অশ্রুবন্দি পর্ব-৩৯+৪০+৪১+৪২

0
5

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৩৯

ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বেরুতে বেরুতে সাড়ে চারটা বেজে গেল সৃজার। ঘর্মাক্ত বদনে, ক্লান্ত শরীরে গেইটের কাছে বেরিয়ে আসতেই লম্বাটে পুরুষটিকে দেখল সে। যে হাত উঁচু করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে ওর। সৃজা একপলকের জন্য থেমে দেখল উচাটন ভঙ্গিতে, কালো টি-শার্ট পরে বাইকের উপর বসে থাকা মানুষটাকে। যার কপালে অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে চুল, শীতল বাতাসের দাপটে যেগুলো উড়ছে। সৃজার খুব ইচ্ছে করল চুলগুলো গুছিয়ে দিতে, ওড়না দিয়ে ক্লান্ত মুখের বিষাদ মুছে দিতে। কিন্তু নাহ, এরকম করা যাবে না। সে এখন কাঠিন্যতার বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। তাই এত গদগদ আচরণ করা ঠিক হবে না। সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল ইহসানের দিকে। ওকে দেখেই চওড়া হাসি ঠোঁটে টেনে ইহসান পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, “ক্লাস শেষ?”

ঢকঢক করে পুরোটা পানির বোতল খালি করে সৃজা ছোট্ট জবাবে বলল, “হু।”

এরপর বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে স্ট্যান্ডে পা রেখে উঠে বসল বাইকের পেছনে। ওড়না গুছিয়ে নিয়ে ইহসানের কাঁধে হাত রেখে বোঝাল যাত্রা শুরু করতে। হ্যান্ডেলে হাত রেখে বসে থাকা ইহসান বউয়ের আচরণ দেখে বিমূঢ় হয়ে গেল। পানিটা ও একাই খেয়ে নিলো? ওকে একবারো সাধল না? তার উপর ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে বাইকে উঠে বসেছে, জড়িয়ে না ধরে কাঁধে নামেমাত্র হাত রেখেছে? ওর ঠোঁটে দৃশ্যমান হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল ব্যস্ত রাস্তা ধরে। মাঝেমধ্যে গতি বাড়াল, কিন্তু সৃজা আগের মতোই অনড় হয়ে বসে রইল। জাপ্টে ধরল না, বারণ করল না। ভীতি নিয়ে সাবধানও করল না ওকে। সৃজার শীতল আচরণ হজম করতে পারছে না ইহসান। বড় রাস্তায় উঠার পর স্বাভাবিক ব্যবহার পাওয়ার আশায় জিজ্ঞেস করল, “কেএফসিতে বসব?”

“নাহ।”

“পার্কে যাবি? চটপটি-ফুচকা খেলি? থামব?”

“উহু।”

“হাবু মামার দোকানে সাতরঙা চা হয়, যাব?”

“না।”

“নদীর পাড়?”

“না।”

“কেন?”

“বোরিং প্লেইস।”

দারুণ একটা বিষম খেল ইহসান। নদীর পাড় তো সৃজার খুব প্রিয় জায়গা। আগে যাবার জন্য নিজেই বায়না করত। জোরাজুরি করতো। অথচ এখন বলছে বোরিং প্লেইস? ও ধৈর্যহারা হয়ে গেল, “তাহলে আমার
ওখানে চল।”

“ইচ্ছে করছে না।”

“সবকিছুতে না না কেন করছিস?”

বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়ল ওর সেই কণ্ঠে। রাগ উঠে যাচ্ছে। কপালের রগ ভেসে উঠছে সেই রাগের পারদে। বুকে অসহনীয় বিষাদ। সৃজা ওর কণ্ঠস্বরের তেজ বুঝে নিয়ে কাঠ গলায় বলল, “সরি, অবাধ্য হওয়া উচিৎ হয়নি। যাও যেখানে ইচ্ছে করে। সরি এগেইন।”

দু’লাইনে কথা শেষ করে চুপ হয়ে গেল সৃজা। আর ওর সরি, সরি শুনে রাগে ইহসানের হাত মুঠোবন্ধ হয়ে যেতে চাইল, কিন্তু সম্ভব হলো না সেটা। সে চোখমুখ শক্ত করে বাইকের গতি বাড়িয়ে একটা বাসকে ওভারটেক করতেই সৃজা চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। শুধু মেয়েলি হাতটা ওর শার্ট খামচে ধরে মুখফুটে বলল, “সাবধানে চালাও।”

বাইকটা থামলো একটা টং দোকানের সামনে। খুব ছোট্ট এক দোকান, জীর্ণশীর্ণ সাইনবোর্ডে লিখা, ‘হাবিব ভাইয়ের টি-স্টল।’ খড়ের চাল আর বেড়া দিয়ে তৈরি দোকানটি সাজানো বনরুটি, কুকিজ, আটার বিস্কুট আর বিভিন্ন চিপসের প্যাকেট, বাচ্চাদের লজেন্স দিয়ে। তবে এখানের মূল আকর্ষণ যে বিভিন্ন ধরনের চা তা টাঙিয়ে রাখা লিস্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনে বসার জন্য দু’পাশে দুটি কাঠের একটা বেঞ্চ রাখা। ইহসান সৃজাকে সেখানে বসিয়ে এগিয়ে গিয়ে দোকানিকে বলল, “হাবু মামা, তোমার দোকানের স্পেশাল চা বানাও।”

আরো কীসব হাবিজাবি অর্ডার দিয়ে এসে সৃজার পাশে ধপ করে বসল ইহসান। সৃজা তখন সামনের একটা ফুলের দোকান দেখছিল। তাই হুট করে কেউ পাশে বসায় ও চমকে তাকাল। একান্ত স্বামী পুরুষটিকে দেখে পরক্ষণেই আবারো নজর ঘুরালো। ইহসান চটপটে গলায় ওকে বলল, “হাবু মামার চায়ের স্বাদই অন্যরকম। খেলেই বুঝবি।”

“আচ্ছা।”

অন্যদিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল সৃজা। ইহসান চোখ ছোট ছোট করে সৃজার দৃষ্টি অনুসরণ করতেই ওর চোখ গেল পাশের ফুলের দোকানটায়। তৎক্ষনাৎ ওর মাথায় কিছু একটা খেলে গেল। মন উৎফুল্ল হলো। এই মেয়েকে এখন বাগে আনবে সে। আর এমন কঠিন কঠিন, এড়িয়ে যাওয়া আচরণ করতে দেবে না। সৃজার এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে আসা কিছু চুল হিজাবের ভেতর গুঁজে দিয়ে বেশ সহজ গলায় বলল, “তুই একটা গোলাপ ফুল সৃজা।”

“থ্যাংকিউ।”

ইহসান এবার উল্লসিত কণ্ঠে বলল, “না না, তুই ফুলের চেয়েও সুন্দর! অবশ্য দেখতে হবে না কার বউ! এই আমার, ইহসান শেখের।”

“হুম।”

“তুই এখানে বস, আমি ফুল নিয়ে আসছি।”

“আনতে হবে না।”

“কেন?”

নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব এলো, “ফুলগুলো বাসি, নষ্ট হয়ে গেছে।”

এটুকু বলে সৃজা আবার আগের মতোই চুপচাপ হয়ে গেল। ইহসানের এত মেজাজ খারাপ লাগল! ইচ্ছে করল ঐ ফুলের দোকান, হাবু মামার দোকান সব ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিতে। সৃজাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিতে। পিচঢালা রাস্তায় শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা বাস-ট্রাকের নিচে লাফিয়ে পড়তে। ও সৃজার হাত মুঠোয় চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করতেই সৃজা অবাক চোখে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? হাত ধরেছ কেন? কোনো সমস্যা?”

ইহসান অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “চায়ে ক’চামচ চিনি দিতে বলব?”

“চিনি ছাড়া খাব।”

কটমট করে বলল ইহসান, “দিনদিন তেঁতো হয়ে যাচ্ছিস…”

“আচ্ছা, তাহলে তুমিই ঠিক করে দাও ক’চামচ চিনি খাব! ওয়েট, আমিই বলে আসছি।”

ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে কথাটুকু শেষ করে সৃজা উঠে গেল। ইহসান মুখ গোঁজ করে বসে রইল। ওর সবকিছু বিরক্ত লাগছে, তেঁতো ঠেকছে! হাবু দোকানদার ইহসানকে চেনেন৷ মাঝেমাঝেই এখানে চা খেতে আসে বলে ভালোই আলাপ আছে ওর সাথে। কিন্তু আজ সাথে করে এই সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এসেছে, মেয়েটা কে হয় ওর? পাঁচ চামচ চিনি চাইল যে? কৌতূহল নিয়েই তিনি সৃজাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ইহসান বাবার কী হও গো মা?”

সৃজা বিব্রত কণ্ঠে বলল, “বউ হই মামা।”

“মাশাল্লাহ! বিয়ের খবর আগেই শুনছিলাম, দেখার সৌভাগ্য হয় নাই মা!”

“দোয়া করবেন মামা।”

হাবু দোকানদার উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, “হ হ, করমু।”

দুটো কাপ নিয়ে একটা ইহসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে পাঁচ চামচ চিনি মেশানো চায়ে চুমুক দিয়েই চোখমুখ বিকৃত করল সৃজা। এত মিষ্টি! মনে হচ্ছে পায়েস! বিস্বাদ ঠেকল চা’টা। কিন্তু ইহসান ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে বলে কিছু বলল না। চুপচাপ চা শেষ করল। এরপর চেয়ে এনে পানি খেল। ইহসান অবশ্য এক চুমুকেই চা শেষ করে বিল মেটাতে গেল। হাবু মামা বিল তো রাখলোই না উল্টো সৃজাকে ডেকে ওর হাতে কুকিজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, “স্বামী সোহাগী হইও গো মা, তোমার জামাইডা বড়ই দিলখোলা, বড় মনের মানুষ। তারে জীবনে কষ্ট দিও না।”

সৃজা চরম বিব্রতবোধ করল। অপ্রস্তুত হাসলো। হাবু মামা এরপর ইহসানকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, “মাইয়া মানুষ বাপের সংসার ছাইড়া আইছে তোমার সংসারে। তুমি তার লগে লগে থাকবা। একটা কথা মাথায় রাইখো, মাইয়া মানুষ আদরে গলে, বেশি শাসনে কাঠ হইয়া যায়। বউরে কাঠ হইবার সুযোগ দিও না গো বাজান। ভুলত্রুটি করলে আদর কইরা বুঝাইও।”

ইহসান গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি কী মাইন্ড রিড করতে পারো নাকি? মানে মনের কথা পড়তে পারো?”

হাবু মামা হেসে ফিসফিস করে বললেন, “তোমরা যে কাইজ্জা করছ, চেহারা দেখলেই বুঝা যাইতেছে। বৌমারেও দেখলাম মুখ ভোঁতা কইরা বইয়া আছে আইবার পর থেইক্কা। পরখ কইরা বুইঝা নিলাম।
এহন কও, আমি ঠিক না ভুল?”

হাবু মামার কথা শুনে ইহসান মাথা নাড়লো, “ঠিক মামা।”

“তোমার হাবু মামা ঠিক কথাই কয়।”

.

বিছানা গোছাতে, কাপড় ভাঁজ করতে সৃজাকে সাহায্য করেছে ইহসান। আগে সৃজা কাজের পাশাপাশি কথার ঝুড়ি খুলে বসতো, খিলখিল করে হেসে মুগ্ধতা ছড়াতো ঘরময়। হৃদযন্ত্রে ব্যথা ধরিয়ে দিতো ওর। কিন্তু সৃজা এখন তেমন কিছুই করছে না। গোসল সেরে এসেও অনেকক্ষণ সৃজার চঞ্চলতা দেখতে না পেয়ে একপর্যায়ে উঠে গিয়ে বই গোছাতে থাকা সৃজাকে টেনে বাহুডোরে আবদ্ধ করল ইহসান, “এত চুপচাপ কেন?”

সৃজা প্রথমে ভড়কে গেলেও এবার স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো, “কাজ করছি।”

“এরজন্য কথা বলা বারণ নাকি?”

সরু গলায় কথাটা বলতেই সৃজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “অহেতুক বকবক করলে তোমার মাথা ধরবে।”

“একথা বলেছি আমি?”

“না। তবে অনুমতিও পাইনি।”

ইহসানের মেজাজ খারাপ লাগল। অনুমতি মানে? কীসের অনুমতি? সৃজা কীসব উল্টাপাল্টা বলছে ওকে? বুকে অহেতুক ছুঁড়ি বসাচ্ছে! ও বিরক্তি ফুটালো চোখেমুখে। কর্কশ গলায় বলল, “আমার এসব ভালো লাগছে না।”

“কোনসব?”

সৃজা বিস্মিত ও প্রশ্নোক্ত চাহনিতে তাকাল। ভাবলেশহীন কণ্ঠ ওর। ইহসান একহাতে নিজের কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঠোঁটের কোণে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে লম্বা একটা চুমু খেল। সৃজা অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ইহসান হতাশ হয়ে ছেড়ে দিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল, “দেখ, আমার শ্বাস চলছে না। বুকে হাত দিয়ে দেখ!”

“প্রেশার ফল করল নাকি? বসো, বসো চেক করে দিচ্ছি।”

এবারে খানিকটা বিচলিত দেখালো সৃজাকে। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ইহসান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রেগে আগুন হয়ে গেল। টি-টেবিলে জোরেশোরে একটা লাত্থি বসিয়ে রাগ ঝাড়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বিনিময়ে পায়ের আঙুলে প্রচন্ড ব্যথা পেল। ধপ করে ব্যথা পা নিয়ে বিছানায় বসে
কিড়মিড় করল ইহসান। থাবা বসালো খাটের পাশে। স্ফিগম্যানোমিটার আনতে গেছে সৃজা? প্রেশার মাপবে? এরচেয়ে চাকু দিয়ে চিঁড়ে ওর বুকের ভেতরটা দেখতো,
শান্তি লাগতো তাতে!

ইহসান ধপ করে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে। এরপর চোখদুটো বুজে শ্বাস ছাড়ল। মাথার ভেতরটা ঘট পেকে আছে। এই ঘট সৃজাবিহীন অন্যকেউ ছাড়াতে পারবে না। সৃজা এলো মিনিট খানিক পর৷ এসে ওকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে কপালে হাত রেখে চিন্তিত গলায় ডাকলো, “বেশি খারাপ লাগছে নাকি?”

সৃজার নরম হাতের স্পর্শে অন্য পৃথিবীতে হারিয়ে গেল ইহসান। চিত্তে শুরু হলো দুর্নিবার ঘূর্ণিঝড়। ঘোরগ্রস্ত হলো সে। ওর হাত টেনে চুমু বসিয়ে এরপর মৃদু স্বরে বলল, “হুম।”

সৃজা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রেশার চেক করতে বসল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফলাফল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইহসানের দিকে। স্বাভাবিকের চেয়ে দু’পয়েন্ট বেশি, ঝুঁকিপূর্ণ নয় কিছুতেই। তবে এটাকেই অস্বাভাবিকের পর্যায়ে ফেলল ইহসান, “দেখলি কত বেড়েছে? শরীরটা একদম ঠিক লাগছে না। একগ্লাস পানি দে তো। আর দরজাটাও চাপিয়ে আয়।”

সৃজা সূঁচালো চাহনিতে ওকে পরখ করল। কিছুই বুঝতে বাকি নেই ওর। বাধ্য মেয়ের ন্যায় উঠে গেল। পানি দিলো, ঔষধ দিলো। দরজাটাও চাপিয়ে এলো। ইহসান আধশোয়া অবস্থায় ওকে ডেকে কাছে এনে ওর ঘাড়ে মাথা রেখে বলল, “একটু গল্পগুজব করতে ইচ্ছে করছে।”

“এখন কোনোভাবে গল্প করার সময় না, ঘুমানোর সময়। ঘুমালেই প্রেশার ঠিক হয়ে যাবে। গল্পগুজব করলে আরো বাড়বে। দেখি শুয়ে পড়ো, আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি!”

কঠোর গলায় বলে সৃজা উঠতে গেল, ইহসান কঁকিয়ে উঠল তখনি। সৃজা হতবিহ্বল হয়ে গেল, “কী হলো?”

“পা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়…”

সৃজা কপালে ভাঁজ ফেলে চাদর সরিয়ে দেখল পা পরীক্ষা করে দেখল পায়ের পাতা ফুলে লাল আছে। আঙুল ছোঁয়াতেই ব্যথায় আত্ম চিৎকার করে উঠল ইহসান। সৃজা হতভম্ব হয়ে তাকাতেই ইহসান চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “দেখলি তো কেমন লাল হয়ে আছে…”

একবার ওর মুখের দিকে একবার পায়ের দিকে তাকাল সৃজা। কাঁচুমাচু পুরুষালি চেহারা নজর এড়াল না ওর। আন্দাজে ধরে ফেলল ঘটনাটা। রয়েসয়ে শক্ত গলায় বলল, “কী করে হলো? আমি যাবার আগেও তো ঠিক দেখে গেলাম!”

ইহসান আমতাআমতা করে বলল, “জানি না, তুই একটু বোস না।”

“বসলে কী হবে? পা ভালো হয়ে যাবে?”

“কথা বললেই হবে।”

শুকনো গলায় বলল ইহসান। এদিকে ওর সাথে কথা বলার জন্যই যে এমন ছটফট করছে, সেটা বুঝতে বাকি নেই সৃজার। তবে এত সহজে তো হবে না। ছোট্ট একটা বিষয়ে সিনক্রিয়েট করে এতদিন যোগাযোগ বন্ধ রেখে সৃজাকে যেমন ছটফট করিয়েছে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, সৃজাও তেমনি করবে। বুঝাবে কাছের মানুষ এড়িয়ে গেলে, কষ্ট দিলে কেমন লাগে! সৃজা সটান উঠে দাঁড়াল। ড্রয়ার খুঁজে একটা মলম এনে পায়ের পাতায় দু’মিনিটে মালিশ করে, বালিশে শুইয়ে দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলল, “চুপচাপ ঘুমাও। আর কোনো কথা নয়।”

আলো-আঁধারিতেই ইহসান ব্যাকুল হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুই কাছে বসবি না?”

“আমার পড়া আছে।”

বলে বইপত্র নিয়ে নিয়ে সোফায় চলে গেল। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে চতুর ইহসানকে দেখতে ভুলল না। এখনো ঘুমায়নি, না ঘুমিয়ে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে চাদরে অর্ধেক মুখ ঢেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে অন্ধকারে কোনো শেয়াল তাকিয়ে আছে। সৃজার ভীষণ হাসি পেল। বেশ হয়েছে! নাস্তানাবুদ হোক, বুজুক মজা। এরপর অনেকটা ক্ষণ পেরিয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে টিকটিক করছে। অ্যাসাইনমেন্ট গুছাতে মগ্ন সৃজা হঠাৎই চমকে গেল ইহসানের কণ্ঠস্বর শুনে। ও তড়িঘড়ি করে উঠে শিয়রে গিয়ে বসল। তাকিয়ে দেখল গভীর ঘুমে মগ্ন ইহসান, কিন্তু ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। বোধগম্য হচ্ছে না বিধায় সৃজা কান পাতলো। শুনলো ঘুমের ঘোরেই ইহসান বলছে, “ঠিক করে কথা বলিস না আমার সাথে? মে’রে ফেলব তোকে সৃজা, মে’রে এরপর আমার বুকে ঢুকিয়ে ফেলব। নতুন কাউকে পেয়েছিস মনে হয় আমি না থাকায়? না না। তেমন তুই করবি না। আমি লুজার না। সন্দেহ করি না তোকে। তুই আমার বুকে চাকু চালিয়ে দে, আমি তাতে খুশি হব। শুধু…আগের মতো হয়ে যা!”

সৃজার মনে হলো ও দমবন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। বহুকষ্টে নিজের হাসি আটকালো ও। মুখ নামিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিয়ে উল্টাপাল্টা বলা আটকাল। ঔষধের প্রভাব থাকায় সহজেই ঘুম ভাঙল না ইহসানের। সৃজা সাবধানে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে সেখানেও একটা চুমু খেল, “এমিলি ইয়াসমিনের এই ছেলেটাও পাগল দেখছি!”

_______

[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে….

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪০

সৃজার মনে হলো ও দমবন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। বহুকষ্টে
নিজের হাসি আটকালো ও। মুখ নামিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিয়ে উল্টাপাল্টা বলা আটকাল। ঔষধের প্রভাব থাকায় সহজেই ঘুম ভাঙল না ইহসানের। সৃজা সাবধানে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে সেখানেও একটা চুমু খেল, “এমিলি ইয়াসমিনের এই ছেলেটা
পাগল দেখছি!”
.

