসতে পারি?”
আম্মুর গলা পেয়েই সচেতন চোখে পেছন ফিরে তাকালাম আমরা। নীবিড় ভাইয়া আম্মুকে দেখে বললেন,
.
—- আরে আরে কি বলছো মামনি! আমাদের মাঝে আসতে আবার পারমিশন নেওয়ার কি আছে?
.
আম্মু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—- কি জানি, তোরা আবার কি সিক্রেট কথা বলিস! যাক গে। এখন কথা হচ্ছে আমরা কাল তিতুমীর ধরে রাজশাহী ব্যাক করছি। ট্রেনের টাইম সন্ধ্যে ৬ টায়। তাই কাল তোরা দিনে বগুড়া ঘুরে নিস!
.
আম্মুর কথায় খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো সবার। রুশো ভাইয়া খুশির ঠেলায় এক কাফ মেরে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
.
—- ইয়া হু! মনি, সিরিয়াসলি আমি লুঙ্গি পড়তে পড়তে তেঁতো হিয়ে গিয়েছে। উফফফ…! যেই সেই দিক থেকে বাতাস ঢোকে। কিছু পড়ে আছি ফিল করাই যায় না। জাস্ট ঠু মাচ ইরিটেটিং! তার ওপর অলওয়েজ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় এই ভেবে যে এই খুলে গেলো বোধহয়! আহ শান্তি শান্তি শান্তি!
.
রুশো ভাইয়ার কথায় হু হা করে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে দিলাম আমরা সবাই। রুশো ভাইয়া এবার বুঝলো যে এক্সাইটেড হয়ে একটু বেশিই বলেছে সে। তাই লজ্জায় গুটিশুটি মেরে বসলো ভাইয়া।
আম্মু রুশো ভাইয়ার চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো!
আম্মু যেতেই নীবিড় ভাইয়া সিরিয়াস ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসলেন। আমরা সবাই উনার সিরিয়াসনেস দেখে হাসি থামিয়ে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম উনাতে।
উনি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলে উঠলেন,
.
—- কালই যেহেতু চলে যাচ্ছি সেহেতু বগুড়ার নিদর্শনাদির মাঝে কিছু তো দেখে যাওয়াই যায়।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথায় আমরা সবাই খানিক চিন্তা করে একবাক্যে উত্তর দিলাম “অবশ্যই যায়!” উনি উত্তর পেয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
.
—- তাহলে মহস্থানগড় যাই কি বলো সবাই? বগুড়ার নিদর্শনাদির মাঝে মহস্থানগড়ই অন্যতম! তাছাড়া এটা খুব একটা দূরেও না। শহর থেকে অনলি ১৩ কিলোমিটার উত্তরে যেতে হবে।
.
নীবিড় ভাইয়া প্রোপোজালে এক বাক্যে সবাই রাজি হয়ে গেলাম। রুশো ভাইয়া খুশি হয়ে বললো,
—- আইডিয়াটা দারুন! তাছাড়া এখানে থেকে থেকে একদম পেকে গেছি। যাওয়ার আগে কিছু ভালো মোমেন্টস দরকার। এন্ড ফটোশুট ও করা হয়নি। ওখানে গেলে অসাম অসাম ফটোশুট করা যাবে!
.
—- হুম তা তো যাবেই! তাহলে গাইস তোমরা রেডি থেকো। আর নিত্য, তোর হবু ননদ এন্ড সো কল্ড ভাবীকে বলবি রাত না জাগতে! তোরাও জাগবি না। কাল আবার মাঝ রাস্তায় ঘুমোলে ওকে কোলে নিতে পারবোনা আমি। মাঝ রাস্তায় ফেলেই চলে যাবো!
.
উনার কথা শুনে নিমিষেই মুখটা ফুলে উঠলো অামার! আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
—- আপনাকে নিতে কে বলেছে? আমার আরোও দু দুটো ভাই আছে!
