#Mr_সাইকো_লাভার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“পার্ট ৩৭”
————————–
রাত ২ঃ০৫ মিনিট।
এলোমেলো শাড়ি নিয়ে গুটশুটি হয়ে রুমের এক কর্ণারে নিশা নিশব্দে চোখের জল ফেলছে। সব কিছু যেনো তার কুয়াশার ন্যয় ধোয়াসা লাগছে। প্রথম থেকে সবটা ভাবছে আর কিছু হিসেব মিলানোর চেষ্টা করছে। ফারানের হঠাৎ কি হলো ভেবেই ঘন্টাখানেক আগের কথা মনে করতে থাকে।
★
ফারান চড় মারাতে নিশা গালে হাত দিয়ে ফারানের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো। ফারানের চোখে মুখে রাগ,ক্ষোভ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নিশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আপনি….”
নিশাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফারান নিশার ডান হাত ধরে টেনে উঠালো তারপর নিশার দুই বাহু জোরে চেপে ধরলো। নিশা ব্যথায় যেনো হাত দুটো অবশ অবশ লাগে। ফারান চিল্লিয়ে বলে,”শাট আপ!! আর একটা কথাও বলবি না তুই। নিজেকে কি মনে করিস? রূপ দেখিয়ে আমাকে বশ করে ফেলবি? সিরিয়াসলি…তোর মতো মেয়েদের কখনো এই ফারান চৌধুরী পশ্রয় দেয়নি এন্ড দিবেও না। তোরা শুধু চিনিস টাকা আর রূপ দেখিয়ে ছেলেদের বশ করতে। তোকে আমি বরাবরই ঘৃণা করি এবং সারাজীবন করবো। আই জাস্ট হেট ইউ আমার সামনে আসবি না।”
বলেই নিশাকে ধাক্কা দিয়ে ফারান রুম থেকে হনহন করে চলে গেলো। নিশার কানে শুধু ফারানের কথাগুলোই বারবার রিপিট হচ্ছে। সে যেনো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ফারান নামক মানুষটাকে নিশা সবসময়ই নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস ভরসা করে এসেছে। কিন্তু তার মাঝে নিজের জন্য এতোটা ঘৃণা খুঁজে পাবে নিশা কখনো কল্পনাও করেনি। কি দোষ তার? সে তো কিছুই করেনি যেটায় ফারান কষ্ট পাবে? তার মানে কি ফারান নামে মাত্র বিয়ে করেছে?
ভেবেই নিশা কোণায় বসে কুপিয়ে কাঁদতে থাকে।
বর্তমান,
নিশা- নাহ ফারান এমন করতে পারে না, নিশ্চয়ই এর মাঝে কোনো এক রহস্য লুকিয়ে আছে। এতোদিন ধরে তাকে চিনি কখনো এসব রাগ হিংস্রতা তার মাঝে ফুটে উঠেনি। আর সে সেদিন আমাকে হারানোর ভিয়ে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদেছে ওই দৃশ্য কি করে অবিশ্বাস করি? নাহ আমায় হারলে চলবে না সকল প্রশ্নের উত্তর আমায় খুঁজে বের করতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিশা সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো নিশা। অবাক হয়ে চারদিকে তাকালো। নাহ রুমে ফারানকে দেখতে পায়নি। তাহলে তাকে বিছানায় কে আনলো? যতোদূর মনে আছে আমি ওই কর্ণারে বসে ঘুমিয়ে গেছিলাম তাহলে??
নিশার ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটিয়ে ফারান হাসিমুখে এক কাপ কফি নিয়ে রুমে ঢুকে। নিশাকে উঠে বসতে দেখে ফারান মুচকি হেসে বলে,”গুড মর্নিং বউজান!”
ফারানের কন্ঠে চমকে উঠে মাথা তুলে তাকায় নিশা। চমকের চেয়েও বড় চমক হলো কাল এতোকিছু হওয়ার পরেও ফারান কি করে এমন নরমাল বিহেব করছে? নিশাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারান ভ্রু কুচকে বলে,”কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে কি এই নতুন দেখলা নাকি?”
নিশার ধ্যান ভাঙতেই নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে,”আপনি এখানে?”
ফারান- এমা এটা আবার কেমন কথা আমার রুমে আমার বউয়ের কাছে আমি থাকবো না তো কে থাকবে শুনি?
নিশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো ৬টা বাজেনি। নিশা বলে,”না মানে এতো ভোরে কফি আনলেন কোথা থেকে? আমার জানামতে এখন সবাই ঘুমোচ্ছে।”
ফারান- কেন আমি নিজে বানিয়ে খেতে পারিনা? সারারাত জেগে ছিলাম ম্যাডাম একটু তো রিলেক্স নিতে হয়।
ফারানের চোখে ভালোভাবে তাকালো নাহ কাল রাতের মতো সেই ঘৃণাটা নিশা খুঁজে পাচ্ছে না। রহস কি এসবের আর ফারান সারারাত জেগে ছিলোই বা কেন?
নিশা- জেগে কেন ছিলেন?
ফারান- আপনার জন্য।
নিশা- মানে?(অবাক হয়ে)
ফারান- বারে আমায় রেখেই তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো এটা কি ঠিক বলো? রুমে এসে দেখি আপনি কি সুন্দর ঘুমোচ্ছেন তাও ওই কর্ণারে। আমিই তো বিছানায় নিয়ে আসলাম আর আমার ঘুমন্ত পরিটাকে দেখতে দেখতেই সন্নাসীর মতো রাত পার করেছি। বাই দ্যা ওয়ে এতো দামি বেড থাকতে তুমি ওই কর্ণারে কেন ঘুমালে?
ফারানের কথায় নিশা অবাক না হয়ে পারেনা। গত রাতের ফারান এবং এখনকার ফারানের মধ্যে আকাশ পাতা পার্থক্য। নিশা আবার প্রশ্ন করে বসে,”আপনি কাল রাত কখন এসেছেন?”
ফারান- আই থিংক প্রায় ৩টা বাজে তখন। ছাদে বসে ছিলাম সময় কিভাবে দৌড়ালো নিজেই তো বুঝতে পারছিলাম না। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে কফিটা খেয়ে নাও তো আমি এখন ঘুমাবো।
নিশা- এই না বললেন কফি আপনার জন্য?
ফারান- হ্যাঁ কিন্তু এখন আর পসিবল না মনে হচ্ছে না ঘুমিয়ে থাকতে পারবো না। তুমি খেয়ে নাও নইলে পরিশ্রম সব চাঁদে যাবে।
ফারানের শেষের কথায় নিশা ফিক করে হেসে দেয়। তারপর মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়। নিশা খেতেই ফারান বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরে। নিশা বেডশিট টা পরম যত্নে ফারানের গায়ে জড়িয়ে দেয়। তারপর যেই নিশা উঠে যাবে ওমনি ফারান নিশার হাত ধরে নিশাকে আবার আগের জায়গাতেই বসে পড়লো।
ফারান- মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।(বাচ্চাদের মতো করে বললো)
ফারানের এমন আবদারে নিশা না করতে পারলো না। আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। নিশার নরম হাতের ছোয়ায় ফারান আরামে ঘুমিয়ে পড়ে। নিশা ফারানের চেহারার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আর ভাবছে কাল রাতের কথাগুলো। নিশার মাথায় যতোই দুস্টু বুদ্ধি থাকুক না কেন নিশা পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে জানে। কখন কিরকম করা উচিত এবং কার জন্য করা উচিত সবটাই তার অবগত। এবং সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতি মেয়ে কখনোই আবেগের বসে কোনো কাজ করেনি সবসময় নিজের বিবেককে প্রস্রয় দিয়ে এসেছে। নিশা ঠান্ডা মাথায় ভাবছে। আপাতত সব চিন্তা দূরে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে কিচেনের দিকে গেলো। সেখানে দুজন সার্ভেন্ট অলরেডি রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে। নিশা মুচকি হেসে তাদের দিকে গেলো। সার্ভেন্ট গুলো নিশাকে দেখে চমকিয়ে বলে,
– আরে ভাবি আপনি এখানে এসেছেন কেন?
নিশা- উমমম ভাবছি আজ ব্রেক্সিটের আমি বানাবো তাই।
– এমা না ছি ছি আমরা থাকতে আপনি রান্না করবেন?
– হ্যাঁ সেটাই কর্তা জানলে আমাদের আস্ত রাখবেন না।
নিশা- কিছু হবে না।
– না ভাবি আপনি এবাড়ির নতুন বউ আপনাকে কিছুতেই রান্নাঘরে রাখতে পারিনা।
নিশা কারো কথায় পাত্তা না দিয়ে রান্না শুরু করে দিলো। অতি যত্নে সবার জন্য রান্না করলো তারপর সার্ভেন্ট দের সাহায্য নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজায়। এরমাঝেই ইয়াসা এসে হাজির হয় এবং টেবিলে এতোসব খাবার সাজানো দেখে তার চোখ চড়ক গাছ। বিশেষ করে নিশাকে এতো সকালে উঠতে দেখে অবাক হন।
ইয়াসা- আরে আরে নিশু তুই এসব কি করছিস সার্ভেন্ট সার্ভেন্ট!!
