#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৪|
মাগরিবের আযান শেষ হয়েছে ১৫মিনিট হবে।রীতি গাল ফুলিয়ে নিজের রুমে বসে আছে।কেউ ওকে পিকনিকে ইনভাইট করে নি কেনো?
রীতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বারান্দায় গেলো।ছাদে হাই ভলিউমে গান চলছে।তাও যেমন তেমন গান না দিলবার গান।সাথে বাচ্চাদের চিতকার, হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে।
রীতি রুমে ঢুকে দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো।
দরজায় এমন ভাবে শব্দ হলো যেনো ভেঙে যাওয়ার অবস্থা।
সেটাকে পাত্তা না দিয়ে রীতি একটা বই খোলে বসলো।এতে যদি মন ভালো হয়।রীতি এক পাতা পড়তেই দিয়া রীতির রুমে ঢুকলো।
রীতির হাত থেকে বই নিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বললো,
—-“দ্রুত রেডি হও।ছাদে যাবো।”
রীতি দিয়ার হাত থেকে বই নিয়ে বললো,
—-“কেনো?”
—-“কেনো আবার?আজকে ছাদে পিকনিক হচ্ছে।”
রীতি বইটা আবারো খোলে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো,
—–“তো?”
দিয়া রীতির থেকে বইটা আবারো কেড়ে নিয়ে বললো,
—–“তো মানে কি?তুমি পিকনিকে যাবে না?”
রীতি সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
—-“আমি কেনো যাবো?আমি না তোমাদের পিকনিকে আছি,না আমাকে কেউ ইনভাইট করেছে।আর না আমি পিকনিক সম্পর্কে কিছু জানি।আর এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি পিকনিকে যেতে ইন্টারেস্টেড নয়।ইঞ্জয় ইউরসেল্ফ।”
রীতি দিয়ার হাত থেকে বই নিতে নিলে দিয়া সরিয়ে ফেলে বললো,
—-“তুমি জানোনা কারণ আমরা তোমার জন্য পিকনিকের বিষয়টি সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছি।আন্টিকে বলেছি,আন্টি সব জানে।উনি চাদাও দিয়েছে।আর রিমন?সে তো ড্রান্সফ্লোরে ড্রান্স করায় ব্যস্ত।এখন চলো তো।”
—-“দিয়া আমি যাবোনা আমার ভালো লাগছে না।”
দিয়া রীতির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
—-“ওকে,ফাইন।”
দিয়া কাউকে কল করছে।রীতি দিয়াকে কাউকে কল করতে দেখে বললো,
—-“কাকে কল করছো?”
দিয়া রীতির কথায় ভেংচি কেটে বললো,
—–“তোমাকে কিডন্যাপ করবো।তাই কিডন্যাপারকে ফোন করছি।বুঝলে?”
দিয়া তারপর ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো।
—-“হ্যালো সাদিব ভাইয়া,রীতি আপু আসবেনা।তাকে আমি অনেক রিকুয়েষ্ট করেছি কিন্তু সে আসবেনা।এখন তুমি যা করার করো।”
সাদিব দিয়ার কল পেয়ে সিড়িঘরে গিয়ে কল রিসিভ করে তবুও ভালো ভাবে শুনতে পাচ্ছেনা।তবে এটুকু বুঝতে পারছে দিয়া বলছে রীতি আসবেনা।
—–“দিয়া,ওকে বলো ভালোয় ভালোয় না আসলে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।”
দিয়া ফোন রেখে রীতিকে বললো,
—–“তুমি না এলে ভাইয়া আসবে তোমাকে নিতে।তোমাকে কোলে তুলে ছাদে নিয়ে যাবে।”
রীতি দিয়ার কথা শুনে চোখ বড়বড় করে বললো,
—–“এইগুলা কি ধরনের কথা?অভদ্র লোকটা আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে?মামার বাড়ির আবদার নাকি?”
দিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—–“তাড়াতাড়ি চলো নয়তো এসে পড়বে।”
রীতি দাতে দাত চেপে বললো,
—–“শয়তানের নানি তুমি।তোমার জন্য সব হলো।”
দিয়া রীতির কথা শুনে দাত কেলিয়ে হাসলো।
রীতি সেটা দেখে বললো,
—–“আর হাসতে হবেনা।চলো।”
দিয়া চোখ বড়বড় করে বললো,
—–“তুমি এভাবে যাবে?”
রীতি নিজের দিকে তাকিয়ে জিভে কামড় দিলো।
ও তো প্লাজু আর ঢিলেঢালা শর্ট একটা টপস পড়া।মাত্রই চেঞ্জ করেছে।রীতি একদম ভুলেই গিয়েছিলো।
রীতি আলমারি থেকে হালকা পেস্ট কালার একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ হতে চলে গেলো।
রীতি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে।চুল আঁচড়িয়ে খোপা করতেই দিয়া খোপা খোলে দিলো।
—-“আপু চুল খোলা রাখো।”
রীতি আবারো চুল বাধতে বাধতে বললো,
—-“কিন্তু মা বকবে।সন্ধ্যা বেলায় চুল খোলে রাখা তার পছন্দ না।”
—-“হুম তোমার যে লম্বা চুল ভূতে ধরবে।হিহি।”
রীতি মুখ ভেংচি দিলো দিয়াকে।
—–“আপু তাহলে অন্য কিছু করো তবুও খোপা করোনা।”
রীতি চুলে দু-তিন ধাপ বেনি করে হেয়ার রাবার লাগিয়ে বাকি চুলগুলো খোলা রেখে সামনে একপাশে এনে রাখলো।ম্যাচিং করে কানে এয়ারিং,ঠোঁটে হালকা পিংক লিপি আর হালকা কাজল।
নিজেকে খুটে খুটে দেখে নিয়ে দিয়ার দিকে তাকাতেই দিয়া বললো,
—-“আপু তোমাকে দেখে আমার হিংসা হচ্ছে।তোমাকে কত সুন্দর লাগছে।আর আমাকে কেমন পেত্নী লাগছে।”(মন খারাপ করে)
রীতি দিয়ার গাল টেনে দিয়ে বললো,
—-“পাম মারা বন্ধ করো।তুমি নিজেই জানক তোমাকে কত সুন্দর লাগছে কালো ড্রেসে।একদম পরী।দেখিস ছাদ থেকে যেনো জ্বিনে তুলে নিয়ে না যায়।”
রীতির কথা শুনে দিয়া হেসে ফেললো।
তারপর দুজনে একসাথে বেড়িয়ে গেলো।
রীতি আর দিয়া ছাদে উঠে।রীতি ছাদে উঠে দেখে ছাদে উৎসবমূখর পরিবেশ।সবাই কত ব্যস্ত।কেউ আড্ডা দিচ্ছে।ছোট ছেলেমেয়েরা উড়া ধুরা ড্রান্স করছে।সাদিবের ভাগ্নে অভিও ড্রান্স করছে, পাশেই সাদিব হাতে তালি দিয়ে অভিকে উৎসাহিত করছে।
রীতি খোজছে রিমনকে।রীতির মা বারবার বলে দিয়েছে রিমনকে যেনো দেখে রাখে।রিমন যা দুষ্ট আর চঞ্চল।একদম রীতির বিপরীত।তাই ওকে নিয়ে ওর মায়ের ভয় হয়।
রীতি এক জায়গায় দাড়িয়েই রিমনকে খোজে চলেছে।
সাদিবের চোখ পড়লো রীতির দিকে।
রীতি দাড়িয়ে দাড়িয়ে এদিক সেদিক দেখছে।মনে হচ্ছে কিছু খোজছে,অথবা কাউকে খোজছে।তবে সাদিব রীতিকে দেখছে।এতো হালকা সাজে কাউকে এতটা স্নিগ্ধ,সুন্দর লাগে সেটা রীতিকে না দেখলে বুঝতে পারতোনা।
রীতি রিমনকে আবারো কোল্ড ড্রিংকস পান করতে দেখলো।
এই ছেলে পেটুক একটা।রীতি রিমনের সামনে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়ালো।
রিমন রীতিকে দেখে ভয়ে ঢোক গিলছে।তাড়াতাড়ি কোল্ড ড্রিংকসের বোতল টেবিলে রেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো।
রীতি রিমনের কান টেনে ধরলো।
“তোকে কতবার নিষেধ করেছি এসব মুখে দিতে?তুই আমার কথা শুনবি না দেখছি।দাড়া মাকে বলছি।”
রিমন কাদো কাদো হয়ে বললো,
—-“আপু আমি আর খাবোনা,সত্যি বলছি।আমার কানে লাগছে।”
রীতি আরো জোরে টেনে ধরে বললো,
—-“খাওয়ার সময় মনে থাকেনা?”
