#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১১|
“আপনি চিনবেন না।আমার পরিচিত একজন।”
রীতি সাদিবকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে মাথা নিচু করে নিচু গলায় উত্তর দিলো।
তবে এই উত্তরে সাদিব সন্তুষ্ট নয়।তাই রীতিকে আবারো প্রশ্ন করলো,
—-“আমি যে চিনি না সেটা বুঝতেই পারছো।চিনলে নিশ্চয়ই তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম না।আমি জানতে চেয়েছি ছেলেটা তোমার কি হয়?কেনো এসেছে?”
রীতি মাথা উঁচু করে বললো,
—-“বললাম তো আমার পরিচিত।একটু ঝামেলা হয়েছে সেটা মেটাতে এসেছে।”
সাদিব জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-“ঝামেলা? কি ঝামেলা? ”
সাদিব রীতিকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।রীতি সাদিবকে থামানোর জন্য বললো,
—-“আপনাকে সবটা কেনো বলতে হবে?”
সাদিব দমে গেলো।আসলেই তো ওকে সব কেনো বলবে?আর ও কেনো সব জানতে চাইছে?কোন অধিকারে?রীতিকে কোনো ব্যাপারে জোর করার অধিকার ওর নেই।
কিন্তু একটা ছেলে এসেছে রীতির কাছে।ছেলেটা রীতির পরিচিত।এই লাইনগুলো ওর মন মানতে নারাজ।
সাদিব রীতির দিকে অদ্ভুত এক চাহুনি দিলো।সে চাহুনিতে অপমান,অবহেলা ভেসে উঠছে।দুচোখে অভিমানেরা হুট করে জড়ো হয়েছে।
সাদিব রীতিকে কোনো প্রশ্ন না করে সিড়ির রেলিঙ ধরে নিচে নেমে গেলো।একবারো পেছনে ঘুরে দেখে নি।
রীতি ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।ওর মনে অপরাধবোধ করছে।
রীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—-“সরি আমি আপনাকে সত্যিটা বলতে পারবোনা।আর এজন্যই আপনাকে হার্ট করে কথা বলেছি।এই ছেলে আমার সাথে এমন বিহেভ করছে তাই আপনি এতোটা ক্ষেপে গেছেন।যদি জানেন এই অসভ্য ছেলে আপনার বোনের বফ না জানি কি করবেন।
সাবিহাকে বকাবকি করবেন,শাসন করবেন।কিন্তু ও এখন যেখানে আছে তাতে ওর পক্ষে ফিরে আশা সম্ভব নয়।ও আপনার বিরুদ্ধে যেতেও দুবার ভাববে না।রিজভীর জন্য সবাইকে ছাড়তে রাজি।আপনার শাসন তো মানবেই না বরং ভুল কিছু করে ফেলবে।কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।হয়তো রিজভী এই সুযোগের অপেক্ষা করছে।বাট আমি তা হতে দেবোনা।সাবিহা যতই আমার সাথে দুর্ব্যবহার করুক ওকে আমি বোন মানি।ওর ক্ষতি হতে দেবোনা।
আপনি এখন রেগে আছেন।রাগের বশে মানুষ ভুল করে ফেলে।রাগ ঠান্ডা হোক আমি আপনার সাথে কথা বলবো।
সাবিহাকে এই পথ থেকে শাসন দ্বারা নয় কৌশলে সরিয়ে আনতে হবে।তাতে আমি আপনার সাথে আছি।”
রীতি ফ্রেশ হয়ে নিলো।তারপর ভাবতে লাগলো সারাদিনের কথা।শেষ সময়ের ঘটনা ভেসে উঠতেই ওর মন খচখচ করছে।কি বাজে একটা ঘটনা ঘটে গেলো।
রীতি সকালে সাদিবকে দেখতে পায়নি। রীতি সাদিবকে দেখার জন্য বারান্দা দিয়ে অনেক বার উঁকিঝুকি দিয়েছে।কিন্তু সাদিবকে দেখতে পায়নি।বিকেলে ছাদে গিয়ে সাদিবকে দেখে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে।