সার্ভেন্ট দুজন ভয়ে দৌড়ে আসে এবং কিছুটা অপরাধী কন্ঠে বলে,”ক্ষমা করবেন ম্যাম আমরা ভাবিকে অনেক বার মানা করেছি কিন্তু ভাবি আমাদের কথা উপেক্ষা করে সবটা করেছেন।”
নিশা- ওরা সত্যি বলছে আম্মু ওরা করতে দিতে চায়নি তবুও আমি জোর করে করেছি ওদের এতে কোনো দোষ নেই।
ইয়াসা- করবা ঠিক আছে কিন্তু তুমি তো এখন নতুন বউ তোমাকে কাজ করা মানায় বলো?
নিশা- সে যাই বলো।
ইয়াসা- আচ্ছা যা উপরে গিয়ে ফারানকে ডেকে নিয়ে আয়।
নিশা- ঠিক আছে যাচ্ছি।
বলেই নিশা উপরে চলে গেলো হঠাৎ একটা রুমের পাশ কেটে যেতেই কিছু পড়ার শব্দ পেলো। নিশা থেমে গিয়ে রুমটার দিকে তাকালো। দরজা কিছুটা ভেজানো দেখে নিশা আস্তে আস্তে ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ভেতরে কি হচ্ছে। দরজায় হাত দিতেই ঠাস করে খুলে গেলো। সামনে পলক দাঁড়িয়ে। দরজা খোলার শব্দে পিছে ফিরে তাকালো। নিশাকে দেখে পলক মুচকি হেসে বলে,”আরে ভাবি আপনি এইসময়ে কিছু কি বলবেন?”
নিশা কি বলবে বুঝতে পারছে না তারপর মাথায় কিছু আসতেই মুচকি হেসে বলে,”আসলে আম্মু নিচে ডাকছে নাস্তার জন্য সেটাই বলতে আসলাম।”
পলক- ওহ আচ্ছা আপনি যান আমি আসছি।
নিশা মাথা নাড়িয়ে যেই আসতে নিবে ওমনি পলকের পায়ের পাশে কিছু জিনিসপত্র পড়ে আছে দেখলো তাও বাচ্চাদের স্টিলের চামচ বাটি।
নিশা- আপনি রুম এমন অগোছালো করে রেখেছেন কেন? সার্ভেন্ট ডাকি আপনার রুম এসে ক্লিন করে দিয়ে যাবে।
বলেই যেই নিশা যাবে ওমনি পলক আমতা আমতা করে বলে,” ননননা ভাবি সমস্যা নেই আপনি যান আমি নিজেই ক্লিন করে নিতে পারবো।”
নিশা- ঠিক আছে তাই যেনো হয়।
বলেই নিশা মুচকি হেসে ফারানের রুমের দিকে চলে আসে। পলকের সামনে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও এখন নিশার মনে একদমই হাসি নেই। ইয়াসার কাছে শুনেছিলো দুনিয়া উল্টালেও পলক কখনো নিজের রুম ক্লিন করেনা তবুও পলক মিথ্যা কথা কেন বললো বুঝতে পারলো না। যতোই হোক নিশা ছেলেদের বিশ্বাসী না ফারানদের বাদে।পলককে বিশ্বাস করতে চাইলেও কেন যেনো পারে না আবার না করেও উপায় নেই।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিশা ফারানকে ডাকতে রুমে আসলো। এসে দেখে ফারান অন্যদিকে মুখ করে শার্ট এর বোতাম লাগাচ্ছে। নিশা মুচকি হেসে পা টিপে টিপে পেছন থেকে ফারানকে “ভাউউ” করে উঠে কিন্তু ফারান কোনো রেস্পন্সই করলো না। সে আগের মতোই শার্টের বোতাম লাগাতে বিজি। নিশা একপ্রকার রেগেই ফারানের কলার ধরে নিজের দিকে ঘুরালো এবং নিশা কিছু বলার আগেই ফারান রেগে জোরে হুংকার দিয়ে বলে,”হাউ ডেয়ার ইউ? তোমার সাহস কি করে হলো আমার কলার এভাবে ধরার একজন রাস্তার মেয়ে হয়ে? বিয়ে হয়েছে বলে মাথায় চড়ে বসেছো তুমি? কতোবার বলবো জাস্ট লিভ মি এলোন স্টুপিড।”
বলেই নিশাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে হনহন করে চলে গেলো। নিশা ছলছল চোখে ফারানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ হঠাৎ কেন ফারান এমন করছে? এইতো কাছে টেনে নিচ্ছে তো আবার দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ফারান আসলে কি চাইছে কি?
————————–
চলবে!!!