রিমন কাদো কাদো ফেস করে আছে।সাদিব দ্রুত এসে রীতির হাত থেকে রিমনকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
—–“তুমি যে এতো দস্যি মেয়ে জানতাম না তো?একটা বাচ্চা ছেলেকে এভাবে মারছো?”
রীতি সাদিবের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।রিমন কান ঢলছে।সাদিব রিমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–“আহারে….!আমার একমাত্র নাদুস-নুদুস শালার কি অবস্থা করেছে এই পাজি মেয়েটা?”
রীতি সাদিবের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।কি বলছে রিমন ওর শালা?
সাদিব রিমনের গাল টেনে বললো,
—-“রিমন দেখ এগুলো আর খাস না।তাহলে আরো বল হয়ে যাবি।তারপর আর বউ পাবিনা।তাই অল্প খাবি।ওকে?”
রিমন মাথা নাড়িয়ে শায় জানালো।
রিমন চলে যেতেই রীতিও চলে যেতে নিলে সাদিব রীতির রাস্তা আটকে দাড়ালো।
—-“চশমা রাণী,তোমার চশমা কই?”
রীতি সাদিবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বললো,
—-“কেউ একজন বলেছিলো আমি চশমা পড়া মেয়ে।মহল্লার ছেলেদের কাছে আমার চশমা পড়া নিয়ে উপহাস করেছিলো।তাই চশমা ভেঙে চারভাগ করেছি।”
রীতির কথা শুনে সাদিব ব্যথিত হলো।রীতি যে ওর কথায় এতটা কষ্ট পেয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি।চশমা ভেঙে ফেলেছে ওর কথা শুনে।
সাদিব বিষন্ন মনে বললো,
—-“রীতি আ’ম সরি।আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতোটা কষ্ট পাবে।আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।প্লিজ,মাফ করে দেও।আমি তোমাকে চশমা এনে দেবো।তোমার চশমা পড়া নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।আমি তোমাকে চশমা পড়া অবস্থায় দেখেই পছন্দ করেছি।এতে বুঝতেই পারছো আমার তোমার চশমা পড়া নিয়ে কোনো রুপ সমস্যা থাকলে তোমাকে পছন্দ করতাম না।তুমি বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে নিজের ক্ষতি করোনা।”
—-“আমার কি ক্ষতি?”
সাদিব আমতা আমতা করে বললো,
—-“না মানে,,তুমি চশমা না পড়ে সব ঠিকঠাক দেখো?মানে সমস্যা হয়না?”
রীতির সাদিবের কথা শুনে প্রচুর হাসি পাচ্ছে।
—-“জ্বি না।কোনো সমস্যা হয়না।আমি সব ঝকঝকে ফকফকে দেখি।ওইটা তো জাস্ট আমার হেবিট হয়ে গেছে।”
এরি মধ্যে অভি মামা মামা বলে সাদিবের কাছে দৌড়ে এলো।সাদিব অভিকে কোলে উঠিয়ে নিলো।
—-“কিরে মামা?তুইও দেখছি কাবাবের হাড্ডি হতে চলে এসেছিস?”
অভি গালে আঙুল রেখে চিন্তার ভঙ্গিতে বললো,
—-“কাবাবের হাড্ডি মানে কি মামা?কাবাবে কি হাড্ডি থাকে?”
সাদিব অভির কথা শুনে হেসে দিলো।
রীতি অপলক সাদিবের হাসি দেখছে।
কি সুন্দর স্নিগ্ধ হাসি?কারো হাসিতে এতটা সরলতা,এতটা মুগ্ধতা থাকে?
সেটা সাদিবের হাসিতে আছে।সাদিবের হাসিতে স্নিগ্ধতা,সরলতা,মুগ্ধতা সব বিরাজ করছে।রীতি সাদিবের হাসির প্রেমে পড়ছে,ভিষণভাবে প্রেমে পড়ছে।
.
“তোমাকে না লেখা চিঠিটা
ডাকবাক্সের এক কোনে
সাদা খামে না লেখা নাম
একেছে তার গানে।(২)
সেই চিঠি যত লেখা
থাকে…একা একা।
সেই গানের না শোনা সুর
একা একা….আকা।
যদি বলি সে সবই তোমারি
একা চিঠি একা আকা গান।
শাইয়্যান…..শাইয়্যান…..।”
সাদিব মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে গান শেষ করলো।
চলবে…..
#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৫|
রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতটা জেকে বসেছে।ফেব্রুয়ারী মাস অনুযায়ী শীতটা একটু কমই।রীতি গায়ের ওড়নাটা নিয়ে চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে নিলো।রীতি একটা চেয়ার নিয়ে একপাশে বসে আছে।ওর দৃষ্টি রিমনের দিকে।কোন গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলবে তারপর রিমনের সাথে সাথে নিজেকেও মায়ের বকুনি হজম করতে হবে।
রীতি পাশাপাশি একটু পর পর সাদিবকেও দেখছে।সাদিব বাবুর্চি যেখানে বিরিয়ানি রাধছে সেখানে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে।
বিরিয়ানির গন্ধে চারপাশ মো মো করছে।কিছুক্ষণ পর পর রীতির নাকে বিরিয়ানির গন্ধ ভেসে আসছে।সালাদ কাটা শেষ।সেগুলো টেবিলের উপরে রাখা হয়েছে।দিয়া টেবিলের উপর থেকে কাটা সালাদ থেকে শসা,গাজর বেছে বেছে হাতে নিচ্ছে আর খাচ্ছে।
রীতি দিয়ার কান্ড দেখে নিজ মনে হেসে ফেললো।
“এই মেয়ে একদম রিমনের ডুব্লিকেট।শুধু খাই খাই করে।রিমনটা বড় হলে একে রিমনের বউ বানাতাম।দেখি এক চান্স নিয়ে।”
রীতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ালো।দিয়া তখনও গাজর চিবানোতে ব্যস্ত।
—-“দিয়া রিমনকে বিয়ে করবে?”
দিয়া রীতির মুখে এমন কথা শুনে চমকে গেলো।তারপর মুখে গাজর চিবানো অবস্থায় বললো,
—-“হটাৎ রিমনের বউ বানাতে চাও কেনো?”
—-“কারণ তুমি আর রিমন সেম।সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করো।বর-বউ দুজনেই যদি পেটুক হয় তবে কেউ কাউকে খাওয়া নিয়ে কথা শুনাবে না।”
রীতি দিয়ার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচালো।
দিয়া মুখ ভেংচি কেটে বললো,
—–“নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলোনা।ওই পিচ্ছি ছেলেকে বিয়ে করবো?হুহ।দিয়ার কি ছেলের অভাব নাকি?আমি খাই দেখে তোমার হিংসে হয় সেটা বলো।”
—-“খাওয়া নিয়ে হিংসা?হাহা।খাওয়া নিয়ে হিংসা করার প্রশ্নই আসেনা।আমার মায়ের হাতের রান্না কত ইয়াম্মি সেটা তো জানোই।রিমনকে বিয়ে করলে মায়ের হাতের ইয়াম্মি আইটেমের খাবার ফ্রিতে খেতে পারতে।”
দিয়া বাকা হেসে বললো,
—-“আন্টির হাতের রান্নার জন্য তোমার ভাবি হতে রাজী আমি।বলো কবে বিয়ে করতে হবে?”
রীতি জোরে হেসে ফেললো দিয়ার কথা শুনে।
.