অগোচরে ইহসানের উপর থেকে রাগ কমালেও
সৃজা ওর সাথে শীতল সম্পর্কটা বজায় রাখলো প্রায় মাসখানিকের মতো। এই দিনগুলোতে সৃজা ওর অনুমতি সহিত সব করতে লাগল। ঘর গোছানো, ধোয়া-মোছা, বইপত্র ধরা, জামাকাপড় ধরা, আলমারি গোছানো এমনকি বারান্দায় পর্যন্ত ইহসানের অনুমতি নিয়ে যেতে লাগল। বাড়িতে না থাকলে ফোন করে অনুমতি চাইতো। কী
বাজার হবে, কী রান্না হবে এসবেও ছাড় দিলো না সৃজা, সেসবেও ইহসানের অনুমতি নিতো।

ইহসান ওর এই আচরণে প্রচন্ড তিতি বিরক্ত হয়ে গেল ভেতরে ভেতরে। অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে গেল। সে রাগের বশে কী এমন বলেছে, তাতে এই মেয়ে এমন করছে! রাগে ওর হাত-পা, মুখ লাল হয়ে যেতো। সৃজা দেখেও না দেখার ভান করতো। কেন দেখবে সে? কেন? ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইহসান যা করেছে, বলেছে সৃজা কস্মিনকালেও আশা করেনি তা। ও সবসময় চেয়েছে সবকিছু খোলা বইয়ের মতো, পরিষ্কার! সেখানে কারোর পার্সোনাল স্পেস থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা শান্তভাবে না বুঝিয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মতো কদর্য কাজ করবে কেন? তাছাড়া ওর অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে একেকটা দিন সৃজা কীভাবে কাটিয়েছে, কী কী অপমান, অপবাদ আর লাঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ওকে জানে কী এই লোক? বিয়ের এই এতগুলো মাসেও যেখানে আজিজ শেখ ওকে কখনো সামনা-সামনি কিছু বলার সাহস করেনি, সেই লোক ওর অসুস্থ বাবা, মৃত মা’কে তুলে পর্যন্ত কথা বলেছে। আর্থিক অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করেছে, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, লোভী বলেছে ওকে।জানে কী ইহসান? কতটুকু দুর্বিষহ যন্ত্রণায় সৃজা কাটিয়েছে গত হয়ে যাওয়া দিনগুলো? না, জানে না। তাই এটুকু শাস্তি ওর প্রাপ্য!

.

ইদানীং ইস্মির ঘুম প্রকট হয়েছে। যখন তখন মেয়েটার ঘুম পায়, দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে চায়। সন্ধ্যার একটু পরপরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। রাতে আর খায় না। জোর করে খেতে গেলে বমি হয়ে যায়। ইজহান এ বিষয়টা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে থাকে, তবে বউয়ের কষ্ট বুঝে সে রাগ করতে পারে না। আজও অফিস থেকে ফিরে দেখল তার বউ ঘুমাচ্ছে। ইজহান কিছুক্ষণ অভিমান নিয়ে বসে থেকে এরপর জামাকাপড় ছেড়েছে। সময় নিয়ে গোসল সেরেছে। পেটে ক্ষিধে থাকায় মকবুলকে ডাকিয়ে খাবারদাবার এনে নিজের হাতে মেখেই ভাত খেয়েছে।
দু’বার গলায় ভাতও আটকেছে। খুকখুক করে কেশেছে, এরপর নিজেই পানি নিয়ে খেয়েছে!
তবুও ঘুমন্ত ইস্মিতাকে সে ডাকেনি। খেয়ে দেয়ে ইস্মিতা রাতের ঔষধ খেয়েছে কি-না সেটা চেক করেছে, বারান্দার শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করে ড্রয়ারে তুলে রেখেছে। এরপর মিজুকে ফোন করে কতক্ষণ বকাঝকা করেছে ভার মনটাকে সতেজ করার জন্য! ওদিকে বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে থাকা মিজু ফোনের ওপাশে চুপচাপ স্যারের বকাঝকা গিলেছে। সে জানে, তার স্যারের মাথায় গন্ডগোল আছে! মিজুকে সাইজ করে মনের ভার একটু কমে যেতেই ইজহান বিছানায় ইস্মির পাশে এসে শুয়েছে। ওকে কাছে না টেনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ওকে জড়িয়ে শুয়েছে। রুক্ষ হাত বাড়িয়ে চুলে বিলি কেটেছে, একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখেছে আগের চেয়েও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠা ইস্মিতাকে। কিন্তু যখনই উঁচু হয়ে থাকা ফর্সা উদরে চোখ গেল, তখনই গলা শুকিয়ে অস্থির হয়ে গেল ভেতরটা! বারবার চোখ সেদিকেই চলে যেতে লাগল ইজহানের। চেয়েও নজরলে শাসন করতে পারল না সে! ইচ্ছে করল ঐ সুন্দর পেটে আগের মতো মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে, মুখ ডুবিয়ে চুমু খেতে। কিন্তু একটা কারণেই সে তা করতে পারছে না। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা তার শূন্য, একবার যদি আদর শুরু করলে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে ইজহান। তাতে বাচ্চার কম, ইস্মিতারই যদি কিছু হয়ে যায়? মূলত এই ভয়েই ইজহান নিজের অনুভূতিকে চেপে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু এই মাঝরাতে, বউ বুকে নিয়ে তার সুধাময়ী রুপের নেশা কাটানো যে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে না পোড়ার বাহানা করা, তা উপলব্ধি হতেই পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে ইজহান ইস্মিতাকে ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে।

তার কাছে ইস্মিতা পুরোই একটা আদর, ভালোবাসা। অনেক মান-অভিমানের পর মেয়েরুপে একটা মা পাবার লোভে বাচ্চাটা রাখতে কোনো ঝামেলা করেনি সে! আর তো কয়েকটা মাস! এরমধ্যে কোনো ভুলচুক করে আবারো কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে চায় না সে। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই আবারো পাশ ফিরে ইস্মিতার মুখোমুখি হয়ে শুলো। আস্তেধীরে হাতটা রাখলো ফোলা পেটে। এরপর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল! এরপর এক মুহূর্ত, দুই মুহুর্ত…এমনি করে কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই হঠাৎ কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকল। কিছু একটা নড়নচড়ন অনুভব করল, ধাক্কা দিলো তার হাতে! ইজহান সটান চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছুটা চিন্তিত হয়ে সে ইস্মিকে আলতো করে ডেকে ফিসফিস করে বলল, “ইস্মিতা, খারাপ লাগছে..উঠো তো…তোমার পেটে কি যেন লাফিয়ে উঠল টের পেলাম! উঠো দেখি… ”

বিচলিত কণ্ঠস্বর কানে বাজতেই ঘুম কেটে গেল ইস্মিতার। মুচকি হাসলো ও। ঘুমঘুম স্বরে বলল,
“হুম! আমিও আজ বিকেলেই টের পেলাম।”

“কী?”

“আপনার মা আমার পেটে নৃত্য করছে!”

ইজহানকে বিভ্রান্ত দেখালো। বিভ্রান্ত হয়ে একই বাক্য দ্বিতীয়বার বলল। একবার প্রশ্নবোধক আরেকবার বিস্ময়সূচক! পরপর লাফিয়ে উঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কান ঠেকাল ইস্মির পেটে। তখনি আবার পেটের ভেতর থাকা ছোট্ট মনুষ্য অবয়বটির তেজ টের পেল। একনাগাড়ে অনেকটা সময় সে মা’কে সে ভেতরে বসে আঘাত করতেই থাকলো। ইজহান হতবিহ্বল হয়ে কম্পিত স্বরে ওভাবেই ইস্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ব্যথা পাচ্ছ?”

ইস্মি এতক্ষণ চুপচাপ উপভোগ করছিল ব্যাপারটা। এবারে ওর হাসি পেল। ইজহানের চুল শক্ত করে টেনে ধরে বলল, “আমার আনন্দ হচ্ছে।”

“এটা তো মনে হচ্ছে ছেলে—এতজোরে কে কিক করে? মেয়েমানুষ হয় ভদ্র সভ্য, এরা এতজোরে কিক করবে না।”

ইস্মি হাসি চেপে বলল, “কেন আপনার কী হিংসা হচ্ছে আমি আব্বা বলে ডাকব কাউকে, তাই?”

ইজহান কথাটা এড়িয়ে গেল। মুখে আঁধার নেমে এলো ওর, “আমি মেয়ে চেয়েছিলাম ইস্মিতা!”

“ছেলে হলে কী কোলে নেবেন না?”

ইজহান রোষাগ্নি চোখে তাকাল, “না, আমি শুধু মেয়েকে নেব!”

“তাহলে মেয়ে হলে আমিও তাকে কোলে নেব না।”

ইজহাম রাগী গলায় বলল, “কেন তুমি আমার মাকে কোলে নেবে না? ও তো তোমার ভেতর থেকেই বেরুবে!”

“কেন আপনি আমার ছেলেকে কোলে নেবেন না? ও তো আমার পেট থেকেই বেরুবে!”

ইস্মি বাঁকা গলায় বলল। যুক্তিতে না পেরে এ পর্যায়ে ইজহান চুপ করে গেল। পেটে যেভাবে কিক কিক খেলা করছে এতে আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়াই সে নিশ্চিত, এটা তার মতোই কোনো ছেলে শিশু। কিন্তু সে তো তার মতো কোনো ছেলে চায় না! মায়ের মতো, ইস্মিতার মতো রসগোল্লা দেখতে মেয়ে চায়! ইজহানের মন খারাপ হয়ে গেল, আবার ইস্মির পেটে কান পেতে ওটাকে অনুভব করতেও ইচ্ছে করল! লোভ সংবরণ করতে না পেরে অবশেষে কান পাতলো ঠিকই, কিন্তু ভেতর থেকে আর কেউ কিক করল না। ইজহান কিছুটা অবাক ও বিরক্তি নিয়ে বলল, “ওটা তো আর নড়ছে না।”

ইস্মি শক্ত মুখে বলল, “আপনার কথা শুনে ওর মন খারাপ হয়েছে, তাই নড়চড় বন্ধ!”

ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তিত হয়ে গেল। সে
কী এমন বলেছে যে ঐ পুঁচকা নড়চড় বন্ধ করে দিয়েছে? এ তো মহা জ্বালা! সে নিজেও তো ইস্মিকে এত জ্বালায় না। পুঁচকাটা কী নিজের বাপকে ট্যাকেল দেওয়ার চেষ্টা করছে নাকি? নাহ! এটাকেও ছোট থেকেই হাতে-কলমে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে সামলে রাখতে হবে, ইজহান কিছুতেই ইস্মিকে এই পুঁচকার সঙ্গে ভাগ করবে না, তবে মেয়ে হলে অন্য কথা! ইজহান কর্কশ কণ্ঠে বলল, “ছেলে এত খারাপ কেন?”

“ওর বাপ খারাপ তাই।”

“আমি খারাপ?”

“আপনি ভালো?”

প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন শুনে ইজহান রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “তুমি কিন্তু খোঁচাচ্ছ আমাকে ইস্মিতা! অথচ সেদিনই বললে আমাকে কখনো খারাপ বলবে না, কারণ আমি খারাপই না। খারাপ হলে তোমার মতো ভালো মেয়ে কপালে জুটতো না।”

ইস্মি সিরিয়াস মুখে বলল, “আমার কোনো দোষ নেই, আমি এগুলো বলছি না। আপনার মেয়ে আমার মুখ দিয়ে বলাচ্ছে।”

“এক্ষুনি বললে ছেলে…”

“মেয়েও হতে পারে। আমি তো জানি না।”

ইস্মি সচেতন গলায় বলল। শুনে ইজহান ভাবুক চিত্তে মুখ ফসকে বলে ফেলল, “যদি দুটোই হয়, মিলেমিশে?”

“তাহলে ভালোই হয়। এদের আপনার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে আমি একটু আরাম করতে পারব। এমনিতে আপনি আমাকে যা জ্বালান, তখন আমার দল ভারী হবে। আমি শোধ নিতে পারব আপনার উপর। দুই পুঁচকা-পুঁচকি মিলে শায়েস্তা করবে আপনাকে।”

সূঁচালো সূঁচালো কথা উপহার দিলো ইস্মি ইজহানকে। এরপর মিটিমিটি হাসতে লাগল। ইজহান অন্ধকার মুখ করে ক্ষেপে গিয়ে বলল, “দল পাকানো হচ্ছে! আর আমাকে হাতকড়া পরানোর ধান্ধা! তুমি অনেক নিষ্ঠুর হয়ে গেছ ইস্মিতা! আমাকে আগের মতো ভালো… ”

কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে দিলো না ইস্মি। কারণ জানে, ইজহান কী অভিযোগ করতে পারে! তাই সে সুযোগ না দিয়ে চট করে দু’হাত বাড়িয়ে গলা আঁকড়ে ধরল ইজহানের। চোখে চোখ রেখে বলল, “কাছে আসুন, আদর করে দিই।”

ইজহান বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে?”

“আপনার মেয়ে দেখছে ভেবে থেমে যাবেন!”

ইস্মি আলতো হাসি বিনিময় করে ঠোঁট বসাল ইজহানের বা-গালে, চোখের পাতায়। নরম স্পর্শে ইজহানের রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। চোখে ঘোর লেগে এলো। ধৈর্যচ্যুতি ঘটতেই সে তড়াক করে মুখ নামিয়ে আনলো ইস্মির গ্রীবাদেশে, হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা উদরে। ওখানে আগ্রাসী চুমু খেতে খেতে অস্ফুটস্বরে বলল, “ঐ পুঁচকাটাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে, নড়ছে না কেন ওটা..”

“আবার ভুল করছেন, পুঁচকিও হতে পারে…”

“যেটাই হোক, নড়বে না কেন ও, চুপচাপ বসে থাকতে তোমার পেটে এসেছে নাকি…”

ইস্মি গভীর চোখে তাকিয়ে রইল ভোল পাল্টানো পাগলের দিকে, সেভাবেই তার আদর অনুভব করতে লাগল!

.

বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছে৷ ঠান্ডা বাতাস আসছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে ইহসান। সামনে চার পদের তরকারি সাজিয়ে ভাত খেতে বসা ইহসান চোরাচোখে বারবার সৃজাকে দেখছে আর চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি লুকাচ্ছে!
ওর ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালদুটো টেনে ধরে শক্ত এক চুমু বসাতে, আগের মতো খুনসুটিতে মেতে উঠতে। কিন্তু সৃজার শীতল ব্যবহারে সহজ হতে পারছে না কেন যেন! ওকে এভাবে দোনা মনা
করতে দেখে সৃজা চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
“ভাত দেব আর?”

“একটু।”

মলিন গলায় বলল ইহসান। কণ্ঠের স্থবিরতা সৃজার বোধগম্য হলো তবে প্রতিক্রিয়াহীনই রইল। থালায় খাবার তুলতে লাগল। ভাত, ডাল, লেবু, ভুনা মাংসের তরকারি দিলো। দিতে গিয়ে কিছুটা ফেলেও দিলো ওর শার্টে। দাগ বসে গেল মাংসের ঝোলের। গামছা ভিজিয়ে এনে সঙ্গে সঙ্গেই মুছে দিলো কিন্তু তাতে দাগটা আরো ছড়ে গেল। তা দেখে সৃজা বিনীত গলায় ইহসানকে বলল, “সরি, আমার খেয়াল করে দেওয়া উচিৎ ছিল।”

সৃজাকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল৷ ইহসান এতক্ষণের অস্বস্তিকর পরিবেশটা ঠিক করার সুযোগ পেয়ে গেল৷ গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, “তোর খেয়াল সবসময়ই কী অন্য কোথাও থাকে? সামান্য তরকারিও দিতে শিখিসনি!”

“আমি সব ভালোভাবে শিখে নেব।”

কথাটা আদতে স্বাভাবিক শোনালেও সৃজার কণ্ঠে অদ্ভুত কিছু একটা ছিল যাতে ইহসান ওর কণ্ঠস্বর শুনে অসহায় নজরে তাকাল। আর কতদিন এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ওকে? আগের সৃজাকে সে কীভাবে পাবে? যে খুনসুটি আর অবান্তর, মিষ্টি ঝগড়া-অভিমানে বারবার নিজের প্রেমে ফেলতো? ইহসান শাণ ধরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোনোমতে থালার খাবারটুকু শেষ করলো। সৃজা
এরপর চুপচাপ সব ধুয়েমুছে, গোছগাছ করে রাখতে নিচে চলে গেল। ইহসান বারান্দার খোলা হাওয়ায় গিয়ে বসলো। রশিদকে একটা ফোন দিয়ে আগামী দিনের স্ক্যাজিউল ঠিক করে রাখলো। সেইসাথে ইনজানের ফ্ল্যাটে খাবার আর ঔষধ দিয়ে আসার নির্দেশ দিতেও ভুলল না। রশিদের এতকথা মনে থাকে না, তাই সে সব নোট করে রাখলো। ইহসান কাজের কথা সেরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর রশিদকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যখন ফ্ল্যাটে ছিলাম তখন সৃজা তোমাকে দিনে কতবার ফোন করে আমার খোঁজ চেয়েছে?”

মাসখানিক আগের কথা, স্যার এসব জিজ্ঞেস করছে কেন? রশিদ একটু মনে করার চেষ্টা করে এরপর বলল, “ডেইলি আট-দশবার করে ফোন করে আপনার খোঁজ চাইতো। চারদিন তো রেস্তোরাঁতেও আইসা গেসিল।”

“তখন কী কান্নাকাটি করেছিল?”

“কান্নাকাটি করতো, কিন্তু আমাদের সামনে না। বাড়ি থেকেই কান্নাকাটি শেষ করে চোখমুখ ফুলিয়ে আসতো। অসহায় ভাব থাকতো চেহারায়।”

“ওকে, ফোন রাখো।”

নিচ থেকে ফিরে সৃজা ঘরে পা রাখতেই একটান খেল হাতে। কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করল ও ইহসানের বুকে। পরক্ষণেই পিঠ ঠেকল দরজায়। সিঁটকিনি আটকাতে আটকাতে ইহসান সৃজার গালে ঠোঁট বসিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল, “সেদিন থাপ্পড় মেরেছিলাম, লেগেছিল তোর?”

মাস পেরিয়ে গেছে, এতদিনে এসে এসব কথা তুলছে ইহসান? আশ্চার্যান্বিত হলেও বুঝতে না দিয়ে সৃজা বলল, “না লাগেনি।”

“সত্যি?”

“হুম।”

“রাগ করে আছিস?”

সৃজা সহজ গলায় জবাব দিলো, “এটা তো আমারই তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল, তুমি কী রেগে আছ আমার উপর?”

“তোর উপর রাগব আমি?”

সৃজা মলিন হাসলো, “সেদিন তো এমনি বেরিয়ে যাওনি, গেছো আমারই জন্য! তবে বলা হয়নি যেটা, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিইনি। ওটা আমি পেয়েছিলাম সোফার নিচে ঝাঁট দিতে গিয়ে। বাতিল ভেবে ফেলেই দিচ্ছিলাম, পরে ভাবলাম তোমার দরকারি কোনো ছবি…তাই একটু অতি আগ্রহী হয়ে গেছিলাম। সরি আমি আবারো…”

“এতবার সরি বলতে হবে না।”

বলে ওকে বুকে টেনে শুয়ে পড়ল ইহসান। চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে অস্ফুটস্বরে বলল, “তোকে ছাড়া এতগুলো দিন কীভাবে কাটিয়েছি জানিস?”

সৃজা নিরুত্তর রইল। জানার আগ্রহ দেখাল না নিজে থেকে। অভিমান কমেনি এখনো ওর। ইহসান উত্তর না পেয়ে নিজেই মুখ গোঁজ করে বলল, “খুব, খুব খারাপ কেটেছে।”

সৃজা ইতোমধ্যেই সরে অন্যপাশে যাওয়ার জন্য ছোটার চেষ্টা করল। কিন্তু ইহসান দিলো না। দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, “আজ দূরে সরিস না প্লিজ। একটু আমার বুকে ঘুমা। অবশ্য আজ লাফালেও কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না তোর। এভাবেই ধরে রাখব।”

শীতলতা কাটেনি সৃজার, কিছু বলেওনি। তবুও ইহসান কিছুটা জোর খাটিয়েই ওর কপালে চুমু খেল সময় নিয়ে। এরপর বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। এতদিন সে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমাবে সে শান্তিতে, প্রশান্তিতে। শেষরাতে সৃজা ঘুমন্ত ইহসানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, “তোমার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনে এক নতুন আলো এসেছে—একটা ছোট্ট খুশি, যে আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ সেই খুশির খবর থেকে আমি তোমাকে বঞ্চিত করেছি, করছি। খবরটা আমি তোমাকে জানাইনি, এত সহজে জানাবও না। কারণ আমি প্র’তিশোধ নিতে শিখে গেছি। কারণ তুমি আমাকে যে কষ্টটা দিয়েছ, সেই ব্যথা এখনও সারেনি!”

______

[রি-চেইক করিনি। দেরিতে দেওয়ার জন্য দুঃখিত।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪১

প্রথমদিকে কোনো লক্ষণ টের না পেলেও ইদানীং সৃজা লক্ষ্য করেছে, সে ইহসান ছাড়া অন্য কারও গায়ের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারছে না। কোনো পারফিউমেরও নয়। এর মধ্যে ঘুমেও সমস্যা হচ্ছে, ছোটখাটো বিষয়ে রাগ জন্মাচ্ছে, কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, বহুবছর আগে কে, কী বলেছিল, ঠাট্টা করেছিল, আঘাত করে কথা বলেছিল—সে সমস্ত কথা স্মৃতিতে জেগে উঠছে আর তাদের প্রতি ভয়ানক রাগ জন্মাচ্ছে। মুড সুইংয়ের এ যন্ত্রণা ওকে বড্ড ভোগাচ্ছে! ইস্মি বলেছে, এগুলোও প্রেগন্যান্সির লক্ষণ, একটু অন্য ধাঁচের, তবে খুব স্বাভাবিক।

সৃজার গর্ভধারণের খবরটা এ বাড়িতে ইস্মি বাদে সালেহা বেগম জানেন। এলিজা, নীলু ফুপিও জানে। মা হওয়ার মতো নিদারুণ সুখের খবরটা সৃজা পেয়েছিল অসময়ে, অদ্ভুতভাবে। ইহসান যখন রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ঠিক সেই সময়টাতে! নিখোঁজ ইহসান কোথায় আছে, রশিদ জানে কি-না কিছু—এটুকু তথ্য জানার জন্য বেশ কয়েকবার রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়েছিল সৃজার। তেমনি একদিন রিকশা করে ফেরার সময় পেছন থেকে আরেকটি রিকশার ধাক্কায় সৃজা পড়ে গিয়ে পা মচকে বেশ ব্যথা পেয়েছিল। উঠেই দাঁড়াতে পারছিল না। হাতেও চোট পেয়েছিল বেশ! এদিকে দুই রিকশাওয়ালা তখন একে অপরের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ায় কারও নজর ছিল না আহত সৃজার দিকে। রাস্তায় অতি উৎসাহী কিছু মানুষ তাদের ঝগড়া উপভোগ করতে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ সাহায্য করতে আসেনি সৃজাকে। তবে অনেক পরে ভিড় ঠেলে একজন মাঝবয়সী মহিলা এসে সৃজাকে উঠতে সাহায্য করে আর ওর চোট দেখে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নিয়ে গেল। সৃজা যদিও না করছিল, তবুও মহিলা শোনেননি। অনেকটা জোর করেই নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর পা কিছুটা ঠিক হলেও ডাক্তার ওর নরমাল চেকআপ করার পর কিছু প্রশ্ন করে, কী মনে করে ওকে একটি প্রেগন্যান্সি টেস্ট দিয়েছিলেন। ফলাফল পজিটিভ!

অপ্রত্যাশিত এ খবরটা পাবার পর সৃজা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তার মধ্যে কেউ আছে, সে মা হতে চলেছে! কারণ—শরীরে প্রেগন্যান্সির কোনো লক্ষণ বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক অনুভূতি, বমি-দুর্বলতা এসব কোনো লক্ষণই ওর নেই। তাহলে? কী করে ফলাফল পজিটিভ আসতে পারে? ইসমির বেলায় তো সে দেখেছে, মেয়েটা কীভাবে নাজুক হয়ে পড়েছিল! সৃজা ডাক্তারকে বলেও ছিল সেসব কথা। ওকে বিশ্বাস করাতে, সন্দেহ দূর করাতে ডাক্তার ওকে দ্বিতীয়বার টেস্ট করান, এবং সেবারও একই ফলাফল আসে। যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে সৃজাও একসময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় সত্যিটা! কী আশ্চর্য! পায়ের সমস্যা নিয়ে সে ডাক্তারের কাছে এসে কী-না জানতে পারল সে মা হতে চলেছে, এটা কোনো কথা? ইহসানের খোঁজ না পাওয়া দুঃখের সময়টাতেও তখন এক পৃথিবী আনন্দ ঘিরে ধরেছিল ওকে। তাই পরপর কয়েক দিন হন্যে হয়ে ইহসানকে খুঁজেছিল বাবা হওয়ার খবরটা জানানোর জন্য। কিন্তু ইহসান নিজেই সব পথ এমনভাবে বন্ধ করে সৃজাকে অসহায় করে তুলেছিল যে একপর্যায়ে কষ্টের অনুভূতিতে ঝাঁঝরা হয়ে সৃজা ঠিক করেছিল, বাবা হওয়ার খবর সেই নিষ্ঠুর লোককে সে দেবে না, কিছুতেই না! নিজ
মুখে সৃজা কখনোই বলবে না সন্তান আসার সুখবরটা!
এর জন্য ইহসান যদি রাগ করে বাড়ি না ফিরে, না ফিরুক! অনেক হয়েছে, আর নয়!

ইহসান ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ হলো! সৃজার ঘুম আসছে না, সাফোকেটিং লাগছে। সে ঘুমন্ত ইহসানের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে অভিমান প্রকাশ করল মনে মনে, বকলও খুব! এরপর সন্তর্পণে ওর বাহুডোর থেকে অতি সাবধানে বেরিয়ে বারান্দায় দরজা খুলে মোড়ায় এসে বসল। বাইরে তখন মাঝরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশ নীরব-নিঃস্তব্ধ! হাওয়ায় দোদুল্যমান টবের গাছগুলো। শীতল বাতাস গায়ে লাগতেই আরামে সৃজার চোখদুটো বুজে এলো। ও রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বসে স্বস্তির শ্বাস ফেলে দূরে দৃষ্টি দিলো। আজকাল অন্ধকারে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে জ্বলজ্বল নক্ষত্র দেখতে ওর ভালো লাগে। সোডিয়াম আলোতে পুকুরে মাছের লাফালাফি দেখতে ভালো লাগে। নির্জনতা ভালো লাগে। আর ভালো লাগে ইহসানকে উচিত শাস্তি দিতে…হুহ! কয়েক দিন পর যখন সৃজার পেটটা একটু উঁচু হবে, মা হওয়ার ভাব ফুটে উঠবে ওর মধ্যে, তখন বুঝুক আর আফসোস করুক। এটাই এই লোকের যোগ্য শাস্তি! ভাবা যায়, ইহসান যখন ওর গায়ে হাত তুলেছিল, তখন বাচ্চাটা ওর পেটেই ছিল! কী ভয়ানক! নাহ! ও কিছুতেই জানাবে না, ‘তুমি বাবা হতে চলেছ।’ সৃজা অশ্রুসিক্ত চোখে রাগ-অভিমান গিলে ঘরের ভেতর তাকায়। বিছানায় উলঙ্গ হয়ে ঘুমিয়ে থাকা পুরুষকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলল, ‘অনুশোচনা, অপরাধবোধ লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়, প্রকাশ করার জিনিস। একবারও মুখ খুললে না, মায়ের কথা তুলতে ভয় হয়, তাই না? আমাকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য একবারও ভুল প্রকাশ করলে না, বড্ড খারাপ হয়ে গেছ তুমি, ইহসান শেখ।’

°

নাইমুর সাহেবের শরীর খারাপ, মারাত্মক খারাপ। খিঁচুনি হচ্ছে সকাল থেকে। প্রেশারটাও ঠিকঠাক না। ওষুধেও কাজ করছে না। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে, বুঝতে পারছে না কেউই। এলিজার থেকে খবরটুকু শুনে সৃজা ভড়কে গেল খুব। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। হাত-পা অসাড় হয়ে গেল। কিছু জিজ্ঞেস না করেই ফোন কেটে দিলো। কী হলো আব্বুর? কেন আবার অসুস্থ হলো? গতকালই না ভিডিয়ো কলে দেখল মানুষটা ভালো। হুইলচেয়ারে বারান্দায় বসে আছে। একটু একটু হাসলো ওকে দেখে! সেদিনও না আসার সময় আব্বু চেষ্টা করল ওর মাথায় হাত রাখতে! কী হলো হঠাৎ করে আবার? বিছানায় পড়া এই মানুষটা ছাড়া আপন কেউ নেই তো ওদের দু-বোনের! সৃজার সবকিছু আঁধার আঁধার ঠেকল। কান্নায় গলা রোধ হয়ে আসতে চাইল। বিস্তারিত কিছু বলার মতো অবস্থায় রইল না ও, শুধু কম্পিত কণ্ঠে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি চেয়ে বসল ইহসানের থেকে।

ইহসান সবে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিল। সৃজার এই আকস্মিক অনুমতির আবেদন চমকে দিলো ওকে কিছুটা। এক মুহূর্তেই ওর চোখের তাপ বেড়ে গেল, চায়ের কাপটি শব্দ করে টেবিলের উপর রেখে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “আমি মরে গেলে, আমাকে মাটির নিচে দিবি নাকি উপরেই রেখে দিবি, জিজ্ঞেস করবি না? মরে গেলে তো আর অনুমতি নিতে পারবি না। নে, জিজ্ঞেস কর তো দেখি!”

সৃজার বুকে ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো তীব্র যন্ত্রণা
সৃষ্টি হলো। আব্বুর অসুস্থতার খবর, তার উপর ইহসানের অশুভ কথা—কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। তবে প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারল না, মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ওর। তর্ক করার মতো শক্তি হলো না। ভঙ্গুর ও ধরে আসা এলোমেলো কণ্ঠে বলল, “এলিজা ফোন করেছিল, আমার যেতে হবে, এক্ষুনি!”

ইহসান ওর কথা কিছুই বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এক্ষুনি?
কিছু হয়েছে?”

“হ্যাঁ, এক্ষুনি। আব্বুর শরীর খুব খারাপ, ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। কী হয়েছে ওরা বুঝতে পারছে না। হাসপাতালে নিতে হবে…”

এটুকু বলে সৃজা আবেগ সংবরণ করতে পারল না। হঠাৎ কেঁদে উঠল দু’হাতে মুখ ঢেকে। ইহসান তখনো বিস্ময় কাটাতে পারেনি। এবারে ওর কান্না দেখে স্থবির হয়ে গেল। নাইমুর আংকেলের শরীর খারাপ এটা না বলে মেয়েটা ওর থেকে অনুমতি চাইছে যাওয়ার? সে ভুল করে, মুখ ফসকে একটা কথা বলেছিল, তার রেশ ধরে মেয়েটা ওকে এই মুহূর্তে এসেও এভাবে পর কেউ ভাবছে? অনুশোচনায় ওর কপালে রগ ভেসে উঠে, হাত-পায়ের তালু গরম হয়ে ওঠে। নিজের কর্মের কথা মনে করে ভেতরে ক্রোধ জন্মে ওর। কিন্তু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে নিজেকে। ধীরে ধীরে ভেতরের ক্রোধ ঠান্ডা করে ধাতস্থ হয়ে, স্নেহভরা ভঙ্গিতে, ইহসান সৃজার পাশে এসে বসে, ধীরে ধীরে ওকে বুকে টেনে নেয়। অনুশোচনা ভরা ঠান্ডা কণ্ঠে বলে, “কী ভাবতে শুধু করেছিস আমাকে তুই বল তো? আমি খুব খারাপ, নিষ্ঠুর-নির্দয়? তোকে আটকে রাখব ঘরে? এতটা দোষী কবে হয়ে গেলাম তোর চোখে যে, আংকেলের অসুস্থতার খবরটাও জানানোর প্রয়োজন মনে করছিস না?”

সৃজা এর উত্তর দিতে পারে না, ওর কণ্ঠে আর শব্দ নেই। একমাত্র— “আব্বুর কাছে যাব।” তিনটি শব্দ ছাড়া!

নাইমুর সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। খিঁচুনি শুরু হয়েছে, শরীর কাঁপছে। রক্তচাপ একবার ২০০, একবার ৮০—তে উঠানামা করছে। শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে, হাঁপানি রোগের মতো। তাঁর মুখমণ্ডল নিস্তেজ, তীক্ষ্ণ কনুইয়ে ঘামে ভিজে গেছে সাদা বিছানাপত্র। একজন নার্স তড়িঘড়ি করে আইভি লাইন লাগাচ্ছেন, অন্যজন অক্সিজেন মাস্ক ঠিক করছেন। ডাক্তার তার পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে পরিস্থিতি কিছুতেই স্থিতিশীল হচ্ছে না। মাঝে মাঝে কাঁপুনির কারণে শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে নাইমুর সাহেব। মনিটর স্ক্রিনে রক্তচাপের ওঠানামা আরও তীব্র হতে থাকে। ডাক্তাররা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। তারা পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। একে অপরকে দ্রুত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আশা রাখতে পারছেন না। নীলু বেগম করিডোরের বেঞ্চিতে বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। সৃজা-এলিজা নিস্পৃহ আর শূন্য চোখে কাচের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বুকে দেখছে চুপচাপ। অশ্রু শুকিয়ে দু’জনের গালে লেগে আছে। যে ই কেবিন থেকে বেরুচ্ছে তাকেই বারবার আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করছে দুই বোন। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাচ্ছে না ওরা। ইহসানকেই নাইমুর সাহেবের কন্ডিশন সম্পর্কে আপডেট জানানো হচ্ছে, সেই থেকে ও দুশ্চিন্তা এবং উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সে রশিদকে নিয়ে সবদিক সামলাচ্ছে, ও একটুও ফুরসত পাচ্ছে না সৃজাকে বুকে টেনে একটুখানি মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার, সান্ত্বনা দেওয়ার।

বিকেল পর্যন্ত নাইমুর সাহেবের পরিস্থিতি অবজার্ভ করে সন্ধ্যার পর ডাক্তার ইহসানকে জানালো, “পেশেন্টের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব। তবে আশা দিতে পারছি না। আপনারা যেকোনো খবর শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন। বাকিটা আল্লাহর হাতে!”

খুব ক্ষীণ আশাই দিতে পারল ডাক্তার ওকে। ইহসান ডাক্তারের কথার মানে বুঝতে পারল। ভেবে পেল না বাইরে অপেক্ষমাণ তিনটি নারীকে সে কী জবাব দেবে! কথা গোছাতে গোছাতে সে কেবিন থেকে বেরুনোর পর সৃজাকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মেয়েটা ওকে দেখে একটু হেসে ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আব্বু বাঁচবে তো?”

প্রশ্ন শুনে ইহসানের সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল। কী বলবে সে? সত্যি না মিথ্যে? কোনটা বললে ঠিক হবে? মেয়ে দুটো তো অসুস্থ বাবাকে অবলম্বন করেই বেড়ে উঠেছে। ও কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক সায় জানিয়ে সৃজাকে বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনাসূচক বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই কাঁদিস না।”

সৃজা মলিন হাসলো, “কাঁদব না।”

বলে একটু থেমে আবারো বলল,

“আমি তোমার থেকে একটা কথা লুকিয়েছি…এখন শুনবে তুমি?’’

“অনুমতি চাওয়ার খেলাটা এবার বন্ধ কর, দয়া কর আমায়। আমি আর কখনো তোকে এ বিষয়ে কিছু বলব না। প্লিজ, আমি কী করলে মাফ পাব বল তো? পায়ে ধরব তোর? কী করব সৃজা…”

ইহসানের চোখে অনুশোচনা, ব্যথার মিশ্রণ দেখতে পেল সৃজা। ও কিছুক্ষণ সেই ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলল। একটু হাসলো। ভেজা চোখ মুছে নিলো ওড়নায়। একটু থেমে, ইহসানের বুকে মিশে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, “ভেবেছিলাম খবরটা তোমাকে বলব না, কিন্তু আজ, এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বলে দেওয়াটাই ঠিক মনে হলো। আমি কিন্তু এরজন্য ক্ষমাপ্রার্থী নই, শুধু তুমি বাবা হচ্ছ, জানার অধিকার আছে, তাই অধিকারের মান বজায় রাখলাম।”

এমন একটা অসময়ে একথা শুনে, পুরোপুরি আহাম্মক বনে গেল ইহসান। কপালে ভাঁজ পড়ল ওর। ধরে এলো গলা, এলোমেলো হয়ে এলো শব্দগুচ্ছ। তীব্র বিস্ময়ে ও কম্পিত দু’হাতে সৃজার মুখটা আগলে নিয়ে বিচলিত চোখে তাকাল। বিস্মিত, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, “বা বাচ্চা—আমার? আমি বাবা হচ্ছি?”

______

[রি-চেইক বিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৪২

ইহসানের গলা ধরে এলো, এলোমেলো হয়ে এলো
শব্দগুচ্ছ। তীব্র বিস্ময়ে ও কম্পিত দু’হাতে সৃজার মুখটা আগলে নিয়ে বিচলিত চোখে তাকাল। বিস্মিত, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, “বা বাচ্চা—আমার? আমি বাবা হচ্ছি?”

সৃজা মুখ নামিয়ে রাখে। চোখ তুলে তাকায় না। ইহসান
ওকে নিয়ে ফাঁকা করিডোরে চলে আসে। উৎকন্ঠিত, উত্তেজিত অবস্থায় আবারো জিজ্ঞেস করে বাবা হওয়ার খবরটা সত্যি কিনা! সৃজা নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে আসা কান্নাগুলো খুব করে লুকাতে চায়। রাগ, অভিমান করে সে ঠিক করেছিল বাবা হওয়ার সুসংবাদ নিজ মুখে দেবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের কথা থেকে সরে এসে নিজেই বলে দিলো। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে— সৃজার অস্থির লাগছে ভীষণ! অবচেতন মন বলছে, ইহসানের থেকে তাঁর সন্তানদের খবর লুকাচ্ছে বলে, তার থেকে বাবা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছে সৃষ্টিকর্তা! ওর বুকের ভেতরটা ভয়ে জমে আছে আব্বুর জন্য! সেই ভয় থেকেই সৃজা অস্ফুটস্বরে কোনোমতে বলে, “টু-ইন!”

এতক্ষণ জবাব না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে যাওয়া অসহ্য ইহসান থমকায়। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে পরপর সৃজাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়! অস্থিরতার দরুণ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে। বিস্ময়ে কতক্ষণ কথাই বলতে পারে না সে। নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজাকে সে অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, “কবে জানলি?”

সৃজা জবাব দেয় না। ইহসানের রাগ লাগে খুব! অস্থিরতায় ছেয়ে যায় ভেতরটা। রাগান্বিত ভঙ্গিতে উঠে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “বলবি না?”

সৃজা ঠোঁট কামড়ে অস্থিরতা লুকোয়। কপালের ঘাম মুছে ওড়না দিয়ে। ঢোক গিলে সচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “রাগ করে যে ক’দিন বাইরে ছিলে,
তার মধ্যে একদিন।”

“এটা কী আমার শাস্তি ছিল?”

“প্রাপ্য ছিল না?”

সৃজা অশ্রুসিক্ত চোখের কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে কথাটুকু বলে। ইহসান জবাব না দিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সৃজার পেটের দিকে। বোঝা যাচ্ছে না…একটু কি ফোলা? হ্যাঁ, ফোলাই তো! ওখানে তাঁর বাচ্চারা আছে! এটা কী করে ফেলল সৃজা? মেয়েটার এত সাহস, ও একমাস যাবৎ গোপন রেখেছে কথাটা! আর ও কিছু বুঝতেই পারেনি! ইহসানের বুকের ভেতরটা দ্রিমদ্রিম শব্দে কাঁপতে থাকে। সৃজাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে বলে, ‘প্রাপ্য ছিলো। আমি তোকে ভাবনার চেয়েও বেশি আঘাত করেছিলাম। নাহ, তুই ঠিক করেছিস। আমি যোগ্য না এই চমকপ্রদ খবরটা শোনার।’ কিন্তু মুখে বলে, “এত কেন জেদী তুই? আমি কোনমুখে নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব সৃজা?”

মেয়েটা ভেজা গাল মুছে এ পর্যায়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠে, “আব্বু বাঁচবে তো? ডাক্তার কী বলল? আমাকে বলো, আমি তোমায় ক্ষমা করে দেব, আচ্ছা দিলাম মাফ করে। তুমিও আমায় মাফ করে দাও বাচ্চাদের কথাটা গোপন করার জন্য। কিন্তু হ্যাঁ, ওরা যে টুইন, এটা কিন্তু আমি শুধু তোমাকেই বলেছি। বাকিরা জানে না। তুমি রাগ করে থাকলে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবে, তখন যদি আব্বুর কিছু…”

সৃজাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দেয় ইহসান, কপালে চুমু খেয়ে স্থবির কণ্ঠে বলে, “উল্টাপাল্টা বকিস না, কুসংস্কার মাথায় ঢুকেছে তোর! সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তাররা চেষ্টা করছে তো…”

সৃজা অবুঝের মতো জানতে চায়, “সত্যি ঠিক হবে?”

“হুঁ।”

ছোট করে জবাব দিয়ে ইহসান মনে মনে সাহস হারায়। সে মিথ্যে বলছে সৃজাকে, আঙ্কেলের অবস্থা ঠিক নেই, কিছুই ঠিক নেই। কিন্তু সে সত্যিটা বলতে পারছে না। সৃজা সহ্য করতে পারবে না। এমনিতেই কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা করছে! ইহসানের একটু স্পেস দরকার, ফাঁকা জায়গা দরকার, একা সময় কাটানো দরকার! এখনো সবটা হজম হচ্ছে না ওর। ভেতরটা পুড়ছে অসহ্য যন্ত্রণায়! আচ্ছা, সে কী ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেনি সৃজার সাথে? কথা বলে সব মিটমাট না করার কী এটাই শাস্তি? এই বুক পোড়া যন্ত্রণা?

.

মেয়েটা নিজের গর্ভে ধারণ করেছে ইহসানের রক্ত, ওর সন্তান… সে বাবা হতে চলেছে, অথচ! অদৃষ্টের উপর রাগ হলো ভীষণ ইহসানের! শরীরটা ক্রোধে কাঁপছে! উফ, খোদা! সে কাপুরুষের মতো একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে? অথচ সেই মেয়েটা সৃজা! যাকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে! কীভাবে হাত তুলেছিল সে মেয়েটার উপর? কোন কাপুরুষের ভূতে ধরেছিল? বাচ্চাটাও নিশ্চয় অনুভব করেছে, বাবা তার মাকে মেরেছে? ইহসান ওয়াশরুমের দেয়ালে মাথা ঠুকে। ভুলতেই পারছে না সে, চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার সেদিনের রাগারাগির ব্যাপারগুলো! গায়ে হাত তোলা—নয় দিন বাড়ি না থাকা, নিজের একটা খোঁজ না দেওয়া, অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হলেও একবার মুখ ফুটে না বলা, মাফ না চাওয়া! মেয়েটাকে কতটুকু মানসিক চাপ দিয়েছে নিজেকে নিঁখোজ করে! আহ! চরিত্রের এ অধঃপতনে সে কীভাবে গর্বিত পিতা বলে দাবি করবে নিজেকে? কোন মুখে জবাবদিহি চাইবে সৃজার কাছে, ‘এক মাস পর কেন আমাকে আমার বাচ্চার খবর দিলি? এই সাহস তোকে কে দিলো?’ প্রশ্নগুলো করার মুখই তো নেই ওর! একরাশ তিক্ততা ইহসানকে গ্রাস করে, ওর বুক ঝাঁঝরা করতে থাকে একটু একটু করে! ইস্মিতার মা হবে শোনার পর থেকে ইজহানের মতো বর্বরটা যেখানে মেয়েটার গায়ে হাত তুলেনি, সেখানে সে সৃজাকে… আচ্ছা, সে কী ইজহানের থেকেও অধম? ভাইকে লুজার বলে, সে নিজেও কী লুজারের চেয়ে কম কিছু? মনে মনে নিজেকে না চাইতেও তুলনা করে ফেলে ইহসান! নিজের চিরাচরিত ভাবনা, ‘বউ হলো ফুল, যে ঝরে পড়ে গেলেও মাটি থেকে তুলে যত্ন করে বুকপকেটে রাখতে হয়,’ কথাটা একবারও ভাবল না কেন সে? অপরাধবোধে ক্লিষ্ট হয়ে মুঠোবন্দি হাতে পাশের দেয়ালে পরপর কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেয় সে। আঘাতে শরীরের প্রতিটা রোমকূপে বিষাক্ত ব্যথা ছড়িয়ে গেলেও ইহসান টের পায়, গ্লানির ব্যথাটুকু এর কাছে কিছুই না!

বাইরে থেকে রশিদ ডাকছে, অনেকক্ষণ যাবৎ। এখন কারো সঙ্গে কথা বলার মতো ইচ্ছা হচ্ছে না ইহসানের। কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু… পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। ওর কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব, একটা পরিবারের দায়িত্ব! যে পরিবারটাকে ও খুব ভালোবাসে, নিজের পরিবারের থেকেও বেশি! সৃজাটার কান্না, মলিন মুখ সে আর নিতে পারছে না। অথচ সামনে গেলেই দেখতে হবে! চোখেমুখে পানি ছিঁটিয়ে, বুক ভরে শ্বাস টানে সে, তবুও সব দমবন্ধ লাগে! অস্থির মন-মস্তিষ্কে সে বেরিয়ে আসে বাইরে। রশিদ ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে, ইহসান প্রশ্নোক্ত চোখে চাইতেই নিচু স্বরে বলে, “অবস্থা তো ভালো বলে না স্যার, তেমন আশা দিতেছে না…”

“আঙ্কেলকে কী এখান থেকে অন্য কোথাও রেফার করব? খোঁজ নাও তো একটু। আমার মাথায় কিছু আসছে না!”

“কী বলেন স্যার? আর কোথায় নিবেন! এটাই তো শহরের বেস্ট হাসপাতাল! যথেষ্ট অভিজ্ঞ, নামকরা ডাক্তাররা সব চেষ্টা করতেছে… তাছাড়া এখান থেকে অন্য কোথাও নিতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে, এই সময়ে টানা-হেঁচড়া ঠিক হবে না।”

ইহসান কিছু ভাবতে পারে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। বেরিয়ে আসতে গিয়ে কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়ে, ঠান্ডা গলায় রশিদকে বলে, “খবর শুনেছ রশিদ?”

রশিদ একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, কী বলবে স্যার? সে কী ভুল কিছু করেছে কাজে? সবসময় এভাবে ঠান্ডা গলায়ই তো বাঁশগুলো দেয় ওকে। ও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়লেও মুখে হাসি টেনে বলে, “কী খবর স্যার?”

“আমি বাবা হচ্ছি! ভাবতে পারো আমার মতো একটা লুজার বাবা হচ্ছে?”

প্রথম বাক্যটা শুনে রশিদের মুখে হাসি ফুটেছিল, শুভকামনা জানাতেই যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ বাক্যটা ওকে দ্বিধায় ফেলে দিলো। ‘লুজার’ মানে? এটা কী স্যার নিজেকে বলল? সবসময় তো ইজহান স্যারকে গালাগাল করে ‘লুজার’ বলে! আজ হঠাৎ নিজেকে বলল যে, স্যার কী খুশি না বাবা হবে শুনে? আশ্চর্য! রশিদ কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহস পেল না স্যারের রক্তবর্ণ চোখ দেখে, থেমে গেল!

.

হাই ডিপেডেন্সি ইউনিটে রাখা হয়েছে নাইমুর সাহেবকে। কিন্তু উন্নতির লক্ষ্মণ দেখা তো দেয়ই না, উল্টো অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে সময়ের এক একটি কাঁটা। অক্সিজেন স্যাচুরেশন অস্বাভাবিক! রক্তে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নেই। অনেকগুলো টেস্ট দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টগুলো নিয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে ইহসানকে। একবার দশতলায়, একবার তিনতলায় একবার ডিসপেনসারিতে! এরমধ্যে সামনে পেলেই সৃজা বারবার ওর সঙ্গে যাওয়ার জেদ ধরছে! দুশ্চিন্তায় মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ! একটু আগেই বমি করে ভাসিয়েছে, এ অবস্থায় ইহসান পারলে ওকেই
এডমিট করিয়ে দেয়! সেখানে এ অবস্থায় মেয়েটা ছুটোছুটি করার জেদ ধরছে, বিকট একটা ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলো ইহসান। নীলু বেগম এসে বকলোও খুব, প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল সৃজা, এলিজা এসে বোঝাল ওকে! ইহসান সামনে থেকে চলে গেল। এলিভেটরে উঠে খারাপ রিপোর্টগুলোর দিকে তাকিয়ে শুধু দোয়া করল, আঙ্কেল যাতে ঠিক হয়ে যায়, অন্তত তাঁর মেয়েদুটোর জন্য হলেও! কিন্তু তার সেই প্রার্থনা টিকলো না। ফজরের কিছুটা সময় পরে শরীর ও আত্মার লড়াইয়ে আত্মাকে জিতিয়ে দিয়ে নাইমুর সাহেব পরাজয় বরণ করলেন। কার্ডিয়াক মনিটরের স্ক্রিনে থেমে থেমে হার্টবিট তুলতে থাকা ‘বিপ বিপ’ থেমে একনাগাড়ে ‘বিপপপপপপপ’ শব্দ শোনা গেল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন সেখানে শূন্য দেখাল, হার্ট রেট সম্পূর্ণ সমতল দেখাল। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘নেই’ বুঝিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন আরো কিছুক্ষণ পর, এসেই সৃজা-এলিজার দিকে তাকিয়ে গোপন শ্বাস ফেলে ইহসানকেই দুঃসংবাদটা দিলেন, “সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ পেশেন্টকে তাঁর কাছেই নিয়ে গেছেন। উই আর সরি…”

.

নীলু বেগম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে একসময় চিৎকার করে ওঠেন। এলিজা অবিশ্বাস্য চোখে একবার কর্তব্যরত চিকিৎসক দিকে তাকিয়ে এরপর ছুটে গিয়ে ফুপিকে ধরে, ওর বিশ্বাসই হয় না আব্বু আর নেই। দু’দিন আগেই যে লোকটা সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করেছে হঠাৎ করে কেন চলে যাবে সে? সৃষ্টিকর্তা এতটাও নিষ্ঠুর নয়। এলিজার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠে, ও প্রাণপণে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। গলা রোধ হয়ে বেরুতে চাওয়া কান্নাটুকু গিলে নেয়। ফুপিকে বুকে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। পাশের কেবিনে থাকা পেশেন্টের বাড়ির মানুষগুলো বড্ড অমায়িক! গতকাল থেকেই খোঁজখবর রেখেছিল ওদের। সেভাবেই একটু আলাপ হয়েছিল। নাইমুর সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে তারা একপ্রকার ছুটেই এসেছে। মহিলাদের মধ্যে দু’জন এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়, আপা আপা বলে নীলু বেগমকে সান্ত্বনা দেয়, এলিজাকে মৃত্যুর মমার্থ বোঝায়! কিন্তু এলিজার কানে সেসব কিছুই ঢোকে না, বরং শক্ত থাকার চেষ্টা করা মেয়েটা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে। কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইহসানের মেয়েটাকে থাপ্পড় দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “তুই কাঁদলে কী করে হবে এলিজ? তোর বোনকে কে সামলাবে? ও দেখ কাঠ হয়ে আছে! আমার তো এত সাহস হচ্ছে না ওকে সামলানোর!”

করুণ চোখজোড়া সৃজার উপর পড়তেই অস্থির লাগে ওর ভীষণ! অভিমানী মেয়েটা আগের মতোই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে! ওর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিজোড়া কাচের দরজায়, যেটা দিয়ে ভেতরের কার্যক্রম দেখছে। ভেতরে, সিটে শোয়া সাদা চাদরে মুখ ঢেকে দেওয়া লম্বাটে পুরুষটা, সম্পর্কে ওর জন্মদাতা! নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে আছে, চিরজীবনের মতো! সৃজার বুকটা ধক করে উঠে! আব্বু, আব্বু কী অবশেষে চলেই গেল ওদের একা রেখে? একবারও ভাবলো না ওদের কথা? ওরা কীভাবে থাকবে ভাবলো না একবারও? কিছু বলেও গেল না? মায়ের মতো নিষ্ঠুর হয়েই বিদায় নিলো? এসব দেখার জন্যই হাসপাতালে এনেছিল আব্বুকে? অথচ আব্বুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত লড়াই-ই না করেছে ওরা! মা’কে হারিয়ে সেই ছোট্ট বয়সেই সবকিছু বুঝতে শিখেছে, দায়িত্ব নিতে শিখেছে। আবেগ বিসর্জন দিতে শিখেছে। কীভাবে সংসার চালাতে হয় শিখেছে। ওদের বয়সী অন্য সবাই যখন সুন্দর জামা-জুতো, খাবার-দাবার, সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে মেতে থেকেছে তখন তারা দু-বোন বাড়ি ভাড়ার টাকা আব্বুর চিকিৎসা-ওষুধের জন্য, বাজার করার জন্য, স্কুল-কলেজের ফি দেওয়ার জন্য টাকা বাঁচিয়েছে। বছর পার করেছে সস্তার জামা দিয়ে, জুতো ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে বছর পার করেছে। তাতেও কোনোদিন আফসোস করেনি। কারণ—একেবারে তো এতিম হয়ে যায়নি তারা, এখনো তো বাবা বেঁচে আছে। আব্বু বলে ডাকার মতো নিজের কেউ আছে! হোক না সে পঙ্গু, অচল! বাবা তো! মাথার উপর ছায়া তো! ছায়ার নিচে থাকার লোভে তারা দু’বোন তো কোনোদিন একটা চকলেটের আবদারও করেনি আব্বুর কাছে, তাহলে কোন দোষে মানুষটা ওদের এতিম করে দিয়ে হারিয়ে গেল? আব্বুর দয়া হলো না ওদের উপর? সৃজার বড্ড অভিমান হয়, রাগ হয়। মুখ লাল হয়ে উঠে ওর। খরখরে শুকনো চোখ দুটো ভিজে আসে। বুকের ভেতর আগুনের উত্তাপ নিয়ে মেয়েটা মুখ বুজে রয়। ওর বুক ভেঙেচুরে আসে। অথচ গাল চকচক করছে যন্ত্রণা হয়ে ঝরে পড়া এক একটি অশ্রুবিন্দুতে! স্বচ্ছ কাচের দরজাটায় তাকাতে পারে না আর ও, চারদিক ঝাপসা লাগে। বুকের ভেতর সবকিছু খালি ঠেকে, পৃথিবী শূন্য মনে হয়। দাঁড়ানোর মতো শক্তি পায় না দু’পায়ে। ও ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে! কপালটা ঠুকে যায় স্টিলের চেয়ারটার কোণায়। ব্যথা পেয়েই যেন মেয়েটা হু হু করে কেঁদে উঠে!

ওয়ার্ড বয় কথা বলছিল ইহসানের সাথে, কিন্তু ওর মনোযোগ ছিল না সেদিকে। ব্যথিত দৃষ্টি শুধু সৃজার দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। দেখছিল মেয়েটার আমূল পরিবর্তন! এ পর্যায়ে দ্রুত কদমে ছুটে এসে আগলে ধরে ওকে। আর ও ধরতেই সৃজা ফুঁপিয়ে উঠে। অস্পষ্ট কণ্ঠে অভিযোগ তুলে, “আব্বু চলে গেল, কেন গেল? আম্মুও ছোটবেলায় ফেলে গেল! আমাদের তো কেউ নেই! তুমি তো বলেছিলে সব ঠিক আছে, তাহলে কেন গেল? আমার আব্বুকে এনে দাও…”

“হুঁশশ! এভাবে কাঁদে না, একদম না।”

ইহসান ওকে আষ্টেপৃষ্টে বুকে ঢুকিয়ে নেয়, জবাব দেওয়ার মতো ও শব্দ খুঁজে পায় না। কিন্তু হৃদয়ের দখলদারিনীর এ অবস্থা ওর মোটেও সহ্য হচ্ছে না। সব ফাঁকা ঠেকছে। ওকে একটু সামলানো দরকার! সে কোনোদিন কাউকে সান্ত্বনা দেয়নি, অভিজ্ঞতা নেই। কীভাবে সদ্য একজন বাবা হারা মেয়েকে বুঝ দেবে সে জানে না। তবুও বলে, ‘‘আমাদের সবাইকেই তো একদিন যেতে হবে, আগে- পরে, যে-কোনো সময়! মানুষ তো অমর নয়! আমিও একদিন যাব, তুইও যাবি। পরপারে আবার দেখা হবে আঙ্কেলের সাথে। এখন এভাবে কাঁদলে তোর যেমন ক্ষতি, তোর মধ্যে যে আছে তারও ক্ষতি। সেইসাথে আঙ্কেলও কষ্ট পাবে, মানুষটার রুহটাকে এভাবে কষ্ট দিস না সৃজা… আঙ্কেল তো জানে তার মেয়েরা তার জন্য কতটুকু কী করেছে, কত স্ট্রং!”

“কীসের স্ট্রং? হু? আব্বু ভুল জানে। আমি কোনোভাবেই স্ট্রং না, হতে পারবও না। আব্বু কেন আমাকে কিছু বলে গেল না, না বলে চলে গেল? আম্মুও এমন করেছে, কেন করে ওরা এরকম! এত নিষ্ঠুর কেন ওরা…না, আমি হতে পারব না স্ট্রং, তুমি আমার আব্বুকে এনে দাও…”

ক্রন্দনরত সৃজার গলায় তেজ, তবে তেজটুকু ঢাকা পড়েছে করুণ স্বরের নিচে। মেয়েটার চোখমুখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে, আগুনের মতো ঠেকছে ইহসানের হাতের তালুতে৷ ও ডানহাতে সৃজাকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে ওর এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে রুক্ষ স্বরে ছোটখাটো ধমক দেয়, “মার খাবি আমার হাতে? শক্ত মার দেব কিন্তু! থাম, এভাবে কাঁদতে নেই।”

কিন্তু কান্না থামে না সৃজার। বরং আরো বেড়ে যায়। ইহসানের হতাশ লাগে খুব, ও যথাসাধ্য বোঝানোর জন্য, চেষ্টা করে ওর কষ্টটুকু ভাগ করার জন্য! না পারতেই ধমকে থামাতে চায়, আচমকাই সৃজা শরীরের সমস্ত ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে একেবারে চুপ হয়ে যায়। ইহসান উৎকন্ঠা আর ভয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে সৃজাকে। পরপর তুলে গালে হালকা থাপ্পড় বসাতে বসাতে চিৎকার করে উঠে, “না না, চোখ বুজিস না। তাকা আমার দিকে, আমার দিকে তাকা, কিচ্ছু হয়নি। তাকা তুই৷ আমি আছি তো, তাকা বাবু…সিস্টার, ডাক্তার! উফ! কোথায় এরা? এই রশিদ কাউকে ডাকো না…”

ইহসান চেঁচিয়ে উঠে বলতে থাকে। কিন্তু সৃজা তাকায় না, তাকাতে পারে না। সেই শক্তিই নেই মেয়েটার মধ্যে। ও চোখ বুজে ফেলে। নিস্তেজ ভঙ্গিতে দুর্বল হাত ছেড়ে যায় ইহসানের শার্টের আস্তিন। করিডোরে থাকা ডাক্তারটা এখানে নেই, চলে গেছে একটু আগেই। রশিদ এদিকওদিক তাকিয়ে তাঁকে দেখতে পায় না। সে ছুটে যায় কাউকে ডাকতে। ততক্ষণে সৃজাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় ইহসান।

নীলু বেগমের অবস্থা ভালো নয়। ইহসান পাশের কেবিনের মহিলাগুলোকে অনুরোধ করে একটু তাঁদেরকে দেখতে বলে এলিজা, নীলু বেগমকে। ওরা ওকে আশ্বস্ত করে দেখবে বলে। ইহসান একটু স্বস্তি পায়। পাশ্ববর্তী একটি কেবিনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয় সৃজাকে। গতরাতেই কেবিনটা বুক করেছিল সে, এতগুলো মানুষ তো আর করিডোরে বসে থাকতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই এখানে আসেনি, ইহসানও জোর করেনি। খাবার আনিয়েছিল সে, সব বক্সে সেভাবেই পরে আছে। একটা লোকমাও কেউ মুখে তুলেনি, সৃজাকে জোর করে নীলু বেগম দু-লোকমা তুলে দিয়েছিল, বমি করে সেসবও বের করে দিয়েছে। ইহসানের কথাই শুনেনি।

রশিদ একজন মহিলা ডাক্তারকে নিয়ে এসেছে। তিনি সৃজার কন্ডিশন জেনে নিয়ে ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে জানালো, আকস্মিক বাবার মৃত্যু সংবাদ ওর মস্তিষ্ক নিতে পারেনি, যারজন্য এই অবস্থা! স্যালাইন আর সেডেটিভ দিয়ে রাখা হলো সৃজাকে। চিৎকার, কান্নাকাটি করলে বাচ্চাটার ক্ষতি হবে। আপাতত ঘুমে থাকুক। কোনো স্ট্রেস নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় নেই মেয়েটা। এদিকে ইহসানের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, হাসফাঁস লাগছে। এই অবস্থায় এই মেয়েকে এখানে রেখে সে কীভাবে যাবে? কার কাছে রেখে যাবে? নীলু বেগম তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না, একমাত্র ভাইয়ের শোকে তারই হার্ট-অ্যাটাকের অবস্থা! এলিজা পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে! শোকে তাপে একেকজনের নাজেহাল অবস্থা! ইহসান একা একা কীভাবে সামলাবে সবাইকে? ডেডবডি সামলানোর জন্য তার পাশে একটা মানুষও নেই। সব দায়িত্ব তার একার। আংকেলের মৃত্যুটা তার নিজের জন্যও কম ধাক্কার না। মানুষটাকে সে ভালো অবস্থা থেকে চেনে, অমায়িক লোক! হাসি ছাড়া, ‘বাবা’ ডাক ছাড়া কখনো কথাই বলেনি ওর সাথে। প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পরেও মাঝেমাঝে বলতো, ‘তোমার উপর অনেক ঋণ জমেছে আমার বাবা, আমার মেয়ে দুটোকে নিজের বোনের মতো দেখছ, পড়াচ্ছ। তোমার মিস. দেখলে কী বলতো জানো? পাগলটা আমার ছেলেই।’

অথচ আজ তাঁরই মৃত্যুর সাক্ষী হতে হলো! সেইসাথে তার ভঙ্গুর পরিবারটাকে সামলানোর দায়িত্বও ওর ঘাড়েই দিয়ে গেল! ইহসান কিছু বলার মতো জোর খুঁজে পায় না। শব্দ হাতিয়ে রশিদকে সে কোনোমতে বলে, ছাড়পত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে! সে একটু সৃজার পাশে বসবে! রশিদ বেরিয়ে যায়। ইহসান দরজাটা ভিড়িয়ে এসে বসে, একরাশ দুশ্চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে নির্ঘুম রাত্রি কাটানো সৃজার মলিন চেহারাটা এখন বিধস্ত দেখাচ্ছে। গর্ভে বাচ্চা, অথচ একফোঁটা পানিও পড়েনি মেয়েটার পেটে, এ অবস্থায় এতবড় একটা ধাক্কা… ইহসানের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়, বুকে চিনচিন ব্যথা করে!

বাইরে ভোর কাটছে। সূর্যের মিষ্টি আলো দেখা যাচ্ছে। ইহসান চিন্তা করে ভেবে পায় না কী করবে, বাড়িতে কাউকে বলা দরকার! সে কাকে ডাকবে? সালেহা বেগমকে? কিন্তু আজিজ শেখ তো আসতে দেবে না, উল্টো ঝামেলা করে গায়ে হাত তুলবে! ইমরান হাঁদাটাও বৌয়ের চ্যালা, এরা আসবে না। ইজহান লুফারটাকে বলবে ইস্মিতাকে একটু নিয়ে আসতে? কিন্তু মেয়েটাও তো এখন সুস্থ না…আচ্ছা সামলাতে তো পারবে সৃজাকে! পাশে বসে থাকতে পারবে তো! তাতেই চলবে! হন্তদন্ত হয়ে পকেট হাতড়ে ফোন বের করে ইহসান। ডায়াল লিস্ট থেকে খুঁজে বের করে ইজহানের ফোন নাম্বারটি, কল লাগানোর অনেকক্ষণ পর ওপাশ কেউ রিসিভ করে। ঘুম ঘুম রুক্ষ স্বর ভেসে আসে, “কে?”

সৃজার ধরে রাখা হাতটা আলতো করে রেখে, চুলে হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু বসিয়ে ইহসান লাগোয়া বারান্দায় চলে আসে৷ যথাসম্ভব মেজাজ সামলে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়, “তোর শত্রু।”

ইজহান চমকে উঠলেও বুঝতে না দিয়ে বলে, “ও ভেড়া!
তো সকাল সকাল কী?”

“প্রয়োজনে।”

“ফাজলামো হচ্ছে? আমার কাছে তোর আবার কী প্রয়োজন?”

“ইস্মিতাকে।”

____

চলবে…