কাগজের তুমি আমি পর্ব-১৯

0
2450

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#১৯তম_পর্ব

ধারা খেয়াল করলো তার বুকে যেনো কেউ ড্রামপিট বাজাচ্ছে। অনলের চোখে চোখে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে, যেনো চোর ধরা পরেছে। এখন এই রুমে একেবারেই থাকতে পারবে না সে। তাই ধীর কন্ঠে বললো,
– তুমি খেতে আসো আমি ফুপির কাছে গেলাম

কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে উঠতে গেলেই পেটে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলো ধারা। হঠাৎ ব্যাথাটা অনুভব করায় পা দুটো ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে নিলে দুটো হাত তাকে আগলে ধরে। ঘটনার আকর্ষিকতায় ধারাও খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। যখন তার হুশ ফিরে যখন দেখে তাকে পেছন থেকে অনল আগলে রেখেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অনলের বজ্রকন্ঠ তার কানে আসে,
– আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতি। বুদ্ধিটা হাটুতে থাকে নাকি? এখন সাড়ে ছয় মাস চলছে তোর প্রেগন্যান্সির। সাবধান থাকবি তো। আমি তো ভাবতেই পারছি না আমি যদি না সামলাতাম কি হতে চলেছিলো? সারাক্ষন দৌড়াদৌড়ি, আমার কথাগুলো তো কানে যায় না তোর। শান্তি লাগে না খুব আমাকে জ্বালাতে। সারাটাক্ষণ তোদের নিয়ে চিন্তায় থাকি। ইচ্ছে করছে একটা ঠাটিয়ে লাগাই। পাগল ছাগল! একটু আসতে উঠলে কি হতো? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতে ছিলাম? চুপ করে আছিস কেন?
– কি…কিক করেছে

ধারা কথাটা কানে যেতেই অনল যেনো একদম শান্ত হয়ে যায়। ধারা তখন ও পেটে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, যেনো সেও একটা ঘোরে রয়েছে। অনলের এতো বকাঝকা কিছুই তার কানে যায় নি। অনল আবারো শিওর হবার জন্য শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে?
– তোমার প্রিন্সেস কিক করেছে
– তুই শি…শিওর?
– হ্যা, হাতটা দাও।

বলেই অনলের হাতটা টেনে নিজের পেটে ছোয়ায় ধারা। তার চোখ জোড়া চকচক করছে। অনল যেনো অধীর আগ্রহে ওয়েট করে রয়েছে তার মেয়ের লাথি অনুভব করার জন্য। হঠাৎ কিছু অনুভূতি হতেই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠে তার। নিমিষেই ধারার উপর যত রাগ ছিলো সব গলে পানি হয়ে যায়। চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলতে থাকে,
– সি কিকড, ধারা সি কিকড। আমার প্রিন্সেস ফার্স্ট টাইম কিক করেছে।

বলেই ধারাকে জড়িয়ে ধরে অনল। হঠাৎ অনলের এমন কাজে ধারা যেনো বরফ ঠান্ডা হয়ে যায়। এক অন্য রকম শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই চলে, শিরদাড়া বেয়ে যেন উষ্ণ রক্তের প্রবাহ বয়ে যায়। খুশির জোয়ারে অনলের মনেই নেই সে ধারাকে জড়িয়ে ধরে আছে। যখন হুশ আসে তখন তড়িৎ গতিতে তাকে ছেড়ে দেয়। ধারার গালে রক্ত জমতে থাকে। মূহুর্তে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ হালকা করতে অনল স্নেহের সাথে ধারার পেটে হাত দিয়ে বলে,
– মাই প্রিন্সেস শুনতে পাচ্ছো, বাবা আজকে অনেক হ্যাপি। আর মাত্র কিছুদিন তারপর তুমি বাবার কাছে চলে আসবে। বাবা আর মেয়ে মিলে তোমার মাম্মামকে জ্বালাবো। তোমার মাম্মামটা অনেক পাজি, সারাক্ষণ বাবাকে টেনসন দেয়। একটু আগেও পাগলামি করেছিলো। তুমি আসলে আমাদের টিমটা ভারী হবে।
– এটা কি হচ্ছে?