সাদিরের চোখ রীতির দিকে পড়তেই সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো।রীতিকে দেখে কেনো জানি ওর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রীতি চিলেকোঠার ঘরের পাশ থেকে টুল নিয়ে ছাদের কর্নারে চলে গেলো।বই খোলে বসে কিন্তু পড়ায় মন বসছে না।সাদিবের সাথে কথা বলতে হবে।কথা না বলা পর্যন্ত ওর মনে শান্তি হবেনা।
দিয়া এসে রীতির পাশে বসেছে।রীতি ভাবছে দিয়াকে রিজভীর কথা বলবে কিনা।ওর যে ঠোঁট পাতলা কাকে কি বলে দেয় তাই দিয়াকেও বলতে ইচ্ছে করছে না।
রীতি দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
—-“সাদিব ভাই চলে গেছে?”(রীতির সাদিবকে ভাই বলে সম্ভোধন করতে ইচ্ছে না করলেও বলতে হচ্ছে।নয়তো দিয়া কি না কি ভাববে)
দিয়া উঠে গিয়ে দেখে এসে বললো,
—-“হ্যা চলে গেছে।কেনো কোনো দরকার? ”
রীতি মাথা নাড়িয়ে বললো,
—-“না উনারা এখানে ছিলো তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।কোনো দরকার নেই।”
রীতি মনে মনে আপসেট।সাদিবের সাথে কথা হলোনা।কিছু বলতে পারলোনা।
.
সাবিহা ফোন রেখে রাগে গজগজ করছে।বিছানার চাদর খামচে ধরে আছে।রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ আগে রিজভী ফোন করেছিলো।
~ফ্ল্যাশব্যাক~
রিজভী সাবিহাকে ফোন দেয় আর সাবিহা খুশি মনেই ফোন রিসিভ করে বলে,
—-“হ্যা বলো মাই লাভ”
—-“রাখো তোমার লাভ জানো গতকাল তোমার ভাই আমার গায়ে হাত দিয়েছে?”
সাবিহার পিলে চমকে উঠলো।ভাই ওকে মেরেছে।তাহলে কি সব জেনে গেছে?রীতি সব বলে দিয়েছে?হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।সাবিহার বুক ধুকপুক করছে।শরীর অসার হয়ে আসছে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভাইয়া যদি জানতো তবে তো জিজ্ঞেস করতো তাহলে?
রিজভী সাবিহাকে চুপ দেখে বললো,
—-“সাবু তোমাকে কিছু বলছি।তুমি কই হারিয়ে গেলে? ”
সাবিহা হন্তদন্ত হয়ে বললো,
—-“ভাইয়া!! এই ভাইয়া কি সব জেনে গেছে?তোমার সাথে কই দেখা হলো?”
—-“তোমাদের বাড়িতে।”
সাবিহার রিজভীর কথা শুনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।কাপা কাপা গলায় বললো,
—-“বাবাবাড়িইইই,,,,!”
—-“হ্যা আমি গতকাল রীতিকে বুঝাতে এসেছিলাম।আর ভদ্রভাবেই বোঝাচ্ছিলাম কিন্তু রীতি আমাকে যা নয় তাই বলছিলো আংগুল তুলে।আমার কিছুটা রাগ হয়েছিলো।হওয়ারই কথা।কেনো হবেনা?তাই একটু জোরে কথা বলেছিলাম।কোত্থেকে তোমার ভাই চলে এলো।আর আমার কলার চেপে ধরলো।”
—-“সর্বনাশ।রীতি আপু কি ভাইয়াকে সব বলে দিয়েছে?”
—-“সেটা তুমি জানো,আমি জানতে চাইওনা।আমি কাউকে ভয় পাইনা।কিন্তু তোমার ওই রীতি আপুর জন্য আমাকে অপমানিত হতে হলো।তোমার জন্য আমাকে আর কত অপমানিত হতে হবে?তোমার ভাই তাই যথেষ্ট ভদ্রতা দেখিয়েছি।নয়তো কখনো কারো সাহস হয়নি আমার কলার ধরার।”
—-“রিজভী, ভাইয়া তো জেনেশুনে কিছু বলে নি।তুমি কেনো এখানে আসতে গেলে?”