সাদিবের হাত ধরে অভি বারবার টানছে।সাদিবকে রান্নার সামনে দাড়াতে দিচ্ছেনা।
সাদিব বিরক্ত হয়ে বললো,
—-“কিরে বাপ,কি হয়েছে তোর?”
অভি হাত বাড়িয়ে বললো,
—-“কোলে নেও।”
—-“কোলে নেবো কেনো?সারাদিন কোলে কোলে করিস কেনো?৫বছর তোর কত বড় হয়ে গেছিস।এতো কোলে উঠে না।চল তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি।”
অভি নাক ফুলিয়ে বললো,
—-“আমি যাবোনা।”
সাদিব আদর করে বললো,
—–“তোমার ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে অভি এখন ঘুমাবে।চলো।তুমি না গুড বয়।”
অভি সাদিবের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
—-“না,আমি যাবোনা।”
—-“দেখো কত ঠান্ডা পড়েছে।তোমাকে আবার পরে গিয়ে নিয়ে আসবো।”
—-“নাহহ।”
সাদিব অভিকে ভয় দেখাতে লাগলো।
—-“রাত হয়ে গেছে।এখন ভূত আসবে।অভি কত কিউট একটা বাচ্চা।ভূতেরা কিউট বাচ্চা পছন্দ করে।তোমাকে কিন্তু নিয়ে যাবে।”
অভি ভ্রু কুচকে সাদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“মামা তুমি মিথ্যা বলছো কেনো?আমি জানি ভূত আসবেনা।আমি কিছুতেই যাবোনা।”
সাদিব হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,
—-“বিচ্ছু ছেলে আমার জীবন জ্বালিয়ে দিলো।কাকে এতক্ষণ এতকিছু বুঝালাম।এ তো আমার চেয়ে শিয়ান।”
সাদিবের তখন রীতির দিকে চোখ পড়লো।
মুখে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠে।
তারপর অভিকে বললো,
—-“অভি ওই যে দেখ সেই চশমা আন্টি।তুই ওর কাছে যা।গিয়ে বল কোলে নিতে।ও তোর মতো কিউট বাচ্চা অনেক আদর করে।তোকেও আদর করবে।”
অভি মাথা চুলকে বললো,
—-“মামা কিন্তু এই আন্টির চোখে তো চশমা নেই।সেই আন্টি তো চশমা পড়ে ছিলো।”
সাদিব বললো,
—-“আজকে পার্টি চলছে তো তাই পড়েনি।এটাই সেই আন্টি।যা গিয়ে বল কোলে নেও।”
অভি আচ্ছা বলে দৌড় দিলো রীতির দিকে।সেটা দেখে সাদিব মিনমিন করে বললো,
“বুঝো ঠেলা।”
.
দিয়া জোর করে রীতির মুখে গাজর পুড়ে দিয়েছে।রীতি গাজর চিবাচ্ছে বাধ্য হয়ে।গাজর চিবাতে চিবাতে সাবিহার দিকে চোখ পড়লো।সাবিহা গানের তালে তালে হাত-পা নাড়িয়ে নাচছে।রীতি সাবিহাকে এতো খুশি দেখে মুচকি হাসি দিলো।তারপর ভাবছে,
—–“কি বাচ্চামি করছে?কেউ ওকে দেখে বলবে কয়েকমাস আগে কারো মোহে আটকে ছিলো।কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসতো?তার দেওয়া বিয়ের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেছিলো?এই বয়সেই কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো?কাউকে ভালোবেসে তাকে বিশ্বাস করে পুরোপুরি ঠকে গিয়েছিলো?ঠকে গিয়ে ভেঙে পড়েছিলো?
আমি চাই সাবিহা তুমি সবসময় এমন খুশি থাকো।ভালো থাকো।”
আচমকা রীতি নিজের হাতে কারো টান,স্পর্শ অনুভব করছে।সাবিহার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাতের দিকে তাকালো।অভি ওর হাত ধরে টানছে।
রীতি অভিকে দেখে মৃদু হেসে বললো,
—-“কি হয়েছে বাবু?”
অভি দুহাত রীতির দিকে বাড়িয়ে বললো,
—–“আন্টি কোলে নেও।”
রীতি অবাক হয়ে বললো,
—-“কোলে!”
রীতি আর দিয়া একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।
রীতি এত বড় একটা ছেলেকে কোলে নিবে ভাবতেই হাত-পা ভেঙে যাচ্ছে।কখনো কাউকে কোলে নেয়নি।ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত কোলে নেয়না।
ভয় লাগে।নিজের মামার পুচকেকে কোলে নিতেও ভয় পেতো।
মনে হতো এই নরম তুলতুলে হাড় ভেঙ্গে যাবে কিংবা কোনো ভাবে ব্যথা পাবে।বাচ্চাদের কোলে নিতে একটা ভয় কাজ করে।মামার ছেলেকে কোলে নিতে কত সাবধানতা অবলম্বন করেছে।এখন এতো বড় একটা ছেলেকে কোলে নিবে।
রীতি জোরপূর্বক হেসে বললো,
—–“বাবু,তোমাকে আমি কি করে কোলে নেবো?”
—–“আমি জানিনা।আমাকে কোলে নেও।নয়তো আমি কাদবো খুব।”
অভি কাদো কাদো হয়ে বললো।
রীতি পড়লো এক বিপদে।রীতি অসহায় ফেস করে দিয়ার দিকে তাকালো।দিয়া মজা নিচ্ছে।দিয়া বললো,
—–“আমি কি জানি?তোমার হবু বরের ভাগ্নে,তুমি বুঝো।”
রীতি চেয়ারে বসে পড়লো।তারপর অভিকে বললো,
—–“বাবু এসো আমার কোলে বসো।”
অভি কিছুক্ষণ রীতির কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে কোলে বসে রীতির গলা জড়িয়ে ধরলো।
রীতি অভির মাথায়,পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।রীতির কেনো জানি মনে অভি ঘুমাবে।
সাদিব দূর থেকে সবটা দেখছে।কিছুক্ষন পরে রীতি অভির ঘন নিশ্বাস অনুভব
করতে পারলো।রীতি ঘাড় কাত করে অভির মুখ দেখার চেষ্টা করলো।অভি ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুমিয়ে পড়ায় অভি পুরো শরীর রীতির উপর ছেড়ে দিয়েছে।রীতি এদিক সেদিক সাবিহাকে খোজছে।
অতঃপর পেয়েও গেলো।
রীতি সাবিহাকে ডাকতেই সাবিহা রীতির কাছে এসে অভিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেলো।অভিকে কোলে নিয়ে দোতলায় যাবে তাই সাবিহা নিজের ভাইকে খোজতে লাগলো।
সাদিব বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজে থেকেই ওদের সামনে এলো।
সাবিহা সাদিবকে দেখে বললো,
—-“ভাই,অভি ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে ঘরে দিয়ে এসো।”
সাদিব ইচ্ছে করেই বললো,
—-“তুই দিয়ে আয়।আমাকে কেনো বলছিস?ধর কোলে নে।”
সাবিহা বিপদের আশংকা দেখে দৌড় মারলো সেখান থেকে।সাদিব সাবিহাকে তাড়ানোর জন্যই বলেছে।সাবিহা যেতেই সাদিব রীতির কোল থেকে অভিকে নিয়ে বললো,
—–“অভিকে তো ভালোই সামলালে।বিয়ের পর আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেশী প্রব্লেম হবেনা।ভালোই সামলাতে পারবে।কি বলো?”
সাদিব কথাটা বলেই বাকা হাসলো।
রীতি বড়বড় চোখ করে সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিবের চোখে মুখে দুষ্ট হাসির রেখা দেখে রীতি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
রীতি দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো লজ্জায়।তারপর অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।সাদিব রীতির লজ্জা পাওয়া দেখে হেসে ফেললো।
রীতি সাদিবকে মনে মনে বকছে,
—–“অসভ্য লোক,বাচ্চাকাচ্চার চিন্তাভাবনা করে ফেলেছে।দেখে তো ভদ্র মনে হয় কিন্তু এ লোক ভেতরে ভেতরে ভারী অসভ্য।উনি নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে অভিকে আমার কাছে পাঠিয়েছে।আমাকে বিরক্ত করার জন্য।কিন্তু অভি তো আর উনার মতো না।আমি যার প্রপোজ একসেপ্ট করিনি সে বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যান করে ফেলছে।এতো সহজে একসেপ্ট করছিনা।আপনার জন্য আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি,অনেক কেদেছি আমার প্রিয় চশমা পর্যন্ত ভেঙেছি।এতো সহজে ধরা দিচ্ছিনা।হুহ।”
রীতি একা মনেই বিরবির করছে।
.
রাত ১০টা।সবাই খেতে বসেছে।রীতি,রিমন,সাবিহা,সাদিব,দিয়া,দিহান ওরা এক টেবিলে বসেছে।সাদিব রীতির বিপরীত পাশে বরাবর বসেছে।সাদিব খাচ্ছে আর রীতিকে দেখছে।রীতি বেচারি সাদিবের জন্য খেতেই পারছেনা।এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় নাকি।রীতির অস্বস্তি হচ্ছে।রীতি খাবার শুধু নেড়েই যাচ্ছে।
বাকি সবাই নিজের মতো খাচ্ছে।রীতি সবার দিকে তাকাচ্ছে আর নিজের প্লেটের খাবারগুলো নাড়ছে।
সাদিব রীতিকে এমন নাড়াচাড়া করতে দেখে নিজের ফোন থেকে মেসেজ করলো।রীতির ফোন টুং শব্দ করে মেসেজ এলো।কিন্তু রীতি ইন্টারেস্ট ফিল করলো না।আজকাল সিম কোম্পানি দিন-রাত মেসেজ দিয়েই চলেছে।রীতির রেসপন্স না দেখে সাদিব আবারো মেসেজ করলো।এক সাথে দু-তিনটা মেসেজ পেয়ে রীতি ফোনের পাওয়ার বাটন অন করে সাদিবের নাম দেখে সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিব ইশারা করলো।
রীতি মেসেজ ওপেন করে দেখলো তাতে লিখা,
—–“খাচ্ছোনা কেনো?খেতে পারছো না?”
রীতির মেজাজ চটে গেলো।রীতি সাদিবের দিকে দাতে দাত চেপে তাকালো।তারপর টাইপ করলো,
—-“আপনার জন্য খেতে পারছি?আমার খাবারের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?নিজের প্লেট থেকে গিলছেন মুখ দিয়ে আর চোখ দিয়ে আমার প্লেটের টা গিলছেন?কেনো?”
সাদিব মেসেজ দেখে হতবাক।সাদিব মুচকি হেসে রিপ্লাই করলো,
—–“উহু,চোখ দিয়ে তোমার প্লেটের বিরিয়ানি নয়,তোমাকে গিলছি।”
রীতি সাদিবের এমন মেসেজ দেখে থ।নির্লজ্জ লিখে সেন্ড করে দিলো।
সাদিব রিপ্লাই দিলো,”তোমার জন্য।”
রীতি সাদিবের রিপ্লাই পড়ে ফোন রেখে দিলো।তারপর টেবিলে বসা সবার দিকে চোখ বুলালো।
খাওয়া শেষ করে রীতি উঠতে নিলে আটকে যায়।মনে হচ্ছে পায়ের স্লিপার আটকে গেছে কিছুর সাথে।স্লিপার টেনেও ছাড়াতে পারছেনা।বাধ্য হয়ে টেবিলের নিচে তাকালো।
টেবিলের নিচে চেয়ে যেনো ওর চোখ কপালে।সাদিব নিজের জুতা দিয়ে রীতির স্লিপার জুতায় পাড়া দিয়ে আটকে রেখেছে।
রীতি মাথা তুলে সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিব নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে।কোনো দিকে তাকাচ্ছেনা।যেনো কিছুই দেখছে না,কিছুই জানেনা।
রীতি সাদিবের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে নিজের জুতা জোরে টান মারলো।রীতির জুতা সাদিবের জুতার নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো।
জোরে টানায় সাদিব একটু নড়ে গেলো।তারপর কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজের প্লেটের দিকে চেয়েই বিরবির করে বললো,
—–“তালপাতার গায়ে জোর আছে দেখছি।”
সাদিব রীতির দিকে তাকাতেই রীতি ভেংচি কাটলো।
.
ধীরে ধীরে ছাদ ফাকা হয়ে যাচ্ছে।একে একে সবাই ঘরে চলে যাচ্ছে।
রীতিও চলে যাবে।রিমনকে ডাকছে।রিমন আসছি আসছি বলে যাচ্ছে।রীতি
বিরক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।সাদিব রীতির পেছনে থেকে গলা খাকারি দিলো।রীতি ঘুরে দাড়িয়ে সাদিবকে দেখলো।
সাদিব পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রীতি শুকনো মুখে বললো,
—–“কিছু বলবেন?”
সাদিব কিছু বলছেনা।চুপ করে দাড়িয়ে আছে।যেনো নীরবতা পালন করছে।রীতি অতি আগ্রহ নিয়ে সাদিবের দিকে চেয়ে আছে সাদিব কি বলবে সেটা জানার জন্য কিন্তু সাদিব কিছুই বলছেনা।যেভাবে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
অবশেষে সাদিব নীরবতা ভেঙে রীতির দিকে চোখ তুলে তাকালো।
—-“তোমার আর কত সময় চাই?”
এমন প্রশ্নে রীতির সারা শরীর ঝাকিয়ে উঠলো।রীতি সাদিবের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেনা।সাদিব রীতির খুব কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বললো,
—–“আমি জানি তোমার কোনো সময়ের প্রয়োজন নেই।উত্তর তোমার জানা।তবে তুমি উত্তর দিতে চাইছোনা।”
একে তো সাদিব ওর এতো কাছে তাতে রীতির বুক ঢিপঢিপ করছে।হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি বেড়ে চলেছে তার উপর সাদিবের বলা সত্য দুটো লাইন।সাদিব রীতির ভেতরটা পড়ে ফেলেছে এটা ভেবেই রীতির অস্বস্তি লাগছে।রীতি তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সাদিব কড়া গলায় বললো,
—-“আমাকে ঘোরাতে চাইছো?আমাকে কেনো ঘুরাচ্ছো?খুব ভালো করছো।”
সাদিব কথাটা বলে এক মুহূর্ত দাড়ালো না।হনহন করে চলে গেলো।
সাদিবের এভাবে চলে যাওয়াটা রীতি মেনে নিতে পারছেনা।মনে হচ্ছে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।রীতির চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
.
রাত দুটো ঘড়ির কাটায়।সাদিবের ঘুম আসছেনা।কেমন ছটফট করছে।খোলা হাওয়া প্রয়োজন।ছাদে গিয়ে যে দাঁড়াবে তারও ইচ্ছে করছে না।ছাদে জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সাদিব নিজের রুম থেকে বের হয়ে মেইনডোর খোলে গার্ডেনে গিয়ে বসলো।অনেক রাত হয়ে গেছে।পুরো বাড়ি নীরব,নিস্তব্ধ।সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।সাদিব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে।ঠান্ডা পড়েছে বেশ।হাত-পা জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়।
রীতিরও ঘুম আসছেনা।সাদিবের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে।রীতি উঠে বারান্দায় গেলো।চোখ দিলো আকাশের দিকে।মন খারাপ প্রচুর।সাদিবকে রীতি কেনো ঘুরাবে?সাদিব কেনো বললো এটা?
রীতির হটাৎ চোখ গেলো বাগানের দিকে। লাইটের উজ্জ্বল আলোয় সাদিবকে চিন্তে ভুল হচ্ছেনা।
“এই ছেলে এই ঠান্ডায় কি করছে?নাহ, এতটা কেয়ারলেস।”
রীতি রুমে এসে একটা চাদর নিয়ে সাদিবকে মনে মনে বকতে বকতে বাগানের দিকে পা বাড়ালো।
চলবে….!