মাজায় হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে ধারা বলে উঠে। অনল বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,
– এটা বাবা-মেয়ের কথা। তুমি মাঝে আসবি না

ধারা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। এই লোকটার সাথে সত্যি সে পেরে উঠে না। তবে মনে একটা খুশির ফুলকারি জ্বলছে। অনলের মুখের আনন্দটা যেনো ধারা এই খুশির কারণ। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন, প্রিয় মানুষটাকে আনন্দে দেখলে নিজেও কখন খুশি হয়ে উঠে বুঝে উঠে না মানুষ। আজ যেমন অনলের উচ্ছ্বাসিত মুখটি দেখে ধারার হৃদয়েও শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারোর দরজায় কড়া পড়লে তাদের বাস্তবে পদর্পন হয়। পেছনে তাকাতেই দেখে মহুয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ইতস্তত ভাবেই মেয়েটা বলে উঠে,
– সরি, আমি বোধ হয় ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আসলে মামি মা ডাকছিলেন। আমরা ডাইনিং টেবিলে ওয়েট করছি খেতে আসো তোমরা।
– তোরা খাস নি?
– না, আসলে মা তোমার সাথে খেতে চাচ্ছিলো। আমি যাচ্ছি

বলেই যেতে নিলে ধারা পেছন থেকে ডাক দেয় তাকে। নিজেকে ঠিক করে মহুয়াকে বলে,
– মহুয়া আপু, আমিও যাবো।

ধারার সাথে মহুয়ার তেমন কোনো কথাই হয় নি সারাদিনে। মহুয়া মেয়েটা খুবই চুপচাপ ধরনের মেয়ে। এবার ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে সে। ধারা খুবই অবাক হয় এটা ভেবে যে তার মাঝে সুমনা বেগমের কোনো প্রতিচ্ছিবি ই দেখা যায় না। এই সুযোগে যদি তার সাথে একটু খাতির হয় তো খারাপ হবে না হয়তো। তাই অনলের বাধন ছেড়ে তার সাথে চলে আসে। অনল ও বাধা দেয় না। যেতে যেতেই ধীর কন্ঠে মহুয়া বলে উঠে,
– ধন্যবাদ
– কেনো বলোতো মহুয়া আপু?
– না আসলে অনল ভাইকে অনেকদিন পর এতটা আনন্দিত দেখলাম। তাই, আরও একটা কারণ আছে। সেটা হলো মাকে সহ্য করার জন্য ও ধন্যবাদ। মা একটু এমন ই কিছু মনে করো না। আসলে মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো মামীর কাছে আমার আর অনল ভাই এর বিয়ের কথা বলার। সে আশায় তো পানি পড়লো তাই একটু খিচে আছে। তুমি চিন্তা করো না।
– আচ্ছা ফুপ্পি কি খেতে ভালোবাসে গো?
– রান্না দিয়ে মন জয় করবে?
– চেষ্টা করবো
– তাতে বেশি লাভ হবে না। তবে একটা কাজে লাভ হবে
– কি বলোতো?
– সময় হলে বলবো।

বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো মহুয়া। মেয়েটাকে খুব ভালো লেগেছে ধারার। নিজের সমবয়সী কাউকে পেলে কার না ভালো লাগে।

ডাইনিং টেবিলে,
অনল যখন খাবার খেতে ব্যাস্ত তখন ই সুমনা বেগম গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
– ভাবী, অনল আমার কিছু বলার আছে। যদি অনুমতি দেন তো বলি

সুমনা বেগমের এভাবে কথা বলার ধরনে বেশ অবাকই হন সুভাসিনী বেগম। সাধারণত এভাবে সুমনা বেগম কথা বলেন না। যা মুখে আসে তাই বলেন। কিন্তু এভাবে কথা বলার একটা মানে হতে পারে তিনি বেশ গুরুতর কিছু বলবেন হয়তো। অনল খাবার রেখে ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বলে,
– তোমার কথা বলার জন্য কখনো পারমিশন লেগেছে বলে আমার জানা ছিলো না। বলো না কি বলবে।
– কথাটা বেশ গুরুতর তাই এভাবে বলতে চাচ্ছি। আমাকে তোরা কেউ ভূল বুঝিস না। হুট করে ঢাকায় আসার কারন নিয়ে ভাবী বেশ কবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু বলে উঠার সাহস হয়ে উঠে নি। কিন্তু না বলেও পারছি না। তাই আর কি পারমিশন চাচ্ছি।

সুমনা বেগমের কথা শুনে এবার একটু চিন্তিত হয়ে উঠেন সুভাসিনী। কি এমন কথা যা বলতে এতোটা ইতস্তত করছেন সুমনা বেগম। বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই তিনি বলে উঠেন,
– সুমনা ভনিতা না করে বলো না কি কথা, কেনো হুট করে আসা তোমার ঢাকায়?