—-“সরি ভেরি সরি আমার ভুল হয়ে গেছে।অনেক বড় ভুল।”
রিজভী খট করে ফোন কেটে দিলো।
সাবিহা ফোন রেখে ছুটে গেলো রীতির কাছে।রীতির রুমে গিয়ে রীতির সামনে গিয়ে দাড়ালো।
রীতি ফোন টিপছিলো শুয়ে শুয়ে।ওর মন যথেষ্ট খারাপ।সাবিহাকে দেখে চমকে গেলো রীতি।এই ভর সন্ধ্যায় সাবিহাকে একদমই আশা করে নি।রীতি উঠে বসে সাবিহাকে দেখলো।সাবিহার চেহেরা দেখে বুঝাই যাচ্ছে ও প্রচন্ড মাত্রায় রেগে আছে।
রীতি সাবিহার রাগের কারণও আন্দাজ করতে পারছে।
তবুও জিজ্ঞেস করলো,
—-“কি হয়েছে সাবিহা?কোনো সমস্যা?”
—-“তুমি এমন ভাব করছো যেনো কিছুই জানোনা?”
—-“আমি জানিনা।তবে অনুমান করতে পারছি।তুমি তোমার বেয়াদব বফের কথা বলতে আসছো তো?”
—-“আপু রিজভীকে একদমই বেয়াদব বলবে না।ও যথেষ্ট ভদ্র ভালো ছেলে।তাই তোমাকে ভালো ভাবে বুঝাতে এসেছিলো।প্লিজ স্ট্রে এওয়ে ফ্রম মি।নিজের চরকায় তেল দেও।আমি এসব একদম সহ্য করবো না।”
রীতি ঠান্ডা গলায় বললো,
—-“তুমিও কি আমাকে হুমকি দিচ্ছো?অবশ্য দিতেই পারো।তোমার বফ শিখিয়েছে এসব আচরণ তাইনা?ও যেমন আস্ত একটা বেয়াদব।এই যে আমি তোমার বেয়াদবিগুলো মুখ বুঝে সহ্য করছি তাতে তোমার স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে।
তুমি কি ভেবেছো তোমাদের বাড়িতে থাকি তাই বলে চুপ করে আছি?উহু,,কথা আমিও বলতে পারি।তোমাদের বাড়িতে থাকি বলে চুপ নয়।কেনো থাকবো?টাকা দিয়ে থাকি।কেউ বিনা পয়সায় থাকতে দেয়নি।আমি চুপ ছিলাম এর প্রথম কারণ আমার শিক্ষা আর দ্বিতীয় কারণ আমি তোমাকে আমার বোন ভাবি তাই।ওর নাথিং।
আর তোমার বফ যে আচরণ করেছে সেটা দেখেই তোমার ভাই তার গায়ে হাত দিয়েছে আমি বলিনি,তাই আমাকে দোষারোপ করোনা।তোমার ভাই তুমি ভালো চিনো।এখন কি তোমার ভাইকে অভদ্র বলবে?সে নিশ্চয়ই অকারণে কারো গায়ে হাত তুলে না?না তুলে সেটা তুমিই ভালো জানো।”
সাবিহা রীতির কথা শুনে রীতিমতো হতবাক।রীতি ওকে এতোগুলা কথা শুনাবে ভাবেনি।
—-“তুমি রিজভীর সাথে চুপচাপ সব মিটিয়ে নিলেই হতো।”
রীতি মুচকি হেসে বললো,
—-“ওই অসভ্য ছেলের সাথে আমার কোনো ঝামেলা নেই তাই মিটিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।আর হ্যা তবুও যদি মনে হয় আমার জন্য এসব বাজে ঘটনা ঘটেছে তাহলে বলবো আমি তোমার বফকে ডাকিনি।
তোমার ভাইকে এখনো বলিনি নয়তো ঝামেলা কাকে বলে বুঝে যেতে।আমি আর এ নিয়ে কথা বলতে চাইনা।
তবে একটা উপদেশ দিতে চাই।তোমার রিজভীর প্রেমে তুমি এতোটাই অন্ধ যে তোমাকে যা বুঝাচ্ছে তাই বুঝে যাচ্ছো।তবে এর জন্য একদিন তোমাকে প্রস্তাতে হবে।আশা করি ওর মুখোশে আবৃত চেহেরাটা খুব শীঘ্রই দেখতে পারবে।ওকে যেমন ভাবো ও তেমন নয়।”
—-“রীতি আপু এখন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
—-“সেইদিন খুব তাড়াতাড়ি আসবে যেদিন তুমি আমাকে সরি বলবে।আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে মাফ চাইবে।নিজের ভুল বুঝতে পারবে।এটা রীতির চ্যালেঞ্জ।নাও ইউ ক্যান গো।আমি পড়তে বসবো।”
সাবিহা কিছুটা অপমানিত বোধ করলো।দ্রুত রীতির রুম থেকে বের হয়ে গেলো।ওর মনের ভেতর কু ডাকছে।মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।বারবার মনে হচ্ছে যদি রীতি আপুর কথা ঠিক হয়।
.
রীতির আর ভালো লাগছে না।সাদিব ওকে বারবার এভয়েড করে যাচ্ছে।
রীতি সাদিবের সামনে গিয়ে দাড়ালো।সাদিব চোখ তুলে রীতির দিকে তাকালো।তারপর রেলিঙের দিকে ঘুরে গেলো।ওর মনে অভিমানেরা জড়ো হয়েছে।যা এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার নয়।
রীতি সাদিবকে বললো,
—-“আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
—-“আমি শুনতে চাইনা।”(ব্যস্ততা দেখিয়ে)
—-“প্লিজ।কথাটা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
—-“আমার জন্য তোমাকে ভাবতে হবেনা।আমি জানতে চাইনা।যাও এখান থেকে। ”
—-“আমি সাবিহার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
সাদিব সাবিহার কথা শুনে অবাক হয়ে ঘুরে দাড়ালো।তারপর রীতির দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো।
রীতি গড়গড় করে বললো,
—-“ওই ছেলেটার নাম রিজভী।ও সাবিহার বয়ফ্রেন্ড।”
সাদিব রীতির কথা শুনে রীতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো।চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
—-“কি বললে তুমি? ওই ছেলে সাবিহার বয়ফ্রেন্ড?”
—-“হ্যা”
সাদিব চেচিয়ে বললো,
—-“সাট আপ!!সাবিহা বাচ্চা একটা মেয়ে ১৭বছর বয়স ওর।ওর নামে এমন একটা কথা বলতে তোমার বিবেক বাধা দিলো না?ছিহ!রীতি তোমাকে আমি ভালো একটা মেয়ে ভেবে এসেছি এতো দিন।আর তুমি? নিজের দোষ আমার বোনের উপর চাপিয়ে দিলে?আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড রাতের বেলায় তোমার সাথে কথা বলতে আসবে?তাও ঝগড়া করতে? আমাকে এতটা বোকা মনে হয় তোমার?
সাবিহার সাথে তোমার কোনো একটা সমস্যা চলছে তাইনা?আমি প্রায়ই দেখেছি তোমাদের অদ্ভুত ভাবে কথা বলতে।তোমাদের কথা না শুনলেও বুঝতে পারতাম কিছু একটা সমস্যা চলছে তোমাদের মধ্যে।আর সেই জন্য তুমি আমার বোনকে এভাবে ফাসানোর চেষ্টা করছো?”
সাদিবের কথা শুনে রীতির বুকের ভিতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।চোখে পানি টলমল করছে।সাদিব ওকে এভাবে বলতে পারলো।এতটা অবিশ্বাস করছে।
—-“জানেন তো আমি একটুও অবাক হইনি আপনার কথা শুনে।কারণ সাবিহা আমাকে আগেই বলেছিলো আপনি বিশ্বাস করবেন না।যাইহোক আমার মনে হয়েছিলো আপনাকে জানানো উচিত তাই জানালাম।আসছি।”
রীতি চোখের পানি মুছে দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে।আর ওদের বিষয়ে কথা বলবেনা।আর না ওদের নিয়ে ভাববে।ওদের দুজনকেই জীবন থেকে কাটঝাট করে দিয়েছে।
সাদিব পেছনে থেকে রাগে ফুসছে।ওর পিচ্ছি বোনের নামে এমন একটা কথা বলতে পারলো?
ওই ছেলে সেদিন ওর পরিচিত ছিলো আর আজ হুট করে সাবিহার বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেলো?
চলবে…..