.
—- হ্যাঁ আর আপনার দু দুটো ভাইয়েরও৷ দশটা নয়, পাঁচটা নয় একটা করে হবু বউ আছে! বউ ছেড়ে তোমাকে কোলে নেবে নাকি?
.
নীবিড় ভাইয়ার কথায় কাশি উঠে গেলো অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়ার। কাশতে কাশতে রুশো ভাইয়া মিনমিন করে বললো,
.
—- আরে ব্রো, আমার ভান্ডা ফুটাও কেন! যেকোনো মুহূর্তে বোম্ব ব্লাস্ট হয়ে যাবে তো!😫
.
চলবে………….💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৫০♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
দীর্ঘ ১ ঘন্টার জার্নি করার পর তবে আমরা পৌঁছোলাম নির্দিষ্ট গন্তব্য মহাস্থানগড়ে! ১০ টার দিকেই বেড়িয়েছি বাড়ি থেকে। গ্রাম থেকে শহরে আসতে লেগেছে ৩৫ মিনিট। আবার শহর থেকে উত্তরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ধরে ১৩ কিলোমিটার পথ সিএনজি করে আসতে লেগে গেলো ২৫ মিনিট। যদিও এতো বেশি সময় লাগতো না তবে রাস্তায় জ্যাম থাকায় একটু বেশিই দেড়ি হয়ে গিয়েছে।
.
সিএনজিতে ড্রাইভার সহ সিট থাকে মোট ৬ টা! সামনে ড্রাইভারের সিট সহ তিনটে মানুষের বসার জায়গা থাকে আর পেছনে তিনটে মানুষের বসার মতো ক্যাপাসিটি থাকে। পুরো সিএনজি একেবারে রিজাভ করার জন্য ভাড়া পড়ে মিনিমাম ১৪০ টাকা!
.
সে হিসেবে সবই ঠিক ছিলো কিন্তু বিপত্তি বাধলো জনসংখ্যা নিয়ে। ড্রাইভার ছাড়াই আমরা জনসংখ্যায় মোট ৬ জন। এখন পুরো সিএনজি রিজাভ নিলেও ড্রাউভার কে তো আর ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না তাই ভীষণ ভাবনার মধ্যে পড়তে হয়েছিলো আমাদের। তবে ভাবনাটা বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি। যখন কোনো উপায় নজরে পড়ছিলো না আমাদের তখন অগ্নি ভাইয়া চট করে রুশো ভাইয়াকে নিজের কোলে বসিয়ে ড্রাইভারের বাম পাশের সিটে উঠে পড়ে। রুশো ভাইয়া লজ্জায় কোলে বসবে না বলে লাফালাফি করলেও শেষমেশ আমাদের ঠোঁট উল্টে থাকা অসহায় মুখ দেখে চুপচাপ গুটিশুটি মেরে অগ্নি ভাইয়ার কোলে বসে এসেছে। এমনি সময় ভাইয়ার কোলে বসার সুযোগ মিস করতে চাইতো না রুশো ভাইয়া তবে আজ ইতস্তত বোধ করছে শুধুমাত্র রাত্রির জন্য। রাত্রির সামনে নিজেকে একটা বাচ্চা প্রমাণ করতে ভুলক্রমেও রুশো ভাইয়া চায়নি কোনো কালেই তবুও একপ্রকার বাধ্য হয়েই আজ নিজের মান-সম্মানের ফালুদা বানিয়ে অগত্যাই ভাইয়ার কোলে চেপে বসে আসতে হলো রুশো ভাইয়ার!
পুরো রাস্তা এই নিয়ে রাত্রি আর আমি একটু পর পরই ফিক করে হেসে উঠছিলাম আর এদিকে লজ্জায় কান্না করে দেবার মতো অবস্থা ছিলো রুশো ভাইয়ার।
.
অগ্নি ভাইয়া তো আরোও একটু মজা নেবার জন্য “আলে লে লে…! বাচ্চা এতো নড়াচড়া করে না। পড়ে যাবে তো! চু চু চু….!” বলে দিব্যি খিল্লি উড়িয়ে গিয়েছে রুশো ভাইয়ার। কি একটা অবস্থা! মাঝখান থেকে নিত্য আপু আর নীবিড় ভাইয়া ছিলেন চুপা রুস্তম! ভেতরে ভেতরে হাসির পাটাকা ফুটিয়ে বাইরে থেকে একদম ফিটফাট টাইপ হয়ে বসে এসেছে পুরো রাস্তা। তাদের মতে যদি আমাদের সাথে তারা নিজেরাও রুশো ভাইয়াকে নিয়ে মজা নেয় তবে রুশো ভাইয়া বোধহয় লজ্জায় আইসক্রিমের মতো গলেই পরে যাবে।
.
অবশেষে সিএনজি এসে স্পটের পাশের স্ট্যান্ডে থামতেই এক লাফ মেরে নেমে গেলো রুশো ভাইয়া। বুক ভরে একটা তীব্র শ্বাস টেনে শান্ত হলো তবে। আর রুশো ভাইয়া নামতেই অগ্নি ভাইয়া নিজের ঝিম ধরা পা ধরে ” ইয়ায়ায়া…!ইইই উউউ….! করে আর্তনাদ শুরু করে দিলো৷ রুশো ভাইয়াকে নিজের কোলে বসিয়ে ২৫ মিনিটের রাস্তা একটানা একই ভাবে বসে থাকতে থাকতে পা অবশ হয়ে গিয়েছিলো অগ্নি ভাইয়ার! রুশো ভাইয়া নামতেই সেই অবশ ছেড়ে গিয়ে ঝিঝির রূপ নিয়েছে পা দুটোয় তার। নীবিড় ভাইয়া অগ্নি ভাইয়ার এমন করুন অবস্থায় ইচ্ছে করে দাঁত কেলিয়ে আস্তে করে টোকা মেরে দিচ্ছেন ভাইয়ার পায়ে। সাথেসাথেই গলা ছেড়ে দিয়ে তীব্র কম্পাংক বিশিষ্ট শব্দে চেঁচিয়ে যাচ্ছে অগ্নি ভাইয়া। বিস্ফরিত চোখে নীবিড় ভাইয়ার দিকে তাকালেও নড়াবার অবস্থায় নেই। অগ্নি ভাইয়ার বর্তমান মনোভাব “খালি পা তা ঠিক হোক, তোরে আজকে খাইছি!” কিছুটা এরকম টাইপ!
.
আমার মতে মহাস্থানগড় পাহাড়পুর টাইপই হবে। আর এসে দূর থেকে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে দেখতে অনেকটা পাহাড়পুরের মতো হলেও ভিন্নতা রয়েছে বেশ! সবাই মিলে সিএনজির ভাড়া চুকিয়ে হাটা ধরলাম মহাস্থানের সেই নগরীতে।
মহাস্থানগড় দেশের অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী দেশের ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিলো। ইভেন এই মহাস্থানগড়ই নাকি একসময় বাংলার রাজধানী ছিলো।
.
আকাশে আজ কোনো মেঘ নেই৷ আছে শুধু সূয্যিমামার রাজত্ব। রোদের তীব্রতায় জ্বলজ্বল করছে প্রকৃতি। সাথে মাথা থেকে হয়তো বা কয়েকশ ফুট ওপরে ঘুরছে চিল। পরিবেশ সেজেছে আজ নিজের মনমাতানো রূপে তবে এই রূপ আমার শরীরে সাথে ঠিক কতটা খাপ খাওয়াবে তা আধঘন্টা না পেরোলে বোঝা যাবে না।
.
🍂
.
যাত্রা শুরুর প্রথমেই মহাস্থানগড়ের যেই নিদর্শনটা চোখে পড়লো তা হলো হযরত মাহিসাওয়ার (রহঃ) এর মাজার। এই মাজারের সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু ধারণা নেই। আমি রুশো ভাইয়ার হাত ঝাঁকিয়ে এই মাজার সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করতেই রুশো ভাইয়া ঠোঁট উল্টালো। যা জানান দিলো রুশো ভাইয়ারও এই সম্পর্কে জ্ঞানের ভান্ডার শূণ্য। নীবিড় ভাইয়া রুশো ভাইয়ার রিয়াকশন দেখে মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন,
.
—- হযরত মাহিসাওয়ার এর পুরো নাম হলো শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার (রহঃ)।
এই মহাপুরুষ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সূদুর বল্লখদেশ থেকে মহাস্থানগড়ে আগমন করেন। এখানে এসে হিন্দু রাজা পরশুরাম কে পরাজিত করেন এবং ইসলাম ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
.
অগ্নি ভাইয়া নীবিড় ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,
—- আরে বাহ! তুই তো অনেক কিছু জানিস!
.
ওমনি নীবিড় ভাইয়া অগ্নি ভাইয়ার পেটে হাতের কুনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বললেন,
—- তোর থেকে কমই জানি।
.
মাজারের ভেতরে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেহেতু ভাইয়ারা আর কেউ ভেতরে ঢুকলেন না। মাজার ছেড়ে এগিয়ে চললাম আমরা জিয়ৎ কুন্ডের দিকে। জিয়ৎ কুন্ড মূলত একটা কূপ। কূপটা আকারে বেশ বড়। একটু হেলে নিচে তাকাতেই তার গভীরতা দৃশ্যমান হলো সবার। গভীরতা বর্তমানে অনেক কমই। টুপ করে দেয়ালের ইটগুলোতে পা রেখে নামা যাবে। আবার টুপ করেই ওঠা যাবে।
জিয়ৎ কুণ্ডের পাশেই বড় একটা সাইনবোর্ড লাগানো যেখানে এর ইতিহাস সম্মন্ধে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু এই রোদেলা দুপুরে ইচ্ছে হলো না কারো চোখ লাগিয়ে খুঁটিয়ে খঁুটিয়ে লেখাগুলো পড়বার। নীবিড় ভাইয়া আমাদের সবার অলসতা দেখে বলতে শুরু করলেন,
.
—- এটা রাজা পরশুরামের আমলেরই একটি কূপ। কথিত আছে এই কূপের পানি পান করে রাজার আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেতো। এই কূপের পানি দ্বারা মরা মানুষ জীবিত করা হতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে জিয়ৎ কুন্ড!
.
রাত্রি নীবিড় ভাইয়ার কথা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
—- মরা মানুষ আবার জিন্দা হতো? সত্যি?
.
নীবিড় ভাইয়া মুচকি হাসলেন, আবারও বললেন,
—- এরকম টা শুধু শুনা যায়।
.
🌸
.
হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে আমরা অবশেষে চলে এলাম গোকুল মেড়। গোকুল মেড় এর আরেক নাম নাকি বেহুলার বাসর ঘর। বলা যায় এটা বগুড়ার শহরে টুরিস্ট স্পট গুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি পাবলিক চয়েজ টুরিস্ট স্পট।
বলতে গেলে মহাস্থানগড়ের মেইন স্পট এই গোকুল মেড় ই।
.
আমাদের টিকিট কাউন্টারের পাশেই দাঁড়াতে বলে ভাইয়ারা গেলো টিকিট কাউন্টারে টিকিট কিনতে। আমি ঘুরে ঘুরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি জায়গা গুলোতে। কতো সুন্দর সবুজে ঢাকা মাঠ-প্রান্তর। রাস্তার ওপর দিয়ে শা শা করে চলে যাচ্ছে একটা দুটো বাইক। রাস্তার ওপারে রয়েছে ধান ক্ষেত। বর্তমানে তাতে বৃষ্টির পানি জমাট বাঁধা। আমার কাছে এই গোকুল মেড় টাকে অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ এর মতোই লাগছে। দূর থেকে হয়তোবা ১৫ ফুট কি সামথিং এরকমই উঁচু বলে মনে হচ্ছে। এদিকে নিত্য আপু আর রাত্রি সেলফি তোলায় ব্যস্ত। নিত্য আপু যদিও ছবি তুলতে খুব একটা পছন্দ করে না কিন্তু রাত্রির জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই তুলতে হচ্ছে আপুকেও।
.
হঠাৎ কাউন্টার থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসতেই ভাইয়াদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। নীবিড় ভাইয়া কাউন্টারের লোকটাকে কিছু একটা বলছেন আর এদিকে রুশো ভাইয়া চেঁচিয়ে বলছে,
.
—- হেই আমি বাংলাদেশি! আম নট এনি ফরেইনার মিনি হাতি!
.
মাঝখানে অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়াকে চেপে ধরে রয়েছে। ব্যাপারখানা আমার এই ছোট্ট মাথায় ঢুকতে চাইছে না কোনো মতেই। তাই আমি অগ্নি ভাইয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- কি হয়েছে রে ভাইয়া?
.
অগ্নি ভাইয়া আমায় কাউন্টারের সাইনবোর্ডের দিকে তাকাতে ইশারা করলো। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো সাইনবোর্ডে তাকালাম। ব্লু রঙের সাইনবোর্ডে সাদা রঙের কালিতে বোল্ড করে লেখা আছে,
” প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর
গোকুল মেড় (বেহুলার বাসর ঘর)
বুকিং কাউন্টার/Booking counter
প্রবেশ মূল্য/Entrance Fee

দেশী টা : ২০৳
মাধ্যমিক স্তর শিক্ষার্থী : ৫.০০ ৳
FOREIGNER TK : 200.00 ৳
SAARC COUNTRY TK : 100.00৳ ”
.
এতোক্ষণে বুঝলাম আসল কাহিনী! তার মানে টিকিট কাউন্টারের লোক রুশো ভাইয়াকে ফরেইনার ভাবছে। অবশ্য ভাইয়াকে ফরেইনার ভাবাও অস্বাভাবিক কিছুই না। রুশো ভাইয়াকে দেখে ফার্স্টলি যে কেউ হয় কোরিয়ান নয়তো থাই ভাববে। রুশো ভাইয়া দেখতেই এমন। না আছে দাড়ি আর না আছে গোপ। ফর্সা গায়ের রং সাথে চুল, ভ্রু, চোখের মনি সবই ব্রাউন কালারের। ঠোঁট বাচ্চাদের মতো গোলাপি। চুলগুলো কোরিয়ান দের মতোই কাট দেওয়া। পুরো কপালের সাথে লেপ্টে থাকে।
কিন্তু ভাষা শুনেও কি বুঝতে পারছে না এই লোকটা যে রুশো ভাইয়া বাংলাদেশিই!
.
—- এই ভাইয়া, লোকটা কি মাথামোটা নাকি যে রুশো ভাইয়ার মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনার পরও ফরেইনার ভাবছে?
.
অগ্নি ভাইয়া চোখমুখ কুঁচকে বললো,
—- সব ফরেইনাররা বাংলা বলতে পারেনা এমনটাও তো না। ওরা প্রমান হিসেবে আইডেন্টিটি কার্ড চাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো রুশো বাসায় ই ফেলে এসেছে।

অগ্নি ভাইয়ার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে চট করে ফোনটা বের করে গ্যালারি তে ঢুকলাম আমি। তার মধ্যে একটা ফটো ক্রিনে বের করে টিকিট কাউন্টারের লোকটাকে দেখে নিতে বললাম।
বর্তমানে সবাই আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। লোকটা ছবিটা দেখে নিয়ে জ্বিবে কামড় দিয়ে বললো,
.
—- সরি ম্যাম, সরি স্যার। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। তাছাড়া উনাকে দেখে ফরেইনারই লাগে তাই আর কি।
.
আমি মুখ বাকিয়ে ” ইটস ওকে ” বলে নীবিড় ভাইয়াকে ইশারা করলাম ২০ টাকা দড়েই ৬ টা টিকিট কিনে নিতে। নীবিড় ভাইয়া আমার কথামতো বিল মিটিয়ে টিকিট নিলেন।
আমার কাছে এসে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
.
—- কিসের ছবি দেখালে যে ব্যাটা একেবারেই বুঝে নিলো?
.
আমি মুচকি হেসে ফোনটা উনার সামনে ধরতেই উনি বললেন,
—- রুশোর আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি তোমার ফোনে কেনো?
.
আমি একটু ভাব নিয়েই বললাম,
—- সাবধানতা অবলম্বনের জন্য ভাইয়াদের আইডি কার্ডের ফটোগ্রাফস রেখে ছিলাম। যদি কখনো কাজে লাগে এই ভেবে। আর আজ কি সুন্দর করে কাজে লেগে গেলো দেখলেন। 😎
.
উনি আমায় ব্যঙ্গ করে বললেন,
—- যাক, যতোটা অপদার্থ তোমায় ভেবেছিলাম ততোটাও অপদার্থ তুমি নও।
.
বলেই উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন উনি।
“ফলো মি!” বলে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এগোতে লাগলেন। রুশো ভাইয়া আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,
—- থ্যাংকস ছুটকি!
ওই পেট মোটা ভূরি ওয়ালা টাক্কু কাক্কু আমায় হেনস্ত করতে এসেছিলো। জাস্ট ইমাজিন কর কতো সাহস টাক্কুর! ব্লা! চল ভেতরে যাই আমরা।
.
🌹
.
বর্তমানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি গোকুল মেড়ের নিচে। আমাদের সামনে রয়েছে ইয়া বড় ইটের পাহার। দূর থেকে ১৫ ফুট ভেবেছিলাম, বাস্তবে এটা প্রায় ৪৫ ফুট উঁচু। তার গা ঘেষে লাগানো আছে এত্তো লম্বা সিঁড়ি। সিঁড়িটাকে নিচ থেকে একবার ওপরে দেখে নিতেই গলা শুকিয়ে এলো আমার। এই সিঁড়ি পুরোটা শেষ করার আগেই আমার জান বের হয়ে যাবে কিনা এই নিয়ে মনে রয়েছে এক গভীর সংশয়!
.
রুশো ভাইয়া একবার নিচ থেকে ওপরে চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে মাথা চুলকোতে চুলকোতে প্রশ্ন করলো,
—- আরিস’শাবাস এই এত্তো বড় পাহার বেহুলার বাসর ঘর ছিল? আর আমাদের বাসর ঘর স্রেফ একটা ছোট্ট ঘর হয়? দ্যটস নট ফেয়ার!
.
নীবিড় ভাইয়া রুশো ভাইয়ার বোকামিতে হেসে দিয়ে সামনে তাকিয়েই আমাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
—- বেহুলার কাহিনি সেন যুগেরও অনেক পূর্বের ঘটনা।বেহুলার বাসরঘর একটি অকল্পনীয় মনুমেন্ট! বর্তমান গবেষকদের মধ্যে এই মনুমেন্ট ৮০৯ থেকে ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেবপাল নির্মিত একটি বৈদ্যমত। এটা একচুয়ালি কোনো বাসর ঘর নয়। স্তুপটিতে আছে বাসর ঘরের প্রবাদ স্মৃতি চিহ্ন।
চলো উপরে যাওয়া যাক।
.
বলেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন উনি। রুশো ভাইয়া কিছু না বুঝে ঠোঁট উল্টে যেতে লাগলো। একে একে চলতে লাগলাম সবাই।
.
১০-১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই বুঝতে পারলাম আমার গতির বেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। গায়ে শক্তি পাচ্ছিনা ঠিকমতো। ঠিক এই জন্যেই জার্নি, ঘুরাঘুরির নাম শুনলেই গলা শুকিয়ে আসে আমার। মহাস্থানগড় বগুড়ার মধ্যেই বলে দু বার না ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু শরীর আবারো তার খেলা দেখানো শুরু করলো। একে এতোক্ষণ হাটাহাটি তার ওপর সূর্যের তীব্র রোদ! সব মিলিয়ে এককথায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে আমার।
.
আমার পাশে আছে রাত্রি। তার সামনে রুশো ভাইয়া, নিত্য আপু আর অগ্নি ভাইয়া। নীবিড় ভাইয়া তাদের এক সিঁড়ি ওপরে ওপরে হাটছেন। আমার গতি কমে যাওয়ার রাত্রি আনমনেই আমার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো। অবসাদ অনুভব করায় একটু জিড়িয়ে নিতে থেমে গেলাম আমি। রুশো ভাইয়া আমি পেছনে আছি ভেবেই বলতে লাগলো, “ছুটকি তোর কি পানি লাগবে?” পেছন থেকে প্রতিউত্তরে কোনো জবাব না আসায় ভাইয়া সহ রাত্রি আর নিত্য আপুও পেছন ফিরে তাকালো। আমি ওদের থেকে কমপক্ষে ৫ কি ৬ টা সিঁড়ি নিচে। সবাইকে থেমে যেতে দেখে পেছন ফিরে তাকালেন নীবিড় ভাইয়াও। আমায় দাঁড়িয়ে হাপাতে দেখে একছুটে আমার কাছে নেমে এলেন উনি। কপাল কুঁচকে বললেন,
.
—- কি? গেলো তো পেট্রোল শেষ হয়ে? জানতাম আমি। তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। রুশো….! তোমার সাইড ব্যাগে পানির পট আছে দাও তো।
.
রুশো ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে চট করে বোতলটা এগিয়ে দিলো নীবিড় ভাইয়ার হাতে। উনি বোতলটা নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
—- পানিটা খেয়ে নাও।
.
উনার কথা শেষ হবার আগেই আমি ক্যাপ খুলে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করে দিলাম। পুরো বোতল শেষ করে উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে নিয়ে বললাম,
—- আমি ঠিক আছি। চলুন!
.
উনি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে হুট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। বাকিদের “আগা তোরা!” বলেই এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন আমায় কোলে নিয়েই।
.
—- আরে আরে কি করছেন? নামান আমায়। হাটতে পারবো আমি।
.
উনি সামনে তাকিয়ে হাটতে হাটতেই ধমকে উঠলেন,
—- জাস্ট শাট আপ। আর একটা কথা বললে উপর থেকে টুপ করে নিচে ফেলে দেবো তোমায়।
.
উনার ধমক খেয়ে ঠোঁট চেপে ধরে গুটিশুটি মেরে থাকলাম উনার কোলেই। কেই বা যেচে নিজের বাচ্চাকালের জীবনটা কোমড় ভেঙে থাকতে চায়? তেমনই আমিও চাইনা।
.
রুশো ভাইয়া নীবিড় ভাইয়াকে আমায় কোলে নিয়ে হাটতে দেখে অগ্নি ভাইয়াকে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
—- ছুটকির কি লাক রে ভাই! হেই ব্রো এখন আমাকে কোলে নাও না প্লিজ। আমি আর একদম লাফালাফি করবো না৷ ট্রাস্ট মি!😅
.
সাথেসাথেই অগ্নি ভাইয়া চোখ বড়বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো,
—- নেহিইইইইইইইইই………!😵
.
.
.
.
চলবে…………💕