এবার ধীর কন্ঠে সুমনা বেগম বলতে লাগলেন,
– আমাকে ভুল বুঝো না ভাবী। আসলে আমি ঢাকা এসেছি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। ভাইয়া দেশে ফিরেছেন।

সুমনা বেগমের কথাটা শোনামাত্র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অনলের। চোখগুলো মূহুর্তেই রাগের অগ্নিতে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। পৃথিবীতে সে যদি কাউকে ঘৃণা নামক জিনিসটা করে থাকে তাহলে সেটা এই লোকটা। সম্পর্কে যিনি তার বাবা হয়। ধারা অনলের মুখের পরিবর্তনটা যেনো আচ করতে পারছে। অনলের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ধারার বুঝতে বাকি রইলো না সে তার রাগ সংযম করছে। অনলের প্রতিটা কাজের সাথে সে খুব ভালো করেই পরিচিত। হঠাৎ সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা তার কানে এলো,
– তোমার ভাইয়া এসেছে, তুমি তার সাথে দেখা করবে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমার রাগ করার তো কিছু নেই সুমনা। এ ব্যাপারটা আমাদের না জানালেও হতো।
– আসলে ভাবী….ব্যাপারটা শুধু এটা নয়। ভাইয়া তোমার আর অনলের সাথে দেখা করতে চায়। সেকারণে

তার কথাটা শেষ হবার আগেই অনল চিৎকার করে বলে উঠে,
– আমরা চাই না তার সাথে দেখা করতে। এতোদিন তো ভালোই ছিলাম আবার কেনো আমাদের জীবনে এসেছে সে। সে তো নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলো অন্য কারোর কাছে। তখন বউ ছেলের কথা মনে ছিলো না? আমার মাকে ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিলো না?

বলেই খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেলো সে। সেখানে বসে থাকলে হয়তো মেজাজটা আরো বিগড়ে যেতো অনলের। এমন একটা পরিস্থিতি কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না ধারা। মহুয়া তখন চোখ দিয়ে তাকে ইশারা করে বলে যাতে অনলের সাথে যায়। ধারাও অনলের পিছন রুমে গেলো। অনলের যে রাগ কি করবে তার ঠিক নেই। এদিকে সুভাসিনী বেগম এখনো সেভাবেই ভাবলেশহীন ভাবেই বসে রয়েছেন। বেশ ঠান্ডা গলায় বলেন,
– আমার কাছে কি চাই তার? যা চেয়েছিলেন আমি তো সব দিয়েছি তাকে। তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন স্বামীর দায়িত্ব থেকে, বাবার দায়িত্ব থেকে। আমি দিয়েছি। শুধু তাই নয় আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি। বাড়ির বউ এর, স্ত্রীর, মার, ভাবীর সব দায়িত্ব। বিনিময়ে কি পেয়েছি আমি সুমনা? এখন এতো বছর পর তার আমার কাছে কি চাওয়া আছে। আমি কি দিতে পারি তাকে নতুন করে?
– ক্ষমা

সুমনা বেগমের কথাটা কর্ণপাত হতেই তার দিকে তাকান সুভাসিনী বেগম। তার ঠোঁট জোড়া কাপছে। ছাব্বিশ বছরে ক্ষতটা যেনো তাজা হয়ে উঠেছে। এতো কাঠখড় পুড়িয়ে যা মনের গহীনে পুতে রেখেছিলেন সেটা আবার খুচিয়ে রক্তক্ষরণ করছে হৃদয়ে৷ এতো বছর পর ও মানুষটার কথা শুনলে বুকে কষ্ট আর শুন্যতাগুলো ঘিরে ধরছে। সুমনা বেগম বেশ ধীর গলায় বলেন,
– ভাইয়া বেশ অনুতাপ করছে ভাবী। শেষবারের মতো তোমাদের দেখতে চায়। আচ্ছা ভাবী লোকটা একটা সুযোগ দেওয়া যায় না। অনল না হয় জানে না কিন্তু তুমি তো জানো তোমাদের ছাড়াছাড়ি টা হয় নি। তোমরা এখনো স্বামী স্ত্রী। লোকটা একা একা আর পারছে না ভাবী। হ্যা মানছি তোমার সাথে সে কম অন্যায় করে নি। কিন্তু
– তুমি আমার জায়গায় থাকলে কি করতে সুমনা? শফিক ভাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে? আমি নিঃস্ব সুমনা। তাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। ক্ষমাও নেই। অনল যদি তার সাথে দেখা করতে চায় তো ভালো। আমি বাধা দিবো না। ছেলে হয় সে তার। কিন্তু আমি তার সামনে যাবো না। একটা কথা কি জানো, ক্ষমা হয়তো করতাম যদি লোকটা আমার থাকতো। সে তো আমার কখনো ছিলো না। আর সম্পর্কের কথা বলছো। সেটা তো খালি কাগজের। সেটা থাকা বা না থাকাতে আমার কিছুই যায় আসে না সুমনা। আমি আর তাকে মনে জায়গা দিতে পারবো না। তোমাকে আমি কখনো তার বোন মনে করি নি। আমার ছোট বোনের মতো দেখেছি। তাই একটা অনুরোধ করছি, আমার কাছে তাকে নিয়ে কোনো অনুরোধ করো না। রাখতে পারবো না।

বলেই উঠে গেলেন সুভাসিনী বেগম। তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুমনা বেগম।

অপরদিকে,
নিজের সমস্ত রাগ ধোয়ায় উড়াতে লাগলো অনল। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। পাছে ধারার ক্ষতি হলে। না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি